পঙ্গু হামিদের বয়স ষাটের কাছাকাছি। চামড়া ঝুলে গেলেও শক্ত-সমর্থ। এখনো ঝুনা নারিকেলের খোসা মুহূর্তের মধ্যে খুলে ফেলতে পারে। গত কোরবানির সময় সে গরুর সিনা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে, তেমন অসুবিধা হয় নি। তার একটাই অসুবিধা, সে হাঁটাচলা করতে পারে না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হুইল চেয়ারে যেতে হয়। হুইল চেয়ারটা দুবছর আগের, তবে এখনো নতুন। প্রতিদিন হামিদের ছেলের বৌ ঝাড়পোছ করে। কাউকে হাত দিতে দেয় না। অনেকেই দেখতে আসে। আগ্রহ নিয়ে বলে, সাইকেল চিয়ারটা একটু দেখাও। চলে ক্যামনে? মেশিং আছে?
হামিদের ছেলের বৌ মর্জিনা অহঙ্কারী গলায় বলে, মেশিং নাই, হাতে চলে।
আচানক জিনিস বানাইছে গো। কোমর ভাইঙ্গা পইড়া থাকলেও অসুবিধা নাই, সাইকেল চিয়ারে কইরা ঘুরবা। জিনিসটার দাম কত?
দাম কত জানি না। চেয়ারম্যান সাব সরকার থাইকা বন্দোবস্ত কইরা দিছেন। সাথে খোরাকির টেকাও পাইছেন। কত জানি না।
মর্জিনা জানে না কথাটা ঠিক না। খোরাকির টাকা মাসে একশ করে পাওয়া যায়। প্রতি তিন মাস পরে পরে চেয়ারম্যান সাহেবের খাতায় টিপসই করে টাকা আনতে হয়।
এলাকার চেয়ারম্যান হাজী শামসুদ্দিন চৌধুরী লোক ভালো। কৌশলের কাজকর্ম তার মতো কেউ জানে না। সে ছাড়া অন্যকেউ হামিদের জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করতে পারত না। ত্রিশ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, আর চেয়ার এসেছে সতের মাস আগে। হামিদ মুক্তিযুদ্ধে আহত হয় নাই। সে দুই বছর আগে কোমর ভেঙেছে কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে পিছলে পড়ে।
চেয়ারম্যান হাজী শামসুদ্দিন চৌধুরী তিন জায়গায় চিঠি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ
বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদ, দেশ নামের এক এনজিও।
তিনি লিখেছেন, যাদের জন্যে আজ স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হয়েছে, ছোরান্তর গ্রামের হামিদ তাদের একজন। আজ হামিদের পরিচয় পঙ্গু। কোমর ভেঙে সে বিছানায় শুয়ে আছে তিন বছর। ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সারা জাতি যখন আনন্দ-সাগরে ভাসে, তখন হামিদ ভাসে অশ্রুজলে।
মুক্তিযোদ্ধার সরকারি তালিকায় তার নাম নেই, কারণ সে নামের পিছনে ছুটে নাই। বিশেষ বিশেষ দিনে যখন অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা এসে তাকে কদমবুসি করে গলায় জবা ফুলের মালা পরিয়ে দেয় তখন সে বলে, আমার মানব জন্ম সার্থক।
স্বাধীন দেশে আমরা ছুটাছুটি করে বেড়াব, আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে হায়েনা হিসাবে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা হামিদ পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদবে। এই কি বিচার?
চেয়ারম্যান হাজী শামসুদ্দিনের জ্বালাময়ী প্রতিবেদন এবং নানান জায়গায় ছোটাছুটির কারণে দেশ এনজিও একটা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করেছে। সঙ্গে এককালীন দশ হাজার টাকা। হাজী শামসুদ্দিন হুইল চেয়ারটা দিয়েছেন, টাকাটা রেখে দিয়েছেন। তিনি হামিদকে বলেছেন, হুইল চেয়ারের সঙ্গে লোক দেখানো কিছু টাকাও দিয়েছে। সেই টাকা আর তোমাকে দিলাম না। হুইল চেয়ার রিলিজ করতে এরচেয়ে বেশি টাকা নিজের পকেট থেকে গেছে। বুঝেছ?
বিনয়ে গলে গিয়ে হামিদ বলেছে, বুঝেছি স্যার।
হাজী সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছেন, পাবলিকের সেবা করতে গিয়ে নিজে হচ্ছি পথের ফকির। এটা কপালের লিখন ছাড়া আর কিছু না। যাই হোক, চেষ্টায় আছি তোমার জন্যে বয়স্কভাতার ব্যবস্থা যাতে করা যায়। মাসে দুশ টাকা পাবে আজীবন। এর মধ্যেও ভেজাল আছে। কয়েকজনকে টাকা খাওয়াতে হবে। চারহাজার টাকা পান খাওয়ার জন্যে দিতে হবে। তুমি দুই হাজার দাও। বাকিটা আমি নিজের পকেট থেকে ম্যানেজ করব। পারবা না?
পারব চেয়ারম্যান সাব।
তোমাদের জন্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে–এখন আমরা যদি কিছু না করি সেটা হবে জাতির প্রতি বেইমানি।
এই ধরনের কথাবার্তা শুরু হলে চেয়ারম্যান সাহেব দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। আশেপাশে শ্রোতা থাকলে বক্তৃতা থামতেই চায় না, তখন হামিদ বড় অস্বস্তি বোধ করে। কারণ সে কোনোদিনই মুক্তিযুদ্ধ করে নাই। এরচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা, সে নাম লিখিয়েছিল রাজাকারে। তাদের কমান্ডারের নাম ছিল সিদ্দিক কমান্ডার। সিদ্দিক কমান্ডার ঠান্ডা মাথায় মানুষ জবেহ করত। এবং বলত–মানুষ জবেহ করার সময় খবরদার কেউ বিসমিল্লাহ বলবা না। শুধু বলবা আল্লাহু আকবার। যুদ্ধে যাবার সময়ও বিসমিল্লাহ বলে যাওয়া যায় না। তখনো বলতে হয় আল্লাহু আকবার। আবার ওষুধ খাওয়ার সময়ও বিসমিল্লাহ বলা যাবে না। বলতে হবে আল্লাহু শাফি। বুঝেছ সবাই? বুঝতে পারলে বুলন্দ আওয়াজে বলো, ইয়েস কমান্ডার।
তারা সবাই উঁচু গলায় বলত, ইয়েস কমান্ডার।
হামিদ যে রাজাকার দলে ছিল এটা তার অঞ্চলের কেউ জানে না। সংগ্রামের সময় সে ধানকাটার কাজ নিয়ে সিলেটের হাওর অঞ্চলে ছিল। সংগ্রাম শুরু হবার পর গাড়ি নৌকা সব বন্ধ। সে আটকা পড়ে। হাতে নাই পয়সা। মুক্তিতে যাওয়া যায়, কিন্তু মুক্তিতে টাকাপয়সা নাই। রাজাকারে গেলে সত্তর টাকা বেতন। লুটপাটের ভাগও আছে। এছাড়াও অন্য সুবিধা আছে। মিলিটারি এক অফিসার একবার ক্যাম্প দেখতে এসে তাদেরকে দুই বোতল বিলাতি দিলেন। আহা কী জিনিস! স্যরি ছিলেন লঞ্চে। তিনি বললেন, অল্পবয়সি দুটা মেয়েছেলে লাগবে। নানান ঝামেলা করে দুজন জোগাড় হলো। তারা স্যারের কাছে নিয়ে গেল। স্যার বললেন, আমার জন্যে তো চাই নাই। তোমাদের জন্যে চেয়েছি। তোমরা ফুর্তি কর। শুধু কাজ করলে হয় না। কাজের সাথে ফুর্তিও লাগে। বোতল খাও, বোতল নিয়া ফুর্তি কর। খাটি পাকিস্তানিদের জন্যে উপহার।
