কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে। পুরুষের এক মহৎ প্রতিনিধি, রবীন্দ্রনাথ, বলেছেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!/পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি।‘ রোম্যানটিকের চোখে নারীমাত্রই দায়িতা বা মানসসুন্দরী, তাই তার চোখে পড়েছে শুধু নারীর চারপাশের বর্ণ, গন্ধ, ভূষণ, যাতে নারীকে সাজিয়েছে পুরুষ। নারীর জন্যে পুরুষসুলভ করুণা, এবং পুরুষ হওয়ার গর্বও তিনি বোধ করেছেন গভীরভাবে। পুরুষ প্রেম আর আলিঙ্গনেও ভুলতে পারে না সে প্ৰভু, নারীর স্রষ্টা। পুরুষের অহমিকা এখানে প্রকাশ পেয়েছে চমৎকারভাবে, নারীসৃষ্টিতে তিনি বিধাতার সাথে পুরুষের ভাগ দাবি করেছেন; এবং অস্বীকার করেছেন নারীর সম্পূর্ণ বাস্তবতাকে ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’ বলে। তার চোখে নারীর অর্ধেক তো কল্পনা বটেই, আর ওই মানবী টুকুও কল্পনা; অর্থাৎ নারী এক সম্পূর্ণ অবাস্তব সত্তা বা ভাব। তাঁর চোখে নারীর কোনো জৈব অস্তিত্ব নেই। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা নারী সৃষ্টি না করলেও নারী ধারণাটি পুরোপুরি পুরুষের সৃষ্টি : পুরুষ নারীকে নানা শব্দে শনাক্ত করেছে, নারীর সংজ্ঞা রচনা করেছে, সংজ্ঞার ভাব ব্যাখ্যা করেছে, নারীর অবস্থান নির্দেশ করেছে, নারীর জন্যে বিধি প্রণয়ন করেছে, এবং নিযুক্ত করেছে নিজের কামসঙ্গী ও পরিচারিকার পদে। পুরুষের চোখে নারী বিকৃত মানুষ, অসম্পূর্ণ সৃষ্টি, একরাশ বিকাবের সমষ্টি, এক আপেক্ষিক প্ৰাণী; অর্থাৎ নারীর অস্তিত্ব নিরপেক্ষ স্বায়ত্তশাসিত নয়, নারীকে নির্দেশ করা সম্ভব শুধু কোনো ধ্রুব সত্তার সাথে তুলনা করে। পুরুষ হচ্ছে ওই নিরপেক্ষ ধ্রুব সত্তা। পুরুষ নারীকে মানুষ হিশেবেই স্বীকার করে না। অধিকাংশ ভাষায় ‘মানুষ’ বা ‘মানুষজাতি’ বোঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হয় যে-সব শব্দ, সেগুলো ‘পুরুষ’ বোঝায়। ‘ম্যান’ বা ‘ম্যানকাইন্ড’ পুরুষবাচক; আর ‘ওম্যান’ বেশ নিন্দাসূচক। বাঙলায় ‘মানুষ’, ‘লোক’ পুরুষ বোঝায় না বলে মনে হ’তে পারে; কিন্তু ‘মেযেমানুষ’, ‘মেয়েলোক’ বললে বোঝা যায়। আপাতত লিঙ্গবাদী বাঙলা ভাষাও লিঙ্গবাদী, পুরুষতন্ত্রের প্রতাপ এতেও প্ৰচণ্ড। বাঙলায় ‘নারীবাচক’ সমস্ত শব্দই কদৰ্থক, বা নির্দেশ করে কামশোষণ। নারী, স্ত্রী, রমণী, ললনা, অঙ্গনা, কামিনী, বনিতা, মহিলা, বামা, নিতস্বিনী, সুন্দরী প্রভৃতি শব্দে কামঙ্গুধার দাগ স্পষ্ট ৷ ‘মেয়েমানুষ’, ‘মেয়েলোক’, ‘মেয়েছেলে’ বললে বোঝায় একটি স্ত্রীলিঙ্গ পশু। পুরুষতন্ত্র নারীর যে-ভাবমূর্তি তৈরি করেছে কয়েক সহস্রকের সাধনায়, তাতে ‘নারী’ বললে মানুষ বোঝায় না; বোঝায় একধরনের মানুষ, যা বিকৃত, বিকলাঙ্গ, অতিরিক্ত, বা না-পুরুষ।
