শ্লোকঃ ২৪
স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোঽনির্বিন্নচেতসা ।
সংকল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্বানশেষতঃ ।
মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ ॥ ২৪ ॥
সঃ—সেই যোগ; নিশ্চয়েন — অধ্যবসায় সহকারে; যোক্তব্যঃ – সাধন করা কতর্ব্য; যোগঃ—যোগপদ্ধতি; অনির্বিঘ্নচেতসা –অবিচলিতভাবে; সংকল্প— সংকল্প; প্রভবান্—জাত; কামান্—কামনা; ত্যক্ত্রা— ত্যাগ করে; সর্বান্—সমস্ত; অশেষতঃ —পূর্ণরূপে; মনসা —মনের দ্বারা; এব—অবশ্যই; ইন্দ্রিয়গ্রামম্ — ইন্দ্ৰিয়সমূহকে; বিনিয়ম্য— নিয়ন্ত্রিত করে; সমস্ততঃ — সমস্ত দিক থেকে।
গীতার গান
উৎসাহ ধৈর্য আর নিলয় আত্মিকা ।
যোগসিদ্ধি লাগি ছাড়ি নির্বেদ প্রাপিকা ৷।
সংকল্প সমস্ত দ্বারা না হয়ে কিঞ্চিৎ ।
মন দ্বারা ইন্দ্রিয়কে করিয়া বিজিত ॥
অনুবাদঃ অবিচলিত অধ্যবসায় ও বিশ্বাস সহকারে এই যোগ অনুশীলন করা উচিত। সংকল্পজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সব দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করা কর্তব্য।
তাৎপর্যঃ যোগীকে দৃঢ় সংকল্প ও ধৈর্য সহকারে অবিচলিত থেকে যোগ অভ্যাস করতে হয়। এক সময় না এক সময় সাধনার সিদ্ধি অবশ্যই হবে—এভাবেই পূর্ণ আশাবাদী হয়ে গভীর ধৈর্য সহকারে এই পথ অনুসরণ করতে হয়। সাফল্য লাভে বিলম্ব হলে হতোদ্যম হওয়া কখনই উচিত নয়। কারণ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যিনি যোগ অভ্যাস করেন, তিনি অবশ্যই সাফল্য লাভ করেন। ভক্তিযোগ সম্বন্ধে শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন—
উৎসাহানিশ্চয়াদ্ধৈর্যাৎ তত্তৎকর্মপ্রবর্তনা ।
সঙ্গত্যাগাৎ সতো বৃত্তেঃ যড়ভিভক্তিঃ প্রসিধ্যতি ॥
“আন্তরিক উৎসাহ, ধৈর্য ও দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে ভক্তসঙ্গে ভক্তির অনুকূল কর্ম করে এবং কেবল সত্ত্বগুণময়ী কর্ম করার ফলে ভক্তিযোগে সাফল্য লাভ করা যায়। ” (উপদেশামৃত ৩) দৃঢ় সংকল্প সম্বন্ধে সেই চড়াই পাখির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত, যার ডিম সাগরের জলে ভেসে গিয়েছিল। একটি চড়াই পাখি সমুদ্রের তীরে ডিম পেড়েছিল, কিন্তু মহাসমুদ্রের দুর্বার তরঙ্গে সেই ডিমগুলি ভেসে যায়। অত্যন্ত মর্মাহত চিত্তে সেই চড়াই পাখি তখন সমুদ্রের কাছে আবেদন করে তার ডিমগুলি ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সমুদ্র তার সেই আবেদনে কর্ণপাতই করেনি। তখন সেই চড়াই পাখি সমুদ্রকে শুকিয়ে ফেলার সংকল্প করে তার ছোট্ট ঠোঁটে সমুদ্রের জল তুলতে লাগল। তার এই অসম্ভব সংকল্পের জন্য সকলেই তাকে পরিহাস করতে লাগল। এদিকে সেই চড়াই পাখির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অবশেষে বিষ্ণুর বাহন পক্ষীরাজ গরুড়ের কানে সেই কথা পৌঁছল এবং তাঁর ছোট্ট বোনটির জন্য সহানুভূতিতে তাঁর হৃদয় ভরে উঠল। তিনি সেই ছোট্ট চড়াই পাখিটিকে দেখতে সেই সমুদ্রের তীরে এলেন। গরুড় চড়াই পাখির এই দৃঢ় সংকল্প দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তারপর তিনি সমুদ্রকে আদেশ করলেন চড়াই পাখির ডিমগুলি ফিরিয়ে দিতে, আর সে যদি তা না করে, তা হলে তিনিই সেই চড়াই পাখির কাজটি সম্পন্ন করবেন, সেই কথাও তিনি সমুদ্রকে জানিয়ে দিলেন। ভীতগ্রস্ত হয়ে সমুদ্র তখন চড়াই পাখির ডিমগুলি ফিরিয়ে দিলেন। এভাবেই গরুড়ের কৃপায় সেই চড়াই পাখি তার ডিম ফিরে পেয়ে সুখী হল।
তেমনই, যোগসাধনা করা, বিশেষ করে ভগবানের সেবার মাধ্যমে ভক্তিযোগ সাধন করাকে ভীষণ কঠিন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিযোগের অনুশীলন করেন, তখন ভগবান তাঁকে নিঃসন্দেহে সাহায্য করবেন, কেন না যে নিজেকে সাহায্য করে, ভগবান তাকে সব রকমের সাহায্য করেন ।
শ্লোকঃ ২৫
শনৈঃ শনৈরুপরমেদ বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া ।
আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ ॥ ২৫ ॥
শনৈঃ শনৈঃ—ধীরে ধীরে; উপরমেং – নিবৃত্তি করে; বুদ্ধ্যা— বুদ্ধির দ্বারা ধৃতিগৃহীতয়া — ধৈর্যযুক্ত; আত্মসংস্থম্—চিন্ময় স্তরে স্থিত; মনঃ —মন; কৃত্বা করে; ন—না; কিঞ্চিদপি—অন্য কোন কিছুই; চিন্তয়েৎ— চিন্তা করা উচিত।
গীতার গান
ক্রমে ক্রমে উপরাম বিষয় ভোগেতে ।
আত্মস্থিত মন করি বিরাম চিন্তাতে ॥
অনুবাদঃ ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে আত্মাতে স্থির করে এবং অন্য কোন কিছুই চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়।
তাৎপর্যঃ সুদৃঢ় বিশ্বাস ও বুদ্ধির প্রভাবে ইন্দ্রিয়গুলিকে ধীরে ধীরে বশ করতে হয়। একেই বলা হয় ‘প্রত্যাহার’। সুদৃঢ় বিশ্বাস, ধ্যান ও ইন্দ্রিয় নিবৃত্তির দ্বারা মনকে সর্বতোভাবে সংযত করে সমাধিস্থ করতে হয়। তখন আর দেহতে আত্মবুদ্ধি হওয়ার কোন আশঙ্কা থাকে না। পক্ষান্তরে বলা যায়, যতক্ষণ জড় দেহের অস্তিত্ব আছে, ততক্ষণ জড় জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, কখনই ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কথা চিন্তা করা উচিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তৃপ্তির কথা ছাড়া আর অন্য কোন সুখের কথা কল্পনা করাও উচিত নয়। সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার ফলে অনায়াসে এই স্থিতি লাভ করা যায়।
শ্লোকঃ ২৬
যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্ ।
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ ৷। ২৬ ।৷
যতঃ যতঃ– যে যে বিষয়ে; নিশ্চলতি – অত্যন্ত বিচলিত হয়; মনঃ—মন; চঞ্চলম্—চঞ্চল; অস্থিরম্—অস্থির; ততঃ ততঃ– সেই সেই বিষয় থেকে, নিয়মা নিয়ন্ত্রিত করে; এতৎ— এই; আত্মনি – আত্মাতে; এব—অবশ্যই; বশম্–বশে; নিয়ে আনবে।
গীতার গান
অস্থির চঞ্চল মন যথা যথা ধায় ৷
চেষ্টা করি সেই মন বশেতে রাখয় ॥
আত্মার বশেতে মন সদাই রাখিবে
চঞ্চল স্বভাব তার শোধন করিবে ॥
অনুবাদঃ চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে আত্মার বশে আনতে হবে।
তাৎপর্যঃ মন স্বভাবতই অস্থির ও চঞ্চল। কিন্তু আত্মতত্ত্বজ্ঞ যোগীর কর্তব্য হচ্ছে সেই মনকে নিয়ন্ত্রিত করা, মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া তাঁর কখনই উচিত নয়। যিনি তাঁর মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে বশ করতে পেরেছেন, তাঁকে বলা হয় গোস্বামী অথবা স্বামী; আর যে মনের অধীন তাকে বলা হয় গোদাস, অর্থাৎ সে তার ইন্দ্রিয়ের দাস। বিষয় ভোগের নিরর্থকতা একজন গোস্বামী ভালমতেই জানেন। অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়সুখে, ইন্দ্রিয়গুলি হৃষীকেশ অথবা ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিরন্তর যুক্ত থাকে। বিশুদ্ধ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা। ইন্দ্রিয়গুলিকে পূর্ণরূপে বশ করার সেটিই হচ্ছে প্রকৃষ্ট পন্থা। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সেটিই যোগ সাধনার পরম সিদ্ধি ।