শ্লোকঃ ১৯

তানহং দ্বিষতঃ ক্রুরান্ সংসারেষু নরাধমান্ ।

ক্ষিপাম্যজাস্রমশুভানাসুরীষেব যোনিষু ।। ১৯ ।।

তাই তাদের, অহম্ — আমি; দ্বিষতঃ – বিদ্বেষী, ক্রূরান্—ক্রুর; সংসারেষু — ভবসমুদ্রে; নরাধমান— নরাধমদের; ক্ষিপামি— নিক্ষেপ করি; অজস্রম্ — অনবরত; অশুভান্—অগুভ; আসুরী— আসুরী; এব— অবশ্যই; যোনিয়ু – যোনিতে।

গীতার গান

সেই সে বিদ্বেষী ক্রুর নরাধমগণে ।

নিত্য সে ক্ষেপণ করি সংসার গহনে ॥

অনুবাদঃ সেই বিদ্বেষী, ক্রূর ও নরাধমদের আমি এই সংসারেই অণ্ডড আসুরী যোনিতে অবিরত নিক্ষেপ করি।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরমেশ্বরের ইচ্ছার প্রভাবেই জীবাত্মা কোন বিশেষ শরীর প্রাপ্ত হয়। আসুরিক মানুষেরা ভগবানের পরমেশ্বরত্ব অস্বীকার করে যথেচ্ছাচার করতে পারে। কিন্তু তাদের পরবর্তী জীবন নির্ধারিত হবে পরম পুরুষোত্তম ভগবানেরই ইচ্ছা অনুসারে—তাদের নিজের ইচ্ছা অনুসারে নয়। শ্রীমদ্ভাগবতে তৃতীয় স্কন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মৃত্যুর পরে জীবাত্মা কোন বিশেষ শরীর প্রাপ্ত হওয়ার জন্য উচ্চতর শক্তির তত্ত্বাবধানে মাতৃজঠরে স্থাপিত হয়। তাই জড় জগতে আমরা পশু, পাখি, কীট, পতঙ্গ, মানুষ আদি নানা রকমের প্রজাতির প্রকাশ দেখতে পাই। এদের প্রকাশ হয়েছে উচ্চতর শক্তির প্রভাবে। ঘটনাচক্রে এদের উদ্ভব হয়নি। অসুরদের সম্বন্ধে এখানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, তারা বারবার অসুরযোনি প্রাপ্ত হয় এবং এভাবেই তারা চিরকাল ঈর্ষাপরায়ণ নরাধমরূপে থাকে। এই ধরনের আসুরিক জীবন সর্বদাই কামার্ত, সর্বদাই অত্যাচারী ও কুৎসিত এবং সর্বদাই অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তারা ঠিক জঙ্গলের শিকারীদের মতো আসুরিক প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।

শ্লোকঃ ২০

আসুরীং যোনিমাপন্না মূঢ়া জন্মনি জন্মনি ৷

মামপ্রাপ্যৈব কৌন্তেয় ততো যান্ত্যধমাং গতিম্ ॥ ২০ ॥

আসুরী— আসুরী, মোনিম্— যোনি, আপন্নাঃ — লাভ করে; মুঢ়া:— সেই মূঢ়গণ, জন্মনি জন্মনি— জন্মে জন্মে, মাম্ আমাকে, অপ্রাপ্য — না পেয়ে; এর – অবশ্যই: কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র, ততঃ– তার থেকে, মাস্তি প্রাপ্ত হয়; অধমাম্ অধম, গতিম্ — গতি ।

গীতার গান

অসুর যোনিতে হয় জনম মরণ ।

অজস্র অশুভ তার জীবন যাপন ।।

অসুরের ঘরে মূঢ় জনমে জনমে ৷

আমাকে ভুলিয়া দুঃখী মরমে মরমে ৷।

ক্রমে ক্রমে পায় সেই অধমা যে গতি

অক্ষম আমাকে পেতে যেহেতু কুমতি ।।

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয় ! জন্মে জন্মে অসুরযোনি প্রাপ্ত হয়ে, সেই মূঢ় ব্যক্তিরা আমাকে লাভ করতে অক্ষম হয়ে তার থেকেও অধম গতি প্রাপ্ত হয়।

