বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই একটা ভবিষ্যদ্বাণী যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। ব্রিজওয়াটার-এর প্যাট সেন্ট জন ভবিষ্যদ্বাণী করেন ১৯৭৯-এর ২২ জুলাই স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ৫৬ মিনিটে নায়াগ্রা জলপ্রপাত ভেঙ্গে পড়বে। সংবাদটিকে গুরুত্ব দিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার তরফ থেকে সাংবাদিক ও ফোটোগ্রাফাররা এসে হাজির হয়েছিলেন। ঘটনাকে সেলুলয়েডে বন্দি করতে হাজির ছিল বিভিন্ন টিভি কোম্পানী। ভবিষ্যদ্বাণীর খবরটি টেলিভিশন মারফত প্রচারিত হওয়ায় শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের মধ্যেই যথেষ্ট ঔৎসুক্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল।
ঘটনার দিন বিকেলের আগেই নায়াগ্রা নদীর জেটিতে এসে হাজির হলেন ‘দি হিউম্যানিস্ট’ পত্রিকার সম্পাদক পল কুরৎজ। তারপর এঁরা যা করলেন তা দেখে উপস্থিত হাজার-হাজার দর্শক, সাংবাদিক ও টিভি-র লোকেরা হতভম্ব। পল কুরুৎজ এবং কিছু মান্যষ উঠলেন স্টিমারে। ভয়ঙ্কর মুহূর্তে কি ওঁরা ‘মেড অফ দ্যা মিস্ট’ স্টিমারে চেপে নায়াগ্রা নদীতে ভ্রমণ করতে চান। এ তো চূড়ান্ত পাগলামো! নায়াগ্রা জলপ্রপাত ভাঙ্গলে নায়াগ্রা নদীর অবস্থা যে কি হবে তা কি বুঝতে পারছেন না, একজন বুদ্ধিজীবী দুঁদে সম্পাদক কুরুৎজ!
কুরুৎজ-এর এই কান্ড-কারখানার ছবিও উঠলো। এক সাংবাদিক তো কুরুৎজ-কে স্টিমারে ওঠার আগেই জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, “আপনার এই ধরনের হঠকারী ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্তের কারণ কি?”
কুরুৎজ উত্তর দিয়েছিলেন, “সিদ্ধান্তটা হঠকারী নয়, বরং বলতে পারেন যুক্তিবাদী সিদ্ধান্ত। আর বিপজ্জনক বলছেন? কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারবেন, আপনার এই কথাগুলো কত ভুল।“
কুরুৎজ-এর সিদ্ধান্ত এবং যুক্তিবাদী বিচার শক্তি শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়েছিল। সেন্ট জনের ভবিষ্যদ্বাণী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছিল।
আমার এক পরিচিত তরুণ এবং আমার এককালের সহকর্মী, নাম ধরে নেওয়া যাক রঞ্জন, একবার তাঁর দুর্বলতম মুহূর্তে আমাকে বলল তাঁর স্ত্রীর চরিত্রে একটু গণ্ডগোল আছে। মাত্র বছর তিনেক হল বিয়ে হয়েছে। একটি দেড় বছরের ছোট্ট সুন্দর মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “এই ধারণার পিছনে কি কারণ রয়েছে?”
রঞ্জন বলল, “সেদিন অফিসে কাজ করছি, হঠাৎ আমার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় আমাকে জানিয়ে দিল বাড়িতে আমার স্ত্রী কোনও পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে গল্প-সল্প করছে। শরীর খারাপ লাগার অজুহাতে আমার কাজ পাশের টেবিলের বন্ধুর ওপর চাপিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। বাড়ি গিয়ে দেখি আমার স্ত্রীর দূর-সম্পর্কের এক ভাই এসেছে। ওরা দুটিতে গল্প-সল্প করছে।“
রঞ্জনের বইয়ে হয়েছিল ওর চেয়ে যথেষ্ট অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ের সঙ্গে। বিয়ের আগে রঞ্জনের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিয়ের পরেও তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। এইজন্যে নিজের মনের মধ্যে একটা পাপবোধ জন্মেছিল। অবচেতন মনে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিত, বউও নিশ্চয়ই ধোয়া তুলসীপাতা রঞ্জন অসময়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে পরীক্ষা করতে চেয়েছে। শেষদিন স্ত্রীকে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে গল্প করতে দেখে মনের ভেতরে এক ধরনের সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছে –আমার স্ত্রীর চরিত্রও তবে আমারই মতো একটু গোলমেলে।
ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয়ের সাড়া পেয়ে বেশ কয়েকবার বাড়ি গিয়ে ব্যর্থতার পর একবার রঞ্জনের সফলতা (?) সত্যিই ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয়ের প্রমাণ কি? ভবিষ্যৎ দৃষ্টির প্রমাণ কি?
আমি তখন স্কুলে পড়ি। দিদিমা এলেন আমাদের খড়্গপুরের রেল-কোয়ার্টারে কিছু দিনের জন্য বেড়াতে। ফর্সা, ছোট-খাটো চেহারা। রাতে পড়াশুনোর পাঠ চুকলে আমরা ভাই-বোনেরা দিদিমার কাছে গোল হয়ে বসে গল্প শুনতাম। দিবানিদ্রার অভ্যেস ছিল দিদিমার। একদিন দুপুরে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। স্বপ্ন দেখেছিলেন, একজন দীর্ঘদেহী লোক দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দিদিমা বার-বারই লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, “কে তুমি? কি চাই?” লোকটা কোনও উত্তর দেয়নি। লোকটার মুখটাও ভালোমতো দেখতে পাননি দিদিমা।
সেদিন রাতেই বাবা কলকাতা থেকে খবর আনলেন আমার মামীমার কাকা পূর্ণচন্দ্র দাশ (ত্রিকোণ পার্কে যার একটি মূর্তি ও কলকাতায় যার নামে একটি রাস্তা আছে) খুন হয়েছেন। দিদিমা খবর শুনে কাঁদলেন। বললেন, “ওঁর আত্মাই আমাকে দেখা দিয়ে গেল।“ বাড়ির বড়রা বললেন, “কত দূরের ঘটনা এখান থেকেই উনি বুঝতে পেরেছিলেন। একেই বলে টেলিপ্যাথি।“
কিন্তু, দিদিমা কখন পূর্ণ দাশকে দেখলেন? কখনোই বা পূর্ণ দাশের মৃত্যু বুঝতে পারলেন? স্বপ্নে দেখলেন, একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার কাছে পূর্ণ দাশের মৃত্যুর খবর শোনার পর সকলেই যা হোক একটা জোড়াতালি দেওয়া যুক্তি খাড়া করে দুটি ঘটনাকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে গোটা ব্যাপারটায় একটা অলৌকিক চেহারা দিতে চাইলেন। আসলে সকলেই সুযোগ পেলে একটা অলৌকিক কিছু দেখতে চান।
এমনি করে, একান্তভাবে অলৌকিক কিছু দেখতে চাওয়ার ইচ্ছে বা নিজেকে ভবিষ্যৎ অধিকারী বলে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করার জন্যেই অনেক সময় মানুষ জোড়াতালি দিয়ে চিন্তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে।