একটি যুক্তি আমাকে প্রায়ই মোকাবেলা করতে হয়– ধর্ম ব্যাপারটা যদি এতো ক্ষতিকারক হয় তাহলে সেটা পৃথিবীতে টিকে আছে কীভাবে? শুধু ধার্মিকেরা নয়, এমনকি যারা বিবর্তনে বিশ্বাস করেন তাদের জন্যও ব্যাপারটা অনেকটা ধাঁধার মতো। প্রায়ই এধরণের বাক্য আমরা উচ্চারিত হতে দেখি–

 ‘ধর্মের যদি কোন উপযোগিতাই না থাকে, যদি সেটা নিষ্ফল এবং ক্ষতিকারকই হয়ে থাকে, তবে লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার ছাকনিতে পড়ে সেটা কি বিলুপ্ত হয়ে যাবার কথা ছিল না?

উপরের উক্তিটি এক ধর্মীয় ব্যঙ্গনবিশ (religious satirist) বেকি গ্যারিসনের। তবে গ্যারিসনেরটা আলোচনার জন্য তুলে দিলেও এ ধরণের উক্তি সব জায়গাতেই কমবেশি দেখা যায়। পাওয়া যায় বাংলা ব্লগ সাইটগুলোতেও। এমনকি আমাদের দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও শাহবাগ আন্দোলনের সময় নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী কিছু লেখা লিখেছিলেন, সেখানে তিনি কিছু পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেছিলেন, এবং বলতে চেয়েছেন, ধর্মের উপযোগিতা আছে বলেই সেটা পৃথিবীতে টিকে আছে।

কিন্তু সত্যই কি তাই? আমরা এই প্রবন্ধে প্রদত্ত যুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করব। বলা বাহুল্য, এখানে আমি নতুন কিছু পাঠকদের জন্য শোনাচ্ছি না। বহু বিশ্লেষকই অতীতে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ যুক্তিমালা চ্যালেঞ্জ করেছেন, এর দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেছেন। সেগুলোই মূলত আলোচনায় আনব। যেমন, এ প্রসঙ্গে ক্রেইগ এ জেমসের ‘দ্য রিলিজিয়ন ভাইরাস’ বইটির কথা বলা যায়। বইটির নাস্তিকদের ধাঁধা’ শিরোনামের একটি অধ্যায়ে বেকি গ্যারিসনের যুক্তিগুলো নিয়ে জেমস পুঙ্খানুপুঙ্খা আলোচনা করেছেন। আসলে বেকির এই ধাঁধার উত্তর খুব সহজ। বেকি যে বলেছেন, কোন কিছু ক্ষতিকর মনে হলেই যে সেটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের হাঁকনিতে পড়ে বাতিল বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সেটা ঠিক নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে উলটো। বহু ভাইরাস, প্যারাসাইট প্রকৃতিতে টিকে আছে তারা জীবজগতের জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণিত হবার পরেও। সত্য বলতে কি ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা জীবজগতের সামগ্রিক সংখ্যার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আমাদের দেহেই দেহকোষের চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার বাসা আর কোন কিছু ক্ষতিকারক হলেই যদি সেটা বিলুপ্ত হয়ে যেত, তবে, আমাদের দেহে ক্যান্সারের মতো মরণরোগ বাসা বাঁধতে পারত ন, এইচআইভি ভাইরাস হুমকি হয়ে দাঁড়াতো না। সোয়াইন ফ্লু, সার্স, ম্যাড কাউ সহ হাজারটা অণুজীব নিয়ে আমাদের এখনো প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হতে না। ধর্মও মানব সমাজে প্রোথিত হয়ে আছে, টিকে আছে অনেকটা ভাইরাসের মতোই।

 

ধর্মের উপযোগিতা?

বেকি গ্যারিসনের যুক্তিকে অন্যভাবেও মোকাবেলা করা যেতে পারে, যেটি করেছেন অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স তার বহুল বিক্রিত ঈশ্বর বিভ্রান্তি গ্রন্থে।

ডকিন্স মানব সভ্যতাকে অনেকটা শিশুদের মানসজগতের সাথে তুলনা করেছেন। আমরা জানি ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় বড়দের কথা মেনে চলার, তাদের কথা শোনার। আমার মনে আছে আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম যে কবিতা ‘নার্সারি রাইম হিসেবে মুখস্থ করেছিলাম সেটি ছিল এরকমের–

‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি
 আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে
আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে’।

এই যে ‘গুরুজনেরা যে আদেশ করবেন সেটা ‘ভাল মনে করে যেতে হবে সেটা ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়। এর কারণ আছে। শিশুদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই একটা সময় পর্যন্ত অভিভাবকদের সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলতে হয়। নদীর পাড়ে যায় না, ওখানে কুমির থাকে’, ‘চুলায় হাত দেয় না, হাত পুড়ে যাবে’, ‘না ধুয়ে আপেল খায় না, পেট খারাপ করবে’– বড়দের দেয়া এই ধরনের অভিভাবকদের দেয়া উপদেশাবলি আমরা বংশপরম্পরায় বহন করি– কারণ এ উপদেশগুলো সঠিকভাবে পালন করলে আমরা প্রকৃতিতে সফলভাবে টিকে থাকতে পারি, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। যে শিশুরা অভিভাবকের অবাধ্য হয়ে নদীর পারে গেছে হয়তো কুমীরের খাদ্য হয়েছে, যে শিশু মায়ের উপদেশ না শুনে আগুনে হাত দিয়েছে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে, তারা কোন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রেখে যেতে পারেনি। প্রজন্ম সফলভাবে রক্ষা করতে পেরেছে সে সমস্ত শিশুরাই যারা অভিভাবকদের কথা বিশ্বাস করেছে, তাদের উপদেশের অবাধ্য হয়নি। ফলে বিবর্তনগতভাবে একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে শিশুদের উপর যে অভিভাবকদের কথা, গুরুজনদের উপদেশ, গোত্ৰাধিপতিদের নির্দেশ পালন করতে হবে, নইলে টিকে থাকতে সমস্যা হবে। এখন কথা হচ্ছে– তারাই যখন অসংখ্য ভাল উপদেশের পাশাপাশি আবার কিছু মন্দ অর্থহীন কিংবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপদেশও দেয়– মঙ্গলবারে মন্দিরে পাঁঠাবলি না দিলে অমঙ্গল হবে’, কিংবা গোলাধিপতি যখন বলেন, সূর্যগ্রহণের সময় নামাজে কুসূফ পড়তে হবে, নইলে সূর্য আর আকাশে উঠবে না‘– তখন শিশুর পক্ষে সম্ভব হয় না সেই মন্দ বিশ্বাসকে অন্য দশটা বিশ্বাস কিংবা ভাল উপদেশ থেকে আলাদা করার। সেই মন্দ-বিশ্বাসও বংশপরম্পরায় সে বহন করতে থাকে অবলীলায়। গুরুজনদের উপদেশ বলে কথা! সব বিশ্বাস হয়তো খারাপ কিংবা ক্ষতিকর নয়, কিন্তু অসংখ্য মন্দ বিশ্বাস অনেক সময়ই জন্ম দিতে পারে বিশ্বাসের ভাইরাসের’। তখন গোত্ৰাধিপতিদের কথাকে শিরোধার্য করে তার একনিষ্ঠ অনুগামীরা বিধর্মীদের হত্যা করা শুরু করে, ডাইনি পোড়ানোতে কিংবা সতীদাহে মেতে উঠে, কখনো গণ-আত্মহত্যায় জীবন শেষ করে দেয় কিংবা বিমান নিয়ে সোজা হামলে পড়ে টুইন টাওয়ারের উপর।