নারী কাকে বলে? দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৩৫) বলেছেন, এর উত্তরে একধরনের পুরুষ বলে, ‘নারী হচ্ছে জরায়ু, ডিম্বকোষ; নারী হচ্ছে স্ত্রীলোক।‘ পুরুষ এমন অসংখ্য সংজ্ঞা দেয় নারীর, যার সবটাই নিন্দাসূচক। কোনো কোনো নারীকে দেখিয়ে তারা বলে, সে নারী নয় যদিও তার জরায়ু-স্তন-যোনি সবই রয়েছে। ওই নারীর মধ্যে তারা দেখতে পায় নারীত্বের অভাব, চিরন্তন নারীত্বের উনতা। তারা চায় নারী হবে নারী, থাকবে নারী, আর হয়ে উঠবে নারী। পুরুষ চায় শাশ্বতী নারী, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। চিরন্তনী বা শাশ্বতী হচ্ছে পুরুষের এক চিরকালীন চক্রান্ত বা ক্ষুধা। সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সামান্যাদের সোহাগ খরিদ ক’রে/চিরন্তনীর অভাব মেটাতে হবে’, তবে কোটি মন্বন্তরেও তিনি ভুলতে পারবেন না শাশ্বতীকে; পুরুষের কামনার সাথে না মিললে নারীমাত্রই পুরুষের কাছে সামান্যা : জরায়ু-যোনি-স্তনের সমষ্টি, নিজের লিঙ্গে ও যৌনতায় বন্দী পশু। পুরুষ ও স্ত্রী বা নর ও নারী ব্যাকরণে দুটি সুষম রূপ বোঝালেও জীবনে বোঝায় দুটি ভিন্ন মেরু। পুরুষ ও নারী নির্দেশ করে দ্বিমুখি বৈপরীত্য : পুরুষ বোঝায় সমস্ত সদর্থক বা অস্তিবাচক গুণ, আর নারী বোঝায় কদৰ্থক বা নঞর্থক বৈশিষ্ট্য। পুরুষ বোঝায় স্বাভাবিকত্ব, আদর্শ রূপ; নারী বোঝায় অস্বাভাবিকত্ব, বিকৃত রূপ। এলেন সিজো পুরুষ-নারীর দ্বিমুখি বৈপরীত্যের একটি তালিকা রচনা করেছেন, যাতে ধরা পড়েছে পুরুষ-নারী সম্পর্কে পিতৃতান্ত্রিক দ্বিমুখি চিন্তাধারা। তালিকাটি নিম্নরূপ [দ্র মোই (১৯৮৫, ১০৪)] :
পুরুষ — নারী
সক্রিয় : অক্রিয়
সূৰ্য : চন্দ্র
সংস্কৃতি : প্রকৃতি
দিন : রাত্রি
পিতা : মাতা
বুদ্ধি : আবেগ
বোধগম্য : দুবোধ্য, স্পর্শকাতর
বিশ্বনিয়ন্ত্ৰক : করুণ
এ-তালিকার দ্বিমুখি বৈশিষ্ট্যে ধরা পড়েছে পুরুষতন্ত্রের মূল্যবোধ। ওই বোধে পুরুষ সব সময় নির্দেশ করে মানুষের সদগুণগুলো, আর নারী নির্দেশ করে নঞর্থকগুলো। তালিকাটি আরো বাড়ানো যেতে পারে, এবং তাতেও দেখা যাবে পুরুষতন্ত্র যাকে ভালো মনে করে, অনেক সময়ই খামখেয়ালিভাবে, তাই হচ্ছে পুরুষের গুণ; আর যা কিছুকে ভালো মনে করে না, তাই নারীর বৈশিষ্ট্য। ‘পৌরুষ’ হচ্ছে মহাজাগতিক সদগুণের সমষ্টি, এর বিপরীত নারীত্ব