তোমাকে দেখি নি, তোমার লাশও দেখি নি; দশ বছর ধ’রে তোমার একরাশ শক্ত সমর্থ স্বাধীন অস্থি বাঙলার কোনো ঠাণ্ডা নদীর অতলে, শহরের কংক্রিটের নিচে, সবুজ পল্লীর পলিমাটির আশ্রয়ে, কোনো অরণ্যের লতাগুল্মশেকড়ের সাথে জড়াজড়ি ক’রে শান্তি পাচ্ছে। তোমার একটি নাম ছিলো, যা সুর হয়ে বেজে উঠতো বোনের, মায়ের, পাশের বাড়ির তরুণীটির কণ্ঠে; কিন্তু এখন, দশ বছর ধ’রে যে শুধু নিহত অস্থি হয়ে আছো, তোমার কোন নাম নেই; পরিচয়ও ছিলো তোমার, যে-কোনো সম্রাটের পরিচয়ের চেয়েও যা সম্ভ্রান্ত, কিন্তু এখন, দশ বছর ধ’রে যে শুধু কালছেঁড়া চিৎকার হয়ে আছো, তোমার কোনো পরিচয় নেই। তোমার কাছে ক্ষমাপ্রাথর্না করি, ক্ষমা চাই। হয়তো তুমি রাড়িখাল, কণকসার, কদমতলি, বাঘরা বা এমন হাজার হাজার সবুজ নামের এক গ্রামে শক্ত মুঠোয় ধ’রে ছিলে লাঙল, তোমার স্বপ্নে ছিলো সোনার গুচ্ছের মতো ধান, সামনে পেছনে ছড়ানো ছিলো পলিমাটির মাঠ; এমন সময় ডাক এসেছিলো, তুমি শুনেছিলে। তুমি হয়তো কোনো পাটকলে বা ঢালাই কারখানায় কলকব্জার সাথে জীবন যাপনে লিপ্ত ছিলে, এমন সময় ডাক শুনে তুমি সাড়া দিয়েছিলে। তুমি হয়তো যাচ্ছিলে ইস্কুলে, মহাবিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমন সময় আহ্বান এসেছিলো। হয়তো তুমি শহরের চৌরাস্তার পাশে ক্লান্ত শুয়েছিলে তোমার ঠেলাগাড়ি, বা রঙিন রিকশার পাশে, এমন সময় তীব্র চীৎকারে জেগে উঠে দেখেছিলে তোমার হাতে আশ্চর্য রাইফেল। বা তুমি ছিলে একান্ত কর্মহীন বেকার, যেহেতু দেশ তোমাকে কোনো কাজ দেয় নি, ছিলে জীবন ধারণের দুঃস্বপ্নে পরাক্রম শত্রুর সাথে দ্বন্দ্বরত, অথচ নিষ্ক্রিয়, এমন সময় দেখলে তোমার সামনে উপস্থিত দেশ, তাকে বাঁচানোর দায়িত্ব।
তোমার চুল কি মার্চ মাস থেকেই অমন লম্বা ছিলো; পেশি ছিলো অমন পাথরের মতো শক্ত, ইস্পাতের মতো ধার? কেমনে তুমি এতো অল্প দিনে অর্জন করেছিলে দ্রুতগতি, আকিস্মক ছুটে এসে অতো দ্রুত শত্রুকে ছিন্নভিন্ন করার কৌশল আয়ত্ত করেছিলে তুমি কেমনে? তুমি কি প্রথম থেকেই জানতে তোমার শক্তির কাছে সহজেই মুষড়ে পড়বে চীন-আমেরিকার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল; তুমি কি জানতে অস্ত্রভারাক্রান্ত শত্রুরা জানে শুধু খুন আর আত্মসমর্পণ? তুমি হয়তো সবই জানতে মনে মনে, নইলে প্রায় অসহায় তুমি এমন উদ্ধত ভঙ্গিতে কী ক’রে দাঁড়াতে পারলে অন্ধকারের হিংস্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে? তোমাকে দেখি নি আমি, ভীরু আমি, কিন্তু এখন, তোমাকে দেখছি আমি : তুমি, বটের বহুমুখি শেকড়ের মতো পা ঢুকিয়ে দিয়েছো বাঙলার পলিমাটির ভেতরে, তোমার মাথা মেঘলোক ভেদ ক’রে উঠে গেছে, উপকথার শত্রুঘ্নের অস্ত্রের মতো গর্জে উঠছে তোমার দিগন্ত-থেকে-দিগন্তে ঠেকা রাইফেল। তুমি আমার কল্লোলোকে একমাত্র বীর, পৃথিবীতে তোমার আগে আর তোমার পরে কোনো বীর নেই। তুমি আমার চিরোজ্জ্বল বীর।
