নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক ঘটনা ভারতবর্ষের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। নকশালবাড়ির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্য-নাটক-গান ইত্যাদির ক্ষেত্রে নতুন যাত্রা যুক্ত করতে এগিয়ে আসেন বহু শিল্পী-সাহিত্যিক-গীতিকার-বুদ্ধিজীবী। এঁদের অনেকেই নকশালবাড়ির আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও বেশির ভাগই ছিলেন নকশালবাড়ির সংগ্রামের সমর্থক, অনুরাগী-পার্টির সদস্য নন।

কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলো ‘তির’ নাটক। উপস্থাপনায়, পরিচালনায়, অভিনয়ে সার্থক নাটক ‘তির’-এ ছিল নকশালবাড়ির সংগ্রামের কথা। ‘তির’ নাটকটি লেখার আগে উৎপল দত্ত নাটকের উপাদান সংগ্রহার্থে নকশালবাড়ি গিয়েছিলেন। সেই সময় এক চক্কর ঘুরে গেলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন মাঠে আয়োজিত জনসভায় তিনি স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গিতে বললেন, “একদিকে নকশালবাড়ি, আর এক দিকে বেশ্যাবাড়ি। মাঝখানে গভীর নোংরা পাঁকের গাড্ডা। আজ ঠিক করে বেছে নিতে হবে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদেরকে, তাঁরা কোন্ বাড়িতে উঠবেন।” পরবর্তীকালে আমাদের সামনে অভিনীত হলো আর এক প্রহসন, যেখানে দেখতে পেলাম শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বানকারী উৎপল দত্তই প্রথম বাড়িটিকে পরিত্যাগ করলেন।

অজিত পাণ্ডে গান লিখলেনঃ

“কৃষ্ণ কি আর কংস কারায়

বেঁধে রাখা যায়?

মাঠে মাঠে লক্ষ কৃষ্ণ

অগ্নি বাঁশের বাঁশি বাজায়।”

উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ভাষায় একটি গান সে সময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কথাগুলো ছিলঃ

“ও নকশাল নকশাল নকশালবাড়ির মা

ওমা তোর বুগোৎ রক্ত ঝরে

সেই অক্ত আজা নিশান লয়্যা

বাংলার চাষী জয়ের ধ্বনি করে।”

গানটি লিখেছিলেন দিলীপ বাগচী। কৃষক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও অনেক গায়ক ও গীতিকারই এগিয়ে এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্যামসুন্দর বসু, প্রতুল মুখার্জি, বিপুল চক্রবর্তী, নীতীশ রায়, কমলেশ সরকার, মেঘনাদ, অলোক সান্যাল, সুরেশ বিশ্বাস। অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন কিছু গোষ্ঠী। যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য ‘অপেরা গ্রুপ’—অজিত পাণ্ডে ছিলেন এই গ্রুপে; ‘গণ বিষাণ’—যাতে ছিলেন জলি বাগচী, পাখি রায়; ‘নিশান্তিকা’—যাতে ছিলেন রমেন সাহা, পার্থ সেন, মানব সেন; ‘অয়নিগোষ্ঠি’-যাতে ছিলেন অমিতেশ সরকার। নকশালবাড়ির সংগ্রামের আগে পর্যন্ত গোটা গণনাট্যের যুগে যত গান রচিত হয়েছিল, নকশালবাড়ির সংগ্রাম পরবর্তী দু-বছরের মধ্যেই তারচেয়েও বেশি গণসঙ্গীত রচিত হয়েছিল।

বহু নাটক এই সময় আমরা পেলাম যেগুলো ছিল নকশালবাড়ির সংগ্রাম দ্বারা প্রভাবিত। মনোরঞ্জন বিশ্বাস লিখলেন ‘পদাতিক’। ‘রণক্ষেত্রে আছি’ মনোরঞ্জনের আর একটি নাটক যা অজস্রবার অভিনীত হয়েছে। শ্যামলতনু দাশগুপ্ত লিখলেন ‘শীতের আগুন’, ‘অগ্নিগর্ভ হেকেমপুর’, ‘তির বিদ্ধ শিকার’। জ্যোছন দস্তিদার লিখলেন ‘গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধ’। অমিতাভ গুপ্ত ওরফে মানস দত্তগুপ্ত লিখলেন ‘হিমালয়ের চেয়ে ভারী’। অমল রায় রচনা করলেন ‘ঘটোৎকচ’, ‘কেননা মানুষ’। নাটক দুটিতে সরাসরি নকশালপন্থী রাজনীতির কথা না থাকলেও বিপ্লবী রাজনৈতিক চিন্তাই ছিল নাটক দুটির ভিত্তিমূল। গৌরব মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘শৌভিক’ নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় বাংলা একাঙ্ক নাটকের ক্ষেত্রে নাটক দুটি এক ইতিহাসই রচনা করে ফেলেছে। অমল রায়ের ‘হট্টমেলায় হট্টগোল’ ছোটদের নাটক হিসাবে অভিনীত হলেও রূপকের মোড়কে বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক। অমল রায়ের হাত থেকেই বেরিয়ে এলো ‘বিপ্লবের গান’, ‘বাস্তিল ভাঙছে’, ‘বিদ্রোহের থিয়েটার’, ‘শববাহকেরা’, ‘দ্রোণাচার্য’ ইত্যাদি। সত্যেন ভদ্রের নাটক ‘যবনিকা কম্পমান’—এ তুলে ধরা হয়েছিল বিপ্লবী যুবকদের কারাগার ভাঙার কাহিনি। নীহার গুণ তাঁর ‘মারীচ’ নাটকে তীব্র আক্রমণ চালালেন সংশোধনবাদের ওপর। মনোজ মিত্রের ‘চাক ভাঙা মধু’তে আমরা ধ্বনিত হতে দেখলাম ‘শ্রেণীশত্রু খতম’-এর লাইন। মোহিত চট্টোপাধ্যায় ‘গিনিপিগ’ ও ‘রাজরক্ত’ নাটকে রূপকের মধ্যে দিয়ে শাসকদের স্বৈরাচারী বর্বরতার রূপকে তুলে ধরলেন।

পার্টির সদস্য নন কিন্তু নকশালবাড়ির সংগ্রামে শ্রদ্ধাবান সমর্থক শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল এই সময় অতিমাত্রায়। কারণ, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে চাইলে সশস্ত্র আঘাত হানার জন্য সংগ্রামী মানুষের বাহিনী নামাবারও আগে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বাহিনীকে নামান। এ কথা সমস্ত শ্রেণির পক্ষেই অতি বাস্তব সত্য। কিন্তু এমন বাস্তব সত্যকেই অনুধাবন করতে অক্ষম হলেন নেতৃত্ব। সাংস্কৃতিক বাহিনীর সাহায্যে সাধারণের মগজ ধোলাই করে ময়লা সাঙ্গ করার যে কথা ইয়েন্যানে মাও সেতুঙ বলেছিলেন—নেতৃত্ব সে কথাকে তেমন আমলই দিলেন না। বরং নেতৃত্ব এইসব সমচিন্তার মানুষদের নিয়ে ফ্রন্ট গড়ার বদলে পার্টির বাইরের শিল্পী-নাট্যকার-সাহিত্যিকদের প্রতি যথেষ্ট বিরূপতাই প্রকাশ করেছিলেন। নেতৃত্বের এমন অপরিপক্বতা এবং ভ্রান্তির জন্যই সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার সাবলীল গতির প্রচেষ্টা অবশ্যই বাধা-প্রাপ্ত হয়েছিল।

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ বিভ্রান্তির সংস্কৃতিঃ বাঁচাও তাহারে মারিয়া

অধ্যায়ঃ দুই

♦ অপসংস্কৃতি ও সুস্থ সংস্কৃতিঃ পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হোক সুচেতনার পথে

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ পৃথিবীর পথে হাজার বছর হাঁটা

অধ্যায়ঃ চার

♦ ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ কেউ কথা রাখেনি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ নকশালবাড়ির সংগ্রামে উব্ধুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন, সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ এসো আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই

অধ্যায়ঃ সাত

♦ ‘যুক্তিবাদ’ একটা সম্পূর্ণ দর্শন, একটা বস্তুবাদী বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতিঃ কুয়াশা কাটে, কাটে নেশা, আকাশের ঘষা-সূর্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়

অধ্যায়ঃ আট

♦ যুক্তির পথচলাঃ লোভের অন্ধকারে ঢোকে না দিনের আলো

অধ্যায়ঃ নয়

♦ অতি ব্যবহৃত কিছু শব্দঃ সিন্দুকেতে মন ভরেছে ভেতরে তার কি আছে কেই বা রাখে খোঁজ?

“সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!