শ্লোকঃ ৪২
অথবা যোগিনামের কুলে ভবতি ধীমতাম্ ।
এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্ ৷৷ ৪২ ॥
অথবা—অথবা, যোগিনাম্ — যোগিদের; এর – অবশ্যই; কুলে -বংশে; ভবতি- জন্মগ্রহণ করেন; ধীমতাম্ — জ্ঞানবান; এতৎ—এই; হি—অবশ্যই দুর্লভতরম্ অত্যন্ত দুর্লভ; লোকে এই জগতে, জন্ম — জন্ম; যৎ— যে; ঈদৃশম্—এই প্রকার।
গীতার গান
অথবা যোগীর কুলে তার জন্ম হয় ৷
দুর্লভ সে সব জন্ম কিবা তার ভয় ৷।
সে সব দুর্লভ জন্ম যদি কেহ পায় ৷
তারপর সঙ্গ দোষে যদি না ভ্ৰময় ৷।
অনুবাদঃ অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান যোগিগণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রকার জন্ম এই জগতে অবশ্যই অত্যন্ত দুর্লভ।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে ভগবান যোগী এবং পরমার্থবাদী সাধকের কুলে জন্ম হওয়ার প্রশংসা করেছেন। কারণ, এই কুলে জন্ম হওয়ার ফলে জীবনের শুরু থেকেই পরমার্থ সাধনের প্রেরণা লাভ করা যায়, বিশেষ করে আচার্য অথবা গোস্বামী পরিবারে জন্ম হওয়ার ফলে। পরম্পরা এবং শিক্ষার প্রভাবে এই কুল বিদ্বান ও ভক্তিযুক্ত হয়, তাই তাঁরা গুরুপদ প্রাপ্ত হতেন। ভারতবর্ষে এই রকম বহু আচার্য পরিবার আছে, কিন্তু যথেষ্ট শিক্ষা ও সংযমের অভাবে তারা অধঃপতিত হয়েছে। ভগবানের কৃপার ফলে কোন কোন পরিবারে পুরুষানুক্রমে সাধক উৎপন্ন হয়। এই রকম পরিবারে জন্ম লাভ করা অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের আচার্যদেব ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী মহারাজ ও আমি স্বয়ং এই রকম পরিবারে জন্ম লাভ করেছি এবং জীবনের প্রারম্ভেই আমরা ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। দৈব বিধান অনুসারে পরবর্তীকালে আমরা মিলিত হয়েছি।
শ্লোক ৪৩
তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্ ।
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন ॥ ৪৩ ॥
তত্র—তার ফলে; ত্বম্ – সেই; বুদ্ধিসংযোগম্ — পরমাত্ম-বিষয়িণী বুদ্ধির সঙ্গে সংযোগ; লভতে— লাভ করেন; পৌর্ব—পূর্ব; দেহিকম্—জন্মকৃত; যততে— যত্ন করেন; চ—ও; ততঃ— তারপর; ভূয়ঃ— পুনরায়; সংসিদ্ধৌ – সিদ্ধি লাভের জন্য; কুরুনন্দন –হে কুরুপুত্র।
গীতার গান
বুদ্ধির সংযোগে পূর্ব দেহে যে সাধিল ৷
হে কুরুনন্দন জান সেই নিশ্চয়ই বুঝিল ৷।
তবে বুদ্ধিমান করে পুনঃ যোগের সাধন।
দৃঢ় চেষ্টা করি যোগী পুনঃ সিদ্ধ হন ৷৷
অনুবাদঃ হে কুরুনন্দন ! সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি পুনরায় তাঁর পূর্ব জন্মকৃত পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।
তাৎপর্যঃ পূর্ব জন্মের সুকৃতি অনুসারে সৎ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে পারমার্থিক চেতনার বিকাশ করার খুব সুন্দর দৃষ্টান্ত আমরা পাই মহারাজ ভরতের মাধ্যমে। মহারাজ ভরত ছিলেন সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর এবং তাঁরই নামানুসারে স্বর্গের দেবতাদের কাছেও এই গ্রহের নাম হয় ভারতবর্ষ। পূর্বে নাম ছিল ইলাবৃতবর্ষ। পারমার্থিক সিদ্ধি লাভ করবার জন্য ভরত মহারাজ খুব অল্প বয়সে সংসার ত্যাগ করেন কিন্তু তিনি সিদ্ধি লাভে অক্ষম হন। পরবর্তী জীবনে তিনি এক সৎ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন। কোন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন না এবং কারও সঙ্গে কথা বলতেন না বলে তাঁর নাম হয় জড় ভরত। পরবর্তীকালে মহারাজ রহুগণ তাঁর সঙ্গে কথোপকথন করার মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তিনি পরম ভাগবত। জড় ভরতের জীবনের মাধ্যমে আমরা অনায়াসে বুঝতে পারি যে, পারমার্থিক সাধনা বা যোগসাধনা কখনই বিফলে যায় না। ভগবানের কৃপার ফলে পরমার্থ সাধকেরা কৃষ্ণভাবনায় সিদ্ধি লাভ করবার জন্য বারবার সুযোগ পান।
শ্লোকঃ ৪৪
পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোঽপি সঃ।
জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ততে ৷। ৪৪ ।।
পূর্ব-পূর্ব, অভ্যাসেন — অভ্যাসের দ্বারা; তেন— সেভাবে; এব—অবশ্যই; হ্রিয়তে— আকৃষ্ট হন; হি—নিশ্চিতভাবে; অবশঃ— অবশ হয়ে; অপি—ও; সঃ—তিনি; জিজ্ঞাসুঃ—জানতে ইচ্ছুক; অপি—এমন কি; যোগস্য – যোগের; শব্দব্রহ্ম — বেদোক্ত কর্মমার্গ; অতিবর্ততে— অতিক্রম করেন।
গীতার গান
স্বাভাবিক ভাবে সেই ইচ্ছার উদ্যম
আকৃষ্ট হইয়া করে সে কার্যে উদ্যম ৷।
জিজ্ঞাসু যদি বা হয় যোগের বিষয় ।
তথাপি সে কর্মকাণ্ড অতীত তরয় ৷।
অনুবাদঃ তিনি পূর্ব জন্মের অভ্যাস বশে যেন অবশ হয়ে যোগ-সাধনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রকার যোগশাস্ত্রের জিজ্ঞাসু পুরুষ বেদোক্ত সকাম কর্মমার্গকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ সকাম কর্মমার্গে যে ফল নির্দিষ্ট আছে, তার থেকে উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ উচ্চ স্তরের যোগীরা বেদের কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট নন, কিন্তু তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই যোগ-পদ্ধতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন, যা তাদের কৃষ্ণভাবনামৃতের স্তরে উন্নীত করে। এই কৃষ্ণভাবনামৃতই হচ্ছে পরমার্থ সাধনের সর্বোচ্চ স্তর। শ্রীমদ্ভাগবতে (৩/৩৩/৭) বৈদিক কর্মকাণ্ডের প্রতি উন্নত পরমার্থবাদীর নিরাসক্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান
যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।
তেপুক্তপত্তে জুহুঃ সমুরার্যা
ব্রহ্মানুচুনাম গুণন্তি যে তে ।।
“হে ভগবান ! চণ্ডালকুলে জন্মগ্রহণ করেও যদি কেউ তোমার অপ্রাকৃত নাম কীৰ্তন করেন, তবে বুঝতে হবে যে, তিনি পারমার্থিক জীবনে অত্যন্ত উন্নত। যিনি ভগবানের নাম করেন, তিনি নিঃসন্দেহে ইতিপূর্বেই সব রকমের তপশ্চর্যা, যাগ- যজ্ঞ, তীর্থস্নান ও শাস্ত্র অধ্যয়ন সমাপ্ত করেছেন।”
এই সম্বন্ধে একটি খুব সুন্দর দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঠাকুর হরিদাস, যাঁকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অন্যতম পার্ষদরূপে গ্রহণ করেছিলেন। যদিও হরিদাস ঠাকুর যবনকুলে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে নামাচার্যরূপে ভূষিত করেছিলেন, কেন না তিনি একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিন লক্ষ হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে জপ করেছিলেন। যেহেতু তিনি নিরন্তর ভগবানের নাম কীর্তন করতেন, এর থেকে বোঝা যায় যে, পূর্ব জন্মে তিনি শব্দব্রহ্ম নামক বৈদিক কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান পূর্ণরূপে সম্পন্ন করেছিলেন। অতএব শুদ্ধ না হলে ভগবদ্ভক্তি লাভ করা যায় না এবং ভগবানের অপ্রাকৃত নাম সমন্বিত হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র উচ্চারণ করা যায় না।