পলিথিনের ব্যাগে পাঁচটা শিং মাছ নিয়ে নিজাম সাহেব বাড়ি ফিরছেন। মাছগুলি যেন মরে না যায় সে জন্যে বুদ্ধি করে ব্যাগে খানিকটা পানি নিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে ব্যাগে পানি নেয়াটা চূড়ান্ত বোকামি হয়েছে। পানি টুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তার প্যান্ট ইতিমধ্যেই মাখামাখি হয়ে গেছে। নিজাম সাহেব লন করেছেন, তার ৪১ বছরের জীবনে তিনি বুদ্ধি করে যে কটা কাজ করেছেন সব কটাই চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা বলে পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে বুদ্ধি খাটিয়ে তার কিছু করাই ঠিক না।
পাঁচটা শিং মাছের দাম নিয়েছে চল্লিশ টাকা। ঠকেছেন বলে মনে হচ্ছে। প্রতিটি শিং মাছের দাম পড়েছে আট টাকা। শিং মাছ সস্তা ধরনের মাছ–সাপের মত কিলবিল করে। এই মাছ আট টাকা পিস হতেই পারে না। বাড়ি ফিরলে স্ত্রীর কাছে প্রচণ্ড ধমক খেতে হবে। নিজাম সাহেবের স্ত্রী ফরিদা–সুপারি গাছের মত সরু। তার বুদ্ধিও সরু। তেজ ভয়াবহ। ফরিদার সরু বুদ্ধি এবং ভয়াবহ তেজের কাছে নিজাম সাহেব কেঁচোর মত হয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে মনে হয় মাপ মত গর্ত পেলে গর্তে ঢুকে যেতেন।
বাজার দেখে, ফরিদা কি বলতে পারে তা নিজাম সাহেব কলপনা করতে করতে যাচ্ছেন। কল্পনা করতে ভাল লাগছে না। কিন্তু উপায় নেই, অন্য কিছু মাথায় আসছে না। প্রথমেই ফবিদা বরফ-শীতল গলায় বলবে–মাছ আর তরকারি আলাদা এনেছ তো? ঐ দিনের মত মাছ-তরকারি-পান-সুপারি সব এক সাথে আননি তো?
না, সেই ভুল নিজাম সাহেব করেননি। মাছ আলাদা আছে।
কাঁচা সুপারি আনতে বলেছিলাম, এনেছ? না ভুলে বসে আছ? যেটা বলা হয়। সেটা তো মনে থাকে না।
আজ মনে আছে। বাজারে ঢুকেই প্রথম কাঁচা সুপারি কিনেছেন।
শিং মাছ আনতে বলেছিলাম, এনেছ? না রাক্ষুসী মাগুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছ? তুমি কচি খোকা তো, যে যা বলে তাই বিশ্বাস কর। আশ্চর্য মানুষ! কত করে নিয়েছে মাছ?
পঁচিশ টাকা নিয়েছে। পাঁচ টাকা পিস।
(নিজাম সাহেব মিথ্যা বলতে পারেন না। মিথ্যা কথা তার গলার ফুটো দিয়ে বের হয় না। তার ধারণা তার গলার ফুটো খুব সরু বলে এই সমস্যা হয়। তবে আজ বাধ্য হয়ে মিথ্যা বলতে হবে।)।
পঁচটা মাছ পঁচিশ টাকা নিল? বাড়িতে কি টাকার গাছ পুঁতে রেখেছ? না তুমি বাংলাদেশের মন্ত্রী-মিনিস্টার? একটা দাম বলবে আর হুট করে দিয়ে দিবে? নাকি মেছো হাটায় গিয়ে বড়লোকি চাল দেখাও? দরদাম করতে ভাল লাগে না? পাঁচ টাকা পিস শিং মাছ কি মনে করে কিনলে? এই শিং মাছগুলির শিং কি সোনা দিয়ে বাধানো?
ফরিদার এই সব কথা তাকে মাথা নিচু করে শুনতে হবে। কোন উপায় নেই। তিনি যদি বলেন মাছ পনেরো টাকা হয়েছে, তিন টাকা করে পিস। তারপরেও কথা শুনতে হবে।
ঝিনুকের চুন আনতে বলেছিলাম, এনেছ?
নিজাম সাহেব চমকে উঠলেন। ঝিনুকের চুন আনা হয়নি। কি সর্বনাশ! ভেবে রেখেছিলেন সব বাজার শেষ হলে চুনটা কিনবেন। এইটাই ভুল হয়েছে। কাঁচা সুপারি কেনার সময়ই চুনটা কেনা উচিত ছিল। চুন ছাড়া বাড়িতে যাওয়াই যাবে না। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তার উচিত ছিল পেছন ফিরে যে দিক থেকে এসেছেন। সেদিক রওনা হওয়া–তা না করে তিনি ঠিক করলেন রাস্তা পার হবেন। প্রাচীন একটা কুসংস্কার আছে–যে রাস্তায় আসবে সে রাস্তায় ফেরত যাবে না।
রাস্তা বদল করতে গিয়েই দুর্ঘটনাটা ঘটল। দশ টনি এক ট্রাক তার গায়ের উপর এসে পড়ল। তাকে চাপা দিয়ে উদ্ধার গতিতে পার হয়ে গেল। অ্যাকসিডেন্টের পর। ট্রাকওয়ালারা খুব সাবধান থাকে। ট্রাক থামায় না। ট্রাক থামালে পাবলিকের হাতে ধরা খেতে হবে। এটা হতে দেয়া যায় না।
দশ টন মাল বোঝাই একটা ট্রাক নিজাম সাহেবের উপর দিয়ে চলে গেছে, তারপরেও তিনি খুবই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, তিনি তেমন ব্যথা পাননি। ইনজেকশনের সূচ ফোটার মত ব্যথা–যা মোটেই ধর্তব্য নয়। ট্রাকচাপা পড়লে ব্যথা পাওয়া যায় না–এই সত্য আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হাতের তরকারির ব্যাগ এবং মাছের ব্যাগ ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। মাছের ব্যাগ থেকে মাছগুলি বের হয়ে এঁকে বেঁকে যাচ্ছে। নর্দমার মধ্যে পড়লে এদের আর পাওয়া যাবে না। নিজাম সাহেব অতি ব্যস্ত হয়ে মাছগুলির কাছে ছুটে গেলেন। বাড়িতে শিং মাছ না নিয়ে গেলে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। তিনি ট্রাক চাপা পড়েছেন এই ঘটনা শুনেও ফরিদা তাকে রেহাই দেবে না।
নিজাম সাহেব উবু হয়ে বসলেন, মাছ ধরতে গেলেন, ধরতে পারলেন না। আঙুলের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত উপায়ে মাছগুলি বের হয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! ঘটনা কি? এর মধ্যে প্রচুর হৈ চৈ শুরু হয়েছে। রাস্তার উপর শত শত লোক জমে গেছে। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। নিজাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন–রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। সেই রক্তে মাখামাখি হয়ে যে শুয়ে আছে সে আর কেউ না, তিনি নিজে।
এই দৃশ্য দেখার পরেও তার বুঝতে কিছু সময় লাগল যে তিনি আসলে মারা গেছেন। অপঘাতে মৃত্যুর পর মানুষ ভূত হয়। তিনিও তাই হয়েছেন। ভূত হয়েছেন। বলেই কেউ তাকে দেখতে পারছে না–তবে তিনি নিজে নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পারছেন। যদিও তার শরীরগত কিছু পরিবর্তন হয়েছে তিনি শিং মাছ ধরতে পারছেন না। মাছগুলি হাতের আঙুল ভেদ করে বের হয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যুর আগে তার গায়ে যে পোশাক ছিল, ভূত হিসেবেও তার গায়ে একই পোশাক। এমনকি শিং মাছের পানি লেগে প্যান্ট ভিজে গিয়েছিল–এখনও প্যান্টটা ভেজা। ভেজা প্যান্ট থেকে আঁশটে গন্ধ আসছে। ভূতরা তাহলে গন্ধ পায়? এই রহস্যময় ব্যাপারটার মানে কি কে জানে। তবে কোন রহস্যময় ব্যাপার নিয়ে আপাতত তার মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করছে না। মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। ধাতস্থ হতে সময় লাগবে। সিগারেট খেতে পারলে হত। ভূতরা সিগারেট খায় কি না তিনি জানেন না।
অ্যাকসিডেন্টের জায়গায় প্রচণ্ড ভিড়। পুলিশ চলে এসেছে। ট্রাফিক পুলিশ পো পে করে বাশি বাজাচ্ছে। কি হয়েছে সবাই এক নজর দেখতে চায়। তিনিও উঁকি দিলেন। এমন ভিড় যে কিছু দেখার উপায় নেই। নিজের ডেডবডি অথচ তিনি নিজে দেখতে পারছেন না। এরচে বড় ট্রাজেডি আর কি হতে পরে? তিনি ফঁক-ফোকর দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলেন। এই সময় তার পিঠে কে যেন হাত রেখে। বলল, স্যার, আপনিই মারা গেছেন?
