শ্লোকঃ ৯

এতাং দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোঽল্পদ্ধয়ঃ ।

প্রভব্যগ্রকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোঽহিতাঃ ॥ ৯॥

এতাম্—এই প্রকার; দৃষ্টি— সিদ্ধান্ত; অবষ্টভ্য— অবলম্বন করে, নষ্টাত্মানঃ- আত্মতত্ত্ব-জ্ঞানহীন; অল্পবুদ্ধয়ঃ – অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রভবন্তি—প্রভাব বিস্তার করে; উগ্রকর্মাণঃ—উগ্রকর্মা, ক্ষয়ায় ধ্বংসের জন্য; জগত: -জগতের; অহিতাঃ- অনিষ্টকারী অসুরেরা।

গীতার গান

এই ক্ষুদ্র দৃষ্টি লয়ে অসুরের গণ ।

আত্মতত্ত্ব-জ্ঞানহীন অল্পবুদ্ধি হন ।।

উগ্র কর্মে উৎসাহ তার জগৎ অহিত ।

ক্ষয়কার্যে পটু তারা হয় প্রভাবিত ।।

অনুবাদঃ এই প্রকার সিদ্ধান্ত অবলম্বন করে আত্মতত্ত্বজ্ঞানহীন, অন্ন-বুদ্ধিসম্পন্ন, উগ্রকর্মা ও অনিষ্টকারী অসুরেরা জগৎ ধ্বংসকারী কার্যে প্রভাব বিস্তার করে।

তাৎপর্যঃ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা যে ধরনের কাজকর্মে নিযুক্ত, তা পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। ভগবান এখানে বলেছেন যে, তারা অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন। জড়বাদীরা, যাদের ভগবান সম্বন্ধে কোন জ্ঞানই নেই, তারা মনে করে যে, তারা উন্নত। কিন্তু ভগবদ্গীতার নির্দেশ অনুসারে তারা অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সব রকমের কাণ্ডজ্ঞানহীন। তারা চরমভাবে এই জড় জগৎকে ভোগ করতে চেষ্টা করে। তাই, তারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য সর্বদাই কিছু না কিছু আবিষ্কার করতে ব্যস্ত। এই ধরনের জড় আবিষ্কারগুলিকে মানব সভ্যতার উন্নতি বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তার ফলে মানুষেরা আরও বেশি নিষ্ঠুর ও হিংস্র হয়ে উঠছে, পশুর প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে এবং অন্য মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। পরস্পরের মধ্যে কি রকম আচরণ করা উচিত, তার কোন ধারণাই তাদের নেই। আসুরিক মানুষদের মধ্যে পশুহত্যার প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল। এই ধরনের মানুষকে পৃথিবীর শত্রু বলে গণা করা হয়, কারণ অবশেষে একদিন তারা এমন একটা কিছু তৈরি করবে বা আবিষ্কার করবে, যা সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংস করবে। পরোক্ষভাবে, এই শ্লোকে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কারের আভাস দেওয়া হচ্ছে, যে সম্বন্ধে আজ সারা জগৎ গর্বিত। যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হতে পারে এবং তখন এই সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্রগুলি ব্যাপক ধ্বংস সাধন করবে। এই প্রকার জিনিস সৃষ্টি হয়েছে। কেবলমাত্র জগৎকে ধ্বংস করবার জন্য এবং এখানে তারই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। নাস্তিকতার প্রভাবে মানব-সমাজে যে ধরনের অস্ত্রগুলি আবিষ্কার করা হচ্ছে, সেগুলি জগতের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য নয়।

শ্লোকঃ ১০

কামমাশ্রিত্য দুষ্পূরং দম্ভমানমদান্বিতাঃ ।

মোহাদ্ গৃহীত্বাসদগ্রাহান্ প্রবর্তন্তেহশুচিব্রতাঃ ॥ ১০ ॥

কামম্—কামকে; আশ্রিত্য — আশ্রয় করে, দুপূরম্—দুপূরণীয়; দত্ত – দত্ত, মান- মান; মদান্বিতাঃ—মদমত্ত হয়ে, মোহাৎ— মোহশত, গৃহীত্বা—গ্রহণ করে; অসৎ— অনিত্য; গ্রাহান্ — বিষয়ে; প্রবর্তন্তে – প্রবৃত্ত হয়; অশুচি—অশুচি কার্যে; ব্ৰতাঃ— ব্রতী হয়।

গীতার গান

দুষ্কৃর আশ্রয় কাম দম্ভ মদান্বিত ।

মোহগ্রস্ত অসদগ্রাহ অশুচিত ৷।

অনুবাদঃ সেই আসুরিক ব্যক্তিগণ দুপূরণীয় কামকে আশ্রয় করে দত্ত, মান ও মদমত্ত হয়ে অশুচি কার্যে ব্রতী হয় এবং মোহবশত অসৎ বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়।

তাৎপর্যঃ এখানে আসুরিক মনোবৃত্তির বর্ণনা করা হয়েছে। অসুরদের কাম কখনও তৃপ্ত হয় না। তাদের জাগতিক সুখভোগের তৃপ্তিহীন বাসনা ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হতে থাকে। যদিও অনিতা বস্তু গ্রহণ করার ফলে তারা সর্বদাই উৎকণ্ঠায় পূর্ণ, তবুও মোহের বশে তারা এই ধরনের কাজকর্মে প্রতিনিয়তই নিযুক্ত থাকে। তাদের কোন রকম জ্ঞান নেই এবং তারা বুঝতে পারে না যে, তারা ভুল পথে এগিয়ে চলেছে। অনিত্য বস্তুকে গ্রহণ করার ফলে এই ধরনের আসুরিক মানুষেরা তাদের মনগড়া ভগবান তৈরি করে, তাদের মনগড়া মন্ত্র তৈরি করে এবং তা কীর্তন করে। তার ফলে তারা জড় জগতের দুটি বস্তুর প্রতি আরও বেশি করে আকৃষ্ট হতে থাকে — যৌন সুখভোগ এবং জড় সম্পদ সঞ্চয়। অশুচিতাঃ কথাটি এই সূত্রে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এই ধরনের আসুরিক মানুষেরা কেবল মদ, স্ত্রীলোক, মাংসাহার ও জুয়াখেলার প্রতি আসক্ত। সেগুলি হচ্ছে তাদের অভ্যাস। দন্ত ও ভ্রান্ত সম্মানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা কতকগুলি ধর্মনীতি তৈরি করে, যা বৈদিক অনুশাসনের দ্বারা অনুমোদিত হয়নি। যদিও এই ধরনের আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা এই পৃথিবীতে সবচেয়ে জঘন্য শ্রেণীর জীব, তবুও কৃত্রিম উপায়ে এই জগৎ তাদের জন্য মিথ্যা সম্মান তৈরি করেছে। যদিও তারা নরকের দিকে এগিয়ে চলেছে, তবুও তারা নিজেদের খুব উন্নত বলে মনে করে।

শ্লোকঃ ১১-১২

চিস্তানপরিমেয়াং চ প্রতিঃ ।

কামোপভোগপরমা এতাবদিতি নিশ্চিতাঃ ৷৷ ১১ ॥

আশাপাশশতৈবদ্ধাঃ কামক্রোধপরায়ণাঃ ।

ঈহস্তে কামভোগার্থমন্যায়েনার্থসঞ্চয়ান্ ৷৷ ১২ ৷৷

চিন্তাম—দুশ্চিন্তা, অপরিমেয়াম —অপরিমেয়, চ—এবং; প্রলয়াত্তাম্—মৃত্যুকাল পর্যন্ত; উপাশ্রিতাঃ— আশ্রয় করে, কামোপভোগ — ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকে, পরমাঃ- জীবনের পরম উদ্দেশ্য, এতাবৎ ইতি—এভাবে; নিশ্চিতা:-নিশ্চয় করে; আশাপাশ—আশারূপ রজ্জুর দ্বারা; শতৈঃ—শত শত বদ্ধাঃ আবদ্ধ হয়ে; কাম কাম, ক্রোধ—ক্রোধ পরায়ণাঃ- পরায়ণ হয়ে; ঈহন্তে— চেষ্টা করে; কাম কাম ভোগ—উপভোগের; অর্থম্ — উদ্দেশ্যে; অন্যায়েন—অসৎ উপায়ে, অর্থ—দন- সম্পদ; সঞ্চয়ান্—সঞ্চয়ের।

গীতার গান

অপরের চিন্তা তার যতদিন বাঁচে ।

কামমাত্র উপভোগ হৃদয়েতে আছে ॥

শত শত আশা পাশ শুধু কাম ক্রোধ ।

কামভোগ লাগি অর্থ অন্য সে বিরোধ ॥

অন্যায় সে করে নিত্য সঞ্চয়েতে ৷

চিত্ত তার নিত্য বিদ্ধ অসং কার্যেতে ॥

অনুবাদঃ অপরিমেয় দুশ্চিন্তার আশ্রয় গ্রহণ করে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকেই তারা তাদের জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। এভাবেই শত শত আশাপাশে আবদ্ধ হয়ে এবং কাম ও ক্রোধ পরায়ণ হয়ে তারা কাম উপভোগের জন্য অসং উপায়ে অর্থ সঞ্চয়ের চেষ্টা করে।

তাৎপর্যঃ অসুরেরা মনে করে যে, ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করাই হচ্ছে জীবনের চরম লক্ষ্য এবং মৃত্যু পর্যন্ত তারা এই ভাবধারা পোষণ করে চলে। তারা জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না এবং কর্ম অনুসারে জীব যে ভিন্ন ভিন্ন রকমের শরীর প্রাপ্ত হয়, তাও তারা বিশ্বাস করে না। জীবন সম্বন্ধে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা কখনও শেষ হয় না। তারা একটির পর একটি পরিকল্পনা করে চলে, কিন্তু কোনটিই পূর্ণ হয় না। এই রকম একজন মানুষের সম্বন্ধে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে, যিনি মৃত্যুর সময়ে ডাক্তারকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর আয়ু আরও চার বছর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, কারণ তাঁর পরিকল্পনাগুলি তখনও পূর্ণ হয়নি। এই ধরনের মূর্খ লোকেরা জানে না যে, ডাক্তার এমন কি এক মুহুর্তের জন্যও কারও আয়ু বর্ধিত করতে পারে না। মৃত্যুর পরোয়ানা যখন আসে, তখন মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনও বিবেচনাই করা হয় না। প্রকৃতির আইন দেব-নির্ধারিত সময়ের বেশি আর এক মুহূর্ত সময়ও মঞ্জুর করে না।

আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা, যাদের ভগবান বা অন্তর্যামী পরমাত্মার উপর কোন বিশ্বাস নেই, তারা কেবল ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য সব রকমের পাপকর্ম করে চলে। তারা জানে না যে, তাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে সাক্ষীরূপে একজন বসে আছেন। জীবাত্মার সমস্ত কাজকর্ম পরমাত্মা নিরীক্ষণ করছেন। উপনিষদে সেই বলা হয়েছে—একটি গাছে দুটি পাখি বসে আছে। তাদের মধ্যে একজন সেই গাছের ফলগুলি ভোগ করে এবং অন্যজন তার সমস্ত কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করে চলে। কিন্তু যারা আসুরিক ভাবাপন্ন, তাদের বৈদিক শাস্ত্র সম্বন্ধে কোন আন নেই এবং সেই সম্বন্ধে বিশ্বাস নেই। তাই তারা পরিণামের বিবেচনা না করো, ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য যে কোনও কাজ করতে প্রস্তুত থাকে।

error: Content is protected !!