কিন্তু তোমাকে আমি কোনো উপাধি দেবো না, কোনো শিরোপা তোমাকে মানায় না; তোমার বুকে বা শিরে ওগুলোকে ফেলনা রাংতার মতো মনে হয়। ওগুলো তাদেরই দরকার, যারা বিক্রি করতে চায় নিজেদের, ঘরে তুলতে চায় রাশিরাশি সোনারূপো। তুমি কিছুই চাও না। তুমি বীরোত্তম বা বীরবিক্রম নও, তার চেয়ে অনেক বড়ো তুমি, ত্যাগোত্তম মহত্তম। তাই তোমার কোনো উপাধিশিরোপা নেই, বুকেবাহুতে তারা বা তলোয়ার নেই, তোমার কোনো চিহ্নিত সমাধি নেই। সারা বাঙলাই তোমার সমাধি, যে-কোনো ফুল ফোটে এ-চরাচরে, তা তোমার জন্যেই, যে-কোনো ফুল বাতাসের ছোঁয়ায় ঝরে, তা তোমার সমাধির ওপরেই ঝ’রে পড়ে। তোমাকে আমি শহীদও বলি নি, বলেছি নিহত; কেননা তুমি সত্য চেয়েছিলে, আমিও চাই; আমি জানি ওই বিদেশি শব্দটি তোমাকে এমন কোনো মহিমা দিতে পারে না। অজস্র ঘাতক ইস্পাত ও বারুদ তোমার বুকের পেশিতে যখন ঢুকেছিলো, রক্তক্ষরিত হচ্ছিলো তোমার সমস্ত শিরাউপশিরা থেকে, তখন তুমি কোনো উপাধি চাও নি, সিংহাসন চাও নি; তুমি শুধু বাঙলার মাটিদুর্বাকে আরো ব্যগ্র আঙুলে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলে। কোনো সেবিকা আসে নি তোমাকে চিকিৎসা করার জন্যে, আসে নি হেলিকপ্টার, স্ট্রেচার। তুমি নামহীন এলাকায় পরিচয়হীন প’ড়ে ছিলে। তোমাকে সবাই ভুলে গেছে। তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাই। কয়েকটি কথা আমি তোমার কাছে জানতে চাই : তুমি কেনো মুক্তি চেয়েছিলে, যুদ্ধে গিয়েছিলে? যে-হাতে ধরতে লাঙল, রিকশার হ্যাঁন্ডেল, কলম, বই, ঠেলাগাড়ির চাকা, স্ত্রী ও প্রেমিকার হাত, কেনো তাতে তুলে নিয়েছিলে স্টেন? অস্ত্র তোমার দরকার হয়েছিলো কেনো? তোমার কি একটা গাঢ় স্বপ্ন ছিলো, আদর্শ ছিলো, লক্ষ্য ছিলো? স্বাধীনতা দরকার ছিলো তোমার, অথচ তোমার তা ছিলো না? তুমি কি একটা অত্যন্ত নিজস্ব দেশ, বিশেষ রকমের সমাজ চেয়েছিলে, যা ছিলো না বর্বর পাকিস্তানে? তুমি যে অত্যন্ত আবেগে ‘জয় বাঙলা’, ‘সোনার বাঙলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে উঠতে, তা কি ছিলো শুধুই সংক্রামক, না তা তোমার বুক থেকে আপনি উঠে আসততা, যেমন বীজ থেকে আপনি উদগত হয় উদ্ভিদ? তুমি কি ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল এলাকাকে শুধু একটি নতুন নাম পরিয়ে দিয়েছিলে, না তাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে চেয়েছিলে? তোমার স্বপ্ন ছিলো, আদর্শ ছিলো, তুমি নতুন সমাজ চেয়েছিলে বাঙলায়, আর ওই কামনাই তোমাকে পরিণত করেছে রক্তমাংসহীন অস্থিতে; বাঙলার মাটিতে তুমি নামহীন পরিচয়হীন প’ড়ে আছো। তুমি স্বাধীনতা দেখো নি, একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর আসার বেশ আগেই তুমি বিগত স্বপ্ন হয়ে গেছো। তুমি কোনো দিন জানবে না বাঙলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন আর খাকি ঘাতকদের অস্ত্র কোলাহল করে না বাঙলার গ্রাম খাল বস্তি শহরে। কিন্তু তুমি যে তোমার জীবন শুরু হ’তে-না-হ’তেই বিলিয়ে দিলে, ভাবলে তোমার রক্তে পরিস্রুত হবে দেশ, তা কি হয়েছে? আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই; প্রার্থনা করি তোমার ক্ষমা, কেননা তোমার রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশ তোমার পথে চলে নি। মুক্তিযোদ্ধা, তুমি কি অপচয়ের অন্য নাম?
মৃত্যুই সব কিছুর সমাপ্তি; তাই তোমার এখন দৃষ্টি নেই, বাঙলার অবস্থা তোমার চোখে তুমি আর দেখতে পাবে না। তবু যদি দেখতে পাও, তবে কি বেশ প্রফুল্ল বোধ করবে এ ভেবে যে তোমার রক্ত অকাজেই তুমি নষ্ট করো নি? এখন চারদিকে তোমার বিরুদ্ধে শত্রুতা, যেমন ছিলো একাত্তরে; কিন্তু একাত্তরে তুমি জয়ী হয়েছিলে, কিন্তু তারপরেই শুরু হয় তোমার পরাজয়। বাঙলার প্রান্তেপ্রান্তে এখন পরাভূত তুমি, তোমার স্বপ্ন এখন হাস্যকর বস্তু। যে-শ্লোগানে তুমি পেশিতে তেজ পেতে, তা এখন প্রায় নিষিদ্ধ; যে-সঙ্গীতকে তুমি আত্মার চেয়ে ভালোবেসেছিলে, তার বিরুদ্ধে এখন প্রাসাদে প্রাসাদে চক্রান্ত। আমি জানি তুমি কোনো বিশেষ দলের ছিলে না, ছিলে বাঙলার; কিন্তু এখন একান্তভাবে বাঙলার থাকাটা নিরাপদ নয়। চারদিকে জেগে উঠেছে অন্ধকারের প্রাণীরা, তোমাকে খঞ্জর হাতে খুঁজতো যারা একাত্তরের পথেঘাটে, পরে পালিয়ে যারা ঢুকেছিলো পাতালে, এখন তাদেরই সুসময়। তোমার লক্ষ্য ছিলো ভবিষ্যৎ, যদিও নিজে তুমি অতীত হয়ে গেছো; কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের লক্ষ্য অতীত। আমরা এখন পিছমুখো, পেছনের দিকে দৌড় দিচ্ছি প্রাণপণে। আমাদের সমস্ত চাওয়া আমরা এখন সংশোধন করে নিচ্ছি; যা একসময় বাতিল ব’লে ছেড়ে এসেছি, এখন তাই বরণ করছি প্রত্যহ; আর যা পাওয়ার স্বপ্নে তুমি অস্থি হয়েছো, তাদের দণ্ড দিচ্ছি, আঁস্তাকুড়ে ফেলছি ভোরবেলা সন্ধ্যাবেলা। তুমি কি ক্ষমা করবে আমাকে?
