শ্লোকঃ ৩৯

এতন্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ ।

ত্বদন্যঃ সংশয়স্যাস্য ছেত্তা ন হ্যপপদ্যতে ॥ ৩৯ ॥

এতৎ—এই: মে—আমার; সংশয়ম্ – সংশয়; কৃষ্ণ – হে কৃষ্ণ, ছেত্তুম্—দূর করতে; অইসি—তুমি সমর্থ; অশেষতঃ — সর্বতোভাবে; ত্ব—তুমি ছাড়া; অন্যঃ – অন্য কেউ; সংশয়স্য—সংশয়ের; অস্য—এই; ছেত্তা— ছেদনকারী; ন–না; হি—অবশ্যই; উপপদ্যতে—পাওয়া যাবে।

গীতার গান

তুমি কৃষ্ণ সে স্বয়ং সব কিছু জান ৷

তুমি বিনা ছেত্তা কিবা আছে আর আন ॥

অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! তুমিই কেবল আমার এই সংশয় দূর করতে সমর্থ। কারণ, তুমি ছাড়া আর কেউই আমার এই সংশয় দূর করতে পারবে না।

তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত। ভগবদ্গীতার প্রারম্ভে ভগবান বলেছেন যে, প্রতিটি জীবই তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এমন কি, জড় বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করার পরেও তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে। এভাবেই তিনি প্রতিটি জীবের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। এখন, অর্জুন তাঁর কাছ থেকে জানতে চাইছেন, যে সমস্ত সাধকেরা তাঁদের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারলেন না, তাঁদের কি পরিণতি হবে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষ, তাঁর ঊর্ধ্বে আর কেউ নেই, এমন কি তাঁর সমকক্ষও কেউ হতে পারে না। তথাকথিত সমস্ত জ্ঞানী ও দার্শনিকেরা, যারা প্রকৃতির কৃপার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল, তারাও কখনও ভগবানের সমকক্ষ হতে পারে না। তাই, আমাদের সমস্ত সন্দেহ নিরসনের জন্য ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণীই হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র, কারণ তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত, কিন্তু তাঁকে কেউ কখনও সম্পূর্ণরূপে জানতে পারে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তেরাই যথার্থ তত্ত্বজ্ঞ।

শ্লোকঃ ৪০

শ্রীভগবানুবাচ

পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে ।

ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ দুৰ্গতিং তাত গচ্ছতি ॥ ৪০ ॥

শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; পার্থ—হে পৃথাপুত্র; নৈব – কখনও এই রকম হয় না; ইহ—এই জড় জগতে; ন–না; অমুত্র — পরলোকে; বিনাশঃ

—বিনাশ; তস্য—তার; বিদ্যতে – বিদ্যমান; ন–না; হি— যেহেতু; কল্যাণকৃৎ— শুভ অনুষ্ঠানকারী; কশ্চিৎ—কেউই; দুর্গতিম্—দুর্গতি; তাত— হে বৎস ; গচ্ছতি — প্রাপ্ত হয়।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

হে পার্থ ! শুনহ তুমি সে রূপ তাহার ।

একজন্মে নহে সিদ্ধ বিপত্তি অপার ৷।

তাহারও নাহি নাশ ইহ বা অমুত্ৰ ৷

কল্যাণ কার্য যে সেই বিজয় সর্বত্র ৷।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন – হে পার্থ! শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদের ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি হয় না। হে বৎস! তার কারণ, কল্যাণকারীর কখনও অধোগতি হয় না ।

তাৎপর্যঃ শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৫/১৭) শ্রীনারদ মুনি ব্যাসদেবকে নির্দেশ দিয়েছেন-

ত্যক্ত্রা স্বধর্ম চরণাম্বুজং হরে-

ভর্জন্নপকোহথ পতেত্ততো যদি ।

যত্র ক বাভদ্রমভূদমুষ্য কিং

কো বার্থ আপ্তোহভজতাং স্বধর্মতঃ।।

“কেউ যদি সব রকম জড়-জাগতিক কর্তব্য পরিত্যাগ করে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের শরণাগত হয়, তা হলে তার কোন রকম ক্ষতি বা পতনরূপী অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকে না। পক্ষান্তরে, সর্বতোভাবে স্বধর্মাচরণে রত অভক্তের কোনই লাভ হয় না।” জাগতিক উন্নতির জন্য নানা রকম শাস্ত্রোক্ত ও প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান আছে। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করবার জন্য পরমার্থ সাধককে এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগ করতে হয়। তর্কের খাতিরে কেউ বলতে পারে যে, ভগবদ্ভক্তি সাধনের পথে সিদ্ধি লাভ করলে পরমার্থ সাধিত হতে পারে, কিন্তু যদি সিদ্ধি লাভ না হয় তা হলে তার জাগতিক জীবন ও পারমার্থিক জীবন উভয়ই বিফলে

যায়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, শাস্ত্রের বিধান অনুসারে স্বধর্মের আচরণ না করলে তাকে সেই পাপের ফল ভোগ করতে হয়; তাই কেউ যদি যথাযথভাবে পরমার্থ সাধনে ব্যর্থ হয়, তা হলে শাস্ত্র নির্দেশিত স্বধর্ম আচরণ না করার জন্য তার ফল ভোগ করতে হয়। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের সংশয় দূর করবার জন্য শ্রীমদ্ভাগবত অসফল পরমার্থবাদীকে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, এক জীবনে পরমার্থ সাধনে সিদ্ধি লাভ না করতে পারলেও তাতে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। এমন কি যদিও স্বধর্ম যথাযথভাবে অনুষ্ঠান না করার জন্য তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ার অধীন হলেও, তাঁর ক্ষতির কোন কারণ নেই। কারণ, শুভ কৃষ্ণভাবনামৃত কখনও বিফলে যায় না এবং পরবর্তী জীবনে কেউ যদি অত্যন্ত নীচ বংশেও জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেও তিনি ভগবদ্ভক্তির মার্গ থেকে বিচ্যুত হন না। পক্ষান্তরে, কেউ যদি একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে স্বধর্মের আচার অনুষ্ঠান করে, কিন্তু অন্তরে যদি ভগবদ্ভক্তি না থাকে, তা হলে তার কোনই কল্যাণ হয় না।

এই তাৎপর্যে আমরা বুঝতে পারি যে, মানুষকে দুভাগে ভাগ করা যায়— সংযত ও উচ্ছৃঙ্খল। যে সমস্ত মানুষ পরজন্মের কথা বিবেচনা না করে, পারমার্থিক মুক্তির কথা বিবেচনা না করে, কেবল পশুর মতো তাদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করার চেষ্টা করে, তারা উচ্ছৃঙ্খল পর্যায়ভুক্ত। আর যারা শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবন যাপন করে, তারা সংযত পর্যায়ভুক্ত। যারা উচ্ছৃঙ্খল, তারা উন্নত হোক বা অনুন্নতই হোক, সভ্য হোক বা অসভ্যই হোক, শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিতই হোক, শক্তিশালী হোক অথবা দুর্বলই হোক, তারা সকলেই পাশবিক প্রবৃত্তির দ্বারা প্রভাবিত। তাদের ক্রিয়াকলাপ কখনও মঙ্গলজনক হয় না, কারণ আহার, নিদ্রা, ভয় আর মৈথুনের মাধ্যমে পশুর মতো ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করে সুখের অন্বেষণ করার ফলে তারা চিরকালই দুঃখময় জড় জগতে পড়ে থাকে এবং নিরন্তর দুঃখকষ্ট ভোগ করে। পক্ষান্তরে, যাঁরা শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী সংযত জীবন যাপন করে ক্রমান্বয়ে কৃষ্ণভক্তির পর্যায়ে উন্নীত হন, তাঁদের জন্ম হয় সার্থক।

যাঁরা মঙ্গলজনক সংযত জীবন যাপন করেন, তাঁদের আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১) ‘কর্মী’ – যারা শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করে জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছেন। ২) ‘মুক্তিকামী’ – যাঁরা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং ৩) ‘ভগবদ্ভক্ত’—যাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে সর্বতোভাবে আত্মোৎসর্গ করে তাঁর সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করে চলেছেন যে সমস্ত কর্মী, তাঁদের আবার দুভাগে ভাগ করা যায়— ‘সকাম কর্মী’ ও ‘নিষ্কাম কর্মী। ধর্ম আচরণ করার প্রভাবে অর্জিত পুণ্যফলের বলে যাঁরা জড় সুখভোগ করতে চান, তাঁরা উন্নত জীবন প্রাপ্ত হন, এমন কি তাঁরা স্বর্গলোকও প্রাপ্ত হন। কিন্তু জড় সুখভোগ করার বাসনায় আসক্ত থাকার ফলে তাঁরা যথার্থ মঙ্গলজনক পথ অনুসরণ করছেন না। জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টাই হচ্ছে মঙ্গলজনক কার্যকলাপ। পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে অথবা দেহাত্মবুদ্ধি থেকে জীবকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে যে কর্ম সাধিত হয় না, তা কোন মতেই মঙ্গলজনক নয়। কৃষ্ণভাবনাময় কর্মই হচ্ছে একমাত্র মঙ্গলময় কর্ম। এই কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগের পথে প্রগতির জন্য যিনি স্বেচ্ছায় সব রকম শারীরিক অসুবিধাগুলিকে সহ্য করেন, তিনি নিঃসন্দেহে তপোনিষ্ঠ পূর্ণযোগী। অষ্টাঙ্গ-যোগেরও পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করা, তাই এই প্রচেষ্টাও অত্যন্ত মঙ্গলজনক এবং যিনি এই মার্গে ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, তাঁরও কোন রকম অধঃপতনের সম্ভাবনা নেই।

শ্লোকঃ ৪১

প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ

শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে ।৷ ৪১ ॥

প্রাপ্য—লাভ করে; পুণ্যকৃতাম্ — পুণ্যবানদের, লোকান্ — লোকসমূহ: উষিত্বা— বাস করে; শাশ্বতীঃ—বহু, সমাঃ—বৎসর; শুচীনাম্ — সদাচারী; শ্রীমতাম্—ধনীর; গেহে—গৃহে; যোগভ্রষ্টঃ—যোগ থেকে বিচ্যুত ব্যক্তি; অভিজায়তে জন্মগ্রহণ করেন।

গীতার গান

যদিবা হইল ভ্রষ্ট যোগের সাধনে।

 তথাপি সে পায় সেই যাহা পুণ্যবানে।।

উত্তম ব্রাহ্মণ ধনী বণিকের ঘরে ।

যোগভ্রষ্ট জন্ম লয় বিধির বিচারে ।।

অনুবাদঃ যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবানদের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমূহে বহুকাল বাস করে সদাচারী ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা শ্রীমান ধনী বণিকদের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।

তাৎপর্যঃ যোগভ্রষ্ট যোগী দুই প্রকারের—এক শ্রেণী হচ্ছেন যাঁরা অল্প সাধনার পর পতিত হয়েছেন, আর অপর শ্রেণী হচ্ছেন যাঁরা দীর্ঘকাল যোগাভ্যাস করার পর ভ্রষ্ট হয়েছেন। অল্প সাধনার পর যাঁরা পতিত হয়েছেন, তাঁরা উচ্চতর লোকে যান, যেখানে পুণ্যবানেরা প্রবেশ করার অধিকার লাভ করেন। সেখানে দীর্ঘকাল নানা রকম সুখভোগ করার পরে তাঁরা আবার এই জগতে ফিরে আসেন এবং সৎ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব অথবা ধনী বণিকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

যোগসাধন করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করা, যা এই অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই রকমের লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগেই যদি কেউ মোহিনী মায়ার প্রভাবে ভ্রষ্ট হন, তা হলে ভগবানের কৃপায় তাঁরা তাঁদের জাগতিক কামনা-বাসনার তৃপ্তিসাধন করার পূর্ণ সুযোগ পান এবং তারপর ধার্মিক অথবা সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই ধরনের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে তাঁরা ভগবদ্ভক্তি লাভ করার সুযোগ পান। তাই, তাঁরা ধার্মিক ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করে তাঁদের ভগবদ্ভক্তি সাধনে ব্রতী হওয়া উচিত।

error: Content is protected !!