অভিজিৎ রায়
আধুনিক সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম ও নৈতিকতার বিশ্লেষণ
ছোটবেলায় এক ভদ্রলোকের বাসায় যেতাম। জ্ঞানী-গুণী কিন্তু রসিক মানুষ। পেশায় অধ্যাপক । আমার সাথে শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম আর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুব আগ্রহ ভরে আলোচনা করতেন। তাঁর বাড়ির নাম ছিল- ‘সংশয়’। আমি একদিন না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম- ‘সংশয়, কেন? উনি উত্তরে হেসে বললেন— ‘অভি, সংশয়ই হচ্ছে সকল জ্ঞানের উৎস । মানুষ চোখ কান বন্ধ করে যে যা বলেছে তা বিশ্বাস না করে সংশয় প্রকাশ করেছে বলেই আমাদের সভ্যতা আজ এত দূর এগিয়েছে।’ সত্যিই তাই। ইতিহাসের দিকে তাকান যাক। টলেমীর ‘পৃথিবী- কেন্দ্ৰিক’ মতবাদে কোপার্নিকাস আর গ্যালেলিওরা সংশয় প্রকাশ করতে পেরেছেন বলেই টলেমীর মতবাদ একসময় ভুল প্রমাণিত হয়েছে । পদার্থবিজ্ঞানীরা একসময় ‘ইথার’ নামক কাল্পনিক মাধ্যমটির অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বলেই পরবর্তীকালে আলোর প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে পদার্থ-বিজ্ঞানে জায়গা করে নিয়েছে প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন আর দ্য ব্রগলীর তত্ত্বগুলো। হাটন ৬০০০ বছরের পুরনো পৃথিবীর বয়সের বাইবেলের সংস্কারে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বলেই মিথ্যা বিশ্বাসকে সরাতে পেরেছিলেন মানুষের মন থেকে। এভাবেই সভ্যতা এগোয়। অনেকেই তর্ক করতে এসে নিজের বিশ্বাসের পক্ষে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন না; তখন খুব ভক্তি গদ গদ চিত্তে তোতাপাখীর মত আউড়াতে থাকেন বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যাওয়া নিরক্ত বাক্যাবলী- “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’ অথবা ‘মানলে তাল গাছ, আর না মানলে গাব গাছ।’ এ যেন ডুবন্ত মানুষের শেষ খড়কুটো আকড়ে ধরে অনেকটা যুক্তিহীনভাবেই অন্ধ-বিশ্বাসের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কিন্তু যারা এ ধরনের তারা বোঝেন না যে, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ এ ধরনের ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে আজও বোধ করি সূর্য পৃথিবীর চারিদিকেই ঘুরত। সভ্যতার অনিবার্য গতি আসলে বিশ্বাসের বিপরীতে, যুক্তির অভিমুখে; ক্যারেন আর্মস্ট্রং তাঁর The Battle for God বইয়ে যেটিকে একটু গুরুগম্ভীর ভাষায় বলেছেন- মিথোস্ থেকে লোগোস এর দিকে’ (১)। এ প্রসঙ্গে গৌতম বুদ্ধেরও একটি চমৎকার উক্তি রয়েছে – Doubt everything, and find your own light. গৌতম বুদ্ধের উক্তিটি যেন আধুনিক যুক্তিবাদীদের সংশয়ী দৃষ্টিভঙ্গীরই এক সংগঠিত রূপ- যেটি আসলে বলছে, কোন কিছুই বিনা প্রশ্নে মেনে নিও না! সেই একই সংশয়বাদী ভাবনার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই আধুনিক কালে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায়ঃ
“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায় ।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে ।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো ।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না ।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ পরিষ্কার করে।’
সংশয়বাদ নিয়ে সামান্য কটি কথা খুব হাল্কাভাবে হলেও প্রথমেই সেরে নেওয়া হল এই কারণে যে, আজ আমরা সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করব, ব্যবচ্ছেদ করে দেখব আমাদের সমাজের একটি বহুল প্রচলিত মিথকে, যেটি ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিখিয়েছে, ধর্ম পালন করা ছাড়া কখনই ভাল মানুষ হওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব নয় সচ্চরিত্রের অধিকারী হওয়া
ধর্ম ও নৈতিকতার জগাখিচুড়ি বনাম রূঢ় বাস্তবতা
প্রাচীনকাল থেকেই ঈশ্বরের প্রতি অগাধ আনুগত্য এবং ধর্ম বিশ্বাসকেই মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের একমাত্র অবলম্বন বলে মনে করা হয়েছে। পাশ্চাত্য বিশ্বে গোড়া খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা সংগঠিত হয়ে অনেক আগে থেকেই মগজ ধোলাই করতে শুরু করেছে এ কথা প্রচার করে যে, তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো আর তাদের ঈশ্বরই একমাত্র নৈতিকতা বিষয়ে শেষ কথা বলবার অধিকার রাখে । ধর্মগ্রন্থগুলোতে যেভাবে পথ দেখানো হয়েছে, সেগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ করাই হল নৈতিকতা (২)। আমাদের দেশি সংস্কৃতি তো আবার এসব ব্যাপারে সবসময় একধাপ এগিয়ে। অনেক বাসায় দেখেছি শৈশব থেকেই ছোট ছেলে মেয়েগুলোর মাথা বিগড়ে দিয়ে বাংলা শেখার আগেই বাসায় হুজুর রেখে আরবী পড়ানোর বন্দোবস্ত করান হয়, ধর্মকথা শেখান হয় আর নৈতিক চরিত্র গঠনের মূলমন্ত্র হিসেবে তোতা পাখীর মত আওড়ানো হয় ‘অ্যাই বাবু-এগুলো করে না- আল্লাহ কিন্তু গুনাহ দিবে।’ ছোটবেলা থেকেই এইভাবে নৈতিকতার সাথে ধর্মের খিঁচুড়ি একসাথে মিশিয়ে এমনভাবে ছেলে- পিলেদের খাওয়ানো হয় যে তারা বড় হয়েও আর ভাবতেই পারে না যে ধর্ম মানা ছাড়াও কারো পক্ষে ভাল মানুষ হওয়া সম্ভব । কিন্তু সত্যিই কি ধর্মের সাথে নৈতিক চরিত্র গঠনের কোন বাস্তব যোগাযোগ আছে? নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাত, কৃষ্ণ নাম, তবলিগ জামাত ইত্যাদির মাধ্যমে গণমানুষের নৈতিকতা উন্নয়নের যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের নামে মারামারি, হানাহানি, হিংসা, শোষণ, নির্যাতন, দারিদ্র্য আর সন্ত্রাসের বিস্তার দেখে বোঝা যায় যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস আসলে কোন বিশাল অনুপ্রেরণা হয়ে মানুষের মধ্যে কখনই কাজ করেনি। কারণটা অতি পরিষ্কার। ঈশ্বরে বিশ্বাসের মাধ্যমে মরালিটি বা নৈতিকতা অর্জনের চেষ্টা করা আসলে সোজা পথে ভাত না গিলে কানের চারিদিকে হাত ঘুরিয়ে ভাত খাওয়ার মতন। প্রত্যেক ধর্মই বলছে বিধাতা ভাল মানুষকে পুরস্কৃত করেন আর পাপী তাপী-নীতিহীনদের শাস্তি দেন। বোঝাই যায় পুরস্কারের লোভটাই এখানে মুখ্য । নৈতিকতা বাদ দিয়ে অন্য যেকোন উপায়ে আল্লাহকে তুষ্ট করে পুরস্কার বগলদাবা করতে পারলে কোন বান্দাই আর নৈতিকতা- ফৈতিকতার ধার ধারবে না। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, রাম-নাম, হরিবোল, পাঁঠা বলি, কোরবানী, নামাজ, হজ্জ, কোরান তেলাওয়াত, পূজা, যজ্ঞ এই সমস্ত ব্যাপার-স্যাপারগুলোর মাধ্যমে মানুষ আসলে নৈতিকতার কোন ধার না ধেরে বিধাতার তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টাতেই মত্ত। মানুষের প্রতি আর সমাজের প্রতি যাদের অবজ্ঞা আর প্রবঞ্চনা বেশি, তারাই কিন্তু বেশী- বেশী ‘আল্লা-আল্লা’ করে চ্যাচায়। কারণ ধর্মেই রয়েছে সমস্ত অ-কাজ, কু-কাজ করেও পার পাবার ঢালাও ব্যবস্থা। মক্কা, জেরুজালেম, পুরী, বারাণসী কি তিরুপতি, এসব পবিত্র স্থান দর্শনে রয়েছে জীবনের সব পাপ ধুয়ে গিয়ে পরকালে স্বর্গবাসী হওয়ার নিশ্চিন্ত গ্যারান্টি । কোটি টাকার চোরাকারবারী তাই ধুম-ধাম করে পূজা-যজ্ঞ করে নয়ত শেষ বয়সে এলাকায় মন্দির গড়ে দেয় ‘সমাজের ভালোর জন্য’।
উপরন্তু, যুক্তি আর বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে সমাজ সচেতন মানুষ আজ বুঝতে শিখেছে যে, ঈশ্বর এক অর্থহীন অলীক কল্পনা মাত্র। রাহুল সঙ্কৃত্যায়নের ভাষায়— ‘অজ্ঞানতার অপর নামই হল ঈশ্বর।’ কাজেই অজ্ঞানতাকে পুঁজি করে ঈশ্বর নামক মিথ্যা-বিশ্বাসের মূলা ঝুলিয়ে মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের কাহিনী আজ অনেকের কাছেই ‘শিশুতোষ ছড়া’ ছাড়া আর কিছু নয় । বার্ট্রান্ড রাসেল তার Why I am not a Christian’ গ্রন্থে বলেন (৩) :
‘ধর্ম সম্পর্কে দু ধরনের আপত্তি করা যায়- বৌদ্ধিক এবং নৈতিক। বৌদ্ধিক আপত্তি অনুসারে বলা যায় যে, কোন ধর্মকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই এবং নৈতিক আপত্তি অনুসারে বলা যায় ধর্মের উপদেশগুলো এমন সময় থেকে উঠে এসেছিল যখন মানুষ বর্তমান যুগের থেকেও অনেক নিষ্ঠুর ছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে এই উপদেশগুলো অমানবিকতাকে চিরন্তন করবার জন্যই তৈরি। যদি এই চিরন্তন ব্যাপারটি গ্রহণে মানুষকে বাধ্য না করা হত, তবে মানুষের নৈতিক বিবেকবোধ বর্তমানে আরো অনেক উন্নত হত ৷’
আমি একবার এক ওয়েব সাইটের জন্য ধর্ম এবং নৈতিকতার মধ্যকার বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। লেখা শুরু করতে না করতেই এক ধার্মিক ভদ্রলোক সেখানে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
‘শ্রী অভিজিৎ রায়দের মত ব্যক্তিবর্গ যুগ যুগ ধরে এসেছে এবং ভুত হয়ে চলে গেছে। এদের সম্পর্কে কোরানে উল্লেখ রয়েছে যে, তারা অন্ধ ও বর্বর। এদের হৃদয়ে সীলমোহর এঁটে দেওয়া আছে। তারা কিছুই দেখতে পায় না এবং শুনতে পায় না। শুধু প্রাণীর মত হাম্বা হাম্বা রব তোলে।’
কোরানে যদি সত্যই এমনটি বলা থাকে (এবং কোরানে সত্যই অবিশ্বাসীদের অন্ধ/বর্বর, এবং এদের হৃদয়ে যে সীলমোহর এঁটে দেওয়া আছে তা বলা আছে; দেখুন সুরা ২:৭, ৪:১৫৫, ৭:১০০, ৭:১০১, ৯:৯৩, ১৬:১০৮, ৩০:৫৯, ৪৫:২৩ ইত্যাদি) বলতেই হয় মহান সৃষ্টিকর্তার রুচিবোধ সত্যিই প্রশংসনীয়। কেবল ধর্ম মানি না বলেই ভদ্রলোক আমায় ‘অন্ধ’ ও ‘বর্বর’ বলেছেন, আর প্রমাণ স্বরূপ ‘সাক্ষী গোপাল’ মেনেছেন তার চির-আরাধ্য ওই ধর্মগ্রন্থকেই। শুধু যে কোরানেই অধার্মিকদের সম্বন্ধে এ ধরনের বিষোদগার করা হয়েছে তা ভাবলে ভুল হবে। শঙ্করাচার্য প্রমুখ দার্শনিকদের প্রাচীনকালের নাস্তিক্যবাদী চার্বাক দর্শনকে ‘লোকায়াত’ বা ইতর লোকের দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতাটির কথা এক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতেই পারে। এমনকি চার্বাক দর্শনের উৎপত্তি সম্বন্ধেও বলা হয় যে, মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাকের নাম থেকেই নাকি চার্বাক দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে। মহাভারতে আছে- চার্বাক ছিল দুর্যোধনের বন্ধু এক দুরাত্মা রাক্ষস। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জিতবার পর চার্বাক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে যুধিষ্ঠিরকে জ্ঞাতিঘাতী হিসেবে ধিক্কার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাহ্মণেরা তাদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাকের চালাকি ধরে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন। বোঝাই যায়, প্রাচীন ভাববাদীরা এই নাস্তিক্যবাদী দর্শনটির প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এমন ঘৃণ্য চরিত্রের রাক্ষসের সাথে দর্শনটিকে জুড়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। আরেকটি উদাহরণ দেখি।
মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্ৰাহ্মণকে ধাক্কা মেরে দিল। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমানের জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করল। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সঙ্কেত দেখতে পেয়ে শিয়াল সেজে হাজির হলেন । ব্রাহ্মণকে তার পশু জীবনের নানা দুঃখ-দুর্দশার কথা বলে মানবজীবনের জয়গান গাইলেন । জানালেন অনেক জন্মের পুণ্যের ফল সম্বল করে এই মানব জন্ম পাওয়া । এমন মহার্ঘতম জীবন আর তায় আবার ব্রাহ্মণ! এমন জীবন পাওয়ার পরও কি কেউ আত্মহত্যা করে? কাজেই অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শিয়াল নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছিল। কিন্তু সে জন্মে সে চূড়ান্ত মুর্খের মত এক মহাপাতকের কাজ করেছিল বলেই আজ এই শিয়াল জন্ম। চূড়ান্ত মূর্খের মত কাজটি কি? এই বারেই কিন্তু বেরিয়ে এল নীতি কথা—
অহমাংস পাণ্ডিতকো হৈতুকো দেবনিন্দকঃ ।
আস্বীক্ষিং তর্কবিদ্যম অনুরক্তো নিরার্থিকাম
হেতুবাদান প্রবদিতা বক্তা সুংসৎসু হেতুমৎ।
আফ্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ব্রাহ্মবাক্যেষু চ দ্বিজান্
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ
ভাস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ (শান্তিপর্ব ১৮০/৪৭-৪৯)
(অর্থাৎ, আমি ছিলাম এক বেদ সমালোচক পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচার সভায় ছিলাম তর্কবিদ্যার প্রবক্তা। যুক্তিবলে দ্বিজদের ব্রহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক, অর্থাৎ কিনা পাণ্ডিত্যাভিমানী মূৰ্খ । হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্ম।)
বোঝাই যায়, বৈদিক যুগেও যুক্তিবাদীদের সংশয়, অযাচিত প্রশ্ন আর অনর্থক তর্ক-বিতর্ক একটা ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠেছিল। ‘পাণ্ডিত্যাভিমানী মূর্খ’- এ ধরনের লেবেল এঁটে দিয়ে বেদ-সমালোচকদের প্রতিহত করার প্রচেষ্টা তারই ইঙ্গিত বহন করে। আজকেও কি এ দৃষ্টিভঙ্গীর খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে? যে ভদ্রলোকটি আমাকে ধর্মগ্রন্থের সমালোচনা করার জন্য ‘অন্ধ’ বা ‘বর্বর’ হিসেবে চিত্রিত করছেন, সে ধরনের লোকজনের কিন্তু আজো সমাজে অভাব নেই, নাস্তিক শুনলেই তারা খ্যাক করে ওঠেন— ‘ও তুমি নাস্তিক! তবে তো তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার! তোমার তো চরিত্র বলে কিছু নেই’। এরা আসলে নাস্তিকদের মানুষ বলেই মনে করেন না, ভাল-মানুষ ভাবা তো অনেক পরের কথা। কিন্তু, নাস্তিক মানেই কি অনৈতিক, চরিত্রহীন, লম্পট গোছের কিছু? এমনিভাবে ভাবার মোটেই কোন কারণ নেই। নাস্তিকরা আসলে নাকের সামনে থেকে ঈশ্বর নামক মূলাটি সরিয়ে বাস্ত বসম্মতভাবে ‘মরালিটি’ বা নৈতিকতাকে দেখবার পক্ষপাতি। ঈশ্বরের ভয়ে নয়, একটি সুন্দর এবং সুস্থ সমাজ গড়ে তুলবার প্রয়োজনেই মানুষের চুরি-দারি, লাম্পট্য, খুন, ধর্ষণ বিসর্জন দিয়ে সামাজিক মূল্যবোধগুলি গড়ে তোলা দরকার । নয়ত সমাজের ভিত্তি-মূলই যে একসময় ধ্বসে পড়বে! কাজেই অধার্মিকদের চোখে ‘নৈতিকতা’ বেহেস্তে যাওয়ার কোন পাসপোর্ট নয়, বরং নিতান্তই সামাজিক আবশ্যকতা। ধর্মান্ধরা যেহেতু সামাজিক মূল্যবোধের এই বিষয়গুলো একেবারেই বুঝতে চান না, তাই তাদের মধ্যে যুদ্ধ, দাঙ্গা, জিহাদ, মারামারি লেগেই আছে। ১৯৭১ সালের কথাই ধরা যাক। সারা বাংলা হত-বিহ্বল হয়ে দেখেছে কিছু ধর্মান্ধ মানুষ ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে কি করে পশুর স্তরে নেমে যেতে পারে ।
এক ভদ্রলোককে চিনতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সাতে-পাঁচে নেই; সাদা চোখে দেখলে নিতান্ত ভালমানুষ বলেই মনে হবে। কিন্তু ভূক্তভোগীরা জানেন যে একাত্তরে ভদ্রলোক এহেন দুষ্কর্ম নেই যা করেননি। সে সময় এমনকি তিনি ফতোয়া দিয়েছিলেন এই বলে যে, খান- সেনারা যদি কোন বাঙালি মেয়েকে ধর্ষণ করে তবে সেটি অন্যায় বলে বিবেচিত হবে না, বঙ্গনারীরা পাকবাহিনীর জন্য ‘মালে গনিমত’, কারণ তারা ইসলামের জন্য লড়ছে। এমন নয় যে ভদ্রলোক অশিক্ষিত ছিলেন, অথবা ছিলেন বুদ্ধিহীন। বরং সৎ এবং হৃদয়বান হিসেবেই একটা সময় তার খ্যাতি ছিল; কিন্তু এই ‘সজ্জন’ ব্যক্তিও স্রেফ ধর্মের ভালবাসায় অন্ধ হয়ে নেমে গেলেন পশুর স্তরে। উনি ভেবেছিলেন পাকিস্তান ভেঙে গেলে ইসলাম হবে বিপন্ন। তাই ধর্ম বাঁচাতে যা যা করা দরকার সবই করেছেন। এমনকি খান সেনাদের সাথে পাল্লা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও আছে। ব্যাপারটি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও অতিমাত্রায় ধর্মপ্রবণদের কাছে এ ধরনের কাজ খুবই স্বাভাবিক। অনেক সময়ই মানবিকতার চেয়ে তাদের কাছে ধর্মবোধটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। এই ভদ্রলোকের কথা ভাবলেই নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ স্টিফেন ভাইনবার্গের বিখ্যাত উক্তিটি আমার মনে পড়ে যায় (4):
‘ধর্ম মানবতার জন্য এক নির্মম পরিহাস। ধর্ম মানুক বা নাই মানুক, সব সময়ই এমন অবস্থা থাকবে যে ভালমানুষেরা ভাল কাজ করছে, আর খারাপ মানুষেরা খারাপ কাজ করছে। কিন্তু ভাল মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর ক্ষেত্রে ধর্মের জুড়ি নেই।’
শুধু একাত্তর তো কেবল নয়, বছর কয়েক আগে গুজরাটে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দাঙ্গা, আর তারও আগে অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের ধ্বংস- শিবসেনাদের তাণ্ডব নৃত্য ধর্মের এই ভয়াবহ রূপটিকেই মনে করিয়ে দেয়। অপরপক্ষে নাস্তিকদের যেহেতু এই অতি মানবিক সত্তা- কেন্দ্রিক নৈতিকতায় কোন বিশ্বাস নেই, একজন নিষ্ঠাবান নাস্তিক সত্যিকার অর্থে গড়ে ওঠেন একজন প্রথা-বিরোধী মানুষ হিসেবে। সুমন তুরহান নামে এক লেখক মাসিক দেশ পত্রিকার ৪ঠা নভেম্বর ২০০২ সংখ্যায় ‘নাস্তিকতার সংজ্ঞা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন- ‘নাস্তিকদের অবিশ্বাস তাই শুধু অতিমানবিক সত্তায় নয়, তার চেয়ে অনেক গভীরে, তিনি অবিশ্বাস করেন প্রথাগত সভ্যতার প্রায় সমস্ত অপবিশ্বাসে। সব কিছুই তারা যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখতে চান।’ (৫) এর মধ্যে যে কিছুটা হলেও সত্যতা নেই তা নয়। তবে ভালমানুষ হোন, আর নাই হোন এটা কিন্তু ঠিক যে নাস্তিক বা অধার্মিকদের মধ্যে থেকে কখনোই আল-কায়েদা, তালিবান, হরকত-উল- জিহাদ, রাজাকার, আলবদর বা শিবসেনাদের মত সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক রূপ দেখা যায় না । যতদিন ধর্ম থাকবে, ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকবে ধর্মের সাম্প্রদায়িক এই সাংগঠনিক রূপটিও কিন্তু বজায় থাকবে পুরোমাত্রায়। কাজেই যতদিন মানুষের আনুগত্য ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে বিভক্ত হয়ে থাকবে ততদিন তা মানুষকে স্বাধীনভাবে আর বিজ্ঞানসম্মতভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অর্জনে বাধা দিবেই। বেহেস্তের লোভে বা ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য নয়, মানুষকে ভালবেসে মানুষের জন্য কাজ করার প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তবেই গড়ে উঠবে সার্বজনীন মানবতাবাদ । সম্প্রতি এর প্রচেষ্টা শুরুও হয়েছে। ঈশ্বর কেন্দ্রিক মিথ্যার বেসাতির মন থেকে সরিয়ে শুধু মানুষের জন্য মানুষের কাজ করার বাসনা নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে নতুন শতকের আধুনিক মতবাদ হিসেবে এসেছে হিউম্যানিজম। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মানবতাবাদী সমিতি এবং যুক্তিবাদী সমিতি অফিস আদালতের ফর্মে বা বিয়ের রেজিস্ট্রেশনে ‘হিন্দু’ ‘মুসলিম’ এই শব্দগুলির পাশাপাশি ধর্মের জায়গায় ‘মনুষ্যত্ব’ শব্দটি ব্যবহারের আইনি অধিকার আদায় করেছে (৬)। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের একটি চমৎকার উক্তি তার অলৌকিক নয়, লৌকিক গ্রন্থ থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি (৭)-
‘আগুনের ধর্ম যেমন দহন, ছুরির ধর্ম যেমন তীক্ষ্ণতা তেমনি মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন। আর সে হিসেবে নামাজ না পড়েও বা শনি শীতলার পূজা না করেও আমরা যুক্তিবাদী নাস্তিকেরাই প্রকৃত ধার্মিক, কারণ আমরা মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ চাই।’
ধর্মগ্রন্থগুলো কি সত্যই নৈতিকতার ধারক এবং বাহক
ধর্ম হল বিষবৃক্ষ, আর মৌলবাদ হল সে বৃক্ষের বিষাক্ত একটি শাখা : ইদানিং এক নতুন ধরণের প্রগতিবাদী (নাকি সুবিধাবাদী) আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার মূলমন্ত্র হল ধর্ম নয়, কেবল মৌলবাদকে আঘাত কর। অনেক মুক্ত-মনা যুক্তিবাদীদের দেখছি বুঝে হোক, না বুঝে হোক এ প্রচারণায় গা ভাসিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মতই ইদানিং সোচ্চারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছেন : “শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও মৌলবাদ রুখব’, যেন মৌলবাদ ব্যাপারটি হঠাৎ করেই আকাশ থেকে আবির্ভূত হয়েছে মহীরূহ আকারে- কোন শিকড়-বাকড় ছাড়াই। যারা ধর্মকে শাশ্বত চিরন্তন আর জনকল্যাণমূলক বলে মনে করেন আর যত দোষ চাপাতে চান কেবল গোলাম আজম, আদভানী কিংবা ‘মৌলবাদ’ নামক নন্দঘোষটির ঘাড়ে, তাদের প্রথমে খোদ ‘মৌলবাদ’ শব্দটিকেই বিশ্লেষণ করে দেখতে বলি । ‘মৌল’ শব্দের অর্থ মূল থেকে আগত, বা ‘মূল সম্বন্ধীয়’ । আর ‘বাদ’ শব্দের অর্থ যে ‘মত’, ‘তত্ত্ব’ বা থিওরী, তা তো আমরা জানিই । তা হলে মৌলবাদ শব্দের প্রকৃত অর্থ কি দাঁড়ালো? দাঁড়ালো— ‘মূল থেকে আগত তত্ত্ব’। কোন্ মূল থেকে আগত তত্ত্ব? শেষ পর্যন্ত ওই ধর্মগ্রন্থের গোঁড়া মূলনীতিগুলো হতে আগত তত্ত্ব কাজেই বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কিন্তু থলের বিড়াল ঠিকই বেড়িয়ে পড়ছে যে, ধর্মশাস্ত্রের মূল নীতিগুলোকে চরম সত্য বলে যারা মনে করেন, তারাই শেষ পর্যন্ত মৌলবাদী হন। মৌলবাদ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Fundamentalism’। এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বলা হয়েছে- “Strict maintainence of traditional spritual beliefs’; চ্যাম্বার্স ডিকশনারি শব্দটি সম্পর্ককে বলছে— ‘Belief in literal truth in Bible, against evolution etc.’। কাজেই ধর্মকে বাদ দিয়ে মৌলবাদ রুখবার চেষ্টা অনেকটা বিষবৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢেলে বাঁচিয়ে রেখে আগায় কাঁচি চালানোর প্রচেষ্টা, নিছক ভণ্ডামি তসলিমা নাসরীন একবার একটি ইংরেজি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন (৮) :
‘আমি সাধারণভাবে মৌলবাদীদের আর সেই সাথে ধর্মের- দু’এরই সমালোচনা করেছিলাম। আমি আসলে ইসলামের সাথে ইসলামী মৌলবাদের কোন তফাৎ দেখি না। আমি মনে করি ধর্মই হচ্ছে মূল উৎস, যেটি থেকে মৌলবাদ নামক বিষাক্ত ডালপালাগুলো সময় সময় বিস্তার লাভ করে। আমি খুব পরিষ্কারভাবেই এটি বলছি কারণ, কিছু উদারপন্থী লোকজন আছেন যারা এ ধরনের প্রশ্নে ইসলামকে ডিফেন্ড করেন আর সমস্ত সমস্যার জন্য কেবল মৌলবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হন। কিন্তু ইসলাম নিজেই তো নারী-নির্যাতনকারী। ইসলাম নিজেই তো গণতন্ত্র সমর্থন করে না আর সমস্ত মানবিক অধিকার হরণ করে।’
আমার এক পরিচিতজন আছেন- সেক্যুলার এবং প্রগতিশীলতার দাবিদার। কিন্তু তসলিমার এই সাক্ষাৎকার পড়ে তার যেন পিত্তি জ্বলে গেল! তসলিমা ‘শ্যালো’, তসলিমা নির্বোধ, তসলিমা ‘ইডিয়ট’, কী নন তিনি! বুঝলাম, তসলিমার বড় অপরাধ তিনি ধর্ম আর মৌলবাদকে এক করে ফেলেছেন। কিন্তু তসলিমা ভুল বলছেন, না ঠিক বলছেন সেটি বিশ্লেষণ করতে হলে নির্মোহ সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মগ্রন্থগুলোর দিকে তাকানো দরকার। যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ধর্মগ্রন্থগুলোর সাথে মৌলবাদের সত্যই কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে কিনা, এবং ধর্মগ্রন্থগুলো আদপেই নৈতিকতার ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত হবার যোগ্যতা রাখে কিনা !
