সাঁওতাল সমাজের কাছে সিং বোঙ্গার (সূর্যের) স্থান সবচেয়ে উঁচুতে। সিং বোঙ্গা রোজ পূর্ব দিকে দেখা দেন বলে সমাজের কাছে পূর্ব দিক পবিত্র দিক। পুজো-পাঠ হয় পূর্ব দিকে মুখ করে। নির্দিষ্ট সময় মেনে সিং বোঙ্গার পুজো হয় না।  সিং বোঙ্গার করুণা পেতে পাঁচ-সাত-দশ বছরে একবার পুজো দিলেই হল। পুজোতে সাদা মোরগ অথবা পাঁঠা বলি চড়ান হয়।

‘মারাং বুরু’ (আক্ষরিক অর্থে বড় পাহাড়) বোঙ্গাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। মারাং বুরু জাতির ও সমাজের পালনকর্তা। ইনিই আদিম মানব-মানবীকে পালন করেছিলেন, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন হাঁড়িয়া তৈরির পদ্ধতি।

শুরুতে মারাং বুরুর পুজোয় দেওয়া হত হাঁড়িয়া বা বাড়িতে তৈরি মদ। পরবর্তীকালে মুন্ডাদের প্রভাবে মারাং বুরুর কাছে বলি দেওয়া হতে থাকে।

মারাং বুরু কোন কোন খুঁটের (উপগোষ্ঠির) গৃহদেবতা। বীরহোর, ভূমিজ, হো বা মুন্ডাদের কাছেও পুজিত হন মারাং বুরু।

‘জাহের-এরা’ জাহের থানের (পবিত্র কুঞ্জ, যেখানে সমাজের সার্বজনীন দেবতারা অবস্থান করেন) অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অনেকের ধারণা, জাহের এরাকে মুন্ডারা জাহের বুড়ি বলেন, ওয়াওঁরা জাহের এরা’কে বলেন ঝাকড়া বুঢ়িয়া বা সরণা বুঢ়িয়া। ফাগুয়া বা দোলের দিন জাহের এবার বিশেষ পুজো হয়। দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয় যেন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা সুস্থ তাহকে, খারাপ বাতাস রোগ না বয়ে আনে।

‘গোসাঞী-এরা’ যা পাঁচড়া ইত্যাদি চর্মরোগের বোঙ্গা। সাদা মোরগ বলি দিয়ে গোসাঞী-এরাকে সন্তুষ্ট রাখা হয়।

‘মোরাইকো-তুরুইকো’ (আক্ষরিক অর্থে পাঁচ ছয়) বোঙ্গা একজন বোঙ্গা হিসেবেই পুজো পান। মোরাইকো-তুরুইকো গ্রামের ভাল মন্দের দেখাশুনো করেন; শস্যের ফলন, বৃষ্টি, খরা, মড়ক ইত্যাদির নিয়ন্ত্রক।

সমাজ বিশ্বাস করে ডাইনি ও ডাইনদের উপর ‘পরগনা  বোঙ্গা’র নিয়ন্ত্রণ আছে। ডাইনির নজর পরে অসুখ-বিসুখ হচ্ছে বলে জানগুরু ঘোষণা করলে ডাইনিদের মন্ত্রকে কাটান দিতে জানগুরুরা পরগণা বোঙ্গার পুজো করেন।

অপর প্রান্তে থাকেন জাহের থান বা পবিত্র কুঞ্জ। এই পবিত্র কুঞ্জে সমাজের বোঙ্গা বা দেবতারা থাকেন। পাশাপাশি তিনটি শালগাছের তলায় তিনটি পাথর মারাং বুরু, জাহের-এরা ও মোরেইতো-তুরুইকো নামে পুজিত হয়। সমাজের বিশ্বাস পাথরগুলো বোঙ্গারাই রেখে গিয়েছেন। দুটি মহুয়া গাছতলা হয় ‘গোসাঞী’-এরা ও পরগনার থান।

জাহের থানে বোঙ্গারা প্রধান প্রধান পরবের বা উৎসবের সময় পুজো দেন। প্রধান উৎসব হল ফসল তোলার উৎসব ‘সোহরাই’, ফসল বোনার উৎসব ‘এরোক সিম’, পুষ্প উৎসব ‘বাহা’ ইত্যাদি।

জাহের থানের বোঙ্গাা ছাড়া গ্রামের মাঝে থাকে ‘মাঝি বোঙ্গা’র থান। মাঝি বোঙ্গাকে ‘মাঝি বুড়ি’ বা ‘মাঝি হড়ম’ নামেও ডাকা হয়। মাঝি থানের অবস্থান গ্রামের মাঝির বাড়ির সামনে। মাঝি বোঙ্গা গ্রামের মাঝির আধ্যাত্মিক উপদেষ্টার কাজ করে। মাঝি বোঙ্গা গ্রামের ভাল-মন্দ দেখাশুনো করেন। জাহের থানের বোঙ্গাদের পুজো দেবার আগে মাঝি বোঙ্গার পুজো দেওয়া হয়। মাঝি বোঙ্গার পুজো করেন মাঝি স্বয়ং। পুজোর মাঝি বোঙ্গাকে নিবেদন করা হয় হাঁড়িয়া, বলি  দেওয়া হয় দুটি পায়রা।

সমাজের বিশ্বের মাঝি বোঙ্গা ও পরগনা বোঙ্গার অন্যান্য বোঙ্গাদের উপর যথেষ্ট প্রভাব আছে।

যদিও জাহের বোঙ্গারা আদিবাসী অনেক জনজাতির কাছে পূজনীয়, কিন্তু এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামের জাহের থানে পুজো দেন না। যদি এক গ্রামের মানুষ স্থায়ীভাবে অন্য গ্রামে বসবাস শুরু করেন, তবে তিনি নতুন গ্রামের জাহের থানে পুজো দেওয়ার অধিকার পান।

এসব ছাড়াও প্রতিটি খুঁটের বা উপগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব দেবতাও। আসধারণত এদের বলা বলা হয় আবগে বোঙ্গা। আবগে বোঙ্গার পুজোর প্রসাদ মেয়েদের খাওয়ার বা ছোঁয়ার অধিকার নেই। প্রসাদে মেয়েদের ছোঁয়া লাগলে দ্বিগুণ নৈবেদ্য দিয়ে আবগে বোঙ্গার পুজো দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।

সমাজের বিশ্বাস আত্মা অমর। দেহত্যাগের পর যতদিন তাঁদের কথা বংশধররা মনে রাখেন ততদিন আত্মা বিপদ-আপদে তাঁদের সাহায্য করে। কেউ দেহ ত্যাগ করার পর বোঙ্গা হয়ে যান। পারলৌকিক কাজ শেষ হওয়ার পর আত্মার বোঙ্গা সাঁওতালদের বাড়িতে স্থান পান। আত্মার এই বোঙ্গাকে বলে হপরামপো বোঙ্গা। প্রতি পরবে পরিবারের লোক হপরামপো বোঙ্গাকে নৈবেদ্য দেয়।

‘দিশম সেন্দ্রা’ বা বার্ষিক শিকার পর্বের সময় সাঁওতাল সমাজ জঙ্গল মহাসভা বা লো বীর ডাকে। ‘লো বীর’ -এর নির্দেশ সমাজের সকলেই মান্য করেন। ‘ডিহরি’ হলেন লো বীর পর্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।

ফাল্গুন মাসে বাহা পর্বের পর ‘লো সেন্দ্রা’ অনুষ্ঠিত হয়। ডিহরি শিকার পরবের দিন ঠিক করেন ও কোথায় কোথায় শিকারীরা রাত্রিবাস করবেন, তাও ঠিক করেন। বিভিন্ন হাটে দূত পাঠান ডিহরি। দূতদের হাতে থাকে ‘ধারওয়াক’ (পাতাসমেত শালগাছের ডাল)। হাটের লোকজন ‘ধারওয়াক’ হাতে কোনও লোক দেখলেই বুঝতে পারেন ডিহরির দূত এসেছেন। সমাজের লোকেরা দূতের কাছ থেকে জেনে নেন শিকারী পর্বের দিনক্ষণ ও অন্যান্য খুঁটিনাটি।

গ্রামের নাইকে পর্বে যাওয়া শিকারীদের কল্যাণ কামনায় পাঁচটা মোরগ উৎসর্গ করে পুজো দেন ডিহরি, শিকার পরবের কয়েকদিন আগে থেকেই সহবাস বন্ধ রাখেন, শয্যা নেন ভূমিতে। শিকার পরবের আগে সন্ধ্যায় পিতলের পাত্রে জলে দুটি শাল-পল্লব রেখে দেন। পরদিন ওই পল্লব-দুটি তাজা থাকলে শুভ লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়, শিকারীরা আসার আগেই ডিহরি তাঁর স্নান সেরে ফেলেন। শিকারীরা হাজির হওয়ার পর ডিহরি বোঙ্গাদের পুজো করেন। বলি দেওয়া মোরগ চালের সঙ্গে রান্না করা হয়। এই খেয়ে ডিহরি তাঁর উপোশ ভাঙ্গেন। শিকারীরা বেড়িয়ে পরেন শিকারে।

সারাদিন শিকার করার পর সন্ধ্যায় তাঁরা সমবেত হন। এক-এক গ্রামের মানুষ এক-এক জায়গায় বসেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকতে যারা ‘লো বীর’ সভায় যাবে তারা ছাড়া সকলে মিলে নাচ-গান-বাজনা শুরু করবে। এই প্রমোদ আসরকে বলে ‘তোরিয়া’। শিকারের দেবী ‘রঙ্গো রুজি’ বোঙ্গাকে খুশি করতেই তোরিয়ার আয়োজন। নাচ-গানে রাত শেষ হবে। ডিহরি ভোর বেলায় স্নান সেরে পুজো করবেন, বলি চাপাবেন। শুরু হবে শিকার। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় শিকার পর্ব শেষ হয়। শিকারীরা গ্রামে ফেরেন। শিকারীদের স্ত্রীরা স্বামীদের পা ধুইয়ে স্বাগত জানান।

শিকার পর্বের সময় বিবাহিতেরা  চুলে ফুল গুঁজতে পারেন না, হাতে পরেন না লোহার বালা। শিকারীরা না ফেরা পর্যন্ত গ্রামে পশু বা মোরগ মারা নিষিদ্ধ।

error: Content is protected !!