শ্লোকঃ ৬

দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেঽস্মিন্ দৈব আসুর এব চ ।

দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ যে শৃণু ।। ৬ ।।

দ্বৌ—দুই প্রকার; ভূতসগৌ— সৃষ্ট জীব; লোকে—সংসারে; অস্মিন্ –এই; দৈবঃ —দৈব; আসুরঃ—আসুরিক, এর – অবশ্যই; চ–ও; দৈবঃ – দৈব, বিস্তরশঃ- বিস্তারিতভাবে; প্রোক্তঃ—বলা হয়েছে, আসুরম্—আসুরিক; পার্থ – হে পৃথাপুত্র; মে—আমার থেকে; শুধু—প্রবণ কর।

গীতার গান

হে ভারত, এ জগতে দুই ভূত সৃষ্টি ৷

এক দৈবী দ্বিতীয় সে আসুরী বা দৃষ্টি ।।

দৈবী যারা তার কথা অনেক হয়েছে ৷

শুন এবে কথা যারা অসুর জন্মেছে ।।

অনুবাদঃ হে পার্থ। এই সংসারে দৈব ও আসুরিক — এই দুই প্রকার জীব সৃষ্টি হয়েছে। দৈব সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এখন আমার থেকে অসুর প্রকৃতি সম্বন্ধে শ্রবণ কর।

তাৎপর্যঃ অর্জুন যে দিবাগুণে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেই আশ্বাস দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এখানে আসুরিক পন্থার বর্ণনা করছেন। এই জগতের বদ্ধ জীবদের দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যাঁরা দিব্যগুণে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন, অর্থাৎ তাঁরা শাস্ত্র এবং সাধু, শুরু ও বৈষ্ণবের নির্দেশ মেনে চলেন। প্রামাণ্য শাস্ত্রের আলোকে কর্তব্য অনুষ্ঠান করা উচিত। এই মনোবৃত্তিকে বলা হয় দিব্য। যারা শাস্ত্র নির্দেশিত বিধি-নিষেধের অনুসরণ না করে তাদের নিজেদের খেয়ালখুশি মতো আচরণ করে, তাদের বলা হয় আসুরিক। শাস্ত্রের বিধি-নিষেধের প্রতি অনুগত হওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেবতা ও অসুর উভয়েরই জন্ম হয় প্রজাপতি থেকে। তাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে, দেবতারা বৈদিক নির্দেশ মেনে চলেন এবং অসুরেরা তা মানে না।

শ্লোকঃ ৭

প্রবৃত্তিং চ নিবৃত্তিং চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ ।

ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে ।। ৭ ।।

প্রবৃত্তিম্—ধর্মে প্রবৃত্তি; চ–ও; নিবৃত্তিম —অধর্ম থেকে নিবৃত্তি; চ—এবং; জনাঃ —ব্যক্তিরা ন-না; বিদুঃ—জানে; আসুরাঃ–অসুর স্বভাব-বিশিষ্ট; ন নেই; শৌচম্—শৌচ, ন– নেই; অপি—ও; চ–এবং, আচারঃ – সদাচার, ন― নেই; সত্যম্—সত্যতা; তেষু—তাদের মধ্যে; বিদ্যতে — বিদ্যমান।

গীতার গান

প্রবৃত্তি নিবৃত্তি যাহা অসুর না জানে ।

শৌচাচার সত্য মিথ্যা নাহি তারা মানে ।।

অনুবাদঃ অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা ধর্ম বিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অধর্ম বিষয় থেকে নিবৃত্ত হতে জানে না। তাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার ও সভ্যতা বিদ্যমান নেই।

তাৎপর্যঃ প্রতিটি সভ্য মানব-সমাজে কতকগুলি শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন আছে, যেগুলি প্রথম থেকেই মেনে চলা হয়। বিশেষ করে আর্যদের, যারা বৈদিক সভ্যতাকে গ্রহণ করেছে এবং যারা সভা মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত বলে পরিচিত। তাদের মধ্যে যারা শাস্ত্রের নির্দেশ মানে না, তাদের অসুর বলে গণ্য করা হয়। তাই এখানে বলা হচ্ছে যে, অসুরেরা শাস্ত্রের বিধান জানে না এবং তাদের মধ্যে কেউ যদি তা জেনেও থাকে, সেগুলি অনুসরণ করবার কোন প্রবৃত্তি তাদের নেই। ধর্মে তাদের বিশ্বাস নেই, আর নেদের নির্দেশ অনুসারে আচরণ করবার কোন ইচ্ছাও তাদের নেই। অসুরেরা অন্তরে ও বাইরে শুদ্ধ নয়। স্নান করে, দাঁত মেজে, কাপড় পরিবর্তন করে ইত্যাদি শৌচ পন্থায় দেহকে পরিষ্কার রাখার জন্য সর্বদাই যত্নশীল হওয়া উচিত। অন্তরের পরিচ্ছন্নতার জন্য সর্বদাই ভগবানের পবিত্র নাম স্মরণ করা উচিত এবং হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র কীর্তন করা উচিত। বাইরের ও অন্তরের পরিচ্ছন্নতার এই সমস্ত নিয়মগুলি অনুসরণ করার কোন প্রবৃত্তি অসুরদের নেই।

মানুষের আচরণ যথাযথভাবে পরিচালিত করার জন্য অনেক নিয়ম ও বিধান আছে, যেমন মনুসংহিতা হচ্ছে মনুষ্য জাতির আইন শাস্ত্র। এমন কি আজও পর্যন্ত হিন্দুরা মনুসংহিতা অনুসরণ করে। উত্তরাধিকারের আইন ও অন্য অনেক আইন এই গ্রন্থ থেকে নিরূপণ করা হয়েছে। মনুসংহিতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, নারীদের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নয়। তার অর্থ এই নয় যে, নারীদের ক্রীতদাসীর মতো রাখতে হবে। তার অর্থ হচ্ছে তারা শিশুর মতো। শিশুদের স্বাধীনতা দেওয়া হয় না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদের ক্রীতদাসের মতো রাখা হয়য়। অসুরেরা এই সমস্ত নির্দেশগুলি এখন অবহেলা করছে এবং তারা মনে করছে যে, পুরুষদের মতো নারীদেরও স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। সে যাই হোক, নারীদের এই স্বাধীনতা পৃথিবীর সমাজ-ব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের প্রতিটি স্তরে নারীদের রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত। শৈশবে তাদের পিতা- মাতার, যৌবনে পতির এবং বার্ধক্যে উপযুক্ত সন্তানদের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। মনুসংহিতার নির্দেশ অনুসারে এটিই হচ্ছে যথার্থ সামাজিক আচরণ। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কৃত্রিমভাবে নারী জীবনের ধারণাকে গর্বস্ফীত করবার উপায় উদ্ভাবন করেছে এবং তাই আজকের মানব-সমাজে বিবাহ-ব্যবস্থা প্রায় লোপ পেতে বসেছে। আধুনিক যুগের নারীদের নৈতিক চরিত্রও অত্যন্ত অধঃপতিত হয়েছে। সুতরাং, অসুরেরা সমাজের মঙ্গলের জন্য যে সমস্ত নির্দেশ তা গ্রহণ করে না এবং যেহেতু তারা মহর্ষিদের অভিজ্ঞতা এবং মুনি-ঋষিদের প্রদত্ত আইন-কানুনগুলি মেনে চলে। না, তাই আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষদের সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়।

শ্লোকঃ ৮

অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম।

অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্ ।। ৮ ।।

অসত্যম্—মিথ্যা; অপ্রতিষ্ঠম্ — অবলম্বনশূন্য: তে—তারা; জগৎ—জগৎ আহুঃ- বলে; অনীশ্বরম্—ঈশ্বরশূন্য, অপরস্পর পরস্পরের কাম থেকে: সম্ভূতম্ — উৎপন্ন, কিমনাৎ—অন্য কোন কারণ নেই, কামহৈতুকম্—কেবল কামের জন্য ।

গীতার গান

অসুর যে লোক তারা না মানে ঈশ্বর ।

জগতের বিধাতা যিনি অস্বীকার তার ।।

সৃষ্টির কারণ সেই অনীশ্বরবাদী ।

জড় কার্যকারণ সে কামুক বিবাদী ।।

অনুবাদঃ আসুরিক স্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলে যে, এই জগৎ মিথ্যা, অবলম্বনহীন ও ঈশ্বরশূন্য। কামবশত এই জগৎ উৎপন্ন হয়েছে এবং কাম ছাড়া আর অন্য কোন কারণ নেই।

তাৎপর্যঃ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা সিদ্ধান্ত করে যে, এই জগৎটি অলীক, এর পিছনে কোনও কার্য-কারণ নেই, এর কোন নিয়ন্তা নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই—সব কিছুই মিথ্যা। তারা বলে যে, ঘটনাচক্রে জড় পদার্থের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যে ভগবান এই জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তারা তা মনে করে না। তাদের নিজেদের মনগড়া কতকগুলি মতবাদ আছে—এই জগৎ আপনা হতেই প্রকাশিত হয়েছে এবং এর পেছনে যে ভগবান রয়েছেন, সেটি বিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। তাদের কাছে চেতন ও জড়ের কোন পার্থক্য নেই এবং তারা পরম চেতনকে স্বীকার করে না। তাদের কাছে সবই কেবল জড় এবং সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হচ্ছে একটি অজ্ঞানতার পিণ্ড। তাদের মত অনুসারে সব কিছুই শূন্য এবং যা কিছুরই অস্তিত্বের প্রকাশ দেখা যায়, তা কেবল আমাদের উপলব্ধির ভ্রম। তারা স্থির নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছে যে, বৈচিত্র্যময় সমস্ত প্রকাশ হচ্ছে অজ্ঞানতা জনিত ভ্রম, ঠিক যেমন স্বপ্নে আমরা অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারি, প্রকৃতপক্ষে যাদের কোন অস্তিত্ব নেই। তারপর যখন আমরা জেগে উঠব, তখন আমরা দেখতে পাব যে, সব কিছুই কেবল একটি স্বপ্নমাত্র। কিন্তু বস্তুতপক্ষে, অসুরেরা যদিও বলে যে, জীবন একটি স্বপ্নমাত্র, কিন্তু স্বপ্নটি উপভোগ করার ব্যাপারে তারা খুব দক্ষ। তাই, জ্ঞান আহরণ করার পরিবর্তে তারা এই স্বপ্নরাজ্যে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ে। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, কেবলমাত্র স্ত্রী-পুরুষের মৈথুনের ফলে যেমন একটি শিশুর জন্ম হয়, এই পৃথিবীর ও কোন আত্মা ছাড়াই জন্ম হয়েছে। তাদের মতে, কেবলমাত্র জড় পদার্থের সমন্বয়ের ফলেই জীবসকলের উদ্ভব হয়েছে এবং আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। যেমন, দেহের ঘাম থেকে এবং মৃতদেহ থেকে কোন কারণ ছাড়াই অনেক প্রাণী বেরিয়ে আসে, তেমনই সমস্ত জগৎ এসেছে মহাজাগতিক প্রকাশের জড় পদার্থের সমন্বয়ের ফলে। তাই জড়া প্রকৃতিই এই প্রকাশের কারণ এবং এছাড়া অন্য আর কোন কারণ নেই। তারা ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের কথা বিশ্বাস করে না। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্। “আমার অধ্যক্ষতায় সমস্ত জড় জগৎ পরিচালিত হচ্ছে।” পক্ষান্তরে বলা যায়, অসুরদের জড় জগতের সৃষ্টি সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান নেই। তাদের সকলেরই নিজের নিজের একটি মতবাদ আছে। তাদের মতে শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত তাদের মনগড়া মতবাদের মতোই একটি মতবাদ মাত্র। শাস্ত্রের নির্দেশ যে প্রামাণ্য সিদ্ধান্ত, তারা তা বিশ্বাস করে না।

error: Content is protected !!