ধর্মগ্রন্থগুলো আসলে কি বলছেঃ পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মমতগুলো সৃষ্টি হয়েছে বড় জোর বিগত ২-৪ হাজার বছরের মধ্যে। হিন্দু, ইসলাম, খ্রিষ্টধর্ম কোনটাই সে অর্থে চিরন্তন বা সনাতন নয়। কাজেই ‘সনাতন ধর্ম’ নিছকই একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস । তবে সনাতন না হলেও ধর্ম সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু কিন্তু হয়েছিলো বহু হাজার বছর আগে। বিরূপ প্রকৃতির নানা দুর্যোগ— দাবানল, প্লাবন, বজ্রপাত প্রভৃতির ব্যাখ্যা খুঁজতে অসহায় হয়ে আর ওগুলোর হাত থেকে মুক্তি খুঁজতে মানুষ সৃষ্টি করেছিল নানা দেবদেবীর; মৃত্যুকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করতে পেরে সৃষ্টি করেছিল অদৃশ্য আত্মার। যারা সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে সামান্য পড়াশুনা করেছেন তারাই এগুলো জানেন। আর এখন পর্যন্ত জানা তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, মানুষের মধ্যে তথাকথিত ‘ধর্মবিশ্বাসের’ সৃষ্টি হয়েছিল এখনকার মানুষের পূর্বসুরী নিয়ানডার্থাল মানুষের আমলে যারা পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে এখন থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগে । নিয়ানডার্থাল মানুষের আগে পিথেকনথ্রোপাস আর সিনানথ্রোপাসদের মধ্যে ধর্মাচরণের কোন নির্দেশ পাওয়া যায়নি (১৫)। তবে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বিশ্বাসগুলো ছিল একেবারেই আদিম- আজকের দিনের প্রচলিত ধর্মমতগুলোর তুলনায় একেবারেই আলাদা। এখন থেকে কমপক্ষে বিশ হাজার বছর বা তারও আগে উচ্চতর পুর-প্রস্তর যুগে এসে ধর্ম, আত্মা, পরমাত্মা, যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপারগুলো সুসংহত হয়। এ সময়কার প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলোর মধ্যে বৈদিক ধর্মের (হিন্দু ধর্মের পূর্বসুরী) উদ্ভব হয়েছিল আজ থেকে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার হাজার বছর আগে, প্রয়োজনে যে ধর্মীয় রীতি নীতি নিয়ম কানুন তৈরি হয়েছিল, আজ তা কালের পরিক্রমায় স্থবির, পশ্চাৎপদ, নিবর্তনমূলক এবং অমানবিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কোরানেও রয়েছে নির্দেশাবলীর ছড়াছড়ি, যেগুলো ‘মৌলবাদের সুতিকাগার’ হিসেবে কারো মনে হতেই পারে। যেমন (৯) :
কোরান মুমিন ভক্তদের শেখাচ্ছে যেখানেই অবিশ্বাসীদের পাওয়া যাক তাদের হত্যা করতে (২:১৯১, ৯:৫), তাদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হতে, কঠোর ব্যবহার করতে (৯:১২৩), আর যুদ্ধ করে যেতে (৮:৬৫)। কোরান শেখাচ্ছে বিধর্মীদের অপদস্ত করতে আর তাদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করতে (৯:২৯)। কোরআন অন্য সকল ধর্মের অনুসারীদের কাছ থেকে ধর্মীয় স্বাধীনতার নির্যাসটুকু কেড়ে নিয়ে সোচ্চারে ঘোষণা করছে যে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম (৩:৮৫)। এটি অবিশ্বাসীদের দোজখে নির্বাসিত করে (৫:১০) এবং ‘অপবিত্র’ বলে সম্বোধন করে (৯:২৮); মুসলিমদের ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আদেশ করে যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য সকল ধর্মকে সরিয়ে ইসলামী রাজত্ব কায়েম হয় (২:১৯৩)। কোরআন বলছে যে শুধু ইসলামে অবিশ্বাসের কারণেই একটি মানুষ দোজখের আগুনে পুড়বে আর তাকে সেখানে পান করতে হবে পুঁতি দুর্গন্ধময় পূঁজ (১৪:১৭)। এই ‘পবিত্ৰ’ গ্রন্থটি অবিশ্বাসীদের হত্যা করতে অথবা তাদের হাত পা কেটে ফেলতে প্ররোচিত করছে, দেশ থেকে অপমান করে নির্বাসিত করতে বলছে আর ভয় দেখাচ্ছে এই বলে যে— ‘তাদের জন্য পরকালে অপেক্ষা করছে ভয়ানক শাস্তি’ (৫:৩৪)। আরও বলছে, ‘যারা অবিশ্বাস করে তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আগুনের পোশাক, তাদের মাথার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেওয়া হবে যাতে ওদের চামড়া আর পেটে যা আছে তা গলে যায়, আর ওদের পেটানোর জন্য থাকবে লোহার মুগুর’ (২২:১৯)। কোরান ইহুদী এবং নাসারাদের সাথে বন্ধতত্ত্বটুকু করতে পর্যন্ত নিষেধ করছে (৫:৫১), এমনকি নিজের পিতা বা ভাই যদি অবিশ্বাসী হয় তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখতে উদ্বুদ্ধ করছে (;২৩, ৩:২৮)। আল্লাহ তার কোরানে পরিষ্কার করেই বলছে- আল্লা-রসুলে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড (৪৮:১৩)। ইসলামে অবিশ্বাস করে কেউ মারা গেলে কঠোরভাবে উচ্চারিত হবে ‘ধর ওকে, গলায় বেড়ি পড়াও এবং নিক্ষেপ কর জাহান্নামে আর তাকে শৃঙ্খলিত কর সত্তুর হাত দীর্ঘ এক শৃঙ্খলে’ (৬৯:৩০-৩৩)। মহানবী সবসময়ই আল্লাহর নামে যুদ্ধ করতে সবাইকে উৎসাহিত করেছেন সাফাই গেয়েছেন এই বলে— ‘এটা আমাদের জন্য ভালই, এমনকি যদি আমাদের অপছন্দ হয় তবুও’ (২:২১৬), তারপর উপদেশ দিয়েছেন— ‘কাফেরদের গর্দানে আঘাত কর’ আর তারপর তাদের উপর রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার নির্দেশের পর বলেছেন অবশিষ্টদের ভালভাবে বেঁধে ফেলতে (৪৭:৪)। পরমকরুণাময় আল্লাহতালা এই বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন- ‘কাফেরদের হৃদয়ে আমি গভীর ভীতির সঞ্চার করব’ এবং বিশ্বাসীদের আদেশ করেছেন কাফেরদের কাঁধে আঘাত করতে আর হাতের সমস্ত আংগুলের ডগা ভেঙে দিতে (৮:১২)।
আল্লাহ জিহাদকে মুমিনদের জন্য ‘আবশ্যিক’ (mandatory) করেছেন আর সতর্ক করেছেন এই বলে- ‘তোমরা যদি সামনে না এগিয়ে আস (জিহাদের জন্য) তবে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (৯:৩৯)। আল্লাহ তার পেয়ারা নবীকে বলছেন, “হে নবী, অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর আর কঠোর হও- কেননা, জাহান্নামের মত নিকৃষ্ট আবাস স্থলই হল তাদের পরিণাম’ (৯:৭৩)।
সবই কোরানের কথা (হাদিস এবং অন্যান্য গ্রন্থগুলোর কথা না হয় বাদই থাকুক আপাততঃ)। অনেকেই দেখেছি নিজস্ব বিশ্বাসে আপ্লুত হয়ে কোরানকে নির্দ্বিধায় ‘The Book of guidence’ বলে মেনে নেন, আর ইসলামকে মনে করেন ‘শান্তির ধর্ম’। যারা এমনটি ভাবেন, তারা কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে উপরের আয়াতগুলো যারা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে আর সমাজে তার বাস্তব প্রয়োগ চায় তারা কি ধরনের ‘শান্তি’ এ পৃথিবীতে বয়ে আনছে? জিহাদীদের কল্যাণে আজকে বিশ্বে ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ একটি প্রতিষ্ঠিত শব্দ । প্রতিদিন কাগজের পাতা খুললেই দেখা যায় এই জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ কিছু লোক বোমা মারছে— লক্ষ্য; মানুষ-জন, বাড়ি-ঘর, কারখানা, রাস্তাঘাট, যানবাহন, সিনেমা হল, সাংস্কৃতিক অঙ্গন বা সমুদ্র- সৈকত। হাজার খানেক জিহাদী সংগঠন যেমন- আল কায়দা, ইসলামিক জিহাদ হামাস, হরকত-উল-জিহাদ, হরকত-উল-মুজাহিদিন, জেইস- মুহম্মদ, জিহাদ-এ-মুহম্মদ, তাহরিখ-এ-নিফাজ-সারিয়াত-এ-মুহম্মদ, আল- হিকমা, আল-বদর-মুজাহিদিন, জামায়ে ইসলামিয়া, হিজাব-এ ইসলামিয়া আজ সারা পৃথিবী জুড়ে কায়েম করছে এক ত্রাসের রাজত্ব (১০)। এই তো কয়েক বছর আগে ১৭ই আগস্ট (২০০৫) সারা বাংলাদেশে ৬৩টি জেলায় এক নাগাড়ে বোমার মহড়া হয়ে গেল । মহড়ার প্রকোপ এমনই ব্যাপক ছিল যে অনেকেই ১৭ই আগস্ট দিনটিকে এখন ‘বাংলাদেশের ৯/১১’ বলে অভিহিত করতে শুরু করেছেন। জঙ্গিবাদের সাথে বিশুদ্ধ ইসলামের সম্পর্ক কতটুকু তা বোঝা হয়ে গেছে বোমা মহড়ার স্থানগুলোতে পাওয়া তাদের ছাপানো লিফলেটগুলো থেকেই। সারা লিফলেট জুড়েই কোরান হাদিস থেকে নানা উদ্ধৃতি দিয়ে কাফের নাফরমানদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক। ফরহাদ মজহার আর বদরউদ্দিন উমরেরা পালের হাওয়া যতই অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করুক না কেন, বিশুদ্ধ ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদের যে একটা সম্পর্ক রয়েছে, তা আর অস্বীকার করার জো নেই (১১)। সচেতন শান্তিকামী ধার্মিক মানুষদের আজ আত্মোপলব্ধির সময় এসেছে, সময় এসেছে সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করার— কেন এই জঙ্গি দলগুলো এত ইসলামিক? কেন তারা সন্ত্রাসী? কারা ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে মোল্লা ওমর, বিন লাদেন, মৌলানা মান্নান, গোলাম আজম, শাইখ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নান আর বাংলাভাইদের? ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে? আজ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে তাই বলার সময় এসেছে— এই ‘পবিত্র’ ধর্মগ্রন্থগুলো অনেকাংশেই মুসলিমদের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের মূল উৎস। তবে সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি দীর্ঘদিনের বিদ্বেষমূলক পররাষ্ট্রনীতির কথাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। জনবিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্র না পাওয়া কিংবা সাদ্দামের সাথে আল-কায়েদার কোন সম্পর্ক না খুঁজে পাওয়া কিংবা জৈব-যুদ্ধাস্ত্র না পাওয়া সত্ত্বেও নির্লজ্জভাবে ইরাকের উপর যে আগ্রাসন চালিয়েছে তা শুধু যে আমেরিকার চিরচেনা সাম্রাজ্যবাদী চেহারাটাকেই স্পষ্ট করে তুলেছে তা নয়, ইসলামী বিশ্ব এই আগ্রাসনকে যে কোন কারণেই হোক ‘ইসলামের উপর আঘাত’ হিসেবে নিয়েছে। সেজন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে সমস্ত দেশেই ইসলামী আত্মঘাতী বোমা হামলার মাত্রাটা বেশি যে দেশের সরকার ইরাক যুদ্ধে বুশ- বেস্নয়ারকে নগ্নভাবে সমর্থন করেছে। এই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আর প্রতিহিংসার ব্যাপারগুলো ভুলে গেলে কোন আলোচনাই সম্পূর্ণ হতে পারে না।
