ব্যাপকভাবে প্রকাশিত এবং একক গ্রন্থরূপে পঠিত ভগবদ্‌গীতা প্রাচীন জগতের মহাকাব্যরূপ সংস্কৃত ইতিহাস মহাভারত গ্রন্থের একটি দৃশ্যাংশ-স্বরূপ আদিতে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমান কলিযুগের ঘটনাবলী অবধি মহাভারতে কথিত হয়েছে। এই যুগেরই প্রারম্ভে, আনুমানিক পঞ্চাশত্তম শতাব্দীর পূর্বে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখা ও ভক্ত অর্জুনকে ভগবদ্গীতা শুনিয়েছিলেন।

তাঁদের পারস্পরিক আলোচনা – যা মানুষের কাছে পরিজ্ঞাত মহত্তম দার্শনিক ও ধর্মীয় সংলাপগুলি ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র ও তাঁদের বিপক্ষে পাণ্ডুপুত্রগণ তথা তাঁদের পাণ্ডব জ্ঞাতিভ্রাতাগণের মধ্যে এক বিশাল ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষরূপ যুদ্ধের প্রারম্ভে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ভূমণ্ডলের পূর্বতন অধিপতি যে ভরত রাজার নাম থেকে মহাভারত নামটি উদ্ভুত হয়েছে, তাঁর বংশানুক্রমে কুরুবংশে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু ভ্রাতারূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যেহেতু জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন, তাই যে-সিংহাসন তাঁরই প্রাপ্য ছিল, তা কনিষ্ঠ ভ্রাতা পাণ্ডুকে প্রদান করা হয়েছিল।

অল্পবয়সে পাণ্ডু মারা গেলে, তাঁর পঞ্চপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব তৎকালীন কার্যকরী রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের অধীন হন। এভাবেই ধৃতরাষ্ট্রের ও পাণ্ডুর পুত্রগণ একই রাজপরিবারে প্রতিপালিত হন। তারা সকলেই সুদক্ষ দ্রোণের কাছে সমরকৌশলে প্রশিক্ষিত হন এবং শ্রদ্ধাভাজন পিতামহ ভীষ্মের কাছে উপদেশাবলী লাভ করেন।

তা সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা, বিশেষত জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন পাণ্ডবদের ঘৃণা ও ঈর্ষা করত। আর অন্ধ ও দুষ্টমনা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বাদ দিয়ে নিজ পুত্রদেরই রাজ্যের অধিকার দিতে চাইতেন।

তাই ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে, দুর্যোধন পাণ্ডুর তরুণ পুত্রদের বধ করবার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং কেবলমাত্র তাঁদের পিতৃব্য বিদুর ও তাঁদের ভ্রাতৃপ্রতিম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সযত্ন সুরক্ষার মাধ্যমে পাণ্ডবেরা তাঁদের প্রাণান্তকর বহু ষড়যন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন।

এখন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান, যিনি পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন এবং সমসাময়িক এক রাজবংশে রাজপুত্রের ভূমিকায় লীলা প্রদর্শন করেছিলেন। এই ভূমিকায় তিনি পাণ্ডবদের জননী পাণ্ডুপত্নী কুন্তী, অর্থাৎ পৃথার ভ্রাতুষ্পুত্রও হয়েছিলেন। সুতরাং আত্মীয়রূপে এবং ধর্মের নিত্য রক্ষকরূপেও শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডুর ন্যায়ধর্মী পুত্রদের প্রতি কৃপা করেছিলেন এবং তাঁদের সুরক্ষা প্রদান করেছিলেন।

অবশেষে, ধূর্ত দুর্যোধন অবশ্য এক জুয়াখেলায় পাণ্ডবদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান জানায়। সেই দুর্ভাগ্যজনক ক্রীড়ার মাধ্যমে, দুর্যোধন ও তার ভ্রাতৃবর্গ পাণ্ডবদের সাধ্বী ও একান্ত অনুগতা পত্নী দ্রৌপদীকে অধিকার করে, আর সমবেত সমগ্র রাজপুত্রগণ ও রাজন্যবর্গের সমাবেশের সামনেই তাঁকে বিবস্ত্রা করার মাধ্যমে অপমাণিত করবার চেষ্টা করে। শ্রীকৃষ্ণের দিব্য হস্তক্ষেপের ফলে তিনি তা থেকে রক্ষা পান, কিন্তু সেই দ্যূতক্রীড়া জালিয়াতিপূর্ণ ও কপটতাপূর্ণ হয়েছিল বলেই পাণ্ডবেরা তাঁদের রাজ্য থেকে বঞ্চিত হন এবং তাঁদের তের বছরের বনবাস গমনে বাধ্য করা হয়।

বনবাস থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে, পাণ্ডবেরা ন্যায়সঙ্গত ভাবেই দুর্যোধনের কাছ থেকে তাদের রাজ্য ফিরে পেতে অনুরোধ জানালে সে স্পষ্টতই তা প্রদান করতে অসম্মত হয়। যেহেতু রাজপুত্রগণ জনসেবা ব্রতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন, তাই পঞ্চপাণ্ডবেরা শুধুমাত্র পাঁচটি গ্রাম ফিরে পাবার অনুরোধে ক্ষান্ত হন। কিন্তু দুর্যোধন উদ্ধতভাবে উত্তর দেয় যে, সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমিও সে তাদের ছেড়ে দেবে না। এ যাবৎ, পাণ্ডবেরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সহিষ্ণু ও সংযত হয়ে ছিলেন। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে যুদ্ধ অনিবার্য।

তা সত্ত্বেও, ভূমণ্ডলের রাজন্যবর্গ বিভক্ত হয়ে গেলে, কিছু ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের পক্ষ নিলেন, অনোরা পাণ্ডবদের দলে এলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পাণ্ডুপুত্রদের পক্ষে বার্তাবহ দূতের ভূমিকা গ্রহণ করে শান্তির প্রস্তাব আলোচনার উদ্দেশ্যে ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় যান। তাঁর শান্তির প্রস্তাব আদি প্রত্যাখ্যাত হলে, এবার যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

মহত্তম আদর্শ নীতির বাহক পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে স্বীকার করলেও, ধৃতরাষ্ট্রের ধর্মভ্রষ্ট পুত্রেরা তা করেনি। তবু শ্রীকৃষ্ণ দুই বিবাদী পক্ষেই অভিলাষ অনুসারে যুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। পরমেশ্বর ভগবানরূপে, তিনি স্বয়ং যুদ্ধ করবেন না বললেন, তবে যে-পক্ষ চায়, তাঁরা ইচ্ছা করলে শ্রীকৃষ্ণের সেনাবাহিনীর সুযোগ নিতে পারতেন— এবং অপর পক্ষ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে উপদেশদাতা ও সহায়করূপে পেতে পারেন। রাজনৈতিক ধুরন্ধর দুর্যোধন শ্রীকৃষ্ণের সেনাবাহিনী কুক্ষিগত করেন, আর পাণ্ডবেরা ঠিক তেমনই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে পেতেই আকুল হয়ে ওঠেন।

এভাবেই, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং হচ্ছেন অর্জুনের সারথি, প্রবাদপ্রসিদ্ধ ধনুর্ধরের সারথি হয়ে তাঁর রথের চালক। এই পর্যন্ত এসে আমরা ভগবদ্গীতার সূচনাক্ষণে উপনীত হই, যেখানে দুই সেনাবাহিনী সারিবদ্ধভাবে সংঘর্ষের জন্য মুখোমুখি প্রস্তুত এবং ধৃতরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর সচিব সঞ্জয়ের কাছে জানতে চাইছেন, “তারপর তারা কি করল?”

দৃশ্যপট প্রস্তুত, এখন কেবল এই অনুবাদকর্ম ও ভাষা সম্পর্কে সামান্য টীকা প্রদান প্রয়োজন।

ভগবদ্গীতা ভাষান্তরিত করবার কাজে সাধারণ শ্রেণীর অনুবাদকেরা যে ধারা অনুসরণ করে এসেছেন, তাতে শ্রীকৃষ্ণের পুরুষসত্তা একপাশে সরিয়ে রেখে তাঁদের নিজেদেরই ভাবধারা ও দর্শনতত্ত্বের জায়গা করে নিয়েছেন। মহাভারতের ইতিবৃত্তকে চমকপ্রদ পুরাকাহিনীরূপে গ্রহণ করা হয়েছে এবং শ্রীকৃষ্ণ হয়েছেন কোনও অজ্ঞাতনামা পণ্ডিত ব্যক্তির চিন্তাভাবনা আদি উপস্থাপনার কাব্যসুলভ এক কাল্পনিক চেহারা মাত্র, কিংবা তিনি বড় জোর এক অতি নগণ্য ঐতিহাসিক পুরুষমাত্র। কিন্তু পুরুষসত্তা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবদ্গীতার লক্ষ্য ও সারমর্ম উভয়ই, অন্তত গীতায় যা উক্ত হয়েছে, তা থেকে এটিই বোঝায়।

ভাষাসহ এই অনুবাদকর্মটি তাই পাঠককে প্রত্যক্ষভাবে শ্রীকৃষ্ণের সমীপে উপনীত করতে সাহায্য করে—তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে নয়। এই যুক্তিবলে, ভগবদ্গীতা যথাযথ অতুলনীয়। আরও অতুলনীয় এই জন্য যে, ভগবদ্‌গীতা পরিপূর্ণভাবে সুসমঞ্জস ভাবদ্যোতক এবং সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ গীতার প্রবক্তা এবং এই গীতার চরম লক্ষ্যও বটে, তাই একমাত্র এই অনুবাদকর্মটি যথার্থই এই মহান শাস্ত্র-সম্পদটিকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছে।

– প্ৰকাশক

error: Content is protected !!