আমাদের দেশ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত। এদেশে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার। সংবিধানের দেওয়া এই অধিকার রক্ষায় সদা সতর্ক কেন্দ্রীয় সরকারের ও রাজ্য-সরকারের প্রশাসন বিভাগের আমলারা ও পুলিশরা। এখানে লৌহযবনিকার অন্তরালে মানুষের কন্ঠ রুদ্ধ করা হয় না। এ’দেশের মানুষ খাঁচার পাখি নয়, বনের পাখির মতোই মুক্ত। এ’দেশে সর্বোচ্চ পদাধিকারী রাষ্ট্রপতি আর ওড়িশার কালাহান্ডির মানুষগুলো একই অধিকার ভোগ করে, চুলচেরা সমান অধিকার।

এই ধরনের প্রতিটি কথাকে বর্বর রসিকতা বলেই মনে হয় যখন দেখি, কালাহান্ডির মানুষগুলো দিনের পর দিন ক্ষুধার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে প্রতিবাদহীনভাবে মৃত্যুকে মেনে নিল, আর তারই সঙ্গে মৃত্যু ঘটল একটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকারের। এ-সব আপনজন হারা বহু মানুষের হৃদয়কে দুমড়ে-মুচড়ে রক্তাক্ত করে। এই রক্তাক্ত হৃদয়গুলোই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে, যখন দেখে শোষকশ্রেণীর কৃপায় গদিতে বসা কতকগুলো রাজনীতিক ঐ একই সময় রাষ্ট্রপতির গণতান্ত্রিক অধিকারসম্মতভাবে দেওয়া ছত্রিশ কোর্সের ভোজসভায় কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে করতে ভারতবর্ষকে ‘সুমহান গণতন্ত্রের দেশ’, ‘সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ’ ইত্যাদি বলে কদর্য বর্বর রসিকতা আছে।

প্রতিটি গণতান্ত্রিক অধিকারই বিড়লা, আম্বানিদের
সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয়েছে রাস্তার ভিখারিটিকে পর্যন্ত।
পার্থক্য শুধু রাষ্ট্রশক্তির অকরুণ সহযোগিতায়
বিড়লা, আম্বানিদের অধিকারের হাত ব্যস্ত থাকতে গিয়ে
ভিখারীর অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করতেই
শুধু ভুলে গেছে রাষ্ট্রের প্রশাসন- এই যা।

এদের আইন-কানুন ও নাগরিকদের অধিকারগুলো তৈরি করেছেন ধনিকশ্রেণীর দালাল সাংসদ ও বিধায়করা, রাজনৈতিক দলগুলো। স্বভাবতই সাধারণভাবে আইনের ধারাগুলো তৈরি হয়েছে ধনকুবেরদের স্বার্থকে পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে।

সংবিধান এ’দেশের মানুষদের খাতায়-কলমে যে’টুকু অধিকার দিয়েছে সেই অধিকারগুলো বহিরঙ্গের দিক থেকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংসদ ও বিধায়কদের একটা নিরপেক্ষ চরিত্র খাড়া করতে সচেষ্ট হলেও বাস্তব চিত্র কিন্তু তা নয়। আইনগুলোর মূল ঝোঁক ধনীদের স্বার্থকে রক্ষা করা। এই মূল ঝোঁককে আড়াল করতেই নিরপেক্ষতার ভান।

সংবিধান এ’দেশের মানুষদের-কে অধিকার দিয়েছে, সেই অধিকার বাস্তবিক পক্ষে কতটুকু সংবিধানের পাতা থেকে বাস্তবে নেমে এসেছে?

আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য হল জনজীবনের মানোন্নয়ন, জনগণের জন্য খাদ্য, পানীয়-বাসস্থান-শিক্ষা ও পুষ্টির ব্যবস্থা এবং এসবের মধ্য দিয়ে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি। ভারতীয় সংবিধানের ৪৭ নম্বর ধারা-এর ২৪৬ নম্বর সম্পর্কিত ৭ নম্বর তফসিলের রাজ্য তালিকায় ৬ নম্বর সূত্রে আছে, জনজীবনের মানোন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতির কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করবে রাজ্য সরকারগুলি। সরকারের এই নীতি অনুসারে রাজ্যসরকারগুলো নিজ উদ্যোগেবিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য কিছু হাসপাতাল স্থাপন করেছে। জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় এই সরকারি বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা খুবই কম। জনগণ যখন বিনামূল্যে চিকিৎসা গ্রহণের সরকারি ব্যবস্থাকে আপন অধিকার হিসেবে ভাবতে শুরু করল, তখন দুর্নীতি ও ভুল অর্থনীতির জালে জড়িয়ে পড়া দেউলিয়া সরকার প্রমাদ গুনল। জনসাধারণের সংখ্যাগুরু অংশ বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার দাবি করলে এই আর্থিক কাঠামোয় সে অধিকার দেওয়া যাবে না। কারণ, একদিকে অর্থসঙ্কট, আর একদিকে শোষণ প্রক্রিয়াও কিছুটা ব্যাহত হয়। আবার জনগণ যেভাবে উত্তরোত্তর বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার দাবি করছে, সেই দাবিকে পুরোপুরি অমর্যাদা করলে ভোট-নির্ভর রাজনীতিতে গদি বাঁচানোই অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই সঙ্কট শুধু ভারতে নয়, ভারতের মত অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই। এইসব দেশের শোষিত জনগণ যাতে চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার আদায়ের দাবিতে অতিমাত্রায় সোচ্চার না হয়ে ওঠে এবং সেই অধিকার আদায়ের লড়াই অন্যান্য অধিকার আদায়ের লড়াইতে নামতে যাতে উদ্বুদ্ধ না করে, সে দিকেই লক্ষ্য রেখে বিশ্বের শোষকদের একচ্ছত্র নেতৃত্বের অধিকারী দেশগুলো (যারা সম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত) নিপীড়িত জনগণের চেতনাকে অন্য দিকে ঘোরাতে চাইল। আর চাওয়ার প্রয়োজনেই

শোষিত জনগণের মগজ ধোলাইয়ের উদ্দেশ্যে
রচিত হল চিকিৎসা নীতির বদলে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতি।
ঘোষিত হল জনস্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মসূচি-
“২০০০ সালে সবার জন্য স্বাস্থ্য।”

ঘোষিত জনস্বাস্থ্য নীতি নিশ্চয়ই সুন্দর। ভারত সরকার ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার জন স্বাস্থ্য নীতি গ্রহণ করেছেন এবং কার্যকর করতে চাইছেন- এ খুবই ভালো কথা। কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যায়, জনগণের দৃষ্টি চিকিৎসা গ্রহণের অধিকারের দিক থেকে ঘোরাতেই, চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড় থেকে কমাতেই স্লোগান-সর্বস্ব এই জনস্বাস্থ্য নীতি হাজির করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি অবশ্যই স্বাগত জানাবার মত- কারণ, শোষিত জনসাধারণের সার্বিক খাদ্য, পানীয় জল, শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থানের দাবি। কিন্তু একি বাস্তবিকই বিশ্বাসযোগ্য যে সরকার জনগণের এই সার্বিক দাবীগুলো মিটিয়ে দেবে? তাহলে তা শোষণের মন্ত্রটাই বিদায় নেবে। যুক্তি-তর্কের বাইরে যদি ধরেও নেওয়া যায় সরকার জনস্বাস্থ্যের নীতি কখনোই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে না। কারণ, দেশে রোগী থাকবে, চিকিৎসার প্রয়োজনও থাকবে। রোগীকে রোগমুক্ত করতে চিকিৎসারই প্রয়োজন এবং ‘জনস্বাস্থ্য’ কখনোই ‘চিকিৎসা’র সমার্থক নয়।

৯৪-এর শেষভাগে পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকার এক ঐতিহাসিক ঘোষণা রাখলেন সরকারি ও সরকার সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে এবং প্রাইভেট স্কুলগুলোতে পর্যায়ক্রমে চালু হবে ক্লাস ওয়ানে লটারি করে ভর্তির ব্যবস্থা। গত কয়েক বছর ধরে যে ভাবে বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মার্কসবাদী মন্ত্রী শান্তি ঘটক থেকে অসীম দাশগুপ্ত পর্যন্ত জ্যোতিষ সম্মেলনগুলোতে দ্গদ্গদ শুভেচ্ছাবাণী পাঠাচ্ছিলেন, তা যে ওইসব মন্ত্রীদের কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, তা পরিষ্কার হয়ে গেল শিক্ষার শুরুতেই শিশু মনে ভাগ্য বিশ্বাসকে মাথায় পেরেক ঠুকে ঢুকিয়ে দেওয়ার এই মার্কসীয় বিপ্লবী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।

মাননীয় মার্কসবাদী মন্ত্রীরা সাধারণ মানুষকে দেওয়া সংবিধানের অধিকারকে লঙ্ঘন করলেন বললে কম বলা হবে, আসলে বলাৎকার করলেন। সংবিধানের দেওয়া অধিকার মতই রাজ্য সরকার বাধ্য, হ্যাঁ অবশ্যই বাধ্য প্রতিটি নাগরিক ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে।

সংবিধান স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, কোনও ক্ষেত্রেই, হ্যাঁ কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশের অধিকার নেই কোনও মানুষকে হত্যা করার, আইন স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, কোনও আন্দোলন, মিছিল বা বিক্ষোভ দারুণ রকম উগ্র হয়ে উঠলে, জাতীয় বা নাগরিকদের সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করলে পুলিশ শূন্যে গুলি চালাতে পারে, উত্তেজিত জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। পুলিশ যদি সরাসরি শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়, যে আক্রমণে প্রাণহানির আশঙ্কা আছে, শুধুমাত্র সেইক্ষেত্রেই পুলিশ আক্রমণকারীদের শরীর লক্ষ্য করে গুলি করতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই পুলিশের গুলির লক্ষ্য হবে শরীরের নিম্নভাগ। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- যাতে গুলিতে প্রাণহাণী না ঘটে। শরীরের উপরের দিক গুলি চালানোর ফলে মৃত্যু ঘটলে গুলি যে পুলিশ চালিয়েছে তাকে সরাসরি হত্যার অভিযোগ অভিযুক্ত করা হবে।

গুলি চালানোর ক্ষেত্রে সংবিধানের এই অধিকার কবে কোথায় আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে পেরেছে? শিয়ালদহ স্টেশনে শাটার বন্ধ করে যাত্রীদের শরীরগুলোকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার পর গুলি চালাবার আদেশ দেওয়া সুলতান সিং গর্বিত ঘোষণা করেন- বেশ করেছেন। সুলতান সিংও হত্যাকারী অন্যান্য পুলিশদের ক’জনকে হত্যার অপরাধে ফাঁসিতে চড়াতে পেরেছে বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করতে পেরেছে আমাদের সংবিধান?

আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা আজ পুলিশের অধিকারে পরিণত হয়েছে। এই অসাংবিধানিক অধিকার কি করে লাগাতারভাবে তাদের কাজ করে চলে? রাষ্ট্রযন্ত্র কি তবে সংবিধানকে হাগা-মোছার কাগজের বাড়তি কোনও গুরুত্ব দেয় না?

এ’দেশের সংবিধানের অনেক অধিকারই এমনি এমনি আসেনি। সংগ্রাম ছাড়া আসেনি। যে সব অধিকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আদায় করা গেছে তার বাইরেও বহু অধিকারই অধরা রয়ে গেছে, যেগুলো পাওয়ার জন্য মানুষ লড়াই চালিয়েই যাচ্ছে। মানবিকতার বিকাশের জন্য মানুষের যে যে অধিকার একান্তই প্রয়োজন, তা আজও দেয়নি আমাদের দেশে ভারত-এর রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার। আজও এ-দেশের মানুষের অধিকার নেই মাথা গোঁজার ছোট্ট ঠাইটুকু পাওয়ার। দু-মুঠো ভাত দু’টো রুটি- একটু ত্যানা জোটাবার জন্য চাকরির অধিকারও আমাদের সংবিধানে নেই। অধিকার নেই সাংসদরা বা বিধায়করা জন-বিরোধী কাজে জড়িত থাকলে বা অঞ্চলের দিকে বিন্দুমাত্র বিকপাত না করলেও তাকে ফিরিয়ে আনার। আমরা আজ যে মানুষের অধিকারগুলো রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছি তা স্পষ্টতই খর্বিত অধিকার।

(রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আপনার অধিকারকে জানতে পড়ুন ‘সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ’। আপনার অধিকার না জানলে আপনি অধিকার রক্ষা করবেন কি করে?)