তোমাকে যদি জানাই যে তোমার স্বপ্নের দেশ বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বিপথগামী, দুর্নীতিপরায়ণ, নৈতিকতাহীন, গরিব, নষ্টভ্রষ্ট, অসুস্থ দেশ, তাহলে কি তুমি দুঃখ পাবে? ক্রুদ্ধ হবে? আবার হাতে তুলে নিতে চাইবে অস্ত্র? কিন্তু তাতে কোনো কাজ হবে না, কেননা তোমার সমস্ত শক্তি গত দশ বছরে নিঃশেষে হরণ করা হয়েছে। তুমি এখন সমস্ত গৌরবহীন, বরং গৌরব পায় তারা, যারা বিরুদ্ধে ছিলো তোমার। সারা দেশটার কথাই ধরা যাক। তার উদ্দেশ্যের প্রচণ্ড বদল ঘটেছে এক দশকে, এমন হয়েছে যে তাকে বাঙলাদেশ না ব’লে বাঙলাস্তান বললেই বেশি মানায়। স্বাধীনতার পর থেকেই কেমন শোচনীয় পতন শুরু হয় দেশটির : চারদিকে মেতে ওঠে লুণ্ঠনকারীরা, তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্বাধীনতার সমস্ত সোনাদানা ঘরে তুলতে। তারা ভুলে যায় রক্ত আর অশ্রুর প্রতিশ্রুতি, কেননা তাদের হাতে উদ্দাম শক্তি। ঘরে হীরেমাণিক্য। দুর্নীতিতে মাতে দেশের সব এলাকা, নৈতিকতা থেকে খ’সে পড়ে একে একে ক্ষমতাবানেরা; অবহেলায় যাদের ‘সাধারণ মানুষ’ বলা হয়, তাদের অবস্থা সুখ জাগায় শুধু শিল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ফটোগ্রাফারদের চিত্তে। বাঙলাদেশ ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো একগুচ্ছ লোকের, যারা তোমার মতো আত্মবিসর্জনের দিকে না গিয়ে অন্যদিকে গিয়েছিলো। বাঙলাদেশ দশ বছরেই একাধিক ক্ষুদ্র একনায়ক দেখেছে, তাদের রক্তাক্ত পতন দেখেছে, তবু পতন থেকে তার উত্থান ঘটে নি। এখনো ঢালু মাঠে গড়িয়ে যাওয়া বলের মতো গড়াচ্ছে বাঙলাদেশ, কেউ জানে না থামবে কোন পাতালে। আমরা দেখেছি বাঙলাদেশকে কেউ কেউ আংটির মতো পরতে চেয়েছে, কেউ তাকে পরিণত করতে চেয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে; কোনো কোনো বীরোত্তম তাকে গেঁথে রাখতে চেয়েছে আপন উর্দির তারা ক’রে, কখনো বুটের মতো পরতে চেয়েছে ডান পায়ে বাঁ পায়ে। তোমার কাছে, আমরা যারা অসহায়ভাবে বেঁচে আছি, ক্ষমা প্রার্থনা করি।
কোনো কোনো সত্য, আমি বিশ্বাস করি, চিরসত্য : যেমন একবার রাজাকার চিরকাল রাজাকার। যে-একাত্তরে জন্ম নেয় নি সেও হ’তে পারে রাজাকার। এখন একটা প্রশ্ন আমার ভেতর থেকে চিৎকারের মতো উঠে আসছে, যদিও প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছি, সেটি হচ্ছে একবার মুক্তিযোদ্ধা কি চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা? না কি মুক্তিযোদ্ধারও ঘটতে পারে আন্তর বদল, এবং হয়ে উঠতে পারে তার-একদা-শত্রুর মতো অবিকল? তুমি যদি ওই নামহীন মাঠে নামহীন গাছের তলায় নামহীন অস্থিপুঞ্জে পরিণত না হতে, তবে কি তুমি চিরদিন থাকতে আকাশ-মেঘ-বিদ্যুতে শির-ঠেকানো উজ্জ্বল মুক্তিযোদ্ধা? অনেক বদল দেখেছি আমি, দেখেছি অন্ধকারের পাত্রপাত্রীদের সাথে মিলে গেছে আলোর সৈনিকেরা, চ’লে গেছে বিপরীত দিকে, যেদিকে তাদের যাওয়ার কথা ছিলো না। যেদিকে যাওয়ার অর্থই হলো নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া, বাঙলার বিরুদ্ধে যাওয়া। তুমি ক্ষমা করো আমাকে। তুমি যদি জিজ্ঞেস করো বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ বছর কোনটি, তবে আমি বলবো একাত্তর। যদিও বাঙলা তখন দোজখে পরিণত হয়েছিলো, সারাক্ষণ কাঁপছিলো বাঙালি রক্তক্ষরণের ভয়ে, বাতাসে থেকে থেকে গর্জন ক’রে উঠছিলো আগ্নেয়াস্ত্র, তবু সেটিই আমাদের সেরা বছর। তখন আমাদের একটা স্বপ্ন ছিলো, লক্ষ্য ছিলো আমাদের, কিন্তু এখন আমাদের কিছু নেই : লক্ষ্য আর স্বপ্ন এখন নর্দমার ময়লার মতো ঘৃণ্য। তোমার বিরোধীরা এখন বাঙলাকে ওই আবর্জনা থেকে উদ্ধার করার কাজে দিনরাত লিপ্ত। কী চমৎকার দুর্নীতিপরায়ণ অনৈতিক সমাজ তুমি আমাদের উপহার দিয়ে গেলে। ভারতীয় উপমহাদেশ দুর্নীতির লীলাভূমি; তবে এখন এ-উপমহাদেশের বাঙলাদেশ নামক ক্ষুদ্র খণ্ডাংশটি দুর্নীতি আর অনৈতিকতার বেহেশত। এখানে যে যতো দুর্নীতিপরায়ণ, সে-ই ততো পুণ্যবান; তারই ততো খ্যাতিপ্রতিপত্তি। বাঙলাদেশের দোকানদার, আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, কবি, বৈজ্ঞানিক, শ্রমিক, চাষী, চোর সবাই এখন দুর্নীতিতে আপাদশির মগ্ন; কেউ কেউ আছে দুর্নীতির সুযোগ পাচ্ছে না। বাঙলাদেশের বর্তমানের সমাজ দোকানদারি সমাজ, যার কোনো নীতি নেই, যে-কোনো কাজই তার নীতিশাস্ত্রে বৈধ। এখন চারপাশে শুধু বেচাকেনা চলছে, রাস্তার ছেঁড়া কাগজ টুকরো থেকে বুকের আবেগ দিনরাত বিক্রি হচ্ছে; যা বিক্রির যোগ্য নয়, তা এখন ফালতু আর হাস্যকর। জ্ঞান এখন ততোটুকুই মূল্যবান যতোটুকু বিক্রির যোগ্য, বিদ্যা ততোটুকুই দামি তার যতোটুকু চাঁদনি চকে বা মতিঝিলে বা জুতোর দোকানে বিক্রি হ’তে পারে। বাপ বেচছে ছেলের কাছে, মেয়ে বেচছে প্রেমিকের কাছে, স্ত্রী বেচছে স্বামীর কাছে, রাজনীতিক ব্যবসায়ী বেচছে দলের কাছে, গুণ্ডা বেচছে মন্ত্রীর কাছে; অর্থাৎ সারা বাঙলা এখন একটি চোরা আর ছেঁড়া মালের বাজার। তোমার কাছে, একাত্তরের ডিসেম্বরের অনেক আগে পরপারে চ’লে যাওয়া সূর্য, আমি করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করি।
