আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা আরও বলেন, ডারউইনের ‘সেক্সুয়াল সিলেকশন’ বা ‘যৌনতার নির্বাচন’ বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা রেখে থাকে তবে এর একটি প্রভাব আমাদের দীর্ঘদিনের মানসপট নির্মাণেও অবশ্যম্ভাবীরূপে পড়বে। যৌনতার উদ্ভবের কারণে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নারী-পুরুষ একই মানবপ্রকৃতির অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়েছে এক ধরনের মনোদৈহিক পার্থক্য জৈববৈজ্ঞানিক পথেই। নারীদের জননতন্ত্রের প্রকৃতি পুরুষদের জননতন্ত্র থেকে আলাদা। মেয়েদেরকে যে ঋতুচক্র, নয়মাসব্যাপী গর্ভধারণসহ হাজারো ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয়–পুরুষদের সেগুলো কোনোটিই করতে হয় না। একটি পুরুষ, তাত্ত্বিকভাবে হলেও যে কোনো সময়ে এই পৃথিবীর বুকে অসংখ্য নারীর গর্ভে অসংখ্য সন্তানের জন্ম দিতে পারে (কুখ্যাত চেঙ্গিস খানের মতো কেউ কেউ সেটা করে দেখিয়েছেও)। কিন্তু একটি মেয়ে এক বছরে শুধু একটি পুরুষের শুক্রাণু দিয়েই গর্ভ নিশ্চিত করতে পারে–এর বেশি নয়। আসলে কেউ যদি বলেন, জৈববৈজ্ঞানিক দিক থেকে বিচার করলে যৌনতার উদ্ভবই হয়েছে আসলে নারী-পুরুষে পার্থক্য করার জন্য এটা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। এই পার্থক্যের প্রভাব ছেলে মেয়েদের মানস জগতেও পড়েছে, পড়েছে সমাজেও। কোনো গবেষকই এখন অস্বীকার করেন না যে যৌনতার বিভাজন নারী পুরুষে গড়ে দিয়েছে বিস্তর পার্থক্য শুধু দেহ কাঠামোতে নয়, তার অর্জিত ব্যবহারেও। সেজন্যই গবেষক ডোনাল্ড সিমন্স বলেন,
‘Men and women differ in sexual natures because throughout the immensely long haunting and gathering phase of evolutionary history of sexual desires and dispositions that were adaptive for either sex were for either sex were for the other tickets to reproductive oblivion.’
মানব সভ্যতার যে কোনো জায়গায় খোঁজ নিলে দেখা যায় ছেলেরা সংস্কৃতি নির্বিশেষে মেয়েদের চেয়ে চরিত্রে বেশি ভায়োলেন্ট’ বা সহিংস হয়ে থাকে, মেয়েরা বাচনিক যোগাযোগে (ভার্বাল কমিউনিকেশন) ছেলেদের চেয়ে বেশি পরিপক্ক হয়। পলিগামি বা বহুগামিত্ব ব্যাপারটা মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে অধিকতর প্রবলভাবে দৃশ্যমান। সম্পর্কের মধ্যে প্রতারণা বা ‘চিট’ ব্যাপারটাও কিন্তু মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি করে থাকে। আবার মেয়েরা প্রতারণা ধরতে অধিকতর দক্ষ।
আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু কিন্তু আলাদা। পুরুষের স্পার্ম বা শুক্রাণু উৎপন্ন হয় হাজার হাজার, আর সে তুলনায় ডিম্বাণু উৎপন্ন হয় কম। ডিম্বাণুর আকার শুক্রাণুর চেয়ে বড় হয় অনেক অর্থাৎ, জৈববৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলে স্পার্ম সহজলভ্য, তাই কম দামি, আর সে তুলনায় ডিম্বাণু অনেক মূল্যবান। ‘স্পার্ম অনেক চিপ’ বলেই (সাধারণভাবে) পুরুষদের একটা সহজাত প্রবণতা থাকে বহু সংখ্যক জায়গায় তার প্রতিলিপি ছড়ানোর। সেজন্য তথাকথিত আধুনিক একগামী সমাজেও দেখা যায় পুরুষেরাই বেশি প্রতারণা করে সম্পর্কে, আর আগেকার সময়ে রাজা বাদশাহদের হারেম রাখার কিংবা শক্তিশালী সেনাপতিদের যুদ্ধ জয়ের পর নারী অধিকারের উদাহরণগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। অপর দিকে ‘এগ ভালুয়েবল’ বলেই প্রকৃতিতে নারীরা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে থাকে অপেক্ষাকৃত খুঁতখুঁতে, কারণ তারা নিশ্চিত করতে চায় কেবল উৎকৃষ্ট জিনের দ্বারাই যেন তার ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে। এ ছাড়া এর আগের অধ্যায়ে আমরা রবার্ট ট্রাইভার্সের ‘অভিভাবকীয় বিনিয়োগ’ (parental investment) অনুকল্পের সাথেও পরিচিত হয়েছি। যেহেতু নারীরা অভিভাবকীয় বিনিয়োগের সিংহভাগে জড়িত থাকে, তারা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে হয়ে উঠে অধিকতর হিসেবি এবং সাবধানী। সেজন্যই প্রকৃতিতে দেখা যায়, পুরুষ ময়ূর পেখম তুলে দাঁড়িয়ে থাকে, ‘খুঁতখুঁতে ময়ূরী হিসেব নিকেশ করে নির্বাচন করে যোগ্যতম ময়ূরকেই তার সৌন্দর্যের ভিত্তিতে। পুরুষ কোকিল গান গেতে থাকে তাদের সুমধুর গলায়, ফুট ফ্লাইরা নাচতে থাকে স্ত্রী মাছিদের প্রণয় লাভের জন্য, পুরুষ চিত্রল হরিণেরা সম্মোহিত করতে চায় তাদের বর্ণাঢ্য শিং এর যাদুতে, আর স্ত্রীরা নির্বাচন করে তাদের মধ্যে যোগ্য পুরুষটিকে।
মানবসমাজের দিকে তাকানো যাক। সাধারণভাবে বললে, একজন পুরুষ তার সারা জীবনে অসংখ্য নারীর গর্ভে সন্তানের জন্ম দিতে পারে। ইতিহাসে একজন পুরুষের সবচেয়ে বেশি সংখক সন্তানের হিসেব পাওয়া যায় ব্লাড থাস্টি মৌলে ইসমাইল-এর (১০৪২ জন সন্তান)। তাত্ত্বিকভাবে একজন পুরুষ গর্ভ সঞ্চার করতে পারে প্রতি মুহূর্তেই। অপরদিকে একজন নারী বছরে কেবল একটি সন্তানেরই জন্ম দিতে পারে। সে হিসেবে সাড়া জীবনে তার সন্তান সর্বোচ্চ ২০-২২টির বেশি হবার সম্ভাবনা নেই (যমজ সন্তানের হিসেব গোনায় আনছি না)। বিবর্তনীয় পটভূমিকায় দেখা গেছে নারীরা যদি ক্রমাগত সঙ্গী বদল করতে থাকলে তা আসলে কোনো প্রজননগত উপযোগিতা (reproductive benefit) প্রদান করে না। তার চেয়ে বরং সন্তানের দেখাশোনায় শক্তি বেশি নিয়োজিত করলেই বরং ভবিষ্যৎ জিন টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত এই কারণেই নারীদের মধ্যে বহুগামিতা থাকে পুরুষদের তুলনায় কম। সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, আদিম কিছু ট্রাইবে ভ্রাতৃয় বহুভ্রাতৃত্ব (fraternal polyandry), যেখানে সহোদর ভাইয়েরা মহাভারতের দ্রৌপদীর মতো একজন পত্নীর অংশীদার– দুচারটি জায়গায় দৃশ্যমান হলেও অভ্রাতৃয় বহুভ্রাতৃত্ব (nonfraternal polyandry) পৃথিবীর কোথাওই সেভাবে দৃশ্যমান নয়।
পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে বেশি, সেটা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে। কিন্তু মেয়েরা আবার ছেলেদের তুলনায় ‘লাভ স্টোরি’র বেশি ভক্ত। সিরিয়াল কিলারের সংখ্যা ছেলেদের মধ্যে বেশি, মেয়েদের মধ্যে খুবই কম। সংস্কৃতি নির্বিশেষে পুরুষদের টাকা পয়সা, স্ট্যাটাস ইত্যাদির মাপকাঠিতে বিচার করা হয়, আর মেয়েদের সৌন্দর্যের। নৃতত্ত্ববিদ মেলভিন কনোর খুব পরিষ্কার করেই বলেন–
ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি সহিংস আর মেয়েরা অনেক বেশি সংবেদনশীল–অন্তত শিশু এবং নাবালকদের প্রতি। এই ব্যাপারটা উল্লেখ করলে একে যদি ‘গতানুগতিক কথাবার্তা’ (cliché) বলে কেউ উড়িয়ে দিতে চান সেটা এ সত্যকে কিছুমাত্র দমন করবে না।
ব্যাপারগুলো সঠিক নাকি ভুল, কিংবা ‘উচিত’ নাকি ‘অনুচিত’ সেটি এখানে বিচার্য নয়, বিচার্য হচ্ছে আমাদের সমাজ কেন এইভাবে গড়ে উঠেছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মন মানসিকতা একটি নির্দিষ্ট ছকে সবসময় আবদ্ধ থাকে? এখানেই মানবপ্রকৃতি বিশ্লেষণে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান যতটা সফল, সমাজবিজ্ঞান ততটা নয়।
কেন সংস্কৃতি-নির্বিশেষে ছেলেরা সম্পর্কের মধ্যে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গীর সাথে বেশি প্রতারণা করে কিংবা কেন পর্নোগ্রাফির বেশি ভক্ত–এটি জিজ্ঞাসা করলে সমাজবিজ্ঞানী কিংবা নারীবাদীদের কাছ থেকে নির্ঘাত উত্তর পাওয়া যাবে যে, যুগ যুগ ধরে মেয়েদের সম্পত্তি বানিয়ে রাখা হয়েছে, তারা শোষিত এই মনোবৃত্তি তারই প্রতিফলন। কিন্তু যে সমস্ত সমাজে ছেলেমেয়েদের পার্থক্যসূচক মনোভাবের মাত্রা কম–সেখানে কী তাহলে এ ধরনের ঝোঁক নেই? না তা মোটেও নয়। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে ইসরায়েলের কিবুজ (Kibbutz) শহরের একটি পরীক্ষামূলক গবেষণায়। সমাজে বিদ্যমান সমস্ত রীতি বা ট্যাবু আসলে জন্মগত নয়, বরং সংস্কৃতি থেকেই উদ্ভূত–এই ধারণা থেকে সেখানকার অধিবাসীরা ঠিক করেছিল সমস্ত যৌনতার প্রভেদমূলক পার্থক্যকে ওই শহর থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে। তার প্রক্রিয়া হিসেবে সেখানকার মেয়েদেরকে ছেলেদের মতো ছোট ছোট চুল রাখতে উৎসাহিত করা হলো, আর ছেলেদেরকে শেখানো হলো সহিংসতা ত্যাগ করে কীভাবে শান্তিপুর্ণভাবে বসবাদ করা যায়! যে সমস্ত মেয়েরা ‘টম বয়’ হয়ে জীবন কাটাতে চায়, তাদের পিঠ চাপড়ে সাধুবাদ জানানো হলো, ছেলেরা যেন ঘরের কাজ আর মেয়েরা যেন বাইরের কাজে দক্ষ হয়ে ওঠে সেজন্য যথাযথ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কিবুজ সে সময় গণ্য হয়েছিল আদর্শবাদীদের স্বর্গ হিসেবে যেখানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু তিন প্রজন্ম পরে দেখা গেল সেই ‘আদর্শ’ কিবুজ পরিণত হয়েছে সবচেয়ে সেক্সিস্ট বা যৌনবৈষম্যবাদী শহর হিসেবে। সেখানকার মানুষজন আদর্শবাদীদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে ফিরে গিয়েছিল সেই চিরন্তন গত্বাঁধা জীবনে। অভিভাবকদের আদর্শবাদী নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরা। ছেলেরা দেখা গেল, অভিভাবকদের দেখিয়ে দেয়া পথ অস্বীকার করে বেশি পদার্থবিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত পড়তে শুরু করেছে, মেয়েরা বেশি যাচ্ছে মেডিকেলে। তারা নার্সিং-এ কিংবা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি। ছেলেদের ঘরের কাজ করার যে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল মেয়েরাই শেষপর্যন্ত ঘরদোর গোছানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। দায়িত্ব তুলে নেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে তারা বলল, “আরে ছেলেরা ঠিকমত বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখতে পারে না। আর অন্যদিকে ছেলেরা বলল, “আরে যত ভালোভাবেই করি না কেন বউয়ের মর্জিমাফিক কিছুতেই হয় না। ব্যাপারটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এ ধরনের বিভক্তিগুলোকে যতই অস্বীকার করে সাম্যের পথে সমাজকে ঠেলে দেয়া হয়, বিদ্যমান জৈববৈজ্ঞানিক পার্থক্যগুলো সে সমাজে তত প্রকট হয়ে উঠে। ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়।
চাহিদায় পার্থক্য, পার্থক্য মানসিকতাতেও
মনোবিজ্ঞানীরা অনেকেদিন ধরেই লক্ষ করছিলেন যে, ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক চাহিদা পছন্দ, অপছন্দে যেমন মিল আছে, তেমনি আবার কিছু ক্ষেত্রে আছে চোখে পড়ার মতোই পার্থক্য। এটা হবার কথাই। নারী পুরুষ উভয়কেই সভ্যতার সূচনার প্রথম থেকেই ডারউইন বর্ণিত ‘সেক্সুয়াল সিলেকশন’ নামক বন্ধুর পথে নিজেদের বিবর্তিত করে নিতে হয়েছে, শুধু দৈহিকভাবে নয় মন মানসিকতাতেও। দেখা গেছে, ছেলেরা আচরণগত দিক দিয়ে মেয়েদের চেয়ে অনেক প্রতিযোগিতামূলক (competitive) হয়ে থাকে। ছেলেদের স্বভাবে প্রতিযোগিতামূলক হতে হয়েছে কারণ তাদের বিভিন্ন গোত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করে, যুদ্ধ বিগ্রহ করে বাঁচতে হয়েছে আদিকাল থেকেই। যারা এ ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে পেরেছে তারাই অধিক হাড়ে সন্তানসন্ততি এ পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে পেরেছে।
আধুনিক জীবনযাত্রাতেও পুরুষদের এই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতাকে একটু চেষ্টা করলেই ধরা যাবে। একটা মজার উদাহরণ দেই। আমেরিকার একটি জরিপ থেকে দেখা গেছে পরিবার নিয়ে লং ড্রাইভিং-এ বেড়িয়ে কখনো পথ হারিয়ে ফেললে পুরুষেরা খুব কমই পথের অন্য মানুষের কাছ থেকে চায়। তারা বরং নিজেদের বিবেচনা থেকে দেখে নিজেরাই পথ খুঁজে নিতে তৎপর হয়, না পারলে বড়জোর ল্যান্ডমার্ক, ম্যাপের দারস্থ হয়, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করে না। আর অন্যদিকে মেয়েরা প্রথমেই গাড়ি থামিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেয়। আসলে পুরুষেরা গাড়ি থামিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পছন্দ করে না, কারণ তাদের ‘আত্মম্ভরি’ মানসিকতার কারণে ব্যাপারটাকে তারা ‘যুদ্ধে পরাজয়’ হিসেবে বিবেচনা করে ফেলে নিজেদের অজান্তেই। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তাদের মানসপটে এত প্রবলভাবে রাজত্ব করে না বলে তারা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে সমাধানে পৌঁছুতে উদগ্রীব থাকে। শুধু ড্রাইভিংই একমাত্র উদাহরণ নয়; পুরুষেরা অর্থ, বিত্ত আর সামাজিক প্রতিপত্তির প্রতি যে বেশি আকৃষ্ট তা যে কোনো সমাজেই প্রযোজ্য। এটাও এসেছে দীর্ঘদিনের প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা থেকে।
এদিকে পুরুষেরা যখন প্রতিযোগিতা, হানাহানি মারামারি করে তাদের ‘পুরুষতান্ত্রিক’ জিঘাংসা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হয়েছে (যুদ্ধ এবং হানাহানি নিয়ে এর পরের অধ্যাআয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে), তখন অন্য দিকে মেয়েরা দায়িত্ব নিয়েছে ‘সংসার গোছানোর। গৃহস্থালির পরিচর্যা মেয়েরা বেশি অংশগ্রহণ করায় তাদের বাচনিক এবং অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষমতা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বিবর্ধিত হয়েছে। একটি ছেলের আর মেয়েদের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে গঠনগত যে বিভিন্ন পার্থক্য পাওয়া গেছে, তাতে বিবর্তনীয় অনুকল্পই সঠিক প্রমাণিত হয়। ছেলেদের ব্রেনের আকার গড়পড়তা মেয়েদের মস্তিষ্কের চেয়ে অন্তত ১০০ গ্রাম বড় হয়, কিন্তু ওদিকে মেয়েদের ব্রেন ছেলেদের চেয়ে অনেক ঘন থাকে। মেয়েদের মস্তিষ্কে কর্পাস ক্যালোসাম এবং এন্টেরিয়র কমিসুর নামক প্রত্যঙ্গ সহ টেম্পোরাল কর্টেক্সের যে এলাকাগুলো ভাষা এবং বাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহায়তা করে বলে মনে করা হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে সেগুলো ছেলেদের চেয়ে অন্তত ২৯ ভাগ বিবর্ধিত থাকে। শুধু তাই নয়, মেয়েদের মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালনের হার ছেলেদের ব্রেনের চেয়ে শতকরা ১৫ ভাগ বেশি থাকে।
মস্তিষ্কের গঠনগত পার্থক্যের প্রভাব পড়ে তাদের অর্জিত ব্যবহারে, আর সেই ব্যবহারের প্রভাব আবার পড়ে সমাজে[১৬৬]। অভিভাবকেরা সবাই লক্ষ করেছেন, মেয়ে শিশুরা ছেলে শিশুদের চেয়ে অনেক আগে কথা বলা শিখে যায় একই রকম পরিবেশ দেয়া সত্ত্বেও। ছেলেদের বাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলো গড়পড়তা মেয়েদের মতো উন্নত না হওয়ায় ডাক্তাররা লক্ষ করেন পরিণত বয়সে ছেলেরা সেরিব্রাল পালসি, ডাইলেক্সিয়া, অটিজম এবং মনোযোগ-স্বল্পতা সহ বিভিন্ন মানসিক রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ ধরনের আরও পার্থক্য আছে। ব্যবহারিক জীবনে দেখা যায় ছেলেরা যখন কাজ করে অধিকাংশ সময়ে শুধু একটি কাজে নিবদ্ধ থাকতে চেষ্টা করে, এক সাথে চার পাঁচটা কাজ করতে পারে না, প্রায়শই গুবলেট করে ফেলে। আর অন্যদিকে মেয়েরা অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে ছয় সাতটা কাজ একই সাথে করে ফেলে। এটাও হয়েছে সেই হান্টার গ্যাদারার পরিস্থিতি দীর্ঘদিন মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই। শিকারি হবার ফলে পুরুষদের স্বভাবতই শিকারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হতো, ফলে তাদের মানসজগৎ একটিমাত্র বিষয়ে ‘ফোকাসড়’ হয়ে গড়ে উঠেছিল, আর মেয়েদের যেহেতু ঘরদোর সামলাতে গিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে হাজারটা কাজ করে ফেলতে হতো তারা দক্ষ হয়ে উঠেছিল একাধিক কাজ একসাথে করাতে।
আরও কিছু পার্থক্য উল্লেখ করা যাক। ছেলেদের মস্তিষ্কের প্যারিয়েটাল কর্টেক্সের আকার মেয়েদের মস্তিষ্কের চেয়ে অনেক বড় হয়। বড় হয় অ্যামাগদালা নামের বাদাম আকৃতির প্রত্যঙ্গের আকারও। এর ফলে দেখা গেছে ছেলেরা জ্যামিতিক আকার নিয়ে নিজেদের মনে নাড়াচাড়ায় মেয়েদের চেয়ে অনেক দক্ষ হয়। তারা একটি ত্রিমাত্রিক বস্তুকে সামনে থেকে দেখেই নিজেদের মনের আয়নায় নড়িয়ে চড়িয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুঝে নিতে পারে বস্তুটি, পেছন থেকে, নীচ থেকে বা উপর থেকে কিরকম দেখাতে পারে। জরিপ থেকে দেখা গেছে, ছেলেরা গড়পড়তা বিমূর্ত এবং ‘স্পেশাল’ কাজের ব্যাপারে বেশি সাবলীল, আর মেয়েরা অনেক বেশি বাচনিক এবং সামাজিক কাজের ব্যাপারে সাবলিল।
হয়তো এজন্যই ছেলেরা অধিক হারে স্থাপত্যবিদ্যা কিংবা প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে উৎসুক হয়, আর মেয়েরা যায় শিক্ষকতা, নার্সিং কিংবা সমাজবিদ্যায়। এই ঝোঁক সংস্কৃতি এবং সমাজ নির্বিশেষে একই রকম দেখা গেছে। এই রকম সুযোগ দেয়ার পরও বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরা বড় হয়ে বুয়েটের চেয়ে মেডিকেলে পড়তেই উদগ্রীব থাকে। কোনো সংস্কৃতিতেই ছেলেরা খুব একটা যেতে চায় না নার্সিং-এ, মেয়েরা যেমনিভাবে একটা ‘গ্যারেজ মেকানিক’ হতে চায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এটা কি কেবলই মেয়েরা শোষিত কিংবা পিছিয়ে পড়া বলে, নাকি বিবর্তনীয় ‘সিলেকশন প্রেশার’ তাদের মধ্যে অজান্তেই কাজ করে বলে?
সব টাকমাথা পয়সাওয়ালা লোকের ঘরে সুন্দরী বউ দেখি কেন?
কলেজ জীবনে ক্লাস ‘বাং মেরে’ নিউমার্কেটে ঘুরার অভিজ্ঞতা আমাদের সময়কার বোধ হয় কমবেশি সব ছাত্রেরই আছে। আমারও ছিল পুরোমাত্রায়। একটা পুরো গ্যাং নিয়ে চলে যেতাম। ওই গ্যাং-এর একটা অংশ আবার সুন্দর মেয়ে দেখায় সদা ব্যস্ত থাকত। কিন্তু দেখলে কী হবে, পোড়াকপাল, যত বেশি সুন্দরী মেয়ে–তত বেশি টাক মাথা, বয়স্ক, হোঁদল-কুকুতে স্বামী নিয়ে ঘুরছে। শেষমেষ এমন হলো যে, টাকমাথা ‘আবলুস বাবা’ টাইপের কাউকে বলিউডের নায়িকাদের মতো মেয়ে নিয়ে ঘুরতে দেখলেই আমরা ধরে নিতাম ব্যাটার হয় ম্যালা পয়সা, নইলে ব্যাটা সমাজে বিরাট কেউকেটা কেউ হবে। মজার ব্যাপার হলো–পরে দেখা যেত আমাদের অনুমান নির্ভুল হতো প্রায় সবক্ষেত্রেই। আসলে ক্ষমতাবান পুরুষেরা যে সুন্দরী তরুণীদের প্রতি বেশি লালায়িত হয়, আর সুন্দরীরা পয়সা আর স্ট্যাটাসওয়ালা স্বামীর প্রতি–এটা সব সমাজেই এত প্রকট যে এটা নিয়ে গবেষণা করার কেউ প্রয়োজনই বোধ করেননি কখনো। এজন্যই ন্যান্সি থর্নহিল বলেন,
Surely no one has ever seriously doubted that men desire young, beautiful women, and that women desire wealthy high status men.
কিন্তু সনাতন সমাজবিজ্ঞানীরা আপত্তি করেছেন। তাদের অনুমান ছিল সব সংস্কৃতিতে নিশ্চয় এ ধরনের ‘স্টেরিওটাইপিং’ নেই। এখন এদের অনুমান সঠিক না কি ভুল তা পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড বাস। তিনি ৩৩ টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, সঙ্গী নির্বাচনের সময় ছেলেরা গড়পড়তা দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে, কিন্তু পাশাপাশি প্রত্যাশা করে তারুণ্য এবং সৌন্দর্য। অন্যদিকে মেয়ারাও গড়পড়তা ছেলেদের কাছ থেকে দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই, পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ আর স্ট্যাটাস। অধ্যাপক বাস প্রথমে আমেরিকায় সমীক্ষা চালালেন। দেখা গেল, আমেরিকায় মেয়েরা যত ভালো চাকরিই করুক না কেন, তারা আশা করে তার স্বামী তাদের চেয়ে বেশি রোজগার করবে নইলে ব্যাপারটা ‘এনাফ কুল’ হবে না। ম্যাচ ডট কম—এর মতো সাইটগুলোতে দেখা যায় মেয়েরা তার হবু সঙ্গীর স্ট্যাটাস এবং প্রতিপত্তির প্রতি আগ্রহী হয় ছেলেদের চেয়ে ১১ গুন বেশি। এমনকি একটি পরীক্ষায় অধ্যাপক বাস একই লোককে কখনো বার্গার কিং বা ম্যাকডোনাল্ডসের কর্মীর পোশাক পরিয়ে, কখনোবা বিরাট কোনো কোম্পানির সিইও সাজিয়ে পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল, নিম্ন স্ট্যাটাসের পোশাক পরা লোকের সাথে মেয়েরা প্রাথমিকভাবে কোনো ধরনের সম্পর্ক করতেই রীতিমত অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অথচ একই লোককে বড় স্ট্যাটাসের কোনো পোশাক পরিয়ে বাইরে নেওয়া হলেই মেয়েরা তার প্রতি উৎসুক হয়ে উঠছে। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে সেরকম প্রবণতা লক্ষ করা যায়নি। অর্থাৎ, ছেলেরা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেয়েদের স্ট্যাটাস নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয়, যতটা তারা উদ্বিগ্ন একটি মেয়ের দৈহিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে। প্রথমে যখন বাসের ফলাফল বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হলো, সেটা উড়িয়ে দেয়া হলো এই বলে–আরে ওটা আমেরিকার পচে যাওয়া ভোগবাদী সংস্কৃতির নিদর্শন। অন্য জায়গায় নিশ্চয় এরকম হবে না। অন্য জায়গার ঘটনা বুঝতে বাস ইউরোপীয় দেশগুলোতে তার সমীক্ষা চালালেন। সেখানেও একই ধরনের ফলাফল বেড়িয়ে আসলো— ছেলেরা মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রতি বেশি মনোযোগী, আর মেয়েরা ছেলেদের স্ট্যাটাসের- তা সে হল্যান্ডেই সমীক্ষা চালান হোক, অথবা জার্মানিতে। এবারে বলা হলো ইউরোপীয় সংস্কৃতি অনেকটা আমেরিকার মতোই। সেখানে তো এরকম ফলাফল আসবেই। এরপর অধ্যাপক বাস ছয়টি মহাদেশ এবং পাঁচটি দ্বীপপুঞ্জের ৩৭ টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ১০০৪৭ জন লোকের উপর সমীক্ষা চালালেন– একেবারে আলাস্কা থেকে শুরু করে সেই জুলুল্যান্ড পর্যন্ত। প্রতিটি সংস্কৃতিতেই দেখা গেল মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আর্থিক প্রতিপত্তিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে[১৬৭]। জাপানে এই পার্থক্য সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেল আর হল্যান্ডে সবচেয়ে কম কিন্তু তারপরেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নারী-পুরুষের চাহিদার পার্থক্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসিঃ কেন পুরুষেরা পর্নোগ্রাফি ভালোবাসে আর মেয়েরা প্রেমের উপন্যাস
নারীপুরুষের এ ধরনের চাহিদার পার্থক্য আরও প্রকট হয়েছে নারী-পুরুষদের মধ্যকার যৌনতা নিয়ে ‘ফ্যান্টাসি’কেন্দ্রিক গবেষণাগুলোতেও। ব্রুস এলিস এবং ডন সিমন্সের করা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, পুরুষ এবং নারীদের মধ্যকার যৌনতার ব্যাপারে ফ্যান্টাসিগুলো যদি সততার সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তিনজনের মধ্যে একজন পুরুষ একাধিক নারীর সাথে যৌনতার ফ্যান্টাসিতে ভোগে, এমনকি সারা জীবনে তাদের পার্টনারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে কল্পনা করে তারা আমোদিত হয়ে উঠে আর মেয়েদের মধ্যে সে সংখ্যাটা মাত্র ৮ ভাগ। এলিস এবং সিমন্সের সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অর্ধেক সংখ্যক নারীরা অভিমত দিয়েছে, যৌনতা নিয়ে কল্পনার উন্মাতাল সময়গুলোতেও তারা কখনো সঙ্গী বদল করে না, অন্য দিকে পুরুষদের মধ্যে এই সংখ্যাটা মাত্র ১২ ভাগ। মেয়েদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো তার নিজের পরিচিত যৌনসঙ্গীকে কেন্দ্র করেই সবসময় আবর্তিত হয়, আর অন্যদিকে পুরুষদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো সময় সময় সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েকে নিয়েও উথলে ওঠে। একারণেই গবেষক এলিস এবং সিমন্স তাদের গবেষণাপত্রে এই বলে উপসংহার টেনেছেন[১৬৮]—
পুরুষদের যৌনতার বাঁধন-হারা কল্পনাগুলো হয়ে থাকে সর্বব্যাপী, স্বতঃস্ফুর্ত, দৃষ্টিনির্ভর, বিশেষভাবে যৌনতাকেন্দ্রিক, নির্বিচারী, বহুগামী এবং সক্রিয়। অন্যদিকে মেয়েদের যৌন অভিলাস অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, আবেগময়, অন্তরঙ্গ এবং অক্রিয়।
একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডেভিড বাসের ‘মেটিং স্ট্র্যাটিজি’ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাতেও। এমনি একটি গবেষণায় দেখা গেছে একজন পুরুষকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সাড়া জীবনে কতজন যৌনসঙ্গীর দরকার বলে তার মনে হয়, গড়পড়তা উত্তর পাওয়া গেছে-১৮। নারীদের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৪.৫ (নীচের ছবি দ্রঃ)।
আরও কিছু মজার তথ্য এবং জরিপের ফলাফল সন্নিবেশিত করা যাক। এই জরিপটা চালানো হয়েছিল একটি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। আর.ডি ক্লার্ক এবং হ্যাটফিল্ডের পরিচালিত এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছিল জার্নাল অব সাইকোলজি এন্ড হিউম্যান সেক্সয়ালিটিতে ১৯৮৯ সালে[১৭০]। ব্যাপারটা ছিল এরকমের। কলেজের কিছু ছাত্রদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল যে তারা অপরিচিত ছাত্রীদের সামনে গিয়ে বলবে
“এই মেয়ে শোন, তোমাকে আমি কয়েকদিন ধরেই ক্যাম্পাসে দেখছি। তুমি খুবই আকর্ষণীয়।”
তারপরের তিনটি প্রশ্ন হবে এরকমের
১। তুমি আমার সাথে ডেটে যেতে চাও?
২। তুমি কি আমার সাথে আমার এপার্টমেন্টে যেতে চাও?
৩। তুমি কি আমার সাথে সেক্স করতে ইচ্ছুক?