এই খর্বিত অধিকার রক্ষার কাজ প্রশাসনের। প্রশাসনকে সাহায্য করতে জনসেবার জন্যই পুলিশ। কিন্তু এই আদায় করা খর্বিত অধিকারের কতটুকু সাধারণ মানুষ ভোগ করেন? কতটুকু আপনি ও আপনার পরিচিত সাধারণ মানুষজন ভোগ করেন? আপনার অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে আপনি কাঁটায় কাঁটায় বিচারে নামুন, দেখবেন আপনার অধিকার প্রতিটি দিন কি বিপুলভাবে খর্বিত হচ্ছে। এই ‘মেরা ভারত মহান’ স্লোগানের দেশটিতে বাস, মিনিবাস, লরির চাকা ঘোরাবার অধিকার কিনতে প্রথমেই উপুড়হস্ত করতে হয় মটোর ভেহিকলস-এর দপ্তরে, তারপর রফায় আসতে হয় পুলিশের সঙ্গে। কোনও মানুষের অধিকার নেই পুলিশ ও রাজনৈতিক মস্তানদের সঙ্গে রফা না করে ফুটপাত দখল করে আনাজ বেচে, কি কামিজ বেচে নিজের বেঁচে থাকার খোরাক তুলবে। এখানে শেষ সম্বল ভিটে-মাটিটুকু বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে গেলেও রাজনৈতিক দাদাদের হাতে কিছু তুলে দিতে হবে। ভাড়াটে তুলবেন, ভাড়াটে বসাবেন, সর্বত্র আপনার আইনি অধিকার ছেঁটে ছোট করতে হবে পাড়ার রাজনীতিকদের সঙ্গে আপোষ করতে গিয়ে। আপনি আপনার আইনি অধিকারে কাজ পাবেন না। ইনকামট্যাক্স অফিসে, সেলসট্যাক্স অফিসে, মহাকারণে, মিউনিসিপ্যালিটিতে, কর্পোরেশনে, বিচারালয়ে। সর্বত্র দুর্নীতির বিশাল হ্যাঁ। এ’দেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, হাইকোর্টের আইনজীবীরা হাইকোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আন্দোলন করেন- আত্মীয় আইনজীবীদের কেসগুলোকে পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে জিতিয়ে দেওয়ার। এদেশে আইনি অধিকার ছেঁটে কিঞ্চিৎ মুদ্রা হাজির করলে তবেই কাজ মেলে, মেলে ব্যাংক লোন, টেন্ডার, পারমিট, পাস হয় বিল, পাস হয় দূরদর্শনের কাহিনী, স্কুল-কলেজে অ্যাডমিশন, কি নয়? জনগণের পাঁচ হাজার কোটি শেয়ার ব্রোকারদের ছোঁয়ায় অদৃশ্য হওয়ার পিছনে অর্থ দপ্তরের ও ব্যাঙ্কের প্রশাসকদের অকুন্ঠ সহযোগিতা যে কাজ করেছিল, সে প্রমাণ মেলার পর অনেক প্রশাসক বিদায় নিয়েছেন, অনেকে নেননি।

কোথায় প্রশাসন, আরা রক্ষা করবে নাগরিকদের অধিকার? প্রতিটি অফিসেই প্রশাসকদের প্রায় একই চেহারা। সোনায় সোহাগা’র মতই দুর্নীতির সঙ্গে প্রশাসকদের অপূর্ব সহাবস্থান।

এইসব প্রশাসকদের কাজ হল ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করা। আর সেই ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিটি গোটা বা আধা-মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই। এঁরা মন্ত্রীর অনুরোধকে ‘আদেশের বাপ’ মানেন। আর তেমন অনুরোধ রাখতে কোন ব্যাটার অধিকার কতটা কাটা পড়ল, দেখতে বয়েই গেছে প্রশাসকদের। প্রশাসক নীতিবাগীশ হলে মন্ত্রীর চলে না। ঠোকাঠুকি অবশ্যম্ভাবী। পরিণতিতে ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’। প্রশাসক আউট অথবা কোণঠাসা। মন্ত্রীর দপ্তরের বশংবদ প্রশাসকরা তাই করেন, যা মন্ত্রী চান। মন্ত্রী তাই করেন, যা ধনকুবেররা চান। আপোষ আর দেওয়া নেওয়ার শাঁসে-জলে পুষ্ট হন প্রশাসকরা।