তারা দুজনকে নিয়ে ফুর্তি করতে পারে নাই। একজন কীভাবে যেন পালিয়ে গেল, অন্যটা পালাতে পারল না। তার নাম ছিল রাধা। চেহারা ভালো ছিল, তবে তেজ ছিল। আটদিন ছিল। আটদিনে কিছুই খায় নাই। এক ফোটা পানিও মুখে দেয় নাই। মেয়েটার ওপর হামিদের খানিকটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। সে অনেকবারই পানি খাওয়াতে চেষ্টা করেছে। যতবারই গেছে ততবারই বজ্জাত মেয়ে তার মুখে থুথু দিয়েছে। আসল হারামি। আদরের মর্যাদা বোঝে না।
দেশ স্বাধীনের পর সে একজোড়া বুটজুতা, খাকি শার্ট এবং প্যান্ট নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। এবং মিনমিনে গলায় বলেছে মুক্তিতে নাম লিখায়েছিলাম। যুদ্ধে জীবন গেছে। জান নিয়া ফিরতে পারব ভাবি নাই। সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
গ্রামের মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাকে যথেষ্টই সম্মান দিয়েছে। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব তাকে একদিন স্কুলে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, তুমি তোমার অভিজ্ঞতার গল্প এদের বললা। এরা শিখবে। দেশমাতৃকার মূল্য কী বুঝবে।
হামিদ বিড়বিড় করে বলল, এইসব পুলাপানের বিষয় না।
হেড স্যার বললেন, এরা যুদ্ধের মধ্যে বড় হয়েছে। সবই এদের বিষয়। এদের জানা দরকার।
হামিদ গলা খাঁকারি দিয়ে যুদ্ধের গল্প শুরু করল। কীভাবে তারা একটা লঞ্চ অ্যাটাক করে সাতজন মিলিটারি মারল এবং একটা হিন্দু মেয়ে উদ্ধার করল। যদিও সে শেষ পর্যন্ত বাঁচে নাই।
হেড স্যার বললেন, নাম কী ছিল মেয়েটার? হামিদ চাপা গলায় বলল, রাধা।
হেড স্যার বললেন, আহারে! সবাই উঠে দাঁড়াও, রাধা মেয়েটার জন্যে এক মিনিট নীরবতা।
সবাই উঠে দাঁড়াল। হেড স্যার বললেন, গলা ফাটায়ে বলো জয় বাংলা। গলা চিরে যেন রক্ত পড়ে।
জয় বাংলা!
হামিদ যুদ্ধের গল্প বলা বন্ধ করে দিয়েছে অনেকদিন। সে গল্প সেইভাবে বানাতেও পারে না। কী বলতে গিয়ে কী বলবে এটা নিয়ে ভয়ও থাকে। একবার তো প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিল। পত্রিকা থেকে এক লোক এসেছে ছবি তুলবে, ইন্টারভিউ নিবে।
ভাই, আপনি কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? আপনার সেক্টর কমান্ডারের নাম কী?
হামিদ থতমত খেয়ে বলল, লেখাপড়া জানি না তো ভাইসাহেব, কিছু ইয়াদও নাই। একবার মিলিটারির হাতে ধরা খাইলাম। তারা পায়ে দড়ি বাইন্ধা কাঁঠাল গাছে ঝুলায়া রাখল তিনদিন। তখনই মাথার গণ্ডগোল হয়েছে। কিছু মনে নাই।
যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তাদের নামও মনে নেই?
