শ্লোকঃ ৩৩

অর্জুন উবাচ

যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন ।

এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্ ॥ ৩৩ ৷।

অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; যঃ অয়ম্ –এই পদ্ধতি; যোগঃ—যোগ: ত্বয়া- তোমার দ্বারা; প্রোক্তঃ—বর্ণিত হল; সাম্যেন— সমদর্শনরূপ; মধুসূদন – হে মধুসূদন; এতস্য—এর; অহম্ – আমি; ন–না; পশ্যামি — দেখি; চঞ্চলত্বাৎ—- চাঞ্চল্যবশত; স্থিতিম্—স্থিতি; স্থিরাম্—স্থায়ী।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

আপনি যে যোগবার্তা কহিলেন আমারে ।

হে মধুসূদন ! তাহা না সম্ভবে মোরে ॥

মোর মন চঞ্চল সে অস্থির সে মতি ৷

অতএব বুঝি আমি অসম্ভব গতি ৷৷

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন-হে মধুসূদন ! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।

তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে শুচৌ দেশে থেকে শুরু করে যোগী পরমঃ পর্যন্ত যে যোগ-পদ্ধতির বর্ণনা করেছেন, অর্জুন এখানে সেই যোগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ তিনি নিজেকে সেই যোগসাধনে অযোগ্য বলে মনে করেছেন। এই কলিযুগে সাধারণ মানুষের পক্ষে গৃহত্যাগ করে পাহাড়-পর্বতে অথবা বনে-জঙ্গলে গিয়ে নির্জন স্থানে যোগাভ্যাস করা সম্ভব নয়। এই যুগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বল্প-আয়ুবিশিষ্ট জীবনের জন্য তিক্ত জীবন-সংগ্রাম। এই যুগের সাধারণ মানুষ এতই অধঃপতিত যে, পরমার্থ সাধন করবার কোন প্রচেষ্টাই তাদের মধ্যে নেই। অতি সহজ সরল পন্থা অবলম্বন করেও তারা পরমার্থ সাধনের প্রয়াসী হয় না। তা হলে জীবনযাত্রা, উপবেশনের প্রক্রিয়া, স্থান নির্বাচন এবং জড় বিষয় থেকে মনের আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করে অত্যন্ত দুরূহ ও দুঃসাধ্য যোগের সাধন তারা কিভাবে করবে? তাই বাস্তব জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞ অর্জুনের মতো মহাবীর চিন্তা করলেন, এই যোগসাধন করা একেবারেই অসম্ভব, এমন কি বিভিন্ন দিক থেকে তাঁর অনুকূল পরিস্থিতি থাকলেও। অর্জুন ছিলেন অতি উচ্চ বংশজাত রাজকুমার এবং তিনি অনন্ত গুণে বিভূষিত। তিনি ছিলেন মহা বীর্যবান, দীর্ঘায়ু-সম্পন্ন মহারথী এবং সর্বোপরি তিনি ছিলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ সখা। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে অর্জুনের সুযোগ-সুবিধা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এই যোগপদ্ধতি সাধন করতে অস্বীকার করেন। প্রকৃতপক্ষে, ইতিহাসের কোথাও তাঁকে এই যোগ অনুশীলন করতে দেখা যায়নি। তাই আমাদের বুঝতে হবে যে, কলিযুগে অষ্টাঙ্গযোগ সাধন করা সাধারণত মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কয়েকজন দুর্লভ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু সাধারণের পক্ষে এটি অসম্ভব। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে যদি এই রকম হয়ে থাকে, তা হলে এখনকার অবস্থা কি হবে? যে সমস্ত মানুষ বিভিন্ন যোগ অনুশীলন কেন্দ্রে এই যোগ-পদ্ধতির অন্ধানুকরণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, তারা কেবল তাদের সময়ের অপব্যবহার করছে। তাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ।