এ’দেশে বহু বিত্তবানই, বহু জোতদারই প্রশাসনকে ট্যাঁকে গুঁজে রেখে নিজেদের অধিকারের হাতকে দীর্ঘতর করতে সেনা বা বাহিনী পোষে। এইসব বিনা লাইসেন্সের আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর নামগুলিও নানা বিচিত্র ধরনের- ভূমিসেনা, লোরিকসেনা, ব্রহ্মর্ষিসেনা, এমনি আরও কত নাম। সেইসব বাহিনীর হাতে নিত্যই নিপীড়িত, খেটে খাওয়া মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার লুন্ঠিত হচ্ছে। সামান্য ইচ্ছায় এরা গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, লুটে নেয় মহিলাদের লজ্জা। আর নির্লজ্জের মত সরকার প্রশাসন দেখেও অন্ধ হয়ে থাকে। এই উগ্রপন্থী নরখাদকদের কঠোর হাতে দমন করতে কখনোই তো এগিয়ে আসে না সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, সেনা? কোন গণতান্ত্রিক অধিকারে এই সব সেনাবাহিনী পুষে চলেছে হুজুরের দল? নিপীড়িত মানুষদের দাবিকে দাবিয়ে রাখতে ওদের সেনাবাহিনী পোষা যদি গণতন্ত্র-সম্মত হয়, উগ্রপন্থা না হয়, তবে অত্যাচারিত মানষদের অধিকার রক্ষার জন্য সেনা গঠন অগণতান্ত্রিক ও উগ্রপন্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।

আমাদের দেশের গণতন্ত্র-বীরভোগ্যার গণতন্ত্র। যার যত বেশি ক্ষমতা, যত বেশি অর্থ, যত বেশি শক্তি, তার তত বেশি বেশি গণতন্ত্র। শোষকদের অর্থে গদিতে আসীন হয়ে শোষক ও শোষিতদের সমান গণতান্ত্রিক অধিকার বিলানো যায় না। শাসক ও শোষকরা শুধু এই অধিকারের সীমা ভঙ্গই করে পরম অবহেলে ; আর শোষিতদের অধিকার বার বার লাঞ্ছিত হয়- এ অতি নির্মম সত্য। আপনার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন ; তাহলেই দিনের আলোর মতন পরিষ্কার হয়ে যাবে ‘গণতন্ত্র’ আছে দেশের সংবিধানের ও বইয়ের পাতায়, গরিবদের জীবনে নয়।

যে দেশের মানুষের
দু’বেলা পেট ভরে খাওয়ার অধিকার নেই,
বেঁচে থাকার অধিকার নেই, চিকিৎসার সুযোগ সুবিধে
গ্রহণের অধিকার নেই, শিক্ষালাভের সুযোগ সুবিধে গ্রহণের
অধিকার নেই, সেখানে বিড়লা, আম্বানি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী
আর গরিব মানুষগুলোর সান গণতান্ত্রিক অধিকার এই
সমাজ-ব্যবস্থায় কোনও প্রশাসকই দিতে পারবে না।

‘মেরা ভারত মহান’ স্লোগানকে বিশাল এক ঠাট্টায় পরিণত করেছে নাগরিক অধিকারের রক্ষক, জনগণের সেবক এ’দেশের পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাহিনী অতি স্পষ্টতই আজ সবচেয়ে সংগঠিত গুন্ডা বাইনী। এই বাহিনী প্রতিটি সংগঠিত অপরাধের পৃষ্ঠপোষক। প্রতিটি থানাতেই আড্ডা দিতে আসে মস্তান, খুনে, ছেনতাইবাজ, ওয়াগন বেকার, চোর, ডাকাত, ধর্ষক, ভেড়ির লুটেরা, জমির বেআইনি দখলদার, বাড়ির প্রমোটার, নানা শ্রেণীর দালাল, সিনেমার ব্ল্যাকার ও রাজনীতি জগতের মানুষগুলো। পুলিশ আজ প্রতিটি অপরাধের আঁতি-পাতি খবর রাখে।। ‘হিস্যা’ আদায়ের জন্যেই এলাকার প্রতিটি অপরাধীদের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতে হয়। হিস্যা’র বিনিময়ে তাদের অপরাধের পথ নিষ্কন্ঠক রাখতে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। এমন কি এও হয়, অপরাধের পথ থেকে ফিরতে চাওয়া অপরাধীদের ভয় দেখিয়ে আবার অপরাধ করতে বাধ্য করে। ওরা সীমান্ত চোরাকারবারিদের দেখভাল করে। কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন তাদের সারা জীবনের মত চুপ করিয়ে দিয়ে আসে।

