১। মানুষ ও পশুতে সাদৃশ্য কেন?
ধর্মাচার্যগণ বলেন যে, যাবতীয় জীবের মধ্যে মানুষ আল্লাহতা’লার সখের সৃষ্টিজীব। পবিত্র মক্কার মাটির দ্বারা বেহেশতের মধ্যে আদমের মূর্তি গঠিত হইয়া বেহেস্তেই তাঁহার থাকিবার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল।
জগতের যাবতীয় জীবের নাকি একই সময় সৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু জগতের বিভিন্ন জীবের দেহ যথা-পশু, পাখী, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি কোন স্থানের মাটির দ্বারা কোথায় বসিয়া কখন সৃষ্টি হইয়াছিল এবং আদমের পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই উহারা এখানে বংশবিস্তার করিয়াছিল কিনা, উহাদের অনেকের সাথে অনেক বিষয়ে মানুষের সৌসাদৃশ্যের কারণ কি এবং আদমের দেহ ও বিভিন্ন জীবের দেহ একই বস্তু দ্বারা সৃষ্টি হইয়াছিল কি?
আদম হইতে আদমী বা মানুষ জাতি উৎপত্তি, এই মতবাদের পর্যালোচনায় উপরোক্ত প্রশ্নগুলি স্বতঃই মনে উদিত হয় এবং আরও যে সকল প্রশ্ন জাগে, তাহার সামান্য আলোচনা করা যাইতেছে।
মানুষের রক্তের প্রধান উপাদান- শ্বেত কণিকা, লোহিত কণিকা, জল ও লবণ জাতীয় কিছু পদার্থ এবং দেহ বিশ্লেষণ করিলে পাওয়া যায়- লৌহ, কার্বন, ফসফরাস ও গন্ধকাদি কতিপয় মৌলিক পদার্থ। অন্যান্য জীবের রক্তের উপাদানও উহাই কেন?
জীবগণ আহার করে তাহাদের দেহের স্বাভাবিক ক্ষয় পূরণের জন্য। ইহাতে দেখা যায় যে, দেহের যে বস্তু ক্ষয় হইতেছে, তাহা পূরণ করিবার জন্যই আহারের প্রয়োজন। জীব জগতে যখন খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বিদ্যমান, তখন উহাদের দেহ গঠনের উপাদানও হইবে বহুল পরিমাণে এক। যেমন- বাঘ মানুষ ভক্ষণ করে, মানুষ মাছ আহার করে, আবার মাছেরা পোকা-মাকড় খাইয়া বাঁচিয়া থাকে ইত্যাদি। ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, উহাদের একের শরীরের ক্ষয়মান পদার্থ অপরের শরীরে বর্তমান আছে। মাতৃহীন ও শিশু যখন গোদুদ্ধ পানে জীবন ধারণ করিতে পারে, তখন গাভী ও প্রসূতির দেহের উপাদান এক নয় কি?
প্লেগ, জলাতঙ্ক ইত্যাদি রোগসমূহ ইতর প্রাণী হইতে মানব দেহে এবং মানবদেহ হইতে ইতর প্রাণীতে সংক্রমিত হইতে পারে ইহাতে উহাদের টিসু (Tissue) ও রক্তের সাদৃশ্য প্রমাণিত হয় না কি?
চা, কফি ও মাদক দ্রব্যাদি ভক্ষণে এবং কতক বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগে মানুষ ও পশুর একই লক্ষণ প্রকাশ পায়। ইহাতে উভয়ের পেশী (Muscle) ও স্নায়ুবিক (Nerve) সাদৃশ্য প্রমাণিত হয় না কি?
গো-মহিষাদি লোমশ প্রাণী, মানুষও তাহাই। উহাদের শরীরে যে রূপ পরজীবী বাস করে, মানুষের শরীরেও তদ্রূপ উকুনাদি পরজীবী বাস করে। প্রজনন কার্যে মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবের বিশেষ কোন পার্থক্য নাই। পূর্বরাগ, যৌন মিলন, ভ্রূণোৎপাদন, সন্তান প্রসব ও প্রতিপালন সকলই প্রায় এক রকম কেন?
মানুষের সন্তানোৎপাদনের শক্তির বিকাশ হয় যৌবনে। এই শক্তির (নারীর) পার্থিব বিকাশকে বলা হয় “রজঃ”। জীব মাত্রেই রজঃ না থাকিলেও স্তন্যপায়ী প্রায় সকল জীবকেই রজঃশীলা হইতে দেখা যায়। তবে বিভিন্ন জীবের যৌবনে পৌঁছিবার বয়স, “রজঃ”-এর লক্ষণ ও স্থিতিকাল এক নহে। তথাপি একজন মানবীর রজঃ বা ঋতুর অন্তর এক মাস (সাধারণতঃ ২৮ দিন) এবং একটি বানরীরও ঋতুর অন্তর এক মাস আর একজন মানবীর গর্ভধারণকাল দশ মাস (দশ ঋতুমাস-২৮০ দিন) এবং একটি গাভীরও ঐরূপ। ইহার কারণ কি? বিশেষত আদি নারী বিবি হওয়া নাকি রজঃশীলা হইয়াছিলেন গন্ধম ছেঁড়ার ফলে, কিন্তু অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীগণ রজঃশীল হয় কেন?
মানুষের ন্যায় পশু পাখীদেরও সন্তান বাৎসল্য এবং সামাজিকতা আছে, সর্বোপরি মানুষের ভাষা আছে। কিন্তু পশু-পাখীদের ভাষা কি আদৌ নাই? মানুষ যেরূপ-আঃ উঃ ইস ইত্যাদি অনেক প্রকার শব্দ দ্বারা হর্ষ, বিষাদ, ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা ইত্যাদি মানসিক ভাব ব্যক্ত করে; তদ্রূপ অনেক ইতর প্রাণীও কতগুলি সাঙ্কেতিক শব্দ দ্বারা মনোভাব ব্যক্ত করিয়া থাকে। গৃহপালিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দের পাঁচটি রকম ভেদ আছে। ইহাতে শত্রুর আগমন শব্দ ব্যবহার করে। গাভীর হাম্বা রবে তিন-চারি প্রকার মনোভাব প্রকাশিত হয়। ইতর প্রাণী কথা যে একবারেই বলিতে পারে না, এমন নহে। ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া ইত্যাদি পাখীরা মানুষের মতই কথা বলিতে শেখে। তাহা হইলে মানুষ ও জীব-জন্তুর ভাষায় পার্থক্য কোথায়? শুধু ধারাবাহিক ব্যাপকতায় নয় কি?
গরু, ঘোড়া, হাতি, বাঘ, শিয়াল-বিড়াল ইত্যাদি পশুরা পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী জীব; মানুষও তাহাই। ঐ সকল পশুর ও মানুষের-রক্ত মাংস, মেদ, মজ্জা, অস্থি ইত্যাদি এবং আভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্র যথা-হৃৎপিণ্ড ফসফুস, প্লীহা, যকৃৎ, মূত্রযন্ত্র, পাকস্থলী ইত্যাদির গঠন, ক্রিয়া সংযোজন ও অবস্থিতি তুলনা করিলে বিশেষ পার্থক্য লক্ষিত হয় না। বিশেষত শিম্পাঞ্জী, গরিলা ও বানরের সহিত মানুষের আকৃতি ও প্রকৃতির সাদৃশ্য যথেষ্ট। ইহার কারণ ক্রম বিবর্তন নয় কি?

২। আকাশ কি?
“আকাশ” বলিতে সাধারণত শূন্যস্থান বুঝায়। কিন্তু কোন কোন ধর্মাচার্য বলিয়া থাকেন যে আকাশ সাতটি। ইহা কিরূপে হয়? যাহা শূন্য, তাহা সংখ্যা দ্বারা সূচিত হয় কিরূপে? যাঁহারা আকাশকে সংখ্যা দ্বারা বিভক্ত করেন, তাঁহারা কি ‘আকাশ’ বলিতে “গ্রহ”কে বুঝেন? কিন্তু গ্রহ তো সাতটি নহে, নয়টি (অধুনা ১০টি)। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও মুসলমান ইত্যাদি ধর্ম প্রবর্তন ও তৎসংক্রান্ত শাস্ত্রাদি প্রণয়ণকাল পর্যন্ত পরিচিত গ্রহের সংখ্যা ছিল ছয়টি। তবে-রাহু, কেতু ও সূর্যকে গ্রহ দলে ধরিয়া নামকরণ হইয়াছিল। নবগ্রহ প্রকৃত পক্ষে সূর্য গ্রহ নহে এবং রাহু ও কেতু হইল চন্দ্র ও পৃথিবীর ছায়া। প্রকৃত গ্রহ হইল- বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি; এই ছয়টি। গ্রহ আকাশ বা শূন্য নহে।
কেহ কেহ সপ্তাকাশকে পদার্থের তৈয়ারী বলিয়া মনে করেন। তাহারা বলেন যে, আকাশ প্রথমটি জলের, দ্বিতীয় লৌহের, তৃতীয় তাম্রের, চতুর্থ স্বর্ণের তৈয়ারী। উহারা আরও বলেন যে, ছাদে ঝুলান আলোর মত চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রাদি আকাশে ঝুলান আছে। কিন্তু এ সবের প্রমাণ কিছু আছে কি? কোন কোন ধর্মবেত্তা আকাশের দূরত্ব নির্ণয় করিয়া গিয়াছেন। কেননা বলা হইয়া থাকে যে, পৃথিবী হইতে প্রথম আসমান ও তদূর্ধ্বে প্রত্যেক আসমান হইতে প্রত্যেক আসমান পাঁচশত বৎসরের পথ দূরে দূরে অবস্থিত।
কোন গতির সাহায্যে দূরত্ব নির্ণয় করিতে হইলে সেই গতির বেগও জানা দরকার। সে যুগে রেল, স্টিমার বা হাওয়াই জাহাজ ছিল না। সাধারণত পায়ে হাঁটিয়াই পথ চলিতে হইত। “পাঁচ শত বৎসরের পথ” এই বলিয়া যাঁহারা আকাশের দূরত্ব নির্ণয় করিয়াছেন, তাঁহারা উহা হাতীর, ঘোড়া, উট, গাধা বা মানুষের গতি অথবা হাঁটা গতি, না দৌড়ের গতি; তাহা কিছু বলেন নাই। সে যাহা হউক, মানুষের পায়ে হাঁটা গতিই মাইলে হিসাব করিয়া দেখা যায় যে, ধর্মীয় মতে কোন আকাশের দূরত্ব কত মাইল।
যথারীতি আহার ও বিশ্রাম করিয়া একজন লোক সাধারণত দৈনিক বিশ মাইল পথ চলিতে পারে। তাহা হইলে এক চান্দ্র বৎসরে অর্থাৎ ৩৫৪ দিন চলিতে পারে ৭ হাজার ৮০ মাইল। সুতরাং পাঁচ শত বৎসরে চলিতে পারে ৩৫ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল। ধর্মীয় মতে ইহা প্রথম আকাশের দূরত্ব, অর্থাৎ চন্দ্রের দূরত্ব। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবী হইতে চন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ২ লক্ষ ৩৯ হাজার মাইল। উপরোক্ত হিসাব মতে চতুর্থ আকাশের দূরত্ব ১ কোটি ৪১ লক্ষ ৬০ হাজার মাইল। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে উহা প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। সে যাহা হউক, আকাশে যে সমস্ত জ্যোতিষ্ক আছে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ উহার দূরত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন যান্ত্রিক ও গাণিতিক সূত্রে। কিন্তু ধর্মগুরুগণ উহা পাইলেন কোথায়, কি সূত্রে?