দেখা গেছে, এ ধরনের প্রশ্নে ৫০% ছাত্রী ডেট এ যেতে রাজি হয়েছে, ৬% ছাত্রী সেই ছাত্রের সাথে এপার্টমেন্টে যেতে রাজি হয়েছে এবং ০% ছাত্রী সেক্সে রাজি হয়েছে। শুধু তাই নয়, বহু ছাত্রী প্রথমেই এভাবে সেক্সের আবেদন হাজির করাকে ‘ইনসাল্ট’ বা অপমান হিসেবে নিয়েছে।
কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ফলাফল পাওয়া গেছে ভিন্ন রকমের। কোনো মেয়ে যদি কোনো ছাত্রের কাছে গিয়ে ঠিক উপরের প্রশ্নগুলো করে, তবে দেখা গেছে, ৫০% ছেলে প্রথমেই ডেটে রাজি হয়েছে, ৬৯% সেই ছাত্রীর সাথে এপার্টমেন্টে যেতে রাজি হয়েছে, আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ৭৫% ছাত্র প্রথমেই ছাত্রীর সাথে যৌনকর্মে সম্মতি দিয়েছে।
ছেলে মেয়েদের যৌন-অভিলাসের পার্থক্যসূচক এই প্রবণতার প্রভাব পড়েছে আজকের দিনের বাণিজ্যে এবং পণ্য-দ্রব্যে। এমনি একটি দ্রব্য হচ্ছে ‘পর্নোগ্রাফি অন্যটি হলো ‘রোমান্স নভেল। পর্নোগ্রাফির মূল ক্রেতা নিঃসন্দেহে পুরুষ। পুরুষদের উদগ্র এবং নির্বিচারী সেক্স ক্রেজের চাহিদা পূর্ণ করতে বাজার আর ইন্টার্নেট সয়লাব হয়ে আছে সফট পর্ন, হার্ড পর্ন, থ্রি সাম, গ্রুপ সেক্সসহ হাজার ধরনের বারোয়ারি জিনিসপত্রে। এগুলো পুরুষেরাই কিনে, পুরুষেরাই দেখে। মেয়েরা সে তুলনায় কম। কারণ, মেশিনের মতো হার্ডকোর পর্ন পুরুষদের তৃপ্তি দিলেও মেয়েদের মানসিক চাহিদাকে তেমন পূর্ণ করতে পারে না। সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীর নগ্ন দেহ দেখে পুরুষেরা যেমন সহজেই আমোদিত হয়, মেয়েরা তেমনি হয় না। কারণ মেয়েদের অবারিত সেক্স জাগ্রত করতে দরকার অবারিত ইমোশন!
আর মেয়েদের এই ‘অবারিত ইমোশন’ তৈরি করতে বাজারে আছে ‘রোমান্স নভেল। এই রোমান্টিক নভেলের মূল ক্রেতাই নারী। দেদারসে প্রেম-পিরিতি বিচ্ছেদের পসরা সাজিয়ে শয়ে শয়ে বই সাড়া দুনিয়া জুড়ে বের করা হয়, আর সেগুলো দেদারসে বিক্রি হতে থাকে সাড়া বছর জুড়ে, মূলত মেয়েদের হাত দিয়ে। বাংলাদেশে যেমন আছে ইমদাদুল হক মিলন, তেমনি আমেরিকায় সুসান এলিজাবেদ ফিলিপ্স, ভারতে তেমনি সুবোধ ঘোষ কিংবা নীহাররঞ্জন গুপ্ত। প্রেম কত প্রকার ও কী কী তা বুঝতে হলে এদের উপন্যাস ছাড়া গতি নেই। আমি শুনেছি, রোমান্স নভেলের জন্য প্রকাশকেরা ইদানীংকালে বিশেষত উঠতি লেখকদের নাকি বলেই দেয় কীভাবে তার উপন্যাস ‘সাজাতে হবে, আর কী কী থাকতে হবে। একটু প্রেম, অনুরাগ, কমিটমেন্ট, মান-অভিমান, বিচ্ছেদ, ক্লাইম্যাক্স তারপর মিলন। আবেগের পশরা বেশি থাকতে হবে, সে তুলনায় সেক্সের বাসনা কম। বইয়ে নায়িকার সেক্সের সাথে আবার ইমোশন মিলিয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি। এভাবে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রোমান্স নভেলের ম্যানুফ্যাকচারিং। মেয়েরা দেদারসে কিনছে, আবেগে ভাসছে, হাসছে, কখনো বা চোখের পানি ফেলছে। আর বই উঠে যাচ্ছে বেস্ট সেলার তালিকায়।
আরও কিছু আনুষঙ্গিক মজার বিষয় আলোচনায় আনা যাক। পশ্চিমা বিশ্বে এক সময় ‘প্লেবয়’-এর পাশাপাশি একসময় ‘প্লে গার্ল’ এবং ‘ভিভা’ চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। চলেনি। মেয়েরা এ ধরনের পত্রিকা কেনেনি, বরং কিনেছে সমকামী পুরুষেরা ঢের বেশি। ছেলেদের প্রেম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব যান্ত্রিক। পর্নোগ্রাফি সেজন্যই ছেলেদেরকেই বেশি আকর্ষণ করে। আরও একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ভায়াগ্রা পুরুষের জন্য কাজ করলেও মেয়েদের জন্য করে না। ভায়াগ্রা কাজ করে খুব সাধারণ একটি পদ্ধতিতে। পুরুষাঙ্গে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দিয়ে। ঠিক একই পদ্ধতিতে ক্লায়টোরিসে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েদের জন্য ‘পিঙ্ক ভায়াগ্রা’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সফল হয়নি। একটি বড় কারণ মেয়েদের প্রেম এত যান্ত্রিক নয়, তাদের প্রেম অনেক বর্ণময়, অনেক ধরনের আবেগের সুগ্রন্থিত মিশ্রণ। তাই ছেলেদের ভায়াগ্রার মতো মেয়েদের জন্য ভায়াগ্রা তৈরি করতে গিয়ে বড় বড় কারখানাগুলো চুল ছিঁড়ে ফেলছে কিন্তু পণ্ডশ্রমই সার হয়েছে, সফলতা আসেনি। এদিকে ছেলেরা শুধু কেন বল খেলবে আর মেয়েরা পুতুল–এই শিকল ভাঙার অভিপ্রায়ে ভিন্ন ধরনের খেলনা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল–চলেনি। কারণ কী? কারণ হচ্ছে, আমরা যত আড়াল করার চেষ্টাই করি না কেন, ছেলেমেয়েদের মানসিকতায় পার্থক্য আছে আর সেটা দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় ছাপ থাকার কারণেই। এই ব্যাপারটিই প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্টে এক মায়ের আর্তিতে। সেই মা পত্রিকায় (নভেম্বর ২, ১৯৯২) তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন–
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনার পত্রিকার বিজ্ঞ পাঠকেরা কী বলতে পারবেন কেন একই রকমভাবে বড় করা সত্ত্বেও যতই সময় গড়াচ্ছে আমার দুই জমজ বাচ্চাদের মধ্যকার নারী-পুরুষজনিত পার্থক্যগুলো প্রকট হয়ে উঠছে? কার্পেটের উপর যখন তাদের খেলনাগুলো একসাথে মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়, তখন দেখা যায় ছেলেটা ঠিকই ট্রাক বা বাস হাতে তুলে নিচ্ছে, আর মেয়েটা পুতুল বা টেডি বিয়ার।
শুধু মানব শিশু নয়, মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি ‘ভার্ভেট মাঙ্কি’ নিয়ে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তাদের হাতে যদি খেলনা তুলে দেয়া হয়, ছেলে বানরেরা ট্রাক বাস গাড়ি ঘোড়া নিয়ে বেশি সময় কাটায় আর মেয়ে বানরেরা পুতুল কোলে নিয়ে। মানবসমাজে দেখা গেছে খুব অল্প বয়সেই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে খেলনা নিয়ে এক ধরনের পছন্দ তৈরি হয়ে যায়, বাবা-মা’রা সেটা চাপিয়ে দিক বা না দিক। দোকানে নিয়ে গেলে ছেলেরা খেলনা-গাড়ি কিংবা বলের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করে, আর মেয়েরা পুতুলের প্রতি। এই মানসিকতার পার্থক্যজনিত প্রভাব পড়েছে খেলনার প্রযুক্তি, বাজার এবং বিপণনে। যে কেউ টয়সেরাসের মতো দোকানে গেলেই ছেলেমেয়েদের জন্য খেলনার হরেক রকম সম্ভার দেখতে পাবেন। কিন্তু খেলনাগুলো দেখলেই বোঝা যাবে–এগুলো যেন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দাদের চাহিদাকে মূল্য দিতে গিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে বানানো।
শুধু শিশু বয়সে নয়, পরিণত বয়সেও ছেলে মেয়েদের মধ্যকার মানসিকতার। প্রভেদমুলক পার্থক্য বজায় থাকে পুরোমাত্রায়। পুরুষদের একটা বড় অংশ অর্থ, প্রতিপত্তি এবং যৌনতার প্রতি যেভাবে লালায়িত হয়, মেয়েরা গড়পড়তা সেরকম হয় না। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ছেলে মেয়েদের এই মানসিক পার্থক্যকে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারে। ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’ তত্ত্ব সঠিক হলে, আমাদের দেহ জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে চাইবে ‘জিন সঞ্চালনে’। পুরুষদের জন্য যেহেতু নয় মাস ধরে গর্ভধারণের ঝামেলা নেই, নেই অন্য আনুষঙ্গিক ঝামেলা মেয়েদের যেগুলো পোহাতে হয় গর্ভধারণের জন্য, সেহেতু তাদের মধ্যে একটা অংশ থাকেই যারা মনে করে যত বেশি জিন সঞ্চালন করা যাবে ততই বেশি থাকবে ভবিষ্যত প্রজন্ম বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। তাই ইতিহাসে দেখা যাবে শক্তিশালী পুরুষেরা কিংবা গোত্ৰাধিপতিরা কিংবা রাজা বাদশাহরা হেরেম তৈরি করে সুন্দরী স্ত্রী আর উপপত্নী দিয়ে প্রাসাদ ভর্তি করে রাখত। পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ পুরুষদেরই বেশি থাকে কিংবা পতিতাপল্লীতে পুরুষেরাই যায় আদিম সেই উদগ্র ‘যৌনস্পৃহা মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই।
