‘বিশ্বাস কোনো কিছুরই উত্তর দেয় না, কেবল প্রশ্ন করা থেকে বিরত রাখে’।

– ফ্রেটার রেভাস

কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?—প্রথম কবে এ প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়েছিলাম তা আজ মনে নেই। সম্ভবত জঁ-পল সাত্রের (১৯০৫-১৯৮০) অস্তিত্ববাদী দর্শন ‘বিয়িং এ্যাণ্ড নাথিংনেস’ কিংবা মার্টিন হাইডেগারের (১৮৮৯- ১৯৭৬) অধিপদার্থবিদ্যা-বিষয়ক বই ‘ইন্ট্রোডাকশন টু মেটাফিজিকস্’ পড়তে গিয়ে। শেষোক্ত বইটির প্রথম লাইনটিই বোধ করি ছিল—‘হোয়াই দেয়ার ইজ সামথিং রাদার দেন নাথিং?’। তার পর থেকে বহু বইয়ে, অসংখ্য জায়গাতেই এর উপস্থিতি টের পেয়েছি। দার্শনিক উইলিয়াম জেমস (১৮৪২-১৯১০) তাঁর ‘সাম প্রবলেমস অব ফিলসফি’ গ্রন্থে এ প্রশ্নটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘অন্ধকারতম দর্শন’ হিসেবে। জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্যার আর্থার বার্নার্ড লোভেল (১৯১৩-২০১২) একে দেখেছেন ‘ব্যক্তির মনকে ছিন্নভিন্ন করা’ প্রশ্ন হিসেবে। এ বিষয়ে আমার পড়া এখন পর্যন্ত সর্বশেষ বই জিম জোল্টের ‘হোয়াই ডাস দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সিস্ট’ (২০১২)263। বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘কেন বিশ্ব অস্তিত্বমান?’ বইয়ের এক জায়গায় লেখক রসিকতা করে বলেছেন, ‘সাইকিয়াট্রিক রোগীরা বরাবরই এই প্রশ্ন দিয়ে আচ্ছন্ন থাকে”!

মানসিক রোগীরা সত্যই এই ধরনের প্রশ্ন দিয়ে আচ্ছন্ন থাকে কিনা জানি না, তবে জিম জোল্ট বইয়ের শুরুতেই রসিকতা করে ‘অস্তিত্বের সহজ প্রমাণ’ হিসেবে যা লেখা আছে, তা মানসিক রোগীর মতোই শোনায় বটে –

ধরুন, দেয়ার ওয়্যার ‘নাথিং’। নাথিং মানে কিছু না, এমনকি কোনো নিয়মনীতি কিছুই নাই। কারণ, নিয়ম থাকা মানেই কিছু একটা থাকা।

কোনো নিয়ম না থাকার মানে, যেকোনো কিছুই সেখানে ‘পারমিটেড’।

যদি সবকিছুই পারমিটেড হয়, তাইলে ‘নাথিং উইল বি ফরবিডেন।

তাই, ‘নাথিং’ বলে কিছু থাকলে ‘নাথিং উইল বি ফরবিডেন’।

অর্থাৎ, নাথিং ব্যাপারটা ‘সেলফ ফরবিডিং’।

সো, দেয়ার মাস্ট বি ‘সামথিং’।

দার্শনিকদের পাশাপাশি আছেন ধার্মিকরাও। কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ প্রশ্নটি ধর্মবেত্তাদের প্রিয় একটি প্রশ্ন হিসেবে বিরাজ করেছিল। বিজ্ঞানীদের মুখে কুলুপ আঁটাতে এ প্রশ্নটি উচ্ছ্বাসভরে ব্যবহার করা হতো। হ্যাঁ, ‘হোয়াই দেয়ার ইস সামথিং রাদার দ্যান নাথিং’-এ প্রশ্নটি সত্যই ছিল বিজ্ঞানীদের প্রতি বড়সড় চ্যালেঞ্জ; প্যালের ঘড়ি, হয়েলের বোয়িং, কিংবা হাল আমলের হুমায়ুনের নাইকন ক্যামেরা যেমন ধার্মিকদের তৃপ্তির ঢেকুর উৎপাদন করত, এই প্রশ্নটিও অনেকটা বিজ্ঞান-ধর্মের বিতর্কে বিজ্ঞানের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতার মতোই হয়ে উঠেছিল যেন অনেকের কাছে। মূল ধারার বিজ্ঞানীরা এত দিন ধরে এর উত্তর প্রদানে অনীহ এবং নিশ্চুপই ছিলেন বলা যায়। অনেকে আবার এ ধরনের প্রশ্ন ‘বিজ্ঞানের বিষয় নয়’ বলে পাশ কাটিয়ে যেতেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে।

Jim Holt, Why Does the World Exist?: An Existential Detective Story, Liveright, 2012

প্যালের ঘড়ি, হয়েলের বোয়িংসহ বিভিন্ন সৃষ্টিবাদী যুক্তির খণ্ডন পাওয়া যাবে অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর লিখিত ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (শুদ্ধস্বর, ২০১১; পুনর্মুদ্রণ ২০১২) গ্রন্থে। এ ছাড়া দেখা যেতে পারে মুক্তমনায় প্রকাশিত নিচের লেখাগুলোও

ভ্রান্ত ধারণাঃ ঘড়ির যেমন কারিগর লাগে, তেমনি মহাবিশ্ব তৈরির পেছনেও কারিগর লাগবে; লিঙ্ক – http://mukto-mona.com/evolution/QA/first_WilliamPaley_design_physics.htm

ভ্রান্ত ধারণাঃ সরল অবস্থা থেকে এত জটিল জীবজগতের উদ্ভব ঘটা জাঙ্ক ইয়ার্ডে ফেলে রাখা জঞ্জাল থেকে এক ঘূর্ণিঝড়ের মাধ্যমে এক বোয়িং বিমান তৈরি হয়ে যাওয়ার মতোই অসম্ভব। লিঙ্ক http://mukto-mona.com/evolution/QA/hoyle_boeing.htm

রায়হান আবীর, মঙ্গলের বুকে পড়ে থাকা সেই নাইকন ক্যামেরাটি, মুক্তমনা, জুলাই ৩১, ২০১২, লিঙ্ক – http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=27782