ধর্ম, মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনার একটা বড় সমস্যা হল অযাচিত ‘স্টেরিওটাইপিং’-এর ভয়। এ ধরনের আলোচনা শুরু হলেই আমি দেখেছি বিশ্বাসীদের অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে বলতে থাকেন- শুধু গুটি কয়েক সন্ত্রাসীদের কারণে সামগ্রিকভাবে ইসলামকে বা মুসলমানদের দায়ি করা কি ঠিক হচ্ছে? একজন বিন লাদেন বা একজন মুফতি হান্নান কি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে নাকি? না, সত্যই করে না। কাজেই আমিও বলি যে, পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কখনও সন্ত্রাসী বলা উচিত নয়, যারা এ ধরনের ‘স্টেরিওটাইপিং’ করতে চান তারা ভুল করেন। এটি একধরনের racism। কেউ বা বলেন এটি এক ধরনের রোগ— ‘ইসলামফোবিয়া’! রোগই বলুন আর পশ্চিমা জাত্যাভিমানই বলুন (যাকে প্রয়াত এডয়ার্ড সাইদ অভিহিত করেন ‘ওরিয়েন্টালিজম’ নামে), ৯/১১-এর পর পশ্চিমাবিশ্বে বসবাসরত মুসলিমরা এ ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বহু ক্ষেত্রেই— এ তো অস্বীকার করবার জো নেই। মুসলিম মানেই যে ‘সন্ত্রাসী’ নয় এটি বোঝার জন্য তো কোন দর্শন কপচানোর দরকার নেই, আমার-আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই তো যথেষ্ট হবার কথা । আমার নিজেরই অনেক মুসলিম বন্ধু-বান্ধব রয়েছেন। তাদের কেউই তো সন্ত্রাসী নন। কেউই বিন লাদেন নন, কেউই নন মুফতি হান্নান। তারা আমার বিপদে আপদে খোঁজ-খবর নেন, বাসায় এসে গল্প-গুজব করেন, খাওয়া-দাওয়া করেন, এমন কি নামাজের সময় হলে এই কাফেরের বাসায় ‘পশ্চিম দিক কোনটা’ জানতে চেয়ে নামাজও পড়েন । এরা নিপাট ভাল মানুষ। তারা কোরআনের কোন আয়াতে ভায়োলেন্সের কথা আছে তা সম্বন্ধে মোটেও ওয়াকিবহাল নন, সেটা নিয়ে আগ্রহীও নন- তারা আসলে ‘spiritual Islam’ এর চর্চা করেন। বিপদটা কখনই এদের নিয়ে নয়। এরা সবাই শান্তি, ভালবাসা আর সহিষ্ণুতায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই মূল্যবোধগুলো তারা যতটা না ইসলাম থেকে পেয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ছোটবেলা থেকেই সামাজিক শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ কোনদিন কোরানের বা ইসলামের চর্চা না করেও তো বহু মানুষ এই গুণাবলি থেকে বর্জিত নয়, এমন প্রমাণ ভুরি ভুরি হাজির করা যায়। কিন্তু এই ‘Spiritual Islam’-এর চর্চাকারী দলের বাইরেও একটা অংশ রয়েছে যারা রীতিমত কোরানের চর্চা করেন, চোখ-কান বন্ধ করে কোরানের সকল আদেশ-নির্দেশ মেনে চলেন আর কোরানের আলোকে দেশ ও পৃথিবী গড়তে চান। বিপদটা এদের নিয়েই। কারণ কেউ যদি সামাজিক শিক্ষার বদলে কোরানের সকল আদেশ-নির্দেশ চোখ-কান বন্ধ করে মেনে নেন তাহলে কি হবে? নিচের আয়াতটায় চোখ বুলানো যাক (১৭)–
Let not the believers Take for friends or helpers Unbelievers rather than believers : if any do that, in nothing will there be help from Allah (Q.3:28)
যারা কোরানের মধ্যে কখনও ভায়োলেন্সের টিকিটিও খুঁজে পান না, বরং পবিত্র কোরানের আলোকে জীবন সাজাতে চান, তারা নিজেরাই কি তাদের কোন হিন্দু, খ্রিষ্টান বা অধার্মিক প্রতিবেশীদের প্রতি কোরানে বর্ণিত উপরের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবহার করেন? তারা কি সত্যিই শুধুমাত্র অমুসলিম বলেই কারো বন্ধতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেন? যদি তা না হয়, তবে বলতেই হয় যে তারা আসলে কোরানের নির্দেশ অনুযায়ী চলছেন না । কিন্তু কোরান তো ‘আল্লাহর কিতাব’ । কেউ যদি ভাসা ভাসা কোরানের চর্চা না করে কোরানের সকল নির্দেশ আক্ষরিকভাবেই মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেয় আর অবশেষে সাম্প্রদায়িক ‘তালিবান’ হিসেবে বেড়ে ওঠেন, তবে দোষটা কার হবে?
আরেকটি আয়াত দেখি (১৭)-
Fighting is prescribed for you, and ye dislike it. But it is possible that ye dislike a thing which is good for you (Q.2:216)
অথবা
Then fight in Allah’s cause- Thou art held responsible only for thyself- and rouse the believers. It may be that Allah will restrain the fury of the fury of the Unbelievers; for Allah is the strongest in might and in punishment (Q.4:84).
কোরানের বর্ণিত নির্দেশ মত জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে তালিবানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইহুদী নাসারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য আফগানিস্তান চলে গিয়েছিলেন অনেকেই। কারণ ইহুদি-নাসারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে তারা আল্লাহর নির্দেশ বলেই মেনে নিয়েছিলেন। তাদের যে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় তাও নয়। এমনি একজন ব্যক্তির উদাহরণ হচ্ছে জন ফিলিপ ওয়াকার লিঙ্ক ধর্মান্তরিত নাম আবদুল হামিদ, বিখ্যাত ‘আমেরিকান তালিবান’। দৈনিক প্রথম আলোর ১৮ই অক্টোবর ২০০৫ রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের তত্ত্বাবধানে আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় তিন হাজার মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে চলে গিয়েছিল (১৮)। কোরানের অমানবিক শিক্ষাই যে শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রদের মধ্যে ‘কাফিরদের’ বিরুদ্ধে অযথা হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোতে বহুলাংশে দায়ি, এটি অস্বীকার করার চেষ্টা স্রেফ আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়। এ স্পর্শকাতর বিষয়টি আলোচনা করতে গেলে সবসময়ই ঘুরে ফিরে ৯/১১’র ঘটনাটি সামনে চলে আসে। ৯/১১-এর ঘটনায় সারা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিলো কি করে কিছু ধর্মোন্মাদ জিহাদী সৈনিক উড়োজাহাজকে অস্ত্র বানিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ লোকের প্রাণহানি ঘটাতে পারে। যারা ইসলামের মধ্যে প্রতিনিয়ত শান্তি খোঁজেন, তারা বলবেন, এগুলো কতিপয় পথভ্রষ্ট দুষ্কৃতকারীদের কাজ— যার সাথে প্রকৃত ইসলামের কোনই সম্পর্ক নাই ৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ‘কতিপয় পথভ্রষ্ট দুষ্কৃতকারী’রা তো আর নিজেদের দুষ্কৃতকারী ভাবেনি। বরং ভেবেছে তারাই সাচ্চা মুসলিম, যারা কিনা আল্লাহর দেওয়া অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে। ৯/১১ ঘটার অনেক আগেই- ১১ই জানুয়ারি ১৯৯৯-এর নিউজ উইকের একটি সংখ্যায় ওসামা বিন লাদেনের একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সেই সাক্ষাৎকারে লাদেন সাহেব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন তিনি সকল আমেরিকানদের মেরে ফেলাকে ‘জায়েজ’ মনে করেন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল (১৯)-
QUESTION: “Why have you asked Muslims to target civilian Americans all over the world? Islam prohibits its followers from killing civilians in war?”
BIN LADEN: “If the Israelis are killing small children in Palestine and the Americans are killing the innocent people in Iraq, and if the majority of the American people support their dissolute president, this means the American people are fighting us and we have the right to target them.
QUESTION : “All Americans?”
BIN LADEN “Muslim scholars have issued a fatwa [a religious order] against any American who pays taxes to his government. He is our target, because he is helping the American war machine against the Muslim nation.
