শ্লোকঃ ৪
যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মস্বনুষজ্জতে ৷
সর্বসংকল্পসন্ন্যাসী যোগারূঢ়স্তদোচ্যতে ॥ ৪ ॥
যদা – যখন; হি – অবশ্যই; ন–না; ইন্দ্রিয়ার্থেষু—ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে; ন-না; কর্মসু—সকাম কর্মে; অনুষজ্ঞতে— আসক্ত হন; সর্বসংকল্প— সমস্ত জড় বাসনা; সন্ন্যাসী — ত্যাগী; যোগারূঢ়ঃ – যোগারূঢ়; তদা—তখন; উচ্যতে—বলা হয়।
গীতার গান
ইন্দ্রিয়ার্থ যদা কর্ম আচরিত নয় ।
সর্ব সংকল্পশূন্য সন্ন্যাসী সে হয় ॥
যোগারূঢ় সে অবস্থা শাস্ত্রের নির্ণয় ।
সে অবস্থা মুক্ত পথ করহ আশ্রয় ৷।
অনুবাদঃ যখন যোগী জড় সুখভোগের সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে এবং সকাম কর্মের প্রতি আসক্তি রহিত হন, তখন তাঁকেই যোগারূঢ় বলা হয়।
তাৎপর্যঃ মানুষ যখন ভক্তিযোগে সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হয়, তখন সে সর্বতোভাবে আত্মতৃপ্ত হয়, তখন ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি অথবা সকাম কর্ম করার কোন প্রবৃত্তি তার থাকে না। আর তা না হলে, সে অবশ্যই ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধনে প্রবৃত্ত হবে, কারণ কর্মরহিত হয়ে মানুষ কখনও থাকতে পারে না। তাই, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম না করা হলে, আত্মকেন্দ্রিক অথবা সমষ্টির স্বার্থে কর্ম করার বাসনা দেখা দেবে। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধানের জন্য সব কিছুই করেন, তাই তিনি ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। পক্ষান্তরে বলা যায়, যার এই উপলব্ধি হয়নি, তাকে যোগমার্গরূপ সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত বিষয়-বাসনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যন্ত্রবৎ প্রযত্ন করতে হবে।
শ্লোকঃ ৫
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ॥ ৫ ।।
উদ্ধরেৎ—উদ্ধার করা কর্তব্য; আত্মনা – মনের দ্বারা; আত্মানম্—জীবাত্মাকে; ন— না; আত্মানম্—আত্মাকে; অবসাদয়েৎ—অধঃপতিত করা; আত্মা–মন; এব— অবশ্যই; হি—বাস্তবিকই; আত্মনঃ—জীবাত্মার; বন্ধুঃ বন্ধু; আত্মা — মন; এব– অবশ্যই, রিপুঃ —শত্রু; আত্মনঃ—জীবাত্মার।
গীতার গান
অনাসক্ত বিষয়েতে যথা কর্ম দৃঢ় ৷
সংসার সে কূপ হতে নিজ আত্মা কাড় ।।
আত্মাকে উদ্ধার করা আত্মার উচিত ।
আত্মাকে নাহি কভু কর অবসাদ ॥
আত্মাই আত্মার বন্ধু আত্মাই সে রিপু ।
আত্মার শত্রু যে হয় হিরণ্যকশিপু ॥
অনুবাদঃ মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে ।
তাৎপর্যঃ অবস্থানুসারে আত্মা বলতে দেহ, মন ও আত্মাকে বোঝায়। যোগপন্থায় বদ্ধ জীবাত্মা ও মনের বিশেষ গুরুত্ব আছে। যেহেতু মনই হচ্ছে যোগাভ্যাসের কেন্দ্র, তাই এখানে আত্মা বলতে মনকে বোঝানো হয়েছে। যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে মনকে বশ করে ইন্দ্রিয়-বিষয় থেকে তাকে সম্পূর্ণ অনাসক্ত রাখা। এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, মনকে এমনভাবে সংযত করতে হবে যাতে তিনি বন্ধ জীবকে অজ্ঞান- সাগর থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন। জড় বন্ধনে আবদ্ধ জীব মন ও ইন্দ্রিয়ের অধীন থাকে। বাস্তবিকপক্ষে শুদ্ধ আত্মা এই জড় জগতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, কারণ মন অহঙ্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে জড়া প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তাই, মনকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত যাতে সে আর মায়ার মিথ্যা চমকের প্রতি আকৃষ্ট না হয় এবং তার ফলে বদ্ধ জীবাত্মার উদ্ধার হয়। ইন্দ্রিয় বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অধঃপতিত হওয়া উচিত নয়। বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ যত বেশি হবে, ভবরোগের বন্ধনটিও তত দৃঢ় হবে। বন্ধন থেকে মুক্তির সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় মনকে সর্বক্ষণ নিযুক্ত করে রাখা। দেওয়ার জন্য হি শব্দটি এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে, অর্থাৎ, উপায় নেই, তাই এই পন্থাকে অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। এই ছাড়া অন্য কোন শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
মন এর মনুষ্যাণাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ ৷
বন্ধায় বিষয়াসঙ্গো মুক্ত্যৈ নির্বিষয়ং মনঃ ॥
“মনই মানুষের বন্ধন অথবা মুক্তির কারণ। ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের প্রতি মনের তন্ময়তা হচ্ছে বন্ধনের কারণ এবং বিষয়ের প্রতি মনের অনাসক্তি হচ্ছে মুক্তির কারণ।” (অমৃতবিন্দু উপনিষদ ২) সুতরাং কৃষ্ণভাবনায় সর্বদা মনকে নিয়োজিত রাখলে চরম মুক্তি লাভ সম্ভব হয়।
শ্লোকঃ ৬
বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ ।
অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ ।৷ ৬ ।৷
বন্ধুঃ —বন্ধু; আত্মা—মন; আত্মনঃ — জীবের; তস্য – তাঁর; যেন—যার দ্বারা; আত্মা–মন; এব—অবশ্যই; আত্মনা — জীবাত্মা কর্তৃক, জিতঃ — বিজিত; অনাত্মনঃ যিনি মনকে সংযত করতে অক্ষম; তু—কিন্তু; শত্রুত্বে শত্রুতার জন্য; বর্তেত— থাকেন; আত্মৈব — সেই মন; শত্রুবৎ-শত্রুর মতো।
গীতার গান
যে জন জিনিল নিজ মন আত্মজিত ।
সে মন যে বন্ধু তাহা শাস্ত্রেতে কথিত ।।
অজিত যে মন সেই মন নিজ শত্রু ।
অপকারী হয় সদা বিরুদ্ধ বিপক্ষ ৷।
অনুবাদঃ যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু, কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু।
তাৎপর্যঃ অষ্টাঙ্গ যোগের অনুশীলন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে মনকে সংযত করা, যার ফলে পরমার্থ সাধনের পথে সে বন্ধুর মতো সাহায্য করতে পারে। মনঃসংযম না করে লোকদেখানো যোগাভ্যাস করলে কেবল সময়ের অপচয় হয়। যে মানুষ মনকে বশ করতে অক্ষম, সে সর্বক্ষণ তার পরম শত্রুর সঙ্গে বাস করছে। তার ফলে, তার জীবন ও তার উদ্দেশ্য, দু-ই নষ্ট হয়ে যায়। জীবের স্বরূপ হচ্ছে তার প্রভুর আজ্ঞা পালন করা। মন যতক্ষণ অজিত শত্রু হয়ে থাকে, ততক্ষণ তাকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ আদির আজ্ঞা পালন করতে হয়। কিন্তু মন যখন বশীভূত হয়, তখন পরমাত্মারূপে প্রত্যেকের হৃদয়ে অবস্থিত যে ভগবান তাঁর আদেশ পালনে জীব স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়। যোগাভ্যাসের যথার্থ তাৎপর্য হচ্ছে, হৃদয়ে পরমাত্মার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাঁর আজ্ঞা পালন করা। কেউ যখন সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে, তখন সে আপনা থেকেই ভগবানের আজ্ঞার প্রতি সম্পূর্ণভাবে শরণাগত হয়।