শ্লোকঃ ৩৪

চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দঢ়ম্ ।

তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥ ৩৪ ॥

চঞ্চলম্— চঞ্চল; হি— নিশ্চিতভাবে; মনঃ—মন; কৃষ্ণ – হে কৃষ্ণ, প্রমাণি বিক্ষোভকর; বলবৎ বলবান; দৃঢ়ম্—দুর্দমনীয়; তস্য—তার; অহম্ –আমি; নিগ্রহম্ — নিগ্রহ; মন্যে — মনে করি; বায়োঃ – বায়ুর; ইব— মতো; সুদুষ্করম্— সুকঠিন।

গীতার গান

হে কৃষ্ণ জান না কিবা প্রমাথী মনেরে ।

অতি বলবান সেই সব পণ্ড করে ৷।

তাহার নিগ্রহ মানি অতি সুদুষ্কর ।

বায়ুরোধ যথা হয় অত্যন্ত প্রখর।।

অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি।

তাৎপর্যঃ মন এতই বলবান ও দুর্দমনীয় যে, সে কখনও কখনও বুদ্ধির উপর আধিপত্য বিস্তার করে তাকে পরিচালিত করতে থাকে, যদিও স্বাভাবিকভাবে মন বুদ্ধির অধীনেই থাকা উচিত। সাংসারিক মানুষকে প্রতিনিয়ত নানা রকম বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়, তাই তার পক্ষে মনকে সংযত করা অত্যন্ত কঠিন। কৃত্রিম উপায়ে শত্রু ও মিত্রের প্রতি সমদৃষ্টি-সম্পন্ন হয়ে মনের ভারসাম্য সৃষ্টি করার অভিনয় করলেও, বাস্তবিকভাবে কোন সংসারী মানুষ তা করতে পারে না। কারণ, তা প্রচণ্ড বেগবতী বায়ুকে সংযত করার চাইতেও কঠিন। বৈদিক শাস্ত্রে (কঠ উপনিষদ ১/৩/৩-৪) বলা হয়েছে——

আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু ।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমের চ।।

ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহবিষয়াংস্তেষু গোচরান ।

আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ ॥

“এই দেহরূপ রথের আরোহী হচ্ছে জীবাত্মা, বুদ্ধি হচ্ছে সেই রথের সারথি। মন হচ্ছে তার বল্গা এবং ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে ঘোড়া। এভাবেই মন ও ইন্দ্রিয়ের সাহচর্যে আত্মা সুখ ও দুঃখ ভোগ করে। চিন্তাশীল মনীষীরা এভাবেই চিন্তা করেন।” বুদ্ধির দ্বারা মনকে পরিচালিত করা উচিত, কিন্তু মন এত শক্তিশালী ও দুর্দমনীয় যে, বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে সে বুদ্ধিকেই পরাভূত করে তাকে পরিচালিত করতে শুরু করে। ঠিক যেমন, অনেক সময় জটিল সংক্রমণ ওষুধের রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতাকে অতিক্রম করে। এই রকম শক্তিশালী যে মন, তাকে যোগ-সাধনার মাধ্যমে সংযত করার বিধান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অর্জুনের মতো প্রবৃত্তি-মার্গের মানুষের পক্ষেও তা সাধন করা বাস্তবসম্মত নয়। সুতরাং, আধুনিক মানুষের সম্বন্ধে আর কি বলার আছে? এই সম্পর্কে এখানে বায়ুর যে উপমা দেওয়া হয়েছে, তা খুবই উপযুক্ত। বেগবতী বায়ুকে দমন করার ক্ষমতা কারও নেই এবং তার তুলনায় অস্থির মনকে বশ করা আরও কঠিন। মনকে দমন করার সবচেয়ে সহজ পন্থা প্রদর্শন করে গেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। সেই পন্থা হচ্ছে পূর্ণ দৈন্য সহকারে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করা। এই পথ হচ্ছে স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়োঃ— মনকে সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করতে হবে। তা হলেই আর কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মন উদ্বিগ্ন হবে না।