ধর্মীয় বিশ্বাসের উদ্ভব নিয়ে আমি এবং রায়হান আবীর ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটিতে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম-। মানব সভ্যতার সূচনা পর্বে ধর্ম ছিল জাদু বিদ্যাকেন্দ্রিক, অনেক নবী পয়গম্বর ছিলেন আসলে জাদুকর। বহুঁকাল আগে, জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের এক গোত্রের কথা চিন্তা করা যাক। গোত্রের সব মানুষের সামনে একজন বুদ্ধিমান পুরোহিত জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দিলেন মুঠোভর্তি কালো গুঁড়ো। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বিস্ফোরণে আগুনের শিখা উপরে উঠে গেল। গোত্রের সাধারণ মানুষদের কাছে ঘটনাটি গণ্য হলো জাদু হিসেবে। এবং এই ‘অতিপ্রাকৃত ঘটনা সবার সামনে ঘটানোর জন্য সামান নিজেকে দাবি করলেন সবার চেয়ে আলাদা একজন, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা যেতে পারে সামানদের দৃষ্টান্তকে। সামান গোত্রভুক্তরা তাদের মনে থাকা অসংখ্য প্রশ্ন ও বিভিন্ন ঘটনা কে ঘটাচ্ছেন এমন প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে দ্বারস্থ হতেন জাদুকর সামানদের কাছে। ইচ্ছা, পেছনে থাকা একজনকে খুঁজে বের করা- যার ইশারায় ঝড় হয়, যার ইশারায় তারা খাবারের সন্ধান পায়, যার ক্রোধে মহামারীতে তাদের অর্ধেকেরও বেশি ধুম করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে আমরা দেখতে পাই, সামানরা নিজেরাও আলাদা কেউ ছিলেন না, তাদের জাদুটাও সত্যিকার অর্থে জাদু নয়, রাসায়নিক বিক্রিয়া। সামানরা নিজেদের ক্ষমতা ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বানিয়ে বানিয়ে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, গোত্রের সবাই মাথা নত করে তার কথা মেনে নিতো। কখনো সূর্য, কখনো দূরে থাকা কোনো পাহাড়কে পূজা করতো।

প্রথমদিকে, মানুষ ছোট ছোট গোত্রে বাস করতো। তখন থেকেই সমঝোতা, ইট-মারলে পাটকেল (tit-for-tat), সততা, সহমর্মিতা, বিনিময়ী পরার্থতা (Reciprocal Altruism) প্রভৃতি মূল্যবোধ প্রায় সবার মধ্যেই ছিল। গরিলা, শিম্পাঞ্জি, নেকড়ে এমন কি মৌমাছি, পিঁপড়ার মতো কিছু সামাজিক প্রাণীর মধ্যেও এই ধরনের কিছু মূল্যবোধের কম- বেশি উপস্থিতির ফলে আমরা নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারি, কোনো ঐশী প্রক্রিয়ায় মূল্যবোধগুলো মানব সমাজে উদ্ভত হয় নি, বরং জৈবিক সামাজিক বিবর্তনের ফলাফল স্বরূপ এগুলো বিবর্তনের ধারাবাহিকতাতেই উদ্ভত হয়েছে মানুষের মধ্যে। পরবর্তীতে সমাজ আরো জটিল হয়েছে। সেই জটিলতা স্পর্শ করেছে নৈতিকতা আর মূল্যবোধগুলোকেও। যেমন, কৃষিকাজের ব্যাপক অগ্রগতির ফলে গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল একসময়, অপরিচিতের সাথে আদান প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হওয়ায় দেখা গেল, আগেকার সেই ছোট গোত্রের মূল্যবোধে ঠিকঠাক কাজ হচ্ছে না। এই কারণে সমাজপতি এবং নেতারা সবাইকে সংঘবদ্ধ রাখার জন্য আরও কিছু নিয়ম-কানুন সমাজে সংযুক্ত করা শুরু করলেন। তারা ভাবলেন, কেউ কিছু বললেই তো আর মানুষ শুনবে না, এই সংশয়ে কেউ কেউ সেই নিয়ম-কানুনগুলোকে ‘ঈশ্বর প্রদত্ত আইন’ বলে প্রচার করলেন। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘবদ্ধ ধর্মের সূচনা তাই কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরঞ্চ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই অঞ্চলগুলোয় কৃষিকাজের দ্রুত উন্নতি তৈরি করেছিল যাজক শ্ৰেণী। সেখানকার রাজারা নিজেদের প্রকাশ করতেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে। খ্রিস্টান রাজারা চার্চের সহায়তার কারণে যেকোনো কাজ করাকে স্বর্গীয় অধিকার বলে মনে করতেন। এধরনের ঘটনা আমরা অন্য অনেক জায়গায়ই দেখি। যেমন, চীনেও একটা সময় রাজাকে মানব সমাজের স্বর্গীয় প্রতিনিধি হিসেবে ভাবা হতো বহুদিন ধরে।

কীভাবে নতুন ধর্ম তৈরি হয়, কীভাবে ধর্মের অনুসারী তৈরি হয়, কীভাবে মানুষ নবী রাসুলকে বিশ্বাস করতে শেখে তা একটা চমৎকার উদাহরণের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন কার্গো কাল্ট (Cargo Cult) নিয়ে গবেষণা করে। কার্গো কাল্ট’ হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলোতে বর্তমান ধর্মবিশ্বাসগুলোর একটি সম্মিলিত নাম- যারা কার্গো জাহাজগুলোকে স্বর্গীয় দূতের পাঠানো সামগ্রী মনে করতো। জাহাজের ইউরোপিয়ান নাবিকেরা কীভাবে রেডিও শোনে, কেন কোনো সারাইয়ের কাজ করতে হয় না, রাতে কী করে আলো জ্বালায়- এ সবই দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা অদ্ভুত বিস্ময়ে দেখত। তাদের কাল্টধান জন ফ্রাম চিরতরে চলে যাবার আগে সেসময় অনেকগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন দ্বিতীয়বারে জাহাজভর্তি সামগ্রী আনবে ও সাদা আমেরিকানদের চিরকালের মতো দ্বীপ থেকে বিতাড়িত করা হবে ইত্যাদি বলে। ঠিক যেমন আপনার পরিচিত বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ যেভাবে অপেক্ষা করে আছে পুনরুত্থিত যিশুখ্রিষ্ট কিংবা ইমাম মাহাদির জন্য, ঠিক তেমনি কার্গো কাল্টের আদিবাসীরাও দীর্ঘ পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে জন কখন আসবে তাদের মুক্তি দিতে।

 

যানজট: ব্যক্তিগত সুবিধা পেতে গিয়ে সমষ্টির ক্ষতি

 বিবর্তনের কথা বললেই একটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমি প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দেই সবাইকে। বিবর্তন কাজ করে একক জিনের উপর, কোন দলের উপর নয়। কাজেই সমষ্টিগতভাবে প্রজাতির কল্যাণের কথা মাথায় রেখে বিবর্তন পরিচালিত হয়নি, কখনো হয় না।

এ ব্যাপারটি জনপ্রিয়ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তুলে ধরার কৃতিত্ব যার, তিনি হচ্ছেন রিচার্ড ডকিন্স। তিনি ১৯৭৬ সালে একটি যুগান্তকারী বই লিখেন ‘সেলফিশ জিন নামে। এটি ছিল রিচার্ড ডকিন্সের প্রথম বই এবং তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর একটি। এই বইয়ের মাধ্যমেই ডকিন্স সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে, বিবর্তন কাজ করে জিনের উপর, একক কোন জীবের উপর নয়। আমাদের দেহ যাই করুক শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত স্বার্থপর’ভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেয়াতেই উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের কোন উদ্দেশ্য যদি থেকে থাকে তবে সেটাই সে উদ্দেশ্য। বইটির নাম ‘সেলফিশ জিন’ হলেও বইটির মূল লক্ষ্য ছিলো ঠিক বিপরীত। জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই ক্রমান্বয়ে কীভাবে উদ্ভব হয় পরার্থিতার মত একটি বিপরীতমুখী অভিব্যক্তির– তা ব্যাখ্যা করাই ছিলো বইয়ের মূল উদ্দেশ্য। ডকিন্স কিন্তু নতুন কিছু লেখেননি, বরং জর্জ উইলিয়ামস এবং উইলিয়াম হ্যামিলটনের কাজগুলোকেই জনপ্রিয় বিজ্ঞানের মোড়কে মলাটবন্দি করেছেন। তথ্যে নতুনত্ব না থাকলেও নিঃসন্দেহে নতুনত্ব আর অভিনবত্ব ছিলো উপস্থাপনায়। উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ ছিলো একেবারেই কাঠখোট্টা একাডেমিক লেভেলে। ডকিন্স তাদের কাজকেই সাধারণ মানুষের দরবারে নিয়ে গেলেন একাডেমিক জাৰ্গন সরিয়ে। আসলে এমনকি একাডেমিক স্তরেও ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে এত ব্যাপকভাবে উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ সম্বন্ধে কারো জানাশোনা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা ছিলো না। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন। পরার্থিতা, আত্মত্যাগের মত যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরো বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারলেন তারা। ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে জীববিজ্ঞানীরা পরার্থিতা এবং আত্মত্যাগকে ব্যাখ্যা করতেন ‘গ্রুপ সিলেকশন’ বা দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, আত্মত্যাগ ব্যাপারটি ব্যক্তির জন্য খারাপ হলেও পুরো দলের জন্য ভালো– এটাই ছিলো আত্মত্যাগের মত প্রবৃত্তিগুলো টিকে থাকার কারণ- এভাবেই ভাবতেন জীববিজ্ঞানীরা। কিন্তু ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটি এসে দাবার ছক একেবারেই উলটে দিলো। ডকিন্স দেখালেন যে, দলের কথা মাথায় রেখে বিবর্তন কখনোই কাজ করে না। আসলে দলগত নির্বাচন ব্যাপারটাই বিবর্তনের পরিভাষা থেকে উঠিয়ে দেয়া উচিৎ। যে ব্যাপারগুলোকে আপাতভাবে দলগত নির্বাচনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার সবগুলোকেই আসলে স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে আরো

অনেক ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ, নির্বাচন হয় জিন লেভেলে, গ্রুপ লেভেলে নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন নিজের জিনকে রক্ষা কিংবা যাদের সাথে জিনের নৈকট্য বেশি থাকে, তাদেরকেই রক্ষার তাগিদ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। আর তা থেকেই ঘটে বৃহৎ স্কেলে পরার্থিতার সুত্রপাত। পিঁপড়া, মৌমাছি,উইপোকা থেকে শুরু করে বানর, শিম্পাঞ্জি কিংবা মানুষ— সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই উদ্ভব ঘটে পরার্থিতার, যা এতদিন ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হতো দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে এ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্যাটার্ন ব্যাখ্যা করার নতুন এক দুয়ার খুলে দিলো ডকিন্সের স্বার্থপর জিন তত্ত্বা স্বার্থপর জিনতত্ত্বই দলগত নির্বাচনকে সার্থক ভাবে প্রতিস্থাপন করলো উইলিয়ামস- হ্যামিলটন-স্মিথের প্রস্তাবিত স্বজাতি নির্বাচন (Kin selection) দিয়ে। আমি ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘ভালবাসা কারে কয়’ বইটিতে এ নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করছিলাম। উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে নিতে পারেন। কিছু গবেষক ধর্ম, নৈতিকতা প্রভৃতির উদ্ভব এবং অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য এখনো দলগত নির্বাচনের সহায় হলেও রিচার্ড ডকিন্স, জেরি কয়েন, স্টিভেন পিঙ্কার, ওয়েস্ট, গ্রিফিন গার্ডেনার প্রমুখ নানাভাবে দেখিয়েছেন যে দলগত নির্বাচনের চেয়ে স্বার্থপর জিনতত্ত্ব এবং স্বজাতি নির্বাচন দিয়েই ব্যাপারগুলোকে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়

বিবর্তন দলগতভাবে কাজ করে না বলেই আমরা জীবজগতে অনেক উদাহরণ দেখতে পাই যেটা ব্যক্তির জন্য উপকার আনলেও সমষ্টিগতভাবে ক্ষতিকর হয়ে যেতে পারে। এটা কেবল জীববিজ্ঞানে নয় আমাদের চারপাশের সামাজিক জীবনেও দৃশ্যমান। রাস্তার যানজট এর একটি ভাল উদাহরণ। সবাই চায় অফিস যাওয়ার সময় রাস্তাঘাট যানজট মুক্ত থাকুক, কিন্তু সবাই অফিসে যাবার সময় নিজের গাড়ি হাঁকিয়ে ঠিক একই সময় বাড়ি থেকে বের হয়, আর রাস্তায় তৈরি করে অসহনীয় যানজটের। ব্যক্তিগত সুবিধা পেতে গিয়ে সমষ্টিগত অসুবিধা তৈরি করার চমৎকার দৃষ্টান্ত এটি।

আমি আমেরিকার আটলান্টার যে প্রান্তে থাকি, সেখান থেকে অফিসে যেতে (খালি রাস্তায় ড্রাইভ করে) বিশ পঁচিশ মিনিট সময় লাগার কথা। কিন্তু প্রতিদিন অফিস আওয়ারে’র সূচনালগ্নে অর্থাৎ সকাল আটটা থেকে নটার মধ্যে অফিস যাওয়ার জন্য হাইওয়ে ৪০০ এ উঠলেই দেখা যায় গাড়ির লম্বা বহর। যানজটে গাড়ি যেন নড়তেই চায় না। বিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে অফিসে পৌঁছুতে অনেক সময় এক ঘণ্টার উপর লেগে যায় আমারা সবাই যদি নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের না হয়ে কেউ কেউ যদি সরকারী বাস কিংবা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতো, তাহলে তাদের অফিসে পৌঁছুতে বিশ মিনিটের জায়গায় হয়তো ত্রিশ চল্লিশ মিনিট সময় লাগতো, কিন্তু দেড় ঘণ্টার সমষ্টিগত যানজটের এই দুর্বিপাক এড়ানো যেত সহজেই। গরীব মানুষেরা কিছুটা করে বটে, কিন্তু যাদের গাড়ি আছে, তারা কেউই তা করে না।

এর পেছনে একটা কারণ আছে। একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, আটলান্টা কমিউনিটি থেকে ঠিক করা হল, একটা সপ্তাহ সবাই বাসে করে অফিসে যাবে। এই ব্যাপারটা ঠিক করার পর প্রথম কয়েকদিনেই যানজট একেবারেই কমে যাবে। সমষ্টিগতভাবে সবার অফিসে যেতে সামান্য দেরি হলেও, কাউকে দেড় ঘণ্টা ধরে রাস্তায় ধুকে ধুকে অফিসে পৌঁছুতে হবে না। কিন্তু এ অবস্থায় শুরু হবে আরেক সমস্যা। দেখা যাবে, কমিউনিটির সুযোগসন্ধানীরা এই ফাঁকা রাস্তার সুযোগ নিতে শুরু করেছে। ধরা যাক আটলান্টা কমিউনিটির মিষ্টার জন দুদিন বাসে করে অফিস যেতে যেতে দেখল— আরে রাস্তা তো ফঁকাই থাকে এখন। আমি বাসে যাওয়ার চেয়ে গাড়ি নিয়ে রওনা হই না কেন। জন এর পরদিন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে সকালে গ্যারেজ থেকে নিজের গাড়ি বের করে সাঁ সাঁ করে চালিয়ে বিশ মিনিটে অফিসে পৌঁছিয়ে গেল। জনের এই সুযোগসন্ধানী কাজ যথারীতি নজরে পড়বে অন্যদেরও। তারাও ঠিক করবে, আমরাই বা এভাবে বাসের জন্য পঁড়িয়ে থেকে, এবং বাসে উঠে পুঁকতে ধুকতে অফিসে যাব কেন। জন যেখানে বিশ মিনিটে অফিসে পৌঁছিয়ে যাচ্ছে, আমাদের চল্লিশ মিনিট ধরে বাসে ঝুলে ঝুলে অফিসে যাওয়ার কোন অর্থ নেই, আমাদের নিজেদের গ্যারেজেও তো গাড়ি আছে। অতএব একে একে সবাই আবার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জনের দেখাদেখি নিজেদের গাড়ি নিয়ে বের হবে, এবং শেষ মেষ তৈরি করবে আবারো সেই আগের মতো অসহনীয় যানজটের। বিশেষত সম্পদ যখন সীমাবদ্ধ থাকে তখন ব্যক্তিগত সুবিধা পেতে গিয়ে সমষ্টির সুবিধাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর ব্যাপারটাকে চলতি ভাষায় বলে ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমনস’। এ ব্যাপারটাকে প্রথম একাডেমিয়ায় তুলে ধরেছিলেন প্রাণীবিজ্ঞানী গ্যারেট হার্ডিন্স ১৯৬৮ সালে একটি গবেষণাপত্রের মাধ্যমে। পরবর্তীতে আরো অনেক গবেষকদের গবেষণাতেই এবং গাণিতিক মডেলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

বহু গবেষকই অভিমত দিয়েছেন ধর্মের ব্যাপারটাও সেরকমের। ধর্ম মানুষকে ব্যক্তিগত সুবিধা দিতে গিয়ে সমাজের সমষ্টির ক্ষতি করে চলেছে অবিরত। অনেকেই ধর্ম পালনের পেছনে কারণ হিসেবে বলেন, তারা ধর্ম পালন করেন, কারণ ঈশ্বরকে ডেকে কিংবা ধর্মের আচার আচরণ পালন করে তারা শান্তি পান। কথাটা হয়তো ঠিকই। ব্যক্তিগতভাবে শান্তি পেলেও, সমষ্টিগতভাবে সেগুলো তৈরি করছে বর্ণবৈষম্য, ধর্মযুদ্ধ, জাতিভেদ, নিম্ন বর্ণের উপর অত্যাচার কিংবা নারীদের অন্তরিন রাখার উপকরণ সহ নানা ধরণের অরাজকতা। বিবর্তন প্রক্রিয়া যেহেতু সমষ্টির উপর কাজ করে না, বরং কাজ করে একক ব্যক্তির জিনের উপর, এ ধরণের ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য তাই বিলুপ্ত না হয়ে টিকে থাকতেই পারে।

 

প্যারাসাইট যখন নিয়ে নেয় জৈবিক প্রক্রিয়ার দখল

 আমরা বইয়ের অনেক জায়গাতেই ল্যাংসেট ফ্লক’ নামের প্যারাসাইটের সাথে পরিচিত হয়েছি। এই প্যারাসাইট যখন পিঁপড়ার মস্তিষ্ক তথা জৈবিক প্রক্রিয়ার দখল নিয়ে নেয়, তখন পিঁপড়া কেবল ঘাসের গা বেয়ে উঠা নামা করতে থাকে। বহুদিন ধরে এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের ধাঁধায় ফেলে রেখেছিল। যখন বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত এই ধাঁধার সমাধান করতে পারলেন, তারা বুঝলেন, পিঁপড়াগুলো আসলে একধরণের মধ্যবর্তী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পিঁপড়াগুলোর মস্তিষ্ককে আসলে ‘হাইজ্যাক করে ফেলেছে ‘ল্যাংসেট ফ্লক’ নামধারী এই প্যারাসাইটগুলো। নিজের বংশবৃদ্ধির জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য পিঁপড়ার মাথাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ল্যাংসেট ফ্লুক।

এরকম আরো একটা উদাহরণের সাথেও আমরা পরিচিত হয়েছি- যেটা কেবল হোস্টের মস্তিষ্কের সংক্রমণ ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয় না, তাকে আত্মহত্যায় বাধ্য করে। নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামের এই ফিতাকৃমি সদৃশ প্যারাসাইট ঘাসফড়িং-এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেললে ঘাসফড়িং পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এখানেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন নিজের প্রজননগত সুবিধা পেতে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম বেচারা ঘাসফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে।

এবারে একটা নতুন উদাহরণ দেখি। ইকনিউমেন (lchneumon) প্রজাতির একধরণের প্যারাসিটোয়েড বোলতা আছে। এদের নিয়ে লিখেছিলাম আমার ভালবাসা কারে কয় বইটিতে। এই বোলতাগুলো শুয়োপোকার মস্তিষ্ককে নয়, তার দেহকে হোস্ট হিসেবে ব্যবহার করে সারা জীবনের খাদ্যের যোগান পেতে। কি ভাবে করে সেটা? তারা হুল ফুটিয়ে শুয়োপোকাকে প্যারালাইজড করে ফেলে এবং সেটার দেহের ভিতরে ডিম পাড়ে। অর্থাৎ, শিকারকে সরাসরি হত্যা না করে দৈহিকভাবে অবশ করে দিয়ে সেই শিকারের দেহকে ব্যবহার করে প্রজন্ম তৈরিতে। এই ডিম ফুটে যে শূককীট বের হয়, তা শিকারের দেহের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খেয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। স্ত্রী বোলতাগুলো তার শিকারের প্রত্যেকটি স্নায়ু গ্রন্থি সতর্কতার সাথে নষ্ট করে দেয় যাতে তাদের শিকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকে।

চিত্রঃ ইকনিউমেন প্রজাতির বোলতা শুয়োপোকাকে হুল ফুটিয়ে দৈহিকভাবে অবশ করে দিয়ে সেই শিকারের দেহের ভেতরে ডিম পাড়ে, আর তার দেহকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে।

প্রকৃতির নিষ্তাঠুরর এই নির্বিচারী উন্মাদনা দেখে সময় সময় বিচলিত হয়েছেন আস্তিক, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, প্রকৃতিবাদী, মানবতাবাদী, সংশয়বাদী– সকলেই। বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স এই ইকনিউমেন প্রজাতির বোলতার উদাহরণটিকে তার গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি রবিন উইলিয়ামসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, এই প্যারাসিটোয়েড বোলতাগুলোর নিষ্ঠুরতা দেখলেই বোঝা যায় যে পরম করুণাময় ঈশ্বরের মতো কোন পরিকল্পনাকারী দ্বারা এই মহাবিশ্ব তৈরি হলে তিনি একজন স্যাডিষ্টিক বাস্টার্ড ছাড়া আর কিছু হবেন না’। এই ঢালাও নিষ্ঠুরতা দেখে এক সময় বিচলিত হয়েছিলেন চার্লস ডারউইনও। তিনি প্যারাসিটোয়েড বোলতাগুলোর বীভৎসতা দেখে মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন

 ‘আমি ভাবতেই পারিনা, একজন পরম করুণাময় এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোন ঈশ্বর এইভাবে ডিজাইন করে তার সৃষ্টি তৈরি করেছেন যে, ইকনিউমেনগুলোর খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য একটি জীবন্ত কিন্তু প্যারালাইজড শুয়োপোকার প্রয়োজন হয়।

কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, সেই ডারউইন থেকে আজকের দিনের রিচার্ড ডকিন্স সহ সকল বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা সবাই জানেন, এ ধরণের প্যারাসাইটিক সংক্রমণগুলো যথাক্রমে পিঁপড়া, ঘাসফড়িং কিংবা শুয়োপোকার জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হবার পরেও প্রকৃতিতে টিকে আছে বিবর্তনের নিয়ম মেনেই। কাজেই কোন কিছু ক্ষতিকর হবার মানে সে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফিল্টারে কাটা পড়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবেই, এই দিব্যি কেউ দিয়ে দেয়নি।

ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও সমাজে টিকে আছে অনেকটা এভাবেই। এ বিশ্বাসগুলো কী ভাবে প্যারাসাইটের মতো মানব মস্তিষ্ককে অধিগ্রহণ করে ফেলে, কী ভাবে তার অনুসারীদের শুয়োপোকার মতোই পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলে, তার হাজারো উদাহরণ আমরা আমাদের চারপাশে তাকালেই দেখতে পাই। প্যারাসাইটিক ধর্মগুলো তার অনুসারীদের কাছ থেকে ইকনিউমেন প্যারাসিটোয়েড বোলতার মতোই যেন সবকিছু শুষে নেয়। দেখা যায় একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারী বান্দারা তাদের আরাধ্য এই প্যারাসাইটিক ধর্মটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বহু কিছুই করে থাকে– দিনে একাধিকবার প্রার্থনা করা, প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও উপাসনালয়ে যোগদান করা, যতদূর সম্ভব ধর্মীয় আইন-কানুন-রীতি-নীতি মেনে চলার চেষ্টা করা, পাশাপাশি অন্য ধর্মের সংক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ঈমান শক্ত করা, বহু টাকা খরচ করে মন্দিরে পশুবলি বা কোরবানি দেয়া, মৃত্যুর আগে মক্কা, মদিনা, কাশী গয়া পুরীর মতো পূণ্যস্থানে ভ্রমণ করা, চারপাশে আর দশজনকেও একই ধারণায় সংক্রমিত করতে চেষ্টা করা ইত্যাদি। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সায়েন্টোলজি, মরমন, জেহোভাস উইটনেস, হরেকৃষ্ণ, ইউনিফিকেশন চার্চ, ভুজ, ইয়াজাদি, অমিসসহ সকল ধর্ম এবং কাল্টই একই কায়দায় তাদের অনুসারীদের মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে।

 

বহির্সংক্রমণ

এই অনুচ্ছেদটা লিখতে গিয়ে এমন এক ঘটনার কথা মনে পড়ছে, যা না বললেই নয়। ১৮৬৯ সালে থমাস অষ্টিন নামে এক ব্যক্তি এমন একটা জিনিস করলেন যা ইতিহাসে এখন পরিচিত হয়ে আছে চরম হঠকারী একটা কাজ হিসেবে। তার সেই কাজের মাশুল হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে এখন প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের স্তন্যপায়ী জীবদের আটভাগের এক ভাগ অস্টিন সাহেবের কাজের কারণে কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদ্ভিদজগত যেভাবে ধ্বংস হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ভুমির অবক্ষয় হয়েছে ভীষণ, জমির উর্বরাশক্তির উপর প্রভাব পড়েছে, প্রভাব পড়েছে জলবায়ুর উপরে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমাহীন। ক্ষতির পরিমাণ এতোই বেশি যে সরকার এমনকি সবটুকু হিসেব করে উঠতেও পারেনি।

তা কী করেছিলেন থমাস অস্টিন? শুনলে খুব নিরীহ ব্যাপার বলে মনে হবে। তিনি তার বন্ধুকে দিয়ে জাহাজে করে বারো জোড়া অর্থাৎ চৰ্বিশটি খরগোশ আনিয়েছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। থমাস সেই চৰ্বিশটি খরগোশ ১৮৫৯ সালের অক্টোবর মাসে খাঁচা খুলে উন্মুক্ত করে দেন।