হচ্ছে অনন্ত নঞর্থকতা। যে-কোনো সাধারণ অভিধানে, যে-কোনো ভাষায়, ‘পুরুষ’, ‘নারী’ বা ‘স্ত্রী’ অন্তর্ভুক্তিগুলো দেখলে বোঝা যায় পুরুষ কতো স্বর্গীয় আর নারী কতো নারকীয়। ‘পুরুষ’ হচ্ছে ‘নর, মনুষ্য, আত্মা, ঈশ্বর, পরমব্ৰহ্ম’, ‘পুরুষত্ব’ হচ্ছে ‘পৌরুষ, উদ্যম, তেজ, পুরুষের রতিশক্তি’। ‘নারী’ হচ্ছে ‘রমণী, স্ত্রীলোক, পত্নী’, ‘নারীধর্ম’ হচ্ছে ‘সতীত্ব মমতা বাৎসল্য প্রভৃতি নারীসুলভ গুণ’; ‘স্ত্রী’ হচ্ছে ‘পত্নী, জায়া, নারী, রমণী, বামা, কামিনী’, ‘স্ত্রীচরিত্র’ হচ্ছে ‘নারীজাতির প্রকৃতি বা স্বভাব’; ‘স্ত্রীধর্ম’ হচ্ছে ‘রজঃ, ঋতু, স্ত্রীলোকের কর্তব্য’ [দ্র শৈলেন্দ্র (১৯৬৪)]।
ইংরেজি ভাষা নারীপুরুষের দ্বিমেরুত্ব নির্দেশে আরো দক্ষ। ওয়েবস্টারের তৃতীয় নতুন আন্তর্জাতিক অভিধান (১৯৬৬) অনুসারে ‘manly’ হচ্ছে ‘having qualities appropriate to a man : not effeminate or timorous; bold, resolute, open in conduct or bearing’, ‘belonging or appropriate in character to a man’, ‘of undaunted courage: gallant, bold; একই অভিধানে ‘womanly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘marked by qualities characteristic of a woman’, ‘possessed of the character or behavior befitting a grown woman’, ‘characteristic of, belonging to, or suitable to a woman’s nature and attitudes rather than to a man’s’। র্যানডম হাউজের ইংরেজি ভাষার অভিধানে (১৯৬৭), ‘manly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘strong, brave, honorable, resolute, virile’ as ‘qualities usually considered desirable in a man’ আর ‘womanly’র অর্থ দেয়া হয়েছে ‘like or befitting a woman; feminine; not masculine or girlsh’, ‘in the manner of, or befitting, a woman’ [দ্র মিলার ও সুইফ্ট্ (১৯৭৬)]। এসব সংজ্ঞায় দেখা যায় পুরুষ বোঝায় মানুষের সব সদগুণ, আর নারী বোঝায় নঞর্থক বৈশিষ্ট্য। তাই পুরুষের সবচেয়ে বেশি অপমান বোধ হয় তাকে লম্পট, চোর, পশু, বদমাশ, গাধা-ধরনের কিছু বললে নয়, তাকে নারী বা মেয়েমানুষ বলা হ’লে।
পুরুষ শুধু নিজেকে নয়, নিজের দেহকেও মনে করে বিশুদ্ধ, উন্নত, আদর্শ কাঠামো; আর নারীদেহকে গণ্য করে বিকৃত, একধরনের প্রতিবন্ধকতা বা কারাগার, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘কুসুমের কারাগার’। ওই দেহের কোনো মাংসকৃত্তি তার কাছে বিশুদ্ধ বৃত্ত, কোনো ত্ৰিভূজ বিশুদ্ধ ত্রিভুজ, কোনো রন্ধ বিশুদ্ধ রন্ধ, কিন্তু তা কামনার সময়ে; উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর ওই দেহকে তার মনেহয় প্ৰতিবন্ধী। আরিস্তাতল বলেছেন, ‘নারী কিছু গুণের অভাব্যবশতই নারী; আমরা মনে করি নারীস্বভাব স্বাভাবিকভাবেই বিকারগ্রস্ত।‘ সন্ত টমাসের মতে, নারী হচ্ছে ‘বিকৃত পুরুষ’, ‘এক আকস্মিক সত্তা’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৫)]। ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলাম ধর্মে নারীসৃষ্টির যে-উপাখ্যান বলা হয়েছে, তাতে নারীশরীর হয়ে উঠেছে পুরুষশরীরেব একটি ‘অতিরিক্ত অস্থি’র পুনর্বিন্যাস। তাই তার দেহ পুরুষের কামনা জাগালেও শুরু থেকেই নিন্দিত। বাইবেলের আদিপুস্তক-এ নারীসৃষ্টির বিজ্ঞানটুকু এমন : সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ঘোর নিদ্রায় মগ্ন করিলে তিনি নিদ্রিত হইলেন; আর তিনি তাহার একখান পঞ্জর লইয়া মাংস দ্বারা সেই স্থান পূরাইলেন। সদাপ্ৰভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করিলেন ও তাঁহাকে আদমের নিকটে আনিলেন। তখন আদম কহিলেন, এবার হইয়াছে; ইনি আমার অস্থির অস্থি ও মাংসের মাংস; ইঁহার নাম নারী হইবে, কেননা ইনি নর হইতে গৃহীত হইয়াছেন।‘ নিজের শরীরের জন্যে নারী ঋণী পুরুষের কাছে, আর যে-হাড়ে সে গঠিত ব’লে কথিত, তাও অপরিহার্য, সম্মানজনক নয়। পুরুষ নারীমূর্তি তৈরি করেছে নিজের কল্পনার বক্র হাড়ে, এবং যুগ যুগ ধ’রে তার নিন্দা করছে। একটি হাদিসে আছে : স্ত্রীগণকে সদুপদেশ দাও, কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তারা সৃষ্ট। পাঁজরের হাড়ের মধ্যে ওপরের হাড় সর্বাপেক্ষা বাঁকা–যদি ওকে সোজা করতে যাও তবে ও ভেঙ্গে যাবে, যদি ছেড়ে দাও তবে আরো বাঁকা হবে।’ [দ্র রফিকউল্লাহ (১৯৭৯, ১৮২)]। প্রতিটি ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানের চেতনায় নারী হচ্ছে একটি অশীল বক্র হাড়। বলা হয়ে থাকে যে হাওয়া বা ইভ মানবজাতির মাতা, কিন্তু ধর্মগ্রন্থেও–যেহেতু এগুলো পুরুষতন্ত্রেরই অনুশাসন বই–থাকে মারাত্মক স্ববিরোধিতা। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানের ধর্মগ্রন্থে হাওয়া বা ইভের আগেই আদমকে তৈবি ক’রে উল্টে দেয়া হয়েছে মানুষজন্মের স্বাভাবিক রীতি; নারীকে জন্ম দেয়া হয়েছে পুরুষের দেহ থেকে, অর্থাৎ পুরুষই হয়ে উঠেছে নারীজাতির মাতা! হাওয়া বা ইভের ধারণাটির উৎপত্তি হয়েছে আদি-বাইবেলেরও আগে, ইহুদিদের প্রাচীন পুরাণে। ইহুদিদের প্রাচীন পুরাণ অনুসারে বিধাতা আদমের জন্যে একটি ‘সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপুণা, পতিপরায়ণা, সতীসাধ্বী’ ভাৰ্য্য সৃষ্টির জন্যে তিন-তিনবার উদ্যোগ নেয়; এবং প্রতিবারই কোনো-না-কোনো বিপত্তি ঘটে। আদমের প্রথম ভাৰ্যার নাম লিলিথ, এমন এক করালী নারী যার ওপর আরোহণের সাধ্য নেই কোনো পুরুষের। আদমের সাথে তার একেবারেই মিল হয় নি, কেননা লিলিথ সঙ্গমের সময় আদমের নিচে শুতে রাজি হয় নি। তার যুক্তি ছিলো, সে আর আদম দুজনেই ধুলোয় তৈরি, তাই সমান; সুতরাং সে কেনো আদমের নিচে শোবে? উত্তেজিত আদম তাকে ধর্ষণেব চেষ্টা করলে সে মন্ত্র উচ্চারণ করে হাওয়ায় মিশে যায়। এরপর বিধাতা আদমের দ্বিতীয় ভার্যা (প্রথম হাওয়া) তৈরি করা শুরু করে। কিন্তু আকস্মিকভাবে আদম ওই সৃষ্টিপ্রক্রিয়া দেখে ফেলে, এবং সৃষ্টির দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ঘেন্না বোধ করে। এতে বিধাতা প্ৰথম হাওয়াকে নিরুদ্দেশ করে ফেলে, এবং আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করে দ্বিতীয় হাওয়াকে যে এখন বিখ্যাত [দ্রা ফিজেস (১৯৭০, ২৭)]। পৃথিবীর তিনটি প্রধান পিতৃতন্ত্রের বদ্ধমূল কুসংস্কার হচ্ছে যে নারী বিকলাঙ্গ, পুরুষের অতিরিক্ত অস্থিতে নির্মিত।
পুরোনো কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের রূপ দিয়েছেন আদিম পিতৃতন্ত্রের এক প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী উত্তরপুরুষ। তার নাম সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তিনি অর্জন করেছেন আধুনিক কালের অন্যতম স্রষ্টার মহিমা; উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নিজের সমস্ত কালো কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে উপস্থিত করেছেন তিনি, তাই তাঁকে কেউ হেসে উড়িয়ে দিতে পারে নি, বরং কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক রূপ দেখে শান্তি বোধ করেছে। ফ্রয়েডের মতে, নারী হচ্ছে এমন মানুষ যার কোনো একটি প্রত্যঙ্গ হারিয়ে গেছে। একে তিনি বলেছেন ‘খোজাগূঢ়ৈষা’। কোন মহান প্রত্যঙ্গটি হারিয়েছে? নারী হারিয়ে ফেলেছে তার ‘শিশ্ন’। প্রায় সব আদিম সমাজই শিশ্নের মহিমায় বিশ্বাস করে; পুরুষের শিশ্ন তাদের চোখে লাঙ্গল, যা কর্ষণ করে, আর নারীর যোনি হচ্ছে জমিতে লাঙলের দাগ। সংস্কৃতে ‘লাঙ্গল’ আর ‘লিঙ্গ’ একই ধাতু থেকে উৎপন্ন শব্দ। ‘সীতা’ ও ‘রাম’-এর মতো পবিত্ৰ শব্দও আসলে যোনি ও লিঙ্গের ধারণা বহন করে। ‘সীতা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘হলরেখা’ বা ‘লাঙ্গলের ফলার দাগ’, আর ‘রাম’ শব্দটি এসেছে ‘রম’ ধাতু থেকে, যার এক অর্থ ‘চাষ করা, কর্ষণ করা’, ও আরেক অর্থ ‘রমণ’ [ দ্র নরেন্দ্রনাথ (১৯৭৫, ১০০, ১১০)]। তাই আদিম কাল থেকেই পুরুষের চোখে লিঙ্গই সম্রাট। পুরুষের বড়ো গৌরবের ধন তার দু-উরুর মধ্যস্থলে আন্দোলিত প্রত্যঙ্গটি, যার সাহায্যে সে পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করে আসছে। সে রাজা, ওটি তার রাজদণ্ড। নারী যেহেতু হারিয়ে ফেলেছে রাজদণ্ড, তাই ফ্রয়েডের মতে নারীস্বভাবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘শিশ্নাসূয়া’; অৰ্থাৎ নারীর জীবন কাটে নিরন্তর পুরুষাঙ্গটিকে ঈর্ষা করে। শিশ্নাসূয়া ধারণার মধ্য দিয়ে আদিম বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানরূপে। ফ্রয়েড যাকে নির্দেশ করেছিলেন নারীর শাশ্বত বৈশিষ্ট্য ব’লে, সে-খোজাগূঢ়ৈষার উৎপত্তি তাঁর ধর্মীয় কুসংস্কারে, এবং ভিয়েনায় তিনি যে-রোগিনীদের চিকিৎসা করতেন, তাদের পারিবারিক-সামাজিক জীবনে। ফ্রয়েড নারীর যে-সব বৈশিষ্ট্যকে জৈবিক, সহজাত ও শাশ্বত ব’লে স্থির করেছিলেন, সেগুলো মূলত বিশেষ সাংস্কৃতিক কারণের পরিণতি। ‘শিশ্নাসূয়া’ বলতে তিনি যা বুঝতেন, তা হচ্ছে পুরুষ-অসূয়া । পুরুষ যে-সব সুযোগসুবিধা ভোগ করে, তাতে পুরুষকে ঈর্ষা করা স্বাভাবিক; কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে নারী ঈর্ষা করে পুরুষের নির্বোধ প্রত্যঙ্গটিকে । রোকেয়া, বাঙলার একমাত্র শুদ্ধ নারীবাদী, নানা রচনায় পুরুষকে আক্রমণ করেছেন, দাবি করেছেন পুরুষের সমান অধিকার । ফ্রয়েড তাকে পেলে সুখী বোধ করতেন; এবং শনাক্ত কবতেন একজন শিশ্নাসূয়াগ্ৰস্ত রোগিণীরূপে! যা বোঝেন নি বৈজ্ঞানিক, তা ঠিকমতো বুঝেছিলেন রোকেয়া (১৯৭৩, ২৯, পাদটীকা) : ‘আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষদের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ।’ ফ্রয়েডের খোজা গূঢ়ৈষা ও শিশ্নাসূয়া ধারণা দুটির উদ্ভব ঘটেছে। এ-বিশ্বাস থেকে যে নারী পুরুষের থেকে জৈবিকভাবে নিকৃষ্ট । তিনি পুরোনো কুসংস্কারকে পরিণত করেছেন আধুনিক অপবিজ্ঞানে। নারীকে ক’রে তুলেছেন নিজেরই শরীরের শিকার। জিহোভার মতো বলেছেন, ‘অ্যানাটমি ইজ হার ডেস্টিনি–শরীরই তার নিয়তি ।’ কুসংস্কার ও বিজ্ঞানের প্রতিভাবান এ-মিশ্রণকারী যে নারীকে বোঝেন নি, তা স্বীকার করেছেন নিজেই; বলেছেন, ‘নারী-আত্মা সম্পর্কে আমার তিরিশ বছরের গবেষণা সত্ত্বেও একটি মহাপ্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি নি; প্রশ্নটি হচ্ছে নারী কী চায়?’