পর্নোগ্রাফি থেকে মুক্ত নয় রক্ষণশীল জিহাদি (অবশ্যই পুরুষ) সৈনিকেরাও
২০১১ সালের মে মাস। আমি যখন বইয়ের এই অংশটুকু লিখছিলাম, তখন পাকিস্তানের এবোটাবাদে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে সবেমাত্র হত্যা করা হয়েছে। লাদেনকে হত্যার জন্য মার্কিন বাহিনী হঠাৎ করেই পাকিস্তানে অভিযান চালায়। লাদেন তখন ইসলামাবাদ থেকে ৩৫ মাইল দূরে এবোটাবাদ নামক একটি শহরের একটি তিন তলা বাড়িতে অবস্থান করছিল। হেলিকপ্টার দিয়ে পরিচালিত ওই অভিযানে লাদেন, লাদেনের একজন ছেলে এবং তার ২ জন। সহযোগীর মৃত্যু হয়।
কিন্তু তার মৃত্যুর পর যে খবরটি মিডিয়ায় এল তা আরও চাঞ্চল্যকর। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর ওসামার বাড়ি থেকে জব্দ কম্পিউটার থেকে পাওয়া গেল পর্নোগ্রাফির হরেক রকম কালেকশন। যে বিন লাদেন মেয়েদের সম্মান করে শরিয়া মোতাবেক চলাফেরা, হিজাব পরা, পর্দানসীন থাকাকে পশ্চিমা ধাচের অশালীন চলাফেরার চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট বলে মনে করতেন, সেই লাদেন পশ্চিমা মেয়েদের পর্নোগ্রাফি তার কম্পিউটারে সংগ্রহ করে রাখতেন, এবং সম্ভবত উৎসাহের সাথে সেগুলো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতেন। এ খবরটি প্রকাশিত হয়েছে রয়টার, সিএনএন, ইয়াহু নিউজ, ফক্স নিউজ, এবিসি নিউজ, গার্ডিয়ান, হাফিংটন পোস্টসহ বহু নিউজ মিডিয়াতেই[১৭১]।
এর মানে হচ্ছে, মরহুম বিন লাদেন চমৎকার একটি ইসলামি জীবন অনুসরণ করেছেন। যেখানে তিনি তার বিপ্লবী আদর্শে বলিয়ান উম্মতদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্ররোচিত করেছেন, নাইন-ইলেভেনের মতো আরও ঘটনা পুনর্বার। ঘটানোর ডাক দিয়েছেন, কাফির নাসারাদের সমূলে ধ্বংস করে ইসলামি সাম্যবাদের পতাকা তুলে ধরার হাঁকডাক পেরেছেন, সেখানে সেই বিপ্লবের অসংবাদিত নেতা লাদেন ইসলামাবাদের মাত্র ৬০ মেইল দূরে সামরিক বাহিনীর অভয়ারণ্য বলে খ্যাত এবোটাবাদের একটি দূর্গতুল্য প্রাসাদে তিন স্ত্রী এবং এগারোজন সন্তানসন্ততি নিয়ে নিরাপদে জীবনযাপন করতেন, কাফির নাসারাদের বানানো কোকা-কোলা / পেপসি চুক চুক করে পান করতেন, শখ করে দূর্গের বাইরে মারিজুয়ানা বা গঞ্জিকার বাগান করতেন, এবং গভীর রাতে কম্পিউটারে বসে বসে পর্নোগ্রাফি দেখতেন। চমৎকার একজন ইসলামি নেতার মতোই কাজ কারবার।
যদিও হলফ করে বলার উপায় নেই যে, বিন লাদেনই সেই পর্নোগুলো দেখতেন, কিন্তু তারপরেও যখন তার পার্সোনাল কম্পিউটারেই রকমারি ধরনের ঢালাও পর্নের সংগ্রহ আবিস্কৃত হয়েছে, এবং সেই কম্পিউটারটি সুরক্ষিত ছিল কেবল বিন লাদেনের নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্যই, তখন মন থেকে জোরালো একটা সন্দেহের তীর প্রক্ষিপ্ত হয় বৈকি! যাহা হাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করে আর যার হাঁসের মতো পালক আছে তাহা শেষ পর্যন্ত হাঁসই।
কেন পর্নোগ্রাফি বহু পুরুষদের উন্মাতাল করে?
পর্নোগ্রাফি দেখা কোনো সত্যিকার যৌনসঙ্গম নয়, এটা সবাই জানে। তারপরেও পর্নোভিডিও কেন পুরুষদের উত্তেজিত করে, কামার্ত করে তুলে? বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে এর উত্তর পাওয়া গেছে। সাভানা অনুকল্পের কথা আমরা প্রথম অধ্যায়ে জেনেছি; যে কারণে আমরা তেল চর্বিযুক্ত খাবারের প্রতি লালায়িত হই, যে কারণে আমরা সাপ আর বিষধর কীটপতঙ্গ দেখলেই ভয় পাই, পর্নোগ্রাফির প্রতি বহু পুরুষদের আসক্তির কারণও মূলত একই জায়গায়। সাভানা অনুকল্প বলছে, আমরা আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও আমাদের মস্তিষ্ক রয়ে গেছে প্রস্তর যুগে আমাদের করোটির ভিতর বাস করে আদিম প্রস্তর যুগের মস্তিষ্ক। কারণ মানব মস্তিষ্কের মূল মডিউলগুলো তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমরা যখন আফ্রিকার সাভানা তৃণভুমিতে শিকারি সংগ্রাহক হিসেবে জীবন। কাটাতাম। ভিডিও, সিনেমা, এগুলো আধুনিক কারিগরী উৎকর্ষময়তার অবদান, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক আধুনিক জটিলতার মাঝে সময় অতিক্রম করলেও এর প্রকৃত বাস্তবতা থেকে অপার বাস্তবতাকে পৃথক করতে অনেক সময়ই থাকে অক্ষম। সেজন্যই গভীর রাতে ভূতের বই পড়লে বা সিনেমা দেখলে আমাদের অনেকেরই গা ছম ছম করে। যে কারণে ভূতের সিনেমা দেখে অনেকে ভয় পায়, একই কারণে পর্নোগ্রাফি দেখেও অনেকে উত্তেজিত হয়। মেয়েদের নগ্ন ছবি কিংবা পর্নোভিডিও দেখলে পুরুষদের মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারে না যে, এগুলো সত্যি নয়–এগুলো আসলে কৃত্রিমভাবে তৈরি পণ্যমাত্র। এই অত্যাধুনিক পণ্যগুলোর কোনো অস্তিত্ব আমাদের পূর্বপুরুষদের সাভানা পরিবেশে ছিল না। তাদের কাছে সে সময় কোনো নগ্ন মেয়ের সাথে সঙ্গম কিংবা সঙ্গম করার জন্য উত্তেজক পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সবসময়ই ছিল সে সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত বাস্তবতার নিয়ামক। কাজেই আধুনিক মানুষ কম্পিউটারে বসে কোনো মেয়ের নগ্ন ছবি দেখলে কিংবা পর্নো ভিডিও দেখলে প্রস্তর যুগে তৈরি পুরুষের মস্তিষ্ক অনুধাবন করতে পারে না যে উপকরণগুলো আসলে কৃত্রিম,বরং মস্তিষ্কে সেই সমস্ত সঙ্কেতই পাওয়া যায় যার মাধ্যমে মনে হয় সত্যি সত্যিই ওই মেয়েদের সাথে যৌনসঙ্গমের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ সময় পুরুষদের জননেন্দ্রিয় শক্ত হয়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, তাদের দৃষ্টি ফোকাস হয়ে উঠে ভিডিওতে দেখা মেয়ের দেহের বিবিধ যৌনাঙ্গে। ঠিক এগুলোই ঠিক একইভাবে ঘটে সত্যিকার এবং সফল যৌনসঙ্গমের প্রাক্কালে। মস্তিষ্ক যদি বুঝতে পারত ভিডিওতে দেখা কিংবা কম্পিউটারে ব্রাউজ করা মেয়েগুলো ভার্চুয়াল, তাদের সাথে সত্যিকার সঙ্গম করা সম্ভব হবে না, তাহলে সে দৃশ্যগুলো দেখে পুরুষাঙ্গ কখনই সঙ্গমের জন্য উখিত হতে শুরু করত না। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক সেটা অনুধাবন করতে পারে না বলেই পর্নোগ্রাফি দেখলে পুরুষেরা উত্তেজিত হয়ে উঠে।
সাভানা অনুকল্পের ব্যাপারটা একইভাবে নারী মস্তিষ্কের জন্যও প্রযোজ্য। নারীদের জন্য পর্নোগ্রাফির আবেদন ভিন্নভাবে তৈরি হয়েছে বিবর্তনের যাত্রাপথে। বিবর্তনীয় পথপরিক্রমায় পুরুষদের মতো ঘন ঘন সঙ্গী বদল মেয়েদের জন্য কোনো প্রজননগত সফলতা নিয়ে আসেনি। নারীরা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে থাকে অপেক্ষাকৃত খুঁতখুঁতে, ফলে স্বভাবগতভাবেই নারীরা অসতর্ক সঙ্গমে (casual sex) পুরুষদের মতো প্রলুব্ধ হয় না। কারণ, এ ধরনের অসতর্ক সঙ্গমে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভকালীন ঝামেলা পোহাতে হয়েছে নারীকেই। গবেষণায় দেখা গেছে, গড়পড়তা একটি পুরুষ কোনো নারীর সাথে পরিচয়ের এক সপ্তাহের মাথায় যৌনসঙ্গমে ইচ্ছুক হয়, সেখানে একটি নারী যৌনসম্ভোগের জন্য অপেক্ষা করতে চায় ছয় মাস[১৭২]। ঠিক যে কারণে পুরুষের প্রস্তর যুগের মস্তিষ্ক পর্নো ভিডিও দর্শনে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ঠিক একই কারণে মেয়েরা হয়ে পড়ে এ ব্যাপারে সতর্ক। মেয়েদের প্রস্তর যুগের মস্তিষ্ক ভুল সঙ্কেত পাঠাতে থাকে যে, এই পর্নোগ্রাফির ফলশ্রুতিতে তারা গর্ভবতী হয়ে যেতে পারে। তাই অধিকাংশ মেয়েই পর্নোগ্রাফির প্রতি নিস্পৃহ কিংবা নিরাসক্ত থাকে, এদের মধ্যে অনেকেই দারুণভাবে বীতশ্রদ্ধও। বিবর্তনীয় যাত্রাপথে নারী পুরুষের যৌনতার ভিন্ন স্ট্র্যাটিজির কারণেই পর্নোগ্রাফির প্রতি ভিন্ন আবেদন দেখা যায়।
বিন লাদেনের পর্নো দেখা নিয়ে আমার কোন সমস্যা ছিল না। মুক্তমনায় প্রকাশিত প্রবন্ধে আমি সেটা পরিষ্কার করে বলেছিলাম যে, আমি পর্নোবিরোধী কেউ না। কে নিশিরাত জেগে পর্নোগ্রাফি দেখছে আর না দেখছে সেটা আমার বিবেচ্য ছিল না কখনোই, এই লেখার মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির বিলুপ্তির কোনো পিটিশনও হাজির করছি না আমি, যার ইচ্ছে হয় দেখুক, আমার কী বলার আছে! কিন্তু আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুটি হলো–যে বিন লাদেন পাশ্চাত্যে অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি, হোমোসেক্সয়ালিটি আর পতিতাবৃত্তিসহ বহুকিছুতে সোচ্চার, সকল ধরনের পশ্চিমা বেলেল্লাপনার বিরুদ্ধেই তার নিরঙ্কুষ জিহাদ, সেই নীতি নৈতিকতার চূড়ামণি বিধ্বংসী জিহাদি নেতা লাদেন বসে বসে পর্নোগ্রাফি দেখতেন—ব্যাপারটা অভিনব না? সর্ষের মধ্যেই যখন ভুত থাকে, তখন আর কী বা বেশি বলার থাকে।
শুধু পর্নোগ্রাফি নয়, বিন লাদেনের দূর্গ থেকে এভেনার মতো বিভিন্ন ‘সেক্সুয়াল স্টিমুলেটরও পাওয়া গেছে। তার চেয়েও মজার ব্যাপার হলো, নিজে আয়েশ করে বাহারি ধরনের পর্নো দেখলেও তার মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীরা যেন কোনোক্রমেই পুনর্বার বিয়ে না করতে পারেন–এ নিয়ে একটি উইল করে গেছেন ‘মহানুভব লাদেন’। অবশ্য এগুলো কোনোটাই আমার কাছে খুব একটা বিস্ময়কর কিছু মনে হয়নি। কাগজে কলমে মৌলানারা তোতাপাখির মতো ‘ইসলামে পর্নোগ্রাফি হারাম’ জাতীয় বুলি আউরালেও কিংবা বোরখা আর হিজাবের জয়গান গাইলেও আরব বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোই সবচেয়ে ‘সেক্স স্টার্ভড’ জাতি সেটা অনেক আগে থেকেই মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। হিন্দি নাচ গানের সেক্সুয়াল ভিডিওর জমজমাট ব্যবসা নাকি আরবেই। মধ্যপ্রাচ্যের ‘বেলি ড্যান্সিং কিংবা পাকিস্তানের মুজরার কথাও কমবেশি সবাই জানে। শুধু তাই নয়, সৌদি বাদশাহদের হারেম পোষা থেকে শুরু করে, দেশ বিদেশ থেকে সুন্দরী নারী ভাড়া করে নিয়ে এসে শেখদের পার্থিব লালসায় ব্যবহারের খবর প্রায়ই পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়[১৭৩]। আর এর মধ্যে পাওয়া গেছে আরও এককাঠি সরেস খবর। সম্প্রতি গুগলের বদৌলতে পর্নোওয়েবসাইট কারা বেশি পরিভ্রমণ করে এ সংক্রান্ত জরিপ চালানো হয়েছে, আর এ থেকে বেরিয়ে এসেছে এক মজাদার তথ্য। ২০০৬ সালে করা এ জরিপে পাওয়া ফলাফলে যে তথ্য উঠে এসেছে তা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। সবচেয়ে বেশি পর্নসাইট ভ্রমণ করেন ইসলামি শরিয়া সমদ্ধ পাকিস্তানিরা[১৭৪]। শুধু ২০০৬ সালের পর থেকেই পাকিস্তানিরা এ ব্যাপারে শীর্ষে, এবং গত বছরের জরিপেও একই ফলাফল বেরিয়ে এসেছে[১৭৫]। জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানিরা কেবল হিউম্যান সেক্সেই আগ্রহী নয়, সেই সাথে ‘horse sex’, ‘donkey sex’, ‘camel sex’ প্রভৃতি সার্চেও তালিকার প্রথমে। শুধু পশুমেহনে পাকিদের আসক্তি থাকলেও না হয় কথা ছিল, সেই সাথে তারা আগ্রহী ‘rape sex’, ‘child sex এবং ‘rape video’ দর্শনেও (সাধু সাবধান)। পর্নোগ্রাফির প্রতি এই ইসলামি রাষ্ট্রটির প্রবল আসক্তি দেখে অনেকেই বলছেন, এই দেশটাকে পাকিস্তান না ডেকে পনিস্তান ডাকলে কেমন হয়?[১৭৬] ঘটনা অবশ্য এখানেই শেষ নয়, আরও আছে ২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী যৌনতাসন্ধানী বুভুক্ষু প্রথম দশটি দেশের ছয়টিই ইসলামি দেশগুলোর দখলে। সেগুলো হচ্ছে: মিসর (দ্বিতীয়), ইরান (চতুর্থ), মরক্কো (পঞ্চম), সৌদি আরব (সপ্তম) এবং তুরস্ক (অষ্টম)। অমুসলিম দেশ চারটে হচ্ছে: ভিয়েতনাম (তৃতীয়), ভারত (ছয়), ফিলিপাইন (নবম) এবং পোল্যান্ড (দশম)। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রথম আটটি দেশের ছ’টিই মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। দ্য ডেইলি বিস্টের Panifest 017 Catania ‘Osama’s Dirty Mind : Bin Laden’s porn and Muslim hypocrisy on sex’ শীর্ষক প্রবন্ধে এজন্যই লিখেছেন[১৭৭]–
Some of the Muslim societies that are the most repressive toward women…also have some of the highest rates of pornography usage in the world.
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের টেরোরিজম বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিন ফেয়ার বলেছেন, ‘লাদেনের বাসায় পর্নো পাওয়ায় অবাক হইনি মোটেই। জিহাদিরা পর্নো ভালোবাসবে এটা তো জানা কথাই। সাধে কী তাদের জন্য পরকালে বাহাত্তরটা হুর পরির লোভ দেখানো হয়েছে নাকি!’। রজার সিম্পসনের উদ্ধৃতি দিয়েই বলতে হয়—- the greater the repression the greater the revolution’, আমি মুক্তমনায় প্রকাশিত আমার ঐ প্রবন্ধে সেজন্যই কৌতুক করে বলেছিলাম, “আগামী বিশ্বের সেক্সুয়াল রিভলুশন সম্ভবত ইসলামি বিশ্বেই শুরু হবে, আর মরহুম বিন লাদেন হলেন সেই বিপ্লবের পথিকৃৎ। আমার তো তাই মনে হচ্ছে’।
অথচ পর্নোগ্রাফি নাকি হারাম ইসলামে[১৭৮]! এক মুখে পর্নোকে হারাম বলা হয়, অথচ ইসলামের জিহাদিদের নেতাই বসে বসে সোৎসাহে পর্নো দেখেন। হারামের কথাই যখন এল, কী হারাম আর কী হারাম নয় তা বলা সত্যই মুশকিল। ধর্মকারী নামে একটা সাইট আছে নেটে। সেই সাইটের প্রকৃতি সম্বন্ধে সাইটটিতে বলা হয়েছে, ‘যুক্তিমনস্কদের নির্মল বিনোদনের ব্লগ। বিতর্ক বা বাকবিতণ্ডার স্থান নেই এখানে। এই ব্লগে ধর্মের যুক্তিযুক্ত সমালোচনা করা হবে, ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে, অপদস্থ করা হবে, ব্যঙ্গ করা হবে। যেমন করা হয়ে থাকে সাহিত্য, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা বা অন্যান্য যাবতীয় বিষয়কে।
অবশ্য সেক্স ম্যানিয়্যাক জীব কেবল ইসলামেই আছে তা মনে করলে বেজায় ভুল হবে। সব ধর্মেই সেটা কমে বেশি আছে বলাই বাহুল্য। ভারতে পরলোকগত সাইবাবার সেক্স স্ক্যান্ডাল পত্রপত্রিকায় এসেছে। “ভগবান রজনীশের’ যৌনউন্মত্ততার কথাও সর্বজনবিদিত ছিল। চার্চের বিভিন্ন পাদ্রী প্রায়ই শিশু যৌন নিপীড়ন এবং ব্যভিচারের কারণে নিত্যদিনই পত্রপত্রিকার শিরোনাম হন, তা তো আমরা এখনও হর-হামেশাই দেখছি। আসলে যেখানেই মাত্রাতিরিক্ত বাধার প্রাচীর তুলে দিয়ে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে নানা ধরনের আসক্তি এবং আস্ফালন। আমরা অবশ্য মনে করি যৌনতা বিবর্তনেরই ফসল। যৌনতাকে পাপ, ব্যভিচার, পশ্চিমের বেলাল্লাপনা বলে কৃত্রিম উপায়ে যে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, যায় না দমন করা কেবল হিজাব কিংবা বুরকার বুলি কপচিয়ে, সেটা মরহুম ওসামা বিন লাদেন লুকিয়ে লুকিয়ে পর্নো দেখে এবং অন্যান্য (অ)কাজ কুকাজের মাধ্যমে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের সত্যতাই পুনর্বার প্রমাণ করে দিলেন, নয় কি?
