বাংলাদেশ লেখক শিবিরের বরিশাল শাখা আয়োজিত নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত লিখিত ভাষণ

মাননীয় সভাপতি সাহেব ও উপস্থিত সুধীবৃন্দ। আপনাদের এ মহৎ অনুষ্ঠানে সমাবিষ্ট মহজ্জনদের মধ্যে অনেকের কাছেই আমি অপরিচিত। তাই আজকের বিষয়ে কিছু বলার পূর্বে আমি আমার পরিচয়জ্ঞাপক দু-চারটি কথা আপনাদের কাছে বলতে চাই। এবং সেজন্য মাননীয় সভাপতি সাহেবের অনুমতি প্রার্থনা করছি।

জন্ম আমার ৩রা পৌষ ১৩০৭ সালে, বরিশাল থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে লামচরি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। মাত্র চার বছর বয়সে পিতৃহারা ও আট বছর বয়শে নিলামে বিত্তহারা হয়ে বিধবা মায়ের আঁচল ধরে দশ দুয়ারের সাহায্যে শৈশবে আমাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। সেকালে আমাদের গ্রামে কোনরূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, স্থানীয় মুন্সি আবদুল করিম সাহেব একখানি মক্তব খোলেন তাঁর বাড়িতে ১৩২০ সালে। এতিম ছেলে বলে আমি অবৈতনিকভাবে তাঁর কাছে শিক্ষা করলাম স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ এবং বানান-ফলা পর্যন্ত। কিন্তু ছাত্রবেতন অনাদায়হেতু তিনি মক্তবটি বন্ধ করে দিলেন ১৩২১ সালে। আর এখানেই হল আমার বিদ্যাশিক্ষার সমাপ্তি বা সমাধি।

শৈশবে পড়ালেখার প্রবল আগ্রহ ছিলো, কিন্তু কোন উপায় ছিলো না। উক্ত সামান্য বিদ্যার জোরেই গ্রাম্য পুঁথিপাঠকদের কাছে গিয়ে বানান করে পড়েছি জয়গুন, সোনাভান, জঙ্গনামা, মোক্তল হোসেন ইত্যাদি পুঁথি এবং ভিক্ষা করে পড়েছি তৎকালীন বরিশালে পড়ুয়া প্রতিবাসী ছাত্রদের পুরোনো পাঠ্যবইগুলো।

দারিদ্র নিবন্ধন আমাকে কৃষিকাজ শুরু করতে হয়েছিল অল্প বয়সেই। কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে বরিশালের এই পাবলিক লাইব্রেরী থেকে চুরি করে করে বই পড়তে শুরু করি ১৯শে পৌষ ১৩৪৪ সাল থেকে। মিউনিসিপ্যাল এলাকার বাইরের কোন পাঠককে তার বাড়িতে বই দেবার নিয়ম নেই বলে আমাকে বাড়িতে নিয়ে বই পড়তে হয়েছে তৎকালীন বরিশালের টুপির ব্যবসায়ী জনাব ওয়াজেদ আলী তালুকদারের বেনামিতে। এটা আমার পক্ষে চুরিই বটে।

তালুকদার সাহেব বর্তমানে স্বনামে বই পড়তে শুরু করি ৮ই আশ্বিন ১৩৭২ সাল থেকে (ইং ২৫-৯-৬৫)। কিন্তু এ সময়ও অসদুপায় অবলম্বন করতে হল আমার অধ্যায়নলিস্পার তাড়নায়। ঠিকানা লিখতে হল ‘দপ্তরখানা রোড, বরিশাল’। এটা ছিল ডাহা মিথ্যা ঠিকানা। আমার এসব অসৎ কাজে যথাসম্ভব সাহায্য দান করেছেন প্রাক্তন লাইব্রেরীয়ান জনাব ইয়াকুব আলী মিয়া (মোক্তার সাহেব) এবং বন্ধুবর সিরাজুল ইসলাম সাহেব। তাঁরা বর্তমানেও এখানেই আছেন।

এছড়া ১৩৫৪-৫৫ সাল থেকে কিছু কিছু বই চুরি করে নিয়ে পড়তে থাকি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ লাইব্রেরী থেকে। কেননা কলেজ লাইব্রেরী থেকে বাড়িতে নিয়ে বই পড়বার কোনো অধিকার আমার ছিল না। সে চুরি কাজে সাহায্য দান করেছেন ও করেন উক্ত কলেজের দর্শন বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেব (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত)। ১৩৫৭ থেকে ৬২ সাল পর্যন্ত চুরি করে কিছু কিছু বই পড়েছি বরিশালের ব্যাপটিস্ট মিশন লাইব্রেরী থেকে। সেখানে চুরি করতে হয়েছে সে লাইব্রেরীর কর্তৃপক্ষের নিষেধের জন্য নয়, আমার প্রতিবাসী গোঁড়া মুস্ললিদের নিন্দার ভয়ে। সেখানে যথোচিত সাহায্য দান করেছেন তৎকালীন লাইব্রেরীয়ান মি. মরিস সাহেব। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী। তবে বাংলা জানতেন ভালো। এর মধ্যে বরিশাল শঙ্কর লাইব্রেরী থেকেও বই-পুস্তক নিয়ে পড়েছি দু-তিন বছর। তাও অনুরূপভাবেই।

উক্তরূপ অসৎ কাজে যে সমস্ত মনীষী আমাকে সাহায্য দান করেছেন, আইনের কাছে অন্যায় করে থাকলেও সমাজের কাছে তাঁরা মহৎ কাজই করেছেন। কেননা তাঁরা একটি অমানুষকে মানুষ বানাবার চেষ্টা করেছেন। হয়তো আশানুরূপ ফল তাঁরা পাননি। আমি তাঁদের কাছে চিরঋণে আবদ্ধ।

পূর্বেই বলেছি যে, বরিশাল থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৭ মাইল। কাজেই যে কোন একখানা বই পড়বার জন্য আমাকে হাঁটতে হয়েছে প্রায় ১৪ মাইল। কেননা তখন কোনোরূপ যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না আমাদের বরিশালে যাতায়াতের জন্য, নেই আজও। এর অভাবে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলেছি আমি ১৩৪৪ থেকে ১৩৭৯ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ একাদিক্রমে প্রায় ৩৫ বছর ধরে। অতঃপর পুস্তকাদি রচনা ও প্রকাশনার ব্যাপারে আমাকে এখন অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতে হচ্ছে ঢাকা নগরীতে।

দারিদ্র নিবন্ধন কোন স্কুল-কলেজে গিয়ে পয়সা দিয়ে বিদ্যা কিনতে পারিনি দেশের অন্য সব ছাত্র ছাত্রীদের মতো। তাই কোন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আমার শিক্ষাপীঠ নয়, আমার শিক্ষাপীঠ হল লাইব্রেরী। আশৈশব লাইব্রেরীকে ভালোবেসে এসেছি এবং এখনো ভালোবাসি। লাইব্রেরীই আমার তীর্থস্থান। আশাকরি আমরণ লাইব্রেরীর সেবা করতে এবং এ-ও কামনা করি, লাইব্রেরীর মেঝেই হয় যেন আমার অন্তিমশয্যা। তাই নিজ পল্লীতে প্রতিষ্ঠা করেছি নগণ্য একটি পাবলিক লাইব্রেরী ১৩৮৬ সালে। আমার মতে মন্দির, মসজিদ, গির্জা থেকে লাইব্রেরী বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।

আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে আপনাদের আর কষ্ট দিতে চাই না। এখন আমি আজকের অনুষ্ঠান সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে বক্তব্য শেষ করবো।

বাংলাদেশ লেখক শিবিরের বরিশাল শাখার উৎসাহী কর্মীবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে আজ এখানে বিদ্রোহী কবির জন্মদিনকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর শুধু এখানেই নয়, এ দিনটি পালিত হচ্ছে দেশের সর্বত্র এবং দেশের বাইরেও বহু জায়গায়, অবশ্য সুধীসমাজে।  এ দিনটিতে সর্বত্রই হচ্ছে কবি জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিষয় সম্বন্ধে নানা ধরণের আলোচনা, নীতিগতভাবেই। দেশের সুধীসমাজ আজ কবির সপ্রশংস আলোচনায় মুখর, ভক্তিরসে আপ্লুত। বিশেষত দেশের যুবসমাজকে দেখি এর পুরোভাগে। এটা শ্লাঘার বিষয় এবং গৌরবেরও। আর কবির আকাঙ্ক্ষাও ছিল এটাই। দেশের দুস্থ জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মোচন ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে উদাত্ত কন্ঠে ডাক দিয়েছেন কবি দেশের তরুণদেরকেই সবসময়। সেজন্য আমাদের মতো বৃদ্ধদেরকে ডাকেননি তিনি কখনো। কেননা তিনি জানতেন যে, দেশের নিপীড়িত জনগণের ভাগ্যে বিবর্তন ঘটাতে পারে একমাত্র তরুণরাই।

কবির যশোগান, গুণগান, স্তুতিগান আজ দেশে বিদেশে সর্বত্র। কিন্তু কবি কি এসবের কাঙ্গাল ছিলেন, বা প্রত্যাশা করেছিলেন, বা প্রাপ্তির জন্য কারো কাছে? না, তিনি ওসবের কাঙ্গাল ছিলেন না এবং প্রত্যাশাও করেননি কারো কাছে ওসব পাবার জন্য। কেননা তাঁর জীবনে ওসব তিনি অযাচিতভাবেই পেয়েছিলেন প্রচুর। তবে কি তিনি নিষ্কাম-নিঃস্পৃহ হয়ে ইহধাম ত্যাগ করতে পেরেছেন? কবির কোনো বাসনা কি অপূর্ণ ছিলো না এবং তা পূর্ণ করবার জন্য তাঁর বিদেহী আত্মা কি আপনাদের দিকে চেয়ে নেই? আছে বইকি। একটু খোঁজ নিলে সহজেই দেখা যাবে যে, তাঁর সে অপূর্ণ বাসনাটি ছিলো দেশের দীন-দুঃখীর দুঃখ-দুর্দশা দূর করার বাসনা। তাঁর সে বাসনাটি পূর্ণ করবার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন আমরণ। কিন্তু তা তিনি পারেননি পূর্ণ করে যেতে ধরাধাম থেকে। তাই কবির মরআত্মা সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে আছে আপনাদের দিকে তাঁর সে বাসনাটি পূর্ণ করার অপেক্ষায়। কবির গানের সুর, কবিতার ছন্দ, প্রবন্ধের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ইত্যাদিতে কবিকে যতোই প্রশংসিত করা হোক না কেন, সমাজের কাছে বাহবা পেলেও কবির বিদেহী আত্মার আশীর্বাদ তাতে মিলবে না, যদি না তাঁর অপূর্ণ বাসনা পূর্ণ করা হয়।

কবির যাবতীয় লেখায় এবং অন্তরে ছিলো দীন-দুঃখী ও মেহনতী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার প্রবল আকুতি। কিন্তু নিয়তির সাথে তিনি পেরে উঠলেন না, পারলেন না মনের সে বাসনা পূর্ণ করে যেতে। আজ তাঁর উত্তরসূরীদের কর্তব্য কবির সে বাসনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া। আর সেজন্য আবশ্যক সুপরিকল্পিতভাবে সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। এ কাজে যথার্থই যারান আত্মনিয়োগ করবেন, একমাত্র তাঁরাই হবেন কবির বাস্তব অনুসারিত্বের দাবিদার। বস্তুত এ কাজই হবে নজরুলপ্রীতির মাপকাঠি, তাঁর নামের অনুষ্ঠানে প্রীতি নয়।

এ পর্যন্ত বলেই আমার বক্তব্য শেষ করছি।

ধন্যবাদ, শুভ হোক।

১২.২.১৩৮৮

১. মানুষের পক্ষে

২. নিবেদন

৩. সৃষ্টি রহস্য

৪. ম্যাকগ্লেসান চুলা

অপ্রকাশিত

৫. কৃষকের ভাগ্য গ্রহ

৬. সীজের ফুল

৭. সংক্ষিপ্ত জীবন বাণী

৮. ভাষণ সংকলন

৮.১ মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ভাষণ

৮.২ বাংলাদেশ সোসিও-ফিলসফিক হিউম্যানিস্ট গিল্ড সেমিনারে ভাষণ

৮.৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৪ নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৫ গুণী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৬ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৭ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ

৮.৮ মানবিক উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা সেমিনারে ভাষণ

৮.৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় ভাষণ

৮.১০ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণ

৮.১১ বার্ষিক বৃত্তিপ্রদান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.১২ বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থায় ভাষণ

৮.১৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ

৮.১৪ বাংলাদেশ দর্শন সমিতিতে ভাষণ

৮.১৫ বার্ষিক বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.১৬ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীতে ভাষণ

৮.১৭ বাংলা একাডেমীর সংবর্ধনা ভাষণ

৮.১৮ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর ষষ্ঠ বার্ষিক অনুষ্ঠানে ভাষণ

৯. নির্ঘণ্ট

১০. বিভিন্ন আলোকচিত্র

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x