শ্লোকঃ ৩৬
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ ।
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোঽবাপ্তুমুপায়তঃ ॥ ৩৬ ॥
অসংযত —অসংযত; আত্মনা—মনের দ্বারা, যোগঃ – আত্ম-উপলব্ধি; দুষ্প্রাপঃ- দুষ্প্রাপ্য; ইতি—এভাবে; মে— আমার; মতিঃ – অভিমত; বশ্য — বশীভূত; আত্মনা— মনের দ্বারা; তু– কিন্তু, যততা — যত্নবান; শক্যঃ – সমর্থ; অবাপ্তম্ — লাভ করতে; উপায়তঃ— যথার্থ উপায় অবলম্বন করে।
গীতার গান
অসংযত মন যার যোগ সে দুষ্কর ।
সেই সে আমার মত বুঝহ বিস্তর ॥
আত্মবশী চেষ্টা করি যে করে উপায় ।
তাহার সে কার্যসিদ্ধি জানহ নিশ্চয় ॥
অনুবাদঃ অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই আমার অভিমত।
তাৎপর্যঃ ভগবান আমাদের এখানে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, জড় বিষয় থেকে মনকে অনাসক্ত করার যথার্থ চিকিৎসা গ্রহণ না করলে কখনই যোগ-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায় না। মনকে সুখভোগে নিয়োজিত রেখে যোগের অনুশীলন করাটা জল ঢেলে আগুন জ্বালাবার চেষ্টার সামিল। মনকে সংযত না করে যোগ অনুশীলন করা কেবল সময়েরই অপচয়। এই ধরনের লোকদেখানো যোগসাধনা অর্থ উপার্জন করার একটি ভাল উপায় হতে পারে, কিন্তু পরমার্থ সাধনের ব্যাপারে তা সম্পূর্ণ নিরর্থক। তাই, নিরন্তর ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময় সেবায় নিয়োজিত করে মনকে সংযত করতে হয়। কৃষ্ণভাবনামৃত বা ভগবৎ-সেবা ছাড়া মনকে কখনও সংযত করা যায় না। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত আলাদা প্রচেষ্টা ছাড়াই অনায়াসে যোগ- সাধনার সমস্ত ফল লাভ করেন। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় না হয়ে যোগ অনুশীলনকারী কখনই তাঁর যোগ-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারেন না।
শ্লোকঃ ৩৭
অর্জুন উবাচ
অযতিঃ শ্রদ্ধয়োপেতো যোগাচ্চলিতমানসঃ ।
অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি ॥ ৩৭ ॥
অর্জুনঃ উবাচ— অর্জুন বললেন; অযতিঃ ব্যর্থ যোগী; শ্রদ্ধয়া—শ্রদ্ধা সহকারে; উপেতঃ—যুক্ত; যোগাৎ—যোগ থেকে; চলিত – ভ্ৰষ্ট; মানসঃ—চিত্ত; অপ্রাপ্য না পেয়ে, যোগসংসিদ্ধিম্ — যোগের সম্যক ফল; কাম্ — কি; গতিম্—গতি, কৃষ্ণ হে কৃষ্ণ; গচ্ছতি—প্রাপ্ত হন।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
চেষ্টা করিয়াও যদি সিদ্ধ নাহি হয় ।
হে কৃষ্ণ! বল তার কি আছে উপায় ৷।
সাধ্যমত চেষ্টা করি বিচলিত হয় ৷
অপ্রাপ্য সে যোগসিদ্ধি তাহার নিশ্চয় ৷।
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন – হে কৃষ্ণ! যিনি প্রথমে শ্রদ্ধা সহকারে যোগে যুক্ত থেকে পরে চিত্তচাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়ে যোগে সিদ্ধিলাভ করতে না পারেন, তবে সেই ব্যর্থ যোগীর কি গতি লাভ হয়?
তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতাতে আত্ম-উপলব্ধির পন্থা বা যোগের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আত্ম- উপলব্ধি বলতে সেই জ্ঞানকে বোঝায় যার ফলে বুঝতে পারা যায় যে, এই জড় দেহটি জীবের স্বরূপ নয়, তার স্বরূপ হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময় আত্মা। এই স্বরূপ অপ্রাকৃত, তা জড় দেহ ও মনের অতীত। জ্ঞানযোগ, অষ্টাঙ্গযোগ অথবা ভক্তিযোগের মাধ্যমে এই আত্ম-উপলব্ধি অন্বেষণ করতে হয়। এই সব কয়টি পন্থাতেই অনুশীলনকারীকে জানতে হয় জীবের স্বরূপ কি, তার সঙ্গে ভগবানের কি সম্পর্ক এবং কিভাবে ভগবানের সাথে সেই সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া যায়। এই তিনটি পথের যে কোন একটিকে অবলম্বন করে সর্বান্তঃকরণে তার অনুশীলন করতে শুরু করলে এক সময় না এক সময় গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায় । ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান আশ্বাস দিয়ে বলেছেন যে, পরমার্থ সাধনের পথে স্বল্প প্রচেষ্টাও জড় বন্ধন থেকে মুক্ত করে এবং মহৎ ভয়ের থেকে ত্রাণ করে। এই তিনটি পন্থার মধ্যে ভক্তিযোগই এই যুগের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী। কারণ, ভগবানকে জানবার জন্য এটিই হচ্ছে সবচেয়ে সহজ পথ। মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর করার জন্য অর্জুন আবার ভগবানকে সেই কথা জিজ্ঞেস করছেন। যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে আমরা জ্ঞানযোগ ও অষ্টাঙ্গ যোগের অনুশীলন করতে পারি। কিন্তু তাদের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান লাভ করা এই কলিযুগে অত্যন্ত কঠিন। তাই, ঐকান্তিক চেষ্টা থাকলেও সিদ্ধি লাভ না হতেও পারে—নানা কারণে তার পদস্খলন হতে পারে। সর্বপ্রথমে, কেউ হয়ত যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে পন্থাটি অনুশীলন নাও করতে পারে। পরমার্থ সাধনে ব্রতী হওয়া মায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করারই সামিল। অতএব, কেউ যখন জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে, তখন মায়া বা জড়া প্রকৃতি তাকে নানাভাবে প্রলোভিত করে বিপথগামী করার চেষ্টা করে। বদ্ধ জীব এমনিতেই জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মুগ্ধ হয়ে আছে, তাই পরমার্থ সাধন করার সময় পুনরায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে । একে বলা হয় যোগাচ্ছলিতমানসঃ—যোগের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়া। এভাবেই যোগভ্রষ্ট হয়ে পড়লে তার পরিণাম কি হয় তা জানতে অর্জুন উৎসুক।
শ্লোকঃ ৩৮
কচ্ছিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি ।
অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্ৰহ্মণঃ পথি ॥ ৩৮ ৷।
কচ্চিৎ— কি; ন–না; উভয়—উভয়, বিভ্ৰষ্টঃ — স্রষ্ট; ছিন্ন — ছিন্ন, অভ্রম্ – মেঘ; ইব—মতো; নশ্যতি—নষ্ট হয়, অপ্রতিষ্ঠঃ – নিরাশ্রয়, মহাবাহো – হে মহাবীর কৃষ্ণ, বিমূঢ়ঃ — বিমূঢ়; ব্রহ্মণঃ ব্রহ্ম লাভের; পথি পথে।
গীতার গান
উভয় ভ্রষ্ট ছিন্নাভ্র মতো সর্বনাশ ।
বিমূঢ় ব্রহ্মের পথে কিবা তার আশ ॥
মহাবাহো ! এ সংশয় করহ ছেদন ।
ঘুচাও আপনি সেই মনের বেদন ৷।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো কৃষ্ণ। কর্ম ও যোগ হতে ভ্রষ্ট ব্যক্তি ব্রহ্ম লাভের পথ থেকে বিমূঢ় হয়ে যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে, সে কি ছিন্ন মেঘের মতো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে ?
তাৎপর্যঃ দুটি পথ ধরে এগোনো যায়। যারা বিষয়াসক্ত, তারা পরমার্থ নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই তারা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে জড় বিষয় ভোগ করতে তৎপর, অথবা যথোচিত কর্ম অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে স্বৰ্গলোকে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়াসী। কেউ যখন পারমার্থিক পথ অবলম্বন করে, তখন তাকে সব রকম বৈষয়িক কর্ম পরিত্যাগ করতে হয় এবং সব রকম জড় সুখভোগের বাসনা পরিত্যাগ করতে হয়। এই পরমার্থ সাধনে তিনি যদি সফল না হন, তখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, তিনি দুই দিকই হারালেন—তিনি জড় সুখভোগ করতে পারলেন না, আর পারমার্থিক সিদ্ধিও লাভ করতে পারলেন না। তিনি যেন বায়ু তাড়িত মেঘের মতোই ছন্নছাড়া। আকাশে অনেক সময় এক টুকরা মেঘ একটি ছোট মেঘ থেকে সরে গিয়ে একটি বড় মেঘের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু সে যদি সেই বড় মেঘটির সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে, তা হলে সে বায়ুর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে অসীম আকাশে হারিয়ে যায়। ব্রহ্মণঃ পথি কথাটির অর্থ হচ্ছে পরমার্থ সাধনের পথ, যার অনুশীলনের ফলে উপলব্ধি হয় যে, জীবের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে তার আত্মা। এই আত্মা হচ্ছে সেই পরমেশ্বরের অংশ, যিনি ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবানরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম তত্ত্বের পূর্ণ প্রকাশ; তাই তাঁর চরণে যিনি প্রপত্তি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন সার্থক পরমার্থবাদী। ব্রহ্ম ও পরমাত্মা উপলব্ধির মাধ্যমে জীবনের পরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে বহু বহু জন্মের প্রচেষ্টার ফলে সম্ভব হতে পারে— বহুনাং জন্মনামন্তে। তাই পরমার্থ সাধনের পরম শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনামৃত, যার ফলে আমরা সরাসরিভাবে জানতে পারি—ভগবান কে? শ্রীকৃষ্ণ কে? তাঁর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক?