রোগ সৃষ্টি ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের শরীরে বহু রোগের উৎপত্তি হয় ভয়, ভাবনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থেকে। আমাদের মানসিক ভারসাম্য নির্ভর করে সামাজিক পরিবেশের ওপর। সমাজ জীবনে অনিশ্চয়তা, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ধর্মোন্মাদনা, জাত-পাতের লড়াই ইত্যাদি যত বাড়ছে দেহ-মনজনিত অসুখ বা Psycho-somatic disorder তত বাড়ছে। সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকে বলে এই সময় তাঁদের অনেকেই দেহ-মনজনিত অসুখের শিকার হয়ে পড়েন।

মানসিক কারণে যে-সব অসুখ হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, মাথার ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, স্পন্ডালাইটিস, আরথ্রাইটিস, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, পেটের আলসার, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেশার, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি। মানসিক কারণে শারীরিক অসুখের ক্ষেত্রে ঔষধি-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইনজেকশন বা ট্যাবলেট কার্যকর ওষুধ বলে প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া যায়। এই ধরনের বিশ্বাস-নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলে ‘প্ল্যাসিবো’ (Placebo ) চিকিৎসা পদ্ধতি। Placebo কথার অর্থ “I will please.” বাংলায় অনুবাদ করে বলতে পারি, “আমি খুশি করব।” ভাবানুবাদ করে বলতে পারি, “আমি আরোগ্য করব।”

একটি ঘটনা বলি ১৯৮৭-র মে মাসের এক সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটু সুপরিচিত পত্রিকার সম্পাদকের স্ত্রী এসেছিলেন আমার ফ্ল্যাটে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক এক সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং জনৈক ভদ্রলোক।

চিকিৎসক জানালেন বছর আড়াই আগে সম্পাদকের স্ত্রীর ডান ঊরুতে একটা ফোঁড়া হয়েছিল। ছোট অস্ত্রোপচার, প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশন ও ওষুধে ফোঁড়ার ক্ষত সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়। কিন্তু এরপর ওই শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থান নিয়ে শুরু হয় এক নতুন সমস্যা। মাঝে- মাঝেই উরুর শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত ও তার আশপাশে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। কখনো ব্যথার তীব্রতায় রোগিণী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে যেসব চিকিৎসকদের দেখান হয়েছে ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই কলকাতার শীর্ষস্থানীয়। ব্যথার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এঁরা খুঁজে পাননি। চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, এক্স-রে ছবি ও রিপোর্ট সবই দেখালেন আমাকে।

আমি পেশায় মানসিক চিকিৎসক না হলেও মাঝে-মধ্যে এই ধরনের কিছু সমস্যা নিয়ে কেউ কেউ আমার কাছে হাজির হন। কাউন্সিলিং করি বা পরামর্শ দিই। রোগিণীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে উরুর শুকনো ক্ষতটা পরীক্ষা করে বললাম, “একবার খপুরে থাকতে দেখেছিলাম একটি লোকের হাতের বিষফোঁড়া, সেপটিক হয়ে, পরবর্তীকালে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করুন, সামান্য ফোঁড়া থেকে এই ধরনের ঘটনাও ঘটে।”

রোগিণী বললেন, “আমি নিজেই এই ধরনের একটা ঘটনার সাক্ষী। মেয়েটির হাতে বিষফোড়া জাতীয় কিছু একটা হয়েছিল। ফোঁড়াটা শুকিয়ে যাওয়ার পরও শুকনো ক্ষতের আশপাশে ব্যথা হতো। একসময় জানা গেল, ব্যথার কারণ গ্যাংগ্রিন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কাঁধ থেকে হাত বাদ দিতে হয়।’

যা জানতে গ্যাংগ্রিনের গল্পের অবতারণা করেছিলাম তা আমার জানা হয়ে গেছে। এটা এখন আমার কাছে দিনের মতোই স্পষ্ট যে, সম্পাদকের স্ত্রী ফোঁড়া হওয়ার পর থেকেই গ্যাংগ্রিন স্মৃতি তাঁর মনে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এই ফোঁড়া থেকেই আবার গ্যাংগ্রিন হবে না তো? এই প্রতিনিয়ত আতঙ্ক থেকেই একসময় ভাবতে শুরু করেন, “ফোঁড়া তো শুকিয়ে গেল কিন্তু মাঝে মধ্যেই যেন শুকনো ক্ষতের আশপাশে ব্যথা অনুভব করছি? আমারো আবার গ্যাংগ্রিন হল না তো? সেই মেয়েটির মতোই একটা অসহ্য কষ্টময় জীবন বহন করতে হবে না তো?”

এমনি করেই যত দুশ্চিন্তা বেড়েছে, ততই ব্যথাও বেড়েছে। বিশ্বাস থেকে যে ব্যথার শুরু, তাকে শেষ করতে হবে বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই।

আমি আবারো একবার উরুর শুকনো ক্ষত গভীরভাবে পরীক্ষা করলাম শরীরের আর কোথায় কোথায় কেমনভাবে ব্যথাটা ছড়াচ্ছে, ব্যথার অনুভূতিটা কী ধরনের ইত্যাদি প্রশ্ন রেখে গম্ভীর মুখে একটা নিপাট মিথ্যে কথা বললাম, “একটা কঠিন সত্যকে না জানিয়ে পারছি না, আপনারও সম্ভবত গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে একটু একটু করে।”

আমার কথা শুনে রোগিণী মোটেই দুঃখিত হলেন না। বরং উজ্জ্বল মুখে বললেন, “আপনিই আমার অসুখের সঠিক কারণ ধরতে পেরেছেন।”

আমি আশ্বাস দিলাম, “আমি অবশ্য নিশ্চিত নই, তবে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, আমার অনুমান ঠিক কি না। আমার অনুমান যদি ঠিক হয়, তবে আপনার কর্তাটিকে একটু কষ্ট করতে হবে। বিদেশ থেকে ওষুধ-পত্তর আনাবার ব্যবস্থা করতে হবে। দেখবেন, তারপর সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।”

রোগিণীর পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে জানলাম, কোনো পরীক্ষাতে-ই রোগের কোনো কারণ ধরা পড়েনি। ডাক্তারদের অনুমান ব্যথার কারণ সম্পূর্ণ মানসিক। রোগিণীর মনে সন্দেহের পথ ধরে একসময় বিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে তাঁর উরুর ফোঁড়া সারেনি, বরং আপাত শুকনো ফোঁড়ার মধ্যে রয়েছে গ্যাংগ্রিনের বিষ। রোগিণীর বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে কেমনভাবে প্ল্যাসিবো চিকিৎসা চালাতে হবে সে বিষয়ে একটা পরিকল্পনার কথা খুলে বললাম।

এই ঘটনার কয়েক দিন পরে রোগিণীর পারিবারিক ডাক্তার সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়া উরুর ফোঁড়ার ওপর নানারকম পরীক্ষা চালিয়ে একটা মেশিনের সাহায্যে রেখা-চিত্র তৈরি করে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে আবার রেখা-চিত্র তোলা হল। দু-বারের রেখা-চিত্রেই রেখার প্রচণ্ড রকমের ওঠা-নামা লক্ষ্য করে স্থির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন, গ্যাংগ্রিনের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। নিউ ইয়র্কে খবর পাঠিয়ে দ্রুত আনানো হল এমনই চোরা গ্যাংগ্রিনের অব্যর্থ ইনজেকশন। সপ্তাহে দুটি করে ইজেকশন ও দুবার করে রেখা- চিত্র গ্রহণ চলল তিন সপ্তাহ। প্রতিবার রেখা-চিত্রেই দেখা যেতে লাগল রেখার ওঠা-নামা আগের বারের চেয়ে কম। ওষুধের দারুণ গুণে ডাক্তার যেমন অবাক হচ্ছিলেন, তেমন রোগিণীও। প্রতিবার ইনজেকশনেই ব্যথা লক্ষণীয়ভাবে কমছে। তিন সপ্তাহ ধরে দেখা গেল রেখা আর আঁকা-বাঁকা নেই, সরল। রোগিণীও এই প্রথম অনুভব করলেন, বাস্তবিকই একটুও ব্যথা নেই। অথচ মজাটা হল এই যে,বিদেশী দামি ইন্জেকশনের নামে তিন সপ্তাহ ধরে রোগিণীকে দেওয়া হয়েছিল স্রেফ ডিসটিলড্ ওয়াটার।

পঞ্চম সপ্তাহে ‘আজকাল’ পত্রিকার রবিবারের ক্রোড়পত্রে আমার একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। শিরোনাম ‘বিশ্বাসে অসুখ সারে’। মহিলার ঘটনাটির উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করেছিলাম ।

বছর পনেরো আগের ঘটনা। আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে দমদমের ‘শান্তিসদন’ নার্সিংহোমে ভর্তি হন। ওই সময় শান্তিসদনের অন্যতম কর্ণধার অতীন রায়ের সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। তিনি অতি সম্প্রতি আসা এক রোগিণীর কেস হিস্ট্রি শোনালেন। মাঝে মাঝেই রোগিণীর পেটে ও তার আশেপাশে ব্যথা হত। আশচর্য ব্যাপার হল, প্রতিবারই ব্যথাটা পেটের বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তন করত। এইদিকে আর এক সমস্যা হল, নানা পরীক্ষা করেও ব্যথার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তার রোগিনীকে একটা ক্যাপসুল দিয়ে বললেন, এটা খান, ব্যথা সেরে যাবে। ক্যাপসুল খাওয়ার পর রোগিণীর ব্যথার কিছুটা উপশম হল। অথচ ক্যাপসুলটা ছিল নেহাতই ভিটামিনের। ব্যথা কিন্তু বারো ঘণ্টা পরে আবার ফিরে এলো।

আবার ভিটামিন ক্যাপসুল দেওয়া হল। এবারো উপশম হল সাময়িক। এভাবে আর কতবার চালানো যায়। ডাক্তারবাবু শেষ পর্যন্ত রোগিণীকে জানালেন, যে বিশেষ ইনজেকশনটা এই ব্যথায় সবচেয়ে কার্যকর সেটি বহু কষ্টে তিনি জোগাড় করেছেন। এবার ব্যথা চিরকালের মতো সেরে যাবেই ।

ডাক্তারবাবু ইজেকশনের নামে ডিসটিলড ওয়াটার পুশ করলেন। রোগিণীর ব্যথাও পুরোপুরি সেরে গেল ।

বছর কুড়ি আগেও কলকাতা জেনারেল পোস্ট অফিসের আশপাশে এক গৌরকান্তি, দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ তান্ত্রিক ঘুরে বেড়াতেন। গলায় মালা (যতদূর মনে পড়ছে রুদ্রাক্ষের)। মালার লকেট হিসেবে ছিল একটি ছোট্ট রুপোর খাঁড়া। বৃদ্ধকে ঘিরে সব সময়ই অফিস-পাড়ার মানুষগুলোর ভিড় লেগেই থাকত। এঁদের উদ্দেশ্য ছিল তান্ত্রিকবাবার অলৌকিক শক্তির সাহায্য নিয়ে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ থেকে নিজেকে মুক্ত করা। বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করে দেখেছি এঁদের অসুখগুলো সাধারণত অম্বলের ব্যথা, হাঁপানি, শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা, বুথ ধড়ফড়, অর্শ, বাত ইত্যাদি।

সাধুবাবা রোগীর ব্যথার জায়গায় লকেটের খাঁড়া বুলিয়ে জোরে-জোরে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে বলতেন, “ব্যথা কমেছে না?”