পুলিশকে জনগণের সেবক মনে করে, এদেশে এমন একটি মানুষও খুঁজে পাবেন না।

আমাদের, সাধারণ মানুষদের বিশ্বাসের অণুতে-পরমাণুতে মিশে রয়েছে “পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা”। পুলিশ অভিযুক্তকে থানায় নিয়ে গিয়ে পেদিয়ে বাবার নাম না ভুলিয়ে ছেড়েছে, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের দেশের শহর-গাঁয়ের মানুষদের হয়নি। গোটা দেশেরই একটি রাজ্য পশ্চিমবাংলাকে প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়েই গত কয়েকতা বছরের ইতিহাসের দিকে একটু চোখ বোলাই আসুন। পশ্চিমবাংলায় শুধুমাত্র বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ১৯৯২-এর নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ কাসট্যাডিতে (custody) বা হেফাজতে অভিযুক্ত মারা গেছেন ১৩৬ জন। Custody কথার অভিধানগত অর্থ ‘নিরাপদ তত্ত্বাবধানে বা হেফাজতেই বড় হয় পরম নিশ্চিন্তে, তদন্ত চলাকালীন তেমন নিশিচিতেই পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্তের থাকাটা আইনমাফিক স্বাভাবিক। সেই আইনকে ভঙ্গ করে পুলিশ যে বর্বরোচিত নির্যাতন অভিযুক্তদের ওপর চালায়, তা অভিজ্ঞতাহীন মানুষদের পক্ষে কল্পনা করা একেবারেই অসম্ভব। অথচ ১৬৩ নম্বর ফৌজদারী দন্ডবিধি মত পুলিশ কখনোই কোনও অভিযুক্তকে মারধর তো করতে পারেই না, এমন কি হুমকি বা ভয় পর্যন্ত দেখাতে পারে না। এই আইনটি সহ প্রতিটি আইনের রক্ষক হল পুলিশ। একই সঙ্গে সংবিধান অনুসারে পুলিশ আইনের অধীন। অর্থাৎ কোনও অবস্থাতেই সে আইনকে ভঙ্গ করতে পারে না। ভঙ্গ করলে সেও অবশ্যই অপরাধী, শাস্তি-যোগ্য অপরাধী। কিন্তু আপনার-আমার অভিজ্ঞতা কি বলে? পুলিশ নিজেই আইন মানে না। প্রতিটি মুহূর্তে আইনের রক্ষকদের হাতেই আইন লংঘিত হচ্ছে। লরি আর বাসের ঘুসে সন্তুষ্ট নয়। চোরাকারবারি, ভেজালদার, ডাকাত, মস্তান, ড্রাগ ব্যবসায়ী, বিল্ডিং প্রমোটার, সবার সঙ্গেই আজ থানা ও পুলিশকে দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক। আইন ভঙ্গকারীরা আইনের রক্ষকদের ছত্র-ছায়ায় আইন ভাঙছে। আইনের রক্ষকরা আইনের মুখে নিত্য প্রতিটি প্রহরে লাথি কষিয়ে বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের রক্ষকের ভূমিকা নিছে। বার-বার তাই পুলিশকে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বয়কট করেছে জঘন্য সমাজবিরোধী বিবেচনায়, চূড়ান্ত ঘৃণায়। এলাহাবাদ আদালতের বিচারপতির ভাষায় “পুলিশ মানে সবচেয়ে সংগঠিত গুন্ডাবাহিনী।“

প্রসঙ্গতে ফিরি- পুলিশ হেফাজতে মৃত ১৩৬ জনের জন্য কতজন পুলিশকে সরকার শাস্তি দিয়েছে? একজনকেও না। তবে কি ওইসব মৃত্যুর জন্য পুলিশ দায়ী নয়? সকল অভিযুক্তই কি তবে আত্মহত্যা করেছিলেন? একটু চোখ বোলান পৃথিবীর আরও কিছু দেশে, এই যেমন সাউথ আফ্রিকা থেকে শুরু করে ফৌজি একনায়ক শাসিত দেশগুলোতে, দেখবেন ও-সব দেশেও পুলিশ হেফাজতে অত্যাচার সহ্য করার শক্তি হারিয়ে লোকে মারা যায়। ওসব দেশের সরকারও এ’দেশের সরকারের মতই পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তো দূরের কথা, কোনও অভিযোগই আনে না।

