কাউকে মুখের ওপর না বলা আমার স্বভাবে নেই। না বলতে না-পারার অক্ষমতার খেসারত আমাকে নানানভাবে দিতে হয়। যেমন—
ক) চিনি না জানি না তরুণীর বিয়েতে উকিল বাবা।
খ) অপরিচিত্র শিশুর খৎনা অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি।
গ) নতুন লেখকের অখাদ্য উপন্যাসের ভূমিকায় লেখা– তরুণ ঔপন্যাসিকের গল্প বলার মুন্সিআনায় আমি বিস্মিত।
না বলতে না-পারার জটিল ব্যাধিতে যিনি আক্রান্ত তাকে দিয়ে ঢেঁকি বা রাইসমিল গেলানো তেমন কঠিন কর্ম না। কাজেই এক দুপুরে আমি দেখলাম যে নুহাশ পল্লীর হিমু উৎসব নামক রাইসমিল আমি গিলে বসে আছি।
কুড়িজন হিমু (এদের মধ্যে চারজন তরুণী হিমু) যাবে নুহাশ পল্লীতে। তারা সারাদিন সেখানে ঘুরবে। আমাকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হবে। উদ্যোক্তা বাংলালিংক নামক টেলিফোন কোম্পানি। হিমুদের নিয়ে তারা একটি sms কনটেস্ট করেছে। পঞ্চাশ হাজারের মতো হিমু সেই কনটেস্টে অংশগ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে সেরা বিশজন যাবে নুহাশ পল্লীতে।
প্রতিটি দুষ্ট বুদ্ধির পেছনে একজন দুষ্টমান থাকেন। (বুদ্ধিমানের মতোই দুষ্টমান।) পুরো পরিকল্পনার দুষ্টমানের নাম ইবনে ওয়াহিল বাপ্পি। সে একসঙ্গে অনেক কিছু করে—
কবিতা লেখে।
নাটক লেখে।
অভিনয় করে।
বই ছাপায়।
অ্যাড বানায়।
প্রয়োজন অপ্রয়োজনে জনসংযোগ করে।
উদ্ভট উদ্ভট আইডিয়া দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
বাপ্পির আইডিয়াতে হিমু উৎসবে রাজি হলাম। বাপ্পি বলল, স্যার, দেখার মতো দৃশ্য হবে। বিশজন হিমু মনের আনন্দে হলুদ পোশাক পরে খালিপায়ে নুহাশ পল্লীতে ছোটাছুটি করছে। হিমুর স্রষ্টা হিসেবে তাদের আনন্দ আপনি দেখবেন না?
আমি বললাম, আনন্দ দেখা যেতে পারে।
সে উৎসাহের সঙ্গে বলল, হিমু সঙ্গীত লিখে ফেলেছি। একটা অন্তরা শুধু বাকি। আশা করছি ঐদিন হিমু সঙ্গীত গীত হবে।
হিমু সঙ্গীতও আছে?
অবশ্যই। আমার মূল পরিকল্পনা জাতীয় পর্যায়ে হিমু দিবস পালন। অশোকের শিলালিপির মতো জায়গায় জায়গায় হিমুলিপি। হিমু পদযাত্রা।
আমি বললাম, সেটা আবার কী?
একদল খাঁটি হিমু তেতুলিয়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে টেকনাফ যাবে। সেখান থেকে যাবে সেন্টমার্টিন। আপনার বাড়ি সমুদ্র বিলাস-এ পৌঁছার পর পদযাত্রার সমাপ্তি। আপনিও আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তবে আপনাকে হাঁটতে হবে না। আপনি থাকবেন গাড়িতে।
হিমু সঙ্গীত একটা অন্তরার অভাবে শেষ পর্যন্ত আটকে রইল। তবে কেন্দুয়া থেকে ইসলামুদ্দান বয়াতী তার দলবল নিয়ে চলে এল এবং সকাল থেকে বাদ্যবাজনা শুরু হয়ে গেল–
নুহাশ পল্লীতে এলে আমরা
কী দেখিতে পাই?
