শ্লোকঃ ১০
যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ ।
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ ৷। ১০ ॥
যোগী—যোগী; যুঞ্জীত — সমাধিযুক্ত করবেন; সততম্—সর্বদা; আত্মানম্ (দেহ, মন ও আত্মার দ্বারা) নিজেকে; রহসি — নির্জন স্থানে স্থিতঃ—অবস্থিত হয়ে; একাকী – একলা; যতচিত্তাত্মা – সংযতচিত্ত; নিরাশীঃ – নিস্পৃহ হয়ে; অপরিগ্রহঃ — পরিগ্রহ রহিত হয়ে।
গীতার গান
যে যোগী সতত থাকি একাকী নির্জনে ।
নিরাশী অপরিগ্রহ চিত্তের যতনে ৷।
সমাধিস্থ হয়ে থাকে অধিক সময় ।
বৈরাগী তাহার মন বশীভূত হয় ৷।
অনুবাদঃ যোগারূঢ় ব্যক্তি সর্বদা পরব্রহ্মে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর দেহ, মন ও নিজেকে নিয়োজিত করবেন; তিনি একাকী নির্জন স্থানে বসবাস করবেন এবং সর্বদা সতর্কভাবে তাঁর মনকে বশীভূত করবেন। তিনি বাসনামুক্ত ও পরিগ্রহ রহিত হবেন।
তাৎপর্যঃ স্তরবিশেষে শ্রীকৃষ্ণকে ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে উপলব্ধি করা যায়। ভক্তি সহকারে সর্বক্ষণ ভগবানের সেবা করাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা। কিন্তু নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদী জ্ঞানী এবং পরমাত্মার অন্বেষণকারী যোগীরাও আংশিকভাবে কৃষ্ণভাবনাময়, কারণ নির্বিশেষ ব্রহ্ম হচ্ছেন ভগবানের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা এবং সর্বব্যাপ্ত পরমাত্মা হচ্ছেন ভগবানের আংশিক প্রকাশ। তাই, ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবা না করলেও যোগী এবং জ্ঞানীরাও পরোক্ষভাবে কৃষ্ণভাবনাময় । তবে, সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী, কারণ তিনি পূর্ণরূপে ব্রহ্ম ও পরমাত্মাতত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত। তিনিই পরমতত্ত্বকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কিন্তু নির্বিশেষবাদী জ্ঞানী ও ধ্যানমগ্ন যোগী পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করতে পারেননি।
তা সত্ত্বেও, এই সমস্ত নির্দেশ এখানে দেওয়া হয়েছে তাঁদের নির্দিষ্ট কার্যকলাপে সর্বদাই নিয়োজিত হবার জন্যে যাতে তাঁরা আগে-পরে সর্বোত্তম সিদ্ধিতে পৌঁছতে পারে। যোগীর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে মনকে সর্বদা ভগবান শ্রীকৃষ্ণে একাগ্র করা। মুহূর্তের জন্যও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে না গিয়ে সর্বক্ষণ তাঁর কথা স্মরণ করা। এভাবেই নিরন্তর ভগবানের চিন্তায় মনকে একাগ্র করার নাম হচ্ছে সমাধি। মনের এই একাগ্রতা লাভ করার জন্য নির্জনে বসবাস করা উচিত এবং বাহ্য বিষয়রূপী উপদ্রব থেকে দূরে থাকা উচিত। সাধকের সতর্ক থাকা উচিত—ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য অনুকূল পরিস্থিতি গ্রহণ করা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি পরিত্যাগ করা। দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে তাঁর অনাবশ্যক ভোগবাসনা পরিত্যাগ করা উচিত, কারণ তা পরিগ্রহরূপে বন্ধনের সৃষ্টি করে।
এই সমস্ত সাধন ও সতর্কতার পূর্ণ পালন তিনিই করতে পারেন, যিনি সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনাময়; কারণ সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া মানেই সম্পূর্ণরূপে ভগবানের কাছে আত্ম-উৎসর্গ করা। এই ধরনের ত্যাগে পরিগ্রহের কোন সম্ভাবনা থাকে না। শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ কৃষ্ণভাবনামৃতের ব্যাখ্যা করে বলেছেন—
অনাসক্তস্য বিষয়ান্ যথার্হমুপযুদ্ধতঃ ।
নির্বন্ধঃ কৃষ্ণসম্বন্ধে যুক্তং বৈরাগ্যমুচ্যতে ॥
প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা হরিসম্বন্ধিবগুনঃ ।
মুমুক্ষুভিঃ পরিত্যাগো বৈরাগ্যং ফল্গু কথ্যতে ॥
“বিষয়ের প্রতি আসক্তিশূন্য হয়ে এবং শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে নিবন্ধ করে ভগবানের সেবার অনুকূল বিষয়টুকু গ্রহণ করাকেই বলা হয় যুক্তবৈরাগ্য। পক্ষান্তরে, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জীবের সম্পর্কের কথা না জেনে যে সব কিছু পরিত্যাগ করে, তার বৈরাগ্য পূর্ণ নয়।” (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু পূর্ব ২/২৫৫-২৫৬)
কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত যথার্থরূপে জানেন যে, সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের সম্পত্তি। তাই, তিনি কোন কিছুই নিজের বলে দাবি করেন না। নিজে ভোগ করার জন্য তিনি কোন কিছুর লালসা করেন না। তিনি জানেন, শ্রীকৃষ্ণের সেবার অনুকূলে কোটি গ্রহণ করা উচিত এবং কোনটি পরিত্যাগ করা উচিত। বিষয় ভোগের প্রতি তিনি সর্বদাই উদাসীন, কারণ তিনি সর্বদাই অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত। ভগবদ্ভক্ত ছাড়া আর কারও সঙ্গ করার কোন প্রয়োজন নেই বলে তিনি সর্বদাই একাকী। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছে পরম যোগী।
শ্লোকঃ ১১-১২
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ ।
নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্ ॥ ১১॥
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ ।
উপবিশ্যাসনে যুঞ্জাদ যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে ॥ ১২ ॥
শুচৌ—পবিত্র; দেশে— স্থানে; প্রতিষ্ঠাপ্য— স্থাপন করে; স্থিরম্—স্থির; আসনম্ আসন; আত্মনঃ—নিজের; ন–না; অতি অতি; উচ্ছিতম্ – উচ্চ; ন–না; অতি— অতি; নীচম্—নীচু; চৈলাজিনকুশোত্তরম্ — কুশাসনের উপর মৃগচর্ম, তার উপরে বজ্রাসন রেখে; তত্র— সেই আসনে; একাগ্রম্—একাগ্র; মনঃ—মনকে; কৃত্বা—করে; যতচিত্ত—মনকে সংযত করে; ইন্দ্রিয়— ইন্দ্রিয়; ক্রিয়ঃ—কার্যকলাপ; উপবিশ্য- উপবেশন করে; আসনে –আসনে; যুঞ্জ্যাৎ- অভ্যাস করবেন; যোগম্—যোগ অভ্যাস; আত্ম—অন্তঃকরণ; বিশুদ্ধয়ে —শুদ্ধ করবার জন্য ।
গীতার গান
পবিত্র স্থানেতে বসি নিজাসন উপরে ।
চেলাজিন বস্ত্ৰ আসনাদি পরোপরে ॥
অতি উচ্চে নাহি বসে অতি নীচে নহে ।
স্থির মন হয়ে সেবা যোগাভ্যাসে রহে ৷।
একাগ্রতঃ মন করি যত চিত্তেন্দ্রিয় ।
যোগাভ্যাস করে মুনি বিশুদ্ধ হৃদয় ৷।
অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের নিয়ম এই যে, কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন, তার উপরে বস্ত্ৰাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সেই আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করে তাতে আসীন হবেন। সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন।
তাৎপর্যঃ এখানে ‘পবিত্র স্থান’ বলতে তীর্থস্থানকে বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষে প্রায় সমস্ত যোগী ও ভক্ত গৃহত্যাগ করে প্রয়াগ, মথুরা, বৃন্দাবন, হৃষীকেশ, হরিদ্বার আদি স্থানে অথবা গঙ্গা ও যমুনার তীরবর্তী কোন নির্জন স্থানে বসবাস করে যোগ অনুশীলন করেন। কিন্তু আধুনিক যুগের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে এই ধরনের সাধনা করা সম্ভব নয়। আজকাল অনেক বড় বড় শহরে তথাকথিত যোগ অনুশীলনের স্কুল বা যৌগিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। এই সমস্ত সংস্থাগুলি টাকা উপার্জনের একটি ভাল ব্যবসা হতে পারে, কিন্তু যথার্থ যোগ সাধনার জন্য এগুলি সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। উদ্বিগ্নচিত্ত, অসংযমী মানুষ কখনই ধ্যান করতে পারে না। তাই, বৃহন্নারদীয় পুরাণে বলা হয়েছে যে, বর্তমান কলিযুগে মানুষ যখন অল্পায়ু, পরমার্থ সাধনে অপটু এবং সর্বদাই নানা রকম উপদ্রবের দ্বারা উৎকণ্ঠিত, তাদের ক্ষেত্রে পরমার্থ সাধনের শ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তন করা।
হরেনাম হরের্নাম হরেনামেব কেবলম্ ।
কলৌ নাস্ত্যের নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা
“বিবাদ ও শঠতায় পরিপূর্ণ এই কলিযুগে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তন করা। এ ছাড়া আর কোন গতি নাই, এ ছাড়া আর কোন গতি নাই, এ ছাড়া আর কোন গতি নাই।”
শ্লোকঃ ১৩-১৪
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ ।
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ ॥ ১৩॥
প্রশান্তাত্মা বিগতভীব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ ।
মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ ॥ ১৪ ॥
সমম্—সরল; কায়শিরঃ শরীর ও মস্তক; গ্রীবম্—গ্রীবা; ধারয়ন্—ধারণ করে; অচলম্—নিশ্চলভাবে; স্থিরঃ—স্থির হয়ে; সংপ্রেক্ষ্য— দৃষ্টি রেখে, নাসিকাগ্রম্ নাসিকার অগ্রভাগে; স্বম্—স্বীয়; দিশঃ—সমস্ত দিকে; চ–ও; অনবলোকয়ন্— অবলোকন না করে; প্রশান্ত – প্রশান্ত আত্মা – চিত্ত; বিগতভীঃ —নির্ভয়, ব্রহ্মচারিত্রতে—ব্রহ্মচর্য ব্রতে; স্থিতঃ—অবস্থিত; মনঃ – মন; সংযমা – সম্পূর্ণরূপে সংযত করে; মৎ- আমাতে (শ্রীকৃষ্ণে); চিত্ত:– চিত্ত; যুক্তঃ – সমাহিতভাবে; আসীত—অবস্থান করবেন; মৎ—আমাকে; পরঃ–চরম লক্ষ্য।
গীতার গান
দেহ শির গ্রীবা তিন সমান করিয়া ।
অচল অবস্থা ধীর ভাবেতে বসিয়া ॥
নাসিকার অগ্রভাগ সতত দেখিয়া ৷
অন্য যত দৃশ্যবস্তু কিছু না দেখিয়া ৷।
প্রশান্তাত্মা ভয় নাই ব্রহ্মচারী ব্রত ।
সংযমিত মন যেবা আমাতেই রত ৷।
অনুবাদঃ শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সমানভাবে রেখে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশাস্তাত্মা, ভয়শূন্য ও ব্রহ্মচর্যব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে, আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন।
তাৎপর্যঃ জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা, যিনি চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপে সকলের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজ করছেন। যোগসাধন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের এই পরমাত্মা রূপকে দর্শন করা। এ ছাড়া যোগের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। জীবের হৃদয়ে বিরাজমান বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণেরই অংশ। চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপী পরমাত্মাকে দর্শন করার অভিপ্রায় না নিয়ে যিনি যোগ অনুশীলন করেন, তিনি কেবল অনর্থক সময়ের ধ্যানযোগ অপচয় করেন। জীবনের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। যোগাভ্যাসের মাধ্যমে তাঁরই অংশ পরমাত্মাকে জানার চেষ্টা করা হয়। জীবের হৃদয়ে বিরাজমান পরমাত্মারূপী শ্রীবিষ্ণুকে উপলব্ধি করতে হলে পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। তাই, যোগীকে গৃহত্যাগ করে নির্জনে একাকী পূর্বোক্ত বিধি অনুসারে ভগবানের ধ্যান করতে হয়। ঘরে অথবা বাইরে নিত্য মৈথুন-পরায়ণ হয়ে তথাকথিত যোগশিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে তথাকথিত যোগাভ্যাস করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না। মনঃসংযম ও সমস্ত রকমের ইন্দ্রিয়তর্পণ, বিশেষ করে যৌন জীবন পরিত্যাগের অভ্যাস করতে হয়। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য রচিত ব্রহ্মচর্য ব্রত সন্দর্ভে বলা হয়েছে
কর্মণা মনসা বাচা সর্বাবস্থাসু সর্বদা ।
সর্বত্র মৈথুনত্যাগো ব্রহ্মচর্য প্রচক্ষতে ॥
“সব রকম পরিস্থিতিতে সর্বদা সর্বত্র মন, বচন ও কর্মের দ্বারা পূর্ণরূপে মৈথুন পরিত্যাগ করাকে বলা হয় ব্রহ্মচর্য।” মৈথুন-পরায়ণ ব্যক্তি কখনই যথার্থ যোগসাধন করতে পারে না। তাই শৈশব থেকেই ব্রহ্মচর্য পালন করার শিক্ষা দেওয়া হয়, কারণ তখন যৌন জীবন সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই থাকে না। বৈদিক সংস্কৃতি অনুসারে শিশুকে পাঁচ বছর বয়সে গুরুকুলে প্রেরণ করা হয়, সেখানে গুরুদেব তাকে ব্রহ্মচর্যের দৃঢ় সংযম শিক্ষা দান করেন। এভাবেই সুনিয়ন্ত্রিত না হলে ধ্যান, জ্ঞান অথবা ভক্তি আদি কোন যোগের পথেই অগ্রসর হওয়া যায় না। শাস্ত্রের বিধান অনুসারে বিবাহিত জীবন যাপন করে যে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে স্ত্রীসঙ্গ করে, তাকে ব্রহ্মচারী বলে গণ্য করা হয়। এই ধরনের সংযত গৃহস্থকে ভক্ত সম্প্রদায় গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু জ্ঞানী অথবা ধ্যানী সম্প্রদায় গৃহস্থ ব্রহ্মচারীকেও গ্রহণ করে না। তাদের জন্য পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করা অবশ্য কর্তব্য। ভক্তিমার্গে গৃহস্থ ব্রহ্মচারীকেও গ্রহণ করা হয়, কারণ এই যোগ এত বলবতী যে, তার অভ্যাস করে ভগবানের সেবা করার ফলে স্ত্রীসঙ্গ করার সমস্ত বাসনা আপনা থেকেই অন্তর্হিত হয়ে যায়। ভগবদ্গীতায় (২/৫৯ ) বলা হয়েছে
বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্ডং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্টা নিবর্ততে ।।
পরমার্থ সাধনের পথে আর সকলকে জোর করে ইন্দ্রিয় সংযম করতে হলেও পরম- তত্ত্বের সৌন্দর্য দর্শন করে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ফলে, ভক্তের আভ্যন্তরীণ বিষয়াসক্তি আপনা থেকেই নিবৃত্ত হয়ে যায়। ভক্ত ছাড়া আর কেউই এই অপ্রাকৃত আনন্দের স্বাদ পায় না। বিগতভীঃ। পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে প্রশান্ত না হলে নির্ভীক হওয়া যায় না। বদ্ধ জীব স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যাওয়ার ফলে সর্বদাই ভীত। শ্রীমদ্ভাগবতে ( ১১/২/৩৭) বলা হয়েছে— ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যাদীশাদপেতস্য বিপর্যয়োহ স্মৃতিঃ। কৃষ্ণভাবনামৃতই হচ্ছে ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র অবলম্বন। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই কেবল যথার্থভাবে যোগ অভ্যাস করতে পারেন। আর যেহেতু যোগসাধন করার পরম লক্ষ্য হচ্ছে অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করা, তাই নিঃসন্দেহে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী। এখানে যে যোগের কথা বলা হয়েছে, তা আজকাল যে সমস্ত জনপ্রিয় তথাকথিত যোগশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।