পুরনো প্রসঙ্গে একটু ফিরে তাকাই। এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ হেফাজতে ১৩৬ জন অভিযুক্তকে হত্যা করা হল। আইনের রক্ষকদের হাতেই আইন ধর্ষিত হল, মানবাধিকার একটা বিশাল তামাশায় পরিণত হল, তবু রাজ্য সরকার একজনকেও শাস্তি দিল না। যেখানে শাস্তি হয়েছে সেখানেও দেখা গেছে অত্যাচারিতের আপনজনেদের চেষ্টায় আইনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পথে এই শাস্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।

গত দশ বছরে পশ্চিমবাংলায়, কেবল মাত্র পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণ ও নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে ৪৩টি। ১৯৮৭-র জুলাইতে তারকেশ্বর থানার কনস্টেবল তারই সহকর্মী মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। এদের কতজনের শাস্তি হয়েছে? শুধুমাত্র একজনের কথা জানি, ৯১ সালে মেদিনীপুর জেলার ভগবানপুরের কায়দা বিবিকে থানায় এনে শ্লীলতাহানির প্রমাণে বড়বাবুর একবছর সশ্রম কারাদন্ড হয়েছে। বাকিদের?

শিক্ষিকা অর্চনা গৃহকে পুলিশ লালবাজারে নিয়ে এসেছিল। উদ্দেশ্য-অর্চনাকে জেরা করে তাঁর নকশাল ভাইয়ের খোঁজ জানা। আইনের রক্ষকরা জেরা করতে পারেন, কিন্তু কোনও ভাবেই পারেন না জেরা করে কথা আদায় করার নামে, কোনও মানুষকেই মারধর করতে, ভয় দেখাতে, এমন কি লোভনীয় কোনও টোপ দিতে। ভারতীয় সংবিধানের ফৌজদাড়ি দন্ডবিধি অনুসারেই এ-সবই বেআইনি। আইন ভাঙ্গলে পুলিশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করবে। কিন্তু আমরা অভিজ্ঞতায় কি দেখলাম? বর্বরোচিত ও অশ্লীল অত্যাচারে অর্চনা পঙ্গু হয়ে গেলেন। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে তিনি অত্যাচারী পুলিশ অফিসার রুণু গৃহনিয়োগীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চালাচ্ছেন ন্যায়বিচারের আশায়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আশায়। কলকাতা পুলিশের ‘রেগুলেশন’ অনুসারে এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেই নির্দেশকে অবহেলা করে রাজ্য সরকার ক্রমান্বয়ে রুণু গুহনিয়োগীর পদোন্নতিই ঘটিয়ে গেছে। এ সবই কি মানবাধিকারকে সরকার কর্তৃক লঙ্ঘনেরই প্রমাণ নয়?

৯২-এর শেষ অর্ধে রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় পাঞ্জাব পুলিশ কলকাতার একবালপুর অঞ্চল থেকে দু’জনকে গ্রেপ্তার করলেন “সন্ত্রাসবাদী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ নিবারক আইন” (TADA)-এ। ওদের বিমানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল পাঞ্জাবে। দুই নিরস্ত্র মানুষকে বিমান থেকে নামিয়ে পুলিশ তাদের গুলি করে হত্যা করলো। এই তো এই দেশের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। হত্যাকারী পুলিশদের পুলিশদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, হবে না। রাষ্ট্রশক্তি স্বয়ং আজ সন্ত্রাসবাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, আইন ভঙ্গকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, মানবাধিকার ধর্ষণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ।

