শ্লোকঃ ১৮
যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে ।
নিস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা ৷৷ ১৮ ৷৷
যদা —যখন; বিনিয়তম্ — বিশেষভাবে সংযত; চিত্ত—মন এবং তার কার্যকলাপ; আত্মনি—আত্মাতে; এর — নিশ্চিতভাবে; অবতিষ্ঠতে — অবস্থান করে; নিস্পৃহঃ- স্পৃহাশূন্য; সর্ব—সর্বপ্রকার; কামেভ্যঃ – কামনা থেকে; যুক্তঃ – যোগযুক্ত; ইতি— এভাবে; উচ্যতে—বলা হয়; তদা—তখন ।
গীতার গান
যতাত্মা বিনিয়ত চিত্ত আত্মতুষ্ট ৷
নিস্পৃহ যে সর্বকামে সেই যোগপুষ্ট ৷।
অনুবাদঃ যোগী যখন অনুশীলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবং সমস্ত জড় কামনা- বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করেন, তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়।
তাৎপর্যঃ সাধারণ মানুষের কার্যকলাপের সঙ্গে যোগীর কার্যকলাপের পার্থক্য হচ্ছে যে, যোগী কোন অবস্থাতেই জড়-জাগতিক কামনা-বাসনা বিশেষ করে যৌনসঙ্গের দ্বারা প্রভাবিত হন না। যথার্থ যোগীর মনঃক্রিয়া এত সংযত যে, তিনি কোন রকম জাগতিক বাসনার দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত আপনা থেকেই এই অতি উৎকৃষ্ট অবস্থা প্রাপ্ত হন। সেই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে (৯/৪/১৮-২০) বলা হয়েছে–
স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়ো-
বচাংসি বৈকুণ্ঠগুণানুবর্ণনে ।
করৌ হরেমন্দিরমার্জনাদিষু
শ্রুতিং চকারাচ্যুতসৎকথোদয়ে ।।
মুকুন্দলিঙ্গালয়দর্শনে দৃশো
তদভূত্যগাত্র স্পর্শেইঙ্গসঙ্গমম্ ।
ঘ্রাণং চ তৎপাদসরোজসৌরভে
শ্রীমতুলস্যা রসনাং তদপিতে ॥
পাদৌ হরেঃ ক্ষেত্রপদানুসর্পণে
শিরো হৃষীকেশপদাভিবন্দনে ।
কামং চ দাস্যে ন তু কার্যকামায়া
যথোত্তমশ্লোকজনাশ্রয়া রতিঃ ॥
“মহারাজ অম্বরীষ সর্বপ্রথমে তাঁর মনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের ধ্যানে মগ্ন করেছিলেন। তারপর ক্রমশ তিনি তাঁর বাণী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা বর্ণনায় নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর হস্ত দ্বারা তিনি ভগবানের মন্দির মার্জনা করেছিলেন, তাঁর শ্রবণ-ইন্দ্রিয় দ্বারা ভগবানের লীলা শ্রবণ করেছিলেন, তাঁর চক্ষু দ্বারা ভগবানের অপ্রাকৃত রূপ দর্শন করেছিলেন, তাঁর ত্বক-ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি ভগবদ্ভক্তের দেহ স্পর্শ করেছিলেন এবং তাঁর ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি ভগবানের শ্রীচরণে অর্পিত পদ্ম ফুলের ঘ্রাণ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জিহ্বা দিয়ে ভগবানের শ্রীচরণে অর্পিত তুলসীর স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর পদযুগল দ্বারা তিনি বিভিন্ন তীর্থস্থানে এবং ভগবানের মন্দিরে গমন করেছিলেন, তাঁর মস্তক দিয়ে তিনি ভগবানকে প্রণতি নিবেদন করেছিলেন এবং তাঁর সমস্ত কামনাকে তিনি ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। এই সমস্ত অপ্রাকৃত কর্মগুলি শুদ্ধ ভক্তেরই যোগ্য।”
নির্বিশেষবাদীদের পক্ষে এই অপ্রাকৃত অবস্থার কথা অনুমান করা অসম্ভব হতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তের পক্ষে তা অত্যন্ত সুগম এবং ব্যবহারিক, যা মহারাজ অম্বরীষের কার্যকলাপের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। অনবরত স্মরণের দ্বারা মন যতক্ষণ না ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে একাগ্র হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অপ্রাকৃত ভগবৎ-সেবায় এই রকম তৎপরতা সম্ভব নয়। ভক্তিমার্গে