হিন্দু ধর্মকে ইসলাম থেকে কোন অর্থেই ভাল বলবার জো নেই। যে জাতিভেদ প্রথার বিষ-বাষ্প প্রায় তিন হাজার বছর ধরে কুরে কুরে ভারতকে খাচ্ছে তার প্রধান রূপকার স্বয়ং ঈশ্বর। মনুসংহিতা থেকে আমরা পাই- মানুষের সমৃদ্ধি কামনায় পরমেশ্বর নিজের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য, আর পা থেকে শূদ্র সৃষ্টি করেছিলেন (১:৩১)। বিশ্ববাসীরা জোর গলায় বলেন, ঈশ্বরের চোখে নাকি সবাই সমান! অথচ, ব্রাহ্মণদের মাথা থেকে আর শূদ্রদের পা থেকে তৈরি করার পেছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যটি কিন্তু বড়ই মহান! শূদ্র আর দলিত নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রতি তাই ‘ঈশ্বরের মাথা থেকে সৃষ্ট উঁচু জাতের’ ব্রাহ্মণদের দুর্ব্যবহারের কথা সর্বজনবিদিত। সমস্ত বড়লোকের বাসায় এখনও দাস হিসেবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নিয়োগ দেয়া হয়। মনু বলেছেন- দাসত্বের কাজ নির্বাহ করার জন্যই বিধাতা শূদ্রদের সৃষ্টি করেছিলেন (৮:৪১৩)। এই সমস্ত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বাসার সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে চলে যাওয়ার পর গঙ্গা জল ছিটিয়ে গৃহকে ‘পবিত্র’ করা হত (ক্ষেত্র বিশেষে এখনও হয়)। আর হবে নাই বা কেন! তারা আবার মানুষ নাকি? তারা তো অচ্ছুৎ! শ্রী এম. সি. রাজার কথায়, ‘আপনি বাড়িতে কুকুর- বিড়ালের চাষ করতে পারেন, গো-মুত্র পান করতে পারেন, এমনকি পাপ দূর করার জন্য সারা গায়ে গোবর লেপতে পারেন, কিন্তু নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ছায়াটি পর্যন্ত আপনি মাড়াতে পারবেন না’ (২০)! এই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের নৈতিকতা! এমন কি হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিতে শূদ্রদের উপার্জিত ধন সম্পত্তির ওপর তাদের ভোগেরও অধিকার নেই। সব উপার্জিত ধন দাস-মালিকেরাই গ্রহণ করবে- এই ছিল মনুর বিধান— ‘ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিত স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ’ (৮:৪১৬)। শূদ্ররা ছিল বঞ্চনার করুণতম নিদর্শন; তাদের না ছিল নাগরিক অধিকার, না ছিল ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক অধিকার । শূদ্রদের যাতে অন্য তিন বর্ণ থেকে আলাদা করে চেনা যায় এবং শূদ্ররা যেন প্রতিটি মুহূর্তে মনে রাখে যে তিন বর্ণের মানুষের ক্রীতদাস হয়ে সেবা করবার জন্যই তাদের জন্ম। তিন বর্ণের মানুষদের থেকে শুদ্ররা যে ভিন্নতর জীব, মনুষ্যেতর জীব তা জানানোর জন্য প্রতি মাসে মাথার সব চুল কামিয়ে ফেলবার নির্দেশ দিয়েছেন মনু (৫:১৪০)। একজন শুদ্রকে বেদ পাঠ তো দূরের কথা, শ্রবণেরও অধিকার দেওয়া হয়নি। একজন শুভ্রকে তার উঁচু জাতে বিয়ে করবার অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। একজন শুদ্র যদি ব্রাহ্মণের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে পড়ে, তবে তার বুকে গরম লোহার রডের ছ্যাকা দেবার অথবা পশ্চাৎদেশ কর্তন করে নেবার বিধান রয়েছে (৮:২৮১)।
মনুর এসব বর্ণবাদী নীতির বাস্তব রূপায়ণ আমরা দেখতে পাই রামায়ণ ও মহাভারতে। বিশেষত ধর্মশাস্ত্রীয় অনুশাসন যে শ্রেণী বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং শূদ্রদের দমন- -পীড়নের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ শম্বুকবধ কাহিনী। এক শূদ্র তাপসের তপস্যা করার ‘অপরাধে’ রামচন্দ্র খড়গ দিয়ে শম্বুকের শিরোচ্ছেদ করেন তার তথাকথিত রামরাজ্যে(২১)। প্রায় একই ধরনের ঘটনা আমরা দেখি মহাভারতে যখন নিষাদরাজ হিরন্যধনুর পুত্র একলব্য দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে এলে তাকে নিচ জাতি বলে প্রত্যাখ্যান করেন দ্রোণ। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত একলব্যের শর নিক্ষেপের দক্ষতা নষ্ট করে ধনুর্বিদ্যায় দ্রোণের প্রিয় ছাত্র অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ণ রক্ষার অভিপ্রায়ে ‘গুরু দক্ষিণা’ হিসেবে একলব্যের বুড়ো আঙুল কেটে নেন তিনি। এ ধরনের অনেক উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন মহাকাব্যগুলোতে(২২) ।
আসলে এইসব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আদিম মানুষের সাম্যের সমাজকাঠামোর ভিত উপড়ে ফেলে প্রতিষ্ঠা করেছিল অসম সমাজের, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের। ধর্মই তৈরি করেছিল হুজুর-মজুর শ্রেণীর কৃত্রিম বিভাজনের, কিংবা হয়ত বলা যায় শোষক শ্ৰেণীই শ্রেণী বিভক্ত সমাজের ফায়দা পুরোপুরি লুটবার জন্য প্রথম থেকেই কাজে লাগিয়েছিল ধর্মকে; যেভাবেই দেখি না কেন এর ফলে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সামাজিক আর অর্থনৈতিক শোষণের। এই শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবার জন্যই ব্রাহ্মণেরা প্রচার করেছিল- ধর্মগ্রন্থগুলো স্বয়ং ঈশ্বরের মুখ-নিঃসৃত। মানুষে মানুষে বিভেদ নাকি ঈশ্বর-নির্দেশিত! ঈশ্বরকে সাক্ষ্য মেনে রাজনৈতিকভাবে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত সুদূরপ্রসারী প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় উপমহাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে ।
ইসলামী জিহাদী সৈনিকদের মতই ভারতে বিভেদের হাতিয়ার ‘সনাতন ধর্ম’ রক্ষায় আজ সচেষ্ট হয়েছে বিজেপি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিব- সেনা, বজরং দলের মত প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো। কয়েক দশক আগেও ভারতে নব্যহিন্দুত্বের তেমন কোন সংগঠিত রূপ ছিল না(২৩)। তবে অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর ধর্মান্ধতার কারণে ভারতের আপামর জনসাধারণের কাছে সন্ন্যাসী, গেরুয়া, জটা, দণ্ড, রুদ্রাক্ষ, কমণ্ডলু এসব দীর্ঘকাল ধরে একটা বিমূঢ় সম্ভ্রম ভোগ করে এসেছ। ধর্মের প্রতি সাধারণ মানুষের মোহের কথা ধুরন্ধর রাজনীতিবিদরা জানে। তাই ধর্মীয় ভাবালুতাকে উস্কে দিতেই বোধহয় ১৯৮৮-৯০ সালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দূরদর্শনে ধর্মীয় অবয়বে প্রচারিত হল রামায়ণ আর মহাভারত। সরকারি প্রচার মাধ্যমে এভাবে অন্ধ বিশ্বাসকে উৎসাহ দেবার ফলে ভারতে মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুয়ার উন্মোচিত হল, রোপণ করা হল এক বিষবৃক্ষের চারা । দূর-দর্শনের পর্দায় প্রথমবার রামায়ণ চলাকালে কল্পিত রাম জন্মভূমি নিয়ে মৌলবাদী আন্দোলনের জোয়ার এবং পরবর্তীকালে ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর উত্থান সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে তার ‘মহাকাব্য ও মৌলবাদ’ বইয়ে বলেন(২৪) :
“দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারতবর্ষে রামায়ণ ও মহাভারতকে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মহাকাব্যিক প্রতিফলন হিসেবে অথবা ভারতীয় তথা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে গণ্য না করে মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতাই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখানেই আমাদের গভীর লজ্জা। প্রথমে ১৯৮৮-৯০ সালে এবং আরও কয়েকবার সরকারি দূরদর্শনে রামায়ণ ও মহাভারত যে অবয়ব ও প্রকাশভঙ্গিমায় সম্প্রচারিত হয়েছে, তা এই মৌলবাদী রাজনীতিতে ইন্ধন জুগিয়েছে বলেই মনে হয়। দূরদর্শনে সম্প্রচারিত রামায়ণের কাহিনী প্রধানত তুলসীদাস রচিত রামচরিত মানস গ্রন্থকে ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে, বাল্মীকি রামায়ণকে ভিত্তি করে নয়। তুলসী রামায়ণের মধ্যযুগীয় ভক্তি আন্দোলনের ফলশ্রুতি এবং বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের ফলশ্রুতি এবং বৈষ্ণব ভক্তি সাহিত্যের অন্তর্গত। আদি বাল্মীকি রামায়ণে বালকাণ্ড ও উত্তর কাণ্ড ছিল না। আর পরবর্তীকালে সংযোজিত এই দুই কাণ্ড এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রক্ষিপ্ত কথা বাদ দিলে -আদি বাল্লীকি রামায়ণে রামের অবতারত্বের বিশেষ চিহ্ন পাওয়া যায় না । মহাকাব্য হিসেবেও রামায়ণের সাহিত্যগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তুলসী রামায়ণে বিষ্ণুকে শ্রেষ্ঠ দেবতা রামকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য । দূরদর্শনে এভাবে রামায়ণকে মহাকাব্য হিসেবে উপস্থিত না করে বিকৃতরূপে অবতারকাহিনী ও ধর্মগ্রন্থরূপেই জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। সরকারি প্রচারমাধ্যমে এভাবে অন্ধবিশ্বাসকে উৎসাহ দেওয়ার ফলে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সঞ্জীবিত হয়েছে, এ ধারণা যুক্তিসঙ্গত। দূরদর্শনের পর্দায় প্রথমবার রামায়ণ চলাকালে রামজন্মভূমি নিয়ে মৌলবাদী আন্দোলনের জোয়ার এবং পরবর্তীকালে তার ব্যাপক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াই এর অকাট্য প্ৰমাণ ।’
ক’বছর আগে গুজরাটে ঘটে গেল স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে ভয়াবহ দাঙ্গা। ধর্মের মায়াজালে পড়ে সাধারণ মানুষ কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে আর নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে- গুজরাটের সাম্প্রতিক দাঙ্গা তার প্রমাণ। তারপরেও কিন্তু ধর্মের সমালোচনা করলে সব শিয়ালই দেখছি এককাট্টা হয়ে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ান!
ইহুদী এবং খ্রিষ্টানদের পবিত্র গ্রন্থের দিকে তাকালে দেখা যায়, পুরো বাইবেলটিতেই ঈশ্বরের নামে খুন, রাহাজানি, ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিছু উদাহরণ তো দেওয়া যেতেই পারে। যুদ্ধজয়ের পর অগনিত যুদ্ধবন্দিকে কব্জা করার পর মুসা (মোশি) নির্দেশ দিয়েছিলেন ঈশ্বরের আদেশ হিসেবে সমস্ত বন্দি পুরুষকে মেরে ফেলতে (৩০) :
‘এখন তোমরা এইসব ছেলেদের এবং যারা কুমারী নয় এমন সব স্ত্রী লোকদের মেরে ফেল; কিন্তু যারা কুমারী তাদের তোমরা নিজেদের জন্য বাঁচিয়ে রাখ’
একটি হিসাবে দেখা যায়, মুসার নির্দেশে প্রায় ১০০,০০০ জন তরুণ এবং প্রায় ৬৮,০০০ অসহায় নারীকে হত্যা করা হয়েছিল (৩১)। এছাড়াও নিষ্ঠুর, আক্রমণাত্মক এবং অরাজক বিভিন্ন ভার্সসমূহের বিবরণ পাওয়া যায় যিশাইয় (২১:৯), ১ বংশাবলী (২০:৩), গণনা পুস্তক (২৫:৩-৪), বিচারকর্তৃগণ (৮:৭), গণনা পুস্তক (১৬:৩২-৩৫), দ্বিতীয় বিবরণ (১২:২৯-৩০), ২ বংশাবলী (১৪:৯, ১৪:১২), দ্বিতীয় বিবরণ (১১:৪-৫), ১ শমূয়েল (৬:১৯), ডয়টারনোমি ( ১৩:৫- ৬, ১৩:৮-৯, ১৩:১৫), ১ শমূয়েল (১৫:২-৩), ২ শমূয়েল (১২:৩১), যিশাইয় (১৩:১৫-১৬), আদিপুস্তক (৯:৫-৬) প্রভৃতি নানা জায়গায় ৷
বিশ্বাসী খ্রিষ্টানরা সাধারণত বাইবেলে বর্ণিত এই ধরনের নিষ্ঠুরতা, এবং অরাজগতাকে প্রত্যাখ্যান করে বলার চেষ্টা করেন, এগুলো সব বাইবেলের পুরাতন নিয়মের (ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ) অধীন, যীশু খ্রিষ্টের আগমনের সাথে সাথেই আগের সমস্ত অরাজগতা নির্মূল হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এটি সত্য নয়। বাইবেলের নতুন নিয়মে যীশু খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন যে তিনি পূর্বতন ধর্মপ্রবর্তকদের নিয়মানুযায়ীই চালিত হবেন (৩০) :
‘এ কথা মনে কোর না, আমি মোশির আইন-কানুন আর নবীদের লেখা বাতিল করতে এসেছি। আমি সেগুলো বাতিল করতে আসি নি বরং পূর্ণ করতে এসেছি’ (মথি, ৫:১৭)।
খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে যীশুকে শান্তি এবং প্রেমের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন, সত্যিকারের যীশু ঠিক কতটুকু প্রেমময় এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায় ৷ যীশু খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন যে :
“আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে এসেছি এই কথা মনে কোর না। আমি শান্তি দিতে আসি নাই, এসেছি তলোয়ারের আইন প্রতিষ্ঠা করতে। আমি এসেছি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করাতে; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বৌকে শাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি’ (মথি, ৫:১৭)।
ব্যভিচার করার জন্য শুধু ব্যাভিচারিণী নন, তার শিশুসন্তানদের হত্যা করতেও কার্পণ্য বোধ করেন না যীশুঃ
‘সেইজন্য আমি তাকে বিছানায় ফেলে রাখব, আর যারা তার সঙ্গে ব্যভিচার করে তারা যদি ব্যভিচার থেকে মন না ফিরায় তবে তাদের ভীষণ কষ্টের মধ্যে ফেলব। তার ছেলেমেয়েদেরও আমি মেরে ফেলব (প্রকাশিত বাক্য, ২:২২-২৩)’।
ধর্মের সমালোচনা কেন
মানবতাবাদীরা আর যুক্তিবাদীরা কেন ধর্মগ্রন্থগুলোর সমালোচনা করেন? সমালোচনা করেন কারণ তা সমালোচনার যোগ্য, তাই। কোন কিছুই তো আসলে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়— তা সে অর্থনীতি বা পদার্থবিজ্ঞানের নতুন কোন তত্ত্বই হোক, বা আল্লাহর ‘মহান’ বাণীই হোক। সমালোচনার একটি বড় কারণ হল, ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে বিরাজমান নিষ্ঠুরতা। ধর্মগ্রন্থগুলি তো আর গীতাঞ্জলি বা সঞ্চিতার মত নির্দোষ কাব্যসমগ্র নয় যে অবসর সময়ে শুয়ে শুয়ে কাব্য চর্চা করলাম আর তারপর আলমারির তাকে তুলে রেখে দিলাম! ধর্মগ্রন্থগুলিতে যা লেখা আছে তা ঈশ্বরের বাণী হিসেবে পালন করা হয় আর উৎসাহের সাথে সমাজে তার প্রয়োগ ঘটানো হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত সতীদাহর মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুধুমাত্র ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৬ সালের মধ্যে সতীদাহের শিকার হয়েছে ৮১৩৫ জন নারী। এই তো সেদিনও ১৯৮৭ সালে রূপ কানোয়ার নামে একটি মেয়েকে রাজস্থানে পুড়িয়ে মারা হল সতী মাতা কী জয়’ ধ্বনি নিয়ে । সারা গ্রামের মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল— কেউ টু শব্দটি করল না। আর করবেই বা কেন? ধর্ম রক্ষা করতে হবে না? মহাভারতের কথা শুনলে যেমন পুণ্য হয়, সতী পোড়ানো দেখলেও নাকি তেমনি। ধর্ম যে কিরকম নেশায় বুদ করে রাখে মানুষকে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই সতীদাহ। এ জন্যই বোধহয় Pascal বলেছেন- ‘Men never do evil so completelly and cheerfully as when they do it from religious convicition.’ খুবই সত্য কথা । চিন্তা করুন ব্যাপারটা— জীবন্ত নারী মাংস জ্বলছে, ছটফট করছে, অনেক সময় বেঁধে রাখতে কষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝে পালাতে চেষ্টা করছে— আফিম জাতীয় জিনিস গিলিয়ে দিয়ে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে আবার চিতায় তুলে দেওয়া হচ্ছে- কী চমৎকার মানবিকতা (২৫)! প্ৰায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় পড়েছি যে, ইসলামী বিশ্বে শারিয়ার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় সাফিয়া, আমিনারা। কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে কাফিরদের বিরুদ্ধে রোজই যুদ্ধের হাঁক পাড়ছে বায়তুল মোকাররমের ‘বিখ্যাত’ খতিব। তবুও নেশায় বুদ হয়ে ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থের মধ্যে ‘শান্তি’, ‘প্রগতি’ আর ‘সহিষ্ণুতা’ খুঁজে চলেছেন মডারেট ধর্মবাদীরা (২৬)।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই বেশ কিছু ভাল কথা আছে (এগুলো নিয়ে আমার বা কারোই আপত্তি করার কিছু নেই); এগুলো নিয়েই ধার্মিকেরা গর্ববোধ করেন আর এ কথাগুলোকেই নৈতিকতার চাবিকাঠি বলে মনে করেন তারা। কিন্তু একটু সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই বোঝা যাবে- ভালবাসা প্রেম এবং সহিষ্ণুতার বিভিন্ন উদাহরণ যে ধর্মগ্রন্থ এবং তার প্রচারকদের সাথে লেবেল হিসেবে লাগিয়ে দেওয়া হয়, সেগুলো কোনটাই ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থের জন্য মৌলিক নয়। যেমন, যীশুখ্রিষ্টের অনেক আগেই লেভিটিকাস (১৯:১৮) বলে গেছেন, ‘নিজেকে যেমন ভালবাস, তেমনি ভালবাসবে তোমার প্রতিবেশীদের।’ বাইবেল এবং কোরানে যে সহনশীলতার কথা বলা আছে, সেগুলোর অনেক আগেই (খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচশ বছর আগে) কনফুসিয়াস (Confucius) একইরকমভাবে বলেছিলেন- ‘অন্যের প্রতি সেরকম ব্যবহার কোর না, যা তুমি নিজে পেতে চাও না।’ আইসোক্রেটস (Isocrates) খ্রিষ্টের জন্মের ৩৭৫ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন, ‘অন্যের যে কাজে তুমি রাগান্বিত বোধ কর, তেমন কিছু তুমি অন্যদের প্রতি কোর না।’ এমনকি শত্রুদের ভালবাসতে বলার কথা তাওইজমে রয়েছে, কিংবা জৈনের ও বুদ্ধের বাণীতে, সেও কিন্তু যীশু বা মুহম্মদের অনেক আগেই ।
কাজেই নৈতিকতার যে উপকরণগুলোকে ধর্মানুসারীরা তাদের স্ব স্ব ধর্মের ‘পৈত্রিক সম্পত্তি’ বলে ভাবছেন, সেগুলো বিকশিত হয়েছে সমাজবিবর্তনের অবশ্যাম্ভাবী ফল হিসেবে। সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে মানুষ কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যকে ‘ নৈতিক গুণাবলী’ হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে; কারণ ওভাবে গ্রহণ না করলে সমাজব্যবস্থা অচিরেই ধ্বসে পড়ত। বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক সলোমন অ্যাশ বলেন,
‘আমরা এমন কোন সমাজের কথা জানি না, যেখানে সাহসিকতাকে হেয় করা হয়, আর ভীরুতাকে সম্মানিত করা হয়; কিংবা উদারতাকে পাপ হিসেবে দেখা হয় আর অকৃতজ্ঞতাকে দেখা হয় গুণ হিসেবে।’
এমন ধরনের সমাজের কথা আমরা জানি না কারণ অমন সমাজ টিকে থাকতে পারে না। খুব সাদা চোখে দেখলেও, একটি সমাজে চুরি করা যে অন্যায়, এটি বুঝবার জন্য করার জন্য কোন স্বর্গীয় ওহি নাজিল হওয়ার দরকার পড়ে না । কারণ যে সমাজে চুরি করাকে না ঠেকিয়ে মহিমান্বিত করা হবে, সে সমাজের অস্তিত্ব লোপ পাবে অচিরেই। ঠিক একইভাবে আমরা বুঝি, সত্যি কথা বলার বদলে যদি মিথ্যা বলাকে উৎসাহিত করা হয়, তবে মানুষে মানুষে যোগাযোগ রক্ষা করাই দুরূহ হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারগুলো উপলব্ধির জন্য কোন ধর্মশিক্ষা লাগে না। আবার এমনও দেখা গেছে যে, শতাব্দীপ্রাচীন কোন চলমান ব্যবস্থার পরিবর্তন মানুষ নিজে থেকেই করেছে পরিবর্তিত মূল্যবোধের কষ্টিপাথরে মানবতাকে যাচাই করে, এবং অনেকক্ষেত্রেই ধর্ম কি বলছে না বলছে তার তোয়াক্কা না করেই। দাসত্বপ্রথার উচ্ছেদ এমনি একটি ঘটনা। বলা বাহুল্য, কোন ধর্মগ্রন্থেই দাসত্ব উচ্ছেদের আহ্বান জানানো হয়নি। বাইবেলের নতুন কিংবা পুরাতন নিয়ম, কিংবা কোরান, অথবা বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা- কোথাও দাসত্বপ্রথাকে নির্মূল করার কথা বলা হয়নি, বরং সংরক্ষিত করার কথাই বলা হয়েছে প্রকারান্তরে । কিন্তু মানুষ সামাজিক প্রয়োজনেই একটা সময় দাসত্ব উচ্ছেদ করেছে, যেমনিভাবে হিন্দু সমাজ করেছে সতীদাহ নির্মূল বা খ্রিষ্ট সমাজ ডাইনি পোড়ানো বন্ধ। সতীত্ব সম্পর্কে প্রাচীন ধারণা, কিংবা সমকামিতা বা গর্ভপাতের অধিকার সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে সারা পৃথিবী জুড়ে এ কয় দশকে। এ পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির অনেকগুলোই ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত নয়।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী
Let the data decide; উপাত্ত দিয়েই বিচার করা যাক-
আজ আধুনিক রাষ্ট্রগুলির দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, আল্লাহর গুনার দোহাই দিয়ে মানুষ জনকে সৎ পথে পরিচালিত করার ব্যাপারটি কি নিদারুণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হয়েছে। আল্লাহ বা ঈশ্বরের গুনার ভয় দেখিয়েই যদি মানুষজনকে পাপ থেকে বিরত রাখা যেত, তা হলে আর রাষ্ট্রে পুলিশ- দারোগা, আইন-কানুন, কোর্ট- কাচারি কোন কিছুরই প্রয়োজন হতো না। এক ইন্টারনেট ফোরামে একটা সময় রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং ধর্মের নৈতিকতা বিষয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম; সাথে সাথেই এক ধার্মিক ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন- ‘অভিজিৎ রায়ের মত নাস্তিক লোকজন রাষ্ট্রে আছেন বলেই পুলিশ দারোগার প্রয়োজন’। এ ধরনের উক্তিকে স্রেফ একজন মাত্র অজ্ঞ ধার্মিকের আস্ফালন বলে মনে করলে কিন্তু ভুল হবে। এ ধরনের ধ্যান ধারণা অনেকেই মনে মনে পোষণ করেন, তাদের বেশ বড় অংশই আবার সুশিক্ষিত। পাশ্চাত্য বিশ্বে ডিস্কোভারি ইনস্টিটিউটের পুরোধা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের অন্যতম প্রবক্তা ফিলিপ জনসনের মতে, যেহেতু অবিশ্বাসীরা ডারউইনের মতানুসারে মনে করে মানুষ বানর থেকে উদ্ভুত হয়েছে, সেহেতু তারা যে কোন ধরনের ‘নাফরমানি’ করতে পারে- সমকামিতা, গর্ভপাত, পর্ণোগ্রাফি, তালাক, গণহত্যা সবকিছু (২৭)। এমন একটা ভাব, ডারউইন আসার আগ পর্যন্ত সারা পৃথিবী যেন এগুলো থেকে একেবারেই মুক্ত ছিল!
একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি হিসেবে ফিলিপ জনসনের এ ধরনের আবেগপ্রবণ আপ্তবাক্যাবলিতে আমার বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই, বরং আমার আস্থা থাকবে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা হতে প্রাপ্ত ফলাফলে; বিজ্ঞানীরা যেটিকে বলেন, ‘Let the data decide’। আমি ফিলিপ জনসনের সমর্থনে এমন কোন উপাত্ত বা ডেটা খুঁজে পাইনি যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদের চাইতে বেশি অপরাধপ্রবণ; বরং কিছু পরিসংখ্যান একেবারেই উল্টো সিদ্ধান্ত হাজির করছে। আমেরিকায় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে নাস্তিকদের চাইতে পুনরুজ্জীবিত খ্রিষ্টানদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশী; এও দেখা গিয়েছে যে, যে পরিবারের পরিবেশ ধর্মীয়গতভাবে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল সেসব পরিবারেই বরং শিশুদের উপর পরিবারের অন্য কোন সদস্যদের দ্বারা যৌননিপীড়নের হার বেশি (২৭)। ১৯৩৪ সালে আব্রাহাম ফ্রাঞ্জরাউ (Abraham Franzblau) তার গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন ধার্মিকতা এবং সততার মধ্যে বরং বৈরী সম্পর্কই বিদ্যমান। ১৯৫০ সালে মুরে রসের (Murray Ross) গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে যে ধার্মিকদের তুলনায় নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদীরাই বরং সমাজ এবং মানুষের প্রতি সংবেদনশীল থাকেন, তাদের উন্নয়নের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ১৯৮৮ সালে ভারতের জেলখানায় দাগী আসামিদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছিল। জরিপের যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল, তা ছিল অবাক করার মত। দেখা গিয়েছে, আসামিদের শতকরা ১০০ জনই ঈশ্বর এবং কোন না কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী (২৮)। আমেরিকায়ও এরকম একটি জরিপ চালানো হয়েছিল ৫ই মার্চ, ১৯৯৭ তারিখে। সে জরিপে দেখা গেছে যে আমেরিকার জনসাধারণের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মহীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কম (মাত্র ০.২১%), সে তুলনায় ধার্মিকদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা অনেক বেশি (১৪)। আজ বাংলাদেশে জরিপ চালালেও ভারতের মতই ফলাফল পাওয়া যাবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস, বেহেস্তের লোভ বা দোজখের ভয় কোনটাই কিন্তু অপরাধীদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারেনি। আল্লাহর গুণাহ কিংবা ঈশ্বরের ভয়েই যদি মানুষ পাপ থেকে, দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে পারত, তবে তো বাংলাদেশ এতদিনে বেহেস্তে পরিণত হত । কিন্তু বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা আজ কী দেখছি? বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ জন লোকই আল্লা- খোদা আর পরকালে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতিতে এই দেশটিই আজ পৃথিবীর শীর্ষে। ধর্মে বিশ্বাস কিন্তু দেশবাসীকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারেনি। পারবেও না। যে দেশে সর্বোচ্চ পদ থেকে বইতে শুরু করে দুর্নীতির স্রোত, যে দেশে রাজনৈতিক নেতা থেকে সরকারের উঁচু স্তরে-সর্বত্র দুর্নীতি বিদ্যমান- যেখানে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হত্যাকারী, ধর্ষক, গুণ্ডা, ছিতাইকারী, ডাকাত ও মাস্তানরা শুধু রেহাইই পায় না, বরং বুক চিতিয়ে ঘুরে বেরাবার ছাড়পত্র পায়, নেতা হবার সুযোগ পায়, সে দেশের মানুষ নামাজ পড়েও দুর্নীতি চালিয়ে যাবে। এতে আর আশ্চর্যের কি আছে? তারা রোজাও রাখবে, আবার ঘুষও খাবে। তাই হচ্ছে। এই তো ধর্মপ্রাণ, আল্লাহ- খোদায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা। অপরদিকে সিঙ্গাপুরের দিকে তাকানো যাক। এ দেশটিতে অধিকাংশ লোকই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মপরিচয় থেকে মুক্ত । ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্রকেই দেখেছি ধর্মপরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তারা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে— ‘ফ্রি থিঙ্কার’। অথচ, ধর্ম নয়, শুধু আইনের শাসন আর সামাজিক মূল্যবোধগুলোর চর্চা করে সিঙ্গাপুর আজ পৃথিবীর সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির একটি। অধিকাংশ সিঙ্গাপুরবাসীরা আল্লা-খোদার নামও করেন না, নরকের ভয় অথবা বেহেস্তের লোভও তাদের নেই । কোন যাদুবলে তারা তাহলে দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকছে?
উপরের পরিসংখ্যানগুলো দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা নয় যে, মানুষ নাস্তিক হলেই ভাল হবে কিংবা আস্তিক হলেই খারাপ হবে, বরং এটাই বোঝানো যে, ধর্ম কোনভাবেই নৈতিকতার ‘মনোপলি ব্যবসা’ দাবি করতে পারে না । আসলে কোন বিশেষ ধর্মের আনুগত্যের ওপর কিন্তু মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন নির্ভর করে না, নির্ভর করে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট আর সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপর । আসলে আধুনিক যুগের জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে একথা বলা যায় যে, প্রাচীনকালের ধর্মগ্রন্থগুলোর আলোকে নৈতিকতাকে বিশ্লেষণ করলে আর চলবে না, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান এবং বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে । মাইকেল শারমার তার The Science of Good & Evil : Why people Cheat, Gossip, Care, Share and Follow the Golden Rule ব্যাখ্যা করেছেন সমাজ বিকাশের প্রয়োজনেই মানুষ কিছু নীতিকে ‘গোল্ডেন রুল’ হিসেবে গ্রহণ করেছে (৩২) :
Do unto others, as you would have them do unto you.
কারণ এই নীতির অনুশীলন ছাড়া সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকবে না। মাইকেল শারমার তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মানব বিবর্তনের ধারাতেই পারস্পরিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আবার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহনশীলতা, উদারতা, স্বার্থত্যাগ, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি গুণাবলির চর্চা হয়েছে। ফলে সভ্যতার প্রতিনিয়ত সংঘাত ও সংঘর্ষে গড়ে উঠেছে মানবীয় সম্ভাবনাময় নীতিবোধ, যা মানুষকে, প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।
নৈতিকতার ব্যাপারটি শুধু মানব সমাজেরই একচেটিয়া তা নয়, ছোট স্কেলে তথাকথিত অনেক ‘ইতর প্রাণী’ জগতের মধ্যেও কিন্তু এটি দেখা যায়। ভ্যাম্পায়ার বাদুরেরা নিজেদের মধ্যে খাদ্য ভাগাভাগি করে, বানর এবং গরিলারা তাদের দলের কোন সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তাকে সহায়তা করে, এমনকি ‘দশে মিলে’ কাজ করে তার জন্য খাবার নিয়ে আসে। ডলফিনেরা অসুস্থ ডলফিনকে ধাক্কা দিয়ে সৈকতের দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে অসুস্থ ডলফিনটির পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেতে সুবিধা হয়, তিমি মাছেরা তাদের দলের অপর কোন আহত তিমি মাছকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। হাতীরা তাদের পরিবারের অসুস্থ বা আহত সদস্যকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল নয় ।
তাহমিনা আর সুকুমারের গল্পঃ নৈতিকতার বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী
আমি আমার প্রবন্ধটি শেষ করতে চাই একটি নাস্তিক ভারতীয় দম্পতির চলমান স্রোতের বিপরীতে নিরন্তর সংগ্রামের কথা বলে। তাদের ঘটনাটি মুক্তমনায় বছর কয়েক আগে প্রকাশিত হয়েছিল, প্রকাশিত হয়েছিল ভারতের বেশ ক’টি পত্র- পত্রিকায়ও। তাহমিনা খাতুন আর তার স্বামী সুকুমার মিত্র— এই দম্পত্তি ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাস নাগাদ সুন্দরবনে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে চব্বিশ পরগনার নাজাত – এর ‘হোটেল পান্থনিবাসে’ এক রাত থাকবার জন্য যান। হোটেলের ম্যানেজার তাদের ঢুকতেই দিল না। স্পষ্ট অবিশ্বাসের সুরে জানালো, ‘একজন খাতুন কি করে একজন মিত্রের স্ত্রী হয়?’ তারা তখন বাধ্য হয়ে ম্যানেজার সাহেবকে নিজেদের বিয়ের সার্টিফিকেট দেখালেন। তবু ম্যানেজার সাহেব নির্দেশ দিলেন তাহমিনাকে পদবী হিসেবে ‘মিত্র’ লিখতে হবে। তাহমিনা- সুকুমার কেউই এতে রাজি হলেন না । আর কেনই বা হবেন, তারা তো হিন্দু বা মুসলিম পরিচয়ে নিজেদের অভিহিত করেন না। তারা বললেন- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান নই, আমরা মনুষ্যত্বে বিশ্বাস করি এবং মনে করি এটি কোন অপরাধ নয়।’ কিন্তু ম্যানেজার সাহেবের হৃদয় তাতে গলেনি । তিনি তাদের হোটেল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ক্ষুব্ধ, অপমানিত এই দম্পতি ব্যাপারটিকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও জেলার পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্টের নজরে আনেন; এমনকি কনজিউমার্স কোর্টে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন তারা।
এ ধরনের ব্যাপার অবশ্য তাদের জীবনে এই প্রথম নয়। হাবড়ার গান্ধী সেন্টিনারি বিটি কলেজে বিএড পড়ার জন্য এক সময় তাহমিনা খাতুন আবেদন করেছিলেন। তার যোগ্যতা অনুসারে তিনি ছিলেন ৮৮০ জন আবেদনকারীর মধ্যে প্রথম। কিন্তু তিনি আবেদনপত্রে নিজেকে মুসলিম হিসেবে চিহ্নিত করেননি। শুধুমাত্র এই অপরাধে তাকে কলেজে ভর্তি করা হল না। তিনি বারাসত আদালতে মামলা করলেন । কোর্টের রায় হল তার অনুকূলে। স্পষ্ট বলা হল, এভাবে ভর্তি না করার ব্যাপারটি একজনের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং কলেজ কর্তৃপক্ষকে তাকে ভর্তি করে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল । কিন্তু আদালতের নির্দেশ মানা হল না, তাহমিনাকে ভর্তি করা হয়নি। তাহমিনা আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলে আদালতে আবার আবেদন জানিয়েছিলেন। এবং শেষ অব্দি অনেক দেরিতে তাকে প্রয়োজনীয় অনুমতি দেওয়া হল— কিন্তু তখন তার চাকরি করার বয়স পেরিয়ে গেছে।
কিন্তু এই ক্রমাগত নিগ্রহ আর নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও তারা মনোবল হারাননি। ‘হয়ত সারা জীবন ধরেই এসবের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে, তবু আমরা লড়াই থেকে পিছু হটতে চাই না, কারণ, শেষ অব্দি আমাদের জয় হবেই’– এই ছিল তাঁদের দ্বিধাহীন উত্তর (২৯)।
তাহমিনা আর সুকুমারদের মত সংগ্রামীদের নিয়েই গড়ে উঠুক আগামী বিশ্ব। সেই দিনের প্রত্যাশায় –
তথ্যসূত্র
(১) ক্যারেন আর্মস্ট্রং তার ‘Battle of God” বইয়ে বলেছেন, মানুষের চিন্তাধারা অনাদিকাল থেকেই বিকশিত হয়েছে পরিষ্কার দুটি ধারায়। এর একটি হচ্ছে ‘মিথোস’ এবং অপরটি ‘লোগোস’। ‘মিথোস এসেছে ইংরেজি ‘মিথ’ থেকে, আরো গভীরে গেলে পাওয়া যাবে ‘musteion’। মিথের মূল প্রতিশব্দগুলো mystery এবং mysticism, যা প্রকাশ করে রহস্যময়তা, দুয়েতা এবং অতীন্দ্রিয়তাকে। ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর চোখে মিথ হচ্ছে কতগুলো রীতি-নীতি, আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কার- যেগুলোর কোন যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ কখনও পাওয়া যায় না। এগুলো মানব মনে জায়গা করে নিয়েছে স্রেফ কতকগুলো বিশ্বাসের কাঁধে ভর করে । ফশফন গ্রিক শব্দ লোগোসকে বর্ণনা করেছেন ‘যুক্তিগ্রাহ্য’, ‘প্রমাণসাপেক্ষ’, ‘বিজ্ঞান ভিত্তিক’ শব্দ ক’টির সাহায্যে। তিনি বলেন, আধুনিক বিশ্বে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, প্রগতি আর উন্নয়নের মূলে রয়েছে ‘লোগোস’- যা জ্ঞান ও যুক্তির মাপকাঠিতে প্রকৃত বাস্তবতার পরিচায়ক। (আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায়, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৪)।
(২) “The religions of the world, especially Christainity, have laid claim to the role of arbiters of human behavior, They insist that they have the right to tell the rest of us what is right and what is wrong because they have a special pipeline to the place where right and wrong are defined- in mind of god.” see “Do Our Values Come from God? The Evidence Says No, ” Victor Stinger, Mukto- Mona (www.mukto-mona.com)
(৩) আমি কেন ধর্মবিশ্বাসী নই, বাট্রান্ড রাসেল, ভাষান্তর : অরিন ভাদুড়ী, দীপায়ন, ২য় সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৪।
( 8 ) “Religion is an insult to human dignity. With or without it you would have good people doing good things and evil people doing evil things. But for good people to do evil things, that takes riligion.”, Steven Weinberg, In a speech given in Washington, DC, on April 1999.
