ম্যাজিক শো’তে জাদুকর বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে দর্শকদের মধ্যে নানা দৃষ্টি বিভ্ৰম ঘটিয়ে নির্মল আনন্দ দেন। আদিম জাদু বিশ্বাস আদৌ এমন ধরনের কোনও ব্যাপার ছিল না। জাদুকররা বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আদিম মানুষদের ঠকাবার মতো কোনও অবস্থাতেই ছিল না। তখন জীবন ধারণের উপকরণ ও হাতিয়ার ছিল অতি সামান্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা, অসুখ, জন্ম রহস্য ইত্যাদি বহুতর বিষয়ের কারণ খুঁজে পাওয়ার মত বুদ্ধির বিকাশ আদিম মানুষদের মধ্যে ঘটেনি। আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে ওয়াকিবহাল কৃষক আজ ফসল ফলাতে জামির যত্ন নেয়, সার দেয়, জলসেচের ব্যবস্থা করে, বীজ বপন ও তারপরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো নেয়। আদিম যুগে জমির উর্বরাশক্তির সঙ্গে নারীর উর্বরাশক্তিকে এক করে দেখা হত। নারীকে কৃষিভূমির সঙ্গে অভিন্ন ভাবা হত। লিঙ্গ ও তার ক্রিয়া লাঙল দেবার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়েছিল। এই ধারণা থেকেই ভাল ফসলের জন্য ক্ষেতে সব সম্পর্ক ভুলে যৌন আচরণের রেওয়াজ ছিল এবং এখনও বহু আদিবাসী ও উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে এই আচরণ বিদ্যমান ।

চাষের জন্যে, পানের জন্যে জল চাই। জলের জন্য আমরা একসময় পুকুর কাটতাম, কুয়ো কাটাতাম। এলো টিউবওয়েল, ডিপ-টিউবওয়েল, শ্যালোপাম্প, বৃষ্টি আনতে বনসৃজন, বিমানের সাহায্যে মেঘে নুন ছড়ানো, আরও কত কী! আদিম যুগে প্রাকৃতিক জলাশয় ছিল পানীয় জলের ভাণ্ডার। বৃষ্টি জলাশয়ে জল ঢালতো, জল ঢালতো জমিতে। বৃষ্টির অভাবে পানীয় জলের যোগানে টান পড়তো। খরার জমি হত ফুটি-ফাটা। তখন জলের জন্য এক মাত্র ভরসা ছিল বৃষ্টি। আদিম মানুষ মেঘের কাছে, দেবতার কাছে প্রার্থনা করতো— মেঘ দাও। এই মেঘ-দেবতাকে বা বৃষ্টি-দেবতাকে পুরুষ ভেবে নিয়ে নগ্ন নারী দেহের লোভ দেখাতো। ভাবতো, নারীদেহের লোভে বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়বে। আজও ভারতের বহু উপজাতি গোষ্ঠীর নারীরা বৃষ্টি নামাতে নগ্ন হয়ে বৃষ্টিকে আহ্বান জানায়। এ’ও জাদু বিশ্বাস।

বিয়ের অনুষ্ঠানে বিধবা হাজির থাকলে নববিবাহিতা বিধবা হবে—এমন জাদু বিশ্বাস এখনও অনেক হিন্দুর মধ্যে রয়েছে।

গর্ভবতী মহিলার সাধভক্ষণ অনুষ্ঠানে পুত্রবতীদের আমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয় এই বিশ্বাস থেকে যে, গর্ভবতীর সুপ্রসব হবে। এ’ও জাদুবিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়।

রোগ নিরাময়ে রাস্তায় তুক্ করে রাখার রেওয়াজ এখনও আছে। তুক্ করা হয় এই বিশ্বাসে যে, কেউ তুক্ ডিঙোলে অসুখ তার সঙ্গে যাবে। রোগী সেরে উঠবে।

শত্রুকে হত্যা করতে তার কুশপুতুল তৈরি করে শত্রুর চুল বা পোশাকের টুকরো ঢুকিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার জাদু বিশ্বাস এখনও অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে। সন্তানকে কুনজর থেকে রক্ষা করতে কপালের পাশে কাজলের টিপ এঁকে দেওয়া, কড়ে আঙুল আলতো করে কামড়ে দেওয়া, এখনও আমাদের সমাজে দিব্বি জাঁকিয়ে বসে রয়েছে।

ব্যবসাকে কুনজর থেকে বাঁচাতে লঙ্কা লেবু দোকানে ঝুলিয়ে রাখা, দোকানকে চোরেদের হাত থেকে বাঁচাতে রাতে দোকান বন্ধের সময় একটা কাগজে আগুন জ্বেলে দোকানের বন্ধ দরজার সামনে তিনবার ঘোরানো, এ’সবই জাদু বিশ্বাস। নতুন বাড়ি হচ্ছে, একটা বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ঝাঁটা, ঝুড়ি ও জুতো। নজর না লাগে ?

আদিম জাদু বিশ্বাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল—জাদু প্রক্রিয়া ছিল গোষ্ঠীর সকলের উপকারের কথা চিন্তা করে। আজও পিছিয়ে থাকা আদিবাসী ও উপজাতি গোষ্ঠীতে জাদু বিশ্বাসের প্রক্রিয়া সমবেত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। জমিতে ফলন বাড়াতে, বৃষ্টি নামাতে, সমবেত জাদু অনুষ্ঠান হত, হয় ।

সমাজ যখন থেকে একটু একটু শ্রেণীবিভক্ত হয়ে পড়লো, তখন ব্যক্তিস্বার্থও মাথা তুলতে লাগলো। জাদু বিশ্বাসকে ব্যবহার করা হতে লাগলো নিজের বা পরিবারের স্বার্থে। নিজের ব্যবসা, নিজের বাড়ি, নিজের পরিবারকে কুনজর থেকে বাঁচাতে ব্যবহৃত হতে লাগলো জাদু বিশ্বাস। প্রাচীন জাদু বিশ্বাস এক সময় নিজস্ব প্রয়োগ পদ্ধতি ও তাৎপর্য হারিয়ে ধনিক-শ্রেণী ও জাদুকর বা পুরোহিত শ্রেণীর স্বার্থে গোপন বিদ্যার রূপ পেল। পুত্র কামনায়, রোগ আরোগ্য কামনায়, শত্রু জয়ের কামনায়, নারী ভোগের কামনায়, এমনি হাজারো কামনায় হোম-যজ্ঞ ও তান্ত্রিক পুজোপদ্ধতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। যাজ-যজ্ঞের বেদী তৈরি করা হতে লাগলো বিভিন্ন দেবী বা ভগবতীর ‘ভগ’ বা যোনির প্রতীক হিসেবে।

অথর্ব বেদ এমনই এক গুহ্যবিদ্যার আকর, যেখানে আদিম জাদু

বিশ্বাসকে ব্যক্তিস্বার্থে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।

জাদুকররাই নাম পাল্টে হয়ে

গেল মুনি-ঋষি-পুরোহিত।

আদিম মানবগোষ্ঠী জাদুবিশ্বাসের যে বীজ বপন করেছিল, আজ তাই পল্লবিত হয়ে বৃক্ষ। এটাই হিন্দু ধর্মের অনন্যতা। ভারত আজও জাদুর দেশ রয়ে গেল। আর জাদুকররা হয়ে গেল ত্রিকালজ্ঞ মুনি-ঋষি-অধ্যাত্মবাদী-‘মিথ’।

error: Content is protected !!