জে না। কিছুই ইয়াদ নাই। আমি আর কোনো কথা বলব না ভাইজান। কথা বললেই মাথায় যন্ত্রণা হয়।
এখন কিছুদিন হামিদের সত্যি সত্যি মাথার যন্ত্রণা হয়। মাথার যন্ত্রণা খুব বাড়লে সে চলে যায় কুয়াতলায়। কুয়াতলাটা পাকা। হুইল চেয়ার নিয়ে ঘুরতে আরাম। তাছাড়া বিশাল দুটা জামগাছ আছে। কুয়াতলা ছায়া হয়ে থাকে। গরমের সময় পাকা জাম টুপটাপ করে গায়ে পড়ে। গায়ে পড়া পাকা জামের স্বাদই আলাদা। কুয়াতলার একদিকে ঘুরে হামিদ, তার ঠিক অন্যদিকে ঘুরে তার নাতনি সুধা। সুধার বয়স আড়াই বছর। ফর্সা। গোলগাল মুখ। সুধীর মা সবসময় সুধীর চোখে কাজল এবং কপালে টিপ দিয়ে রাখে। যেন কেউ নজর দিতে না পারে।
সুধা আপন মনে রান্নাবাটি খেলে। বিড়বিড় করে হাত নেড়ে কথা বলে। হাসে। শুধু যখন হামিদ ডাকে, এই এই কাছে আয়– তখন সুধার চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। হামিদ যখন হুইল চেয়ার নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় তখন সে চট করে উঠে দাঁড়ায় এবং হামিদের দিকে থু করে থুথু দেয়ার ভঙ্গি করে।
এর কারণটা কী? দাদার সাথে একী ব্যবহার? হামিদ ইচ্ছা করলেই ছেলেকে ঘটনাটা বলতে পারে। মেয়ে তার বাবার হাতে কয়েকটা চড় খেলেই সহবত শিখবে। তবে হামিদ এখনো ছেলেকে কিছু বলে নি। ঘটনার কারণ বের করা দরকার। কারণ নিশ্চয়ই আছে।
এক দুপুরে হুইল চেয়ারে হামিদ বসা। হামিদের উল্টাদিকে সুধা খেলছে। দুজনের মাঝখানে কুয়া বলে তাকে দেখা যাচ্ছে না, তবে তার গলা শোনা যাচ্ছে। কী একটা ছড়া বলছে,
ও কুটকুট কই যাস?
ভাত নাই পান্তা খাস
পান্তায় আছে শিং মাছ
সইয়ের বাড়িত বড়ই গাছ।
হামিদ ডাকল, সুধা। ও সুধা।
সুধা বলল, চুপ।
হামিদ হুইল চেয়ার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চাকার ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। সুধা বলল, কাছে আসবি না, ছেপ দিমু।
হামিদ বলল, ছেপ কেন দিবা দাদু?
তুই পচা।
হামিদ থমকে গেল। মেয়েটার কথাবার্তা এরকম কেন? সে কি কিছু জানে? পুলাপানরা অনেক সময় অনেক কিছু জানে। ক্যামনে জনে বলা কঠিন। মেয়েটা আর কাউরে থুথু দেয় না। তাকে দেখলেই থুথু দেয়। রাধাও থুথু দিত। রাধার মুখও ছিল গোল। দুইজনের নামেরও মিল আছে। একজন রাধা আরেকজন সুধা। হামিদ সাবধানে হুইল চেয়ার নিয়ে এগুচ্ছে, এত সাবধানে যেন কোনো শব্দ পর্যন্ত হয়।
সুধা দাদাকে দেখে চমকে তাকাল। হামিদ বলল, দাদু, জাম খাইবা?
সুধা মুখ ভেংচি দিল। জিহ্বা বের করে সাপের মতো নাড়ছে। বদ মেয়ের এত বড় জিহ্বা? কেঁচি দিয়ে কচ করে জিহ্বাটা কেটে ফেললে মনটা শান্ত হতো। সেটা সম্ভব না। আদরের নাতনি। মেয়েটার বিষয়ে তার বাবা-মাকে বলা দরকার। শাসন করার দায়িত্ব বাবা-মার। দাদা-দাদির শাসন বাবা-মা নিতে পারে না।
রাতে খাবার সময় হামিদ বলল, বৌমা, মেয়েটারে একটু শাসন করা দরকার।
হামিদের ছেলের বউ মর্জিনা অবাক হয়ে বলল, আব্বাজান, শাসন করব কেন? এমন লক্ষ্মী মেয়ে। সারাদিন নিজের মনে খেলে।
হামিদ বলল, কিছু কিছু বাজে অভ্যাস হয়েছে। ছেপ দেয়। আবার মুখ ভেংচি দেয়।
কারে ছেপ দেয়?
আমারে।
বলেন কী! ঐ সুধা, সুধা। কাছে আয় দেখি। তুই দাদুরে ছেপ দেস?
