১৩৪৮ সালের মারাত্মক বন্যার ক্ষয়ক্ষতির জের চলছিল উনপঞ্চাশ সালে। সে বন্যায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল- আখ, পাট, তিল, মরিচ ইত্যাদি মাঠের যাবতীয় অর্থকারী ফসল। এতে কৃষক সমাজে দেখা দিয়েছিল দারুন অর্থ সঙ্কট এবং তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল- শিল্প, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী ইত্যাদি সকল শ্রেণীর লোকের মধ্যে এবং সরকারের রাজস্ব খাতেও। এর পর গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত উনপঞ্চাশ সালের প্রথমার্ধে শুরু হ’’ল অতিবৃষ্টি ও অতিশয় জলস্ফীতি। ফলে ব্যহত হল আউশ ও আমন ধানের চাষ, নষ্ট হল আমন ধানের প্রায় পনের আনা ফসল। পক্ষান্তরে- এ বছরের কার্তিক হতে চৈত্র মাস পর্যন্ত শেষার্ধে আদৌ বৃষ্টিপাত হল না। ফলে রবি ফলন মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল। অধিকন্তু ১৩৫০ সালের আষাঢ় মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আখ, পাট বিশেষতঃ আউশ ধানের চাষ করা সম্ভব হ’ল না। ফলে এদেশের মানুষের খাদ্য ও অর্থসঙ্কট চরমে ঠেকল। আট চল্লিশ ও উনপঞ্চাশের পুঞ্জীভূত অভাব পঞ্চাশে এসে রূপ নিল দুর্ভিক্ষের।
উনপঞ্চাশ সালে আমন ধান যা জন্মিল, তা কাটাই, মাড়াই ও ছাটাই করে পৌষ মাসেই চাল থাকল না অনেক কৃষকের ঘরে। চিরাচরিত
নিয়ম মাফিক ধান-চালের সর্বনিম্ন মূল্য থাকে পৌষ মাসে। কিন্তু এ বছর এ সময়টাতেই শুরু হল উহার মূল্য বৃদ্ধি হতে।
বিগত কয়েক বছর যাবত খাদ্য দ্রব্য গুলোর বিশেষতঃ চালের মূল্য ধীরে ধীরে বেড়েই চলছিল। ১৩১২ সালে চালের মূল্য ছিল প্রতি মন হতে টাকা,
১৩৪৫ সালে ৩ থেকে
১৩৪৭ সালে ৪,
১৩৪৮ সালে হতে ৫ এবং
১৩৪৯ সালের পৌষ মাসেই মূল্য দাঁড়াল ৭ – ৮ টাকায়।
১৩৫০ সালের পৌষ মাসে চালের মন হ’ল ১৬ টাকা এবং আশ্বিনে উঠল ৬০ টাকায়।
আগের তুলনায় চালের মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও অন্যান্য ফসল ও শিল্পজাত দ্রব্যের মূল্য এবং শ্রমিকের মজুরী আদৌ বৃদ্ধি হল না, বরং কমে গেল। ফলে নিম্ন শ্রেণীর কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে দেখা দিল অর্থ সঙ্কট, অধিকাংশেরই চাল কেনার ক্ষমতা থাকল না। আবার কেহ কেহ সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কোথাও চাল কিনতে না পেরে ট্যাঁকে টাকা নিয়ে অনাহারে রাতে শুয়ে থাকতে বাধ্য হ’ল। শুরু হল লোকের অল্পাহার, অর্ধাহার ও অনাহারের পালা। ভাতের অভাবে লোকে কাঁচা ফলমূল ও তরিতরকারি- সিদ্ধ করে খেতে লাগল। যখন তাও জুটল না, তখন- বুনো শাক-পাতা ও নানাবিধ অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে বিশেষতঃ পেটের পীড়ায় শত শত মানুষ মারা যেতে লাগল।
১৩৪৯ সালে আমার ভাগ্য চক্রটি ঘুরছিল উল্টা পাকে। প্রতাপপুর মৌজার নূতন চরের হেলি, ধান ইত্যাদি গরু লায়ক জমি বাদে এ সময় আমার চাষের জমির পরিমাণ ছিল ৪ কানি। এর মধ্যে প্রায় তিন কানি জমিই ছিল উঁচু ভিটা। এতে কখনো আমন ধান জন্মিত না বা অতি অল্পই জন্মিত। এ বছর জলবৃদ্ধির দরুন আমার এক কানি নিচু জমির ফসল নষ্ট হলেও প্রায় তিঙ্কানি উঁচু জমিতে প্রচুর আমন ধান জন্মিল। এর পূর্বে আমার জমিতে কোন বছর ৫০-৬০ মণের অধিক আমন ধান জন্মিত না। কিন্তু এ বছর জন্মিল ১১০ মণ অর্থাৎ আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া বিগত কয়েক বছর যাবত প্রতাপপুরের নূতন চর জমিতে আমার বোরো ধান জন্মিত বছরে ৩০-৪০ মণ করে। কিন্তু এ বছর জন্মিল ৬০ মণ।
আমার ক্ষেতের ধান চাল সংবছর খেয়েদেয়ে এ যাবত উদ্বৃত্ত হত না কখনো। হয়ত কখনো কখনো দু এক মাসের খোরাকী চাল কিনতে হত। কিন্তু উনপঞ্চাশে আমার আমন ও বোরো ধানের ফলন অধিক হওয়ায় পঞ্চাশ সালে আমি চাল বিক্রি করলাম প্রায় এক হাজার টাকার মত।
১৩৫০ সালে কেন রূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগবশতঃ আমন ধানের চাষ ব্যাহত হ’ল না। কিন্তু কৃষকদের আর্থিক অনটন ও স্বাস্থ্যগত কারণে ফসলের যথোপযুক্ত পরিচর্যা করা সম্ভব হ’ল না বলে ফসল অনেকটা কম হ’ল। তবুও হেমন্ত কাল হতে (নতুন চাল দেখা দিলে) দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচল।
ভিখারীর আত্মকাহিনী- প্রথম খন্ড
♦ চর পূর্বাভাস ও জন্ম (১১৫৮-১৩০৭)
♦ উচ্চ শিক্ষার প্রচেষ্টা (১৩৩৫)
ভিখারীর আত্মকাহিনী- দ্বিতীয় খন্ড
♦ মোসলেম সমিতিঃ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতা (১৩৩৬-১৩৪১)
♦ ইঞ্জিনিয়ারিং শিখার উদ্যোগ ও মাতৃবিয়োগ (১৩৩৯)
♦ ভিখারীর আত্মকাহিনী- তৃতীয় খন্ড
♦ বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর শিক্ষা
♦ অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সান্নিধ্যে
♦ ভিখারীর আত্মকাহিনী- পঞ্চম খন্ড
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