চারদিকে ঘুরিতেছে
শত হিমু ভাই।
আহা বেশ বেশ বেশ
আহা বেশ বেশ বেশ।
তাদের গায়ের জামা হলুদ রঙের হয়
পায়ে জুতা স্যান্ডেল কখনোই নয়।
আহা বেশ বেশ বেশ
আহা বেশ বেশ বেশ
এগারোটার দিকে টেলিফোন কোম্পানির গাড়ি ভর্তি করে হিমুদের দল চলে এল। অবাক হয়ে দেখি তাদের কারো গায়েই হলুদ পাঞ্জাবি নেই এবং কারোর পা খালি না। আমি বাপ্পিকে বললাম, ব্যাপার কী? এরা শুনেছি ভেজালবিহীন খাঁটি হিমু। এদের হলুদ পাঞ্জাবি কোথায়?
বাপ্পি মাথা চুলকে বলল, ব্যাপারটা আমিও বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। এখন পরবে।
আলোচনার শুরুতেই ছিল পরিচয়পর্ব। পরিচয়পর্বে দেখা গেল অর্ধেকের বেশি মফস্বলের হিমু। চাঁদপুরের হিম, দিনাজপুরের হিমু। মফস্বলের হিমুদেরকে খানিকটা উগ্র বলেও আমার কাছে মনে হলো। তারা আমাকে জানাল যে, হিমু বিষয়ক সমস্ত বই তারা অধ্যয়ন করেছে। একটি বিষয়ে তারা কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না বলে চিন্তিত। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কোন বিষয়ে?
হিমুদের কি প্রেম করার অধিকার আছে?
আমি জবাব দেবার আগেই অন্য হিমুরা কথা বলা শুরু করল। এবং তাদের কাছ থেকে জানলাম–
ক) হিমুরা আগ বাড়িয়ে প্রেম নিবেদন করতে পারবে না। তবে কোনো মেয়ে তাদের প্রেমে পড়লে তারা ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি অবলম্বন করবে।
খ) হিমুদের রূপা টাইপ প্রেমিকা একজন থাকতে পারে। তবে রূপার সঙ্গে (অর্থাৎ রূপা টাইপ প্রেমিকার সঙ্গে) কখনো দেখা করা যাবে না, তবে মোবাইলে কথা বলা যাবে এবং sms চালাচালি করা যাবে।
আলোচনার মাঝখানে একজন মফস্বল হিমুকে হঠাৎ বের হয়ে যেতে দেখলাম। মিনিট দশেক পর সে হলুদ পাঞ্জাবি, খালি পা এবং সানগ্লাস চোখে পরে উদয় হলো।
বাকি হিমুরা হৈহৈ করে উঠল, হিমুরা কখনো সানগ্লসি পরে না।
বেচারা সানগ্লাস খুলে মনমরা হয়ে একা ঘুরে বেড়াতে লাগল।
আধঘণ্টা পর নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার চিন্তিত মুখে কানে কানে আমাকে বলল, খালি পায়ের হিমু ভাইয়ের মাথায় মনে হয় ক্র্যাক স্যার। উনি কিছুক্ষণ এক জায়গায় লাফিয়ে এখন কদম গাছের মগডালে উঠে কেমন করে জানি শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
আমি বললাম, তুমি আশে পাশে থাক। এবং যে-কোনো সময় যে-কোনো দুর্ঘটনার জন্য তৈরি থাক।
ম্যানেজার চিন্তিত মুখে কদমগাছের দিকে ছুটে গেল।
অনুষ্ঠানের একটি পর্বে ছিল হিমুর স্রষ্টার সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ।
এই পর্বে আমি সবার চোখের আড়ালে বসে থাকব। আমার সামনে একটা খালি চেয়ার থাকবে। হিমুরা একজনের পর একজন সেই চেয়ারে বসবে এবং একান্তে কথা বলবে।
আমি বাপ্পিকে বললাম, এই পর্বটি বাদ দাও। আমি হিমুদে ভাবভঙ্গির মধ্যে হঠাৎ প্রবল আউলাভাব লক্ষ করছি। কে কী করে বসে তার নাই ঠিক।
এই পর্ব বাদ গেল।
দুজন হিমুকে দেখলাম অত্যন্ত উত্তেজিত। তারা বলছে, একটা হলুদ পাঞ্জাবি কিনলেই হিমু হওয়া যায় না। হিমু হওয়া সাধনার ব্যাপার। যুব সমাজের ভেতর এই সাধনার অভাব। বাংলাদেশে যত হিমু দেখা যাচ্ছে তার সবই ভেজাল। প্রতি পূর্ণিমাতে জোছনা দেখা হিমুদের জন্যে অবশ্যকর্তব্য, অথচ বেশির ভাগ হিমু পূর্ণিমা কবে তাই জানে না। হিমদের জন্যে মিসির আলির বই পড়া নিষিদ্ধ। অথচ এখানে অনেক হিমু আছে যারা মিসির আলির বই পড়ে। এরা হিমু সমাজের কলঙ্ক।
হিমুদের যে মিসির আলির বই পড়া নিষিদ্ধ এই তথ্য আমি নিজেও জানতাম না। নতুন জ্ঞান পেয়ে ভালো লাগল।
মেয়ে হিমুদের একজন এসে বলল, স্যার, সোনার রঙ তো হলুদ। আমরা মেয়ে হিমুরা কি সোনার গয়না পরতে পারি?
আমি বললাম, অবশ্যই পরতে পার।
হলুদ শাড়ি পরলে মনে হয় কোনো গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। এর কী করব?
হলুদ পাঞ্জাবি পরলে হয় না?
না হয় না। তাহলে ছেলে হিমুদের সঙ্গে আমাদের তফাত কী থাকল?
টেলিফোন কোম্পানি হিমুদের জন্যে কিছু গিফটের ব্যবস্থা করেছিল। তার মধ্যে একটা করে মোবাইল ফোনের সেট ছিল। হিমুরা সবাই আগ্রহ করে মোবাইল সেট নিল, যদিও হিমুদের বৈষয়িক আসক্তি থেকে মুক্ত থাকার কথা।
দুপুর আড়াইটায় খাবার দেয়া হলো। হলুদ রঙের খাবার– খিচুড়ি। আমি প্রচণ্ড মাথা ধরেছে এই অজুহাতে হিমুদের কাছ থেকে বিদায় চাইলাম।
তারা বলল, গুরু রেস্ট নিন। আপনার রেস্টের প্রয়োজন আছে।
খুব হালকাভাবে লেখাটা লিখলাম। লেখাটা আরেকটু গুরুত্বের সঙ্গে লেখা উচিত ছিল। পৃথিবীতে কাল্টের (Cult) বিষয়টি প্রবলভাবেই আছে। কিছু মানুষের জিনের ভেতরই হয়তোবা Cult সদস্য হবার বিষয় থাকে। গুরুর নির্দেশে এরা করতে পারে না এমন কাজ নেই।
কাল্টের সংজ্ঞা হচ্ছে, ক্ষুদ্র একদল মানুষ যারা গুরুর পেছনে সীমাহীন আবেগে একত্রিত হয়। শ্রীলঙ্কার প্রভাকরণকে এক অর্থে Cult গুরু বলা চলে। তালেবানরাও তাই। জাপানে এক প্রায় অন্ধ Cult গুরুর (Shoko Asahara) আদেশে বহু মানুষকে Serin গ্যাস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনা ১৯৯৫ সনের। এই গুরুর দলের নাম Aum Shinikyo দলের সদস্যরা গুরুকে দেখত শারের
জিম জোনস (James Warrarn Jim Jones)-এর ঘটনা তো সবার জানা। ১৭ নভেম্বর ১৯৭৮ সনে তার কারণে ৯০০ মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে।
হিমু নামের যে গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে এরা অবশ্যই নির্বিষ, ভেজিটেবল টাইপ। তবে এদেরকে কখনোই একত্রিত হতে দেয়া যাবে না। সব কাল্ট সদস্য একসময় নির্বিষ ভেজিটেবল থাকেন।
পাদটিকা
রাশিয়ার মস্কো শহরে একটি হিমু ক্লাব হতে যাচ্ছে। ক্লাবের সদস্যরা বাঙালি না, রাশিয়ান। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের ছাত্রছাত্রী। ওরা হিমুকে নিয়ে লেখা কয়েকটি বই রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছে। বইগুলির প্রকাশনা উৎসবেই ক্লাব তৈরির ঘোষণা দেয়া হবে। উৎসবে আমন্ত্রিত সব অতিথিনে হলুদ রঙের কিছু পরতে হবে। অতিথিদের বড় অংশ ডিপ্লোমেট। তাদের জন্যে ৫০টা হলুদ টাই কেনা হয়েছে।
সূত্র : বাংলাদেশে রুশ দূতাবাসের এক তরুন কর্মকর্তা, পাভেল। সে নিজেও নাকি একজন হিমু।
“কাঠপেন্সিল” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