ষষ্ঠ অধ্যায়
ধ্যানযোগ
শ্লোকঃ ১
শ্রীভগবানুবাচ
অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ ।
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ ॥ ১ ॥
শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; অনাশ্রিতঃ–আশ্রয় বা অপেক্ষা না করে; কর্মফলম্—কর্মফলের; কার্য—কর্তব্য; কর্ম—কর্ম; করোতি — অনুষ্ঠান করেন; যঃ– যিনি; সঃ – তিনি; সন্ন্যাসী — সন্ন্যাসী; চ–ও; যোগী — যোগী; চ– ও; ন–না; নিরগ্নিঃ— অগ্নি রহিত; ন-না; চ–ও; অক্রিয়ঃ – নিষ্ক্রিয়।
গীতার গান
ভগবান কহিলেনঃ
অনাশ্রিত কর্মফল সেই মুখ্য হয় ৷
তাহা বিনা সন্ন্যাসী কি যোগী কিছু নয় ॥
কর্মত্যাগ নহে মুখ্য কর্মফল ত্যাগ ।
দৈহিক চেষ্টা সে ত্যাগ নহে ত সম্যক ৷।
তাই সে সন্ন্যাসী যোগী সমান যে ক্রম ।
কর্মফল ত্যাগ বিনা দুই সেই ভ্ৰম ।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন – যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশূন্য তিনি সন্ন্যাসী বা যোগী নন। যিনি কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই যথার্থ সন্ন্যাসী বা যোগী।
তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন যে, অষ্টাঙ্গযোগ হচ্ছে মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করার একটি পন্থাবিশেষ। তবে এই যোগ সকলের পক্ষে অনুশীলন করা কষ্টকর, বিশেষ করে এই কলিযুগে তা অনুশীলন করা এক রকম অসম্ভব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ে অষ্টাঙ্গ যোগের পদ্ধতি বর্ণনা করে অবশেষে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন যে, কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম বা কর্মযোগ অষ্টাঙ্গযোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই জগতের সকলেই তার স্ত্রী, পুত্র, পরিজনের ভরণ-পোষণের জন্য কর্ম করে। ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা ভোগবাঞ্ছা ব্যতীত কেউই কোন কর্ম করে না। কিন্তু সাফল্যের মানদণ্ড হচ্ছে কর্মফলের প্রত্যাশা না করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য কর্ম করা। প্রতিটি জীবই ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই ভগবানের সেবা করাই হচ্ছে তাদের একমাত্র কর্তব্য। শরীরের বিবিধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ শরীরের পালন-পোষণের জন্য কর্ম করে, তাদের আংশিক স্বার্থের জন্য নয়। তেমনই, যে মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে পরব্রহ্মের তৃপ্তির জন্য কর্ম করেন, তিনি হচ্ছেন প্রকৃত সন্ন্যাসী এবং প্রকৃত যোগী।
ভ্রান্তিবশত, কিছু সন্ন্যাসী মনে করে যে, তারা সব রকম জাগতিক কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়েছে এবং তাই তারা অগ্নিহোত্র যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করা ত্যাগ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা স্বার্থপরায়ণ, কারণ তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বিশেষ ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করা। এই সমস্ত বাসনা জাগতিক কামনা থেকে মহত্তর হলেও তা স্বার্থশূন্য নয়। ঠিক তেমনই, সব রকমের জাগতিক ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগ করে, অর্ধনিমীলিত নেত্রে যোগী যে তপস্যা করে চলেছেন, তাও ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত। তিনিও তাঁর আত্মতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্তই হচ্ছেন একমাত্র যোগী, যিনি পরমেশ্বরের তৃপ্তিসাধন করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করেন। তাই, তাতে একটুও স্বার্থসিদ্ধির বাসনা থাকে না। শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধান করাটাই তাঁর সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি, তাই, তিনিই হচ্ছেন যথার্থ যোগী, যথার্থ সন্ন্যাসী। বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রার্থনা করেছেন-
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং
কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে ।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে
ভবতাম্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি ॥
‘হে জগদীশ্বর! আমি ধন কামনা করি না, আমি অনুগামী কামনা করি না এবং আমি সুন্দরী স্ত্রী কামনা করি না। আমার একমাত্র কামনা হচ্ছে, আমি যেন জন্ম- জন্মান্তরে তোমার প্রতি অহৈতুকী ভক্তি লাভ করতে পারি।”
শ্লোকঃ ২
যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পাণ্ডব ৷
ন হ্যসংন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন ।৷ ২ ।৷
যম্—যাকে; সন্ন্যাসম্― সন্ন্যাস; ইতি—এভাবে; প্রাহুঃ বলা হয়; যোগম্ পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পন্থাকে; তম্—তাকে, বিদ্ধি— জানবে; পাণ্ডব—হে পাণ্ডুপুত্র; ন–না; হি—অবশ্যই; অসংন্যস্ত ত্যাগ না করে; সংকল্পঃ —সংকল্প, যোগী—যোগী; ভবতি—হন; কশ্চন—কেউ।
গীতার গান
অসংন্যস্ত সংকল্প বিনা নহে যোগী ।
বাহ্যে মাত্র ক্রিয়াহীন অন্তরে সে ভোগী ৷।
অনুবাদঃ হে পাণ্ডব ! যাকে সন্ন্যাস বলা যায়, তাকেই যোগ বলা যায়, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না।
তাৎপর্যঃ যথার্থ ‘সন্ন্যাস-যোগ’ অথবা ‘ভক্তিযোগের তাৎপর্য হচ্ছে জীবাত্মারূপে স্বীয় স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হয়ে সেই অনুসারে কর্ম করা। জীবাত্মার কোন পৃথক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। জীব হচ্ছে ভগবানের তটস্থা শক্তি। যখন সে জড়া শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তখন সে বদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং যখন সে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে, অর্থাৎ ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়, তখন সে তার স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। তাই, জীব যখন ভগবৎ-তত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত হয়, তখন সে জড় ইন্দ্রিয়তৃপ্তি থেকে বিরত হয়, অথবা সব রকম ইন্দ্রিয় উপভোগের কার্যকলাপ পরিত্যাগ করে। ইন্দ্রিয়-দমন করে যোগীরা জড় আসক্তি থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করে। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত তাঁর সব কয়টি ইন্দ্রিয়ই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করেন, তাই তার অন্য কোন বিষয়ের প্রতি আর আসক্তি থাকে না। সুতরাং, কৃষ্ণভক্ত একাধারে যোগী ও সন্ন্যাসী। জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ বিষয়ক যোগের প্রয়োজন কৃষ্ণভাবনায় আপনা থেকেই পূর্ণ হয়ে যায়। স্বার্থসিদ্ধির প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করতে না পারলে জ্ঞান অথবা যোগ সাধন করার কোন অর্থ হয় না। জীবনের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সব রকম ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানে ব্রতী হওয়া। যিনি পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন, অর্থাৎ যিনি কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করেছেন, ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি তাঁর আর কোন স্পৃহা থাকে না। তিনি সব সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করবার চেষ্টায় মগ্ন। যারা ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারেনি, তাদের পক্ষে জড় ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, কারণ নিষ্ক্রিয় স্তরে কেউ এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করার ফলে সব কয়টি প্রয়োজনই যথার্থভাবে সাধিত হয়।
শ্লোকঃ ৩
আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে ।
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ॥৩॥
আরুরুক্ষোঃ—আরোহণ করতে ইচ্ছুক, মুনেঃ – মুনির; যোগম্ — অষ্টাঙ্গযোগ; কর্ম— কর্ম; কারণম্—কারণ; উচ্যতে বলা হয়; যোগ— অষ্টাঙ্গযোগ; আরূঢ়স্য—আরূঢ় হয়েছেন; তস্য – তাঁর, এব—অবশ্যই; শমঃ — সমস্ত কর্মের নিবৃত্তি; কারণম্ – কারণ; উচ্যতে—বলা হয় ।
গীতার গান
সব যোগ হয় সিদ্ধ কর্ম সে কারণ ।
আরুরুক্ষ মুনি সেই শুন বিবরণ ॥
যোগেতে আরূঢ় সেই শমতা কারণ।
সাধকের ক্রম পন্থা যোগানুসরণ ॥
অনুবাদঃ অষ্টাঙ্গযোগ অনুষ্ঠানে যারা নবীন, তাদের পক্ষে কর্ম অনুষ্ঠান করাই উৎকৃষ্ট সাধন, আর যাঁরা ইতিমধ্যেই যোগারূঢ় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে সমস্ত কর্ম থেকে নিবৃত্তিই উৎকৃষ্ট সাধন।
তাৎপর্যঃ ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পন্থাকে বলা হয় যোগ। এই যোগকে একটি সিঁড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়, যার দ্বারা পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ করা যায়। জীবনের সর্বনিম্ন স্তর থেকে এই সিঁড়ির শুরু এবং ক্রমান্বয়ে তা অধ্যাত্মমার্গের চরম স্তরে উপনীত হয়েছে। উচ্চতার ক্রম অনুসারে এই সিঁড়ির বিভিন্ন অংশের ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ সিঁড়িটিকে বলা হয় যোগ এবং সেটি তিন ভাগে বিভক্ত — জ্ঞানযোগ, ধ্যানযোগ ও ভক্তিযোগ। এই সিঁড়ির প্রথম ও সর্বোচ্চ সোপানকে যথাক্রমে যোগারুরুক্ষু ও যোগারূঢ় স্তর বলা হয়।
অষ্টাঙ্গ যোগের প্রাথমিক স্তরে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের মাধ্যমে আসন অভ্যাস করে ধ্যান করার প্রচেষ্টাকে সকাম কর্ম বলে গণ্য করা হয়। এই সমস্ত ক্রিয়ার প্রভাবে ক্রমশ ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পূর্ণ মানসিক সমতা লাভ হয় । ধ্যানাভ্যাসে সিদ্ধি লাভ হলে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী সব রকম মানসিক ক্রিয়াগুলি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা যায়।
কৃষ্ণভাবনাময় কৃষ্ণভক্ত শুরু থেকেই ধ্যানের স্তরে অবস্থিত, কারণ তিনি সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করেন। তিনি সর্বদাই ভগবানের সেবায় রত, তাই তিনি সব রকম জাগতিক কর্মগুলি সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেছেন বলে গণ্য করা হয়।