শ্লোকঃ ২২

এতৈর্বিমুক্ত কৌন্তেয় তমোদ্বাস্ত্রিভির্নরঃ।

আচরত্যাত্মনঃ শ্রেয়স্ততো যাতি পরাং গতিম্ ।। ২২ ।।

এতৈঃ— এই বিমুক্তঃ — মুক্ত হয়ে; কৌন্তেয়— হে কুন্তীপুত্র; তমোঘারৈঃ- তমোময় দ্বার থেকে, ত্রিভিঃ তিন প্রকার; নরঃ- মানুষ; আচরিত – আচরণ করেন; আত্মনঃ— আত্মার; শ্রেয়ঃ— মঙ্গল, ততঃ—’ — অনন্তর যাতি লাভ করেন; পরাম্— পরম গতিম্ গতি ।

গীতার গান

এই তিনে মুক্ত যারা শুন হে কৌন্তেয় ৷

তমোগুণের দ্বার সেই অতিশয় হেয় ।।

তবে সে আচরি ধর্ম নিজ শ্রেয়স্কর ।

পরাগত লাভ করে মম ভক্তি পর ।।

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয় ! এই তিন প্রকার তমোদ্বার থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ আত্মার শ্রেয় আচরণ করেন এবং তার ফলে পরাগতি লাভ করে থাকেন।

তাৎপর্যঃ মানব জীবনের তিনটি শত্রু – কাম, ক্রোধ ও লোভ থেকে সর্বদাই অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। কাম, ক্রোধ ও লোভ থেকে মানুষ যতই মুক্ত হয়, তার জীবন ততই নির্মল হয়। তখন সে বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধি-নিষেধের অনুশীলন করতে সক্ষম হয়। মানব-জীবনের বিধি-নিষেধগুলি অনুশীলন করার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে আত্মজ্ঞান লাভের স্তরে উন্নীত হতে পারে। এই প্রকার অনুশীলনের ফলে কেউ যদি কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে, তা হলে তার সাফল্য অনিবার্য। বৈদিক শাস্ত্রে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সমন্বিত যথাযথ কর্ম আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মানুষকে নির্মল জীবনের স্তরে উন্নীত করবার জন্য। সেই সমগ্র পন্থাটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে কাম, ক্রোধ ও লোভ পরিত্যাগ করার উপর। এই পন্থায় জ্ঞান অনুশীলন করার ফলে আত্ম-উপলব্ধির চরম স্তরে উন্নীত হওয়া যায়। ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে এই আত্ম-উপলব্ধির পূর্ণতা লাভ হয়। এই ভক্তিযোগে বদ্ধ জীবের মুক্তি অনিবার্য। তাই, বৈদিক প্রথায় চারটি বর্ণ ও জীবনের চারটি আশ্রমের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তাকে বলা হয় দৈব-বর্ণাশ্রম ধর্ম। সমাজে বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রমের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধান নির্দিষ্ট হয়েছে এবং কেউ যদি যথাযথভাবে সেগুলি আচরণ করে, তা হলে আপনা থেকেই সে অধ্যাত্ম উপলব্ধির চরম স্তরে উন্নীত হতে পারবে। তখন সে নিঃসন্দেহে মুক্তি লাভ করতে পারবে।

শ্লোকঃ ২৩

যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ ।

ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ।। ২৩ ।।

যঃ— যে; শাস্ত্রবিধিম্—শাস্ত্রবিধি; উৎসৃজ্য—পরিত্যাগ করে; বর্ততে— বর্তমান থাকে, কামকারতঃ– কামাচারে, ন–না; সঃ – সে; সিদ্ধিম্ — সিদ্ধি; অবাপ্নোতি- প্রাপ্ত হয়; ন–না; সুখম্ — সুখ; ন— না: পরাম্ — পরম; গতিম— গতি।

গীতার গান

শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগে কাম আচরণ ।

সিদ্ধিপ্রাপ্তি নহে তাহে সুখ গতিপর ।।

অনুবাদঃ যে শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে কামাচারে বর্তমান থাকে, সে সিদ্ধি, সুখ অথবা পরাগতি লাভ করতে পারে না।