ধর্মীয় মতে প্রথম আকাশ জলের তৈয়ারী এবং চন্দ্র সেই জলে ভাসিতেছে। অধুনা প্রথম আকাশে অর্থাৎ চন্দ্রের দেশে মানুষ যাওয়া-আসা করিতেছেন এবং তাঁহারা দেখিতেছেন যে, চন্দ্র ভাসিতেছে শূন্যে এবং ওখানে জলের নাম-গন্ধও নাই।
শাস্ত্রীয় মতে-চতুর্থ আকাশের দূরত্ব দেড় কোটি মাইলেরও কম। অথচ আধুনিক বিজ্ঞানীগণ ৩ কোটি মাইলেরও অধিক দূরে শুক্র ও মঙ্গল গ্রহে রকেট প্রেরণ করিতেছেন। কিন্তু কোথাও লোহা, তামা বা সোনার আকাশ (ছাদ) দেখিতেছেন না, সবটাই শূন্য।
ধর্মগুরুদের আকাশ বিষয়ক বর্ণনাগুলি অলীক কল্পনা নয় কি?

৩। দিবা-রাত্রির কারণ কি?
সাধারণত আমরা দেখিয়া থাকি, যে সূর্য প্রত্যহ পূর্বদিক হইতে উদিত হইয়া পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। কিন্তু সূর্য তো কোন জীব নয় যে সে নিজেই দৌড়াইতে পারে। তবে সে চলে কি রকম? ইহার উত্তরে কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, চতুর্থ আসমানে একখানা সোনার নৌকায় সূর্যকে রাখিয়া ৭০ হাজার ফেরেস্তা সূর্যসহ নৌকাখানা টানিয়া পূর্বদিক হইতে পশ্চিম দিকে লইয়া যায় ও সারা রাত আরশের নীচে বসিয়া আল্লাহর এবাদত করে এবং প্রাতে পুনরায় সূর্য পূর্বদিকে হাজির হয় (মলাট পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। পক্ষান্তরে হিন্দুদের পুরাণ শাস্ত্রে লিখিত আছে যে কশ্যপ মুনির ঔরসে তৎপত্নী অদিতির গর্ভে সূর্যের জন্ম হয়। এই হেতু সূর্যের আর এক নাম ‘আদিত্য’। ইনি সপ্ত-অশ্ব-যুক্ত রথে চড়িয়া আকাশ ভ্রমণ করেন এবং অরুণ ঐ রথের সারথি।
জ্যোতির্বিদ পণ্ডিতগণ বলিয়া থাকেন যে, সূর্য এক জায়গায় দাঁড়াইয়া আছে আর তাহা হইতে প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে থাকিয়া পৃথিবী স্বীয় মেরুদণ্ডের উপর ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরপাক খায়। ইহাতেই দিবারাত্রি হয় এবং সূর্যকে গতিশীল বলিয়া আমাদের ভ্রম হয়।
যদিও- “সূর্য এক জায়গায় দাঁড়াইয়া আছে” ইহা বলা হইল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সূর্য এক জায়গায় দাঁড়াইয়া নাই। পৃথিবীর আহ্নিক এবং বার্ষিক গতির ন্যায় সূর্যেরও দুইটি গতি আছে। সূর্য স্বীয় মেরুদণ্ডের উপর প্রায় ২৭ দিনে একবার ঘুরপাক খাইতেছে এবং সে আমাদের নক্ষত্র জগতের ব্যাসের ১/৩ দূরে থাকিয়া প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৭৫ মাইল বেগে নক্ষত্র জগতের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করিতেছে (১৭)। ইহার একপাক শেষ করিতে সূর্যের সময় লাগে প্রায় সাড়ে বাইশ কোটি বৎসর। কিন্তু মানুষ তার সহজ দৃষ্টিতে সূর্যের এই দুইটি গতির একটিরও সন্ধান পায় না।
সে যাহা হউক, দিবা-রাত্রির যে তিনটি কারণ বর্ণিত হইল, ইহার মধ্যে প্রামাণ্য ও গ্রহণীয় কোনটি?

৪। পৃথিবী কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত?