এই সমস্ত বিহিত কর্মগুলিকে বলা হয় ‘অন’ অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করা। মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে কোন না কোন কর্মে অবশ্যই নিযুক্ত করতে হয়। কর্মবিরত হয়ে মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা কোন মতেই সম্ভব নয়। তাই, সাধারণ মানুষের বিশেষ করে যারা সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেন, তাদের পক্ষে পূর্ববর্ণিত বিধি অনুসারে ইন্দ্রিয়গুলিকে ও মনকে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করাই ভগবৎ-প্রাপ্তির যথার্থ পন্থা। ভগবদ্গীতায় একে যুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ১৯
যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা
যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ ॥ ১৯ ॥
যথা—যেমন; দীপঃ—প্রদীপ; নিবাতস্থঃ বায়ুশূন্য স্থানে; ন–না; ইঙ্গতে — বিচলিত হয়; সা উপমা – সেই উপমা; স্মৃতা – বিবেচিত হয়; যোগিনঃ – যোগীর; যতচিত্তস্য – সংযতচিত্ত; যুঞ্জতঃ– অভ্যাসকারী; যোগম্—যোগ; আত্মনঃ—আত্ম- বিষয়ক।
গীতার গান
যথা দীপ বিনা বায়ু স্থিরভাবে থাকে ।
উত্তম উপমা সেই যোগীর নিষ্ঠাকে ॥
অনুবাদঃ বায়ুশূন্য স্থানে দীপশিখা যেমন কম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও তেমনইভাবে অবিচলিত থাকে।
তাৎপর্যঃ বাতাস না থাকলে দীপশিখা যেমন স্থিরভাবে জ্বলে, সর্বতোভাবে পরব্রহ্মের চিন্তায় ধ্যানস্থ হয়ে আছেন যে ভক্ত, তাঁর চিত্তও সেই দীপশিখার মতোই স্থির নিশ্চল।
শ্লোকঃ ২০-২৩
যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া ।
যত্র চৈবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি ॥ ২০ ॥
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্ ।
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ ॥ ২১ ॥
যং লক্কা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ ৷
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥ ২২ ৷৷
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্ ॥ ২৩ ॥
যত্র—যে অবস্থায়; উপরমতে—নিবৃত্তি হয়; চিত্ত—চিত্ত; নিরুদ্ধম্—জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়; যোগসেবয়া—যোগ অনুষ্ঠানের দ্বারা; যত্র—যেখানে; চ— ও; এব—অবশ্যই; আত্মনা—শুদ্ধ মনের দ্বারা; আত্মানম্—আত্মাকে; পশ্যন্— উপলব্ধি করে; আত্মনি—আত্মাতে; তুষ্যতি —তুষ্ট হয়; সুখম্ —সুখ, আত্যন্তিকম্ – পরম; যৎ—যা; তৎ—তা; বুদ্ধি – বুদ্ধি দ্বারা; গ্রাহ্যম্—গ্রহণযোগ্য; অতীন্দ্রিয়ম্— অপ্রাকৃত; বেত্তি—জানেন; যত্র— যেখানে; ন–না; চ–ও; এব—অবশ্যই: অয়ম্— এই অবস্থায়; স্থিতঃ—অবস্থিত; চলতি — বিচলিত হন; তত্ত্বতঃ – আত্মস্বরূপ থেকে; যম্যা; লম্বা—অর্জনের মাধ্যমে; চ—ও; অপরম্ — অন্য কিছু; লাভম্—লাভ; মন্যতে—মনে হয়; ন–না; অধিকম্—অধিক; ততঃ—তার চেয়েও; যস্মিন্ —যাতে; স্থিতঃ—স্থিত হলে; ন — না; দুঃখেন – দুঃখের দ্বারা; গুরুণা অপি—যদিও খুব কঠিন; বিচাল্যতে—বিচলিত বিচাল্যতে — বিচলিত হয়; তম্—তা; বিদ্যাৎ—অবশ্যই জানবে; দুঃখসংযোগ— জড় জগতের সংযোগ-জনিত দুঃখ; বিয়োগম্ – বিয়োগ; যোগসংজ্ঞিতম্— যোগসমাধি বলা হয় ।
গীতার গান
যোগীর সে আত্মস্থির যোগ সাধনেতে ।
যোগাত্মন তার নাম যোগ অভ্যাসেতে ৷।
বিষয় ভোগের উপরতি যোগীর প্রমাণ।
নিরুদ্ধ সে যোগসেবা সিদ্ধির নিধান ।।
আত্মারাম যদা তুষ্ট আত্মার দর্শনে ।
সিদ্ধ সেই যোগী হয় যোগের সাধনে ॥
সত্য যে সুখ তাহা ইন্দ্ৰিয়াতীত ৷
যেবা সেই নাহি জানে অস্থির তত্ত্বতঃ ।।
যে সুখ হইলে লাভ সৰ্বলাভ হয় ৷
