ড. রিচার্ড ডকিন্স

অনুবাদঃ বন্যা আহমেদ ও জাহেদ আহমদ

আমাদের চারপাশে ধর্মচর্চার নামে কি অপরিসীম অপচয়ই না করা হয়- একজন ডারউইনবিদ হিসেবে ধর্মের এই লাগামহীন অপব্যয়িতার দিকটি আমাকে ভাবিয়ে তোলে । প্রকৃতি অত্যন্ত মিতব্যয়ী, সে প্রতিটি মুহূর্তের, প্রতিটি পাই পয়সার হিসেব রাখে, নগণ্য অপচয়কেও ছেড়ে দেয় না। কোন বন্য প্রাণী যদি তার স্বভাবগত কারণে অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) ঠিকই তার থেকে যোগ্যতর কোন প্রতিবন্ধীকে বেছে নেয় যে বংশবৃদ্ধি এবং টিকে থাকার কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রকৃতি অর্থহীন বিলাসিতাকে প্রশ্রয় দেয় না। যদিও এত স্পষ্টভাবে আমরা সবসময় তা দেখতে পাই না, প্ৰকৃতি কিন্তু তার এই নির্মম গতিতেই এগিয়ে চলে ।

কিছু পাখি আছে যারা পিঁপড়ার বাসায় পাখা ডুবিয়ে দিয়ে স্নান (anting) করে— দেখলে মনে হবে যেনো পিঁপড়েগুলোকে দিয়ে তারা তাদের পাখা আক্রমণ করাচ্ছে। হয়তো বা এর পিছনে পাখা থেকে জীবাণু ঝেড়ে ফেলার মত কোন স্বাস্থ্যগত কারণ রয়েছে। কিন্তু, এই ধরণের কাজের আদৌ কোন উপকারিতা আছে কিনা সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়। তবে এ ধরনের অনিশ্চয়তা একজন ডারউইনবিদকে এসব কর্মকাণ্ডের পিছনে কোন ভালো কারণ থাকতেও পারে— তা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা থেকে বিরত করতে পারে না ।

মানুষ নামের দ্বিপদী জীবরা ধর্মচর্চার পিছনে প্রচুর সময় ব্যয় করে, ব্যয় করে প্রচুর সম্পদও। মধ্যযুগের শত শত বছর ধরে অসংখ্য মানুষের শ্রমের বিনিময়ে চার্চগুলো নির্মিত হয়েছে। মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর সময়কার অধিকাংশ মেধাই ব্যয়িত হয়েছে পবিত্র ধর্মীয় সঙ্গীত এবং চিত্রকল্প রচনায়। খুবই কাছাকাছি আরেকটি ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অপরাধে হাজার হাজার— এমনকি লাখ লাখ মানুষকে অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে, মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে; ধর্মপ্রাণ মানুষেরা তাদের দেবতাদের জন্য প্রাণ দিয়েছে, হত্যা করেছে, উপবাস করেছে, চিরকুমারত্ব বরণ করেছে, এমনকি সমাজচ্যুতও হয়েছে।

বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, পৃথিবীতে এমন কোন সমাজ ব্যবস্থাই নেই যেখানে কোন না কোন ধরনের সময় এবং অর্থ অপচয়ী, বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী, বংশবৃদ্ধিরোধকারী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অস্তিত্ব দেখা যায় না। এ বিষয়টি ডারউইনবাদে বিশ্বাসী যে কারও জন্য একটা বড় রকমের ধাঁধার মত। আমরা যেভাবে পাখীদের অন্টিং-এর উদ্দেশ্যটা অনুমান করেছি, ধর্মও কি ডারউইনবাদীদের সামনে একই ধরনের চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে না— যার অনুরূপ একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া আজ খুবই প্রয়োজন? আমরা কেন প্রার্থনা করি, কেনই বা আমরা এত জাঁকজমকপূর্ণ ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করে আমাদের সারাটা জীবনই উৎসর্গ করে দিই?

ধর্মীয় আচরণ তখনি ডারউইনবাদের মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়ায় যখন তা অদ্ভুত কোন ব্যতিক্রম না হয়ে বহুলভাবে স্বীকৃত একটি ব্যাপারে পরিণত হয়। আপাতদৃষ্টিতে, ধর্ম সার্বজনীন, এবং শুধুমাত্র বিভিন্ন সমাজে এর বিভিন্ন রূপ আছে বলেই সমস্যাটা আপনাাপনি দূর হয়ে যাবে না । ভাষার তই ধর্ম মূলত সাৰ্বজনীন এবং অঞ্চলভেদে এই বিশ্বাসের তারতম্যও অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়। এই প্রবন্ধের বেশিরভাগ পাঠকই স্বীকার করবেন যে আমাদের মধ্যে সবাই ধাৰ্মিক নন । তারপরও ধর্ম মানব সমাজে সর্বজনস্বীকৃত: পোশাক পরিধানের কিংবা খাবার পরিবেশনের রীতির মতই প্রত্যেকটি সমাজে বিশেষ ধর্মীয় রীতিও প্রচলিত রয়েছে; এমন কি যারা ধর্মচর্চা করেন না, তারাও সেটাকে সামাজিক নিয়ম হিসেবেই মেনে চলেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই ধর্ম ঠিক কী কাজে লাগে?

কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাস যে মানুষকে টানা-পীড়ন সম্পর্কিত অসুখ (stress-related diseases) থেকে মুক্তি দিতে পারে— এই ধারণাটির পিছনে তেমন কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এটা সত্যি হলেও আমাদের অবাক হওয়ার মত কিছু থাকবে না। ডাক্তারদের চিকিৎসার একটা লক্ষ্যণীয় অংশই হচ্ছে সান্ত্বনা এবং আশ্বাস প্রদান । আমার ডাক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে চিকিৎসা করেন না, কিন্তু অনেক সময়ই মনে হয় যে, তার স্টেথোস্কোপ পরা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার আশ্বাসবাণী শুনেই আমার ছোটখাটো অনেক অসুখ ভাল হয়ে গিয়েছে । রোগীর মন রক্ষার জন্য মিথ্যা ওষুধ দেওয়ার ব্যাপারটি (Placebo effect) সবাই জানেন। অনেক সময় ওষুধীয় গুণাবলীহীন এসব নকল বড়ি (dummy pills) খেয়েই দেখা যায় রোগীরা ভাল হয়ে যায়। সে জন্যই নতুন ওষুধের ট্রায়ালের সময় প্ল্যাসিবো ব্যবহার করা হয়। প্ল্যাসিবোর মত হোমিওপ্যাথি ওষুধেও রোগ সেরে উঠতে দেখা যায়, অথচ হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরি করার সময় এগুলোকে এতই তরল করে ফেলা হয় যে তাতে রোগ সারানোর কোন উপাদানই আর অবশিষ্ট থাকে না ।

ধর্মও কি, প্ল্যাসিবোর মতই, মনের পীড়ন কমিয়ে মানুষের আয়ু বাড়িয়ে তোলে? হয়তো করে, কিন্তু তত্ত্বটিকে সংশয়বাদীদের সাথে পরীক্ষায় উপনীত হতে হবে যারা মনে করেন অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ম অশান্তি তো কমায়ই না বরং বাড়িয়ে তোলে। আমার মতে ধর্মের মত একটি বিশাল এবং সার্বজনীন বিষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য এটি একটি অত্যন্ত দুর্বল তত্ত্ব। আমাদের পূর্বসুরীদের মনের অশান্তি কমিয়ে তাদেরকে দীর্ঘজীবী করার মাধ্যমে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিলো বলে আমি মনে করি না। এই ধরনের থিওরী ধর্মের মত এতো বড় একটি ব্যাপারকে ব্যাখ্যা করার জন্য আদৌ যথেষ্ট নয় ।

অন্যান্য তত্ত্বগুলো এ সম্পর্কিত ডারউইনীয় ব্যাখ্যা সম্পর্কে মোটেও ওয়াকিফহাল নয় বলে মনে হয়। উদাহরণ হিসেবে নিচের কথাগুলি বিবেচনা করা যাক। ‘ধর্ম মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটায় এবং মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরে’, কিংবা ‘ধর্ম সান্ত্বনাদায়ক । মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় এবং ধর্ম আমাদের আশ্বস্ত করে আমরা অমর থাকবো।’ এ সমস্ত কথায় মনস্তাত্ত্বিক সত্য থাকতে পারে, কিন্তু এগুলি কখনোই ডারউইনীয় ব্যাখ্যা হতে পারে না। এ কথাটিই স্টিভেন পিংকার উল্লেখ করেছেন তার মন কী ভাবে কাজ করে’ (How the Mind Works, Penguin, ১৯৯৭) বইতেঃ

‘… এটি কেবল প্রশ্নেরই জন্ম দেয় যে, মন কেন এমনভাবে বিকশিত হবে যেখানে তাকে স্পষ্ট মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে। বরফ শীতল পরিবেশে একজন মানুষ মনে মনে ‘আমি উষ্ণতায় আছি’ ভাবলেই আরাম পাবে না; তেমনি সিংহের মুখোমুখি একজন মানুষ সিংহকে খরগোস কল্পনা করলেই তার মনের সমস্ত ভীতি দূর হয়ে যাবে না।’ (পৃষ্ঠা ৫৫৫)।

মৃত্যু-ভয় সম্পর্কিত ডারউইনীয় তত্ত্বের স্বরূপটি হওয়া উচিত এরকমঃ ‘পরকালে বিশ্বাসের ব্যাপারটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে যখনই একে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।’ এ বিষয়টি সত্য, কিংবা মিথ্যা হতে পারে । অথবা হতে পারে- এটি মানসিক চাপ এবং রোগীর মন রাখার জন্য মিথ্যা ওষুধ সম্পর্কিত আরেকটি তত্ত্ব- কিন্তু আমি সে বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যায় এখন যাচ্ছি না। আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে, একজন ডারউইনবিদের সবসময় এ ভাবেই প্রশ্ন উত্থাপন করা উচিত।

কোন কোন মানুষ বিশ্বাসের সাথে একমত পোষণ করেন এবং কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করেন- এমন সব মনস্তাত্ত্বিক বক্তব্য কেবল মাত্র তাৎক্ষণিক, কোন চূড়ান্ত ব্যাখ্যা নয় । একজন ডারউইনবিদ হিসেবে আমি চূড়ান্ত প্রশ্নগুলির ব্যাপারেই আগ্রহী ।

ডারউইনবিদদের কাছে তাৎক্ষণিক আর চূড়ান্তের পার্থক্যের ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাৎক্ষণিক প্রশ্নগুলি আমাদেরকে শরীরবিদ্যা (Physiology) আর মস্তিষ্ক প্রভৃতি অঙ্গের দিকে ধাবিত করে। তাৎক্ষণিক উত্তরে ভুল কিছু নেই, এগুলি গুরুত্বপূর্ণ, এবং বৈজ্ঞানিক।

কিন্তু আমার কাছে আগ্রহের বিষয় হচ্ছে ডারউইনীয় চূড়ান্ত ব্যাখ্যার ব্যাপারটি। বিজ্ঞানীরা যদি কখনো মস্তিষ্কে ‘সৃষ্টিকর্তা কেন্দ্র’ নামক কোন কিছুর আদৌ সন্ধান পান, আমার মত ডারউইনবিদের কাছে তখন জিজ্ঞাসার বিষয় হবে: ‘সৃষ্টিকর্তা কেন্দ্র’টি কেন বিকশিত হয়েছে। কেন আমাদের সেই সমস্ত পূর্ব পুরুষ যারা বংশগত নীতির (genetic) বদৌলতে ‘সৃষ্টিকর্তা কেন্দ্র’ পেয়েছে, তারা কেন টিকে থাকতে পেরেছে তাদের প্রতিপক্ষের তুলনায়, যাদের মস্তিষ্কে ‘সৃষ্টিকর্তা কেন্দ্র’ বিকশিত হয়নি? চূড়ান্ত ডারইনিীয় প্রশ্নগুলি কিন্তু মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের তাৎক্ষণিক প্রশ্নের তুলনায় বেশি ভাল, গভীর কিংবা বিজ্ঞানসম্মত নয়। তবুও আমি এখানে এই প্রশ্নগুলিই আলোচনা করছি। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, চূড়ান্ত ব্যাখ্যার বিষয়টি আসলে দলগত বাছাই তত্ত্বেরও (Group selection theories) অন্য রূপ। দলগত নির্বাচন একটি বিতর্কিত ধারণা যেখানে বলা হয় ডারউইনীয় তত্ত্ব অনুযায়ী দেখা যায় এটি গোষ্ঠীর মধ্যকার ব্যক্তি পর্যায় থেকে বাছাই করে থাকে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-তত্ত্ববিদ (anthropologist) কলিন রেনফ্রিউ ধারণা করেন যে, খ্রিষ্টান ধর্ম টিকে থেকেছে একধরনের দলগত বাছাইয়ের মাধ্যমে কারণ তারা নিজেদের মধ্যে বিশ্বস্ততা এবং ভ্রাতৃত্বশীল ভালবাসার বিষয়টি লালন করে। আমেরিকান বিবর্তনবাদী ডেভিড স্লওয়ান ও একই রকম তত্ত্বে বিশ্বাসী ।

দলগত বাছাই তত্ত্ব ধর্মের ক্ষেত্রেও যে কাজ করতে পারে সেটির একটি কাল্পনিক উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক, একটি উপজাতি অত্যন্ত পরাক্রমশালী যুদ্ধের দেবতা বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। পাশাপাশি আরেকটি উপজাতি শান্তি ও পরমসহিষ্ণুতার দেবতায় কিংবা তাদের আদৌ কোন দেবতা বা ঈশ্বর নেই। প্রথম দলটি দ্বিতীয় দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে যে সব যোদ্ধারা বিশ্বাস করেছে যে যুদ্ধে ‘শহীদ’ হলে তারা সরাসরি স্বর্গে পৌঁছে যাবে, তারা বেশি সাহসিকতা ও মনোবলের সাথে যুদ্ধ করবে এবং নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হবে না। কাজেই এমন একটি উপজাতির আন্তঃগোত্রীয় বাছাইয়ে টিকে থাকার সম্ভাবনা অধিক; তারা তখন পরাজিত উপজাতির গবাদি পশু ছিনিয়ে নেবে, তাদের স্ত্রীলোকদের লুট করে উপপত্নীতে পরিণত করবে। এইরকম উপজাতি ক্রমান্বয়ে বংশবৃদ্ধি করতে থাকবে, একই বৈশিষ্ট সম্পন্ন নতুন জাতির জন্ম দেবে যারা সেই একই যুদ্ধবাজ দেবতা, বা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। এখানে পাঠকের খেয়াল রাখা উচিত- আমি যা বলছি সেটি কিন্তু ‘যুদ্ধ বাজ ধর্ম টিকে থাকে’ বলার চাইতে আলাদা। অবশ্যই সেটি টিকে থাকবে, কিন্তু এখানে আসল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- গোত্র যারা যুদ্ধের দেবতায় বিশ্বাসী তারাই টিকে থাকে ।

দলগত বাছাই তত্ত্ব নিয়ে জোরালো আপত্তি রয়েছে। সেগুলো সব খণ্ডানো এই .প্রবন্ধের পরিধির বাইরে । গাণিতিক মডেল প্রমাণ করেছে যে, বিশেষ কিছু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দলগত বাছাই তত্ত্ব কাজ করতে পারে। বলাবাহুল্য, উপজাতির গোত্রের ক্ষেত্রে ধর্ম সেই বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে কাজ করেছে। এটি একটি অত্যন্ত মজাদার তত্ত্ব কিন্তু এখানে আমি এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনায় যাব না ।

ধর্ম কি কোন সাম্প্রতিক ব্যাপার? আমাদের জিন (বংশগতি উপাদানের একক) বেশিরভাগ প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলার পর কি এর উদ্ভব হয়েছে? ধর্মের সর্বব্যাপিতা এই তত্ত্বের যেকোন সরলীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তথাপি, এটির একটি বড় দিক রয়েছে যেটি আমি এখানে তুলে ধরব। আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে দলগত বাছাই বা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে বৈশিষ্ট্যগুলি স্থান করে নিয়েছিল সেটি প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্ম নয়। এর অনন্য উপকারিতা ছিল, এটি ঘটনাক্রমে আজকে আমাদের সামনে ধর্মীয় আচরণ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। ধর্মীয় আচার-আচরণের ব্যাপারটি কেবল তখনি আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে যখন, আমরা প্রশ্নটিকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হব ।

