শ্লোকঃ ১৩-১৬

ইদমদ্য ময়া লব্ধমিমং প্রাপ্স্যে মনোরথম ।

ইদমস্ত্রীদমপি যে ভবিষ্যতি পুনৰ্ধনম্ ।। ১৩।।

অসৌ ময়া হতঃ শত্ৰুহনিষ্যে চাপরানপি ।

ঈশ্বরোঽহমহং ভোগী সিদ্ধোহহং বলবান্ সুখী ।। ১৪ ।।

আঢ্যোহভিজনবানম্মি কোহন্যোঽস্তি সদৃশো ময়া ৷

যক্ষ্যে দাস্যামি মোদিষ্য ইত্যজ্ঞানবিমোহিতাঃ ।। ১৫ ।।

অনেক চিত্তবিভ্রান্তা মোহজালসমাবৃতাঃ ।

প্রসক্তাঃ কামভোগেষু পতন্তি নরকেঽশুচৌ ।। ১৬ ।।

ইদম্—এই; অদ্য—আজ; ময়া – আমার দ্বারা; লব্ধম্—লাভ হয়েছে; ইমম্—এই প্রান্স্যে—লাভ করব, মনোরথম্ — আমার মনোভীষ্ট অনুসারে, ইদম্—এই; অস্তি- আছে; ইদম্—এই; অপি–ও; মে— আমার; ভবিষ্যতি হবে; পুনঃপুনরায়: ধনম্—সম্পদ; অসৌ—ঐ; ময়া – আমার দ্বারা; হতঃ– নিহত হয়েছে; শত্রুঃ- শত্রু; হনিষ্যে—আমি হত্যা করব, চ–ও; অপরান্ – অন্যদের; অপি—অবশ্যই; ঈশ্বরঃ—প্রভু; অহম্ – আমি; অহম্ – আমি; ভোগী — ভোক্তা; সিদ্ধ: – সিদ্ধ: অহম্—আমি; বলবান্—শক্তিশালী; সুখী সুখী; আঢ্যঃ ধনবান, অভিজনবান্ অভিজাত আত্মীয়স্বজন পরিবৃত; অস্মি— হই; কঃ – কে; অন্যঃ – অন্য; অস্তি- আছে; সদৃশঃ—মতো; ময়া – আমার; যক্ষ্যে — যজ্ঞ করব, দাস্যামি-দান করব: মোদিব্যে—আনন্দ করব; ইতি—এভাবে; অজ্ঞান — অজ্ঞান দ্বারা, বিমোহিতাঃ- বিমোহিত হয়; অনেক—বহু প্রকার; চিত্তবিভ্রান্তাঃ —দুশ্চিন্তার দ্বারা বিভ্রান্ত হবো, মোহ—মোহ; জাল—জালের দ্বারা; সমাবৃতাঃ —বিজড়িত হয়ে; প্রসত্তাঃ আग চিত্ত সেই ব্যক্তিরা; কাম কাম; ভোগেষু – ভোগে; পতন্তি — পতিত হয়, ন নরকে: অশুচৌ—অশুচি।