তাৎপর্যঃ পূর্বেই বলা হয়েছে, মানব-সমাজে বিভিন্ন বর্ণের ও আশ্রমের জন্য শাস্ত্রবিধি বা শাস্ত্রীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে এই সমস্ত বিধিগুলি অনুশীলন করা। কেউ যদি সেই নির্দেশগুলি অনুশীলন না করে কাম, ক্রোধ ও লোভের বশবর্তী হয়ে নিজের খেয়ালখুশি মতো জীবন যাপন করতে থাকে, তা হলে সে কখনই সিদ্ধি লাভ করতে পারবে না। পক্ষান্তরে বলা যায়, কোন মানুষ সিদ্ধান্তগতভাবে এই সমস্ত শাস্ত্রনির্দেশ সম্বন্ধে অবগত থাকতে পারে, কিন্তু সে যদি তার নিজের জীবনে সেগুলিকে আচরণ না করে, তা হলে বুঝতে হবে যে, সে একটি নরাধম। মনুষ্য-শরীর প্রাপ্ত জীবের কাছে এটিই প্রত্যাশা করা হয় যে, সে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন জীবনের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য শাস্ত্র-নির্দেশগুলি অনুশীলন করবে। সে যদি তা না করে, তা হলে তার অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী।. কিন্তু সমস্ত বিধি-নিষেধ ও নৈতিক আচার-অনুষ্ঠান করেও সে যদি ভগবৎ-তত্ত্ব উপলব্ধির স্তরে উন্নীত না হয়, তা হলে বুঝতে হবে যে, তার সমস্ত জ্ঞানই ব্যর্থ হয়েছে। আর এমন কি ভগবানের অস্তিত্বকে স্বীকার করেও যদি সে ভগবানের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত না করে, তবে বুঝতে হবে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ। তাই, ধীরে বীরে কৃষ্ণভাবনামৃত ও ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হতে হবে। তখনই কেবল সিদ্ধির সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়। এ ছাড়া আর কোন উপায়েই তা সম্ভব নয়। কামকারতঃ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জ্ঞাতসারে মানুষ শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে কাম আচরণ করে। সেই আচরণগুলি নিষিদ্ধ জেনেও যদি তা আচরণ করা হয়, তাকে বলা হয় খেয়ালখুশি মতো আচরণ করা। সে জানে যে, সেগুলি অনুশীলন করা উচিত, কিন্তু তবুও সে তা করে না, তাই তাকে বলা হয় খামখেয়ালী। এই সমস্ত মানুষদের পরিণতি হচ্ছে যে, তারা ভগবানের দ্বারা দণ্ডিত হয়। জীবনের সে চরম সিদ্ধি, তা তারা কখনই লাভ করতে পারে না। মানব-জীবনের বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনকে পবিত্র করা এবং যারা শাস্ত্রবিধির অনুশীলন করে না, আচরণ করে না, তারা কখনই পবিত্র হতে পারে না এবং তারা যথার্থ শান্তি লাভ করতে পারে না।

শ্লোকঃ ২৪

তস্মাচ্ছাস্ত্রং প্রমাণং তে কাৰ্যকাৰ্যব্যবস্থিতৌ ।

জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি ৷৷ ২৪ ॥

তস্মাৎ— অতএব, শাস্ত্রম্ শাস্ত্র, প্রমাণম্ — প্রমাণ, তে– তোমার, কার্য কর্তব্য: অকার্য— অকর্তব্য; ব্যবস্থিতৌ — নির্ধারণে; জ্ঞাত্বা – জেনে, শাস্ত্র— শাস্ত্রের বিধান— বিধান; উক্তম্—কথিত হয়েছে; কর্ম— কর্ম; কর্তম— করতে; ইং— এই অসি।

গীতার গান

অতএব শাস্ত্রবিধি কার্যের প্রমাণ।

জানি শাস্ত্রবিধি কর কার্য সমাধান ।।

অনুবাদঃ অতএব, কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। অতএব শাস্ত্রীয় বিধানে কথিত হয়েছে যে কর্ম, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও।

