শ্লোকঃ ৩০

যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি ।

তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি ॥ ৩০ ॥

মঃ – যিনি; মাম্—আমাকে; পশ্যতি –দর্শন করেন; সর্বত্র — সর্বত্র; সর্বস্—সব কিছু, চ—এবং; ময়ি—আমাতে; পশ্যতি –দর্শন করেন; তস্য – তাঁর; অহম্—আমি; ন– না; প্রণশ্যামি —হারিয়ে যাই; সঃ—তিনি; চ—ও; মে— আমার, ন–না; প্রণশ্যতি— হারিয়ে যান।

গীতার গান

সে দেখে আমারে সব স্থাবর জঙ্গমে ৷

অন্য দৃষ্টি নাহি তার নির্গুণ সঙ্গমে ॥

সে হয় আমার প্রেমী আমি হই তার ।

নীরস শুকনা তর্ক নহে ব্যবহার ॥

অনুবাদঃ যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না।

তাৎপর্যঃ আত্ম- কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত নিঃসন্দেহে সর্বত্র ভগবানকে দর্শন করেন এবং তিনি সব কিছুই ভগবানের মধ্যে দেখতে পান। যদিও মনে হতে পারে যে, এই ধরনের মানুষ মায়ার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশকে সাধারণ মানুষের মতো ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখছেন, কিন্তু তিনি অনুভব করেন যে, সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরই প্রকাশ, তাই তিনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনাময়। শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না এবং শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সব কিছুর ঈশ্বর। এটিই কৃষ্ণভাবনার মূলতত্ত্ব। কৃষ্ণভাবনামৃতের উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণপ্রেমের বিকাশ করা—এই স্তর জড় বন্ধন-মুক্তির অতীত। উপলব্ধির অতীত কৃষ্ণভাবনার এই স্তরে ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান, অর্থাৎ তাঁর কাছে তখন সব কিছুই কৃষ্ণময় হয়ে ওঠে এবং তিনিও তখন পূর্ণরূপে কৃষ্ণপ্রেমে আবিষ্ট হয়ে যান। ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে তখন এক নিবিড় অন্তরঙ্গ প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই অবস্থায় জীব কখনই বিনাশ প্রাপ্ত হয় না, তখন শ্রীকৃষ্ণ আর কখনও তাঁর ভক্তের দৃষ্টির অগোচর হন না। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে লীন হলে আত্মার স্বাতন্ত্র্যের বিনাশ হয়। তাই ভক্ত কখনও এই ভুল করেন না। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৮) বলা হয়েছে—

প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তিবিলোচনেন

সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি ।

যং শ্যামসুন্দরমচিন্ত্যগুণস্বরূপং

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।

“প্রেমাঞ্জন দ্বারা রঞ্জিত ভক্তিচক্ষু বিশিষ্ট সাধুরা যে অচিন্ত্য গুণসম্পন্ন শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণকে হৃহৃদয়ে অবলোকন করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”

এই প্রেমাবস্থায়, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কখনই তাঁর ভক্তের দৃষ্টির অগোচর হন না এবং ভক্তও ভগবানের দৃষ্টির অগোচর হন না। যে সিদ্ধ যোগী তাঁর হৃদয়ে পরমাত্মারূপে ভগবানকে দর্শন করছেন, তিনিও এভাবেই নিরন্তর ভগবানকে দর্শন করেন। এই ধরনের সিদ্ধ যোগী শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তে পরিণত হন এবং তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভগবানকে না দেখে থাকতে পারেন না।

শ্লোকঃ ৩১

সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ ।

সর্বথা বর্তমানোঽপি স যোগী ময়ি বর্ততে ৷৷ ৩১ ৷৷

সর্বভূতস্থিতম্—সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত, যঃ – যিনি; মাম্ — আমাকে ; ভজতি — ভজনা করেন; একত্বম্ — অভিন্নরূপে; আস্থিতঃ – আশ্রয়পূর্বক, সর্বথা— সর্বতোভাবে, বর্তমানঃ — অবস্থিত হয়ে; অপি— সত্ত্বেও; সঃ – তিনি; যোগী—যোগী; ময়ি—আমাতে; বর্ততে—অবস্থান করেন।

গীতার গান

সর্বভূতস্থিত দেখে সর্বত্র আমারে ৷

ভজনে আস্থিত হয়ে সেবয়ে সে মোরে ॥

সে যোগী নিখিল ভবে সর্বত্র থাকিয়া।

আমাতে বসয়ে নিত্য আমারে ভজিয়া ॥

অনুবাদঃ যে যোগী সর্বভুতে স্থিত পরমাত্মা রূপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন।

তাৎপর্যঃ যে যোগী পরমাত্মার ধ্যান করেন, তিনি তাঁর হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের আংশিক প্রকাশ শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভূজ বিষ্ণুকে দর্শন করেন। যোগীদের এটি জানা উচিত যে, শ্রীকৃষ্ণ থেকে শ্রীবিষ্ণু ভিন্ন নন। শ্রীকৃষ্ণই পরমাত্মা বিষ্ণুরূপে সর্বজীবের অন্তরে বিরাজ করেন। তা ছাড়া, অসংখ্য জীবের অন্তরে যে অসংখ্য পরমাত্মা বিরাজ করছেন, তাঁরাও ভিন্ন নন। তেমনই, ভক্তিযোগে তন্ময় কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত এবং পরমাত্মা বিষ্ণুর ধ্যানে মগ্ন যোগীর মধ্যেও কোন পার্থক্য নেই। কৃষ্ণভাবনাময় যোগী এই জড় জগতে অবস্থানকালে নানা রকম জাগতিক কাজে ব্যস্ত থাকলেও তিনি সর্বদা শ্রীকৃষ্ণে অবস্থান করেন। ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে (পূর্ব ২/১৮৭) শ্রীল রূপ গোস্বামী সেই সম্বন্ধে বলেছেন— নিখিলাস্বপ্যবস্থাসু জীবন্মুক্তঃ স উচ্যতে। সর্বদাই কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত সর্ব অবস্থাতেই জীবন্মুক্ত। নারদ পঞ্চরাত্রেও সেই সম্পর্কে বলা হয়েছে—

দিকালাদানবচ্ছিন্নে কৃষ্ণে চেতো বিধায় চ।

তন্ময়ো ভবতি ক্ষিপ্রং জীবো ব্ৰহ্মণি যোজয়ে।।

“যিনি একাগ্র চিত্তে স্থান-কালের অতীত শ্রীকৃষ্ণের সর্বব্যাপক শ্রীবিগ্রহের ধ্যান করেন, তিনি কৃষ্ণভাবনায় তন্ময় হন এবং শ্রীকৃষ্ণের দিব্য সান্নিধ্য লাভ করে চিন্ময় আনন্দ অনুভব করেন।”

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন হওয়াটাই যোগ সাধনার পরম সিদ্ধি । সমাধিযুক্ত যোগী যখন উপলব্ধি করতে পারেন যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা রূপে সর্বজীবের অন্তরে বিরাজ করছেন, তখনই তিনি সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হন। শ্রীকৃষ্ণের অচিন্তা শক্তির সমর্থন করে বেদে (গোপালতাপনী উপনিষদ ১/২১) বলা হয়েছে, একোঽপি সন্ বহুধা যোহরভাতি — “যদিও ভগবান একজন, তিনি বহুরূপে অসংখ্য হৃদয়ে বিরাজমান।” অনুরূপভাবে, স্মৃতি-শাস্ত্রে বলা হয়েছে

এক এর পরো বিষ্ণুঃ সর্বব্যাপী ন সংশয়ঃ।

ঐশ্বর্যাদৄপমেকং চ সূর্যবং বহুধেয়তে ।।

“অদ্বিতীয় হলেও শ্রীবিষ্ণু নিঃসন্দেহে সর্বব্যাপক। তাঁর অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে এক বিগ্রহরূপে তিনি সর্বত্রই বিদ্যমান। সূর্যের মতো তিনিও একই সময় বহু স্থানে দৃষ্ট হন।”

শ্লোকঃ ৩২

আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন ।

সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ ॥ ৩২ ৷৷

আত্ম—নিজের; ঔপম্যেন—তুলনার দ্বারা; সর্বত্র — সর্বত্র, সমম্ – সমভাবে; পশ্যতি–দর্শন করেন; যঃ – যিনি; অর্জুন – হে অর্জুন; সুখম্ সুখ; বা—অথবা, যদি — যদি; বা—অথবা দুঃখম্ –দুঃখ; সঃ— সেই; যোগী – যোগী; পরমঃ- সর্বশ্রেষ্ঠ; মতঃ—মনে করা হয়।

গীতার গান

বসুধা কুটুম্ব তার কেহ নহে পর ।

প্রাকৃত বিচার নাই স্বপর অপর ৷।

নিজ সুখ নিজ দুঃখ অন্যেতে ব্যবহার ।।

সেই সে সমানদর্শী সর্বত্র প্রচার ॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন ! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছেন পরম যোগী। নিজের অনুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সকলেরই সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে সচেতন। ভগবানের সঙ্গে তার শাশ্বত সম্পর্কের কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই জীব ক্লেশভোগ করে। আবার পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণই যে মানুষের সমস্ত কার্যকলাপের পরম ভোক্তা, সমস্ত দেশ ও গ্রহলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের অন্তরঙ্গ সুহৃদ, সেই সত্যকে উপলব্ধি করাই হচ্ছে তার সুখের কারণ। সিদ্ধ যোগী জানেন যে, জড়া প্রকৃতির গুণে আবদ্ধ জীব শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার নিত্য সম্পর্কের কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই ত্রিতাপ ক্লেশ ভোগ করছে। আর কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত, যিনি পূর্ণ আনন্দের স্বাদ লাভ করেছেন, তিনি চান যে, আর সকলেই সেই দিব্য আনন্দ লাভ করুক, তাই তিনি সমস্ত বিশ্বে কৃষ্ণভাবনামৃত বিতরণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। যথার্থ যোগী কৃষ্ণভাবনামৃতের গুরুত্ব প্রচার করার প্রয়াসী হন, তাই তিনি এই জগতের শ্রেষ্ঠ পরোপকারী এবং তিনি হচ্ছেন ভগবানের প্রিয়তম সেবক। ন চ তস্মান্মনুষ্যেষু কশ্চিন্নে প্রিয়কৃত্তমঃ (গীতা ১৮/৬৯)। পক্ষান্তরে, ভগবদ্ভক্ত জীবের কল্যাণ সাধনে নিত্য তৎপর, তাই তিনি সকলের প্রকৃত সুহৃদ। তাকে সর্বোত্তম যোগী বলা হয়, কারণ তিনি স্বার্থসিদ্ধির জন্য যোগের সিদ্ধি কামনা করেন না, বরং তিনি সমস্ত জীবের যথার্থ কল্যাণ সাধনে নিত্য যুক্ত। তিনি কারও প্রতি হিংসা, দ্বেষ আদি মনোভাব পোষণ করেন না। শুদ্ধ ভক্ত ও সিদ্ধিকামী যোগীর মধ্যে এটিই হচ্ছে পার্থক্য। সিদ্ধি লাভ করার আশায় যে যোগী নির্জনে বসে ধ্যান করেন, তিনি স্বার্থ চিন্তায় মগ্ন। কিন্তু যে ভগবদ্ভক্ত প্রতিটি মানুষকে কৃষ্ণভক্তে পরিণত করবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, তিনি নির্জনে ধ্যানরত যোগীর থেকে অনেক উচ্চমার্গে অবস্থিত।

error: Content is protected !!