কেহ কেহ বলেন যে, পৃথিবী একটি বলদের শৃঙ্গের উপর আছে। কেহ বলেন পৃথিবী একটি মাছের উপর এবং কেহ বলেন পৃথিবী জলের উপর অবস্থিত। তাই যদি হয়, তবে সেই মাছ, বলদ বা জল কিসের উপর অবস্থিত। অধুনা বহু পর্যটক জল ও স্থল এবং বিমান পথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিতেছেন। কিন্তু তাঁহারা কেহ ওসবের সাক্ষাৎ পান না কেন? বিশেষত পৃথিবী যদি বলদের শৃঙ্গের উপর অবস্থিত থাকিয়া থাকে, তবে সেই বলদটির পানাহারের ব্যবস্থা কি?
আধুনিক পণ্ডিতগণ বলেন যে, পৃথিবী কোন কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। পৃথিবীর কোন দৃশ্যমান অবলম্বন নাই। ইহার সকল দিকেই আকাশ বা শূন্যস্থান। ফুটবল খেলোয়াড়ের পায়ের আঘাতে একটি ফুটবল যেমন ভন্‌ ভন্‌ করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে আকাশে (শূন্য) চলিতে থাকে, পৃথিবীও তদ্রূপ সূর্যকে কেন্দ্র করিয়া ভর আকর্ষণে বাঁধা থাকিয়া শূন্যে ঘুরিতেছে। সূর্যের চারি ধারে একবার ঘুরিয়া আসিতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ১/৪ ঘণ্টা। ইহাকে বলা হয় সৌর বৎসর বা “বৎসর”। বাস্তব ঘটনা ইহাই নয় কি?

৫। ভূমিকম্পের কারণ কি?
কেহ কেহ বলেন, যে পৃথিবীধারী বলদ ভারাক্রান্ত হইয়া কখন কখন শৃঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে এবং তাহার ফলে পৃথিবী কম্পিত হয়। যদি ইহাই হয়, তবে একই সময় পৃথিবীর সকল অঞ্চলে ভূমিকম্প হয় না কেন?
ভূতত্ত্ববিদ পণ্ডিতগণের মতে আগ্নেয়গিরির অগ্লুৎপাত ও ভূগর্ভস্থ অতিশয় উষ্ণ গলিত পদার্থের হঠাৎ শীতলস্পর্শে বাষ্পীয় রূপ ধারণে উহা#2494; বিস্ফোরণের চেষ্টা বা অকস্মাৎ ভূস্তর ধ্বসিয়া যাইয়া ইত্যাদি কারণে ভূমিকম্প হয়।

৬। বজ্রপাত হয় কেন?
কোন কোন ধর্মপ্রচারক বলিয়া থাকেন যে, স্বর্গরাজ্য হইতে বিতাড়িত হওয়ার পরেও শয়তান স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ
করিতে পারিত এবং আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীতে প্রযোজ্য ভবিষ্যৎ কার্যাবলীর নির্দেশ পূর্বাহ্নেই জানিয়া আসিয়া পৃথিবীতে ভবিষ্যদ্বাণী করিত। পৃথিবীর লোক শয়তানের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইতেছে দেখিয়া তাহার উপর বিশ্বাস করিত। অর্থাৎ শয়তান যাহার মুখ দিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করাইত তাহাকেই লোকে ভগবানের ন্যায় বিশ্বাস করিত এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কথা একেবারেই ভুলিয়া যাইত। এইরূপে শয়তান খোদাতা’লার বিরুদ্ধাচরণ করিত এবং লোকদিগকে কুপথে লইয়া যাইবার সুযোগ পাইত। কিন্তু হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর জন্মের পরে স্বর্গরাজ্যে শয়তান যাহাতে প্রবেশ করিতে না পারে এবং উপরোক্ত পদ্ধতিতে মানুষকে বিপথে নিতে না পারে, এজন্য খোদাতা’লা শয়তানের স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ চিরতরে নিষিদ্ধ করিয়া দেন এবং ফেরেস্তাগণকে কড়া হুকুম দিয়া দেন, যেন শয়তান আর স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করিতে না পারে। অধিকন্তু শয়তান বিতাড়নের অস্ত্রস্বরূপ ফেরেস্তাগণকে বজ্রবাণ প্রদান করেন। যখনই শয়তান স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করে তখনই ফেরেস্তাগণ শয়তানের উপর বজ্রবাণ নিপেক্ষ করেন। উহাকে আমরা “বজ্রপাত” বলিয়া থাকি।
উপরোক্ত বিবরণ যদি সত্য হয়, তবে সকল সময় এবং বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় না কেন? শীত ঋতুতে বজ্রপাত হইতে শোনা যায় না কেন? সাধারণত আকাশে চারি শ্রেণীর মেঘ জন্মিয়া থাকে, কিন্তু উহার সকল শ্রেণীর মেঘে বজ্রপাত হয় না কেন? চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে পৃথিবীতে বজ্রপাত ছিল না কি?
সচরাচর দেখা যায় যে, অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানেই বজ্রপাত হয় বেশী। যথা- মাঠের উঁচু শস্য ক্ষেত্র, বাগানের তাল-নারিকেলাদি বৃক্ষ, শহরের উঁচু দালানাদি এমন কি মসজিদের চূড়াতেও বজ্রপাতের কথা শোনা যায়। শয়তান কি ঐ সমস্ত উঁচু জায়গায়ই বাস করে?
হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন যে, দধীচি মুনির অস্থি দ্বারা বজ্রবাণ তৈয়ারী এবং উহা ব্যবহার করেন দেবরাজ ইন্দ্র, তাঁর শত্রু নিপাতের জন্য ‘জৈমিনিশ্চ সুমন্তশচ বৈশম্পায়ন এবং চ। পুনস্ত্যঃ পুলহো জিষ্ণু ষড়েতে বজ্র বারকা।” এই মন্ত্রটি উচ্চারিত হইলে সেখানে বজ্রপাত হয় না ।(১৮) পক্ষান্তরে মুসলমানগণ বলিয়া থাকেন “লা হওলা অলা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহেল আলিউল আজিম” এই কালামটি পাঠ করিলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। এসবের পরীক্ষামূলক সত্য কিছু আছে কি?
বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন যে, বজ্রবারক (Lightning proof) ব্যবহার করিলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। শহরে উঁচু দালানাদি তৈয়ার করিয়া ইঞ্জিনিয়ারগণ উহার উপরে “বজ্রবারক” সন্নিবেশিত করেন এবং তাহাতে বজ্রপাত হইতে দালানাদি রক্ষা পাইয়া থাকে। তবে কি বজ্রবারক দেখিয়াই শয়তান দূর হয়? যদি তাহাই হয়, তবে শয়তান দূর করিবার জন্য অন্যরূপ কোসেস না করিয়া “বজ্রবারক” ব্যবহার করা হয় না কেন?
বজ্রপাত সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য কিছুটা জটিল। তবে সংক্ষিপ্ত এইরূপঃ গ্রীষ্মকালে কোন কোন অঞ্চলে সময় বিশেষে বায়ুর ঊর্ধ্বগতি হয়। ঐ সময় ঐ অঞ্চলের আকাশে যদি মেঘ থাকে এবং সেই মেঘের জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হইয়া যদি নিম্নগতি সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে সেই নিম্নগতি সম্পন্ন মেঘ ও ঊর্ধ্বগতি সম্পন্ন বায়ুর সংঘর্ষের ফলে সময় সময় মেঘের জলকণা ভাঙ্গিয়া অণু ও পরমাণুতে পরিণত হয়। সংঘর্ষের মাত্রাধিক্যে কোন কোন সময় আবার ঐ সকল পরমাণু ভাঙ্গিয়া উহার সমস্ত ইলেক্ট্রন ও প্রোটন মুক্ত হইয়া পড়ে। ইহার ফলে মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। এইরূপ বিদ্যুৎযুক্ত মেঘ আকাশে থাকিলে তন্নিগ্ন ভূমিতে আর এক দফা বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়, ইহাকে “আবিষ্ট বিদ্যুৎ” বলে। এইরূপ অবস্থায় আকাশের বিদ্যুৎ ও মাটিস্থ আবিষ্ট বিদ্যুতের সঙ্গে পরস্পর আকর্ষণ চলিতে থাকে। মিশিবার জন্য ভূ-পৃষ্ঠের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে যাইয়া উঁকি মারিতে থাকে। বিদ্যুৎতাশ্রিত স্থানটি সূঁচাগ্রবৎ হইলে ওখানে বিদ্যুৎ জমিতে পারে না, অল্পে অল্পে মুক্ত হইয়া আকাশের বিদ্যুতে সঙ্গে মিশিয়া যায়। কিন্তু ঐ স্থানটি সূচাগ্রবৎ না হইলে ওখান হইতে বিদ্যুৎমুক্ত হইতে পারে না। বরং ক্রমশ জমিয়া শক্তিশালী হইতে থাকে। আকাশের মেঘে যে বিদ্যুৎ থাকে, তাহা হইতে মাটির আবিষ্ট বিদ্যুতের শক্তি বেশী হইলে, তাহা আকাশের বিদ্যুৎকে টানিয়া ভূ-পাতিত করে। এইভাবে আকাশের বিদ্যুৎপতনকে আমরা বজ্রপাত বলি। বিদ্যুৎ পতনের তীব্রগতির পথে যে সকল বায়বীয় পদার্থ ও
ধুলিকণা থাকে, উহা জ্বলিয়া তীব্র আলোর সৃষ্টি হয় এবং বায়ু কম্পনের হয় শব্দ।
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, একটু অনুধাবন করিলেই বুঝিতে পারিবেন যে, বজ্রপাত কেন উঁচুস্থানে হয়, কেন সকল মেঘে ও শীতকালের মেঘে হয় না, কেন উঁচু গাছ কাছে থাকিলে নীচু গাছে হয় না এবং বজ্রবারক ব্যবহার করিলে কেন সেখান বজ্রপাত হয় না।
(ধর্মযাজকগণ আলোচ্য বিষয়গুলি পর্যবেক্ষণ করিয়া দেখিবেন কি?)

৭। রাত্রে সূর্য কোথায় থাকে?