গীতার গান

অদ্য এই অর্থলাভ মনোরথ সিদ্ধি ৷

পুনর্বার ভবিষ্যতে হবে অর্থ বৃদ্ধি ।।

সে শত্রু মরিল অন্য নিশ্চয় মারিব ।

আমি সে ঈশ্বর ধনী সে কার্য সাধিব ।।

আমি ভোগী সিদ্ধ আর বলবান সুখী ।

মম সম কেহ নহে আর সব দুঃখী ।।

আমি অভিজনবান আমি ধনআঢ্য ।

আমার সমান হবে কার কিবা সাধ্য ।।

আমি সে করিব যন্ত্র আমি দান দিব ।

স্ত্রীসঙ্গ করিয়া আমি আনন্দ পাইব ।।

অজ্ঞান মোহিত হয়ে কত কথা বলে ।

মোহজাল সমাবৃত কালের কবলে ।।

আসলেতে কামাসক্ত নরকের যাত্রী ।

অশুচি নরকে বাস নরক বিধাত্ব ।।

অনুবাদঃ অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা মনে করে— “আজ আমার দ্বারা এত লাভ হয়েছে এবং আমার পরিকল্পনা অনুসারে আরও লাভ হবে। এখন আমার এত ধন আছে এবং ভবিষ্যতে আরও ধন লাভ হবে। ঐ শত্রু আমার দ্বারা নিহত হয়েছে এবং অন্যান্য শত্রুদেরও আমি হত্যা করব। আমিই ঈশ্বর, আমি ভোক্তা। আমিই সিদ্ধ, বলবান ও সুখী। আমি সবচেয়ে ধনবান এবং অভিজাত আত্মীয়স্বজন পরিবৃত। আমার মতো আর কেউ নেই। আমি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করব, দান করব এবং আনন্দ করব। ” এভাবেই অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা অজ্ঞানের দ্বারা বিমোহিত হয়। নানা প্রকার দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে এবং মোহজালে বিজড়িত হয়ে কামভোগে আসক্তচিত্ত সেই ব্যক্তিরা অশুচি নরকে পতিত হয়।

তাৎপর্যঃ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষদের ধন-সম্পদ আহরণ করার বাসনার কোন অন্ত নেই। তা অসীম। তারা কেবল চিন্তা করে কি পরিমাণ অর্থ তার এখন আছে এবং সেই অর্থকে আরও বাড়াবার জন্য নানা রকম বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে। সেই উদ্দেশ্যে যে কোন রকম পাপকর্ম করতে তারা দ্বিধা করে না এবং তাই তারা কালোবাজারী আদি অবৈধ কাজকর্মে লিপ্ত হয়। তারা তাদের সঞ্চিত অর্থ, গৃহ, জায়গা-জমি, পরিবার আদি সমস্ত সম্পদের দ্বারা মুগ্ধ হয়ে থাকে এবং তারা সর্বদাই পরিকল্পনা করে কিভাবে সেগুলির আরও উন্নতি সাধন করা যায়। তারা তাদের নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের উপরে আস্থাযান এবং তারা জানে না যে, যা কিছু তারা লাভ করছে, তা সবই তাদের পূর্বকৃত পুণ্যকর্মেরই ফল মাত্র। এই ধরনের সমস্ত ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ তারা পায়। কিন্তু তার কারণ যে তাদের পূর্বকৃত কর্ম, সেই সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। তারা মনে করে যে, তাদের সঞ্চিত ঐশ্বর্য তারা তাদের বাক্তিগত প্রচেষ্টার ফলেই আহরণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষ তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার উপর আস্থাবান। তারা কর্মফলে বিশ্বাস করে না। মানুষ তার পূর্বকৃত কর্মের ফলে উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করে অথবা ধনবান হয়, অথবা উচ্চ শিক্ষিত হয় কিংবা রূপবান হয়। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষ মনে করে যে, সমস্তই ঘটনাচক্রে এবং তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফলে ঘটে। চলেছে। বিভিন্ন রকমের মানুষের রূপ, গুণ, শিক্ষা আদির পেছনে যে এক অতি সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রয়েছে, তা তারা অনুভব করতে পারে না। কেউ যদি এই সমস্ত আসুরিক মানুষদের প্রতিযোগী হয়, তা হলে তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হয়। আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষ অসংখ্য এবং তারা সকলেই একে অপরের শত্রু। এই শত্রুতা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে—প্রথমে ব্যক্তিগত, তারপর পরিবারে পরিবারে, তারপর সমাজে, অবশেষে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর রাষ্ট্রের। তাই, জগং জুড়ে সর্বদাই বিবাদ, যুদ্ধ ও শত্রুতা লেগেই রয়েছে।

প্রতিটি আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষই মনে করে যে, অন্য সকলকে বলি দিয়ে সে বেঁচে থাকতে পারে। সাধারণত আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা নিজেদের পরমেশ্বর ভগবান বলে মনে করে এবং আসুরিক প্রচারকেরা তাদের অনুগামীদের বলে— “তোমরা ভগবানকে খুঁজছ কেন? তোমরা সকলেই ভগবন! তোমাদের যা ইচ্ছা, তাই তোমরা করতে পার। ভগবানকে বিশ্বাস করো না। ভগবানকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। ভগবান মরে গেছে।” এগুলি হচ্ছে আসুরিক প্রচার।