অন্য সব যত লাভ কিছু কাম্য নয় ।৷
যাহাতে হইলে স্থিত গুরু দুঃখে অতি ৷
অস্থির না হয় থাকে অটল বিচ্যুতি ৷।
যোগ সাধি সে অবস্থা যদি লভ্য হয় ৷
অষ্টাঙ্গ-যোগের সিদ্ধি তাহারে কহয় ৷৷
অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরূপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন। সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুখ অনুভূত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।
তাৎপর্যঃ যোগ অনুশীলন করার ফলে ক্রমশ জড় বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি আসে। এটিই হচ্ছে যোগের প্রথম লক্ষণ। তারপর যোগী সমাধিতে স্থিত হন। যার অর্থ হচ্ছে—তিনি আত্মা ও পরমাত্মাকে এক বলে মনে করার ভ্রম থেকে মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয় ও চিত্তের দ্বারা পরমাত্মাকে অনুভব করেন। যোগমার্গ সাধারণত পতঞ্জলির যোগসূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিছু কপট ব্যাখ্যাকার জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে অভেদ স্থাপন করার অসৎ চেষ্টা করে এবং অদ্বৈতবাদীরা সেটিকে মুক্তি বলে মনে করে, কিন্তু তারা পতঞ্জলির যোগ প্রণালীর প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না। পতঞ্জলির যোগপদ্ধতিতে অপ্রাকৃত আনন্দের উপলব্ধির কথা স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু অদ্বৈতবাদীরা তা স্বীকার করে না, কারণ তা হলে তাদের অদ্বৈত মতবাদ সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্ত বলে পরিগণিত হবে। জ্ঞান ও জ্ঞাতার দ্বৈতবাদকে অদ্বৈতবাদীরা স্বীকার করে না, কিন্তু এই শ্লোকটিতে অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত আনন্দ অনুভূতির কথা স্বীকার করা হয়েছে এবং সেই কথার স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন স্বয়ং পতঞ্জলি মুনি, যিনি হলেন যোগের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার। এই মহামুনি তাঁর যোগসূত্রে (৩/৩৪) বলে গেছেন — পুরুষার্থশূন্যানাং গুণানাং প্রতিপ্রসবঃ কৈবল্যং স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তিরিতি ।
এই চিতিশক্তি অথবা অন্তরঙ্গা শক্তি হচ্ছে অপ্রাকৃত। পুরুষার্থ বলতে বোঝায় ধর্ম, অর্থ, কাম এবং পরিশেষে ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত হওয়াকে অদ্বৈতবাদীরা বলেন কৈবল্য। কিন্তু পতঞ্জলি বলছেন যে, এই কৈবল্য হচ্ছে সেই দিবা অন্তরঙ্গা শক্তি, যার দ্বারা জীব তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর শিক্ষাষ্টকে এই অবস্থাকে বলেছেন, চেতোদর্পণ মার্জনম্ অথবা চিত্তরূপ দর্পণকে মার্জন করা। চিত্তের এই শুদ্ধিই হচ্ছে যথার্থ মুক্তি, অথবা ভবমহাদাবাগ্নিনির্বাপণম্। প্রারম্ভিক নির্বাণ-মতও এই সিদ্ধান্তের অনুরূপ। শ্রীমদ্ভাগবতে (২/১০/৬) একে বলা হয়েছে স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ। ভগবদ্গীতার এই শ্লোকেও সেই একই কথা বলা হয়েছে।
নির্বাণের পরে, অর্থাৎ জড় অস্তিত্বের সমাপ্তি হলে কৃষ্ণভাবনামৃত নামক ভগবৎ- সেবার চিন্ময় ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ – এটিই হচ্ছে ‘জীবাত্মার যথার্থ স্বরূপ’। এই স্বরূপ যখন বিষয়াসক্তির দ্বারা আবৃত থাকে, তখন জীবাত্মা মায়াগ্রস্ত হয়। এই বিষয়াসক্তি বা ভবরোগ থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তখন আদি নিত্য স্বরূপের বিনাশ হয়। পতঞ্জলি মুনি এই সত্যের সমর্থন করে বলেছেন – কৈবল্যং স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তিরিতি। এই চিতিশক্তি বা অপ্রাকৃত আনন্দ হচ্ছে যথার্থ জীবন। বেদান্ত-সূত্রেও (১/১/১২) সেই কথার স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, আনন্দময়োহভ্যাসাৎ। এই স্বাভাবিক অপ্রাকৃত আনন্দই হচ্ছে যোগের চরম লক্ষ্য এবং ভক্তিযোগ সাধন করার মাধ্যমে অনায়াসে এই আনন্দ লাভ করা যায়। সপ্তম অধ্যায়ে ভক্তিযোগ বিশদভাবে বর্ণনা করা হবে।