মুরগী এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। সবল মুরগীদের দুর্বল মুরগীকে ঠোকরানোর ব্যাপারটি (‘Pecking order’) অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন । এই ‘দলগত প্রভাবশালীতা’র (dominance hiearchy’) ধারণাটি প্রথম মুরগীদের মধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। প্রতিটি মুরগী শিখে নেয় কোনটিকে সে লড়াইয়ে হারাতে পারবে এবং কোনটি তাকে হারানোর ক্ষমতা রাখে। যে দলে এই ‘প্রভাবশালীতা’ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে সেখানে প্রকাশ্য লড়াই দেখা যায় না বললেই চলে। এরকম গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত পাকাপোক্তভাবে আসনগাড়া মুরগীরা, ঘন ঘন দল বদল করা অন্যান্য দুর্বল মুরগীদের চাইতে বেশি ডিম পাড়ে। এ ব্যাপারটিতে দলগত প্রভাবশালীতার উদাহরণ দেখা যায়; কিন্তু এটি কোন আদর্শ ডারউইনবাদ নয়; কারণ, এটি একটি দলগত ব্যাপার। দলগত উৎপাদনশীলতার ব্যাপারটি হয়তো কৃষকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু অস্বাভাবিক কোন ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ক্ষেত্রে এর কোন উপযোগিতা নেই বললেই চলে। ‘দলগত প্রভাবশালীতা’ তত্ত্বটি টিকে থাকার সংগ্রামে কতটুকু মূল্যবান?’— একজন ডারউইনবিদের কাছে এ প্রশ্নের কোন গুরুত্ব নেই। এক্ষেত্রে সঠিক প্রশ্নটি হওয়া উচিতঃ ‘ব্যক্তি পর্যায়ে শক্তিশালী মুরগীর বিরুদ্ধাচারণ করে টিকে থাকার সংগ্রামের মূল্য কতটুকু, কিংবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল মুরগীদের থেকে আলাদা হয়ে না থাকার ক্ষতি তাকে কতটুকু পোষাতে হয়?’ ডারউইনবাদে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলিকে এমনভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যেখানে বংশগত বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা (genetic variations) দেখা যায়। এখানে আলাদা আলাদাভাবে এক একটি মুরগীর মারমুখী প্রবণতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা প্রত্যেকটি মুরগীর মধ্যে বংশগত বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা আছে। কিন্তু দলগত প্রভাবশালীতার ক্ষেত্রে বংশগত বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা (genetic variations) বিষয়টি অবান্তর, কেননা দলের কোন বংশানুগতি (gene) নেই। তা আছে কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে।

উপরের উদাহরণ দিয়ে আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি যে, ধর্মও দলগত প্রভাবশীলতার মত একটি বিষয় হতে পারে। ‘টিকে থাকার সংগ্রামে ধর্মের ভূমিকা কতটুকু’ এই প্রশ্নটিই হয়ত ভুল। আমার মতে সঠিক প্রশ্নটি হওয়া উচিত : ‘ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের মধ্যে যেসব ব্যবহার বা মনস্তাত্ত্বিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়— সেগুলিকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আমরা ধর্ম বলি; টিকে থাকার সংগ্রামে এগুলির গুরুত্ব কতটুকু?’ সঠিক উত্তর খোঁজার আগে আসলে প্রশ্নটিকে সঠিকভাবে দাঁড় করানো খুবই জরুরি। ডারউইনবিদদের মধ্যে যারা কেবল ধর্মের টিকে থাকার কারণ খোঁজার মধ্যেই ব্যস্ত রয়েছেন, তারা আসলে ভুল প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। এর বদলে বরং আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে চলে আসা এমন কিছু বিবর্তনশীল বিষয় নিয়ে ভাবা উচিত যেগুলো তাদের সময় ধর্ম হিসেবে বিবেচিত না হলেও পরবর্তীতে সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মীয় উপাদান হিসেবে খুঁটি গেড়ে বসেছে।

আমি এই প্রবন্ধে মুরগীদের ঠোকরানোর ধারা নিয়ে কিছু উদাহরণ হাজির করেছি। আসলে এ ব্যাপারটি আমার থিসিসের একেবারে মূল বিষয়; তাই একই বিষয়ে আরেকটি উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না বলে পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মথ যখন দলবদ্ধভাবে প্রজ্জ্বলিত আগুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এটাকে কেউ স্রেফ দুর্ঘটনা বলে মনে করেন না। দেখলে মনে হবে তারা যেন উড়তে উড়তে আগুনে আত্মাহুতি দিচ্ছে। এটাকে আমরা মথদের ‘আত্মবিনাশী আচরণ’ হিসেবে গণ্য করতে পারি আর বিস্মিত হতে পারি এই ভেবে যে ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন কীভাবে এমন একটি আত্মবিনাশী কাজকে সমর্থন করতে পারে! আমার কথা হচ্ছে এই সমস্যাটি থেকে একটা বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর আশা করার আগে প্রশ্নটিকে বরং ঘুরিয়ে নতুন করে লেখা উচিত। এটা মোটেও আত্মাহুতি নয়। আসলে অনভিপ্রেত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসেবেই আমরা এই আপাতঃ আত্মাহুতির ব্যাপারটি দেখে থাকি ।

