আনিসুজ্জামান
এই বক্তৃতার শিরোনামটি বেশ ভারিক্কি শোনালেও কোনো তত্ত্বকথার অবতারণা করে আমি আপনাদের ভারাক্রান্ত করব না। আমার সে অভিপ্রায় নেই, যোগ্যতাও নেই। ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ে আমাদের যে-অভিজ্ঞতা, আমি সে সম্বন্ধে কিছু বলব এবং তার পটভূমি সম্বন্ধে দু’চার কথা বলব। অনেকের মতো আমিও ইংরেজ আমলে জন্মেছি, পাকিস্তান আমলে বড় হয়েছি এবং বাংলাদেশ আমলে মরতে বসেছি। ইংরেজ আমলের মতো পাকিস্তানেরও গোড়ার দিকে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিল না; তার পরে পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হলো; আমরা বাংলাদেশ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়লাম; তারপর ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলাম এবং তারও পরে রাষ্ট্রধর্ম করলাম। আমার মনে পড়ে, ঊনিশ শতকের বিখ্যাত ব্রাহ্মনেতা ও লেখক রাজনানায়ণ বসুর (১৮২৬-৯১) কথা। আত্মচরিত-এ (১৯০৯) তিনি লিখেছিলেনঃ
হিন্দু কলেজে পড়িবার সময় আমার ধর্মমতে পর পর কতগুলি পরিবর্তন হয়, কিন্তু ঊনিশ বৎসরের সময় পরম শ্রদ্ধাসম্পদ শ্রীযুক্ত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সঙ্গে আলাপ হইলে যে আদি ব্রাহ্মসমাজের ব্রাহ্ম হই, তাহা এখনও আছি । শোভালিয়র র্যামেজ-র ‘সাইরাসেজ ট্রাভেলস’ পড়িয়া প্রচলিত হিন্দুধর্মে আমার বিশ্বাস বিচলিত হয়। তৎপরে রামমোহন রায়ের … এবং চ্যানিঙ্গের গ্রন্থ পাঠ করিয়া ইউনিটারিয়ান খ্রিষ্টিয়ান হই, তৎপরে ঈষৎ মুসলমান হই, পরিশেষে কলেজ ছাড়িবার অব্যবহতি পূর্বে হিউম পড়িয়া সংশয়বাদী হই । যে পুস্তক যখনই পাঠ করা যায় তখনই সেইরূপ হওয়া অবশ্য বালকতা বলিতে হইবে, আর তখন যথার্থই বালক ছিলাম ।
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক-বিষয়ে ঘন ঘন মত পরিবর্তন করে আমরাও বালকতার পরিচয় দিয়েছি কিনা বলা যায় না। হয়তো রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা এখনো বালক রয়ে গেছি ।
যে-দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, অনেকে সে-তত্ত্বের উদগাতা বলে জানেন স্যার সৈয়দ আহমদ খানকে (১৮১৭-৯৮)। তার বহু বক্তব্য এ ধারণা সমর্থন করে, তবে উল্টো কথাও তিনি বলেছিলেন। ১৮৮৪ সালে স্যার সৈয়দ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন। জানুয়ারি মাসে গুরুদাসপুরে তিনি বলেনঃ
Remember that the words Hindu and Mahomedan are onely meant for religious distinction-otherwise all persons, whether Hindu o Mahomedan or even Christians who reside in this country are all in this particular respect belonging to one and the same nation.
ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে তিনি বলেনঃ
With me it is not so much work considering that their relgious faiths but that we inhabit the same land and are subject to the rule of the same government. These are the grounds upon which I Call both the races which inbahit India by the word ‘Hindu’ by which I mean that they are the inhabitants of Hindustan.
স্বধর্ম ও স্বদেশের মধ্যে যে-পার্থক্য এখানে করা হয়েছে, তা বিশেষভাবে বিবেচনার যোগ্য। ধর্ম সম্পর্কে স্যার সৈয়দের আরেকটি মৌলিক ধারণার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তাও ভেবে দেখা যেতে পারে। তিনি মনে করতেন যে, সকল নবীই মানবসমাজে অভিন্ন ধর্মবিশ্বাস (দীন) প্রচার করেছিলেন, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই নিজেদের কালোপযোগী ভিন্ন জীবনবিধান (শরীয়া) বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। বিশ্বাস অপরিবর্তনীয় বা শাশ্বত; বিধান পরিবর্তনীয় ও ইহজাগতিক। পূর্বগামী নবীদের আনীত বহু আইন কুরআন শরীফ বাতিল করে দিয়েছে, কেননা ইতিহাসের অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে সেসব আইন প্রয়োগযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। স্যার সৈয়দ যে এভাবে ইহজাগতিক ও পারলৌকিককে আলাদা করে দেখতে পেরেছিলেন, এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয় ।
স্যার সৈয়দ আহমদের পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয় মুসলমানদের সুযোগ প্রতিনিধি মনে করা হয় মওলানা মোহাম্মদ আলীকে (১৮৭৮-১৯৩১)। ইসলামের ঐক্য ও মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তার বেশ কিছু বক্তব্য আছে। তবে ধর্মীয় অস্তিত্ব ও দেশগত পরিচয়কে তিনিও পৃথক করে দেখেছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন: সে যুক্তরাষ্ট্র কেবল রাজনৈতিক নয় ধর্মীয় যুক্তরাষ্ট্রও। প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে তিনি বলেছিলেনঃ
Where God commands… I am a Muslim first, a Muslim second and a Muslim last and nothing but a Muslim… My first duty is to my maker, not to HM the king nor to my companion Dr Monje… But where India is concerned, where India’s freedom is concerned, where the welfare of India is concerned, I am an Indian first, an Indian second, an Indian last and nothing but an Indian… I belong to two circles of eqal size but which are not concentric. One is India and the other is the Muslim world… we belong to these circles … and we can leave neither.
সমাজ-রাজনীতি-সাংবাদিকতা-ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে আত্মপ্রকাশ করে মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) গণ্য হয়েছিলেন মওলানা মোহাম্মদ আলীর সমসাময়িক একজন বিশিষ্ট নেতা ও চিন্তাবিদ বলে। ইসলামের বাইরে তিনি কিছুই ভাবতে চাননি এবং তাই এক সময়ে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা মুসলমানের পক্ষে নীরব ধর্মদ্রোহিতার তুল্য জ্ঞান করেছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি স্পষ্টই লিখেছিলেন যে, ইউরোপে জাতি শব্দ সহস্র হৃদয় স্পন্দিত করে, আর মুসলমানের হৃদয় যাতে স্পন্দিত হয়, তা হলো আল্লাহ বা ইসলাম শব্দ । খিলাফত আন্দোলনের সময়ে তিনি খিলাফতের একটি নতুন তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন এবং ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দুর সঙ্গে সহযোগিতা করা মুসলমানের কর্তব্য বলে স্থির করেন। পরে অসহযোগ আন্দোলনের কালে তিনি যে তত্ত্বে উপনীত হন, তাতে তিনি আজীবন নিষ্ঠ ছিলেন। এই তত্ত্বের মূল তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন হযরত মুহম্মদের মদিনা চুক্তিতে, যাতে মুসলমান-অমুসলমান-নির্বিশেষে মদিনাবাসীকে উম্মা ওয়াহিতা বা একটিমাত্র সম্প্রদায় বলে অভিহিত করা হয়। এটিকে নজির হিসেবে ধরে নিয়ে তিনি ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন এবং এভাবে ইসলামের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ভারতবাসীর অখণ্ড সত্তায় আস্থাজ্ঞাপন করেছিলেন ।
তবে ভারতীয় রাজনীতির ধারা এবং শাসনব্যবস্থা সংস্কারের গতি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের দিকে। একদিকে বাস্তব জীবন ও রাজনীতি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছিল। অন্যদিকে মর্লি-মিন্টো সংস্কারে মুসলমানের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের যে ব্যবস্থা করা হয়, মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে তা ব্যাপকতা লাভ করে। স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবির পোষকতা করেছিল।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রগঠনের দাবি জানানো হয়। পরে, ১৯৪৬ সালে এপ্রিল মাসে, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ দলীয় আইনসভা-সদস্যদের সম্মেলনে দুটি রাষ্ট্রের জায়গায় পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান নামটি উল্লেখ করা হয়নি এবং ভাবী রাষ্ট্রের ধর্মীয় চরিত্র সম্পর্কেও কোনো আভাস দেওয়া হয়নি। ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) রাষ্ট্রের নাম প্রসঙ্গে যা বলেন, তার সারমর্ম এইঃ লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান কথাটাই ব্যবহার করা হয়নি। হিন্দুরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলে যে, এতে পাকিস্তান চাওয়া হয়েছে। হিন্দুদের সংবাদপত্রের একাংশ এবং ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকা পাকিস্তান কথাটা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। তবে আমি তাদের ধন্যবাদ দিই এজন্য যে, এর ফলে অনেকগুলো শব্দের বদলে এই একটি শব্দ ব্যবহারের সুযোগ তারা করে দিয়েছেন।
১৯৪৩ সালের মুসলিম লীগ অধিবেশন আরো একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ঘটে। অধিবেশন শুরু হবার আগে একদল প্রতিনিধি প্রস্তাব করেন যে, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান কুরআনের ভিত্তিতে রচিত হবে বলে মুসলিম লীগকে ঘোষণা করতে হবে। বোম্বাইয়ের ড. আবদুল হামিদ কাজী এই অধিবেশনে উত্থাপনের জন্য একটি প্রস্তাবের খসড়াও প্রচার করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্ত ানের সংবিধান রচিত হবে হুকমত-ই-ইলাহিয়ার- অর্থাৎ প্রথম চার খলিফার হাতে প্রণীত নীতিসমূহের ভিত্তিতে। কিন্তু প্রস্তাব উত্থাপনের সময় আসার আগেই সভাপতির ভাষণ প্রদত্ত হয় এবং তাতে এ প্রসঙ্গে জিন্নাহ বলেনঃ
The constitution of Pakistan can only be framed by the millat and the people. Prepare yourselves and see that you frame a Constitution to your heart’s desire. There is a lot of misunderstanding. A lot of mischief is created. Is it going to be an Islamic Government? Is it not begging the question? Is it not a question of passing a vote of censure on yourself? the Constitution and the Government will be what the people will decide.
এর পরে ড. কাজী তার প্রস্তাব উত্থাপন করেননি । তিনি খুশি হয়েছিলেন কিনা বলা মুশকিল । কেননা জিন্নাহর বক্তৃতায় একদিকে যেমন বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের সরকার ইসলামী হবে না, এমন মনে করা আত্মনিন্দার শামিল, অন্যদিকে তেমনি বলা হয়েছিল যে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কেবল জনগণের অভিপ্রায়-অনুসারী সংবিধান রচনা করবে।
তবে মুসলিম লীগের অনেক নেতাই বিভিন্ন সময়ে এমন উক্তি করেছিলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে কুরআনের নির্দেশ-অনুগ। অনেকেই আবার এসব কথায় আস্থাজ্ঞাপন করেননি। জমিয়ত-আল-উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মওলানা হুসেন আহমদ মদনী (১৮৭৯-১৯৫৭) জিন্নাহকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন যে, পাকিস্তান যে ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না, জাগতিক রাষ্ট্র হবে, তা এদের কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। জিন্নাহ এবং অন্যান্য মুসলিম নেতাকে তিনি ইসলাম সম্পর্কে কেবল অজ্ঞ নন, উদাসীন বলে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং তার বক্তব্যের সমর্থনে এদের পক্ষে ১৯৩৭ সালের শরীয়া আইন সমর্থন না করার ও ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন বিরোধিতা না করার দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন। জিন্নাহকে তিনি অভিহিত করেছিলেন কাফেরে আজম বলে (কেউ কেউ বলেন, আহরার- নেতা মওলানা মজহার আলী আজহারের দুটি ছন্দোবদ্ধ চরণে প্রথম এই বিদ্রূপপূর্ণ উক্তি করা হয়) এবং মুসলিম লীগে যোগদান ইসলামবিরোধী কাজ বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। জামাতে ইসলামীর আমীর মওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী (১৯০৩-৭৯) তো স্পষ্টতই বলেছিলেন যে, জিন্নাহ থেকে শুরু করে মুসলিম লীগের নিম্নপর্যায়ের কর্মীদের কারো দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামসম্মত নয় এবং কোনো সমস্যাকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা তাদের নেই। জাতীয়তাবাদ- তা ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদ হলেও— এবং গণতন্ত্রের ধারণা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিজাত বলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পাকিস্তান, তার মতে, কাফেরানা রাষ্ট্র— যার নাম তিনি দিয়েছিলেন না-পাকিস্তান। অবশ্য উল্টো কথা বলার মতো আলেমও পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের সমর্থক আলেমদের সংগঠন জমিয়ত-আল-উলামায়ে ইসলাম উপরিউক্ত সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন যে, মুসলিম লীগে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন লোকের অভাব থাকলে তেমন লোকদের উচিত মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে সে- অভাব দূর করা। তবেই অধার্মিক পাশ্চাত্যপন্থী নেতাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান ধার্মিক ব্যক্তিদের নেতৃত্বে শরীয়ার শাসন প্রবর্তনে সমর্থ হবে।
সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, পাকিস্তান- প্রতিষ্ঠার আগে ভারতীয় মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি সত্ত্বেও দেশটিতে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল না। মুসলমানেরা যাতে নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী জীবন গঠন করতে পারেন, তার নিশ্চয়তা লাভই ছিল পাকিস্তানের লক্ষ্য। ১৯৪৬-এ রয়টারের প্রতিনিধিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিন্নাহ বলেনঃ
The new state would be a modern democratic state with sovereignty resting in the people and the members of the new nation having equal rights of citizenship regardless of their religion, caste or creed.
তাই এটা বিস্ময়কর নয় যে, পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে, ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্টে, সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেনঃ
You are free to go to your mosques or any other place of worship in this State of Pakistan. You may belongs to any religion or caste or creed that had nothing to do with the business of the State… you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the State.
জিন্নাহর এ উক্তি কেবল ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টাদের ক্ষুণ্ন করেনি, জি. এম সৈয়দের মতো মুসলিম লীগবিরোধী নেতাকেও একথা বলতে প্ররোচিত করেছিল যে, এতে জিন্নাহর chastened mood-এর প্রকাশ ঘটেছে এবং লীগের এত কালের কর্মসূচি ও সংগ্রামের অন্তরালবর্তী মৌলিক নীতি বিসর্জন দেওয়া হয়েছে । তবে জিন্নাহর অনুসারীরা অল্পকালের মধ্যেই তার এই দৃষ্টিভঙ্গী পরিত্যাগ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তান সংবিধান-সংক্রান্ত যে Objective Resolution উত্থাপন করেন, তাতে প্রথমেই রাষ্ট্রের— শুধু রাষ্ট্রের নয়, সমগ্র বিশ্বজগতের— সার্বভৌমত্ব বলা হয়েছে আল্লাহর এবং রাষ্ট্রকে যদিও স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তবু এই রাষ্ট্রের মুসলিম অধিবাসীরা যাতে কুরআন শরীফ ও সুন্নায় বর্ণিত ইসলামের শিক্ষা ও আবশ্যকতা-অনুযায়ী ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনযাপন করতে পারেন, তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ১৯৫০ সালের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টেও এর প্রতিধ্বনি করা হয় এবং সেই সঙ্গে যোগ করা হয় যে, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা নির্বাচনী অঙ্গীকারের শীর্ষদেশেও লেখা হয়েছিলঃ
নীতিঃ কোরআন ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয় করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে । *
১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় এই নামান্তরের প্রস্তাব করেন।
* এ সম্পর্কিত একটা শোনা কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার রচনার ভার পড়ে আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) উপরে। তিনি এর আগে আওয়ামী লীগের জন্য ৪২ দফায় একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা মনে রেখে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর (১৮৮৫-১৯৭৯) সম্মতি নিয়ে এই ৪২ দফা হেঁকেকেটে এবারে তিনি ২১ দফায় রূপ দেন। এ পর্যন্ত আবুল মনসুর আহমদ নিজেই লিখে গেছেন। তারপরের অংশই শোনা কথা। এই ২১ দফা মওলানা ভাসানীকে দেখালে তিনি নাকি কুরআন ও সুন্নার খেলাফ কোনো আইন তৈরি করা হবে না— এই অঙ্গীকার জুড়ে দিতে বলেন। আবুল মনসুর আহমদ ২১ দফা রাখতে চান বলে এটাকে কোনো দফা হিসেবে গণ্য না করে প্রথম দফার মাথায় ‘নীতি’ বলে কথাগুলো যোগ করেন এবং ‘কুরআন ও সুন্না’র জায়গায় ‘কুরআন ও সুন্নার মৌলিক নীতি’ বসিয়ে দেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯৩-১৯৬৩)। সভায় মওলানা ভাসানী বলেন যে, এই প্রস্তাব অনেকদিন ধরেই তাদের বিবেচনাধীন ছিল। তবে ভাষা আন্দোলনের সময়ে মুসলিম লীগ যেরকম মিথ্যে প্রচার করে, তা স্মরণ করেই সংগঠন যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় না করা পর্যন্ত তারা নাম বদলাবার ঝুঁকি নিতে চাননি। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে এই নীতির সংযোজন অনুরূপ বিবেচনাপ্রসূত কিনা তা বলা যায় না। তবে মওলানা ভাসানী পরেও কুরআন ও সুন্নার সঙ্গে সংগতির কথা বলেছেন।
১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়, তখন দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের অনেকে দেশের এই নামকরণের বিরোধিতা করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০- ৭৫) যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃতিযোগ্যঃ
আমার এক বন্ধু বলেছিলেন যে, তারা মাইনরিটিদের সমানভাবে দেখবেন। আমি জিজ্ঞাসা করি, কিভাবে সমানভাবে দেখবেন— ইসলামিক রিপাবলিক নাম চেঞ্জ করে দিয়ে? ইসলামিক রিপাবলিক না হয়ে পাকিস্তান রিপাবলিক হোক, আমরা একথা নিয়ে ফাইট করেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম, রাজনীতিতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সব সমান হবে- সত্য এবং সাম্যের নীতির উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। স্যার, আমরা হেড অফ দি স্টেট মুসলমান করে দিলাম। ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান নাম করলাম । এইভাবে দুই জাতি তো করেই দিলাম তার উপরেও যদি সেপারেট ইলেকশন হয় তাহলে কি হয়? দুই জাতির ভিত্তিতে আমাদের পাকিস্তান হয়েছে। এর পরও যদি আজকে আলোচনা করা হয় যে, পাকিস্তানে আমরা দুই জাতি, একটা হিন্দু আর একটা মুসলমান, তাহলে একটা প্রোভোকেশন দেয়া হয়। আজ যদি পূর্ব বাংলার এক কোটি হিন্দু বলে যে, আমাদের আলাদা জায়গা অর্থাৎ একটা হিন্দু স্টেট দিতে হবে, তাহলে কি হবে? পাকিস্তানের খাতিরে, পাকিস্তানের ইনসাফের খাতিরে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাতিরে আমি আমার বন্ধুদের অনুরোধ করব তারা যেন এই সেপারেট ইলেকটরেটের প্রস্তাব উইথড্র করেন।
এই বক্তৃতায় যে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা বিকশিত হচ্ছিল অনেকদিন ধরে। বিশেষ করে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর থেকে পূর্ব বাংলার রাজনীতিক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ভাষা- আন্দোলনের আগে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ছিল দেশের একমাত্র সংগঠন যার দ্বার সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল । ভাষা-আন্দোলনের পরে আমরা দেখি অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠনরূপে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্রী দলের আত্মপ্রকাশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে পরিণত এবং দেশের এই অংশের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী মুসলিম লীগের আওয়ামী লীগে রূপান্তর। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় যুক্ত নির্বাচন প্রথার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ এই ক্রমবর্ধমান অসাম্প্রদায়িক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে যুক্ত নির্বাচন বিল উত্থাপন করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি স্মরণীয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার অংশবিশেষ এরকমঃ
It may appear strange to those who have not been able to adapt themselves to the change in political outlook resultant on the creation of Pakistan that I who was an advocate of the two nation theory in undivided India, and whose contribution to the creation of Pakistan was perhaps not insignificant, and who belived in separate electorate in undivided India, should advocate joint electorate in Pakistan as a salutary constitutional principle… Separate electorate was a device to secure proper representation in the Legislatures for the Muslim minority; it took something away from the majority population; it was certainly never meant to be a device to safeguard the intersts of the majority population…,
The two nation theory was advanced by the Muslims as a justification for the partition of india and the creation of a State made up of geographically contiguous units where the Muslims were numerically in a majority. Once the State was created. the two nation theory lost its force even for the Muslims. If it is still persisted in, it will logically lead to the partition of Pakistan… The Muslims who were a nationality in undivided India, are now citizens in their own country Pakistan, in which every citizen, whatever may be his religions, is a member of the Pakistani nation. There is, thus a radical difference between the conception of the Millat-i-Islam which transcends geographical boundaries, and the conception of a Pakistani nation or qaum which has boundaries and has a peculiar entity which differentiates it from other nations. Circumstances thus have changed, and so must our political outlook change with the establisment of Pakistan.
গণপরিষদে কিন্তু এই প্রশ্নে আপসরফা হলো এভাবে যে, পূর্ব পাকিস্তানে হবে যুক্ত নির্বাচনপ্রথা আর পশ্চিম পাকিস্তানে থাকবে স্বতন্ত্র নির্বাচনপ্ৰথা ।
পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কতটা গড়ে উঠেছিল, এ থেকে সহজেই বোঝা যায়। তাই একদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র, অন্যদিকে তার দুই অংশে দুরকম নির্বাচন প্ৰথা ৷
পাকিস্তানে পরবর্তী পনেরো বছরে অন্যান্য বিষয়ে বিরোধের মতো রাষ্ট্রজীবনে ধর্মীয় অনুসঙ্গ এবং অসাম্প্রদায়িকতার- কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতার- বিরোধ তীব্র হয়েছে। ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে ১৯৬২ সালে দেশের দ্বিতীয় সংবিধান প্রবর্তিত হয়। রাষ্ট্রের নাম ফিরে আসে পাকিস্তান রাষ্ট্রে— অর্থাৎ নাম থেকে ইসলামী কথাটা বাদ যায়। তবে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে কুরআন ও সুন্না এবং ইসলামী জীবনধারার কথা বলা হয় এবং তার জন্য ইসলামী আদর্শ-বিষয়ক একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিধান রাখা হয় । ১৯৬২ সালের সংবিধান রদ হয়ে যায় ১৯৬৯ সালে । জেনারেল ইয়াহিয়া খান যে Legal Farmework Order জারি করেন, তাতে বলা হয় যে, নির্বাচনের পর যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে সে-সংসদের দ্বারা প্রণীতব্য সংবিধানে “Islamic ideology which is the basis for the creation of Pakistan” t রাখতে হবে। এই কারণে ১৯৭০ সালে যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, কুরআন ও সুন্নার পরিপন্থী আইন-প্রণয়ন থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি তাদের প্রত্যেককেই দিতে হয়েছিল।
জেনারেল আইয়ুব খান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মতো সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান সংবিধানের ইসলামী চরিত্র রাখতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, ক্ষমতায় থাকার জন্য, সাধারণ মানুষকে ভোলাবার জন্য, তাদের প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের যোগ ঘটানোর । এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ মুনীর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বিবৃত করেছেনঃ
When I was a member of Ayub’s Cabinet in 1962 and the Political Parties Bill was under discussion a person moved and amendment to the bill proposing that no party would be formed the object of which was opposed to the ‘Ideology of Pakistan’ shall have to be defined. On this the member who had moved the original amendment replied that the ideology of Pakistan was ‘Islam’, but nobody asked him the further question. ‘What is Islam?’ The amendment to the bill was therefore passed as the member who supported the amendment was Maulvi Abdul Bari of Lyallpur who was a supporter of Ayub. Nobody can say anything to the contrary where Islam is mentioned. Ayub was then in Karachi and I could not contact him. When he returned I mentioned to him the incident and he remarked, “What will the world say about it all”.
বিচারপতি মুনীর যে বলেছেন- ইসলাম কী, এ বিষয়ে কেউ আর প্রশ্ন করল না- তার একটা ইতিহাস আছে। পাঞ্জাবে ১৯৫৩ সালে আহমদীয়া-বিরোধী দাঙ্গা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য তার নেতৃত্বে বিচারপতি কায়ানীকে নিয়ে যে কোর্ট অফ ইনকোয়ারি গঠিত হয়, তাতে তাঁরা দেখতে পান যে, ইসলাম কী এবং মুসলমান কে, সে বিষয়ে কোনো দুজন আলেম একমত হতে পারেননি। কোনো কোনো আলেমের মতে, আল্লাহর আইন কুরআন ও সুন্নায় পাওয়া যায় বলে ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির বা সমষ্টির আইন-প্রণয়নের অধিকার নেই এবং আল্লাহর আইন ব্যাখ্যা করার অধিকার রয়েছে কেবল শাস্ত্রজ্ঞানীদের।
পাকিস্তানের শাসকেরা ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংযোগ ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু দেশের দুই অংশের বিচ্ছেদ অনিবার্য করে তুলেছিলেন। এর আশু কারণ আমাদের অজানা নয়। তবে অনেকদিন ধরে যেসব কারণে দুই অংশের মতান্তর সৃষ্টি হচ্ছিল, ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়টি তার একটি বললে ভুল হবে না।
৩
অনেক স্বেদ, অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র যে ধর্মীয় হবে না, তার প্রথম আভাস পাওয়া যায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। এতে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হবে, সে কথা মুক্তিযুদ্ধের কালে নেতারা বহুবার বলেছিলেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান এবং এমন কি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমদের বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তিন নীতি— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার— কথা একাধিকবার ঘোষিত হয়েছিল । পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন রেসকোর্সের জনসভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি বলেছিলেনঃ
সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম ও ভারত তৃতীয়। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ।
পরে তিনি আরও একটি নীতি যোগ করেন— জাতীয়তাবাদ। সেই চারটি মূলনীতিকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়।
আগে বলেছি, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাব শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তার একটা কারণ ছিল এই যে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উপেক্ষা করে যারা উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তারা ধুয়া তুলেছিলেন ধর্মের। পাকিস্তান মুসলমানের রাষ্ট্র, উর্দু মুসলমানের ভাষা; তাই উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে। বাংলা হিন্দুর ভাষা, ওতে ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট লেখা হয়নি; তাই বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারবে না। পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৫১ সালে বলেছিলেন যে, জাতি হিসেবে মুসলমানের টিকে থাকার সংগ্রাম আর উর্দুকে জিইয়ে রাখার সংগ্রাম অভিন্ন। উর্দুর আধিপত্য প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষ ধর্মের নামে শোষণ ও উৎপীড়ন এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভাষা-আন্দোলনের পরে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ কিংবা প্রতিষ্ঠিত ছাত্র ও রাজনৈতিক দলের অসাম্প্রদায়িকীকরণ সম্ভবপর হয়েছিল শুধু নয়, অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। বাঙালি হতে হলে ও গণতন্ত্রী হতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ না হয়ে উপায় নেই, এ কথা বুঝতে মানুষের দেরি হয়নি। ইসলামের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার যে চেষ্টা দেশে চলছিল, সে সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দীর পূর্বোল্লিখিত বক্তৃতায় খুব চমৎকার করে বলা হয়েছে।
It is so easy to mislead our people who are prepared to sacrifice everything in the way of Islam, to mislead them in the name of Islam. It is so easy to excite passion, so easy to kindle dires, so easy to destroy’, so difficult to build, that I would beg of those who are utilising these controversy, for the sake of opposition, not to fan the flames of fanaticism and bigotry and hatred, but to pause and build Pakistan on the solid foundation of trust and unity between all the people inhabiting this beloved country of ours.
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার বিপদ সম্পর্কে পাকিস্তানের দিনগুলিতেই আমরা ক্রমশ অবহিত হয়েছি। তারপর ১৯৭১-এ এর মারাত্মক রূপ দেখলাম। ইসলাম রক্ষার নামে, মুসলিম রাষ্ট্রের নামে, কী অমানুষিক অত্যাচারই না হলো দেশের মানুষের উপর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসররা ধর্মের নামে সকল বর্বরতার প্রতি সমর্থন জানালেন। ইসলাম ও পাকিস্তানকে অভিন্ন বলে দাবি করে তারা ঘোষণা করলেন যে, পাকিস্তানের বিরোধীতা মানেই ইসলামের বিরোধিতা। যেন পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ইসলামের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করলেন যে, আল-বদর বাহিনী গঠন করা হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্যে। যখন সেই সামরিক বাহিনীর ভরাডুবি হলো, তখন তাদের যোগসাজশে ক্রোধে উন্মত্ত আল-বদরেরা দেশের সেরা সন্তানদের হত্যা করে নিজেদের আদর্শবাদের পরিচয় রেখে গেল ।
এই অভিজ্ঞতা ১৯৭২ সালে আমাদের মনে তাজা ছিল। তাই যে সংবিধান আমরা তখন রচনা করেছিলাম, তাতে একদিকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মূল রাষ্ট্রীয় নীতি বলে গৃহীত হয়, অন্যদিকে তেমনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ লোপ করে দেয়া হয় সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে। তাতে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাবান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হবে ।
ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বলে স্বীকৃত হলেও এর তাৎপর্য আমাদের সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি- এমনকি, রাষ্ট্রপরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সকলের কাছেও নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা ব্যবহৃত হচ্ছে সেকুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে। অনেকে মনে করেন, ইহজাগতিকতা বললে কথাটা স্পষ্ট হতো। তা হয়তো হতো, তবে ধর্মনিরপেক্ষ বলায়ও ভুল হয় না। নিরপেক্ষ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অপেক্ষারহিত- ওতে কর্মসম্পর্কহীন, প্রয়োজনরহিত বা উদাসীন বোঝায় । আমরা যখন জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বা দলনিরপেক্ষ ব্যক্তির কথা বলি, তখন নিরপেক্ষ শব্দের সেই দ্যোতনাই ধরা পড়ে। কোনো জোটের সঙ্গে যে দেশের যোগ নেই, তা জোটনিরপেক্ষ দেশ; কোনো দলের সঙ্গে যে ব্যক্তির সংস্রব নেই, তিনি দলনিরপেক্ষ লোক । তেমনি ধর্মের সঙ্গে যে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই, তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাই বোঝায় রাষ্ট্রীয় উদযোগের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ের সংযোগহীনতা, ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংস্রবশূন্যতা, পারলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন ইহজাগতিকতা। ধর্ম থাকবে নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হয়ে, রাষ্ট্র সকলকে নিজস্ব ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও অধিকার দেবে, কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না ।
তবে নিরপেক্ষতা বলতে অনেকেই ধরে নেন রাষ্ট্রে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্ম ও যেসব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পক্ষপাতহীনতা । সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট বিধান সত্ত্বেও ১৯৭২ সাল থেকে আমাদের প্রবণতা দেখা দিল রাষ্ট্র কর্তৃক সকল ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদানের। তাই বেতারে, টেলিভিশনে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে- সর্বত্র কুরআন শরীফ, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ হতে থাকল একসঙ্গে। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় এ নয়, এ হতে পারে সকল ধর্মের সমান মর্যাদালাভ । আমরা কথায় কথায় আরও ঘোষণা করতে লাগলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। আর তা প্রমাণ করার জন্যই যেন বঙ্গভবনে বা গণভবনে মিলাদ পড়ানোও হলো ।
ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যাই বোঝাক না কেন, আমাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক লোকের কাছে তা একবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের ধারায় আস্থাবান, মুসলমান ও অমুসলমানকে ভিন্ন ভিন্ন জাতিরূপে দেখতে অভ্যস্ত, সকল ধর্মের গ্রন্থ ও অনুসারীর সমান মর্যাদালাভ তাদের কাছে খুবই শোচনীয় ব্যাপার। ১৯৭৫ সালের পরে তাদের সুযোগ এলো। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান (১৯৩৫-৮১) মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ক্ষমতার অংশ দিলেন এবং সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আনলেন। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ বলে সংবিধানের প্রস্তাবনার পূর্বে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম যুক্ত হলো, ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় এলো ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের উচ্ছেদ হয়ে গেল। ১২ অনুচ্ছেদের উচ্ছেদের ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নতুন করে আমদানি হলো এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশকে বৈধ রূপ দেওয়া হলো । জিয়াউর রহমান যেমন আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জন করেন, মনে হয়, জেনারেল এরশাদ তেমনি পূর্বগামীর কীর্তি কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন । সংশোধনীতে বলা হয়ঃ ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ ইসলামের সঙ্গে অন্য ধর্মের কী বিপুল পার্থক্য করা হলো, সংশোধনীর ভাষা থেকেও তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবে সংবিধানে সকল নাগরিককে যে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং আইনের দৃষ্টিতে যে সমতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা লংঘন করা হলো। কোনো অমুসলমানের পক্ষে সংবিধান রক্ষার এবং এর প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেওয়ার অর্থ হয়ে দাঁড়ালো বিসমিল্লাহর প্রতি তার আনুগত্য- ঘোষণা।
রাষ্ট্রধর্ম-প্রবর্তনের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন লিখেছেনঃ
বিধানটি রাষ্ট্রের ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্যদের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করেছে, যদিও তারা একই দেশের সমান সাংবিধানিক অধিকারের অধিকারী। প্রশ্ন থেকে যায়, ইসলাম কোনো একটি দেশের সে দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলমান হলেও- রাষ্ট্রধর্ম হতে পারে কি না? আবার একটি রাষ্ট্র সার্বভৌম ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করতে পারে কি না?…
ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলে, ইসলাম সে দেশের মুসলিমদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম অধিকারের অধীন হয়ে যাচ্ছে। ইসলাম তার সর্বজনীনতা হারাচ্ছে। তার বিশ্বজনিনতা খর্ব হচ্ছে।
যদি ধর্মমত সার্বভৌম হয়ে থাকে, তবে রাষ্ট্রকে সেই মতের অধীন হয়ে চলতে হবে…। ইসলামের মতো আপন নীতিমালাসম্পন্ন ধর্ম রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। আবার সার্বভৌম রাষ্ট্র ইসলামের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। এর মিমাংসা হতে পারে রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক করা।
বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাতের ফলে যে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়, একথা অনেকে মানতে চান না। তারা যুক্তরাজ্যের দৃষ্টান্ত টানে। স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের পরে ইউরোপে ক্রমে ধর্ম ও রাষ্ট্রের— চার্চ ও স্টেটের— পৃথকীকরণ ঘটে এবং সকল নাগরিকের ইহলৌকিক কল্যাণসাধন রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে স্বীকৃত হয়। তা সত্ত্বেও ইউরোপের সব দেশে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক হয়নি । যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানী চার্চ অফ ইংল্যান্ডের রক্ষাকর্তা— এই অর্থে অ্যাংলিকান চার্চের ধর্মই যুক্তরাজ্যের সরকারি ধর্ম। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একাধিক দেশ বা আয়ারল্যান্ড, ইতালি ও স্পেনে রাষ্ট্র বিশেষ বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। অন্যদিকে ক্যাথলিক ধর্মের অসাধারণ প্রাধান্য সত্ত্বেও ফ্রান্স ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, প্রোটেস্ট্যান্টদের গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ দেশ- সরকারি কর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করা বা কর্মক্ষেত্রে ঈশ্বরের নামে শপথ নিতে বলা কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে বাইবেল পাঠ বা প্রার্থনা করাও সংবিধানবিরোধী বলে সেদেশের সর্বোচ্চ আদালত স্থির করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্রসংস্থার (ওআইসি) অর্ধেক সদস্যরাষ্ট্রেই রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু নেই। ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমীরাত বা সিরিয়ার মতো দেশ রাষ্ট্রধর্ম স্বীকার করে না। তুরস্ক কেবল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়, তার সংবিধানের যেকটি ধারা কোনোভাবে সংশোধনযোগ্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা তার একটি; সে দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও নারীর স্বাধীনতা-বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষ আইন প্রচলিত। সুতরাং কেবল উদাহরণ দিয়ে কোনো লাভ নেই । স্বদেশের অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির ভিত্তিতেই এ করণীয় নির্ণয় করা আবশ্যক। ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ ফ্রান্সকে ধর্মনিরপেক্ষ থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে; আদি বসতিস্থাপনকারীদের ধর্মীয়ভাবে নিপীড়িত হওয়ার অভিজ্ঞতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ কোনো ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে দেয়নি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে কুফল আমরা ভোগ করেছি, ধর্মের নামে যে শোষণ ও নিপীড়ন এখানে চলেছে, এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত সংগ্রামের যে ইতিহাস আমরা রচনা করেছি, তার ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শগ্রহণই আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক ও সংগত ছিল ।
8
সামরিক শাসনের আওতায় ধর্মনিরপেক্ষতা উঠে গিয়েছিল— তার বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম- ঘোষণার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, যদিও তা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। আওয়ামী লীগ ও আট দলে তাদের সহযোগিরা, ওয়ার্কার্স পার্টি ও পাঁচদলে তাদের সহযোগীরা, মহিলা-সংগঠন এবং অধিকাংশ সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন প্রতিবাদ করেছিলেন । বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) চুপ করে থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ যে তাদেরই কীর্তি, তা তারা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময়ে প্রচার চলল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ উঠে যাবে। এ প্রচারণায় কাজ হয়েছিল। আওয়ামী লীগও ভয় পেয়ে আল্লাহ আকবর ধ্বনি তুলল, আবার ধর্মনিরপেক্ষতাও ছাড়তে পারল না। একটি পোস্টারে দেখেছিলাম, নৌকার ছবির নিচে নজরুল ইসলামের কবিতার উদ্ধৃতি: কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝিমাল্লা/ দাড়িমুখে সারিগান লা-শরিক আল্লাহ। আওয়ামী লীগই শুধু যে এই পরস্পরবিরোধী পথ অনুসরণ করে, তা নয় । বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসেও মিলাদ মাহফিল হয় এবং তাদের প্রার্থীর নির্বাচনী পোস্টার ও প্রচারপত্রে আল্লাহ আকবর যোগ করা হয় । সাধারণ নির্বাচনের পরে জয় বাংলা ও খোদা হাফেজেরও যোগ কিছু বেড়েছে বলে মনে হয়।
ধর্মনিরপেক্ষবাদী যে ধর্মবিশ্বাসী হতে পারবেন না, তা নয়; তবে রাজনীতিতে ধর্ম টেনে আনবেন না বলে তিনি প্রতিশ্রুতিবিদ্ধ । তিনি নামাজ পড়ুন, রোজা রাখুন, জাকাত দিন, হজ পালন করুন, মন্দিরে যান, চার্চে প্রার্থনা করুন, বৌদ্ধ ধর্মসংঘের শরণ নিন, কিন্তু এই ধর্মবোধের সঙ্গে যেন রাজনীতির সংস্রব না ঘটান, এটাই তার কাছে দাবি। এটাই যে তার করণীয় তা তিনি নিজেই জানেন ভালো করে, তবে প্রতিপক্ষের অপপ্রচারে ভীত হয়ে যা করণীয়, তা তিনি করতে পারেন না। ভয় যে শুধু অপপ্রচারে তা নয়। লোকে কী বলবে, তারও ভয়; মনে সংশয় ।
কী চায় জনসাধারণ? মনে রাখতে হবে যে, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ কিংবা সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের সংযোগ জনসাধারণের দাবিতে হয়নি। শুধু ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছায় এসব ঘটেছে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রধান দুটি দলের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীদের (৩০.৮%) চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা (৩৩.৮৭%)। তবে বিএনপি, জামাতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মোট প্রাপ্ত ভোটের (৫৪.৭৮%) হিসেবে বলতে হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধীরা বেশি জনসমর্থন লাভ করেছেন । ওদিকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের নির্বাচনের ফলাফল দেখলে স্পষ্টই মনে হয়, রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে না হলেও তরুণদের বেশিরভাগ ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে নয়।
এ অবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষবাদীর কর্তব্য কী? তিনি কি তাকিয়ে থাকবেন জনগণের অভিপ্রায় বোঝার জন্যে? তিনি কি চালিত হবেন তাদের সাময়িক মনোভাবের দ্বারা? নাকি নেতৃত্ব দিয়ে তাদের নিয়ে যাবেন তার বিশ্বাস-অনুযায়ী মঙ্গল ও কল্যাণের পথে? পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বের আবহাওয়ায় যারা সাহস করে বলেছিলেন, এ তত্ত্ব ভুল, অন্তত অপ্রয়োজনীয়, তাদের দৃষ্টান্ত কি পথ দেখাবে না? ১৯৪৮-এ যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তাদের পক্ষে সেদিন জনসমর্থন ছিল না, তবু বিশ্বাস অনুযায়ী তারা অগ্রসর হয়েছিলেন- এ উদাহরণ কি অনুকরণীয় হবে না? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি ব্যর্থ হয়ে যাবে ।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেই রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। ধর্মরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা গোপনে লালন করে যারা আপাতত রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের আশার পথ চেয়ে আছেন। তবে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির পরিণাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা নিশ্চয়ই তাদেরও অজানা নয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই একদিন এদেশের জনপ্রতিনিধিরা চেয়েছিলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত জীবনের বিষয় হয়ে থাক, রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সংস্রব ঘটিয়ে কাজ নেই— তাতে রাষ্ট্র ও ধর্ম দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বোধ যার আছে, তাকেই বলতে হবে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় ফিরে যাবো, যেমন ফিরে গিয়েছি সংসদীয় গণতন্ত্রে ।
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