(৫) নাস্তিকতার সংজ্ঞা, সুমন তুরহান। দেশ ৪ নভেম্বর, ২০০২।
(৬) ‘ধর্ম’ যেহেতু ব্যক্তিগত ব্যাপার তাই ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মীয় পরিচয় জানানো জরুরি নয় বলে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীরা মনে করে। কিন্তু সমস্যা হল, যারা কোন ধর্ম মানে না তারা চাকুরী বা শিক্ষার ক্ষেত্রে কলামটা খালি রাখতে চাইলেও অতীতে আপত্তি উঠেছে নানা জায়গায়; এমনকি ফর্ম বাতিল করা হয়েছে অসম্পূর্ণ বলে। সেই সময় বহুমানুষ দ্বারস্থ হয় ভারতীয় মানবতাবাদী সমিতির। এই সময় প্রথম এই সমিতি Humanists Association of India সক্রিয় হয় মানবতাকে ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে, সেটা ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে। দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ও সংবাদপত্রের দপ্তরে যোগাযোগ করে ঘটনাটি জানানো হয়। যাতে একজন মানুষ নিজের ধর্ম ‘মানবতা’ বলতে পারে তার জন্য সরকারি কোনও নিয়মাবলী বা নির্দেশিকা আছে কিনা তা স্পষ্টভাবে জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে সবাই বলেন যে এভাবে নতুন ধর্ম তৈরি করা সম্ভব নয়। তারপর মানবতাবাদী সমিতি সরাসরি চিঠি পাঠায় জাতিসংঘের অফিসে। উত্তর আসে দেরি না করেই। জাতিসংঘ তাদের ‘মানবিক ও ধর্মীয় অধিকার’ সংক্রান্ত যাবতীয় বই ও কাগজপত্র পাঠিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়- ‘১৯৮১’-এর জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে রাষ্ট্রসংঘ ঘোষণা করেছে প্রতিটি মানুষের যে কোন ধর্মমত গ্রহণ ও চর্চা করার স্বাধীন অধিকার আছে। তারপরই এই আইনী লড়াইতে যৌথভাবে নেমে পড়ে ভারতের মানবতাবাদী সমিতি ও যুক্তিবাদী সমিতি। রাষ্ট্রসংঘকে চিঠি দিয়ে জানানো হয় যে ভারত জাতিসংঘের সদস্য দেশের অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও প্রচলিত ধর্মের বাইরে অন্য ধর্মকে এখানে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। Humanism-কেও ধর্ম বলে স্বীকার করা হয় না। কিন্তু যেহেতু জাতিসংঘ তার নির্দেশিকা পাঠিয়ে দিয়েছে, আমরা জাতিসংঘের অন্তর্গত দেশ হিসাবে মনে করি মানবতা আমাদের ধর্ম হতে কোন বাধা নেই। এবং আইনীভাবে এই ধর্মমতকে গ্রহণ করার অধিকার ভারতের নাগরিকেরা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এই চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও বিদেশী দূতাবাসগুলিতেও। তারপর ভারতের মানবতাবাদী সমিতির সহায়তায় কোর্টে গিয়ে affidavit করে দলে দলে ছেলে- মেয়ে Humanism-কে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে (১৯৯৩ এর ১০ ডিসেম্বর)। বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন : মানুষের ধর্ম মানবতা, সুমিতা পদ্মনাভন, দুই বাংলার যুক্তিবাদীদের চোখে ধর্ম, পুনঃমুদ্রিত, মুক্তমনা (www.mukto-mona.com)
(৭) অলৌকিক নয়, লৌকিক, প্রথম খণ্ড, প্রবীর ঘোষ, দে’জ প্রকাশন
(৮) “I criticized fundamentalists as well as religion in general. I don’t find any difference between Islam and Islamic fundamentalists. I believe religion is the root, and from the root fundamentalism grows as a poisonous stem. If we remove fundamentalism and keep religion, then one day or another fundamentalism will grow again. I need to say that because some liberals always defend Islam and blame fundamentalists for creating problems. But Islam itself oppresses women. Islam itself doesn’t permit democracy and it violates human rights, One brave Woman vs. Religious Fundamentalism. An interview with Taslima Nasrin, Free inquiry magazine, Volume 19, Number 1, available on line http:/www.secularhumanism.org/libray/fi/nasrin 191.html
কোরআন শরীফ (বঙ্গানুবাদ), মাওলানা খান মুহাম্মদ ইউসুফ আবদুল্লাহ, সোলেমানিয়া বুক হাউস ।
(১০) প্রথম আলোর অক্টোবর ১৮, ২০০৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী খোদ বাংলাদেশেই ২৯টি কিংবা তারও বেশি জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : জামাতুল মুজাহিদিন, জাগ্রত মুসলিম জনতা, শাহাদাত-ই আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী, শহীদ নসুরুল্লাহ আল আরাফাত বিগ্রেড, হিজবুত তাওহিদ, জামায়াত-ই ইয়াহিয়া, আল তুরাত, আল হারাত আল ইসলামিয়া, জামায়াতুল ফালাইয়া তাওহিদি জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, জুম্মাতুল আল সাদাত, শাহাদাত-ই-নবুয়ত, আল্লাহর দল, জইশে মোস্তফা বাংলাদেশ, আল জিহাদ বাংলাদেশ, ওয়ারত ইসলামিক ফ্রন্ট, জামায়াত-আস-সাদাত, আল খিদমত, হরকত-এ ইসলাম আল জিহাদ, হিজবুল্লাহ ইসলামী সমাজ, মুসলিম মিল্লাত শরিয়া কাউন্সিল, ওয়ার্লড ইসলামিক ফ্রন্ট ফর জিহাদ, জইশে মুহাম্মদ, তা আমীর উদদীন বাংলাদেশ, হিজবুল মাহাদী, আল ইসলাম মার্টায়ারস বিগ্রেড ও তানজীম । এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ করেছে চারটি আত্মস্বীকৃত ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনকে, এগুলো হল : শাহাদাত ই আল হিকমা (২০০৪) জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি ২০০৫), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি ২০০৫) এবং হরকাতুল জিহাদ (২০০৫)। এর মধ্যে সম্প্রতি কয়েকটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
(১১) ‘আমাদের সময়’ পত্রিকার একটি খবরে (সেপ্টেম্বর ৯, ২০০৫) প্রকাশ ফরহাদ মজহার সাহেব প্রেসক্লাবে একটি আলোচনা সভায় বক্তব্য রেখেছেন যে, ১৭ আগস্টের বোমাহামলাকারীদের যদি সন্ত্রাসী বলা হয়, তবে নাকি ৭১-এর মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী; শুধু তাই নয়, ‘বোমাবাজি সন্ত্রাস-জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এই সমাবেশটিতে সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন বোমাবাজদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যদি ‘অবৈধ’ হয় তবে নাকি ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১-এর সকল আন্দোলনও সবই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। মজহার জেহাদ ও শ্রেণী সংগ্রামকে এক করে দেখেন, আর মার্ক্সিয় তত্ত্ব আউড়ে সেটাকে সময় সময় বৈধতা দিতে চেষ্টা করেন। এই প্রেসক্লাবের আলোচনা সভাতে মজহার সাহেব পরিষ্কার করেই বলেছেন, ১৭ই আগস্টের হামলাকারীরা নাকি ‘তাদের মত করে সমাজটাকে বদলাতে চায়।’ এতে নাকি দোষের কিছু নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিন লাদেনের প্রতি মজহার সাহেব একটা সময় এতই গুণমুগ্ধ ছিলেন যে, তিনি ‘চিন্তা’ নামক একটা পত্রিকায় ‘ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম’ নামের প্রবন্ধের (ডিসেম্বর, ২০০১) সমাপ্তি টেনেছেন করাচীর ‘উম্মত’ নামক পত্রিকায় লাদেনের সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে । চেগুয়েভারা, লেনিন, স্ট্যালিনের মত বিন-লাদেনকেও একই কাতারে ফেলে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে ‘বিপ্লবী কমরেড’ বানিয়ে ছেড়েছিলেন লাদেনকে! ‘প্রগতিশীল’ এবং ‘নিরপেক্ষ’ মজহার বিশ্বাস করতেন না ৯/১১ এর বিধ্বংসী ঘটনায় লাদেন জড়িত থাকতে পারে। কারণ তার ধারণা হয়েছিল, “মুসলমান হিসেবে তিনি মিথ্যা কথা বলেন না।’ ফরহাদ মজহারকে নিয়ে আমার একটি লেখা ‘ফরহাদ মজহারের বিভ্রান্তি’ শিরোনামে দৈনিক ভোরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। প্রবন্ধটি মুক্তমনা (www.mukto-mona.com) ওয়েবসাইটে রাখা আছে ।
(১২) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে (১ম ও ২য় পর্ব), অনন্ত, মুক্ত-মনায় প্রকাশিত। এছাড়া আরও পড়ুন অলস দিনের ভাবনা, অভিজিৎ রায়, মুক্ত-মনা। The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity, by Tariq Ali, Verso; Pbk edition (April, 2003) ; Rogue State: A Guide to the World’s Only Superpower by William Blum, Common Courage Press (May, 2000);
(১৩) দেখুন : http:/www.usccr.gov/pubs/tragedy/imm1012/zogby3.htm
(১৪) দেখুন : The results of the Chiristians vs atheists in prison. investigation, By Rod Swift, http:/holysmoke.org/icr-pri.htm
(১৫) ধর্মের উৎস সন্ধানে (নিয়ান্ডার্থাল থেকে নাস্তিক), ভবানীপ্রসাদ সাহু, প্রবাহ, জানুয়ারি ১৯৯২
(১৬) বিস্তারিত তথ্যের জন্য পড়ুনঃ মুক্ত-মনা কারা? অভিজিৎ রায়,
Response to Manosh on Criticism of Islam etc in Mukto-Mona by Avijit Roy; Hoax of “Constructive Criticism” by Avijit Roy http:/www.mukto-mona.com/articles/avijit/index.htm
( ১৭ ) The Holy Quran, Translation by Adbullah Yusuf Ali, Goodwords Books 2001.
(১৮) অবশেষে হরকাতুল জিহাদ নিষিদ্ধ, প্রথম আলো রিপোর্ট; ১৮ই অক্টোবর, ২০০৫।
(১৯) TERRORIST AND INSURGENT ORGANIZATIONS, Air University Library Publication,
(২০) My Religion, by Avijit Roy http:/humanists.net/avijit/article/my- religion-avijit.htm
(২১) বাল্মীকি রামায়ণ, হেমচন্দ্র অনুদিত, রিপ্লিকেট পাবলিকেশন, কলিকাতা ১৯৮৪, পৃঃ ১০৬৭-৭১
(২২) মহাকাব্যগুলোতে প্রভাব বিষয়ে আলোচনার জন্য দেখুন : মহাকাব্য ও মৌলবাদ, জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়, এলাইড পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা। এবং Laws of Manu, translated with extracts from seven commentaries by G. Buhler, ed. F Max Muller, Clarendon Press, Oxford, 1886.
(২৩) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, সুকুমারী ভট্টাচার্য, দীপ প্রকাশন, ২০০০।
(২৪) মহাকাব্য ও মৌলবাদ, জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়, এলাইড পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা ৷
(২৫) সতীঃ একের আনলে বহুরে আহুতি, ভাস্বতী চক্রবর্তী, দেশ ৪ জানুয়ারি, ২০০৩। (২৬) সত্যি কথা বলতে কি- আমি আসলে বিন-লাদেন, মুফতি হান্নান, বাংলাভাই, মোল্লা ওমর, খোমেনি বা মৌলানা মান্নানের মত লোকদের তেমন একটা দোষ দেই না; অন্তত তারা কথায় আর কাজে এক । আল্লাহ কোরানে যেভাবে যেভাবে বলেছেন, ঠিক সেভাবেই কোরানের আদর্শকে সামনে রেখে তারা কাজ করে চলেছেন। আমি আসলে দোষ দেই ‘শিক্ষিত’ এবং ‘মডারেট’ তকমাধারী (বক) ধার্মিকদের যারা কোরানের মধ্যে সহিষ্ণুতা খুঁজে পান আর চারিদিকে এত অশান্তি দেখেও ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেন। ঠিক একই ব্যাপার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের জন্যও খাটে যারা রামের শাসনামলে শূদ্র তাপস শম্বুক কিংবা রামপত্মী সীতার কি করুণ অবস্থা হয়েছিল তা না জেনেই ‘রাম রাজ্য’ প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, অথবা বেদ, গীতা, উপনিষদ মনুসিংহিতায় কি আছে তা না জেনেই হিন্দু ধর্মকে সহিষ্ণুতম ধর্ম হিসেবে আখ্যা দিয়ে বসেন, আর মারামারি হানাহানি আর সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির জন্য দায়ি করেন কেবল গুটিকয় আদভানী আর লালু প্রসাদকে ।
(২৭) দেখুনঃ see “Do Our Values Come from God ?, The Evidence Says No”. Victor stinger, http:/www.colorado.edu/philosophy/vstinger/ Godless/Values.htm অলৌকিক নয়, লৌকিক, তৃতীয় খণ্ড, প্রবীর ঘোষ, দে’জ প্রকাশনী, পৃঃ ৩৯।
(২৯) নাস্তিক হওয়ার অপরাধে, ভবানী প্রসাদ সাহু, দীপ প্রকাশন, ২০০০। (৩০) পবিত্র বাইবেল, পুরাতন ও নূতন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা, ২০০০ ।
(৩১) ‘Do not think that I have come to send peace on earth : I have not come to send peace, but a sword. For I have come to set a man at against his father, a daughter against her mother, and a daughter- in-law against her mother-in law’ (Matthew 10:34-37 RSV)-47 বঙ্গানুবাদ ৷
(৩২) The Science of Good & Evil: Why People Cheat, Gossip, Care, Share and Follow the Golden Rule, Michael Shermer, New York: Times Boojs, 2004.
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