শ্লোকঃ ৩৫

শ্রীভগবানুবাচ

অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ।

অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে ॥ ৩৫ ॥

শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; অসংশয়ম্ — সন্দেহ নেই; মহাবাহো—হে মহাবীর; মনঃ – মন; দুর্নিগ্রহম্ — দুর্দমনীয়; চলম্— চঞ্চল; অভ্যাসেন-অভ্যাসের দ্বারা; তু– কিন্তু, কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র; বৈরাগ্যেণ— বৈরাগ্যের দ্বারা; চ—ও, গৃহ্যতে বশীভূত করা সম্ভব।

গীতার গান

ভগবান কহিলেনঃ

অসংশয় সেই কথা তুমি যা কহিলে ৷

অত্যন্ত কঠিন সেই মনের চঞ্চলে ।।

কিন্তু যদি করে চেষ্টা শুনহ কৌন্তেয় ৷

বৈরাগ্য সাধনে তবে হয় কার্য শ্রেয় ৷।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে মহাবাহো ! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।

তাৎপর্যঃ অবাধ্য মনকে সংযত করা যে কত কঠিন তা অর্জুন বুঝতে পেরেছিলেন। ভগবানও সেই কথা স্বীকার করলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান জানিয়ে দিলেন যে, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা তা সম্ভব। সেই অভ্যাসটি কি? বর্তমান কলিযুগে তীর্থবাস, পরমাত্মার ধ্যান, মন ও ইন্দ্রিয়গুলির নিগ্রহ, ব্রহ্মচর্য, নির্জন বাস আদি কঠোর বিধি-বিধান পালন করা সম্ভব নয়। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করার ফলে নববিধা ভগবদ্ভক্তি সাধন করা যায়। ভক্তির প্রথম ও প্রধান অঙ্গ হচ্ছে কৃষ্ণকথা শ্রবণ। মনকে সমস্ত ভ্রান্তি ও অনর্থ থেকে শুদ্ধ করার জন্য এটি অতি শক্তিশালী পন্থা। কৃষ্ণকথা যত বেশি শ্রবণ করা যায়, মন ততই প্রবুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণবিমুখ বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত হয়। কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল কার্যকলাপ থেকে মনকে অনাসক্ত করার ফলে সহজেই বৈরাগ্য শিক্ষা লাভ করা যায়। বৈরাগ্য মানে হচ্ছে বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি এবং ভগবানের প্রতি আসক্তি। কৃষ্ণলীলায় মনকে আসক্ত করার থেকে নির্বিশেষ বৈরাগ্য অনেক বেশি কঠিন। কৃষ্ণলীলার প্রতি আসক্তি বস্তুত খুবই সহজসাধ্য, কারণ কৃষ্ণকথা শ্রবণ করা মাত্রই শ্রোতা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়। এই আসক্তিকে বলা হয় পরেশানুভব, অর্থাৎ পারমার্থিক সন্তোষ। এই অনুভূতি অনেকটা ক্ষুধার্ত ব্যক্তির প্রতি গ্রাসে গ্রাসে ক্ষুধা-নিবৃত্তিরূপ তৃপ্তির মতো। ক্ষুধার সময় যতই ভোজন করা হয়, ততই তৃপ্তি ও শক্তি অনুভব হয়। সেই রকম, ভক্তির প্রভাবে মন বিষয়াসক্তি থেকে মুক্ত হয় এবং অপ্রাকৃত তৃপ্তি অনুভূত হয়। এই পদ্ধতি অনেকটা সুদক্ষ চিকিৎসা এবং উপযুক্ত আহারের দ্বারা রোগ নিরাময় করার মতো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় লীলা শ্রবণ করা হচ্ছে উন্মত্ত মনের সুদক্ষ চিকিৎসা এবং কৃষ্ণপ্রসাদ হচ্ছে ভবরোগ নিরাময়ের উপযুক্ত পথ্য। এই সৰ্বাঙ্গীণ চিকিৎসা হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত।

error: Content is protected !!