হামিদ তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। কী জবাব দেয় শোনা দরকার। সুধা অবাক হয়ে একবার তার দীদার দিকে একবার তার মার দিকে তাকিয়ে বলল, না মা।
এমনভাবে বলেছে যে বিশ্বাস না করে উপায় নাই। বদ মেয়ে।
মর্জিনা বলল, আব্বাজান, আপনে মনে হয় ধান্দা দেখছেন। বয়সকালে মানুষ ধান্দা দেখে। সুধা মা, যাও দাদুরে আদর দেও। যাও।
হামিদ বিরক্ত মুখে বলল, আদর লাগবে না।
মর্জিনা বলল, অবশ্যই লাগবে। মা যাও। দাদুরে আদর দাও।
সুধা এগিয়ে গেল এবং থু করে থুথু ফেলল। হামিদ বলল, দেখলা কী করেছে?
মর্জিনা অবাক হয়ে বলল, কী করেছে?
ছেপ দিয়েছে দেখ নাই?
মর্জিনা বলল, ছেপ দেয় নাই। আপনি ভুল দেখছেন?
হামিদ নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করল। এরা কিছু বুঝতে পারছে না। রাধা যেভাবে গুথু দিত এই মেয়েও তাই করে। মেয়েটা দেখতেও রাধার মতো। গোল মুখ। নামেও মিল আছে–রাধা আর সুধা। সুধা নাম রাখা বোকামি হয়েছে। হিন্দুয়ানি নাম।
বয়সকালে মানুষের ঘুম কমে যায়। সারা রাত জেগে কাটাতে হয়। হামিদের হয়েছে উল্টাটা। রাতের ভাত খাওয়ার পর পরই তার ঘুম পায়। এক ঘুমে রাত কাবার। ঘুম আরামের হয় না, এই এক সমস্যা। আলতু-ফালতু স্বপ্ন। বেশির ভাগ স্বপ্নেই সিদ্দিক কমান্ডারকে দেখা যায়। স্বপ্নগুলি এত বাস্তব।
স্বপ্নে সিদ্দিক কমান্ডার এসে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। রাগী গলায় বলে, খবর পাইছি মুক্তি আসছে। আর তুই ঘুমে? হাতিয়ার কই? হাতিয়ার নিয়া বাইর হ দেখি। আইজ আমরার খবর আছে।
স্বপ্নের পরের অংশ বড়ই কষ্টকর। ভারি হাতিয়ার কাঁধে নিয়ে বনেজঙ্গলে কাদায়-পানিতে মুক্তির ভয়ে ছোটাছুটি।
মাঝে মাঝে রাধার বিষয়টা স্বপ্নে আসে। একটা গামছায় কোনোমতে শরীর ঢেকে রাধা ঘরের কোনায় বসে আছে। বাস্তবে তার হাত পেছনদিকে বাঁধা থাকত, স্বপ্নে হাত থাকে খোলা। হামিদ ঘরে ঢুকতেই রাধা বলে, আপনারে বাপ ডাকলাম। আপনি আমার ধর্ম বাপ। আমারে দয়া করেন। তখন সিদ্দিক কমান্ডারের কথা শোনা যায় স্বপ্নে সিদ্দিক কমান্ডার হঠাৎ উদয় হয় এবং চাপা গলায় বলে, সংগ্রামের সময় দয়া মায়া শ্বশুরবাড়িতে বেড়াইতে যায়। বুঝছ রাধা? আরেকটা কথা, সংগ্রামের সময় বাপ মিলিটারি, আর কেউ বাপ না। আমরারে বাপ ডাইক্যা লাভ নাই। এখন আমরা তোমার স্বামী। এক স্ত্রী সাত স্বামী। একেক স্বামী একেক পদের। প্রত্যেককে সোহাগ করবা। ছেপ যদি দেও পরে বুঝবা।
শেষের দিকে মুক্তিদের অবস্থা ভালো হয়ে গেল। বলতে গেলে রোজ রাত্রেই মুক্তি আসে। একদিন সিদ্দিক কমান্ডার বললেন, আইজ রাতে আমরা পালায় রাজানগর বাজারে চলে যাব। সেখানে মিলিটারির ঘাঁটি আছে। আমরা নিরাপদে থাকব। সব তৈয়ার থাক। রওনা দিব মাগরেবের ওয়াক্তে।
হামিদ বলল, রাধারে কী করবেন? ছাইড়া দিবেন, না সাথে নিয়া যাবেন?
সিদ্দিক বলল, ছাইড়া দিব কোন দুঃখে! এই মেয়ে আমাদের সবেরে চিনে। মুক্তির কাছে খবর দিবে। বুঝেছ ঘটনা? রাধারে বস্তায় ভইরা হাওরের পানিতে ফেলায়া যেতে হবে। দশ-বারোটা ইট দিবা বস্তার ভিতরে, যেন না ভাসে। আর কাজটা করবা হামিদ।
হামিদ বলল, আমি কী জন্যে করব?
আমি অর্ডার দিছি এইজন্যে তুমি করবা। কমান্ডারের অর্ডারের উপরে কোনো কথা নাই।
হামিদ কাজটা একা করে নাই। কমান্ডার সিদ্দিক সাহায্য করেছে। মেয়েটারে বস্তায় ভরতে বিরাট ঝামেলা হয়েছিল। সিদ্দিক কমান্ডারের হাত কামড় দিয়া করল রক্তারক্তি কাণ্ড।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পরেই কমান্ডার সিদ্দিক ধরা পড়েছিল মুক্তির হাতে। মুক্তির কমান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি সারাজীবনে কোনো ভালো কাজ কী করছ? একটা ভালো কাজের কথা বলো।
সিদ্দিক কমান্ডার বলেছে, ভালো কাজ কী করেছি, মন্দ কাজ কী করেছি আপনারে কেন বলব? এইটা তো রোজহাশর না। তবে আমার সঙ্গে যারা যারা ছিল প্রত্যেকের নাম ঠিকানা দিতেছি, পারলে এদেরও ধরেন। কাগজ-কলম আনেন, নাম লেখেন।
অনেকেই ধরা পড়েছে, হামিদ বাদ পড়েছে। আজ লোকজন তাকে সম্মান করে। ছোট ছোট পুলাপান পতাকা হাতে নিয়ে চিকন গলায় বলে, মুক্তিযোদ্ধা হামিদ জিন্দাবাদ। জীবনটা তার এইভাবে কাটবে সে নিশ্চিত। সমস্যা একটাই, সুধাকে দেখলেই মনে হয় সে সব জানে। রাধা যেভাবে থুথু দিত, সুধা মেয়েটাও সেভাবেই থুথু দেয়। মেয়েটা বড় হবার আগেই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। সিদ্দিক কমান্ডার বলতেন–যা ইচ্ছা করবা। প্রমাণ রাখব না। হামিদ নিজেও কোনো প্রমাণ রাখতে চায় না। প্রমাণ খারাপ জিনিস। তার নাতনি সুধা প্রমাণ ছাড়া কিছু না।
এক দুপুরে অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। কুয়াতলায় হামিদ হুইল চেয়ারে বসে আছে। এক ফোঁটা বাতাস নেই। কুয়ার অন্যপাশে সুধা খেলছে। কুটুর কুটুর পুটুর পুটুর করে নিজের মনে কথা বলছে। হামিদ হুইল চেয়ার নিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। তাকে দেখেই সুধা খেলা বন্ধ করে থু করে একদলা থুথু ফেলল। হামিদ হাত বাড়িয়ে সুধাকে ধরল। পরের ঘটনাগুলি মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। কুয়াতে ঝপাং করে ভারি কিছু পড়ার শব্দ হলো। হামিদ এক দুই তিন করে একশ পর্যন্ত গুনল। কুয়ার ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসছে না। হামিদ তখন আকাশফাটা চিৎকার দিল, বৌমা কই? বৌমা কই? আমার দাদু কুয়াতে পড়ে গেছে। বৌমা, ও বৌমা…।
“আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ” সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