আমাদের সৌন্দর্যবোধ আর শিল্পবোধগুলো তৈরি হয়েছে বিবর্তনের পথ ধরে
সুদক্ষ শিল্পীর নয়নাভিরাম শিল্পকর্ম কে না ভালোবাসে! পিকাসোর গুয়েরনিকা, অগস্ত রদ্যার ‘থিঙ্কার কিংবা মাইকেলএঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ দেখে আমরা মুগ্ধ হই, ঠিক তেমনি আমরা উদ্বেলিত হই শামীম শিকদারের ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতার পাশে দাঁড়িয়ে, কিংবা নিতুন কুণ্ডুর ‘সাবাস বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু কেন আমাদের ভাস্কর্য দেখতে ভালো লাগে? কখনো কি আমরা ভেবেছি কেন ভাস্করদের নিপুণ কাজ আমাদের মনোমুগ্ধকর বলে মনে হয়, তাদের ব্যক্তিত্বকে কাঙ্ক্ষিত মনে হয়? অনেক বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীই মনে করছেন ব্যাপারটির উৎস আসলে বিবর্তনমনোসঞ্জাত। আমাদের পূর্বপুরুষেরাও এমনিভাবে পাথুরে হাতিয়ার, প্রবালের নেকলেস প্রভৃতি বানিয়ে জয় করতে পেরেছিল বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষণ, জাগাতে পেরেছিল অন্যদের চিত্তচাঞ্চল্য। প্রায় দের মিলিয়ন বছর আগে হোমো ইরেক্টাসরা শুরু করেছিল পাতলা পাথরের ফালি বানানো। এগুলো দেখতে ডিম্বাকৃতির, কখনোবা ত্রিভুজাকৃতির পাতার মতোন বা ‘টিয়ার ড্রপ’ আকারের[১৭৯]। এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকাসহ পৃথিবীর যেখানেই হোমো ইরেক্টাস আর হোমো ইরগাস্টারদের যাতায়াত ছিল, সেখানেই পাওয়া গেছে হাজার হাজার একুলিয়ান হ্যান্ড অ্যাক্স। সবচেয়ে পুরনো ‘অ্যাকুলিয়ান হ্যান্ড অ্যাক্স’-এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে ১.৮ মিলিয়ন বছর আগেকার।
এ প্রাচীন হাতিয়ারগুলোই আমাদের মানবেতিহাসের সবচেয়ে পুরনো শিল্প। ব্যবহারিক অস্ত্রের এই বিমুগ্ধকর নান্দনিক রূপান্তর প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কারিগরি দক্ষতা তুলে ধরে। ডারউইনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘হ্যান্ড এ্যাক্স’ সভ্যতার নতুন এক ধাপের প্রতীক। দেখে মনে হয় এই হাতিয়ারগুলো তৈরিই হয়েছে একধরনের প্রচ্ছন্ন ‘ফিটনেস সিগন্যাল দেয়ার জন্য, যে সিগন্যালের মধ্যে প্রকাশ পায় নির্মাতার বুদ্ধি, কর্মনিপুণতা, সচেতনতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতা। অনেকটা পেখমওয়ালা ময়ূরের মতোই অস্ত্র বানানোয় দক্ষ পুরুষ আকর্ষণ করতে পেরেছিল আদিম সমাজে নারীদের অনুগ্রহ। আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের এ গুণগুলো ছিল তারা আকর্ষণ করেছিল অধিকমাত্রায় বিপরীত লিঙ্গের সান্নিধ্য, তারাই রেখে গেছে অধিক হারে উত্তরসূরী। যারা এই কারিগরিবিদ্যা রপ্ত করতে পারেনি, তারা বিপরীত লিঙ্গের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেনি, তারা প্রজননগতভাবে সফল ছিল না।
নিউজিল্যান্ডের কেন্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস ডাটন (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪-২৮ ডিসেম্বর, ২০১০) একটি বই লিখেছেন ডারউইনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সৌন্দর্যপ্রিয়তা এবং শিল্পের প্রতি অনুরাগ বিশ্লেষণ করে[১৮০]। তার একটি চমৎকার লেকচার আছে টেড ডট কম সাইটে এবং ইউটিউবে[১৮১]। তিনি মনে করেন, শিল্প বিষয়ক যে কোনো আধুনিক রুচি সেটা যে কোনো শিল্প মাধ্যমই হোক না কেন, উদ্ভূত হয়েছে বিবর্তনের ক্রমপ্রক্রিয়ায়, ডারউইনের তত্ত্ব দিয়ে যাকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে পূর্বপুরুষদের চোখে পাথুরে হাতিয়ার তৈরির মতো দক্ষতাগুলো যেমন আকর্ষণীয় হয়ে ধরা দিয়েছিল, সেই একই ধরনের ভালোলাগাগুলো এখনও আমাদের মনে কাজ করে যায় প্রায় একইরকমভাবে। নিপুণ কারিগরি দক্ষতায় সম্পন্ন যে কোনো কাজ বা শিল্প দেখলে আমাদের মন এখনও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, আমরা সেই শিল্পকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হই অবচেতনভাবেই। কোনো গয়নার দোকানে টিয়ার ড্রপ আকারের কোনো হীরার অলংকার দেখলে আমাদের মন উদ্বেলিত হয়ে উঠে। এমন মনে করার কারণ নেই যে আমাদের সংস্কৃতিই হঠাৎ করে শিখিয়েছে এগুলোকে সুন্দর ভাবতে। বরং আমাদের সুদূর পূর্বপুরুষরাও ভালোবাসতো এই ধরনের শৈল্পিক আকৃতিগুলো, আর কদর করত এর নির্মাণের পেছনের কর্মকুশলতা আর দক্ষতাকে। আমাদের আধুনিক রুচিবোধগুলো মূলত তৈরি হয়েছে সেই প্লেইস্টোসিন যুগের আদিম পছন্দ অপছন্দগুলোর উপর ভর করেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য, খেলাধুলা প্রভৃতির প্রতি অনুরাগগুলো তৈরি হয়েছে লৈঙ্গিক আবেদনের মাধ্যমে যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরে। প্রাকৃতিক নির্বাচন গড়ে উঠেছে মূলত বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, আর অন্যদিকে যৌনতার নির্বাচন কাজ করেছে প্রজননগত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলার মনে করেন, আমাদের এই শৈল্পিক রুচিবোধগুলো কোনো অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার সুনিপুণ ডিজাইনের মাধ্যমে যেমন হয়নি, ঠিক তেমনি পুরোটুকু তৈরি হয়নি অন্ধ এবং নির্বিচারী এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেও। বরং আমাদের মানসপটের বিবর্তন হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের দীর্ঘদিনের চাহিদাকে মূল্য দিয়ে, তাদের বুদ্ধিবৃত্তির উপর ভর করে এবং তাদের সতর্ক সঙ্গী নির্বাচনের মাধ্যমে। আমরা তাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছি তাদের নানারকম পছন্দ-উদ্যম, সৃজনশীলতা, কৌতুকপ্রিয়তা, বুদ্ধিমত্তা এবং শিল্পবোধসহ বিভিন্ন নৈর্ব্যক্তিক বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ। তারা সঙ্গী নির্বাচনের সময় সচেতনভাবেই গুরুত্ব দিয়েছে কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতি, সে সমস্ত বৈশিষ্ট্য গুলো সংরক্ষিত থেকেছে আমাদের জনপুঞ্জে। সে সমস্ত বৈশিষ্ট্য কারো মধ্যে খুঁজে পেলে আমাদের মস্তিষ্ক স্বভাবতই আমোদিত হয়, প্রলুব্ধ হয় ঠিক যেমন ময়ূরী প্রলুব্ধ হয় দীর্ঘ পেখমওয়ালা ময়ূরকে খুঁজে পেলে। আমরা মূলত আমাদের পূর্বপুরুষদের লক্ষ বছরের বংশগতীয় পরীক্ষানিরীক্ষার সফল পরিণতি।
নারী পুরুষ শেষ পর্যন্ত অভিন্ন মানব সত্তারই অংশ
পুরো অধ্যায়টিতে মূলত জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী পুরুষের পার্থক্য উল্লেখ করা হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, নারী পুরুষ কোনো আলাদা প্রজাতির জীব নয়, নয় কোনো ভিন্ন ভুবনের দুই বাসিন্দা, বরং তারা শেষ পর্যন্ত তারা অভিন্ন মানবপ্রকৃতিরই অংশ। হ্যাঁ নারীপুরুষের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় দিক থেকে এবং আচরণগত বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্য আছেই, সেটার কারণ বহুবিধ। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নারী এবং পুরুষকে বিবর্তনের যাত্রাপথে ভিন্ন ধরনের অভিযোজনগত সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে, তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করেছে, যেগুলোর প্রকাশ আজও তাদের মানসপটে রয়ে গিয়েছে। যেমন, গর্ভধারণ, শিশুকে স্তন্যপান করানো সহ বহুকিছুর অভিযোজনগত সমাধান জৈবিকভাবে করতে হয়েছে কেবলমাত্র নারীকেই। আবার অন্য দিকে অনাগত সন্তানের পিতৃত্বের নিশ্চয়তার সংশয় সংক্রান্ত ঈর্ষা নিয়ে জুঝতে হয়েছে মূলত পুরুষকেই, নারীকে নয়। এগুলোর পার্থক্য সূচক প্রভাব নারী পুরুষের শরীরে এবং মনোজগতে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়।
বিভিন্ন সমস্যা নারী পুরুষ যেমন ভিন্নভাবে যেমন সমাধান করেছে, তেমনি আবার অতীতের পৃথিবীতে বহু অভিযোজনগত সমস্যাই ছিল যেগুলো আবার তারা সমাধান করেছে প্রায় একই রকমভাবে, একই পদ্ধতিতেই। যেমন, নারী পুরুষ উভয়েরই দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য সঠিক সঙ্গী খুঁজে নিতে হয়েছে, তাদেরকে বুঝতে হয়েছে তার সঙ্গী তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে বিশ্বস্ত থাকবে কিনা, সন্তানকে বড় করলে তুলার ব্যাপারে শতভাগ নিয়োজিত থাকবে কি না ইত্যাদি। ভালোবাসা, সম্পর্কের স্থায়িত্ব, সুস্থ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা, নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি প্রভৃতি বহু ব্যাপারে নারীপুরুষের চাহিদাগুলো নির্বিশেষে একইরকমই হয়[১৮২]। নারী পুরুষ উভয়েই চায় নিজেরা সুখী হতে, নিজেদের সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত এবং সুখী দেখে যেতে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব প্রভৃতির ব্যাপারে কারো অবদানই কম নয়। বিজ্ঞানী জেনেট শিবলী হাইড তার একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, নারীপুরুষের পার্থক্যসূচক অভিব্যক্তিগুলোর চেয়ে তাদের মধ্যে জেন্ডারগত সাম্যই বেশি পরিলক্ষিত হয়[১৮৩]। নারীবাদী বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, যৌনতার বৈচিত্র্য এবং শারীরিক আগ্রাসনসহ কিছু ক্ষেত্রে একটি নারীর সাথে একটি পুরুষের পার্থক্য রয়েছে সত্য[১৮৪], কিন্তু সেটা জেন্ডারগত সাম্যকে লঙ্ঘন করে না, বরং আন্তঃযৌনতা প্রতিযোগিতা (intrasexual competition) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়[১৮৫]। রোজালিন ফ্র্যাঙ্কলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের (শিকাগো মেডিকাল স্কুল) বিজ্ঞানী লিসি এলিয়ট তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, নারী পুরুষের মধ্যে শারীরিক এবং জৈবিক দিক থেকে পার্থক্য আছে, কিন্তু সেই পার্থক্যগুলো এমন কিছু বড় নয়। বহুক্ষেত্রেই ছেলেদের বাচনক্ষমতা, সহমর্মিতা যেমন চেষ্টা করলে বাড়ানো যায়, ঠিক তেমনি আবার মেয়েদের গাণিতিক কিংবা ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণের ক্ষমতাগুলোও বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে[১৮৬]। যেমন, দেখা গেছে, গণিত বা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে চেষ্টা করলে নারীরা শুধু পুরুষদের সমান নয়, এমনকি ছাড়িয়েও যেতে পারে। আসলে জগতের বহু বিষয় যেগুলো একসময় কেবল ‘পুরুষদের এলাকা’ বলে চিহ্নিত করা হতো, সেগুলোতে নারীরা কেবল পদার্পণই করেনি, ছাড়িয়েও গিয়েছে। যেমন, সারা পৃথিবীতে গণিতকে ঢালাওভাবে পুরুষদের আধিপত্যময় বিষয় বলে বিবেচনা করা হলেও দেখা গেছে আইসল্যান্ডে মেয়েরা গড়পড়তা ছেলেদের চেয়ে অনেক ভালো ফলাফল করেছে[১৮৭]।
আবার ছেলেরা গড়পড়তা যে সব ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়ে দুর্বল–বিশেষত সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিংবা সহমর্মিতা আর সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে সম্মিলিত চর্চার মাধযমে সেগুলোর অব্যাহতভাবে উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে অনেক ছেলেরই। কাজেই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এবং সঠিক প্রচেষ্টা থাকলে নারী পুরুষ সবার পক্ষেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন সম্ভব। পাথরের গায়ে কখনোই খোদাই করে লেখা নেই নারীরা ‘ইহা পারিবে’, আর পুরুষেরা ‘উহা’। বরং অভিন্ন মানববৈশিষ্টের বহু কিছুই আমরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের মধ্যে ধারণ করি, এবং নিজ নিজ পছন্দ, অভিরুচি এবং আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে সেগুলোর পরিস্ফুটন ঘটাই।
এই জায়গায় আমার মতে, নারীদের নিয়ে একটু বেশি বলা দরকার, যেহেতু সামাজিক স্টেরিওটাইপিং এর ব্যাপারগুলো মূলত নারীদের ঘিরেই, এবং সেগুলো নারীদের অবদমনের কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়। একটা সময় ছিল যখন নারীদের পুরুষের সমকক্ষ হওয়া তো দুরের কথা মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হতো না। অথচ উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আজ দেখা যাবে, নারীরা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। যেমন, সবচেয়ে দুর্গম, এবং মেধাশীল ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত মহাকাশযাত্রায় নারীদের অবদানের কথাই বলা যাক। সোভিয়েত নারী ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা ছিলেন প্রথম মহাকাশ বিজয়ী নারী, এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না, বর্তমানে নাসার বহু। উল্লেখযোগ্য মহাকাশ মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুদক্ষ নারীরা। যেমন, আইলিন কলিনস ১৯৯৯ সালের স্পেস শাটলের প্রথম মহিলা কমান্ডার হিসেবে কলাম্বিয়া মিশনের সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে তিনি মার্কিন বিমান বাহিনির সি-১৪১ বিমানের প্রধানের দায়িত্বেও ছিলেন। ২০০৭ সালের স্পেস শাটল ডিস্কভারি এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মিলনের সময় উভয়েরই প্রধান ছিলেন নারী। ডিস্কভারির নেতৃত্বে ছিলেন পামেলা মেলরয় আর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন পেগি হুইটুন। নাসায় কর্মরত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রয়াত ড, কল্পনা চাওলাও কলম্বিয়া মিশনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মহাকাশচারণায় যথেস্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন; এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি ডিগ্রি ছিল তার। আরেকজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী মার্কিন নভোচারী শ্যানন লুসিড একসময় মহাকাশে দীর্ঘতম সময় কাটানোর রেকর্ড সৃস্টি করেছিলেন। এ ছাড়া ড, স্যালী রাইডের কথাও অনেকে জানেন যিনি স্পেস শাটলের প্রথম মহিলা সদস্য হন ১৯৮৩ এ। মহাকাশ জয়ে এখনও অবদান রাখতে না পারলেও বাঙালি মেয়েরা পিছিয়ে নেই যাত্রীবাহী বিমান চালনায়। যেমন, বাংলাদেশ বিমানের ইয়াসমিন রহমান এশিয়ার প্রথম মহিলা ডিসি-১০ বিমানের ক্যাপ্টেন হবার গৌরব অর্জন করেন ১৯৯১ তে। ডিসি-১০ বিমানের ক্যাপ্টেন হয়ে পাঁচ বছর বিমান চালাবার পর রাজনৈতিক কারণে তাকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও ইয়াসমিন রহমানের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। স্থাপত্যবিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে পাঁচ বছর স্থপতির পেশায় নিয়োজিত থেকে আবার সাফল্যের সাথে পরীক্ষা দিয়ে সক্রিয় বিমান চালনায় প্রত্যাবর্তন করে বিমানের এয়ারবাস এর ক্যাপ্টেন হন ২০০১ সালে। নারীদের জন্য তিনি এক উজ্জীবিত উদাহরণ। পাশাপাশি বাংলাদেশের সুলেখক এবং গবেষক সেলিনা হোসেনের কন্যা ফারিয়া লারার কথাও আমরা জানি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে স্নাতক হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন একজন সফল পাইলট। ১৯৯৬ সালে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের কাছ থেকে তিনি প্রাইভেট পাইলটের লাইসেন্স অর্জন করেন। এর দু’বছর পরে ১৯৯৮ সালের ১৯ শে মার্চ লারা বাণিজ্যিক পাইলট হওয়ার লাইসেন্স পান। তিনি এরপরই পাইলটদের প্রশিক্ষক হবার প্রশিক্ষণ দেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী যিনি এই পেশায় আসেন। ১৯৯৮ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর একটি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু না হলে তিনিই হতেন বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট প্রশিক্ষক।
মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস: নারীরা সব পারে’ নামের একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের পাপিয়া নামের এক সাহসী মেয়ের উদাহরণ নিয়ে এসেছিলেন[১৮৮]। ১৯৯৮ সালের দিকে পাপিয়া জীবিকার তাগিদে ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালাতে শুরু করে ইতিহাস সুস্টি করেছিলেন। পাপিয়া তার রিক্সায় বাহক নারী নাকি পুরুষ তা বিচার না করে সবাইকে বহন করতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটাই বোধহয় প্রথম আর শেষ উদাহরণ। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা এখনও এরকম দুঃসাহসিক কাজে মেয়েদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। সামাজিক বাস্তবতার জন্য মেয়েরা বাসের ড্রাইভার বা কন্ডাক্টরও হয়তো হতে পারবেন না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, যদিও ট্রাফিক ও যাত্রীসংখ্যার দিক দিয়ে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক আর ঢাকার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই তবু সিঙ্গাপুর শহরে কিংবা ব্যাংককে মেয়ে বাসকন্ডাক্টর এক অতি পরিচিত দৃশ্য। আমি নিজেই দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে থেকেছি। বহুবারই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে এমন বাসে আমার উঠতে হয়েছে যেখানকার চালক পুরুষ নন, নারী। শুধু বাসের চালক বা কন্ডাক্টর হওয়া নয়, রাস্তায় রাস্তায় ফটোকপি মেশিন চালনা, মাল পরবহন, মালামালের ক্রয়বিক্রয় সহ সব ধরনের মানসিক এবং শারীরিক শ্রমসাধ্য কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা অংশগ্রহণ করেছে সমান তালে।
সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন সময়ের একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। ১৯৯৯/২০০০ সালের ঘটনা। আমি তখন সবেমাত্র বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে পাড়ি দিয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে মাস্টার্স করছি। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সিঙ্গাপুরের ক্লেমেন্টি এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকতাম, আর সেখান থেকে বাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। বাসে সিটের তুলনায় যাত্রী উঠতো বেশি, অনেকটা ঢাকা শহরের বাসগুলোর মতোই। বাসের সিট ভরে যাওয়ার পর অনেক যাত্রীকেই দাঁড়িয়ে যেতে হতো তাদের মধ্যে নারী পুরুষ সবাই থাকতেন। স্বভাবতই আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে সবেমাত্র এসেছি তাদের জন্য ব্যাপারটা ছিল খুব অস্বস্তিকর। আমরা সব তাগড়া জোয়ানেরা সিট দখল করে বসে আছি, আর হয়তো পাশেই একটি মেয়ে পুরো রাস্তা বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমার বন্ধু। সাইফুল ছিল খুব মানবদরদি টাইপের। একদিন ঠিক তার সিটের পাশেই একটি নরমসরম মেয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, দেখে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে নিজ সিটে মেয়েটিকে বসতে অনুরোধ করল। কিন্তু মেয়েটি তাতে খুশি হলো না মোটেই, বরং অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
– “আপনার জায়গায় কেন আমি বসব?_অবাক চোখে প্রশ্ন মেয়েটির।
— ‘কারণ, আপনি দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। আর আমি বসে … সাইফুলের জবাব।
— ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি বসলে তো আবার আপনাকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়।
–‘তাতে অসুবিধা নেই।
– “আমার আছে। আপনি তো আমার আগে বাসে উঠেছেন, আপনি কেন আমার জন্য সিট ছেড়ে দেবেন? আর দিলেই বা আমি বসব কেন?
— ‘কিন্তু আপনি তো মেয়ে… আমতা আমতা কণ্ঠ সাইফুলের।
— মেয়ে তো কী হয়েছে? আমি তো আর অথর্ব নই। আপনি যেভাবে দাঁড়িয়ে যেতেন, আমি ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। এতে তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।‘
-‘তা বটে, কিন্তু …’
— ‘আমরা এখানে কেবল বয়োবৃদ্ধ নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেনদের কিংবা পঙ্গু বা প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন ছেড়ে দেই। অন্য কারো জন্যে নয়। আপনাদের দেশে কি নিয়ম আলাদা?
— “হ্যাঁ, আমাদের দেশে বাসে নারীদের জন্য আলাদা আসন থাকে। কোনো নারী দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা তাদের জন্য আসন ছেড়ে দেই। নইলে অভদ্রতা করা হয়। আমি ভেবেছিলাম এই ভদ্রতার ব্যাপারটা সব জায়গায় একই রকম হবে…।
— কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন, যে এই ভদ্রতার আড়ালে একটি মানসিকতা কাজ করছে যে, নারীরা অথর্ব, তারা আপনাদের মতো দাঁড়িয়ে বাসে করে যেতে পারবেন না…’।
ঘটনার অনেক দিন পার হয়ে গেলেও এই সংলাপগুলো আমার এখনও মনে আছে আমার, সাইফুলের দুজনেরই। এই ভদ্রতার আড়ালে একটি মানসিকতা কাজ করছে যে, নারীরা অথর্ব’ মেয়েটির এই ধাক্কার জের আমাদের বহন করতে হয়েছিল অনেকদিন।
আসল কথা হলো, সভ্যতার বিনির্মাণে কারো অবদানই কম নয়, দুজনেই একে অন্যের পরিপূরক। নারী পুরুষ উভয়েই সভ্যতা তৈরিতে অবদান রেখেছে বিপুলভাবে, এ নিয়ে কারোই কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। অধ্যায়টি শেষ করছি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতাটি থেকে অবিস্মরণীয় কিছু লাইন তুলে দিয়ে
‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর।
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।
…
জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নি বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
…
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি, কত বোন দিল সেবা
বীর স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী’।
…
সে যুগ হয়েছে বাসি
যে যুগে যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি!
“ভালোবাসা কারে কয়” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