নিজাম সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, জ্বি।
নিজের মৃত্যুর কথা নিজের মুখে বলতে লজ্জা লাগল।
খুবই আফসোসের কথা। ভেরি স্যাড।
লোকটির কথায় নিজাম সাহেব অভিভূত হলেন। যখন মানুষ ছিলেন তখন এত সহানুভূতি নিয়ে কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি। ভূত হবার পর মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছেন, এটা তুচ্ছ করার ব্যাপার না।
স্যার, আপনার নাম কি?
নিজাম। নিজামুদ্দিন।
আমার নাম মোতালেব। আমিও আপনার মত ভূত। ঐ যে টাইলসের একটা দোকান দেখছেন ইউরেকা টাইলস আমি ছিলাম ঐ দোকানের ম্যানেজার।
ও।
দোকানের মধ্যেই পা পিছলে বেকায়দা অবস্থায় পড়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। হাসপাতালে নেবারও সুযোগ হয়নি।
ও।
তারপর থেকে এইখানেই আছি। রাতে দোকানে ঘুমাই।
নিজাম সাহেব আবারও বললেন, ও।
মেইন রোডের উপর দোকান। ট্রাক-ফাঁক সারারাত চলে, ঘুম ভাল হয় না।
ভূতদের ঘুমের প্রয়েজন হয় তার জানা ছিল না। ভূত জগৎ সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানেন না। ধীরে ধীরে সব জানবেন। মোতালেব সাহেবকে পাওয়ায় তার লাভ হয়েছে। সাধারণ জিনিশগুলি তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাবে।
মোতালেব বলল, এইখানে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে কি করবেন স্যার, চলে যান।
নিজাম সাহেব বললেন, কোথায় যাব?
ভাবীর কাছে চলে যান। এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, ভাবীর আশেপাশে থাকলেও একটা সান্ত্বনা।
যাব কি ভাবে?
রিকশা করে চলে যান। আপনার তো আর রিকশা ভাড়া লাগবে না। চালু একটা রিকশা দেখে লাফ দিয়ে সীটে উঠে বসে পড়ুন। আপনার বাসা কোথায়?
কলাবাগান।
ঐ দিকে যাচ্ছে এমন একটি রিকশায় উঠে বসুন। আমি অবশ্যি কোথাও যেতে হলে গাড়িতে করে যাই। তবে রিকশার আলাদা মজা আছে।
নিজাম সাহেব চুপ করে আছেন। এত দিন ভেবেছিলেন ভূতরা বাতাস হয়ে ঘুরে বেড়ায়–এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপার সে রকম নয়। চলাফেরার জন্যে তাদেরও রিকশা, বেবীটেক্সি লাগে।
মোতালেব বলল, স্যারের মনটা এত খারাপ কেন?