তাৎপর্যঃ পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সমস্ত বৈদিক বিধি ও নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা। কেউ যদি ভগবদ্‌গীতার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরে কৃষ্ণভাবনার অমৃতময় স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হন, তখন তিনি বৈদিক শাস্ত্র প্রদত্ত জ্ঞানের চরম সিন্ধির স্তরে উপনীত হয়েছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই পন্থাকে অত্যন্ত সরল করে দিয়ে গেছেন। তিনি মানুষকে কেবল হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে -এই মহামন্ত্র কীর্তন করতে, ভক্তিযুক্ত ভগবৎ সেবায় নিযুক্ত হতে এবং ভগবৎ হরে প্রসাদ গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। যিনি এভাবেই ভক্তিমূলক কর্মধারায় প্রত্যক্ষভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন, তিনি সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রাদি অনুশীলন করেছেন বলেই বুঝাতে হবে। তিনি সঠিকভাবে বৈদিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। অবশ্যই, যারা কৃষ্ণভাবনার অমৃতময় স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবানের সেবায় যুক্ত হতে পারেনি, তাদের পক্ষে বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে কর্তব্য-অকর্তব্য বিচার করে কর্ম করা উচিত। কোন রকম কুতর্ক না করে বৈদিক নির্দেশ অনুসারে কর্ম করে যাওয়া উচিত। তাকেই বলা হয় শাস্ত্রবিধির আচরণ করা। শাস্ত্র হচ্ছে চারটি ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং বদ্ধ জীবের যে চারটি ত্রুটি আছে, সেগুলি হচ্ছে ভ্রম প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব (ভুল করার প্রবণতা, মোহগ্রস্ত হওয়া, প্রবঞ্চনা করার প্রকাতা ও অপূর্ণ ইন্দ্রিয়াদি)। এই চারটি প্রধান ত্রুটি থাকার জন্য বদ্ধ জীব বিধিনিয়ম রচনার অযোগ্য। সেই কারণেই শাস্ত্রোক্ত বিধিনিয়মগুলি এই চারটি ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত বলে সমস্ত মহামুনি, ঋষি, আচার্য ও মহাত্মাগণ শাস্ত্রের নির্দেশগুলিকে কোনও রকম পরিবর্তন না করে গ্রহণ করেছেন।

ভারতবর্ষে অনেক আধ্যাত্মিক সম্প্রদায় রয়েছে, যেগুলি সাধারণত দুভাগে বিভক্ত—নির্বিশেষবাদী ও সবিশেষবাদী। তাঁরা উভয়েই অবশ্য বৈদিক নির্দেশ অনুসারেই জীবন যাপন করেন। শাস্ত্রনির্দেশ অনুশীলন না করে কখনই সিদ্ধি লাভ করা যায় না। তাই, যিনি যথার্থভাবে শাস্ত্রের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনিই ভাগ্যবান।

পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করার পন্থা অবলম্বন না করার ফলেই মানব-সমাজে অধঃপতন দেখা দেয়। মানব-জীবনে সেটিই হচ্ছে সবচেয়ে গর্হিত অপরাধ। তাই, ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি মায়া সর্বদাই আমাদের ত্রিতাপ দুঃখ দিয়ে চলেছে। এই বহিরঙ্গা শক্তি জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণের দ্বারা গঠিত। পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করতে হলে অন্তত সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হতে হবে। সত্ত্বগুণের স্তরে উন্নীত হতে না পারলে মানুষ রজ ও তমোগুণের স্তরে থেকে যায়, যা আসুরিক জীবনের কারণ। যারা রজ ও তমোগুণে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তারা শাস্ত্রকে অবজ্ঞা করে, সাধুদের অবজ্ঞা করে এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতেও অবজ্ঞা করে। তারা সদ্‌গুরুকে অমান্য করে এবং তারা শাস্ত্র-নির্দেশের কোন রকম পরোয়া করে না। ভগবদ্ভক্তির মাহাত্ম্য শ্রবণ করা সত্ত্বেও তারা তার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। এভাবেই তারা নিজেদের মনগড়া উন্নতির পন্থা আবিষ্কার করে। এগুলি মানব-সমাজের কতকগুলি ত্রুটি, যা মানুষকে আসুরিক জীবনের পথে পরিচালিত করে। কিন্তু সে যদি সদৃশুরুর দ্বারা পরিচালিত হয়ে যথার্থ মঙ্গলের পথ অবলম্বন করে যথার্থ উন্নতির স্তরে উন্নীত হতে পারে, তা হলেই তার জীবন সার্থক হয়।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।

শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ॥

ইতি—দৈব ও আসুরিক প্রকৃতিগুলির পরিচয় বিষয়ক দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদগীতার ষোড়শ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

error: Content is protected !!