জাহেদা তার ছেলের নাম রেখেছে–জাহেদুর রহমান খান। মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম। ছেলের নামে যদি মায়ের নামের মিল থাকে, তাহলে বেহেশতে মা ছেলের দেখা হয়। এটা তুচ্ছ করার বিষয় না। লাখ লাখ মানুষ বেহেশতে যাবে। কারণ লাখ লাখ মানুষ উপাসী। বেহেশত উপাসী মানুষদের জন্যে পুরস্কার। মাওলানা সাহেবের নিজের মুখের কথা। লাখ লাখ মানুষের মধ্যে জাহেদা তার ছেলেকে খুঁজে নাও পেতে পারে। মিল দিয়ে নাম রেখে এই সমস্যার একটা সমাধান করে জাহেদা খুশি। জাহেদার স্বামী কুদ্দুসও খুশি। জাহেদুর রহমান খান নামকরণে কুদুসেরও কিঞ্চিৎ ভূমিকা আছে। নামের শেষে খান সে লাগিয়ে দিয়েছে। সে বউকে বলেছে, খান বসার কারণে নামের মধ্যে স্পিড় আসছে। আমরা খান বংশ না তো কী? আমার ছেলে খান।
কুদ্দুস ঢাকা শহরে রিকশা চালায়। তার কথাবার্তায় কিছু ইংরেজি শব্দ থাকে। এইসব ইংরেজি সে সিনেমা দেখে শিখে। সিনেমার হিয়োরা কথাবার্তায় অনেক ইংরেজি বলেন। নায়ক মান্নাভাই এক ছবিতে হিরোইনকে বললেন, চাঁদ শোন, তোমাকে খুব বিউটি লাগছে। কুদ্দুস সেখান থেকে বিউটি শব্দটা শিখেছে। ছেলের মুখ দেখে সে বলেছে, জাহেদা, তোমার ছেলে বিরাট বিউটি হয়েছে।
জাহেদা বলেছে, নজর লাগায়েন না। পিতামাতার নজর খুব খারাপ। ছেলের মাথাত থুক দেন। তিনবার বলেন, মাশাল্লা।
কুদ্দুস তার ছেলের মুখে একদলা থুথু ফেলে বলল, মাশাল্লা। তিনবার বলার কথা, সে বলল সতিবার।
সাধারণত কন্যাসন্তান সংসারে ভাগ্য নিয়ে আসে। মাওলানা সাহেব এই কথা ওয়াজে বলেছেন। জাহেদার ধারণা তার বেলায় উল্টাটা হয়েছে। ছেলে সংসারে। ভাগ্য নিয়ে এসেছে। রিকশা চালিয়ে ছেলের বাবা ভালো টাকাপয়সা আনছে। যা ভাড়া তারচেয়ে অতিরিক্ত টাকা বেশ কয়েকবার পেয়েছে। নিউমার্কেট থেকে ধানমণ্ডি তিন-এর ভাড়া হয় দশ টাকা। সেখানে এক প্যাসেনজার একশ টাকার একটা নোট বের করে বলল, ভাংতি আছে?
কুদ্দুস বলল, জি-না স্যার।
তোমার সাথে কত আছে দেখ।
কুদ্দুস টাকা গুনে বলল, একাশি টাকা আছে স্যার।
যাত্রী বলল, একাশি টাকা আমাকে দিয়ে একশ টাকার নোটটা রেখে দাও। কী আর করা।
কুদ্দুস একাশি টাকা প্যাসেনজারকে দিতে গেল। তখন হঠাৎ প্যাসেনজার বলল, থাক টাকা দিতে হবে না। পুরোটাই রেখে দাও।
এইরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না। ছেলের ভাগ্যেই ঘটছে। কিছুই বলা যায়, ছেলের ভাগ্যেই হয়তো কুন্দুসের নিজের রিকশা হবে। মালিকের রিকশা চালিয়ে রোজ পঞ্চাশ টাকা জমা দিতে হবে না। কুদ্দুস ঠিক করে রেখেছে, নিজের রিকশা হলে সে একবেলা রিকশা চালাবে। একবেলা বিশ্রাম। সেই একবেলা সে ছেলেকে খেলা দিবে।
কুদ্দুস সকাল সাতটায় রিকশা নিয়ে বের হয়। ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা-বারোটা হয়। এই দীর্ঘ সময় ছেলেকে না দেখতে পারায় তার বড় অস্থির লাগে। নিজের রিকশা হলে এই অস্থিরতা থাকবে না। তখন তার একবেলা কাটবে প্যাসেনজারের সাথে, একবেলা ছেলের সাথে।
এখনো সে ছেলের সঙ্গে সময় কাটায়। খুবই অল্প সময়। মালিকের কাছে রিকশা জমা দিয়ে সে ঘরে ফিরে গোসল করে। ভাত খেয়ে ঘুমুতে আসে। তখন সে ছেলেকে বুকে নিয়ে গল্প করে। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসে। সে জোর করে জেগে থাকে। বিড়বিড় করে ছেলের সঙ্গে কথা বলে। মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে ছড়া বাঁধে–
আমার ছেলে রিকশা বায়
রইদে পুড়ে আশুলিয়া যায়।।
এই ধরনের ছড়ায় জাহেদা রাগ করে। সে কঠিন গলায় বলে, এইগুলা কী বলেন! আপনের ছেলে রিকশা বাইব কোন দুঃখে? হে লেখাপড়া শিখব। ছুলেমান ভাইয়ের ছেলের মতো জিপি পাইব। পত্রিকায় তার ছবি ছাপব।
ছুলেমান বস্তিতে জাহেদার পাশের ঘরেই থাকে। তার ছেলে এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। তার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পত্রিকাওয়ালারা ছুলেমানকে একটা নতুন রিকশা কিনে দিয়েছে।
জাহেদা নিশ্চিত একদিন তার ছেলে জাহেদুর রহমান খানের ছবিও ছাপা হবে। তারাও নতুন একটা রিকশা পাবে। জাহেদা ঠিক করে রেখেছে, যেদিন নতুন রিকশা পাবে সেদিন সে ছেলেকে নিয়ে প্যাসেনজারের মতো রিকশায় বসে থাকবে। শহর ঘুরে দেখবে। মা-ছেলে মিলে আইসক্রিম কিনে খাবে। সন্ধ্যাবেলা মা-বাৰা-বেটায় মিলে ছবি দেখতে যাবে। মান্না ভাইয়ের কোনো ছবি। মান্না ভাইকে জাহেদার খুবই পছন্দ। আহারে, কী পাট গায়! বেশ কয়েকবার সে এফডিসির গেটে দাঁড়িয়ে মান্না ভাইকে দেখেছে। ঠিক দেখা বলা যাবে না। মান্না ভাই দামি গাড়িতে হুট করে ঢুকে গেছেন।
বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার, মান্না ভাইয়ের সঙ্গে জাহেদার যোগাযোগের এক ব্যবস্থা হয়ে গেল। এফডিসিতে অভিনয়ের জন্যে বাচ্চা সাপ্লাই দেয় ফরিদা। সে একদিন জাহেদার কাছে উপস্থিত। পানের পিক ফেলতে ফেলতে ফরিদা বলল, তোর পুলার চেহারা ছবি মাশাল্লা ভালো। ফিল্মে পাট গাইতে দিবি?
জাহেদা বলল, দুধের শিশু, দশদিন বয়স, সে কী পাট গাইব?
মায়ের পেট কাইটা সন্তান বাইর হইছে এই পাট গাইব। ডায়লগ আছে। ডায়লগ হইছে চিৎকার কইরা কান্দন। এই শিশুই বড় হইয়া হইব হিরু মান্না। রাজি থাকলে ক। পরশু সইন্ধায় শুটিং। ছেলে একবেলা কাজ করব। নগদ পাঁচশ পাইব।
পাঁচশ?
হুঁ। আগে তিনশ ছিল। এখন বাইরা পাঁচশ হইছে। তুই আমারে দিবি দুইশ। তিনশ নিজের কাছে রাখবি। পুলার রোজগার খাইবি। পুলার রোজগার খাওয়ার মতো আনন্দের আর কিছুই নাই। রোজগার একবার খাইয়া দেখ। কী রাজি?
হুঁ রাজি।
জাহেদার অতি দ্রুত রাজি হবার পেছনের কারণ ছেলের রোজগার খাওয়া। তার ছেলে মান্না ভাইয়ের পাট গাইছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। তারচেয়েও বড় ব্যাপার এক মাসের জন্যে একটা টেবিল ফ্যানের ভাড়া তিনশ টাকা। এই টাকায় সে একটা ফ্যান ভাড়া করতে পারবে। তার ঘরে ইলেকট্রিসিটি আছে। ফ্যান চলবে। ফ্যানের বাতাসে জাহেদুর রহমান খান আরাম করে ঘুমাবে। গরমে বেচারা বড় কষ্ট করছে। হাতপাখা দিয়ে কতক্ষণ আর বাতাস করা যায়! তারপরেও জাহেদা প্রায় সারারাতই হাওয়া করে। ঘুমের মধ্যেও তার হাত নড়ে। ফ্যান চললে তার নিজেরও শান্তি।
জাহেদার খুব শখ ছিল শুটিং দেখবে। সেটা সম্ভব হলো না। ফরিদা বলল, ডিরেক্টর বলে দিয়েছে বাচ্চার মা যেন না আসে। সব বাচ্চার মা শুটিংয়ের সময় নখরা করে। বাচ্চার জন্যে অকারণে অস্থির হয়। শুটিং-এ ডিস্টার্ব।
জাহেদা বলল, বাচ্চা না দেইখা আমি ক্যামনে থাকব?
ফরিদা বলল, আমি কোলে কইরা নিয়া যাব। দুই ঘন্টা পরে ফিরত দিয়া যাব। তুই খাড়ায়া থাকবি এফডিসির গেটে। ঠিক আছে কি-না বল। ঠিক না থাকলে অন্য বাচ্চা দেখি। শিশুবাচ্চার কোনো অভাব নাই। আরো দুইজনের সাথে কথা হইয়া আছে। এখন বল ঠিক আছে?
জাহেদা ক্ষীণস্বরে বলল, ঠিক আছে। টেকা কি আইজই পাব?
ফরিদা বলল, অবশ্যই। বাচ্চা আর টেকা একসঙ্গে পাবি।
কাজ দুই ঘণ্টায় শেষ হইব?
আরো আগেই শেষ হইব। এই ডাইরেক্টর শিশুবাচ্চার ব্যাপারে খুব সাবধান। বাচ্চা নিয়া উপস্থিত হইলে তিনি সব কাজ ফালাইয়া বাচ্চার শুটিং করেন।
ডাইরেক্টর সাহেবের নাম কী?
কামাল। হিট ডাইরেক্টর। এখন যে ছবি বানাইতাছেন, তার নাম প্রেম দিওয়ানা। এই ছবিও হিট হইব। তোর ছেলের নাম ফাটব। হলে গিয়া ছেলের
ছবি দেখবি।
ডাইরেক্টর কামাল ছোট শিশুর ব্যাপারে যে সাবধানী তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ফরিদার কোলের বাচ্চা দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ নতুন করে হাসপাতালের লাইট করতে বললেন। হাসপাতালের সেট তৈরিই আছে। শুধু লাইট করা।
ডাইরেক্টর কামাল বললেন, ট্রলি শট হবে। এক টেকে OK করতে হবে। নবজাতক শিশু নিয়ে কারবার। আমি দশবার শট নিব না। লেড়ি ডাক্তার বাচ্চার পায়ে ধরে বাচ্চাকে ফ্রেমে নিয়ে আসবে। বাচ্চা কাঁদছে। বিগ ক্লোজ। সেখান থেকে ক্যামেরা ওয়াইড হবে। সবাইকে যখন একসঙ্গে পাওয়া যাবে তখন বাচ্চার মা বলবে, আমার যাদু কই? আমার যাদু কই? বলতে বলতে মায়ের মৃত্যু। শট শেষ। আধঘণ্টা সময়। আধঘণ্টার মধ্যে সব রেড়ি চাই। ট্রলি বসাও। ড্রাই ক্যামেরা রিহার্সেল হবে। রুহ আফজা আর ভ্যাসলিনের একটা মিকচার করে বাচ্চাটার গায়ে মাখাও। দেখেই যেন মনে হয়, এইমাত্র মার পেট থেকে বের হয়েছে। ভ্যাসলিন দিবে বেশি, রুহ আফজা কম।
আধঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল, একঘণ্টা লেগে গেল। ট্রলি ঠিকমতো বসছে না। জার্ক হচ্ছে। ট্রলি শট বাদ দিয়ে জুম দিয়ে কাজ হবে। বাচ্চার ফ্রেম থেকে ওয়াইড হবে।
গায়ে ভ্যাসলিন মাখার পর থেকেই বাচ্চা কাদছে। শটের জন্যে ভালো। ডাইরেক্টর কামাল ক্যামেরা বললেন, ডাক্তারের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন তিনি বাচ্চার পা ধরে তাকে ঠিক সময়মতোই ফ্রেমে নিয়ে এলেন। জুমল্যান্স বাচ্চার মুখে ফোকাস করল। বাচ্চা শুরু করল বিকট চিৎকার। তখনি দুর্ঘটনা ঘটল। ডাক্তার মেয়ের হাত থেকে পিছলে বাচ্চা মেঝেতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না বন্ধ হয়ে গেল।
ডাইরেক্টর কামাল জাহেদার বাসায় এসেছেন। তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। জাহেদা সেইসব কথা শুনছে না-কি শুনছে না তা বোঝা যাচ্ছে না। সে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। কামাল সাহেব বললেন, তোমার ছেলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। শট শুরু হবার আগেই তার হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তারের সার্টিফিকেটও আছে। চাইলে দেখাব। সার্টিফিকেটে লেখা–কজ অব ডেথ হার্ট অ্যাটাক। এইসব ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ হার্ট অ্যাটাকে মানুষের কোনো হাত নাই। তোমার ছেলে যদি তোমার কোলে শুয়ে থাকত তাহলেও হার্ট অ্যাটাক হতো। হার্ট অ্যাটাক এমনই জিনিস। যাই হোক, তারপরেও আমরা দশ হাজার টাকা দিলাম। এইখানে সই করে টাকাটা নাও। সই করতে না পারলে বুড়া আঙুলের টিপসই দাও।
জাহেদা টিপসই দিয়ে টাকা নিল। তার ছেলের প্রথম এবং শেষ রোজগার।
কুদ্দুস নয়া রিকশা কিনেছে। একটা টেবিলফ্যান কিনেছে। দিনে সে রিকশা চালায়। রাতে সে ফ্যানের বাতাসে ঘুমায়। ঠান্ডায় তার ভালো ঘুম হয়। জেগে। থাকে জীহেদা। রাত গভীর হলে সে ছেলের নামে ছড়া কাটে–
আমার ছেলে রিকশা বায়
রইদে পুড়ে আশুলিয়া যায়।
“আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ” সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