কৃত্রিম আলোগুলো আমাদের রাতের দৃশ্যপটে অতি সাম্প্রতিক সংযোজন । এর আগে রাতের আলো বলতে শুধু চাঁদ আর তারার আলোই বোঝাতো । আলোর এই উৎসগুলো প্রায় অসীম দূরত্বে থাকার কারণে এদের কাছ থেকে আলো এসে পৌঁছায় সমান্তরাল পথে, ফলে তৈরি হয় এক আদর্শ দিকদর্শন যন্ত্র । আকাশের এই আলোক উৎসগুলোকে পতঙ্গরা সরল পথে চলবার জন্য ব্যবহার করে থাকে । পতঙ্গদের স্নায়ুতন্ত্রগুলো একটি সরল নিয়ম অনুসরণ করে অভিযোজিত হয়েছে— ‘এমনভাবে পথ চলে যেন, আলো এসে তোমার চোখে ৩০ ডিগ্রি কোণে আঘাত করে।’ যেহেতু পতঙ্গদের চোখগুলো যৌগিক (পুঞ্জাক্ষি), এই ব্যাপারটা একটা বিশেষ ধরনের ওমাটিডিয়ামের (পুঞ্জাক্ষির কেন্দ্রে এক ধরনের বিশেষ টিউব) জন্য খুবই সহায়ক।

কিন্তু এই আলোক দিকদর্শন যন্ত্রটি আলোর উৎস্যগুলোর অসীম দূরত্বে থাকার উপর খুব গভীরভাবে নির্ভরশীল। যদি তা না থাকে, তবে আলোক রশ্মিগুলো সমান্ত রাল রইবে না, বরং অনেকটা সাইকেলের চাকার স্পোকগুলোর মত ছড়িয়ে যাবে। যে স্নায়ুতন্ত্র ওই ত্রিশ ডিগ্রির সাধারণ নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেটি মথকে একটি লগারিদমিক সর্পিল পথে ঠেলে আগুনের শিখার উপর নিয়ে ফেলবে। শ’য়ে শ’য়ে মথ যখন প্রতিদিন চাঁদ বা তারা বা দূরের শহরের আলোর উপর নির্ভর করে নিখুঁতভাবে দিক নির্ণয় করে চলতে থাকে তখন আমরা তা আর খেয়াল করি না। আমরা শুধু দেখি মথগুলো আগুনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আর তা দেখে আমরা ভুল প্রশ্ন করে যেতে থাকি— ‘ কেন মথগুলি আত্মাহুতি দিয়ে চলেছে?”

এই শিক্ষাগুলোকে মানুষের ধর্মীয় ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায় । অসংখ্য মানুষ, এমনকি কোন কোন জায়গায় শতকরা একশজন মানুষ, এমন সব বিশ্বাস পোষণ করে যা শুধু বৈজ্ঞানিকভাবে অপ্রমাণযোগ্য তথ্যেরই পরিপন্থি নয়, আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের সাথে তার বিরোধিতাও অত্যন্ত প্রকট। তারা শুধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসই করে না, এর পিছনে প্রচুর সময় এবং অর্থ ব্যয় করে, জীবন দান করে, এমনকি হত্যাও করে। আমরা অনেকে তা দেখে বিস্মিত হই যেমন হই মথের আত্মবলি দেওয়া দেখে। আমরা ভাবতে থাকি, ‘কেন?’ কিন্তু আমার মতে আমরা এক্ষেত্রেও ভুল প্রশ্ন করছি।

মনে হতে পারে, আজকে আমরা যেসব ধর্মীয় আচরণ দেখি তা নিতান্তই কোন এক সময়ের মানুষের কোন এক মানসিক প্রবণতার দুর্ভাগ্যজনক অভিব্যক্তি, কিন্তু হয়তো সেই সময়ে এর কোন উপযোগিতা ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে এই মানসিক প্রয়োজনটি কি হতে পারে এ বিষয়ে আমি একটি প্রস্তাব দিতে চাই, কিন্তু প্রস্তাবটি দেওয়ার আগে পরিষ্কার করে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে এটি একটি উদাহরণ মাত্র । আমি মনে করি, এ বিষয়ে একটি বিশেষ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে আমাদের সঠিক প্রশ্নটি খুঁজে বের করা অনেক বেশি জরুরি ।

আমার এই সুনির্দিষ্ট প্রকল্পটি হচ্ছে শিশুদের নিয়ে। অন্য যে কোন প্রজাতির চেয়ে আমরা, টিকে থাকার জন্য, পূর্ববর্তী প্রজন্মের অভিজ্ঞতার উপর অনেক বেশি নির্ভর করে থাকি। তত্ত্বগতভাবে, শিশুরা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই শিখে নিতে পারে যে নদীতে কুমীর থাকলে সেখানে সাঁতার কাটতে হয় না। কিন্তু এটা ঠিক যে শিশুমস্তিষ্কে ‘বড়রা যা বলে তা বিশ্বাস করো, পিতামাতার কথা শোন, মুরুব্বিরা যখন গুরু গম্ভীরভাবে কিছু বলে তা প্রশ্নকরা ছাড়াই মেনে চল’– এই ধরনের কিছু নিয়ম বাঁধা আছে বলে তা থেকে আমরা অনেক বাড়তি সুবিধাও পেয়ে থাকি ৷

ছোটবেলায় স্কুলের ধর্মযাজকের শিখানো সেই ভয়ংকর উপদেশটির কথা আমি কখনই ভুলব না। এটা আসলে ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়েছে পরবর্তীকালে : সে সময়ে ধর্মযাজক যেভাবে চেয়েছিলেন আমার শিশু-মস্তিষ্ক সেভাবেই উপদেশটি গ্রহণ করেছিলো। একদল সৈন্যের রেল লাইনের পাশে কুচকাওয়াজ করার একটি গল্প বলেছিলেন আমাদের। এক সময় তাদের নেতার দৃষ্টি অন্য কিছুতে আকৰ্ষিত হওয়ায় তিনি সৈন্যদেরকে থামার উপদেশ দিতে ভুলে যান। সৈন্যরা বিনাবাক্যে আদেশ মেনে নিতে এতই অভ্যস্ত ছিল যে, তারা মার্চ করতে করতে চলমান ট্রেনের মুখে গিয়ে পড়ে। যদিও এখন আমি গল্পটি আর বিশ্বাস করি না, কিন্তু নয় বছর বয়সে ঠিকই বিশ্বাস করেছিলাম। যাজকটি চেয়েছিলেন আমরা যেন সৈন্যদের এই প্রশ্নাতীতভাবে আদেশ মেনে চলার রীতিকে, তা যতই অযৌক্তিকই হোক না কেন, একটি আদর্শ হিসেবে মেনে নেই। এবং সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সে সময়ে এটিকে একটি গুণ বলেই মনে করতাম। আমি তখন আসলেই ভাবতাম দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চলন্ত ট্রেনের মুখে পড়ার সৎসাহস কোনদিনও আমার হবে কিনা ।

সুশিক্ষিত সৈন্যদের মত কম্পিউটারকেও যা বলা হয় তারা তাই করে থাকে । Programming Language-এর মাধ্যমে তাদেরকে যা নির্দেশ দেওয়া হয় তারা আজ্ঞাবাহী গোলামের মতই তা পালন করতে থাকে । এদিকে কম্পিউটার আমাদের প্রয়োজনীয় অনেক কাজ করে দেয়, অন্যদিকে এই আনুগত্যের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে খারাপ নির্দেশাবলীকেও সে একইভাবে পালন করতে থাকে। কোনটি ভালো নির্দেশ আর কোনটি খারাপ নির্দেশ কম্পিউটার তা বুঝতে পারে না। সৈন্যদের মত তারাও শুধু নির্দেশ পালন করে যায় ৷

এই প্রশ্নাতীত বাধ্যতার ফলেই কম্পিউটার ভাইরাসের শিকারে পরিণত হয় । খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা একটি প্রোগ্রাম যখন কম্পিউটারকে তার ভিতরে লিপিবদ্ধ সব ঠিকানার তালিকা পাঠাতে নির্দেশ দেয় তখন সে তো তা পালন করেই, অন্য সব কম্পিউটার যাদেরকে সে এই প্রোগ্রামটি পাঠায় তারাও কাজটি একের পর এক অনুগতভাবে সম্পাদন করতে থাকে। এভাবেই অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ভাইরাসগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এমনভাবে কোন কম্পিউটার বানানো সম্ভব নয় যা আমাদের কাজের বেলায় অনুগত থাকবে কিন্তু ভাইরাসের সামনে দুর্বল হবে না ।

আমার উপরের ব্যাখ্যা যদি বোধগম্য হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই আপনারা ইতোমধ্যেই শিশুমস্তিষ্ক এবং ধর্মের মধ্যকার যোগসূত্রটি আবিষ্কার করে ফেলেছেন । প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) একটি শিশুর চিন্তাধারাকে এমনভাবেই তৈরি করে যাতে সে মা বাবা এবং গোত্রের মুরুব্বিদের কথা বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে। এবং এই বিশেষ গুণটিই অবচেতনভাবে তাকে আবার মানসিক ভাইরাসের আক্রমণের শিকারে পরিণত করে। শিশুমস্তিষ্ক— ভালোভাবে বেঁচে থাকার পূর্ব শর্ত হিসেবে- বাবা মা এবং মুরুব্বিদের বিশ্বাস করতে বলে। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই ‘বিশ্বাসকারীর’ পক্ষে ভাল উপদেশ এবং খারাপ উপদেশের মধ্যে পার্থক্য করার কোন উপায় থাকে না। শিশুর পক্ষে বুঝে নেওয়া অসম্ভব যে ‘নদীতে সাঁতার কেটো না, কুমীল খেয়ে ফেলবে’ একটি ভালো উপদেশ কিন্তু আবার ‘পূর্ণিমার সময় ছাগল বলি না দিলে শস্যহানি ঘটবে’ একটি খারাপ উপদেশ। দুটি উপদেশষই তার কাছে একই রকম তাৎপর্যময়। দুটি উপদেশই এসেছে এমন এক বিশ্বাসী লোকের কাছ থেকে যাকে শ্রদ্ধা এবং ভক্তি করা শিরোধার্য ।

পৃথিবী, মহাশূন্য, নৈতিকতা এবং মানব প্রকৃতি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। আবার যখন এই শিশুটিই বড় হয়ে ওঠে, তার নিজের ছেলেমেয়ে হয়, সে তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে আরও সুচারুভাবে এসব শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করে ।

এই মডেল অনুযায়ী, আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ রকমের ভিত্তিহীন বিশ্বাসের ধারা পুরুষানুক্রমিক বিকশিত হতে থাকে। এই অযৌক্তিক বিশ্বাসগুলো হয় এলোপাতাড়িভাবে (random drift) ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অথবা ডারউইনীয় নির্বাচনের মত কোন এক গতিতে বিকশিত হতে থাকে, এবং অবশেষে আমরা যে রূপটি দেখতে পাই তা তার আদি রূপ থেকে বিবর্তিত হতে হতে অনেকখানি বদলে গেছে। একইভাবে ভাষাও পর্যাপ্ত সময় এবং ভৌগোলিক ব্যবধানের কারণে তার মূল উৎস থেকে সরে যেতে যেতে লক্ষ্মণীয়ভাবে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। একই জিনিস দেখা যায় ধর্মের ক্ষেত্রেও, শিশুমস্তিষ্ককে সহজেই ছাঁচে ঢেলে বানানো যায় বলেই ধর্ম বংশ পরম্পরায় একজন থেকে আরেকজনের কাছে ক্রমাগতভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে ।

ডারউইনীয় নির্বাচন শিশুমস্তিষ্কে এমনভাবেই তৈরি করে যাতে তারা মুরুব্বিদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করে; চিন্তাধারাকে এমনভাবেই সংগঠিত করে যেন বাচ্চারা একদিকে অনুকরণ প্রবণ হতে, অন্যদিকে গুজব, রূপকথা এবং ধর্মে বিশ্বাস করতে প্রবৃত্ত হয়। বংশগতিক নির্বাচনই (genetic selection) আমাদের মস্তিষ্ককে এভাবে তৈরি করেছে এবং এখান থেকেই non genetic (বংশগতনীতির অধীন নয় এরকম) এক ডারউইনীয় নির্বাচনের ভিত্তি তৈরি হবে। আমি মনে করি ধর্ম এমনি এক দলগত ঘটনা যাকে non genetic মহামারী এবং ডারউইনীয় নির্বাচনের সংমিশ্রণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় । আমার এই প্রকল্প যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এমন কি তাদের জীনের জন্যও ধর্মের কোন ভূমিকা বা উপকারিতা নেই । এর যদি কোন উপকারিতা থেকেই থাকে তা মানুষের প্রয়োজনে নয়, তা শুধুই ধর্মের নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনে।*

*ড. রিচার্ড ডকিন্সের এই প্রবন্ধটি ইংরেজিতে সর্বপ্রথম Free Inquary ম্যাগাজিনের ২৪ নম্বর ভল্যুমের ৫ নম্বর সংখ্যায় ‘What Use is Religion?” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। প্রকাশকের অনুমতি সাপেক্ষে প্রবন্ধটি বাংলায় অনুবাদ করা হল। বাংলা অনুবাদের স্বত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে মুক্তমনা (www.mukto-mona.com) কর্তৃক সংরক্ষিত।

error: Content is protected !!