কেন এ কাজ করলেন অস্টিন? কারণ হচ্ছে, অষ্টিন আগে খুব শিকার করতে পছন্দ করতেন। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন নেবার পর থেকে শিকার করার আনন্দ তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সেই আনন্দধারা আবার নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য এই খরগোশ গুলো এতদূর পাড়ি দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, আর উঠোনে ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ইংল্যান্ডের পুরনো দিনগুলো আবার বুঝি ফিরে আসবে– যে সময়টাতে তিনি মধ্যাহ্নভোজনের আগে বন্দুক নিয়ে বের হয়ে গোটা কয়েক খরগোশ শিকার করে বস্তাবন্দি করে ফিরতেন। সে কথা মনে করে ইংল্যান্ডে তার ভাগ্নেকে চিঠি লিখলেন, ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ায় কিছু খরগোশের চালান আনা যায় কিনা।

সেই আনাই তার কাল হল। অস্ট্রেলিয়ায় এর আগে খরগোশ বলে কিছু ছিল না। ১৮৫৯ সালে মাত্র চব্বিশটা খরগোশ উঠোনে ছেড়ে দেবার পর, ‘Breeding like rabbits’ এর পুরনো উসমাকে সত্য প্রমাণিত করে দশ বছরের মধ্যে সারা অস্ট্রেলিয়া এমনভাবে খরগোশে ছেয়ে গেল যে এখন প্রতি বছর অস্ট্রেলীয় সরকারকে প্রায় বিশ লক্ষ খরগোশ মেরে ফেলতে হয়। খরগোশের জন্য নিত্যনৈমন্তিক ভূমি ক্ষয়, ফসলের ক্ষতি, অন্য প্রজাতির ধংস এগুলো লেগেই আছে। সরকার খরগোশ মারার মিশন নিয়ে নামলেন। গুলি করে করে খরগোশ। মেরে ফায়দা হচ্ছে না দেখে সরকার একসময় কৃত্রিমভাবে খরগোশের প্লেগ তৈরি করলেন। ১৯৫০ সালে সরকারের তরফ থেকে বিধ্বংসী মাইক্সোমা ভাইরাস প্রবিষ্ট করে খরগোশের প্রজাতিতে মহামারী তৈরি করা হল। ১৯৯৬ সালে প্রযুক্ত হল ক্যালসিভাইরাস যেটাকে চলতি ভাষায় বলা হয় ‘Rabbit hemorrhagic disease’। তাতেও কোন লাভ হয়নি। খরগোশের প্রজাতির বিস্তার এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে পরিবেশবিদরা রীতিমত শঙ্কিত। জীবজগতের সামগ্রিক ভারসাম্যই হুমকির মুখে।

অষ্ট্রেলিয়ার খরগোশের উদাহরণটি জীবজগতের হাজারো উদাহরণের একটি– যেখানে ‘এলিয়েন ইনভেশন বা বহিস্থ সংক্রমণের ফলে আঞ্চলিক পরিবেশ প্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে গেছে। এ ধরণের আরো অনেক উদাহরণ আছে। যেমন, ভূমধ্যসাগরীয় ফলের মাছির প্রকোপে হাওয়াই অঞ্চলের শস্যের বড় একটা অংশ বিলীন হয়ে যাওয়া, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় কলার্সা শৈবালের প্রকোপে ভূমধ্যসাগরের পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হওয়া, আমেরিকার হ্রদে রাশিয়ান জেব্রা ঝিনুক আশঙ্কাজনক ভাবে ছড়িয়ে পড়া প্রভৃতির কথা বলা যায়।

বিশ্বাসের ব্যাপারগুলোও তেমনি। যেভাবে সম্পূর্ণ অপরিচিত অঞ্চলে ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্মের বীজ প্রবিষ্ট করিয়ে জনগণকে বিশ্বাসের আওতায় আনা হয়েছে তা বহির্সংক্রমণ ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলামের নবী মুহম্মদ জীবনের শেষ বছরগুলোতে নাখলার যুদ্ধ, বদরের যুদ্ধ, বানু কাইনুকা, বানু নাদির, বানু মুস্তালাক, আহজাব, বানু কোরাইজা, খাইবারের যুদ্ধ করেছিলেন, কিংবা পরবর্তী চার খলিফার নেতৃত্বে ওমান, ইয়েমেন, ইয়ামাহ, সিরিয়া, পারশিয়া, বাসরা, দামাস্কাস জেরুজালেম, মিশর, আজারবাইজান, সাইপ্রাস, বাইজেন্টাইন সিসিলি, কনস্টানটিপোল, উত্তর আফ্রিকা ফ্রান্স এবং স্পেন আক্রমণ করে সে সমস্ত জায়গাকে ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে তা এক ধরণের বহির্সংক্রমণই বলা যায়। ভারতবর্ষেও মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল এভাবেই। এ প্রসঙ্গে গবেষক আবুল কাশেম মুক্তমনায় প্রকাশিত ‘ইসলামে বর্বরতা’ নামক প্রবন্ধে লেখেন

 ‘মোহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধুর দেবাল বন্দর জয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইসলামের শক্ত ও স্থায়ী ভিত্তি রচনা করে। বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ আল-বিরাদুরী লিখেছেন: ‘দেবাল আক্রমণ করে সেখানে তিনদিন ধরে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালানো হয়; মন্দিরের যাজকদের সবাইকে হত্যা করা হয়। কাসিম ১৭ বছরের অধিক বয়সী পুরুষদেরকে তলোয়ারের ডগায় হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস বানায়। দেবালে কত লোককে বন্দি করা হয়েছিল সে সংখ্যা লিখিত হয়নি, তবে ‘চাচনামা থেকে জানা যায়, বন্দিদের মধ্যে ছিল মন্দিরে আশ্রয়গ্রহণকারী ৭০০ রমণীও লুণ্ঠিত মালামাল ও ক্রীতদাসদের মধ্যে খলিফার এক-পঞ্চমাংশের হিস্যায় ছিল পঁচাত্তর জন কুমারী, যাদেরকে হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অবশিষ্টদেরকে কাসিম তার সেনাদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়।

চাচনামা থেকে আরো জানা যায়, রাওয়ারে কাসিমের আক্রমণের সময় প্রায় ৩০,০০০ বন্দিকে ক্রীতদাস বানানো হয়, যাদের মধ্যে ছিল সেনাধ্যক্ষদের কন্যারা ও একজন ছিল রাজা দাহিরের বোনের মেয়ে। বন্দি ও লুণ্ঠিত মালামালের এক-পঞ্চমাংশ হাজ্জাজের নিকট প্রেরণ করা হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ যখন মুসলিম আক্রমণে পতিত হয়, জানায় ‘চাচনামা’: ৮,০০০ থেকে ২৬,০০০ লোককে নিধন করা হয়; এক-পঞ্চমাংশ বন্দিকে আলাদা করে গণনা করা হলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার; অবশিষ্টদেরকে যোদ্ধাদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়। তার অর্থ পঁাড়ায়: এ আক্রমণে প্রায় ১০০,০০০ নারী ও শিশুকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল।

খলিফার হিস্যা হিসেবে একবার প্রেরিত লুণ্ঠন দ্রব্য ও ক্রীতদাসদের মধ্যে ছিল ৩০,০০০ নারী ও শিশু এবং নিহত দাহিরের ছিন্ন মস্তক। সেসব বন্দির মধ্যে ছিল সিন্ধুর বিশিষ্ট মর্যাদাবান পরিবারের কিছু তরুণী কন্যা। হাজ্জাজ লুণ্ঠন দ্রব্য ও ক্রীতদাস বহনকারী বহর দামেস্কে খলিফা আল-ওয়ালিদের নিকট পাঠিয়ে দেন। সে সময়ের খলিফা যখন চিঠিটি পড়েন, লিখেছে চাচনামা: তিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রশংসা করেন। তিনি সেনাধ্যক্ষদের কন্যাদের কিছুকে বিক্রি করে দেন এবং কিছু উপহার হিসেবে প্রদান করেন। তিনি রাজা দাহিরের ভগ্নির কন্যাদেরকে যখন দেখেন, তাদের সৌন্দর্য ও মনোহর রূপে এতই অভিভুত হন যে, হতবাক হয়ে আঙ্গুল কামড়াতে থাকেন।

আল-বিলাদুরী লিখেছেন, মুলতান আক্রমণে বন্দি হওয়া লোকদের মধ্যে মন্দিরের পুরোহিতদের সংখ্যাই ছিল ৬ হাজার। এ সংখ্যাটি আমাদেরকে একটা ধারণা দিতে পারে মুলতান আক্রমণে মোট কত সংখ্যক নারী ও শিশুকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল। কাসিম একই রকমের অভিযান চালিয়েছিল সেহওয়ান ও ধালিলায়। সংক্ষিপ্ত তিন বছরের (৭১২ ১৫) নেহাতই ছোট কৃতিত্বে কাসিম সম্ভবত সর্বমোট তিন লাখের মতো লোককে ক্রীতদাস বানিয়েছিল।

ইসলামের এই আগ্রাসনের মতোই খ্রিস্টধর্মের অনুসারীরাও একই কায়দায় সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের বিশ্বাসের সংক্রমণ ঘটিয়েছিল। মার্টিন লুথারের খ্রিষ্টীয় ভাইরাস ১৫০০ সালের দিকে জার্মানির অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত এবং অজ্ঞ জনগণের মধ্যে সস্তা জনপ্রিয়তা পেয়ে ভাইরাসের মতোই ছড়িয়ে গিয়েছিল। লুথারের এই প্রটেষ্টান্ট ভাইরাস এতোই শক্তিশালী ছিল যে তার সংক্রমণ আগেকার ক্যাথলিক ভাইরাসের সংক্রমণকে পর্যুদস্ত করে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইউরোপের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সংক্রমণ যে সবসময় শান্তিপূর্ণ ছিল তা নয়। সে সময় ত্রিশ বছরের সহিংসতা ইতিহাসের সমস্ত হত্যাযজ্ঞকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৬১৮ সালে লুথারের অনুসারী প্রটেষ্টান্ট নেতারা প্রাগের দুইজন ক্যাথলিক মিশনারিকে জানালা দিয়ে বিল্ডিং এর বাইরে ফেলে দেয়। এর পর থেকে ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টদের মধ্যে সহিংসতা জার্মানি থেকে শুরু করে স্পেন, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফ্রান্স এবং ইতালি সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সুইডেনের প্রটেষ্টান্ট সৈনিকেরা লুথারের ‘Ein ‘Feste Burg (আমাদের ঈশ্বরই আমাদের দুর্গ) ধ্বনি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল। তিন দশক পরে মধ্য ইউরোপ যেন মৃতদেহের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। একটা পরিসংখ্যানে দেখা যায় জার্মানির জনসংখ্যা এই সহিংসতার কারণে ১ কোটি আশি লক্ষ থেকে কমে চল্লিশ লাখে নেমে এসেছিল। ক্যালভিনিষ্ট ভাইরাস ছিল আবার লুথেরান ভাইরাসের মিউটেশন। এরকম আরো অনেক মিউটেশন তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টধর্ম থেকে, তারা সবাই নিজেদের অনুগামীদের সাহায্যে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল একে অপরের সাথে।

অন্যদিকে ভারতবর্ষে একটা সময় আবার হিন্দু ধর্মের মিউটেশনে তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধধর্ম যা খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮০ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮০ শতক পর্যন্ত শীর্ষ ভাইরাস হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল। পরে উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ভাইরাসের দাপটে ভারতবর্ষ থেকে প্রায় বিতাড়িত হতে হয় বৌদ্ধদের। শুধু হিন্দুরাই নয়, পরবর্তীকালে বখতিয়ার খিলজি সহ মুসলিম জিহাদি ভাইরাসের হাতে নালন্দা বিদ্যানিকেতন ধ্বংস হওয়াও বৌদ্ধধর্মের বিলীন হবার পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

 

সিকেল সেল অ্যানিমিয়া: ক্ষতিকর প্রকরণ কীভাবে টিকে থাকে

ওয়াল্টার ক্লেমেন্ট নোয়েল ১৮৮৪ সালে গ্রেনেডা দ্বীপপুঞ্জে জন্মেছিলেন। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এই ব্যক্তি পরিণত বয়সে আমেরিকা চলে আসেন। তিনি যখন আমেরিকা এসেছিলেন, সে সময় কালো মানুষদের নানা ধরণের সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে হত। খুব কমই সুযোগ পেতেন সাদাদের সাথে মিলে একাডেমিয়ায় এবং অন্যত্র একসাথে কাজ করার। কিন্তু নোয়েল ছিলেন সেই বিরল সংখ্যালঘু মানুষদের অন্যতম। নোয়েলের শিক্ষা, কর্মদক্ষতা এবং তার মেধার প্রতিদান হিসেবে শিকাগো কলেজ অব ডেন্টাল সার্জারি’ তে যোগ দিলেন ১৯০৪ সালে।

কিন্তু আমেরিকান বিদ্যায়তনে যোগদানের পর নোয়েল যে খুব সুখে ছিলেন তা নয়। কারণ তার সদা ভঙ্গুর স্বাস্থ্য। তার মাথা ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট সহ একগাদা সমস্যা লেগেই ছিল।

তিনি হাসপাতালে জেমস বি হেনরিক নামে এক নামকরা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা শুরু করেন। তার রক্তের নমুনা পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার সাহেব এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন। তার রক্তকণিকাগুলোর আকার গোলাকার না হয়ে কেমন যেন চিকন কাস্তের মত দেখতে। এই ধরনের ঘটনা ডাক্তারবাবুর জন্য নতুন। এর মধ্যে নোয়েল বেশ কয়েকবারই মাংসপেশির খিচুনি এবং বিলিয়াস অ্যাটাক’-এ ভুগে প্রেসবেটেরিয়ান হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কিন্তু কেন এগুলো হচ্ছে তার খুব একটা কুল কিনারা করতে পারছেন না ডাক্তারেরা।