আল্লাহর “আরশ” কোথায় কোনদিকে জানি না। কিন্তু কোন কোন ধর্ম প্রচারক বলিয়া থাকেন যে, রাত্রে সূর্য থাকে আরশের নীচে। ওখানে থাকিয়া সূর্য সারারাত আল্লাহর এবাদত বন্দেগী করে এবং ভোরে পূর্বাকাশে উদয় হয়।
সৌর-বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সূর্য প্রায় ৮ লক্ষ চৌষট্টি হাজার মাইল ব্যাস বিশিষ্ট অগ্নিপিণ্ড। উহার কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ৬ কোটি ডিগ্রী এবং বাহিরের তাপমাত্রা প্রায় ৬ হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড (১৯) প্রজ্জলিত সূর্যের দেহ হইতে সতত প্রচণ্ড তাপ ও সুতীব্র আলো বিকীর্ণ হইতেছে এবং সূর্যের সেই আলোর সীমার মধ্যে থাকিয়া পৃথিবী নিজ মেরুদণ্ডের উপর ঘুরপাক খাইতেছে। ভূ-পৃষ্ঠের যে অংশ যখন সূর্যের দিকে থাকে তখন সেই অংশে হয় দিন, অপর অংশে হয় রাত্রি।
পৃথিবীর যে অংশে আমরা বাস করি, তার বিপরীত দিকে আছে আমেরিকা রাজ্য। কাজেই আমরা যখন সূর্যের দিকে থাকি, তখন আমেরিকা থাকে বিপরীত দিকে। অর্থাৎ আমাদের দেশে যখন রাত্রি, তখন আমেরিকায় দিন এবং আমাদের দেশে যখন দিন, তখন আমেরিকায় রাত্রি। কাজেই রাত্রে সূর্য থাকে আমেরিকার আকাশে। এ বিষয়টি সত্য নয় কি?

৮। ঋতুভেদের কারণ কি?
কেহ কেহ বলেন যে, দোজখের দ্বার যখন বন্ধ থাকে, তখন শীত ঋতু হয় এবং যখন খোলা থাকে, তখন গ্রীষ্ম ঋতু।
আধুনিক পণ্ডিতগণ বলেন যে, সূর্যকে কেন্দ্র করিয়া এক বর্তুলাকার কক্ষে ঈষৎ হেলান অবস্থায় থাকিয়া পৃথিবী বারমাসে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ইহাতে সূর্য-রশ্মি পৃথিবীর উপর কখনও খাড়াভাবে এবং কখনও তেরচাভাবে পড়ে। সুতরাং যখন খাড়াভাবে পড়ে, তখন গ্রীষ্ম ঋতু হয় এবং যখন তেরচাভাবে বা হেলিয়া পড়ে তখন হয় শীত ঋতু। আলোচ্য মত দুইটির মধ্যে গ্রহণীয় কোনটি?

৯। জোয়ার-ভাটা হয় কেন?
কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, পৃথিবীধারী বলদ যখন শ্বাস ত্যাগ করে তখন জোয়ার হয় এবং যখন শ্বাস গ্রহণ করে, তখন হয় ভাটা। তাই যদি হয় তবে পৃথিবীর সব অঞ্চলে একই সময় জোয়ার বা ভাটা হয় না কেন?
বিজ্ঞানীদের মতে জোয়ার ভাটার বিশেষ কারণ হইল চন্দ্রের আকর্ষণ। ভূ-পৃষ্ঠের যে কোন স্থানে চন্দ্র যখন মধ্যাকাশে থাকে, তখন সেই স্থানে চন্দ্রের আকর্ষণ জোরালো থাকে এবং চন্দ্র দিগন্তে থাকিলে তখন তার আকর্ষণ হয় ক্ষীণ। কাজেই চন্দ্র মধ্যাকাশে থাকিলে যেখানে জোয়ার হয়, দিগন্তে থাকিলে সেখানে হয় ভাটা। অধিকন্তু ভূ-পৃষ্ঠের যে অংশে যখন জোয়ার বা ভাটা হয়, তার বিপরীত পৃষ্ঠে তাই হয়, তার বিপরীত পৃষ্ঠেও তখন জোয়ার বা ভাটা হইয়া থাকে। তাই একই স্থানে জোয়ার বা ভাটা হয় দৈনিক (২৪ ঘণ্টা) দুইবার।
আলোচ্য দুইটি মতের মধ্যে বাস্তব কোনটি?

১০। উত্তাপবিহীন অগ্নি কিরূপ?