আসুরিক মানুষ যদিও দেখতে পায় যে, অন্যেরা তারই মতো বা তার থেকে অধিক বিত্তবান বা ক্ষমতাবান, তবুও সে মনে করে যে, কেউই তার থেকে অধিক ধনবান বা ক্ষমতাসম্পন্ন নয়। উচ্চতর গ্রহলোকে যাবার জন্য যজ্ঞ করার যে প্রয়োজন, তা তারা বিশ্বাস করে না। অসুরেরা মনে করে যে, তারা তাদের নিজেদের মনগড়া যজ্ঞবিধি তৈরি করবে এবং কোন রকম যন্ত্র আবিষ্কার করবে, যার দ্বারা তারা যে কোন উচ্চতর গ্রহলোকে যেতে পারবে। এই ধরনের অসুরদের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হচ্ছে রাবণ। সে তার অনুগত জনদের বুঝিয়ে ছিল যে, স্বর্গে যাওয়ার জন্য তাদের সে একটি সিঁড়ি তৈরি করে দেবে—যাতে কোন রকম বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠান না করেই যে কেউ তাতে চড়ে স্বর্গলোকে যেতে পারবে। তেমনই, আধুনিক যুগের আসুরিক মানুষেরা যান্ত্রিক উপায়ে উচ্চতর লোকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এগুলি হচ্ছে ভ্রান্তির নিদর্শন। তার ফলে তারা তাদের অজান্তেই নরকের দিকে অধঃপতিত হচ্ছে। এখানে মোহজাল কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জালে যেমন মাছ ধরা হয়, এই মোহরূপ জালে জীবেরা তেমন আবদ্ধ হয়ে আছে এবং তার থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই ।

শ্লোকঃ ১৭

আত্মসম্ভাবিতাঃ স্তব্ধা ধনমানমদান্বিতাঃ ।

যজন্তে নামযজ্ঞৈস্তে দন্তেনাবিধিপূর্বকম্ ।। ১৭ ।।

আত্মসম্ভাবিতাঃ— আত্মাভিমানী; স্তব্ধাঃ — অনম্র; ধনমান— ধন ও মানে; মদান্বিতাঃ — মদমত্ত, যজন্তে— যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে, নাম — নামমাত্র, যজ্ঞৈঃ— যজ্ঞের দ্বারা, তে—তারা; দন্তেন— দত্ত সহকারে; অবিধিপূর্বকম্ — শাস্ত্রবিধি অনুসরণ না করে।

গীতার গান

আত্ম-সম্ভাবিত মান ধনেতে অনম্ৰ ৷

মদান্বিত অসুর সে সর্বদা বিনম্ৰ ৷।

নামমাত্র যজ্ঞ করে শাস্ত্রে বিধি নাই ।

দস্তুমাত্র আছে সার কেবল বড়াই ।।

অনুবাদঃ সেই আত্মাভিমানী, অনস এবং ধন ও মানে মদান্বিত ব্যক্তিরা অবিধিপূর্বক দত্ত সহকারে নামমাত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে।

তাৎপর্যঃ নিজেদের সর্বেসর্বা বলে মনে করে এবং কোন রকম অধ্যক্ষতা অথবা প্রামাণ্য শাস্ত্রের পরোয়া না করে অসুরেরা তথাকথিত ধর্মানুষ্ঠান বা যজ্ঞবিধির অনুষ্ঠান করে থাকে। যেহেতু তারা নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক সূত্র রিশ্বাস করে না, তাই তারা অত্যন্ত উদ্ধত। তার কারণ হচ্ছে সঞ্চিত ধন-সম্পদ ও অহঙ্কারে মত্ত হয়ে তারা মোহাচ্ছ। কখনও কখনও এই ধরনের অসুরেরা ধর্মপ্রচারক সেজে জনসাধারণকে বিপথগামী করে এবং ধর্ম সংস্কারক বা ভগবানের অবতার রূপে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করে। তারা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ভান করে, অথবা দেব-দেবীর পূজা করে, অথবা নিজেদের মনগড়া ভগবান তৈরি করে। সাধারণ লোক তাদের ভগবান বলে মনে করে তাদের পূজা করে। মূর্খ লোকেরা তাদের ধর্মজ্ঞ বা দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন বলে মনে করে। তারা সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে সব রকম অপকর্মে লিপ্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে যাঁরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, তাদের প্রতি নানা রকম বিধি-নিষেধের নির্দেশ রয়েছে। অসুরেরা কিন্তু এই সমস্ত বিধি-নিষেধের ধার ধারে না। তাদের মতে কোন নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করার দরকার নেই। যার যার নিজের মত অনুযায়ী এক-একটি পথ বার করে নিলে চলে। অবিধিপূর্বকম্ অর্থাৎ কোন বিধি-নিষেধের পরোয়া না করা কথাটির উপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। অজ্ঞতা ও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলেই এগুলি হয় ।

শ্লোকঃ ১৮

অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং চ সংশ্রিতাঃ ।

মামাত্মপরদেহেষু প্রদ্বিষন্তোহভ্যসূয়কাঃ ॥ ১৮ ॥

অহঙ্কারম্— অহঙ্কার; বলম্বল, দর্প— দর্প; কামম্ — কাম, ক্রোধম্— ক্রোধকে; চ—ও: সংশ্রিতাঃ— আশ্রয় করে, মাম্ আমাকে; আত্ম— স্বীয়; পর– অন্যের; দেহে— দেহে অবস্থিত; প্রদ্বিযন্তঃ — বিদ্বেষ করে, অভ্যসূয়কাঃ— সাধুদের গুণেতে দোষারোপ করে।

গীতার গান

অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধাশ্রয় ৷

আমার সম্পর্কে দেহে দ্বেষ সে করয় ।।

অসূয়ার বশে চিন্তা স্বপর অপরে ।

সাধুর গুণেতে দোষ কিংবা নিন্দা করে ।।

অনুবাদঃ অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধকে আশ্রয় করে অসুরেরা স্বীয় দেহে ও পরদেহে অবস্থিত পরমেশ্বর স্বরূপ আমাকে দ্বেষ করে এবং সাধুদের গুণেতে দোষারোপ করে।

তাৎপর্যঃ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা সর্বদাই ভগবানের মহত্ত্বের বিরোধিতা করে এবং তাই তারা শাস্ত্রের নির্দেশ বিশ্বাস করতে চায় না। তারা শাস্ত্র ও পরম পুরুষোত্তম ভগবান, উভয়েরই প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। তাদের তথাকথিত জড় প্রতিষ্ঠা, তাদের সঞ্চিত সম্পদ, তাদের শক্তিসামর্থ্য, এগুলিই হচ্ছে তাদের এই মনোভাবের কারণ। তারা জানে না যে, তাদের এই জীবনটি হচ্ছে তাদের পরবর্তী জীবনকে গড়ে তোলার একটি মহান সুযোগ। সেটি না জেনে তারা অন্য সকলের প্রতি এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের নিজেরও প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়। সে অপরের শরীরের প্রতি হিংস্র আচরণ করে এবং তাদের নিজের শরীরেও হিংস আচরণ করে। তারা পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানের পরোয়া করে না, কারণ তাদের কোন জ্ঞানই নেই। শাস্ত্র বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তারা ভগবানের অস্তিত্ব অস্বীকার করবার জন্য নানা রকম কপট প্রমাণের অবতারণা করে এবং শান্তের নির্দেশ খণ্ডন করার চেষ্টা করে। তারা মনে করে যে, সব রকম কর্ম করার শক্তি ও স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। তারা মনে করে যে, যেহেতু শক্তি, সামর্থ্য অথবা বিত্তে কেউই তাদের সমকক্ষ নয়, তাই তারা যা ইচ্ছা তাই করে যেতে পারে, কেউই তাকে বাধা দিতে পারবে না। তাদের কোন শত্রু যদি ইন্দ্রিয়-পরায়ণ কার্যকলাপে বাধা দিতে চেষ্টা করে, তখন তারা তাকে সমূলে বিনাশ করার পরিকল্পনা করে।

error: Content is protected !!