এই অধ্যায়ে বর্ণিত যোগপদ্ধতিতে সমাধি দুই রকমের— ‘সম্প্রজ্ঞাত-সমাধি’ ও ‘অসম্প্ৰজ্ঞাত-সমাধি’। নানা রকম দার্শনিক অন্বেষণের দ্বারা অপ্রাকৃত স্থিতিকে বলা হয় ‘সম্প্ৰজ্ঞাত সমাধি’। ‘অসম্প্ৰজ্ঞাত-সমাধিতে কোন রকম জড় বিষয়ানন্দ ভোগের সম্বন্ধ থাকে না, কারণ এই স্থিতিতে তিনি সব রকম ইন্দ্রিয়জাত সুখের অতীত। এই চিন্ময় স্বরূপে অধিষ্ঠিত যোগী কখনও কোন কিছুর দ্বারা বিচলিত হন না। যোগী যদি এই স্তরে উন্নীত না হতে পারেন, তা হলে বুঝতে হবে যে, তাঁর যোগসাধনা সফল হয়নি। আধুনিক যুগের তথাকথিত যোগ, যা বিভিন্ন ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের সঙ্গে যুক্ত তা পরস্পর-বিরোধী। মৈথুন ও মদ্যপানে আসক্ত হয়ে যে নিজেকে যোগী বলে, সে উপহাসের পাত্র। এমন কি, যে যোগী যৌগিক সিদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট, সেও যথার্থ যোগী নয়। যোগী যদি যোগের আনুষঙ্গিক উপলব্ধির প্রতি আকৃষ্ট থাকে, তবে সে যোগের যথার্থ সিদ্ধি লাভ করতে পারে না, সেই কথা এই শ্লোকে বলা হয়েছে। তাই, যারা যোগ-ব্যায়ামের কসরৎ দেখায় অথবা তাদের সিদ্ধি প্রদর্শন করে ম্যাজিক দেখায়, তারা যোগের অপব্যবহার করছে। তাদের বোঝা উচিত যে, তাদের যোগ-সাধনার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
এই যুগে যোগ-সাধনার শ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা এবং এই যোগসাধনা ব্যর্থ হয় না। ভগবদ্ভক্তি সাধন করবার মাধ্যমে ভক্ত যে অপ্রাকৃত আনন্দ আস্বাদন করে, তার ফলে তিনি আর কোন রকম জড় সুখভোগ করার আকাঙ্ক্ষা করেন না। শঠতাপূর্ণ এই কলিযুগে হঠযোগ, ধ্যানযোগ ও জ্ঞানযোগ অনুশীলনের পথে অনেক বাধাবিপত্তি আছে, কিন্তু কর্মযোগ অথবা ভক্তিযোগ অনুশীলনে তেমন কোন অসুবিধা নেই।
যতক্ষণ এই জড় দেহটি আছে, ততক্ষণ আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন আদি জড় দেহের চাহিদাগুলিও মেটাতে হবে। কিন্তু শুদ্ধ ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার মাধ্যমে যখন এই আবশ্যকতাগুলি মেটান হয়, তখন ভক্তের ইন্দ্রিয়গুলি উত্তেজিত হয় না। বরং, ভক্ত তাঁর জীবন ধারণের জন্য যতটুকু নিতান্ত প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করে যথাসম্ভব লাভ ওঠাবার চেষ্টা করেন এবং কৃষ্ণভাবনামৃতের অপ্রাকৃত আনন্দ আস্বাদন করেন। তিনি দুর্ঘটনা, রোগ, অভাব, এমন কি অতি নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু আদি প্রাসঙ্গিক ঘটনাতেও নির্বিকার থাকেন। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তি সাধনের ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ সজাগ। কোন দুর্ঘটনাই তাঁকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারে না। ভগবদ্গীতাতে (২/১৪) বলা হয়েছে— আগমাপায়িনোঽনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত। তিনি এই সমস্ত প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলিকে সহ্য করেন, কারণ তিনি ভালমতেই জানেন যে, এগুলি অনিত্য –এগুলি আসবে ও যাবে, তাই তাঁর কর্তব্যকর্ম কখনই এদের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এভাবেই তিনি যোগের পরম সিদ্ধি লাভ করেন।