শ্লোকঃ ৪৫
প্রযত্নাদ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিলিষঃ ৷
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্ ॥ ৪৫ ॥
প্রযত্নাৎ—যত্ন অপেক্ষা; যতমানঃ – যত্নবান; তু—কিন্তু; যোগী—এই প্রকার যোগী; সংশুদ্ধ— বিশুদ্ধ; কিলিষঃ— সর্বপ্রকার পাপ; অনেক—বহু; জন্ম—জন্ম: সংসিদ্ধঃ – সিদ্ধি লাভ করে; ততঃ—তারপর; যাতি লাভ করেন; পরাম্—পরম গতিম্—গতি।
গীতার গান
যত্নমাত্র করি যোগী কার্যসিদ্ধি করে ।
জন্ম-জন্মান্তরে সিদ্ধ ভবার্ণব তরে ৷।
অনুবাদঃ যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ ধর্মপরায়ণ, সম্ভ্রান্ত ও পবিত্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে মানুষ পরমার্থ সাধন করবার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে তাঁর অসম্পূর্ণ সাধনাকে পূর্ণ করতে প্রয়াসী হন এবং এভাবেই সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি কৃষ্ণভাবনা লাভ করেন। কৃষ্ণভাবনাই হচ্ছে জড় কলুষ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রকৃষ্ট পন্থা। এই সম্বন্ধে ভগবদ্গীতায় (৭/২৮) বলা হয়েছে-
যেষাং ত্বক্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্ ।
তে দ্বন্দ্বমোহনিমুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ ।।
“জন্ম-জন্মান্তরের বহু পুণ্যকর্মের ফলে কেউ যখন পাপ ও জড় জগতের মোহময় দ্বন্দ্ব থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হন, তখন তিনি দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে ভগবানের সেবায় যুক্ত হন।”
শ্লোকঃ ৪৬
তপস্বিভ্যোঽধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোঽপি মতোঽধিকঃ ।
কর্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদযোগী ভবার্জুন ॥ ৪৬ ।।
তপস্বিভ্যঃ—তপস্বীদের চেয়ে; অধিকঃ—শ্রেষ্ঠ; যোগী—যোগী; জ্ঞানিভ্যঃ— জ্ঞানীদের চেয়ে; অপি—ও; মতঃ —মত; অধিকঃ—শ্রেষ্ঠ; কর্মিভ্যঃ—সকাম কর্মীদের চেয়ে; চ—ও; অধিকঃ—শ্রেষ্ঠ; যোগী—যোগী; তস্মাৎ—অতএব; যোগী—যোগী; ভব—হও, অর্জুন – হে অর্জুন।
গীতার গান
তপস্বী সে যত আছে, সব নিম্ন যোগী কাছে,
জ্ঞানী নহে তার সমতুল্য ।
কর্মীর কি কথা আর, কোথায় তুলনা তার,
হে অর্জুন! যোগী হও যোগ্য ৷।
অনুবাদঃ যোগী তপস্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মীদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। অতএব, হে অর্জুন! সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও।
তাৎপর্যঃ যোগের অর্থ হচ্ছে পরম তত্ত্বের সঙ্গে চেতনের সংযোগ। বিভিন্ন পন্থা অনুসারে এই যোগকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। কর্মের মাধ্যমে যখন চেতনাকে ভগবানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় কর্মযোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে যখন ভগবানকে জানবার চেষ্টা করা হয়, তখন তাকে বলা হয় জ্ঞানযোগ এবং ভক্তির মাধ্যমে যখন ভগবানের সঙ্গে জীবের নিত্য সম্পর্কের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, তখন তাকে বলা হয় ভক্তিযোগ। সমস্ত যোগের চরম পরিণতি বা পরম পূর্ণতা হচ্ছে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা। সেই কথা পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভগবান যোগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছেন, কিন্তু তিনি কখনই বলেননি যে, এই যোগ ভক্তিযোগের থেকে শ্রেয়। ভক্তিযোগ হচ্ছে পরম তত্ত্বজ্ঞান এবং তাকে কোন কিছুই অতিক্রম করতে পারে না। আত্ম- তত্ত্বজ্ঞান ব্যতীত তপশ্চর্যার কোন তাৎপর্য নেই। ভগবানে শরণাগতি না হলে গবেষণামূলক জ্ঞানও সম্পূর্ণ নিরর্থক। আর কৃষ্ণভাবনা-বিহীন সকাম কর্ম কেবল সময় নষ্ট করারই নামান্তর। তাই, সমস্ত যোগের মধ্যে ভক্তিযোগকেই শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়। পরবর্তী শ্লোকে তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ৪৭