শোনা যায় যে, বাদশাহ নমরূদ হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে বধ করিবার জন্য ভীষণ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তালার অসীম কৃপায় তিনি মারা যান নাই বা তাঁহার দেহের কোন অংশ দগ্ধ হয় নাই। বস্তুত এই জাতীয় ঘটনার কাহিনী জগতে বিরল নয়। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনীতে এরূপ অনেক ঘটনার বিবরণ পাওয়া গিয়াছে।
সেকালে হিন্দুদের ধারণা ছিল যে সতী-নারী অগ্নি-দগ্ধ হয় না। তাই রাম-জায়া সীতা দেবীকে অগ্নি পরীক্ষা করা হইয়াছিল। সীতা দীর্ঘকাল রাবণের হাতে একাকিনী বন্দিনী থাকায় তাঁর সতীত্বে সন্দেহ বশত তাঁহাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু উহাতে নাকি তাঁর কেশাগ্রও দগ্ধ হয় নাই আর আজকাল দেখা যায় যে চিতানলে-সতী বা অসতী সকল রমণীই দগ্ধ হয়। ইহাতে মনে হয় যে হয়ত অগ্নিদেব দাহ্য পদার্থ মাত্রেই দহন করে, সতী বা অসতী কাহাকেও খাতির করে না, নতুবা বর্তমান কালে সতী নারী একটিও নাই।
হজরত ঈসা (আঃ)-এর জন্মের প্রায় দুই হাজার বৎসর পূর্বে পার্সি ধর্মের প্রবর্তক জোরোয়াষ্টার নিজ দেহের উপর উত্তপ্ত তরল ধাতু ঢালিয়া দিয়া অলৌকিক ক্রিয়া দেখাইতেন। ক্যাপি ডোসিয়ার অন্তর্গত ডায়ানার মন্দিরের পুরোহিতগণ উত্তপ্ত লাল বর্ণের লৌহের উপর দিয়া যাতায়াত করিয়া লোকদিগকে স্তম্ভিত করিতেন। ভারতবর্ষের বিশেষভাবে বাংলাদেশে-জগন্নাথের সন্ন্যাসীগণ জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উপর দিয়া যাতায়াত করিয়া লোকের বিশ্বাস উৎপাদন করিতেন।
জাপানের “সিন্ট” পুরোহিকগণ তাঁহাদের “মাৎসূরীর”র (উৎসবের) সময় অনেক অলৌকিক ক্রিয়া দেখাইয়া থাকেন। সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিয়াটির নাম “হাই ওয়াতারী”। অর্থাৎ জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়া যাতায়াত করা। জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়া পুরোহিতগণত হাঁটেনই, অধিকন্তু হাত ধরিয়া দর্শকগণকেও হাঁটাইতে পারেন। সিন্ট পুরোহিতগণ তার একটি বিভূতি প্রদর্শন করিয়া থাকেন, উহার নাম “কুগা-দুচী”। অর্থাৎ ফুটন্ত জলের দ্বারা স্নান করা (২৩)।
উপরোক্ত অগ্নি ঘটিত বিভূতিগুলি সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত যাদুকর (Magician) পি.সি.সরকার মহাশয় বলিয়াছেন- “বর্তমানকালের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে উহার ভৌতিক (অলৌকিক) অংশ চলিয়া যাইয়া ‘ম্যাজিক’ অংশটি বাহির হইয়া পড়িয়াছে”, অর্থাৎ তিনি উহার অধিকাংশই প্রদর্শন করিতে পারিতেন ও করিতেন।
বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে জানা গিয়াছে যে, দহনের একমাত্র সহায়ক হইল “অক্সিজেন”। ইহা এক প্রকার বায়বীয় পদার্থ। যেখানে অক্সিজেনের অভাব, সেখানে আগুন জ্বলে না। এই কারণেই বৃহদায়তনের কাঠের গুঁড়িত#2503; আগুন ধরাইলে, উহার অভ্যন্তর বা কেন্দ্রভাগ জ্বলে না এবং বিপুল আয়তনের কাষ্ঠ রাশিতে আগুন দিলেও উহার মধ্যভাগের কাষ্ঠ থাকে অদগ্ধ।
হজরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন ভীষণ অগ্নিকাণ্ডে নিক্ষিপ্ত হইয়াও দগ্ধ হইলেন না, তখন কি প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়া অগ্নির দাহিকা শক্তি লোপ পাইয়াছিল, না বৃহদায়তন হেতু কাষ্ঠ রাশির অভ্যন্তর ভাগ “অক্সিজেন” অভাবে অদাহ্যই ছিল।
শোনা যায় যে, আগের দিনে মুনি-ঋষীদের কেহ কেহ কুম্ভক প্রক্রিয়ার দ্বারা নাকি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ রাখিয়া অর্থাৎ অক্সিজেন ছাড়া দীর্ঘ সময় বাঁচিয়া থাকিতে পারিতেন। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) তাহা জানিতেন কি? নতুবা তিনি অক্সিজেন শূন্য স্থানে বাঁচিলেন কি রূপে?

১১। হজরত নূহ নবীর সময়ের মহাপ্লাবন পৃথিবীর সর্বত্র হইয়াছিল কি?
ধর্মাচার্যগণ বলিয়া থাকেন যে, হজরত নূহের সময় নানাবিধ পাপাচার করায় মানুষ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে খোদাতা’লা পৃথিবীর এক গজব (মহাপ্লাবন) নাজেল করেন। চল্লিশ দিবারাত্র অবিরাম বৃষ্টির ফলে সমস্ত পৃথিবী জলে ডুবিয়া গিয়াছিল। এমন কি পর্বতের উপরেও ১৫ হাত জল জমিয়াছিল। পৃথিবীতে মানুষ, পশু, পাখী, কীট-পতঙ্গাদি কোন প্রাণীই জীবিত ছিল না। হজরত নূহ তার জাহাজে যে সকল প্রাণীদের আশ্রয় দিয়াছিলেন, মাত্র তাহারাই জীবিত ছিল।
হজরত আদম হইতে হজরত নূহ দশম পুরুষ এবং উক্ত মহাপ্লাবন হইয়াছিল হজরত আদমের জন্মের তারিখ হইতে ১৬৫৬ বৎসর পরে (২০)। মাত্র এক জোড়া মানুষ হইতে এত অল্প সময়ের মধ্যে তখন পৃথিবীতে মানুষ খুব বেশী জন্মিতে পারে নাই। বিশেষত সেকালের মানুষ ছিল শান্ত ও সরল প্রকৃতির। তথাপি তাহাদের পাপকার্য সহ্য করিতে না পারিয়া আল্লাহ জগতময় মহাপ্লাবন-রূপ গজব নাজেল করিলেন, আর বর্তমানে সহ্য করেন কিরূপে? বর্তমান জগতে পাপ কর্ম নাই কি?
