শ্লোকঃ ২৭
প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্ ৷
উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্ ॥ ২৭ ॥
প্রশান্ত—প্রশান্ত, শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে নির্বিষ্ট; মনসম্—যাঁর মন; হি— নিশ্চিতভাবে; এনম্—এই; যোগিনম্—যোগী; সুখম্—সুখ; উত্তমম্—সর্বোত্তম; উপৈতি — প্রাপ্ত হন; শান্তরজসম্— রজগুণ প্রশমিত; ব্রহ্মভূতম্ — ব্রহ্মভাব সম্পন্ন; অকল্মষম্— নিষ্পাপ।
গীতার গান
প্রশান্ত হইলে মন সুখ উত্তম যোগীর
শান্ত হয় রজোগুণ নিষ্পাপ শরীর ॥
নিষ্পাপ হইলে সেই সত্ত্বগুণে স্থিত ৷
ব্রহ্মভূত নাম তার শুদ্ধ সমাহিত ৷।
অনুবাদঃ ব্রহ্মভাব-সম্পন্ন, প্রশান্ত চিত্ত, রজোগুণ প্রশমিত ও নিষ্পাপ হয়ে যাঁর মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে, তিনিই পরম সুখ প্রাপ্ত হন।
তাৎপর্যঃ জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় সর্বতোভাবে নিয়োজিত হওয়াকে বলা হয় ব্রহ্মভূত। মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্ (ভঃ গীঃ ১৮/৫৪)। ভগবানের চরণারবিন্দে মন স্থিত না হওয়া পর্যন্ত ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায় না। স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োঃ। ভগবদ্ভক্তি বা কৃষ্ণভাবনামৃতে নিত্য তন্ময় থাকলে রজোগুণ এবং সব রকম জড় কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া যায়।
শ্লোকঃ ২৮
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ ৷
সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে ॥ ২৮ ॥
যুঞ্জন— যোগযুক্ত হয়ে; এবম্—এভাবে; সদা — সর্বদা; আত্মানম্ — আত্মাকে; যোগী—যিনি পরম আত্মার সঙ্গে যুক্ত; বিগত—মুক্ত; কল্মষঃ—সর্বপ্রকার জড় কলুষ থেকে; সুখেন—চিন্ময় সুখে; ব্রহ্মসংস্পর্শম্—পরব্রহ্মের সঙ্গে নিরন্তর যুক্ত হয়ে; অত্যন্তম্ পরম সুখম্ — সুখ; অশ্রুতে—লাভ করেন।
গীতার গান
বিধৌত সমস্ত পাপ যোগী অকল্মষ ।
সুখে ব্রহ্মসংস্পর্শ সে ক্রমশ ক্রমশ ৷৷
ব্রহ্মসুখে মগ্ন হয় সে যোগী তখন ৷
প্রাকৃত গুণাদি ত্যজি ব্ৰহ্ম অনুভব ৷।
ব্রহ্মস্পর্শ কিবা হয় কেমনে তা জানি।
সর্বভূত ব্রহ্মে দর্শন সর্ব ব্ৰহ্ম জানি ॥
অনুবাদঃ এভাবেই আত্মসংযমী যোগী জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম- সংস্পর্শরূপ পরম সুখ আস্বাদন করেন।
তাৎপর্যঃ আত্মদর্শনের অর্থ হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে আমাদের যে নিত্য সম্পর্ক রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বরূপ উপলব্ধি করা। জীবাত্মা হচ্ছে ভগবানের অপরিহার্য অংশ। তাই, তার কর্তব্য হচ্ছে ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা করা। ভগবানের সঙ্গে এই অপ্রাকৃত সম্পর্ককে বলা হয় ব্রহ্মসংস্পর্শ।
শ্লোকঃ ২৯
সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি ।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ৷৷ ২৯ ॥
সর্বভূতস্থম্—সমস্ত প্রাণীতে স্থিত; আত্মানম্—পরমাত্মাকে; সর্ব— সমস্ত; ভূতানি — জীব; চ—ও; আত্মনি—আত্মায়; ঈক্ষতে –দর্শন করেন; যোগযুক্তাত্মা—কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত; সর্বত্র—সর্বত্র; সমদর্শনঃ—সমদর্শন।
গীতার গান
সর্বত্র সমান দৃষ্টি যোগযুক্ত আত্মা ।
সমাধিস্থ সেই যোগী দেখে পরমাত্মা ।।
অনুবাদঃ প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণচেতনাময় যোগীই হচ্ছেন প্রকৃত দ্রষ্টা, কারণ তিনি সকলের অন্তরে পরমাত্মারূপে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করেন। ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি। পরমাত্মারূপে ভগবান সকলের হৃদয়ে অবস্থান করেন। তিনি যেমন ব্রাহ্মণের হৃদয়ে
অবস্থান করছেন, তেমনই আবার একটি কুকুরের হৃদয়েও অবস্থান করছেন। যথার্থ যোগী জানেন যে, ভগবান হচ্ছেন নিত্য চিন্ময়, তাই তিনি একটি কুকুরের হৃদয়েই অবস্থান করুন অথবা একজন সৎ ব্রাহ্মণের হৃদয়েই অবস্থান করুন, জড় কলুষের দ্বারা তিনি কখনও প্রভাবিত হন না। এটিই হচ্ছে ভগবানের পরম নিরপেক্ষতা। স্বতন্ত্র জীবাত্মাও স্বতন্ত্র হৃদয়ে অবস্থান করে, কিন্তু সে সর্বজীবের হৃদয়ে অবস্থান করে না। সেটিই হচ্ছে পরমাত্মা ও জীবাত্মার পার্থক্য। যে বাস্তবিকপক্ষে যোগ সাধনে রত নয়, সে তত স্পষ্টভাবে দর্শন করতে পারে না। একজন কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কৃষ্ণভক্ত আপনা থেকেই বিশ্বাসী অবিশ্বাসী উভয়ের অন্তরে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারেন। স্মৃতি শাস্ত্রে সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে— আততত্বাচ্চ মাতৃত্বাচ্চ আত্মা হি পরমো হরিঃ। সর্বজীবের উৎস হরি মায়ের মতো সকলকে পালন করেন। মা যেমন তাঁর সব কয়টি সন্তানের প্রতি সমদৃষ্টি-সম্পন্ন, পরম পিতা বা মাতা ভগবানও তেমন সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। পরমাত্মারূপে তিনি সকলের অন্তরে বিরাজ করেন।
বাহ্যিকভাবেও, প্রতিটি জীব ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তিতে অবস্থিত। ভগবানের শক্তির মুখ্য প্রকাশ হচ্ছে তাঁর চিৎ-শক্তি বা পরা শক্তি এবং জড়া শক্তি বা অপরা শক্তি। এই সম্বন্ধে ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। জীব ভগবানের পরা শক্তির অংশ হলেও সে অপরা শক্তির দ্বারা বন্ধ হয়ে পড়েছে। জীব সর্বদাই ভগবানের শক্তিতে অধিষ্ঠিত। প্রতিটি জীবই কোন না কোনভাবে ভগবানের মধ্যে অবস্থিত।
যোগী সর্বভূতে সমদৃষ্টি-সম্পন্ন, কারণ তিনি দেখেন যে, জীব তাদের কর্মফল অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকলেও সর্ব অবস্থাতেই তারা ভগবানের নিত্যদাস। জীব যখন ভগবানের অপরা শক্তিতে বদ্ধ অবস্থায় থাকে, তখন সে জড় ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করে; যখন সে ভগবানের পরা শক্তিতে অধিষ্ঠিত হয়, তখন সে সাক্ষাৎ ভগবানের সেবায় তৎপর হয়। উভয় অবস্থাতে জীব ভগবানেরই দাসত্ব করে। সর্বভূতের প্রতি এই যে সমদর্শন, তা কেবল কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই পূর্ণরূপে প্রাপ্ত হন।