শ্লোকঃ ১৫

যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ ।

শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি ॥ ১৫ ॥

যুঞ্জন—অভ্যাস করে; এবম্—এই প্রকারে; সদা-সর্বদা; আত্মানম্ — দেহ, মন ও আত্মাকে, যোগী—যোগী; নিয়তমানসঃ – সংযতচিত্ত; শান্তিম্—শান্তি, নির্বাণ- পরমাম্—জড় বন্ধনমুক্তি; মৎসংস্থা — চিৎ-জগৎ, অধিগচ্ছতি — প্রাপ্ত হন।

গীতার গান

সেভাবে যে যোগ সাধে নিয়ত মানস ৷

সদাত্ম সেই যোগী অমৃত পরশ ৷।

নির্বাণ পরম শান্তি হয় অধিকারী ।

ফিরে যায় মম ধামে যথা লীলাহরি ॥

অনুবাদঃ এভাবেই দেহ, মন ও কার্যকলাপ সংযত করার অভ্যাসের ফলে যোগীর জড় বন্ধন মুক্ত হয় এবং তিনি তখন আমার ধাম প্রাপ্ত হন।

তাৎপর্যঃ যোগ অনুশীলন করার পরম উদ্দেশ্য এখানে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জড় জগতের সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা যোগ-সাধনের উদ্দেশ্য নয়। পক্ষান্তরে, জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করাই হচ্ছে যোগ-সাধনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা অথবা লৌকিক সিদ্ধিলাভ করার জন্য যোগ অভ্যাস যে করে, ভগবদ্গীতায় তাকে যোগী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ভবরোগ নিবৃত্তির অর্থ স্বকপোলকল্পিত শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া নয়। ভগবানের সৃষ্টিতে শূন্য বলে কিছুই নেই। বরং, ভবরোগ নিবৃত্তি হলে পরব্যোমে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তি হয়। ভগবদ্গীতায় ভগবৎ-ধামের বিশদ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, সেই বৈকুণ্ঠধামকে আলোকিত করবার জন্য সূর্য, চন্দ্র অথবা তড়িৎ-শক্তির প্রয়োজন হয় না। সেখানে প্রতিটি গ্রহই সূর্যের মতো আপন আলোকে উদ্ভাসিত। ভগবৎ-ধাম সর্বব্যাপক, কিন্তু পরব্যোম এবং সেখানে অবস্থিত গ্রহলোককে পরমং ধাম অথবা উৎকৃষ্ট ধাম বলা হয়।

যে যোগী তাঁর যোগ-সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন, যিনি সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরেছেন, তাঁর সম্বন্ধে ভগবান বলেছেন— মচ্চিত্রঃ মৎপরঃ, মংস্থানম্। তিনিই যথার্থ শান্তি লাভ করেন, জীবনান্তে কৃষ্ণলোক বা গোলোক বৃন্দাবন নামক তাঁর পরম ধামে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। ভগবানের আলয় গোলোক বৃন্দাবন সম্বন্ধে ব্রহ্মসংহিতাতে (৫/৩৭) বলা হয়েছে, গোলোক এর নিবসত্যখিলাত্মভূতঃ— ভগবান যদিও তাঁর স্বধাম গোলোকে বাস করেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর উৎকৃষ্ট চিন্ময় শক্তির প্রভাবে সর্বব্যাপ্ত ব্রহ্ম এবং সর্বভূতে পরমাত্মারূপে সর্বত্র বিরাজমান। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্বাংশ-প্রকাশ বিষ্ণু সম্বন্ধে সর্বতোভাবে অবগত না হলে কোন অবস্থাতেই ভগবানের নিতা আলয় বৈকুণ্ঠলোক অথবা গোলোক বৃন্দাবনে প্রবেশ করা যায় না। তাই পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে যিনি ভগবানের সেবা করছেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত যোগী, কারণ তাঁর মন সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তাতেই মগ্ন—স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োঃ। বেদেও (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/৮) বলা হয়েছে, তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি— “পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারার ফলেই জন্ম ও মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। ” এর থেকে বোঝা যায় যে, যোগসাধন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া। ম্যাজিক দেখানো বা শারীরিক কসরৎ দেখিয়ে লোকঠকানো যোগের উদ্দেশ্য নয়।

শ্লোকঃ ১৬

নাত্যশ্নতস্ত যোগোঽস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ ।

ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন ॥ ১৬ ॥

ন—না; অতি—অত্যধিক; অশ্বতঃ– ভোজনকারী; তু—কিন্তু, যোগঃ — পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে যুক্ত; অস্তি – হয়; ন–না; চ—ও; একান্তম্ — নিতান্ত, অনশ্বতঃ —অনাহারীর; ন–না; চ–ও; অতি – অত্যন্ত; স্বপ্নশীলস্য — নিদ্রাশীলের; জাগ্রতঃ —জাগরণকারীর; ন–না; এব—কখনও; চ–এবং; অর্জুন – হে অর্জুন।

গীতার গান

অতিভোজী অনাহারী যোগে সিদ্ধ নয় ।

অতিনিদ্রা অতিজাগী শুন ধনঞ্জয় ৷।

অনুবাদঃ অধিক ভোজনকারী, নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় ও নিদ্রাশূন্য ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়।