ওয়াল্টার ক্লেমেন্ট নোয়েল ১৯০৭ সালে ডেন্টাল স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হন, এবং সেন্ট জর্জ সিটিতে প্রফেশনাল দন্ত চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু নোয়েলের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তার জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অবশেষে ১৯১৬ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে নোয়েলকে মারা যেতে হয়। যদিও তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে সেসময় লেখা হয়েছিল ‘আনডিটেকটেড পালমোনারি হাইপারটেনশন’ এখন সবাই জানে, নোয়েল আসলে ছিলেন আমেরিকার প্রথম সিকেল সেল অ্যানিমিয়া রোগী।

সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার ব্যাপারটা আসলে অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের কাছে ‘ধাঁধার মত ছিল। এটা একধরণের ত্রুটিপূর্ণ হিমগ্লোবিনজনিত রোগ, আফ্রিকার ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে টিকে আছে কারণ, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার রোগীরা সুস্থ কোষের চেয়ে একটু বেশি ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সক্ষম। আফ্রিকার যে অঞ্চলগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেসমস্ত জায়গাগুলোতেই সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার রোগী অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। কোন একসময় মিউটেশনের ফলে আফ্রিকাবাসীদের মধ্যে এই বিকৃত রোগের উৎসের জিনটা ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম মেনে দেখা গেলো, যে অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশী সেখানে সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার একটা জিন ধারণকারী লোকের টিকে থাকার ক্ষমতাও বেড়ে যাচ্ছে, কারণ হিমোগ্লোবিনের এই রোগ বহনকারী জিন ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধে বেশী কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে। অন্যদিকে যাদের মধ্যে দু’টিই সুস্থ জিন রয়েছে তারা ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে অনেক বেশী হারে। সেজন্যই প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম মেনে এখানে এই ত্রুটিপূর্ণ জিন বহনকারী মানুষগুলোই শেষ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া রোগের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে বেশীদিন টিকে থাকতে পারছে এবং বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে। এই টিকে থাকার দায়েই শত শত প্রজন্ম পরে দেখা গেলো আফ্রিকাবাসীদের একটা বিশাল অংশের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। বিকৃত সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার জিন। বিবর্তনের মাথায় কিন্তু সিকেল সেল অ্যানিমিয়াকে রক্ষা করার কোন পরিকল্পনা আগে থেকে ছিলো না। এটা স্রেফ টিকে গেছে আফ্রিকায় ম্যালেরিয়ার উপদ্রবের কারণেই। নোয়েল ছিলেন এমনই একজন সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার রোগ বহনকারী। এই রোগ থাকার কারণে তার দেহ আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সক্ষম ছিল, কিন্তু আমেরিকায় এসে অপরিণত বয়সে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

কাজেই জেনেটিক ট্রেইট খারাপ বা ভাল– দুইই হতে পারে। জিনের ‘সারভাইভাল’ বা উদ্বর্তন নির্ভর করে ‘নীট’ বা সামগ্রিক ফলাফলের উপর– কেবল যে কোন এক দিকের ভাল বা খারাপ ফলাফলের উপর নয়। সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার উপযোগিতা পাওয়া যায়। যখন কোন অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বিদ্যমান থাকে। এর ফলে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে হয়তো বাঁচা যায়, কিন্তু সেটা আবার রোগজনিত কষ্টভোগ এবং অকাল প্রয়াণের মাধ্যমে অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যায়। ধর্মের এই টিকে থাকাও অনেকটা সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার মতোই পরিস্থিতি নির্ভর হতে পারে। কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে এক ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে আরেক বিশ্বাসের জন্ম হতে পারে এবং ছড়িয়ে পড়তে পারে দ্রুত গতিতে। এগুলো সমাজে টিকে থাকতে পারে এমনকি এদের ট্রেইট খারাপ প্রমাণিত হবার পরেও।

 

ধর্ম তাহলে কীভাবে টিকে আছে?

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বেকি গ্যারিসনের ‘ধর্ম যদি ক্ষতিকারক হলে টিকে আছে কি করে? এই বিখ্যাত ধাঁধাটির অন্তত পাঁচটি সমাধান দেখতে পাচ্ছি:

 ১) বিবর্তন কাজ করে ব্যক্তির জিনের উপর, সমষ্টির উপরে নয়। ফলে সমষ্টির জন্য আপাত ক্ষতিকারক অনেক বৈশিষ্ট্যই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বাতিল না হয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা দিতে গিয়ে টিকে থাকতে পারে।

২) প্যারাসাইটগুলো মস্তিষ্ক এবং দেহের জৈবিক প্রক্রিয়ার দখল নিয়ে নিতে পারে, যদিও তাদের উদ্ভব হয়তো একটা সময় ঘটেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রয়োজনে।

 ৩) জিন কিংবা মিমের বহির্সংক্রমণ ঘটতে পারে এবং যে কোন সময় আঞ্চলিক পরিবেশের কিংবা মানস-কাঠামোর ধংসসাধন ঘটতে পারে।

 ৪) জিন কিংবা মিমের ভাল কিংবা মন্দ বৈশিষ্ট্য পরিস্থিতিভেদে বিলুপ্ত হতে পারে কিংবা সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার মতো টিকে থাকতে পারে।

এবং সর্বোপরি—

৫) ধর্মীয় বিশ্বাস বিলুপ্ত না হয়ে টিকে থাকে, কারণ এগুলো আসলে ভাইরাস।

ভাইরাসের মতোই এরা দেহকোষ কিংবা মস্তিষ্কের দখল নিতে পারে, এবং পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এক হোস্ট থেকে অন্য হোস্টে। একটি ভাইরাস যখন কোথাও সংক্রমণ ঘটায় তখন যেমন কখনো চিন্তা করে না একটি দেহের জৈব রাসায়নিক উপাদান কত সুষম বা সুন্দর, কিংবা কখনোই ভেবে দেখে না সে মোটা দাগে জীবদেহের, সমাজের কিংবা পরিবেশের ক্ষতি করছে না উপকার, সে কেবল ওটাকে ব্যবহার করে যেতে থাকে। মানব মনে প্রোথিত বিশ্বাসগুলোও তেমনি। যদিও ধর্ম বর্তমান এবং আগামী সভ্যতার জন্য এক ধরণের বোঝা কিংবা অভিশাপের মতো হয়ে উঠেছে, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য ক্ষতিকর হলেও এটা টিকে থাকতে পারে চিরায়ত বিবর্তনের নিয়ম মেনেই। ভাইরাস বা প্যারাসাইটগুলো যেভাবে প্রকৃতিতে টিকে থাকে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x