রোগী ধন্দে পড়ে যেতেন। সত্যিই ব্যথা কমেছে কি কমেনি? বেশ কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করে প্রায় সকলেই বলতেন, “কমেছে মনে হচ্ছে।”

এই আরোগ্য লাভের পিছনে তান্ত্রিকটির কোনো অলৌকিক ক্ষমতা কাজ করত না, কাজ করত তান্ত্রিকটির অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি রোগীদের অন্ধ বিশ্বাস ।

এবারের ঘটনাটা আমার শোনা। বলেছিলেন প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিশ্বনাথ রায়। ডা. রায়ের সার্জারির অধ্যাপক ছিলেন ডা. অমর মুখার্জি। তাঁর কাছে চিকিৎসিত হতে আসেন এক মহিলা। মহিলাটির একান্ত বিশ্বাস, তাঁর গলস্টোন হয়েছে। এর আগে কয়েকজন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন পেটে ব্যথার কারণ গলস্টোন নয়। চিকিৎসকদের এই ব্যাখ্যায় মহিলা আদৌ সন্তুষ্ট হতে পারেননি ।

ডা. মুখার্জি মহিলার গল-ব্লাডারের এক্স-রে করালেন। দেখা গেল কোনো স্টোন নেই। তবু ডা. মুখার্জি তাঁর ছাত্রদের শিখিয়ে দিলেন রোগিণীকে বলতে, তাঁর গলস্টোন হয়েছে। এক্স-রে-তে দুটো স্টোন দেখা গেছে। অপারেশন করে স্টোন দুটো বার করে দিলেই ব্যথার উপশম হবে।

রোগিণীকে জানানো হল অমুক দিন অপারেশন হবে। নির্দিষ্ট দিনে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান করে পেটের চামড়া চর্বিস্তর পর্যন্ত কাটলেন এবং আবার সেলাই করে দিলেন। ও.টি. স্টাফের হাতে ছোট্ট দুটো রঙিন পাথর দিয়ে ডা. মুখার্জি বললেন, রোগিণী জ্ঞান ফেরার পর স্টোন দেখতে চাইলে পাথর দুটো দেখিয়ে বলবেন, এ-দুটো ওর পিত্তথলি থেকেই বেরিয়েছে।

রোগিণী কয়েকদিন হাসপাতালেই ছিলেন। সেলাই কেটেছিলেন ডা. রায়। রোগিণী হৃষ্টচিত্তে রঙিন পাথর দুটো নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। যে ক-দিন হাসপাতালে ছিলেন সে ক-দিন গলব্লাডারের কোনো ব্যথা অনুভব করেননি। অথচ আশ্চর্য, সাজানো অপারেশনের আগে প্রতিদিনই নাকি রোগিণী গলব্লাডারে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতেন।

এবার যে ঘটনাটি বলছি, তা শুনেছিলাম চিকিৎসক এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির একসময়ের সভাপতি ডা. বিষ্ণু মুখার্জির কাছে। ঘটনাস্থল জামশেদপুর। ডা. মুখার্জি তখন জামশেদপুরের বাসিন্দা। নায়িকা তরুণী, সুন্দরী, বিধবা। ডা. মুখার্জির কাছে তরুণীটিকে নিয়ে আসেন তাঁরই এক আত্মীয়া। তরূণীটির বিশ্বাস তিনি মা হতে চলেছেন। মাসিক বন্ধ আছে মাস তিনেক। ডা. মুখার্জির আগেও অন্য চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, মাতৃত্বের কোনো চিহ্ন নেই। ডাক্তারের স্থির নিশ্চিত সিদ্ধান্তে মেয়েটির পরিবারের আর সকলে বিশ্বাস স্থাপন করলেও, মেয়েটি কিন্তু তাঁর পূর্ব বিশ্বাস থেকে নড়েননি। তাঁর এখনো দৃঢ় বিশ্বাস, মা হতে চলেছেন। এবং মা হলে তাঁর সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে। ইতোমধ্যে সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

পূর্ব ইতিহাস জানার পর ডা. মুখার্জি পরীক্ষা করে মেয়েটিকে জানালেন, “আপনার ধারণাই সত্যি। আপনি মা হতে চলেছেন। যদি অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব থেকে অব্যাহতি চান নিশ্চয়ই তা পেতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে অ্যাবরশন করতে হবে।

মেয়েটি এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। সাজানো অ্যাবরশন শেষে জ্ঞান ফিরতে রোগিণীকে দেখানো হল অন্য এক রোগিণীর দু’মাসের ফিটাস ট্রেতে রক্তসহ সাজিয়ে ।

মেয়েটি সুখ ও স্বস্তি মেশানো নিশ্বাস ছাড়লেন। পরবর্তীকালে মেয়েটি তাঁর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক জীবন ফিরে পেয়েছিলেন।

 

যেসব রোগ নিজে থেকেই বাড়ে-কমে

অনেক পুরনো বা Chronic রোগ আছে যেসব রোগের প্রকোপ বিভিন্ন সময় কমে- বাড়ে। যেমন গেঁটে বাত, অর্শ, হাঁপানি, অম্বল। আবার হাঁপানি, অম্বলের মতো কিছু পুরনো রোগ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়াই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে সেরে যায়। অলৌকিক বাবাদের কাছে কৃপা প্রার্থনার পরই এই ধরনের অসুখ বিশ্বাসে বা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে কিছুটা কমলে বা সেরে গেলে অলৌকিক বাবার মাহাত্ম্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি অমিয় সেন একবার আমাকে বলেছিলেন, “মার্কসবাদে বিশ্বাসী হলেও আমি কিন্তু অলৌকিক শক্তিকে অস্বীকার করতে পারি না। দীঘার কাছের এক মন্দিরে আমি এক অলৌকিক ক্ষমতাবান পুরোহিতের দেখা পেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী গেঁটে-বাতে পায়ে ও কোমরে মাঝে-মাঝে খুব কষ্ট পান। একবার দীঘায় বেড়াতে গিয়ে ওই পুরোহিতের খবর পাই। শুনলাম উনি অনেকের অসুখ-টসুখ ভালো করে দিয়েছেন । এক সন্ধ্যায় আমরা স্বামী-স্ত্রীতে গেলাম মন্দিরে। পুজো দিলাম। সন্ধ্যারতির পর পুরোহিতকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে আসার উদ্দেশ্য জানালাম। পুরোহিত বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে আমার স্ত্রীর কোমর ও পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। একসময় জিজ্ঞেস করলেন, “কি, এখন ব্যথা কমেছে না?” অবাক হয়ে গেলাম আমার স্ত্রীর জবাব শুনে। ও নিজের শরীরটা নাড়া-চাড়া করে বলল, “হ্যাঁ, ব্যথা অনেক কমেছে।” এইসব অতি- মানুষেরা হয়তো কোনো দিনই আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হাজির হবেন না। কিন্তু এদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়ার পর তা অস্বীকার করব কীভাবে?”

আমি বলেছিলাম, “যতদূর জানি আপনার স্ত্রীর বাতের ব্যথা এখনো আছে।”

আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি জবাব দিয়েছিলেন, “পুরোহিত অবশ্য আরো কয়েকবার ঝেড়ে দিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। কাজের তাগিদে আর যাওয়া হয়নি। ত্রুটিটা আমাদেরই।”

এই সাময়িক আরোগ্যের কারণ পুরোহিতের প্রতি রোগিণীর বিশ্বাস, পুরোহিতের অলৌকিক কোনো ক্ষমতা নয়। অথবা, পুরনো রোগের নিয়ম অনুসারেই স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় গেঁটে-বাতের প্রকোপ কিছুটা কম ছিল।

 

বিশ্বাসে কাজ হয়

কেস হিস্ট্রিঃ এক

সালটা সম্ভবত ১৯৮৪। সে সময়কার বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক ‘বিশ্ববাণী’র মালিক ব্রজ মণ্ডলের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। হোটেলে পৌছতেই রাত দশটা পার হয়ে গেল। এগারোটায় খাবারের পাট চুকানোর পর প্রকাশক বন্ধুটির খেয়াল হল সঙ্গে ঘুমের বড়ি নেই । অথচ প্রতি রাতেই ঘুম আনে ঘুমের বড়ি। বেচারা অস্থির ও অসহায় হয়ে পড়লেন। “কী হবে প্রবীর? এত রাতে কোনও ওষুধের দোকান খোলা পাওয়া অসম্ভব। তোমার কাছে কোনো ঘুমের ওষুধ আছে?” বললাম, “আমারো তোমার মতোই ঘুম নিয়ে সমস্যা। অতএব সমাধানের ব্যবস্থা সব সময়ই সঙ্গে রাখি। শোবার আগেই ওষুধ পেয়ে যাবে।”

শুতে যাওয়ার আগে প্রকাশকের হাতে একটা ভিটামিন ক্যাপসুল দিয়ে আমিও একটা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্যাপসুলটা নেড়ে চেড়ে দেখে প্রকাশক বললেন, “এটা আবার কী ধরনের ওষুধ? ক্যাপসুলে ঘুমের ওষুধ? নাম কী?”

একটা কাল্পনিক নাম বলে বললাম, “ইউ.এস.এ’র ওষুধ।” কলকাতার এক সুপরিচিত চিকিৎসকের নাম বলে বললাম, “আমার হার্টের পক্ষে এই ঘুমের ওষুধই সবচেয়ে সুইটেবল বলে প্রতি তিন মাসে একশোটা ক্যাপসুলের একটা করে ফাইল এনে দেন। যে চিকিৎসকের নাম বলেছিলাম তিনি যে আমাকে খুবই স্নেহ করেন সেটা প্রকাশক বন্ধুটির জানা থাকায় আমার কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লেন। পরের দিন সকালে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন ঘুম হল?”

“ফাইন। আমাকেও মাঝে মধ্যে এক ফাইল করে দিও।”

প্রকাশকের বিশ্বাস হেতু এক্ষেত্রে ঘুমের ওষুধহীন ক্যাপসুলই ঘুম আনতে সক্ষম হয়েছিল।

 

কেস হিস্ট্রিঃ দুই

গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার কথা। আমার কাছে এসেছিলেন এক চিকিৎসক বন্ধু এক বিচিত্র সমস্যা নিয়ে। বন্ধুটি একটি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে এক রোগিণী ভর্তি হয়েছেন। তাঁকে নিয়েই সমস্যা। তিনি মাঝে মাঝে অনুভব করেন গলায় কিছু আটকে রয়েছে। এই সময় তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়। এক্স-রেও করা হয়েছে, কিছু মেলেনি। দেহ- মনজনিত অসুখ বলেই মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে রোগিণী তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন বলে আমি মনে করি, সেটা জানতেই আসা।

পরের দিনই নার্সিংহোমে রোগিণীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিলেন বন্ধুটি। নানা ধরনের কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে রোগিণী তাঁর উপসর্গের কারণ হিসেবে কী ভাবছেন, এইটুকু জানতে চাইছিলাম। জানতেও পারলাম। চিকিৎসক বন্ধুটিকে জানালাম, রোগিণীর ধারণা তাঁর পেটে একটা বিশাল ক্রিমি আছে। সেটাই মাঝে-মাঝে গলায় এসে হাজির হয়। অতএব রোগিণীকে আরোগ্য করতে চাইলে একটা বড় ফিতে কৃমি জোগাড় করে তারপর সেটাকে রোগিণীর শরীর থেকে বার করা হয়েছে এই বিশ্বাসটুকু রোগিণীর মনের মধ্যে গেঁথে দিতে পারলে আশা করি তাঁর এই সাইকো-সোমাটিক ডিঅর্ডার ঠিক হয়ে যাবে।