যে-পুরুষতন্ত্র নারীকে সৃষ্টি করেছে, নির্দেশ করেছে প্রতিবন্ধীরূপে, তাকে যে সে কোনো মূল্য দেবে না, বিবেচনা করবে না স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে, তা অবধারিত। তাই পুরুষ নারীকে সংজ্ঞায়িত করেছে, নারীর অবস্থান নির্দেশ করেছে নিজেকে মানদণ্ড ক’রে। পুরুষ ধ্রুব, নারী আপেক্ষিক। মিশলে বলেছেন, ‘নারী, এক আপেক্ষিক সত্তা।‘ পুরুষের মতে, পুরুষ নারীকে ছাড়াই ভাবতে পারে নিজের কথা; কিন্তু নারী পারে না পুরুষকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে। তাই নারী হচ্ছে তা, পুরুষ তাকে যা মনে করে : পুরুষ তাকে মনে করে যৌনসামগ্ৰী। পুরুষের কাছে নারী হচ্ছে যোনি, যৌনবস্তু, কামের পরিতৃপ্তি; এর বেশি নয়, কম নয়। পুরুষ নারীকে নির্দেশ করে, নারীর স্বাতন্ত্র্য বোঝায় নিজের সাথে তুলনা ক’রে । পুরুষ হচ্ছে অনিবাৰ্য, অপরিহার্য, অবধারিত; আর নারী হচ্ছে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, সংখ্যাতিরিক্ত [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৬)]। নারী যে মানুষ, কোনো কিছুর সম্পর্কে না এসেও তার একটি নিজস্ব সত্তা আছে, এটা পুরুষতন্ত্র স্বীকার করে নি। নারীর মূল্য তার মাংসের জন্যে, তার ভূমিকার জন্যে-স্ত্রী, মাতা, দাসী হিশেবে; এর বেশি নয়। সারা এলিস লিখেছেন, ‘তারা (নারীরা) তাদের গঠনে ও পৃথিবীতে তাদের অবস্থান অনুসারে আপেক্ষিক প্রাণী’ [দ্র বাঙ্ক (১৯৭৪, ৫)]। নারীর মাংস চিরকালই পুরুষের কাছে সবচেয়ে সুস্বাদু; বাঙলার রাধা চিৎকার করেছে, ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’; আর বিলেতের রাজকবি টেনিসন পুরুষের সমস্ত ক্ষুধায় উত্তেজিত হয়ে লিখেছেন, ‘পুরুষ শিকারী, নারী শিকার’ [দি প্রিন্সেস, ১৮৪৭]। তাই পুরুষ অন্য যা-কিছু হতে প্ৰস্তুত, শুধু নারী ছাড়া।
পুরুষ গৌরব বোধ করে যে সে পুরুষ, কারণ সে সব কিছুর প্রভু। অন্ধ, বিকলাঙ্গ, নির্বোধ পুরুষও অধিষ্ঠিত শ্রেষ্ঠ নারীর ওপরে; একটি অন্ধ বিকল নির্বোধি পুরুষও অসহায় ক’রে তুলতে পারে শ্রেষ্ঠ নারীকে। ইহুদিরা ভোরবেলা প্রার্থনা করে, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, যেহেতু তিনি আমাকে নারী করেন নি’; আর একই সময় তাদের নারীরা কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলে, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে তাঁর নিজের ইচ্ছানুসারে সৃষ্টি করেছেন।‘ প্লাতো দু-কারণে তাঁর দেবতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন; প্রথমত তারা তাকে স্বাধীন মানুষ করেছে, ক্রীতদাস করে নি; দ্বিতীয়ত তাঁকে পুরুষ করেছে, নারী করে নি। কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কতা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এ জন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে’ [ দ্র ৪ : ৩৪]। পুরুষ তার সুবিধা শান্তির সাথে ভোগ করার জন্যে দিয়েছে তাকে শাশ্বত ধ্রুব ভিত্তি; তারা তাদের প্রাধান্যকে পরিণত করেছে ঐশী অধিকারে। শুধু পার্থিব পুরুষের শক্তিতে তারা সন্তুষ্ট থাকে নি, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আবিষ্কার করেছে ও কাজে লাগিয়েছে অলৌকিক পরমপুরুষকে। পুরুষেরা বিধান প্রণয়ন করেছে, তাতে একচেট সুবিধা দেয়া হয়েছে পুরুষকে; তারপর তারা নিজেদের বানানো বিধানকে উন্নীত করেছে চিরন্তন নীতিমালায়। তারা মুখর হয়েছে নারীনিন্দায়। তারতুলিয়ান লিখেছেন, ‘নারী, তুমি শয়তানের দ্বার। তুমি তাঁকে বিপথগামী করেছে যাকে শয়তানও সরাসরি আক্রমণের সাহস করে নি। তোমার কারণেই ঈশ্বরের পুত্রকে মরতে হয়েছে; তুমি সব সময় শোকাকুল ও ছিন্নবস্ত্রে থাকবে।‘ সন্ত জন ক্রাইসোসটম বলেছেন, ‘সমস্ত বর্বর পশুর মধ্যেও নারীর মতো ক্ষতিকর আর কিছু নেই।‘ হাদিসে আছে : ‘নারীর চেয়ে ক্ষতিকর কোনো দুৰ্যোগ আমি রেখে যাচ্ছি না’ [দ্র হিউয়েজ (১৮৮৫)] বা ‘পুরুষের পক্ষে নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রাখিয়া যাইতেছি না।’ [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ১৮৭)]। কোৎ বলেছেন, নারীত্ব হচ্ছে ‘প্রলম্বিত শৈশব’, যা নারীর মনকে দুর্বল করে রেখেছে। বালজাক লিখেছেন, ‘নারীর নিয়তি ও পরম গৌরব হচ্ছে পুরুষের হৃদয়ে স্পন্দন জাগানো…নারী অস্থাবর সম্পত্তি এবং ঠিকমতো বলতে গেলে নারী হচ্ছে পুরুষের সহায়ক।‘ তিনি আরো বলেছেন, ‘বিবাহিত নারী হচ্ছে ক্রীতদাসী, যাকে সিংহাসনে বসিয়ে রাখতে হবে’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৪২)]। খুব কম নারীকেই পুরুষ সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছে, কিন্তু দাসী ক’রে রেখেছে সবাইকে। এমনকি ক্ষমতাশালী রানীরাও তাদের স্বামীদের কাছে পরিচারিকার মতোই আচরণ করেছে, যেমন রানী ভিক্টোরিয়া। নারীদের মধ্যে কোনো দান্তে নেই, শেক্সপিয়র নেই, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ নেই, নিউটন-আইনস্টাইন নেই, ভিঞ্চি-পিকাসো নেই, প্লাতো-আরিস্ততল-মার্ক্স নেই, কোনো প্রেরিতপুরুষ তো নেই-ই; কিন্তু সত্য হচ্ছে পুরুষদের মধ্যেও এঁদের মানের লোক বেশি নেই; এবং প্রশ্ন হচ্ছে থাকবে কী করে? নারীরা আজো পুরুষদের থেকে নিকৃষ্ট; এর কারণ এ নয় যে তারা সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট, এর কারণ তাদের নিকৃষ্ট হয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের পরিস্থিতিই তাদের নিকৃষ্ট করে রেখেছে। শূদ্ৰদের ক’রে রাখা হয়েছে শূদ্ৰ, তাদের বাধ্য করা হয়েছে নিম্নবৃত্তিতে; কিন্তু এ থেকে সিদ্ধান্তে পোঁছানো যায় না যে শূদ্ররা শুধু নিম্নবৃত্তিরই উপযুক্ত। নারীকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বলা যায় না নারী অশিক্ষিত; তাকে বিজ্ঞান থেকে বহিষ্কার ক’রে বলা যায় না নারী বিজ্ঞানের অনুপযুক্ত। তাকে শাসনকার্য থেকে নির্বাসিত ক’রে বলা যায় না নারী শাসনের যোগ্যতাহীন। নারীর কোনো সহজাত অযোগ্যতা নেই, তার সমস্ত অযোগ্যতাই পরিস্থিতিগত, যা পুরুষের সৃষ্টি বা সুপরিকল্পিত এক রাজনীতিক ষড়যন্ত্র।
“নারী” উপন্যাস বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ পিতৃতন্ত্রের খড়গঃ আইন বা বিধিবিধান
♦ নারীর শত্রু মিত্রঃ রুশো, রাসকিন, রবীন্দ্রনাথ, এবং জন স্টুয়ার্ট মিল
♦ ফ্রয়েডীয় কুসংস্কার, ও মনোবিশ্লেষণাত্মক-সমাজবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা
♦ মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটঃ অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু
♦ রামমোহন ও বিদ্যাসাগরঃ প্রাণদাতা ও জীবনদাতা
♦ পুরুষতন্ত্র ও রোকেয়ার নারীবাদ
♦ বঙ্গীয় ভদ্রমহিলাঃ উন্নত জাতের নারী উৎপাদন
♦ নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা
♦ নারীদের নারীরাঃ নারীদের উপন্যাসে নারীভাবমূর্তি