তাৎপর্যঃ সকলেই জানে যে, ভগবান হচ্ছেন পরম করুণাময়। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভগবান অসুরদের প্রতি কখনই করুণাময় নন। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা জন্ম-জন্মান্তরে অসুরযোনি প্রাপ্ত হয় এবং পরমেশ্বর ভগবানের কৃপা থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা ক্রমান্বয়ে অধঃপতিত হতে হতে অবশেষে কুকুর, বেড়াল ও শূকরের শরীর প্রাপ্ত হয়। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই ধরনের অসুরদের পরবর্তী কোন জীবনেই ভগবানের কৃপা লাভ করার কিছুমাত্র সম্ভাবনা থাকে না। বেদেও বলা হয়েছে যে, এই ধরনের মানুষেরা ক্রমান্বয়ে নিমজ্জিত হতে হতে অবশেষে কুকুর ও শূকরের শরীর প্রাপ্ত হয়। এখন এই সম্বন্ধে বিতর্কের উত্থাপন করে কেউ বলতে পারে যে, ভগবান যদি এই সমস্ত অসুরদের প্রতি কৃপা পরায়ণ না হন, তা হলে তাঁকে কৃপাময় বলে জাহির করা উচিত নয়। এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, বেদান্তসূত্রে উল্লেখ আছে, পরমেশ্বর ভগবান কাউকেই ঘৃণা করেন না। অসুরদের যে সবচেয়ে অধঃপতিত জীবন দান করেন, তাও তাঁর কৃপারই এক রকম প্রকাশ। কখা কখন অসুরেরা পরমেশ্বর ভগবানের হাতে নিহত হয়, কিন্তু এভাবেই ভগবানের হাতে নিহত হওয়াও তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক। কারণ, বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, ভগবানের হাতে মৃত্যু হলে তৎক্ষণাৎ মুক্তি লাভ হয়। ইতিহাসে রাবণ, কংস, হিরণ্যকশিপু আদি বহু অসুরের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তাদের হত্যা করবার জন্য ভগবান নানারূপে অবতরণ করেছেন। সুতরাং, ভগবানের কৃপা অসুরদের উপরেও বর্ধিত হয় যদি তারা ভগবানের হাতে নিহত হবার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে।

শ্লোকঃ ২১

ত্রিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ ।

কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতন্ত্রয়ং ত্যজেৎ ।। ২১ ।।

ত্রিবিধম্ — তিনটি; নরকস্যা — নরকের; ইদম্—এই; দ্বারম্—দ্বার; নাশনম্ নাশকারী, আত্মনঃ— আত্মার, কামঃ – কাম, ক্রোধঃ – ক্রোধ, তথা- ও লোভঃ— লোভ; তস্মাৎ— অতএব, এতং – এই; ত্রয়ম্— তিনটি; ত্যজেৎ— পরিত্যাগ করবে।

গীতার গান

সেই কাম, ক্রোধ, লোভ, নরকের দ্বার ।

ত্যজ তাহা নয় তিন সাধু ব্যবহার ।।

অনুবাদঃ কাম, ক্রোধ ও লোভ—এই তিনটি নরকের দ্বার, অতএব ঐ তিনটি পরিত্যাগ করবে।

তাৎপর্যঃ এখানে আসুরিক জীবনের কিভাবে শুরু হয়, তার বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ কাম উপভোগ করবার চেষ্টা করে এবং তার অতৃপ্তিতে তার চিত্তে ক্রোধ ও লোভের উদয় হয়। সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন যে মানুষ আসুরিক জীবনে অপতিত হতে না চায়, তাকে অবশ্যই এই তিনটি শত্রুর সঙ্গ বর্জন করতে হবে। এই তিনটি শত্রু আত্মাকে এমনভাবে হত্যা করে, যার ফলে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আর কোন সম্ভাবনাই থাকে না।

error: Content is protected !!