তাৎপর্যঃ মাংস তমোগুণ সম্পন্ন মানুষের এই শ্লোকে যোগীদের আহার ও নিদ্রা সংযত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতিভোজীর অর্থ হচ্ছে যে, যারা প্রাণ ধারণের অতিরিক্ত আহার করে। মানুষের জন্য ভগবান যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য-শস্য, ফল-মূল, দুধ আদি দিয়েছেন, তাই পশু ভক্ষণ করা মানুষের কোন মতেই উচিত নয়। ভগবদ্গীতায় এই প্রকার সাদাসিধে খাদ্যকে সত্ত্বগুণময় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আহার। তাই, যারা মাছ মাংস আহার করে, মদ পান করে, ধূমপান করে এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন না করে আহার করে, তারা আহার-দোয়ের ফলস্বরূপ নিঃসন্দেহে পাপের ফল ভোগ করে। ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্তাত্মকারণাৎ। যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন না করে কেবল নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য রন্ধন করে এবং আহার করে, সে পাপ ভক্ষণ করে। যে এভাবে পাপ আহার করে বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করে, সে কখনই যোগ অনুশীলন করতে পারে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করে তাঁর প্রসাদ গ্রহণ করাই হচ্ছে সর্বশ্ৰেষ্ঠ পন্থা। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত ভগবানকে উৎসর্গ না করে কখনই কিছু গ্রহণ করেন না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই কেবল যোগসাধনে পূর্ণতা লাভ করতে পারেন। কিন্তু যে মনগড়া উপবাস প্রণালী সৃষ্টি করে কৃত্রিম উপায়ে আহার বর্জন করে, সে যথার্থ যোগ অনুশীলন করতে পারে না। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত শাস্ত্রের বিধান অনুসারে উপবাস করেন। তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহারও করেন না, আবার উপবাসও করেন না। তাই, তিনি যোগ অভ্যাস করার জন্য যথার্থই উপযুক্ত। যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করে, সে ঘুমন্ত অবস্থায় নানা রকম স্বপ্ন দেখে এবং তার ফলে সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমায়। ৬ ঘণ্টার বেশি ঘুমানো কারও পক্ষেই উচিত নয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে ছয় ঘণ্টার বেশি ঘুমায়, সে অবধারিতভাবে তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। যে মানুষ তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন, সে স্বভাবতই অলস এবং অত্যধিক নিদ্রাতুর। সেই মানুষ যোগ অনুশীলন করতে পারে না।

শ্লোকঃ ১৭

যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু ৷

যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা ॥ ১৭ ॥

যুক্ত—নিয়ন্ত্রিত; আহার — ভোজন; বিহারস্য – বিহার; যুক্ত – নিয়ন্ত্রিত, চেষ্টস্য— চেষ্টাবিশিষ্ট; কর্ম—কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠানে; যুক্ত—নিয়ন্ত্রিত, স্বপ্নাববোধস্য – নিদ্রিত ও জাগ্রত ব্যক্তির; যোগঃ — যোগ অভ্যাস; ভবতি হয়; দুঃখহা — দুঃখনাশক।

গীতার গান

যুক্তভোজী বিহার সে যুক্ত কর্ম চেষ্টা ।

যুক্ত নিদ্রা যুক্ত জাগি যোগ পরাসৃষ্টা ॥

অনুবাদঃ যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন, পরিমিত প্রয়াস করেন, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।

তাৎপর্যঃ আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন—এগুলি হচ্ছে দেহের প্রবৃত্তি। যথাযথভাবে এদের সংযত না করা হলে এরা যোগের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করার মাধ্যমে আহারের প্রবৃত্তিকে সংযত করা যায়। ভগবদ্‌গীতা (৯/২৬) অনুসারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অন্ন, শাক, সবজি, ফল, ফুল, দুধ আদি নিবেদন করা যায়। এভাবেই কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত মানুষের অযোগ্য অর্থাৎ সত্ত্বগুণের শ্রেণীভুক্ত নয়, এমন খাদ্য বর্জন করার শিক্ষা লাভ করেন। কৃষ্ণভক্ত সর্বদাই তাঁর কৃষ্ণভাবনাময় কর্তব্য পালন করতে তৎপর, তাই তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিদ্রা উপভোগকে মস্ত বড় ক্ষতি বলে মনে করেন। অব্যর্থকালত্বম্— কৃষ্ণভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করে একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে চান না। তাই তিনি খুব অল্প সময় নিদ্রার জন্য ব্যয় করেন। এই বিষয়ে তাঁর আদর্শ হচ্ছেন শ্রীল রূপ গোস্বামী, যিনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় তন্ময় থেকে কেবলমাত্র দুই ঘণ্টার জন্য নিদ্রা যেতেন, কখনও কখনও আবার তারও কম। নামাচার্য ঠাকুর হরিদাস তিন লক্ষ নাম জপ না করে মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতেন না এবং প্রসাদ পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। কৃষ্ণসেবা ছাড়া কৃষ্ণভক্ত আর কোন কর্মই করেন না। তাই, তাঁর প্রতিটি কর্মই সংযত এবং ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কলুষ থেকে মুক্ত। কৃষ্ণভক্তের যেহেতু ইন্দ্রিয়- তৃপ্তির বাসনা থাকে না, তাই তাঁর জড় সুখভোগের অবকাশ নেই। যেহেতু তাঁর কর্ম, বাক্য, নিদ্রা, জাগরণ এবং সব রকমের দৈহিক কর্ম সুনিয়ন্ত্রিত, তাই তিনি কখনই জড়-জাগতিক ক্লেশ ভোগ করেন না।

error: Content is protected !!