আমি রক্তের কণায় কণায় তোমার উপস্থিতি বোধ করি; যদিও তোমাকে, তোমার সঙ্গীদের আমি দেখি নি। তুমি লুংগি প’রে মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছো, পেরোচ্ছো খাদ খাল নদী, ঝোঁপঝাড়ের তল দিয়ে গিয়ে হঠাৎ সক্রিয় ক’রে তুলছো তোমার ভোঁতা রাইফেল, শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা মেশিনগান, এবং বাঙলার এক একটি এলাকা পবিত্র হচ্ছে। তোমার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে উৎসারিত শব্দ কী আশ্চর্য সুখকর। তোমার রাইফেল থেকে বুলেট নয়, বেরিয়ে আসছিলো গুচ্ছগুচ্ছ গোলাপ, যা শত্রুর জন্যে ছিলো বুলেট, আমাদের জন্যে ছিলো পুষ্পের গুচ্ছ। শহরের বানানো স্বাভাবিকতা যখন কোনো কোনো সন্ধ্যায় আচমকা নষ্ট হয়ে যেতো, বিকল হতো সুরক্ষিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, অজস্র গুলির শব্দে যখন শহরে নামতো অন্ধকার, তখন বুঝতাম তুমি এসেছো, আর সে-অন্ধকারকেই মনে হতো আলোর অধিক। এখন আমি সেই অন্ধকার চাই। যখন কোনো ভাঙা সাঁকোর সামনে এসে দাঁড়াতাম, দেখতাম দানবের মতো ক্ষেপে আছে খাকিবাহিনী, বুঝতাম তুমি এসেছিলে। তুমি দলে দলে এসে, শত্রুর দিকে উদ্যত নল থেকে ঢেলে দিচ্ছো রাশিরাশি ইস্পাত, তোমার হাত থেকে শাঁ শাঁ করে ছুটে যাচ্ছে গ্রেনেড, বিধ্বস্ত হচ্ছে– শত্রুর বানানো স্বাভাবিকতার সাঁকো, চুরমার হচ্ছে তার শিরস্ত্রাণ আর ব্যক্তিগত হাড় : এখনো দেখতে পাই তোমার এলোমেলো ক্রুদ্ধ বাউলের মতো চুল বাঙলার আকাশ জুড়ে ওড়ে। তুমি লুকিয়ে আছো কোনো সবুজ ঝোঁপের আড়ালে বাঙলার বাঘের মতো, তোমার চোখ জ্বলছে; তুমি ব্রিজের নিচে ডুবে আছো বাঙলার কুমিরের মতো, ছিনিয়ে নিচ্ছো শত্রু; তুমি শহরের স্ট্রিটের কোণায় সেরেনাদাওয়া প্রেমিকের মতো দাঁড়িয়ে আছো, এবং তোমার গান বজ্রবিদ্যুতের মতো খানখান করে দিচ্ছে শত্রুর ছাউনি বাঙলার প্রতিটি ফুলপাখিমানুষকে রাত্রে সুনিদ্রা দেয়ার জন্যে। যা দেখি নি তাও স্পষ্ট দেখছি আমি, তুমি আছো বিনিদ্র রাইফেলের পাশে, যে-কোনো সময় দুজনেই গর্জন ক’রে উঠবে ব’লে। তোমার কোনো ক্লান্তি নেই, যেহেতু সকলের ক্লান্তি হরণের দায়িত্ব তোমার; তোমার কোনো ভয় নেই, যেহেতু সকলের ভয় দূর করার স্বপ্ন তোমার। তুমি ছিলে, তাই আমরা একাত্তরে ভুলে ছিলাম ভয় আর ক্লান্তি; তুমি নেই, তাই একাশিতে আমরা ভয় ক্লান্তি দুঃস্বপ্নের ভেতরে ঢুকছি। তুমি আমাদের উদ্ধার করো।