এখন অনেক বিজ্ঞানীই আস্থার সাথে অভিমত দিচ্ছেন যে তাঁরা এর উত্তর জানেন। উত্তরের নিশ্চয়তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ধর্ম ও দর্শনের বলয়ে পড়ে থাকা এ প্রশ্নটিতে পদার্থবিজ্ঞানীরা যে নাক গলাতে শুরু করেছেন, এবং এ নিয়ে একটা অবস্থানে পৌঁছুতে চাইছেন সেটি এখন মোটামুটি নিশ্চিত। সেজন্য বেশ ক’বছর ধরেই দেখছি পদার্থবিজ্ঞানীদের লেখা বইগুলোতে বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসতে। আমরা পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘গড দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’ শীর্ষক গ্রন্থে এর উল্লেখ ও ব্যাখ্যা দেখেছি, দেখেছি বিজ্ঞানী হকিং-স্লোডিনোর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়েও। আর এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ সংযোজন বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউসের ‘A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing। বাংলা করলে বলতে পারি—‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব -কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’ বইটিতে পদার্থবিদ ক্রাউস পদার্থবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে শূন্য থেকে আমাদের চিরচেনা বিপুল মহাবিশ্ব উদ্ভূত হতে পারে একেবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে। যারা লরেন্স ক্রাউসের ব্যাপারে জানেন না, তাঁদের জন্য দু লাইন বলি। অধ্যাপক লরেন্স ক্রাউস বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সুপরিচিত জ্যোতিঃপদার্থবিদ, পিএইচডি করেছিলেন এমআইটি থেকে ১৯৮২ সালে এবং বর্তমানে অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অরিজিন’ নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের কর্ণধার। এই প্রজেক্টে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, পদার্থের উৎপত্তি থেকে প্রাণের উৎপত্তিসহ নানা ধরনের প্রান্তিক বিষয়-আশয় নিয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করা হয়।

ক্রাউসের বইটিতে শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে দর্শনের সবচেয়ে প্রগাঢ় সমস্যাটি—আমাদের অস্তিত্বের একদম গোড়ার সমস্যা –কেনইবা একেবারে কিছু না থাকার বদলে গ্যালাক্সি, তারকাপুঞ্জ, সৌরজগৎ, পৃথিবী, জীবজগৎসহ এত কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের চারপাশজুড়ে। এত কিছু থাকার বদলে নিঃসীম আঁধার থাকলেই বা কী ক্ষতি ছিল? ক্রাউসের বইটির মুখবন্ধে বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স বলেছেন, ‘জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইনের অরিজিন অব স্পিশিজ যেমনি, জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্রাউসের শূন্য থেকে মহাবিশ্বও তেমনি’। ডারউইনের বইয়ে বর্ণিত বিবর্তন তত্ত্ব যেমন জীবজগতের ক্ষেত্রে কোন অপ্রাকৃত সত্ত্বা থাকার অনুকল্পকে বাতিল করে দিয়েছে, ক্রাউসের বইও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অর্থাৎ, মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে কোনো অপ্রাকৃত বা অপার্থিব সত্ত্বার অস্তিত্ব থাকার সকল দাবিকে বাতিল করে দিয়েছে। ক্রাউসের বইটির শিরোনামটিই কেন্দ্রীভূত হয়েছে ধার্মিকদের ছুড়ে দেওয়া প্রিয় এ প্রশ্নকে উপজীব্য করে। বলা বাহুল্য যে সমস্ত মূলধারার পদার্থবিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ লেখায়, তাঁরা সবাই বিজ্ঞানের চোখ দিয়েই সমস্যাটি মোকাবিলা করেছেন এবং সমাধানে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন, ধর্মবেত্তা কিংবা দার্শনিকদের মতো জল ঘোলা না করে। যেমন, ক্রাউস তাঁর বইয়ে বলেছেন (‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, পৃষ্ঠা ১৪৩) –

আমাদের মহাবিশ্বের আধুনিক বিজ্ঞানের ছবি, এর ইতিহাস, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, ও সর্বোপরি শূন্য বলতে আসলে কী বোঝায় তা অনুধাবন এবং পর্যালোচনা করে আমরা এটুকু বলতে পারি যে, এখন এ প্রশ্নটিকে মোকাবিলা করার জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছি।

লরেন্স ক্রাউস কোনো অতিশয়োক্তি করেননি। একটা সময় ভাবা হতো ‘নাথিং’ ব্যাপারটা হচ্ছে বস্তুর কিংবা জগতের জন্য স্বাভাবিক অবস্থা, আর ‘সামথিং’ ব্যাপারটা আরোপিত। যেমন জার্মান গণিতবিদ লিবনিজ তাঁর ১৬৯৭ সালে লেখা ‘অন আল্টিমেট অরিজিন অব থিংস’ নামক একটি প্রবন্ধে এ বিষয়ে অভিমত দেন এই বলে যে, ‘নাথিং’ ব্যাপারটা স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু অন্যদিকে ‘সামথিং’ ব্যাপারটা অর্জন করতে কাজ করতে হয়। আর বাইরের কোনো কিছুর হস্তক্ষেপ ছাড়া এমনি এমনি নাথিং থেকে সামথিং-এ উত্তরণ ঘটে না। লিবনিজের কাছে এর সমাধান ছিল যথারীতি ‘ঈশ্বর’।

তার পর থেকে এভাবেই আমাদের দিন গেছে। ‘কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’ উত্তর খুব সোজা কারণ হলেন ঈশ্বর। আসলে স্টিফেন হকিং এবং তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য ‘ট্যাট্‌না’ বিজ্ঞানীদের হাতে সত্তরের দশকে ‘কোয়ান্টাম কসমোলজির’ জন্ম হবার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞান এর বিপরীতে সফল উত্তর দিতে পারেনি, ঠিক যেমনি ডারউইন আসার আগ পর্যন্ত আমরা প্যালের

Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012.

Leibniz, “On the Ultimate Origination of the Universe”, 1697

ডিজাইন আর্গুমেন্টকে ঠিকমতো দলাইমলাই করার উপকরণ খুঁজে পেতাম না। তারপরেও কিছু ঘাড়ত্যাড়া দার্শনিক যে ছিলেন না তা নয়। তাঁরা এ ধরণের ‘হোয়াই দেয়ার ইজ সামথিং রাদার দ্যান নাথিং’ মার্কা প্রশ্ন মুচকি হেসে বলতেন, তা যদি ‘নাথিং” ব্যাপারটা এতো স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত হয়, তাহলে ঈশ্বরেরই বা থাকার দরকার কী ছিল? Why there is God rather than nothing? ‘নাথিং’ বাবাজিকে প্রতিহত করতে অদৃশ্য অপ্রমাণিত ঈশ্বরকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে দেখানো যাবে, কিন্তু বাস্তব যে মহাবিশ্বটা আমরা চোখের সামনে হরহামেশা দেখছি সেটাকে ‘কুত্রাপি নয়’, এ ব্যাপারটা একটু হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে না? এমনকি অন্তিম প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসেবে ঈশ্বরকে সাক্ষীগোপাল করে হাজির করার ব্যাপারটা যে আসলে কোনো উত্তর নয়, তা কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের মাথায়ও এসেছিল। এ জন্যই ‘সত্যের সন্ধান’ বইয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন “ঈশ্বর সময়কে সৃষ্টি করেছেন কোন সময়ে?” অথবা ‘স্থানকে সৃষ্টি করা হলো কোন স্থান থেকে?” কিংবা ‘শক্তি সৃষ্টি করা হলো কোন শক্তি দ্বারা? ধার্মিকেরা এই ধরনের প্রত্যুত্তরে খুব একটা ভালো উত্তর কখনোই দিতে পারেননি। বরং গোস্বা করেছেন। এক দুর্মুখ নাস্তিক একবার খ্রিষ্টীয় ধর্মবেত্তা সেন্ট অগাস্টিনকে জিজ্ঞেসা করেছিল – ‘ফাদার, এই মহাবিশ্ব বানানোর আগে ঈশ্বর বাবাজি কী করছিলেন বলুন তো?” অগাস্টিন রাগে ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তোদের মতো লোক, যারা এ ধরনের প্রশ্ন করে, তাদের জন্য জাহান্নাম তৈরি করছিলেন ঈশ্বর’!

তবে ধার্মিকেরা গোস্বা করলেও সংশয়বাদী দার্শনিকেরা সবসময়ই লিবনিজের উপসংহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। আগেও করেছেন, এখনো করছেন। যেমন, জার্মান দার্শনিক এডলফ গ্রুনবোম তাঁর ‘দ্য পভার্টি অব থিইস্টিক কসমোলজি’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে পদ্ধতিগতভাবে লিবনিজের উপসংহারের সমালোচনা হাজির করেছেন, এই সময়ের প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী শন ক্যারল সেটা তাঁর একটি ব্লগে উল্লেখ করেছেন।

তবে দার্শনিকেরা তাঁদের দার্শনিক প্যাঁচঘোচ থেকে উত্তর বের করতে পারলেও আমার মতে সেগুলো ছিল মোটা দাগে স্রেফ ‘পিছলামি কথার খেলা’, বৈজ্ঞানিক কোনো সমাধান নয়। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো লিবনিজের সময়কালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং এ-সংক্রান্ত অগ্রগতি সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের কোনো ধারণাই ছিল না। চোখের সামনে দেখা বিশ্বজগতের জন্য যে নিয়ম প্রযোজ্য, সেটার ভিত্তিতেই তাঁরা এবং তাঁদের মতো দার্শনিকেরা সিদ্ধান্ত নিতেন। তাঁরা জানতেন না যে, তাঁদের দৃশ্যমান জগতের বাইরে বিশাল একটা জগৎ আছে; এই সেই আন্তপারমাণবিক জগৎ, যে জগতের নিয়মগুলো অনেকটা হ্যারি পটারের গল্পের ‘হগওয়ার্টস স্কুল’-এর নিয়মকানুনের মতোই অদ্ভুত। আমাদের দৃশ্যমান জগতে আমরা শূন্য থেকে কিছু তৈরি হতে দেখি না, কিংবা আমরা আমাদের বাড়ির ইটের দেয়াল ভেদ করে হেঁটে ওপারে চলে যেতে পারি না। কিন্তু কোয়ান্টাম জগৎ যেন ভিন্ন, এখানে কণা আর প্রতিকণারা রীতিমতো শূন্য থেকে উদ্ভূত হয়, নিশ্চিত অবস্থান নেওয়ার বদলে সম্ভাবনার বলয়ে থাকতে পছন্দ করে, আর মাঝেমধ্যেই তারা ‘কোয়ান্টাম টানেলিং’-এর মাধ্যমে দুর্লঙ্ঘ্য বাধার প্রাচীর গলে চলে যায় অশরীরী সত্তার মতোই। কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকানুনগুলোকে অবাস্তব ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। এটা আমার এই প্রবন্ধের মতোই নিখাদ বাস্তব। যাঁরা ইলেকট্রনিকসের যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাঁরা সবাই টানেল ডায়োড ও জোসেফসন জংশনের কথা জানেন, এগুলো কিন্তু কোয়ান্টাম রাজ্যের হ্যারি পটারের সেই ‘হগওয়ার্টস স্কুল’-এর মতো নিয়মকানুনের উপর ভর করেই চলে। এমনকি আমাদের পরিচিত সুয্যি মামার ভেতরে অনবরত যে হাইড্রোজেনের ফিউশন ঘটে চলছে বলে আমরা জানি, সেটাও কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের নীতি মেনেই হচ্ছে।

Victor Stenger, God: The Failed Hypothesis: How Science Shows That God Does Not Exist, Prometheus Books, 2007

আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র, পাঠক সমাবেশ।

Grunbaum, Adolf. “The Poverty of Theistic Cosmology” in Brit. J. Phil. Sci. 55, 4, 2004.

দেখুন, Sean Carroll, Why Is There Something Rather Than Nothing? http://blogs.discovermagazine.com/cosmicvariance/2007/08/30/ why -is-there-something-rather-than-nothing/#.UMTdlHep2L8

লিও এসাকি, ইভার গিয়াভার ও ব্রায়ান জোসেফসন ১৯৭৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। এসাকি টানেল ডায়োড আবিষ্কার করেছিলেন, এবং ব্রায়ান জোসেফসন আবিষ্কার করেছিলেন জোসেফসন জাংশন। এ দুটো যন্ত্রই কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে কাজ করে।

বিজ্ঞানী হ্যান্স বিথে ১৯৬৭ সালে নোবেল পুরস্কার পান তারার ভেতরকার ফিউশন-প্রক্রিয়া সফলভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।

বিগত সত্তর এবং আশির দশকে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন, কোয়ান্টাম জগতে ‘নাথিং’ ব্যাপারটি ডিফল্ট কিছু নয়, বরং ‘সামথিং’ ব্যাপারটাই বরং সেখানে ‘ডিফল্ট’। নাথিং ব্যাপারটা সেখানে মোটা দাগে ‘আনস্টেবল’ বা অস্থিতিশীল। শূন্যতা অস্থিতিশীল বলেই ওটা কখনো শান্ত-সমাহিতভাবে পড়ে থাকতে পারে না, সেখানে অনবরতভাবে তৈরি হতে থাকে অসদ কণিকা, অহর্নিশি চলতে থাকে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের রহস্যময় খেলা। আমরা আমাদের বইয়ে আগে আলোচনা করেছি—অ্যারিস্টটল একসময় প্রকৃতিজগৎ দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রকৃতি শূন্যতাকে একদম পছন্দ করে না’ (Nature abhors a vacuum ) । এমনকি শূন্যতাকে দেখা হতো ‘ব্লাসফেমি’ হিসেবে। কিন্তু পরে বিজ্ঞানী টরিসেলি পারদ নিয়ে ঐতিহাসিক পরীক্ষার সাহায্যে দেখিয়ে দেন যে, শূন্যতা ইচ্ছে করলেই তৈরি করা যায়, এতে ব্লাসফেমিও হয় না, কারো মাথায় আকাশও ভেঙে পড়ে না। অবাক ব্যাপার হচ্ছে ‘প্রকৃতি শূন্যতাকে একদম পছন্দ করে না’—অ্যারিস্টটলের করা প্রাচীন এ উক্তিটি যেন কোয়ান্টাম জগতের জন্য সত্য হয়ে ফিরে এসেছে। বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ক্লোস তাঁর ‘নাথিং’ বইয়ে এ জন্যই বলেছেন, ‘অ্যারিস্টটল কোয়ান্টাম জগৎকে দেখে যাওয়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু তাঁর এই উচ্চারণ কোয়ান্টাম জগতের জন্য যেন হাড়ে হাড়ে সত্য হয়ে গেছে’।

‘নাথিং’ ব্যাপারটা যে অস্থিত ও নড়বড়ে টাইপের কিছু, তা আশির দশকে উল্লেখ করেছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক উইলজেক সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল “The Cosmic Asymmetry Between Matter and Antimatter’। মহাবিশ্বের উৎপত্তির উষালগ্নে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ যখন উদ্ভূত হয়েছিল এক রহস্যময় কারণে প্রকৃতি প্রতি- পদার্থের তুলনায় পদার্থের প্রতি খুব সামান্য হলেও পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছিল। এই পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারটা যদি না ঘটত, তাহলে আজ আমরা এখানে বসে বসে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে এই আঁতেলেকচুয়াল প্রশ্ন করার সুযোগ পেতাম না। ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার একে অপরকে আলিঙ্গন করে ধ্বংস করে দিত, আর আমাদের সামনে তখন চেনাজানা পদার্থ, জীবজগৎ নক্ষত্ররাজির বদলে থাকত কেবল তেজস্ক্রিয়তায় পরিপূর্ণ অবারিত এক শূন্যতা। আমাদের এই পার্থিব প্রাণচাঞ্চল্যের বদলে বিরাজ করত একেবারে কবরের নিস্তব্ধতা। তবে একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য। ‘অলৌকিক’ কোনো কারণে এই পক্ষপাতিত্ব ঘটেনি। আর এমনও নয় যে প্রকৃতিকে বিশাল কোনো পক্ষপাতিত্ব দেখাতে হয়েছিল এর জন্য। বরং বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন সূচনালগ্নে পদার্থ-প্রতিপদার্থের মধ্যে এক বিলিয়নের এক ভাগ মাত্র অসমতাই খুলে দিতে পারত আমাদের এই চেনাজানা মহাবিশ্ব তৈরি হবার দুয়ার। আর সত্য বলতে কি—ঠিক তাই সম্ভবত হয়েছে। আজকের মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ বিশ্লেষণ করেও বিজ্ঞানীরা ঠিক তেমনটিই দেখছেন। ফ্র্যাঙ্ক উইলজেক তাঁর সেই প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন কিভাবে অলৌকিক নয়, বরং নিতান্ত প্রাকৃতিক উপায়ে প্রতিসমতার ভাঙনের মাধ্যমে শুরুতে পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থের মধ্যকার অসমতা তৈরি হয়েছিল, এবং তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, ‘শূন্য ব্যাপারটার অস্থিতিশীলতা’। উইলজেক তাঁর পেপারে লিখেছিলেন এভাবে–

ধারণা করা যায় যে, মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল যতদূর সম্ভব সর্বোচ্চ প্রতিসম দশার (symmetrical state) মধ্য দিয়ে, এবং এ দশায় কোনো পদার্থের অস্তিত্ব ছিল না, মহাবিশ্ব ছিল একটি ভ্যাকুয়াম। দ্বিতীয় দশায় পদার্থ এল। এই দশায় প্রতিসাম্যতা ছিল কিছুটা কম, কিন্তু শক্তিও ছিল কম। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কম প্রতিসম দশা এসে সেটি বেড়ে গেল খুব দ্রুত। এই অবস্থান্তরের ফলে যে শক্তি নির্গত হলো সেটা কণা তৈরি করল। এই ঘটনা মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কাজেই ‘কেন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’

Frank Close, Nothing: A Very Short Introduction, Oxford University Press, 2009

Frank Wilczek, “The Cosmic Asymmetry Between Matter and Antimatter,” Scientific American 243, no. 6, 82-90, 1980

এ ব্যাপারটি নিয়ে প্রথম কাজ ছিল রুশ বিজ্ঞানী আঁদ্রে শাখারভের, যিনি তার শান্তিকামী আন্দোলনের জন্য স্ট্যালিনের জামানায় নির্যাতিত হন, এবং তাকে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্যও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হবার অনুমতি দেয়া হয়নি। শাখারভ তার ১৯৭৬ সালে লেখা গবেষণাপত্রে সমাধান দিয়েছিলেন কিভাবে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থের মধ্যে অসমতা তৈরি হতে পারে। তার সমাধান ‘ব্যারিওজেনেসিসের সমাধান’ হিসেবে পরিচিত (A. D. Sakharov, Violation of CP invariance, C asymmetry, and baryon asymmetry of the universe. Sov. Phys. Usp. 34 (5), pp.392–393.)

276 Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012

Frank Wilczek, পূর্বোক্ত।

প্রাচীন এ প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর হলো – ‘নাথিং” ব্যাপারটা অস্থিতিশীল’।

জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের দেয়া সর্বাধুনিক তত্ত্ব থেকে আমরা এখন জানি যে, আমাদের এই মহাবিশ্ব একটি ‘কোয়ান্টাম ঘটনা’ হিসেবেই একসময় আত্মপ্রকাশ করেছিল। কাজেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মূল সূত্রগুলো মহাবিশ্বের উৎপত্তির সময়ও একইভাবে প্রযোজ্য হবে, সে আর নতুন কী! সেটা করতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা দেখলেন শূন্য থেকে মহাবিশ্বের আবির্ভাব কেবল সম্ভব তা-ই নয়, রীতিমতো অবশ্যম্ভাবী। সেজন্যই ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে স্টিফেন হকিং ও স্লোডিনো বলেছেন বহুল পঠিত এই উক্তিতে –

মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্রের মতো পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র কার্যকর রয়েছে, তাই একদম শূন্যতা থেকেও মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্ভব এবং সেটি অবশ্যম্ভাবী। ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপত্তি’ হওয়ার কারণেই ‘দেয়ার ইজ সামথিং, রাদার দ্যান নাথিং’, সে কারণেই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের। মহাবিশ্ব উৎপত্তির সময় বাতি জ্বালানোর জন্য ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই। আসলে কোয়ান্টাম শূন্যতা অস্থিতিশীল বলেই সেখানে ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপত্তি’র মাধ্যমে বস্তুকণার উদ্ভব অবশ্যম্ভাবী। ব্যাপারটি খোলাসা করেছেন লরেন্স ক্রাউসও তাঁর সাম্প্রতিক ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইয়ে (‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’, পৃষ্ঠা ১৬৯) :

কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির ক্ষেত্রে মহাবিশ্ব শূন্য থেকে উদ্ভূত হতে পারে, এবং হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সে সমস্ত মহাবিশ্ব ফাঁকা হবার দরকার নেই, তাতে পদার্থ ও শক্তি থাকতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না এর মাধ্যাকর্ষণের সাথে যুক্ত ঋণাত্মক শক্তিসহ এর সর্বমোট শক্তি শূন্য হবে।

এবং ক্রাউসের সুচিন্তিত উপসংহার (‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’, পৃষ্ঠা ১৭০) – ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার। কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ কেবল মহাবিশ্বকে শূন্য থেকে উদ্ভূত হতে অনুমতি দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, একেবারে অবশ্যম্ভাবী করে তুলে। কারণ, স্থানকালের অবর্তমানে যে শূন্যাবস্থার কথা আমরা বলছি সেটা একেবারেই আনস্টেবল বা অস্থিতিশীল।

একই ধারণার প্রতিফলন আমরা দেখি পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেঙ্গরের বিভিন্ন বইয়ে এবং প্রবন্ধে। তিনি তাঁর ‘কমপ্রিহেনসিবল কসমস’ বইয়ে দেখিয়েছেন যে, কোনো কিছু থাকা এবং না থাকার সম্ভাবনার ব্যাপারটি আসলে গণনা করা সম্ভব, এবং থাকার সম্ভাবনা ষাট শতাংশেরও বেশি পাওয়া যায়। অধ্যাপক স্টেঙ্গার তাঁর প্রবন্ধটি শেষ করেছেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক উইলজেকের পেপার থেকে উদ্ধৃতিটি হাজির করে, যেখানে তিনি অভিমত দিয়েছেন ‘নাথিং ব্যাপারটা অস্থিতিশীল’।

সংশয়বাদী দার্শনিক মাইকেল শারমার সম্প্রতি ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান এবং তাঁর সম্পাদিত ‘স্কেপ্টিক’ পত্রিকায় এ নিয়ে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন। স্কেপ্টিক পত্রিকায় প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে কেন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে এই রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে অন্তত বারোটি সমাধান হাজির করেছেন। তার মধ্যে ধার্মিকদের ‘ঈশ্বর অনুকল্প’টি বাদ দিলে শারমার আরো যে এগারোটি সমাধান হাজির করেছেন তার সবগুলোই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের দেওয়া বৈজ্ঞানিক সমাধান, যেগুলোতে অপার্থিব ও অলৌকিক কোনো সত্তা আমদানি না করেই ব্যাপারটিকে মোকাবিলা করা যায়। এর মধ্যে যে সমাধানটিকে সবচেয়ে শেষে রেখেছেন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সমাধান বলে মত দিয়েছেন শারমার ‘শূন্যতা অস্থিতিশীল’।

বোল্ড করা অংশটির মূল ইংরেজি পেপারে ছিল এরকম “The answer to the ancient question ‘Why is there something rather than nothing?’ would then be that ‘nothing’ is unstable.

এ প্রসঙ্গে স্টিফেন হকিং তাঁর ‘গ্র্যন্ড ডিজাইন বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে লিখেছেন (অনুবাদ তানভীরুল ইসলাম) ‘যদিও আমরা এখনো কোয়ান্টাম মহাকর্ষের কোনো পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব পাইনি, তার পরও আমরা জানি, মহাবিশ্বের সূচনা একটি কোয়ান্টাম ঘটনা। ফলে, আমরা যেভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাকে বিশেষভাবে মিলিয়ে মহাস্ফীতির তত্ত্ব নিরূপণ করেছি, সেভাবে যদি আরো অতীতে যাই এবং মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কেই জানতে চাই, তাহলেও অবশ্যই সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সম্পর্কে আমর যা কিছু জানি তার সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মেলাতে হবে।

Victor Stenger, God: The Failed Hypothesis. How Science Shows That God Does Not Exist, Prometheus Books; Reprint edition, 2008 Victor Stenger, Why Is There Something Rather Than Nothing?,CSI, Volume 16.2, June, 2006

Victor Stenger, God: The Comprehensible Cosmos: Where Do the Laws of Physics Come From?, Prometheus Books; 2006

Michael Shermer, Much Ado about Nothing, Scientific American, April 27, 2012.

Michael Shermer, Nothing is Negligible: Why There is Something Rather than Nothing, Skeptic, Vol 17, No. 3, 2012.

আমরা আমদের এই বইয়ে গণিতবিদ ও জ্যোতিঃপদার্থবিদদের আধুনিক ধারণাগুলোর সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছি। সেজন্যই এ বইটিতে আমরা গণিতের শূন্যতা এবং পদার্থবিজ্ঞানের শূন্যতা নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করেছি। আলোচনা করেছি মহাবিশ্বের উৎপত্তির সাম্প্রতিক ধারণাগুলো নিয়ে; বিশেষত দীর্ঘ পরিসরে সাম্প্রতিক স্ফীতি তত্ত্ব (inflation theory) নিয়ে। স্ফীতি তত্ত্বকে অধিকাংশ মূলধারার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরাই মহাবিশ্বের উৎপত্তির রহস্য সমাধানের সবচেয়ে জোরালো তত্ত্ব বলে আজ মেনে নিয়েছেন। সুগ্রন্থিত এ তত্ত্বের আলোকে দেখানো যায়, শুরুতে শূন্যতা থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত দশা পরিবর্তনের (phase transition) মাধ্যমে পদার্থের উদ্ভব ঘটা সম্ভব, এবং বাস্তবে হয়তো সেভাবেই মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে। ব্যাপারটি অস্বাভাবিকও নয়, অবৈজ্ঞানিকও নয়। মহাবিশ্বকে যেহেতু কোয়ান্টাম শূন্যতার মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হতে হয়েছে, তাই তার উদ্ভব ঘটেছে কোয়ান্টাম স্তরের ‘অস্থিতিশীলতা’ সামলিয়েই। আমরা আমাদের বইয়ে দেখিয়েছি যে, ‘কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’ – এটা কোনো ধর্মীয় কিংবা দার্শনিক প্রশ্ন নয়, এটা একান্তভাবেই একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন। বিগত কয়েক শতকে বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি ঘটেছে, তার নিরিখে আমরা বলতে পারি, আমরা এ প্রশ্নকে মোকাবিলা করতে সক্ষম, এবং তা বৈজ্ঞানিকভাবেই। আসলে এ ধরনের প্রশ্ন মোকাবিলায় এতো দিন যে সনাতন ছবিটি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হতো, সেটা এরকমের–

আমাদের বইয়ের মাধ্যমে অস্তিত্বের ব্যাখ্যা হিসেবে যে নতুন বৈজ্ঞানিক ছবিটি আমরা পাঠকদের কাছে নিবেদন করেছি সেটার সারমর্ম হলো এরকমের –

কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকানুনের কথা মাথায় রাখলে কিছু ‘না থাকার’ অবস্থা থেকে ‘কিছু থাকার’ পরিস্থিতিতে পৌঁছানো যায় সহজেই। আর এটা তদারকির জন্য আমাদের ঈশ্বর নামে কোনো মধ্যস্বত্ত্বভোগী ওপরওয়ালার দরকার নেই; প্রাকৃতিকভাবেই এটা সম্ভব। কারণ আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে শূন্যতা ব্যাপারটি মোটাদাগে অস্থিতিশীল।

এবং এটাই ‘বিজ্ঞানের চোখে’ আমাদের অস্তিত্বের মূল কারণ। এই জন্যই কিছু একদম না থাকার বদলে কিছু আছে বলে আমরা জানি। অন্তত আধুনিক বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখলে সেটাই ‘আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে’ এখন পর্যন্ত পাওয়া সর্বশেষ উত্তর।

 

শেষ কথা

আমাদের বইটি শূন্য নিয়ে। শূন্য নিয়ে আমাদের এই আলোচনা আবর্তিত হয়েছে মূলত দুটি এলাকা ঘিরে—একটি হলো গণিতের শূন্যতা, আর অন্যটি পদার্থবিজ্ঞানের। গণিতের শূন্যতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই এসেছে শূন্য সংখ্যাটির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা। শূন্য সংখ্যাটা আমাদের কাছে এখন এতই স্বাভাবিক যে প্রাইমারি স্কুলের ছেলেপিলেদের শূন্য সম্বন্ধে জিজ্ঞেসা করলে হেসে গড়িয়ে পড়বে। একদিন কিন্তু তা এরকম ‘জলবৎ তরলং’ ছিল না। আসলে শূন্য বলে কোনো কিছু আমাদের সংখ্যার সাম্রাজ্যে ছিলই না। ব্যাপারটা যে অস্বাভাবিক তাও বলা যাবে না অবশ্য। এমন তো নয় যে প্রাত্যহিক জীবনে এর বিশাল কোনো ব্যবহার আছে। জমিজমা কিংবা সন্তানসন্ততির হিসাব রাখতেই হোক,কিংবা হোক না বিয়ারের ক্যান খালি করতে, কিংবা বাজার থেকে কলা কিনতে কেউ শূন্যের ঝামেলায় যায় না; যেতে হয় না। এ নিয়ে বইয়ের প্রথমদিকে আমরা বলেছিলাম খেতের চাষিকে কখনো ‘শূন্য’সংখ্যক বীজ বপন করতে হয়না, ‘শূন্য’ গরুর দুধ দোয়াতে হয় না, কিংবা হতে হয় না ‘শূন্য’ সন্তানের মৃত্যুতে কাতর। কাজেই শূন্য সংখ্যার উপকারিতা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে।

সময় লাগার আরও একটা বড় কারণ শূন্য সংখ্যাটির প্রকৃতি। আমরা দেখেছি, শূন্য সংখ্যাটা অন্য সব সংখ্যার মতো নয়। যেকোনো সংখ্যাকে নিজের সাথে যোগ করলে সংখ্যার মান বাড়ে। যেমন ১ কে ১-এর সাথে যোগ দিলে আমরা পাই ২। ২-এর সাথে ২ যোগ করলে আমরা পাই ৪ । কিন্তু শূন্যকে শূন্যের সাথে যোগ দিলে কেবল শূন্যই পাওয়া যায়। ব্যাপারটা সংখ্যার সর্বজনীন ধর্মের বিরোধী যেন। সে নিজে বাড়তে চায় না, এমনকি অন্য সংখ্যাকেও বাড়তে দেয় না। ২-এর সাথে ০ যোগ করুন। আপনি পাবেন ২। অথচ শূন্যের ক্ষেত্রে ফলাফল দেখে মনে হবে, কেউ কখনো কোনো কিছু যোগ করার চেষ্টাই করেনি যেন। আর পূরণ ভাগের ক্ষেত্রে এই রহস্য যেন আরও ব্যাপক। শূন্য আমাদের তাড়া করে ফেরে অশরীরী সত্তর মতোই। যেকোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে কেবল শূন্যই পাওয়া যায়, সেটা যত বড় কিংবা ছোট সংখ্যা যা-ই হোক না কেন। আর শূন্য দিয়ে ভাগ করতে গেলে যেন অঙ্কের জানা সব কাঠামোই ভেঙে পড়তে চায়।

শূন্যের এই রহস্যময় ব্যাপারস্যাপারগুলো প্রাচীনকালের দার্শনিকদের ভীতবিহ্বল করে তুলেছিল। তাই আমরা ইতিহাসের একটা বড় সময়জুড়ে শূন্যকে ঠেকানোর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করি, অন্তত পশ্চিমে তো বটেই। গণিতবিদ পিথাগোরাস আর তাঁর অনুরক্ত বাহিনী মিলে একধরনের ‘কাল্ট’ই গড়ে তুলেছিলেন তথাকথিত শূন্য আর অমূলদ সংখ্যা ঠেকাতে। তাঁদের ধারণা ছিল, প্রকৃতির পবিত্র সুসামঞ্জস্য বজায় রাখতে হলে এইটাই করণীয়। কিন্তু প্রকৃতি তো এত সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার বহু বৈশিষ্ট্যেই, বহু কাঠামোতেই খুঁজলে অমূলদ সংখ্যা বেরিয়ে আসে। বেচারা হিপসাসকে প্রাণ দিতে হয়েছিল এই গুমোর ফাঁস করে দেওয়ার জন্য। তাই আমরা দেখি, খ্রিষ্টের জন্মেরও বহু আগে ব্যাবিলনে শূন্যের ধারণার উদ্ভব ঘটলেও কিংবা মায়া সভ্যতায় এবং তাদের বিখ্যাত ক্যালেন্ডারে এর নিদর্শন থাকলেও পশ্চিম শূন্যকে গ্রহণ করেনি। শূন্যকে পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত করতে আসলে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো। পিথাগোরাসের জ্যামিতি থেকে শুরু করে, ভারতীয়-আরবীয় সংখ্যাপদ্ধতি, জেনোর ধাঁধা, সুবর্ণ অনুপাত, ফিবোনাচির রাশিমালা, লিমিট, লোপিতালের সূত্রসহ বহু সিঁড়ি পার হয়ে, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আমরা শূন্যের সঠিক ব্যবহার করায়ত্ত করেছি।

পিথাগোরাসের মতো অ্যারিস্টটলের কাছেও শূন্যতার ব্যাপারটি ছিল অগ্রহণীয়। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতিতে শূন্যতা থাকতে পারে না (‘Nature abhors a vacuum’)। একটা সময় অ্যারিস্টটলের এ সমস্ত বাণীকে দেখা হতো যেন সাক্ষাৎ দৈববাণী হিসেবে। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ছিল বিশাল। সেজন্য পদার্থবিজ্ঞানের জগতেও শূন্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ঢের ঘাম ঝরাতে হয়েছে। পিথাগোরাসের মতো অ্যারিস্টটলের অনুগত বাহিনীও প্রায় দুই হাজার বছর ধরে শূন্যকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। শূন্যতাকে সে সময় দেখা হতো ‘ব্লাসফেমি’ হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানী টরিসেলি পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, শূন্যতা ইচ্ছে করলেই তৈরি করা যায়। এখনকার স্কুল-কলেজের বিজ্ঞানের বইগুলোতেও টরিসেলির সেই ভ্যাকুয়ামের ছবি দেখি হরহামেশাই। বিজ্ঞানী প্যাস্কালও পানি আর পারদ নিয়ে টরিসেলির মতো পরীক্ষা করেছিলেন। টরিসেলির শিক্ষক বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি সাকশন পাম্প নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে অনেক আগেই দেখেছিলেন, পাম্প দিয়ে ১০ মিটারের বেশি উচ্চতায় পানি তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এর বেশি উচ্চতায় পানি তুলতে গেলে সাকশন টিউবে তৈরি হবে ভ্যাকুয়াম। তিনিই পরে টরিসেলিকে তাঁর পরীক্ষাটি পারদ নিয়ে করার বুদ্ধি দিয়েছিলেন। শিক্ষকের প্রস্তাবমতো সুযোগ্য ছাত্র টরিসেলি ১ মিটার লম্বা একটা টিউবে পারদ পূর্ণ করে একটি পারদপূর্ণ বাটিতে টিউবটি খাড়া করে দেখেছিলেন পারদ টিউবের মধ্যে এভাবে খাড়া হয়ে থাকতে পারে ৭৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। তার ওপরে ২৪ সেন্টিমিটার উচ্চতার ‘খালি জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে ভ্যাকুয়াম। আরেক বিজ্ঞানী এবং জার্মান শহরের মেয়র অটো ভন গুয়েরিক শূন্যতা তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি দেখিয়েছিলেন শুধু দুটো ব্রোঞ্জের গোলকের ভেতরের বাতাস বের করে দিলে তা এমন শক্তভাবে আটকে থাকে যে বিপরীত দিক থেকে আটিটি করে ঘোড়া জোরা দিয়ে টানাটানি করলেও তা খোলা যায় না। আজ আমরা জানি অটো ভন গুয়েরিকের বানানো সেই শূন্যস্থানের ওপর আসলে ক্রিয়া করছিল প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ১০ টন ওজনের অমানুষিক চাপ। আর এই চাপ আসছিল আসলে আমাদের চারপাশের বায়ুমণ্ডল থেকে। এই পরীক্ষাগুলোর কথা আমরা স্কুলেই পড়েছি।

কিন্তু স্কুল-কলেজের বইগুলোতে আমরা যা পাইনি তা হলো শূন্যতার আধুনিক ধারণার সাথে পরিচিত হতে। আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এসে যেন নতুন করে শূন্যতাকে সংজ্ঞায়িত করেছে। স্কুল-কলেজের বইপত্রে টরিসেলি বা অটো ভন গুয়েরিককের শূন্যতার যে বর্ণনা আমরা পেয়েছিলাম, তা আসলে প্রকৃত শূন্যতা ছিল না। আমরা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং পরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা থেকে দেখেছি, আমাদের মহাবিশ্বের সকল পদার্থ বিলীন করে দিলেও আমরা ‘প্রকৃত শূন্যতা’র হদিস পাই না, পাব না। মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থকে রাতারাতি উধাও করে দেয়া ব্যবহারিকভাবে সম্ভব ও হয়তো নয়; কিন্তু আমরা সেটা আমাদের মানস পরীক্ষার সাহায্যে করতে পারি। মনের আঙিনা থেকে মহাবিশ্বের প্রতিটি নক্ষত্র, প্রতিটি গ্রহ, গাছপালা, পাহাড়পর্বত, মানুষজন, পশু- পাখি থেকে শুরু করে প্রতিটি পদার্থ, প্রতিটি কণা, প্রতিটি প্রতি-কণা একে একে বিলীন করে দিতে পারি আমরা। কিন্তু কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব অনুযায়ী এভাবে মই বেয়ে একদম নিচে নেমে আসলেও শূন্য শক্তির দেখা আমরা পাব না। মইয়ের একদম তলায় শূন্যস্থান বলে কথিত যে জায়গার হদিস আমরা পাই, সেখানে নেমেও আমরা দেখি তার মধ্যে কিছু শক্তি লুকিয়ে আছে। এটাই সেই ‘জিরো পয়েন্ট এনার্জি’। এই ‘জিরো পয়েন্ট এনার্জি’ আছে বলেই শূন্যস্থানকে আমরা শান্তভাবে পড়ে থাকতে দেখি না, বরং দেখি অনবরত ‘ফ্লাকচুয়েট’ করতে।

অর্থাৎ, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী, শূন্যতা মানে আক্ষরিক অর্থে শূন্য নয়। শূন্যস্থানে প্রতিনিয়ত চলছে কণা ও প্রতিকণার সৃষ্টি ও ধ্বংসের নিরন্তর খেলা। যে শূন্যদেশকে আমরা আপাত দৃষ্টিতে শান্ত, সমাহিত বলে মনে করেছিলাম, তার মধ্যে নিহিত শক্তি থেকে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে পদার্থকণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হচ্ছে, আবার তারা নিজেকে সেই শক্তিতে বিলীন করে দিচ্ছে। ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের বাস্তব প্রমাণ আমরা পেয়েছি কয়েক দশক আগেই বিজ্ঞানীদের করা ‘ল্যাম্ব শিফট’ কিংবা ‘কাসিমিরের পরীক্ষা’ থেকে খুব জোরালো-ভাবে।

আধুনিক ‘কোয়ান্টাম জ্যোতির্বিদ্যা’– যেটাকে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী জন গ্রিবিন অভিহিত করেছেন ‘নিউটনের পর বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন’ হিসেবে–সে শাখার গবেষকদের পাওয়া ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এই ধরনের ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’ থেকেই আমাদের এই মহাবিশ্ব আত্মপ্রকাশ করেছিল প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে। অর্থাৎ, এই বিপুলা মহাবিশ্বের আবির্ভাব স্রেফ শূন্য থেকে কোয়ান্টাম ঝলকানির মাধ্যমে। এ তত্ত্ব থেকে আমরা আরও জানতে পেরেছি, মহাবিশ্বের উদ্ভবের পর ১০ সেকেন্ড পরে এর তাপমাত্রা ছিল ১০২৭ ডিগ্রির মতো। এ সময় ভ্যাকুয়ামকে বিভিন্ন ধরনের ‘ফেজ ট্রাঞ্জিশন’-এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, ত্বরান্বিত হয়েছিল প্রতিসাম্যের ভাঙন। প্রকৃতির মৌলিক বলগুলো পৃথক হয়ে গিয়েছিল এভাবেই। যেমন, যখন তাপমাত্রা ১০১৫ ডিগ্রির কাছাকাছি চলে আসল, তখন তাড়িত চুম্বক এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল আলাদা সত্তা হিসেবে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। এগুলোর পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, ১০-১২ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে ভ্যাকুয়াম আরো শীতল হলে হিগস ক্ষেত্র ‘ঠান্ডায় জমাটবদ্ধ’ হয়ে প্রসারিত করেছিল উপপারমাণবিক কণাদের ভরপ্রাপ্ত হবার সুযোগ (সম্প্রতি সার্নের বিজ্ঞানীদের হিগস কণার সন্ধান লাভ এই তত্ত্বকে আরো জোরালো করেছে)।

একটা সময় মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে আরো শীতল হয়েছে, মহাজাগতিক বিবর্তনের ক্রমধারায় তৈরি হয়েছে ছায়াপথ, নীহারিকা, নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ। বিগ ব্যাং নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছিলাম, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম কিংবা লিথিয়ামের মত মৌল মহাবিশ্বের উদ্ভবের উষালগ্নে তৈরি হলেও আমাদের

John Gribbin, Q IS FOR QUANTUM: An Encyclopedia of Particle Physics, Touchstone, 2000

জীবনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে মৌলগুলো কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন কিংবা লৌহ – এরা কিন্তু সে সময় তৈরি হয়নি। এগুলো তৈরি হয়েছে অনেক অনেক পরে কোনো-না কোনো নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ থেকে। বলেছিলাম, ‘আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান, আমাদের সবার দেহ তৈরি হয়েছে কেবল নাক্ষত্রিক ধূলিকণা দিয়ে’। এখন কোয়ান্টাম জ্যোতির্বিদ্যা ও স্ফীতি তত্ত্ব থেকে পাওয়া ফলাফলগুলো সত্য হলে এ-ও আমরা বলতে পারি, আমাদের অস্তিত্ব সম্ভবপর হয়েছে শূন্যতার মাঝে কোয়ান্টাম ঝলকানির কারণেই। সে হিসেবে নিঃসীম শূন্যতার মাঝে হঠাৎ ঘটা নান্দনিক কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনই যেন আমাদের হারানো প্রপিতামহ।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এ ধরনের মহাবিশ্বকে দীর্ঘকাল টিকে থাকতে হলে এর মোট ‘ভার্চুয়াল শক্তি’ হতে হবে শূন্যের কাছাকাছি। আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। আমাদের মহাবিশ্বে ধনাত্মক শক্তি ও ঋণাত্মক শক্তির যোগফল সর্বদা শূন্যই পাওয়া যায়। একইভাবে মহাবিশ্বের ঘূর্ণন কিংবা নেট চার্জ পরিমাপ করেও দেখা গেছে এদের মান থাকে শূন্য। অর্থাৎ পুরো মহাবিশ্বটাই যেন শূন্য থেকে পাওয়া, যাকে বিজ্ঞানী অ্যালেন গুথ অভিহিত করেন ‘আল্টিমেট ফ্রি লাঞ্চ’ অভিধায়।

এখন কথা হচ্ছে শূন্য থেকে মহাবিশ্বের মতো অতিকায় কিছুর উদ্ভব যদি এতই স্বাভাবিক হতো, তাহলে আমরা সচরাচর শূন্য থেকে কোনো কিছুর আবির্ভাব ঘটতে দেখি না কেন? মুক্তমনায় মহাবিশ্বের উদ্ভব নিয়ে লেখাটির শেষ পর্ব প্রকাশের পর এ ধরনের প্রশ্ন অনেক পাঠকের কাছ থেকে এসেছে। এ ধরনের প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিকই। এ ক্ষেত্রে আমাদের উত্তর হচ্ছে, ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের ব্যাপারটা কেবল ‘এম্পটি স্পেসে’ হয়। আমাদের বিশ্বজগৎ এখন আর শূন্য নেই – পদার্থ এবং তার তেজস্ক্রিয়তা প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে। তবে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরে শূন্যস্থানে হয়তো এভাবে ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে অনবরত মহাবিশ্ব তৈরি হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, স্ফীতি তত্ত্বের সর্বাধুনিক ভাষ্য ‘চিরন্তন স্ফীতি’ আর স্ট্রিং তত্ত্বের গণনাগুলো যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে উদ্ভূত মহাবিশ্বের সংখ্যা একটি-দুটি নয়, অসীম-সংখ্যক।

কেন শূন্যতা থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হতে পারে? আমরা যে শূন্যতার কথা বলছি সেখানে ভর নেই, শক্তি নেই, স্থান নেই, সময় নেই, ঘূর্ণন নেই, ইলেকট্রন নেই, প্রোটন নেই, বোসন নেই, ফার্মিয়ন নেই একেবারে যাকে বলে অবারিত নিঃসীম শূন্যতা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এ ধরনের শূন্যতা ‘অস্থিতিশীল’। তাঁরা মনে করেন, এ ধরনের শূন্যতা থেকে প্রতিসমতার ভাঙনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের উদ্ভব ‘অবশ্যম্ভাবী’। বহুদিন আগে অ্যারিস্টটল যে উক্তি করেছিলেন, ‘প্রকৃতি শূন্যতাকে পছন্দ করে না’ তা মাঝে ভুল প্রমাণিত হলেও, সেটা কোয়ান্টাম জগতের জন্য আবার যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে।

আসলে শূন্যতা আমাদের অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শূন্যতার মাধ্যমেই আমাদের অস্তিত্ব প্রকাশমান, হয়তো শূন্যতার মাঝেই আমরা সবাই হব বিলীন একদিন। আমাদের অস্তিত্বকে ঠিকমতো বুঝতে হলে শূন্যতাকে বোঝা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। জীবনানন্দ দাশকে উদ্ধৃত করেই শেষ করি বইটি –

‘আমি তারে পারি না এড়াতে

সে আমার হাত রাখে হাতে;

সব কাজ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়,

সব চিন্তা – প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয়’!

♦ ড. মিজান রহমান

♦ অভিজিৎ রায়

♦ ভূমিকা

♦ শূন্য অধ্যায়ঃ অশূন্য মতামত

♦ প্রথম অধ্যায়ঃ কিছু না

♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি

♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে

♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে

♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?

♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস

♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব

♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি

♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা

♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?

♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি

♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে

♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি

♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন

♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?

“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!