কয়েক দিন পরে বন্ধুটি আমাকে ফোনে খবর দিলেন রোগিণীর গলা থেকে পেট পর্যন্ত এক্স-রে করে তাঁকে জানানো হয়েছিল একটা বিশাল ফিতে কৃমির অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। অপারেশন করে কৃমিটাকে বের করা প্রয়োজন। তারপর পেটে অপারেশনের নামে হালকা ছুরি চালিয়ে রোগিণীর জ্ঞান ফেরার পর তাঁকে কৃমিটা দেখানো হয়েছে। এরপর চারদিন রোগিণী নার্সিংহোমে ছিলেন। গলার কোনো উপসর্গ নেই। রোগিণীও খুব খুশি। বারবার ধন্যবাদ জানিয়েছেন ডাক্তার বন্ধুটিকে।

 

অনিশ্চয়তা থেকে অসুখ

১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালের ঘটনা, আমি তখন হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়াই। কুসংস্কারবিরোধী অনুষ্ঠান করি গুপি-সঞ্জয়কে প্রধানত সঙ্গী করে। মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরা হত না। রাতে এখানে ওখানে। গামছা পেতে পয়সা তোলা হত দর্শকদের কাছ থেকে। যাঁরা আমন্ত্রণ করতেন, তাঁরা রাতে রুটি তরকারি বা ভাত, ডাল, আলুভাতে দিতেন খেতে। এক সঙ্গে আড্ডা-খাওয়া। আমরা তো মজায় কাটাতাম, এনজয় করতাম।

আর ওদিকে বাড়িতে একা একা থাক তো সীমা ও পিনাকী। গভীর রাতে সীমার হাঁপানির টান উঠতো। পাশের বাড়ির মল্লিকদা পাড়ারই এক ডাক্তারকে ডেকে আনতেন। এটা আমি বাইরে থাকলেই হত। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব সময়ই হত। আর আমি রাতে বাড়ি থাকলে হাঁপানির সমস্যা হত না ।

এক মনোবিদের সাহায্য নিয়ে সারালাম। আমার পক্ষে ওকে সম্মোহন করা সম্ভব ছিল না। কারণ ওকে সম্মোহন করি, আমার সাধ্য কোথায়! ওর ভয় ছিল সম্মোহন করে যদি ওর মনের অনেক গোপন কথা…

বিশ্বাসবোধকে যে শুধুমাত্র চিকিৎসকেরাই কাজে লাগান, তা নয়। অনেক তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাধরেরাও বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় ঘটিয়ে অলৌকিক ‘ইমেজ’ বজায় রাখেন অথবা বর্ধিত করেন।

পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন

অধ্যায়ঃ দুই

♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?

অধ্যায়ঃ তিন

♦ ফোটো-সম্মোহন কি সম্ভব?

অধ্যায়ঃ চার

♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ জন্মান্তর ও সম্মোহন

অধ্যায়ঃ সাত

♦ সম্মোহন ও নার্কো টেস্ট

অধ্যায়ঃ আট

♦ সম্মোহন করে কথা বলানো যায় ?

অধ্যায়ঃ নয়

♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?

পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ মানসিক রোগের রকমফের

অধ্যায়ঃ চার

♦ Hysterical neurosis – Conversion type

অধ্যায়ঃ চার

♦ সাইকোসিস (Psychosis) উন্মাদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)

পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)

অধ্যায়ঃ দুই

♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব

অধ্যায়ঃ তিন

♦ টেনশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ রিল্যাকসেশান পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যৌনতা এবং যৌন-সমস্যা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব

পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন চিকিৎসা এবং…

অধ্যায়ঃ দুই

♦ রোগীকে সাজেশন দেওয়ার পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ রকমারি রোগ, রকমারি সাজেশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ প্রাচীন আমল থেকেই মানসিক রোগ মানেই অশুভ শক্তির কালো হাত

“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!