এখন দেশ অসংখ্য শ্রেণীদলসংঘে বিভক্ত, আর তারা পরস্পরের পরিচ্ছন্ন উৎখাত চায়। নানা অস্ত্র নিয়ে তারা প্রস্তুত, যেদিন বিদেশে অবস্থিত কেন্দ্রের নির্দেশ আসবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা লক্ষ্যের মস্তকের ওপর। বাঙলায় এখন শেকড় নেই কারো তোমার মতো, সকলের শেকড় অন্যত্র ছড়ানো। যার শেকড় একান্ত বাঙলায়, সে এ-ভূভাগে তেলাপোকার চেয়েও অসহায়। ভীষণ অসহায় সে-মানুষেরা, যাদের বলা হয় সাধারণ মানুষ। দু-ধরনের মানুষ চোখে পড়ে এখন : সাধারণ আর অসাধারণ। অসাধারণ মানুষেরা, যারা মনুষ্যত্ব অনেকটা ঝেড়ে ফেলে অসাধারণ হয়ে উঠেছে, সমস্ত ক্ষমতার পরিণতি, আর সাধারণ মানুষেরা ক্ষমতার উৎস। প্রকাশ্যে প্রচণ্ড স্তুতি করা হয় সাধারণ মানুষদের; বলা হয় তারাই ক্ষমতার উৎস, দেশের ভিত্তি, কিন্তু সংগোপনে তাদের ত্রস্ত রাখা হয় সব সময়। তারা অধিকারহীন, পেট শূন্য, শরীর নগ্ন, তবু তাদের অশ্লীল মনে হয় না; কেননা যতোটুকু মেদ শরীরে জমলে উলঙ্গ শরীরকে অশ্লীল মনে হয় সে-অশালীন মেদটুকু তাদের চামড়ার তলে নেই। মনে হয় তারা এখন আর কিছু চায় না, এমনকি বাঁচতেও চায় না; হাজার বছর ধ’রে কামনা করে এখন তারা নিষ্কাম বাউল। তাদের বেঁচে থাকাটা একরকম করুণ লোকসঙ্গীত। কিন্তু কী চমৎকার আছে ক্ষমতার পরিণতিরা। শরীরে তাদের মেদমাংসের বিস্ময়কর ছড়াছড়ি; তারা বিদেশি পোশাক পরে, বিদেশি খাদ্য খায়, সাইরেনঅলা গাড়ি চড়ে, না-ঠাণ্ডা না-গরম ঘরে ঘুমোয়, বিদেশি আর দেশি ব্যাংকে মিলিয়ন-বিলিয়ন (লাখকোটি এখন বাতিল) টাকা জমায়, সুন্দরী ও সানগ্লাসের সাহচর্যে থাকে। মাঝে মাঝে রটনা করে দুর্নীতির উনিশ-বিশ দফা, তাতে সাধারণ মানুষদের রফা ঘটে অনেকখানি, কিন্তু আরো শক্তি জমে পরিণতিদের পেশিতে। তোমার কাছে ক্ষমা চাই, কেননা তোমার সমস্ত পুরোনো লক্ষ্য এখন বাঙলায় বাতিল হয়ে গেছে। পুঁজি জমছে একগোত্রের ট্যাকে, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র এখন পচা বুলি, বাঙলা ভাষাটাশার কথা এখন হাস্যকর, সবখানেই ইংরেজির ছড়াছড়ি, সম্মান; এবং আসছে আরবি, ডুবছে বাঙলাভাষা। এখন মূর্খ চাষা ছাড়া আর কেউ বাঙলা বলে না, পতিতাও বিদেশি ভাষা শিখছে নানা টিউটরিয়ালে। তবু কখনো যখন কোনো নির্বোধ যুবক নিঃসঙ্গভাবে পুরোনো গান ধরে, তখন শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করি, এবং এ-দুঃসময়ে তোমারই ধ্যান করি। অচিহ্নিত মাটির তলায় ঘুমিয়ে-থাকা অস্থি, ব্রিজের নিচে দিনদুপুরে অস্তমিত সূর্য, দশবছর ধ’রে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত শূন্যতা, আমাদের প্রথম বিজয় আর পরাজয়, কোটি কোটি মানুষের চোখের পাতায় বিশাল অশ্রুবিন্দু, আমাদের সকলের নিহত হৃৎপিণ্ড, তোমার ধ্যান করি, তোমার কাছে ক্ষমা চাই। তুমি কি আবার জেগে উঠবে বাঙলার নদীর ধারে, বনঝোঁপের আড়ালে, ধান আর পাটের আলে, মফস্বল শহরের কানাগলিতে, আলোঅন্ধকারের কামড়ে আহত রাজনীতির স্ট্রিটে, পাহাড়ের চুড়োয়? আমি তোমার আকাশছাওয়া উদ্ধত চুলের দিকে তাকিয়ে আছি, উদ্যত নলের দিকে চেয়ে আছি, তোমার স্বপ্ন অবিচল সমস্ত চোখেচোখে ধ’রে আছি। কিন্তু দশ বছর ধ’রে তোমার কাছ থেকে স’রে যাচ্ছে তোমারই স্বপ্ন, উল্টে যাচ্ছে পাল্টে যাচ্ছে, হয়ে উঠছে তোমার স্বপ্নের বিপরীত, তোমার দুঃস্বপ্ন। কী রকম ভয়ঙ্কর মূর্তি তার। কখনো বুট হয়ে ঢুকে যাচ্ছে দানবিক পায়ে, তারা হয়ে ঝুলছে তার উর্দিতে, নাচছে চাবুকের শব্দে, খোঁচা খেয়ে প্রসব করছে ধান, আর যারতার সাথে ঘুম যাচ্ছে প্রকাশ্যে। তুমি থাকলে হয়তো চিৎকার করে বলতে, ‘এ-জন্যই কি আমি হাজার হাজার বছর ধ’রে অরণ্যের ভেতর দিয়ে, নদীর জল সাঁতরিয়ে, খালের পার দিয়ে, পাহাড়ের চূড়ো ডিঙ্গিয়ে, আলকাতরা কংক্রিট পেরিয়ে, সাঁকো পার হয়ে তোমার দিকে আসছিলাম ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের সবুজ রূপসী?’ আমি তোমার কাছে, আমার একমাত্র বীর, দিনরাত ক্ষমাপ্রার্থনা করি।
“নির্বাচিত প্রবন্ধ” উপন্যাস বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ মধ্যাহ্নের অলস গায়কঃ রোম্যান্টিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথ
♦ পাকিস্থানবাদী সাহিত্যতত্ত্বঃ প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবৃক্ষ
♦ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতাঃ অবতরণিকা
♦ বাংলা গদ্যচর্চা ও বিদ্যাসাগর
♦ মেরিওলস্টোনক্র্যাফটঃ অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু
♦ নামপরিচয়হীন যে-কোন একজন নিহত মুক্তিযোদ্ধার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা
♦ শহীদ মিনারঃ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু
♦ নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা
♦ নারীদের নারীরাঃ নারীদের উপন্যাসে নারীভাবমূর্তি
♦ বাঙ্গালীঃ একটি রূগ্ন জনগোষ্ঠি
♦ মাইকেল মধুসূদনঃ প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা