সাধারণ মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আখের গোছানোর ধান্দা পৃথিবীর ইতিহাসে অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। ভারতও এর বাইরে নয়। ২২০০ বছর আগে ভারতবর্ষে ঈশ্বরের নামে লোকঠকানো যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ তার উল্লেখ পাই। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী কৌটিল্য তাঁর বর্ণাশ্রম নীতি রক্ষার জন্য ‘অর্থশাস্ত্র’ –এর পঞ্চম অধিকরণের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কিছু উপায় বর্ণনা করেছেন। কৌটিল্য-বর্ণিত নীতি ও উপদেশগুলো নিয়ে আলোচনা করলে দেখতে পাবেন কি প্রচন্ড মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রজাশোষণ করতে উপদেশ দিয়েছেন।
“কোন প্রসিদ্ধ পুন্যস্থানে ভূমি ভেদ করে দেবতা উঠেছেন বলে প্রচার করতে হবে। অথবা রাত্রিতে বা নির্জনে একটি দেবতা স্থাপন করে ও এই উপলক্ষে উৎসবাদি ও মেলা বসাতে হবে। শ্রদ্ধালু লোকের প্রদত্ত ধন দেবতাধ্যক্ষ গোপনে রাজসমীপে অর্পণ করিবেন।“ (কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র, ৫ম অধিকরণ, ২য় অধ্যায়, ৯০তম প্রকরণ)।
‘দেবতাধ্যক্ষ’ কথাটি লক্ষ্য করুন। সেনাদের দেখার দায়িত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব যার ওপর থাকত তাকে বলা হতো সেনাধ্যক্ষ। তেমনি দেবস্থান অর্থাৎ মন্দির এবং পুরোহিত ও পণ্ডিতদের দেখাশুনোর দায়িত্ব যার ওপর থাকত তাকে বলা হতো দেবতাধ্যক্ষ। এই দেবতাধ্যক্ষ কাজ চালাতো তার অধীন পণ্ডিতকুল ও পুরোহিতকুলের সাহায্যে।
ওই গ্রন্থের ৯০তম প্রকরণে আরও বলা হয়েছে, “দেবতাধ্যক্ষ ইহাও প্রচার করিতে পারেন যে, উপবনে একটি বৃক্ষ অকালে পুষ্প ও ফলযুক্ত হইয়াছে এবং ইহা হইতেই সেখানে দেবতার আগমন নিশ্চিত হইয়াছে।“
“সিদ্ধপুরুষের বেশধারী গুপ্তচরেরা কোন বৃক্ষে প্রতিদিন এক-একটি মানুষ ভক্ষণার্থ কররূপে দিতে হইবে তা জানাতে। এই মর্মে রাক্ষসের ভয় উৎপাদন ক্রিয়া পৌর ও জনপদজন হইতে বহু টাকা লইয়া সেই ভয়ের প্রতিকার করিবে। রাক্ষস-ভয়ে স্ব-জীবনার্থ প্রদত্ত টাকা রাজাকে গোপনে অর্পণ করিবে।“
অর্থাৎ, প্রজাদের শোষণ করার জন্য চাণক্য শুধু দেবতাদেরই সৃষ্টির কথা বলেননি, ভূত বা রাক্ষস সৃষ্টির কথাও বলেছেন। রাক্ষসের ভয় দেখিয়ে তারপর রাক্ষস তাড়াবার নাম করে অর্থ আদায়ের এই পন্থা বাইশশো বছর পরে আজও তেমনই রয়েছে। আজও ভারতের বহু প্রান্তে ভূত ধরা ও ভূত তাড়ানোর নানা অলৌকিক (?) খেলা সমানে চলেছে।
৫ম অধিকরণ, ২য় অধ্যায়ের ৯০ তম প্রকরণে আরও রয়েছে, “দেবতাধ্যক্ষ দুর্গের ও রাষ্ট্রের দেবতাগণের ধন যথাযথভাবে একস্থানে একত্রিত রাখিবেন এবং সেইভাবে রাজাকে আনিয়া দিবেন।“
ধর্মের নামে সুন্দর ব্যবসা ফেঁদে বসাতে হবে এবং সাধারণকে দোহন করে রাজকোষে বাড়াতে হবে। রাজকোষ বাড়াবার জন্যে ধনীদের স্বার্থরক্ষার জন্যেই চাণক্য পুরোহিতদের কাজ লাগাবার কথা উল্লেখ করেছেন।
একালের মতোই সেকালেও কিছু যুক্তিবাদী লোক ছিলেন, যারা ‘সকলেই যা মেনে নিয়েছে তাই সত্য’ এই যুক্তিতে বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস করতেন না, রাজা, পুরোহিত বা প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতরা মেনে নিয়েছেন বলেই কোন কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার না করেই মেনে দিতে হবে। তাঁরা সর্বযুগের যুক্তিবাদীদের মতো স্ব কিছুকেই যুক্তি দিয়ে বিচার করতেন এবং তারপরই সেটা মেনে নিতেন অথবা বর্জন করতেন। ।এই সব যুক্তিবাদীরা। শাসক, পুরোহিত, পণ্ডিতসমাজ ও ধনীদের পক্ষে ছিলেন যথেষ্টই বিপজ্জনক। মানুষকে দুর্বল, অসহায় ও ঈশ্বর-নির্ভর করে তোলার পক্ষে এই সব ঈশ্বরে শ্রদ্ধাহীন যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন যথেষ্ট বাধা স্বরূপ। এঁদের সম্বন্ধে চাণক্যের উপদেশ হল, “যাহারা অশ্রদ্ধালু, বেশি জিজ্ঞাসু, তাহাদিগকে ভোজন ও স্নানাদি-দ্রব্যে স্বল্পমাত্রায় বিষ প্রয়োগ করিয়া মারিয়া ফেলিবে। তারপর ‘ইহা দেবতার অভিশাপ’ বলিয়া প্রচার করিবে।“
প্রধাণত রাজা-রাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই গড়ে উঠেছিল সেকালের বিখ্যাত মন্দিরগুলো, যেগুলো আজও লক্ষ-কোটি ভক্তদের আকর্ষণ করে ও আদায় করে প্রণামী। প্রণামীর একটা অংশ যেত রাজকোষে। প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মন্দির আজও ভারতের বিখ্যাততম ধনীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মতো সম্পদের অধিকারী। স্বাধীন ভারতে মন্দিরের সম্পদ মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের। অর্থাৎ ধর্মগুরুদের। এক-একজন ধর্মগুরুর সম্পদ দেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পপতিদের সম্পদকেও হার মানায়।
ভারত সত্যিই বিচিত্র দেশ –প্রাচীন খারাপ ঐতিহ্যকে গর্বের সঙ্গে ধারণ করে আছে।