ধর্মীয় মতে ইরান, তুরান, ইরাক ও আরবের কোন কোন অংশেই তখন লোকের বসতি ছিল। বাকী এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকায় কোন লোকই ছিল না এবং আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ছিল অজ্ঞাত। এমতাবস্থায় সমস্ত পৃথিবী ব্যাপিয়া মহাপ্লাবন হইবার কারণ কি এবং মানুষের পাপের জন্য অন্যান্য প্রাণীরা মরিল কেন?
মানুষের জীবন হরণ করা আজ্রাইল ফেরেস্তার কাজ। সে আল্লাহর আদেশ পাইলে যে কোন সময়ে, যে কোন অবস্থায়ই মানুষের ‘জান-কবজ’ করিয়া নিতে পারেন এবং গুটিকতক পাপীর ‘জান-কবজ’ করা হয়ত তাঁহার এক মুহূর্তের কাজ। মানুষের মৃত্যুই যদি আল্লাহর কাম্য হইত, তবে তিনি আজ্রাইলকে দিয়া উহা এক মুহূর্তে করাইতে পারিতেন। কিন্তু তাহা না করাইয়া তিনি চল্লিশ দিন স্থায়ী প্লাবনের ব্যবস্থা করিলেন কেন?
ভূমণ্ডলে জলের পরিমাণের হ্রাস-বৃদ্ধি নাই, আছে শুধু স্থানান্তর ও রূপান্তর। কোন দেশের উপর যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তৎসন্নিহিত সাগরাদির জল সেই পরিমাণ কমিয়া যায়। কেননা বাষ্পাকারে ঐ জল সাগরাদি হইতেই আসিয়া থাকে আর জলের একটি বিশেষ ধর্ম এই যে, বাহিরের কোন শক্তি প্রয়োগ না হইলেও উহার উপরিভাগ থাকে সমতল।
অরারট পর্বতের চতুর্দিকেই ভিন্ন ভিন্ন সাগর অবিস্থত। যথা- কৃষ্ণ সাগর, কাষ্পিয়ান সাগর, পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, ভূমধ্য সাগর ইত্যাদি। অরারট পর্বতের চূড়ার উপর নাকি পনের হাত জল জমিয়াছিল এবং হজরত নূহের জাহাজখানা ঐ পর্বতের চূড়ায় আটকাইয়াছিল (তৌরিতে লিখিত অরারট পর্বতকে মুসলমানগণ বলেন “যুদী” পাহাড়)। কিন্তু ঐ পরিমাণ সাগরগুলির জল কমিয়াছিল কিনা? যদি কমিয়া থাকে, তাহা হইলে-সাগরের নীচু জলের সহিত অরারট পর্বতের উঁচু জল চল্লিশ দিন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া থাকিল কিরূপে, জল কাত হইয়াছিল কি?
প্রবল প্রবাহের ফলে হয়ত সমুদ্রের জল আসিয়া কোন দেশ প্লাবিত করিতে পারে এবং বায়ুর বেগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ জল স্থল ভাগের উপর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু আলোচ্য প্লাবনে কোন রূপ বায়ুপ্রবাহ ছিল না, ছিল অবিরাম বৃষ্টি (২১)। ঐ প্লাবনে কোনরূপ ঝড়-বন্যা হওয়ার প্রমাণ আছে কি?
হজরত নূহের জাহাজখানা নাকি দৈর্ঘ্যে ৩০০ হাত, প্রস্থে ৫০ হাত ও উচ্চতায় ৩০ হাত ছিল এবং প্লাবনের মাত্র সাতদিন পূর্বে উহা তৈয়ারের জন্য খোদাতা’লার নিকট হইতে হজরত নূহ ফরমায়েশ পাইয়াছিলেন (২২)।
বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে লোহা-লক্কড়, কলকব্জা ও ইঞ্জিন-মেশিনের অভাব নাই। তথাপি ঐ মাপের একখানা জাহাজ মাত্র সাত দিনে কোন ইঞ্জিনিয়ার তৈয়ার করিতে পারেন না। হজরত নূহ উহা পারিলেন কিরূপে? নদ-নদী ও সাগর বিরল মরু দেশে সূত্রধর ও কাঠের অভাব ছিল না কি? বিশেষত কাঠ চেরাইয়ের যন্ত্র ছিল কি? অধিকন্তু ইহারই মধ্যে-পৃথিবীর যাবতীয় পশু-পক্ষী ও কীট-পতঙ্গাদি জোড়া জোড়া এবং যাবতীয় গাছ-পালার বীজ সংগ্রহ করিয়া জাহাজে বোঝাই করিলেন কোন সময়?
উক্ত প্লাবনে নাকি পৃথিবীর সকল প্রাণীই বিনষ্ট হইয়াছিল, মাত্র জাহাজে আশ্রিত কয়েকটিই জীবিত ছিল। বর্তমান জগতের প্রাণীই নাকি ঐ জাহাজে আশ্রিত প্রাণীর বংশধর। তাই যদি হয়, তবে মানুষ ও পশু-পাখী ওখান হইতে আসিতে পারিলেও কেঁচো ও শামুকগুলি বাংলাদেশে আসিল কিভাবে?

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x