যোগিনামপি সর্বেষাং মদগতেনান্তরাত্মনা ।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ ॥ ৪ ॥
যোগিনাম্—যোগীদের; অপি—ও; সর্বেষাম্—সর্বপ্রকার; মদ্গতেন— আমাতেই আসক্ত, অন্তরাত্মনা — অন্তরে সব সময় আমার কথা চিন্তা করে; শ্রদ্ধাবান্—পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে, ভজতে — ভজনা করেন; যঃ – যিনি : মাম্ আমাকে (পরমেশ্বর ভগবানকে); সঃ— তিনি; মে— আমার; যুক্ততমঃ—সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; মতঃ- অভিমত।
গীতার গান
যত যোগী প্রকার সে শাস্ত্রেতে নির্ণয় ।
তার মধ্যে মদ্গতপ্রাণ যেবা কেহ হয় ৷৷
সবার সে শ্রেষ্ঠ যোগী জানিহ নিশ্চয় ৷
শ্রদ্ধাবান যদি সেই আমারে ভজয় ।।
অনুবাদঃ যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদ্গত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।
তাৎপর্যঃ এখানে ভজতে শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভজ্ ধাতু থেকে এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘সেবা’ অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। পূজা করা এবং ভজনা করা—এই দুটি শব্দের অর্থ এক নয়। পূজা করার অর্থ পূজ্য ব্যক্তিকে অভিবাদন করা। কিন্তু ভজনা করার অর্থ হচ্ছে প্রেম ও ভক্তি সহকারে সেবা করা, যা কেবল ভগবানেই প্রযোজ্য। পূজ্য ব্যক্তিকে অথবা দেবতাকে পূজা না করলে মানুষ কেবল শিষ্টাচারহীন অভদ্র বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু ভক্তি ও ভালবাসার সঙ্গে ভগবানের সেবা না করা নিন্দনীয় অপরাধ। প্রতিটি জীবই হচ্ছে ভগবানের অপরিহার্য অংশ, তাই প্রতিটি জীবেরই ধর্ম হচ্ছে ভগবানের সেবা করা। তা না করার ফলেই তার অধঃপতন হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/৩) সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
য এবাং পুরুষং সাক্ষাদাত্মপ্রভবমীশ্বরম্ ।
ন ভজন্ত্যবজানন্তি স্থানাদ ভ্রষ্টাঃ পততাঃ।।
“পরমেশ্বর ভগবানের ভজনা না করে, যে তার কর্তব্যে অবহেলা করে, সে অবধারিতভাবে ভ্রষ্ট হয়ে অধঃপতিত হয়।”
এই শ্লোকেও ভজন্তি কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। পরমেশ্বর ভগবানের ক্ষেত্রেই কেবল ভজন্তি কথাটি প্রযোজ্য, কিন্তু ‘পূজা’ শব্দটি দেব-দেবী ও অন্যান্য মহৎ জীবের বেলায় ব্যবহার করা যেতে পারে। শ্রীমদ্ভাগবতের এই শ্লোকের অবজানন্তি শব্দটির উল্লেখ ভগবদ্গীতাতেও পাওয়া যায়। অবজানন্তি মাং মূঢ়াঃ- “যারা অত্যন্ত মূঢ়, তারাই কেবল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যথার্থভাবে জানতে না পেরে অবজ্ঞা করে।” ভগবানের প্রতি সেবার মনোবৃত্তি ছাড়াই এই সব মূঢ়রা ভগবদ্গীতার তাৎপর্য লেখার দায়িত্বভার গ্রহণ করে, তাই তারা ভজন্তি ও ‘পূজা’ এই শব্দ দুটির মধ্যে যে কি পার্থক্য তা নিরূপণ করতে পারে না।
সব রকমের যোগ-সাধনার চরম পরিণতি হচ্ছে ভক্তিযোগ। অন্যান্য সমস্ত যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি বা ভক্তিযোগের স্তরে উন্নীত হওয়া। ‘যোগ’ বলতে প্রকৃতপক্ষে ভক্তিযোগকেই বোঝায়। আর অন্য সমস্ত যোগগুলি ক্রমান্বয়ে ভক্তিযোগেই যুক্ত হয়। কর্মযোগ থেকে শুরু তত্ত্বজ্ঞান লাভের এক সুদীর্ঘ পথ। নিষ্কাম কর্মযোগ থেকেই এই পথের শুরু। কর্মযোগের মাধ্যমে যখন জ্ঞান ও বৈরাগ্যের উদয় হয়, তখন সেই স্তরকে বলা হয় জ্ঞানযোগ। দৈহিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে যখন জ্ঞানযোগের সঙ্গে ধ্যান যুক্ত হয়ে মনকে পরমাত্মার উপর একাগ্র করা হয়, তখন তাকে বলা হয় অষ্টাঙ্গযোগ । অষ্টাঙ্গ-যোগকে অতিক্রম করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়াই হচ্ছে ভক্তিযোগ। প্রকৃতপক্ষে, এই ভক্তিযোগই হচ্ছে চরম পরিণতি। কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভক্তিযোগের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হলে অন্য সমস্ত যোগ সম্বন্ধে অবগত হতে হয়। যে যোগী প্রগতিশীল, তিনি পরমার্থ সাধনের পথে বিশেষ সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। কিন্তু প্রগতিবিহীন হয়ে কেউ যখন কোন এক স্তরে স্থির হয়ে পড়ে, তখন তাকে সেই বিশেষ স্তরের নামানুসারে কর্মযোগী, জ্ঞানযোগী, ধ্যানযোগী, রাজযোগী, হঠযোগী আদি নামে অভিহিত করা হয়। পরম সৌভাগ্যের ফলে কেউ যখন ভক্তিযোগের স্তরে উন্নীত হন, তখন বুঝতে হবে যে, তিনি অন্য সব যোগের স্তর ইতিমধ্যেই অতিক্রম করেছেন। তাই, কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে কৃষ্ণভক্ত হওয়াই যোগমার্গের সর্বোচ্চ শিখর। যেমন, আমরা যখন হিমালয় পর্বতের কথা বলি, তখন আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা সম্পর্কে বলি, এই হিমালয়ের আবার সর্বোচ্চ শিখর হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট।
অনেক সৌভাগ্যের ফলে মানুষ কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে ভক্তিযোগের পথ অবলম্বন করে এবং বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী এই যোগ অনুশীলন করে। আদর্শ যোগী শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন থাকেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে শ্যামসুন্দর বলা হয়, কারণ তাঁর অঙ্গকান্তি জলভরা মেঘের মতো নীলাভ, তাঁর পদ্মের মতো মুখারবিন্দ সূর্যের মতো প্রফুল্লোজ্জ্বল, তাঁর বসন মণি-রত্নের দ্বারা বিভূষিত, তাঁর শ্রীঅঙ্গ ফুলমালায় সুশোভিত। তাঁর দিব্য অঙ্গকান্তি ব্রহ্মজ্যোতির সর্ব ঐশ্বর্যময়ী প্রভায় সর্বদিক উদ্ভাসিত। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীনৃসিংহদেব, শ্রীবরাহদেব এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপে তিনি অবতরণ করেন। তিনি হচ্ছেন সমস্ত অবতারের অবতারী — তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি মাতা যশোদার নন্দনরূপে অবতারী—তিনি সাধারণ মানুষের মতো আবির্ভূত হন এবং শ্রীকৃষ্ণ, গোবিন্দ, বাসুদেব আদি নামে পরিচিত হন। তিনি হচ্ছেন আদর্শ সন্তান, আদর্শ পতি, আদর্শ সখা, আদর্শ প্রভু। তিনি সমস্ত ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এবং অপ্রাকৃত গুণাবলীতে বিভূষিত। ভগবানের এই স্বরূপ যিনি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী।
যোগের সর্বোচ্চ সিদ্ধির এই স্তর লাভ হয় ভক্তিযোগের মাধ্যমে, যা বৈদিক শাস্ত্রে প্রতিপন্ন হয়েছে
যস্য দেবে পরা ভক্তিযথা দেবে তথা গুরৌ ।
তস্যৈতে কথিতা হার্থাঃ প্রকাশতে মহাত্ম।।
“যে সমস্ত মহাত্মারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও গুরুদেবের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি লাভ করেছেন, তাঁদের কাছে সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সম্পূর্ণ তাৎপর্য প্রকাশিত হয়।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/২৩)
ভক্তিরস্য ভজনং তদিহামুত্রোপাধিনৈরাসোনামুস্মিন্ মনঃকল্পনমেতদেব নৈষ্কর্ম্যম্। “ভক্তি মানে হচ্ছে লৌকিক অথবা পারলৌকিক সব রকম বিষয় -বাসনা রহিত ভগবৎ-সেবা। বিষয় -বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে মনকে সম্পূর্ণরূপে ভগবানের সেবায় পূর্ণরূপে তন্ময় করা। সেটিই হচ্ছে নৈষ্কর্মের উদ্দেশ্য।”
(গোপালতাপনী উপনিষদ ১/১৫)
এগুলি হচ্ছে যোগপদ্ধতির সর্বোচ্চ সিদ্ধির স্তর — ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার কয়েকটি উপায়।
ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।
শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ॥
ইতিধ্যানযোগ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।