নিজাম সাহেব বললনে, না না, মন খারাপ না। একটু ইয়ে লাগছে। কথা নেই। বার্তা নেই হঠাৎ ভূত হয়ে গেলাম।
মোতালেব বলল, একটু ইয়ে তো লাগবেই। শুধু একটু না, অনেকটু ইয়ে লাগবে। আধঘণ্টা আগেও ছিলেন মানুষ, এখন হয়েছেন ভূত। আমি যখন প্রথম ভূত হই–কি অভিজ্ঞতা! কি করব না করব কিছুই জানি না। তখন ছিল ঘোর বর্ষা, বুঝলেন ভাই সাহেব। আমি বেকুবের মত সারারাত বৃষ্টিতে ভিজলাম। তার কোন প্রয়োজন ছিল না। ইচ্ছা করলেই যে কোন বাড়িতে ঢুকে যেতে পারতাম। আমরা হলাম ভূত–দরজা বন্ধ থাকুক বা না থাকুক, আমরা যে কোন ফুটোফাটা দিয়ে ঢুকতে পারি, তাই না?
কিছু না বুঝেই নিজাম সাহেব বললেন, জ্বি।
বুঝলেন ভাই সাহেব, যেহেতু কিছুই জানি না–সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে আমার হয়ে গেল সর্দি। বুকে কফ বসে গেল–খকর খকর করে কাশি।
নিজাম সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, ভূতদের সর্দি হয়?
মোতালেব বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাঙের যদি সর্দি হতে পারে, ভূতের হবে না। কেন? আমরা কি ব্যাঙের চেয়েও খারাপ?
নিজাম সাহেব কিছু বললেন না। তার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। মোতালেব বলল, শুধু শুধু দেরি করছেন কেন স্যার? চলে যান। ভাবীর পাশে বসে থাকুন। আপনার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর পর ভাবী আছাড়-পিছাড় খেয়ে কাদবে। ঐ দৃশ্য দেখে খুব মজা পাবেন। একটা রিকশা নিয়ে চলে যান। তবে চোখকান খোলা রাখবেন–একটু কেয়ারফুল থাকবেন।
কেয়ারফুল থাকব কেন?
কিছু সন্ত্রাসী ভূত আছে। চাদাবাজ। ভদ্রতা বলতে কিছুই জানে না। মানুষ থাকতে যেমন বদ ছিল মরে আরো বদ হয়েছে। অকারণে মারধোর করে।
নিজাম সাহেব আঁতকে উঠে বললেন, সে কি!
পরশুদিনের ঘটনা–একটা পাজেরো গাড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। নতুন গাড়ি দেখে লোভ লাগল। গাড়ির প্রতি আমার আবার একটা দুর্বলতা আছে। বিকেলের দিকে গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। পাজেরো দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। লাফ দিয়ে গাড়িতে ঢুকে পড়লাম। গাড়ি যাচ্ছিল গুলশানের দিকে। ফার্মগেটেই রেড লাইট। গাড়ি থামছে। আমি বেকুবের মত মাথা বের করেছি। আমাকে দেখেই চার-পাঁচ সন্ত্রাসী ভূত হৈ চৈ করে ছুটে এল। আমি কিছু বোঝার আগেই জানালা দিয়ে টেনে বের করে ফেলল। দিল ধোলাই। এখনো আমার হাতে-পায়ে ব্যথা।
নিজাম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, সর্বনাশ!
অপঘাতে যারা মারা যায় তারাই তো ভূত হয়–অপঘাতে মারা যায় কারা? সন্ত্রাসী-খুনী-চাদাবাজ। আমরা যারা সাধারণ ভূত তারা এদের হাতে জিম্মি। কাওরান বাজারে এক খুনী-ভূত আছে–রামদা হাতে বসে থাকে। কাউকে দেখলেই হুঁ হুঁ হুঁ শব্দ করে রামদা হাতে ছুটে আসে। ভাই সাহেব, কাওরান বাজার এলাকার দিকে ভুলেও যাবেন না।
জি আচ্ছা।
মিরপুর চার নাম্বারেও যাবেন না।
ঐখানে কি?
মিরপুরে আছে দুই ভাই–ছদরুল-বদরুল, দুভাই-ই ভয়ঙ্কর। আমার। ফ্যামিলি থাকে মীরপুরে। দুবছরের উপর হয়ে গেল ওদের দেখতে যেতে পারি। নাই। মন মানে না, দেখতে ইচ্ছ করে–বেকুবের মত একবার চুপি চুপি চলে গেছি, বাসায় উঠার আগেই দুজনের হাতে ধরা পড়লাম। কিরিচের এক কোপে তারা আমার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলল–তারপর সেই কাটা পা নিয়ে কি খুশি! ফুটবলের মত ছোড়াছুঁড়ি করে। ওরা পা নিয়ে লাফালাফি করছিল, আমি সেই ফাঁকে কোনক্রমে পালিয়ে এসেছি। দুমাস ভুগলাম–দুই মাসে নতুন পা গজাল।
পা গজায়?
তা গজায়। লেজের মত গজায়–ভূত হবার এই এক সুবিধা। যখন পা কাটা গেল তখন জানতাম না পা আবার গজায়। খুব মন-কষ্টে ছিলাম, তারপর একদিন দেখি পা গজিয়েছে। দেখুন না।
ভদ্রলোক পায়জামা পরে ছিলেন। পায়জামা সরিয়ে গজানো পা দেখালেন। এবং নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, গজানো পা আসল পায়ের মত হয় না। দুর্বল হয়–জোর পাওয়া যায় না। তবু যে পা গজায় সেটা কম না। ভূত-জীবনে দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। হাত-পা গজানোর সিস্টেম না থাকলে বিরাট বিপদ ছিল।
মাথা গজায়?
মাথা কাটা পড়লে মাথাও গজায়। সেই মাথা সাইজে ছোট হয়।
নিজাম সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, ভাই সাহেব, আপনি কি আমার সঙ্গে একটু আসবেন? একা যেতে ভয়-ভয় লাগছে। মোতালের সঙ্গে সঙ্গে বলল, চলুন। আপনার উপর মায়া পড়ে গেছে। আপনাকে একা ছাড়তেও ইচ্ছা করছে না। ভূত যদি ভূতকে না দেখে, তাহলে কে দেখবে? একটা গান আছে না–ভূত ভূতের জন্যে …
মোতালেব গান ধরল। গলায় সুর বেশ ভাল। একটু নাকি নাকি তারপরও শুনতে খারাপ লাগছে না। কয়েক লাইন গেয়ে বলল, স্যারের গান-বাজনার চর্চা আছে?
জি না।
চর্চা থাকলে ভাল হত। আমাদের সময় কাটে না তো–গান-বাজনা করে সময় কাটাই। চলুন রওনা হই–রিকশায় যাবেন, না গাড়িতে? রিকশায় যাওয়া। ভাল। আপনার তো নিশ্চয়ই চলন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে ওঠার অভ্যাস নেই। শিখে যাবেন। বেঁচে থাকার জন্যে সবই শিখতে হবে। সংগ্রাম করতে হবে। ভূতদের জীবন। হল সংগ্রামী জীবন।
নিজাম সাহেব চমকে উঠলেন। ভূতদের জীবন সংগ্রামী জীবন–তার মানে কি? বেঁচে থাকতে সংগ্রাম, মরার পরেও সংগ্রাম? কি ধরনের সংগ্রাম মোতালেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া ভাল।
মোতালেবকে জিজ্ঞেস করা হল না। তার আগেই সে গান ধরল–
আইঁজ পাশা খেঁলবরে ভুতনী
ও ভূতনী তোঁমার সঁনে।
একেঁলা পাইঁয়াছিরে ভূতনী
এই নিঘোর বঁনেঁ…
নিজাম সাহেবের ভাল লাগল। মোতালেবের গলা আসলেই ভাল। তালজ্ঞানও ঠিক আছে। নিজাম সাহেব হাতে তাল দিতে লাগলেন। মোতালেব গান থামাল
স্যার।
জ্বী।
একটা খালি রিকশা যাচ্ছে, চলুন উঠে পড়ি। আমার হাত ধরে লাফ দিন। হাই জাম্প। ছোটবেলায় হাই জাম্প দেননি?
জ্বি না।
ছোটবেলায় হাই জাম্প না দিলেও নিজাম সাহেব ভালই লাফ দিলেন। রিকশার পাটাতনে গড়িয়ে পড়লেন। মোতালেব তাকে সীটে টেনে তুললো। নিজাম সাহেব বললেন–রিকশায় প্যাসেঞ্জার উঠলে আমরা কি করব?
মোতালেব হাই তুলতে তুলতে বলল, কোন সমস্যা নেই। তখন আমরা প্যাসেঞ্জারদের কোলে বসে থাকব। ভূত হবার এও এক মজা। মানুষের কোলে বসে বসে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
মানুষের কোলে বসে জীবন কাটিয়ে দেবার ব্যাপারটা নাজিম সাহেবের খুব রুচিকর মনে হল না। তিনি কিছু বললেন না। রিকশার হুড ধরে বসে রইলেন। হঠাৎ তার মনে হল, তিনি পিঠে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করছেন। অস্বস্তিকর ব্যথা। যেন মেরুদণ্ড ধরে কেউ একজন হালকাভাবে তাকে পেছন দিকে টানছে। ব্যথাটা শুরুতে হালকা থাকলেও রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই বাড়ছে। মোতালেবকে ব্যাপারটা বলবেন কি না তিনি বুঝতে পারছেন না। ভৌতিক ব্যাপার হয়ত সে অনেক ভাল জানে। রিকশায় চড়লে সব ভূতদেরই হয়ত পিঠে ব্যথা করে। এটাই নিয়ম। ব্যথাটা বাড়ছে, কিছুতেই যাচ্ছে না। ব্যথা কমাবার জন্যে নিজাম সাহেব খুক খুক করে কাশলেন। মোতালেব মাথা ঘুরিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, কাশছেন কেন?
কাশি আসছে এই জন্যে কাশলাম। ভূতদের কি কাশা নিষেধ?
কাশা নিষেধ না। আপনার কাশির ধরনটা ভাল না। পিঠে ব্যথা আছে?
নিজাম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ আছে।
মেরুদণ্ডে?
জ্বি।
সর্বনাশ! লাফ দিয়ে নামুন দেখি রিকশা থেকে।
নিজাম সাহেব রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নামলেন। ভীত গলায় বললেন, কি হয়েছে?
সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেছে। পিছন দিকে দেখেন।
নিজাম সাহেব পিছন ফিরে দেখলেন–তার পেছনে রঙিন এক ফিতা–ফিতার এক মাথা তার পিঠে লাগছে, অন্য মাথা বহু দূর চলে গেছে।
মোতালেব বিরক্ত হয়ে বলল, কিছু বুঝতে পারছেন?
জি না।
আরে ভাই, আপনি তো এখনো মরেন নাই। মনে হয় ডাক্তার আপনার জীবন বাচানোর চেষ্টা করছে। কিছু নির্বোধ ডাক্তার আছে না, রোগীকে বাঁচাবার জন্যে জীবন দিয়ে দেয়। একজন মরতে চাচ্ছে মরতে দাও–তা দেবে না। বাঁচিয়ে তুলবে। বাচিয়ে তুলে লাভটা কি?
নিজাম বললেন, ফিতার ব্যপারটা বুঝতে পারছি না।
আপনার রক্ত মাংসের শরীরের সঙ্গে এই ফিতা লাগানো। ফিতায় টান পড়ছে, তার মানে হল আপনাকে ঐ শরীরে ঢুকতে হবে। ব্যথা, যন্ত্রণা, চিকিৎসা চলবে–ওই, শরীরে ঢুকতে চান?
বুঝতে পারছি না।
কোন দরকার নাই। যা আছেন ভাল আছেন। দেখি চেষ্টা করে ফিতা ছিড়তে পারি কিনা। আপনিও হাত লাগান। আরো কয়েকজন ভূত পেলে ভাল হত–একসঙ্গে টানাটানি করে ছিড়ে ফেলতাম। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন–আমি দেখি কয়েকজনকে নিয়ে আসি। খবর্দার, যাবেন না। এই টেলিফোনের খামা ধরে দাঁড়ান। দু হাতে শক্ত করে খামা ধরে থাকুন, নয়ত ফিতার টানের চোটে উঠে চলে যাবেন। মহাবিপদে পড়লাম দেখি।
নিজাম সাহেব টেলিফোনের খামা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। পিঠের টান বাড়ছে। তার একবার মনে হল খামাশুদ্ধ তাকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাবে, এমন টান। ইতিমধ্যে মোতালেব তিন-চারজন ভূত নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তারা ফিতা ছেড়ার চেষ্টা করছে। লাভ কিছু হচ্ছে না। এক সময় টান প্রবল হল–নিজাম সাহেব টেলিফোনের খামা ছেড়ে দিলেন। তার মনে হল তিনি ঝড়ের মত ছুটে যাচ্ছেন। ভয়াবহ অবস্থা! মানুষ (নাকি ভূত?) এমন বিপদে পড়ে!
নিজাম সাহেবের মাথার অপারেশন শেষ হয়েছে। নিউরোলজির সার্জেন্ট প্রফেসর ইফতেখারুল ইসলাম–হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে বললেন, অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে বলেই আমার ধারণা। রোগীর বেঁচে থাকার কথা। অবশ্যি চব্বিশ ঘণ্টা পার না হলে কিছু বলা যাচ্ছে না–তারপরেও আমি আশাবাদী। চোখের মণিতে আলো ফেলে দেখুন তো রিফ্লেক্স একশান কেমন?
একজন ডাক্তার নিজাম সাহেবের চোখের মণিতে আলো ফেললেন। চোখের মণি বড় বড় হয়ে আছে। নিজাম সাহেবের ভূত তার শরীরের কাছেই বসা। তিনি শরীরের ভেতর ঢোকার তীব্র আকর্ষণ বোধ করছেন–কোন দিক দিয়ে ঢুকবেন বুঝতে পারছেন না।
স্যার।
নিজাম সাহেব চমকে তাকিয়ে দেখেন মোতালেব চলে এসেছে। বোধহয় দৌড়ে এসেছে। হাপাচ্ছে।
নিজাম সাহেব মোতালেবের দিকে তাকালেন। মোতালেব বলল, খামাখা আর বসে আছেন কেন? এরা তো মনে হয় আপনাকে বাচাবেই–শরীরে ঢুকে পড়ুন।
কোন দিক দিয়ে ঢুকব?
চোখের মণি দিয়ে ঢুকে পড়ুন। চোখের মণি দিয়ে ঢোকাটা সহজ হবে।
ভয় লাগছে তো।
কচি খোকা নাকি, ভয় লাগছে! ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না।
সেকি, হাসপাতালের বারান্দায় লম্বা হয়ে পড়ে আছে। ভাবীর সঙ্গে আপনার ছোট মেয়েটাও আছে। বেচারী বোধ হয় খুব বাপ ভক্ত। কান্নাকাটি যে ভাবে করছে বলার না।
খুব কাঁদছে?
আহারে, শুধু শুধু কথা বলে সময় নষ্ট। ঢুকে পড়ুন তো।
নিজাম সাহেব তার চোখের মণির ভেতর দিয়ে নিজের শরীরে ঢুকলেন।
যে ডাক্তার চোখের মণির উপর আলো ফেলছিল সে আনন্দিত গলায় বলল, রিফ্লেক্স একশান ভাল। চোখের মণি ছোট হচ্ছে। এ যাত্রা বোধ হয় টিকে গেল। ট্রাকের নিচে পড়েও বেঁচে যায়–এই প্রথম দেখলাম। একেই বলে ভাগ্য।
“অদ্ভুত সব গল্প” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