লেখার এই অংশটা পড়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন- শিখ উগ্রপন্থীরা যখন নিরীহ মানুষদের হত্যা করে, তখন? সে বিষয়ে কি মতামত দেবেন? না কি মুখ বুজে থাকবেন?এ-জাতীয় প্রশ্ন ওঠে, বার-বারই ওঠে। প্রশ্নকর্তারা কখনো ব্যক্তি, কখনো বুদ্ধিজীবী, কখনো রাজনীতিক, কখনো পত্র-পত্রিকা, কখনো রাষ্ট্রশক্তি। হুজুরের দল ও তার কৃপাধন্যেরা বারবার এমন প্রশ্ন তুলে সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে নিজেদের বেআইনি কাজের প্রতি জনমত তৈরি করতে চায়, জন-বিক্ষোভ এড়িয়ে মানুষের অধিকারকে ছিনিয়ে নিতে চায়। যারা সরকার-ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী, তারা যখনই কোনও নিরীহ বা অ-নিরীহকে হত্যা করছে তখনই দেশের আইন ভঙ্গকারী। শাস্তির স্পষ্ট বিধান দেওয়াই আছে। এবং সেই আইনমাফিক শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রশক্তির আছে। রাষ্ট্রশক্তি সেই আইন মাফিক না চলে আইনকে ভঙ্গ করে যা করছে তা অবশ্যই বে-আইনি, তা অবশ্যই রাষ্ট্র-সন্ত্রাস, তা অবধারিতভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘন।

পুলিশ বার বার দুর্নীতি চালিয়েও পার পেয়ে যায়, কারণ পুলিশ সমাজ কাঠামো বা সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। পুলিশরা আইনের রক্ষার জন্য পরিচালিত হয়, সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলের ইচ্ছের দ্বারা পরিচালিত হয়। নির্বাচনে রিগিং হলে কখনো চোখ বুজে থাকে, কখনো বা সরকারের পক্ষে রিগিং পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে- এ’সবই তো আপনি, আমি, আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি।

এইসব জঘন্যতম কাজ-কর্ম, অত্যাচার ও দুর্নীতি ‘পুলিশ’ নামক সবচেয়ে সংগঠিত সরকারী গুন্ডাবাহিনীকে চালাতে দেওয়া হয়, বিনিময়ে তারা এই অসাম্যের ও দুর্নীতির পক্ষে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত ব্যক্তিদের হত্যাকারীর ভূমিকায় বার-বার তাদের নিষ্ঠুরতা ও দক্ষতাকে প্রমাণ করেছে।

শোষকশ্রেণীর ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিটি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির ওপর যথেষ্ট নজর রাখে রাষ্ট্রশক্তির। সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের রয়েছে বহু বিভাগ। আমাদের রাজ্য সরকারের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টেরই রয়েছে তিরিশের ওপর বিভাগ বা সেল। ছাত্র, রাজনৈতিক দল, দেশের মানুষের যথার্থ স্বার্থ রক্ষায় সংগ্রামী সংগঠন ইত্যাদি প্রত্যেকটা বিভাগের উপর নজর রাখার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা সেল। গোয়েন্দারা এইসব সংগঠনগুলোর উপর নজর রাখেন।

প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীরা গোয়েন্দাদের সাহায্যে তাদের নিজেদের দলের ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের উপর নজর রাখেন, নিজের গদিটিকে নিষ্কন্টক রাখতে। বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনের হাল-চালের খবর রাখেন, প্রয়োজনে কৌশল হিসেবে কোনও কোনও আন্দোলনকে বাড়তে দেন। অনেক ক্ষেত্রে এইসব আন্দোলন শোষিত মানুষদের ক্ষোভকে বের করে দেওয়ার সেফটি ভাল্বের কাজ করে। কিন্তু যখন গোয়েন্দা দপ্তর থেকে খবর মেলে কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা সংগঠন বর্তমান সমাজ-কাঠামো বা সিস্টেমের পক্ষে বিপজ্জনক, তখন পুলিশ হয়ে ওঠে আইন লঙ্ঘনকারী, চরম নিষ্ঠুর অত্যাচারী ও হত্যাকারী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে প্রথম যাদের সন্ত্রাসকারীর ভূমিকায় নামানো হয়, তারা হল পুলিশ।

বিরোধী আসনে বসে পুলিশের বিরুদ্ধে গরম গরম কথা বলা রাজনীতির মানুষগুলোই গদিতে বসার অধিকার যখনই পেয়েছে, তখনই আন্তরিকতার সঙ্গেই চেয়েদছে, পুলিশ থাক সংগঠিত গুন্ডাবাহিনী হয়েই, পুলিশ থাক দুর্নীতির নেশায় মশগুল হয়ে। আর এই দুর্নীতিই পুলিশকে করে তুলবে জনগণের সেবকের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের সেবক। ইতিহাস বার বার সেই সত্যকেই আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। আসুন ইতিহাস থেকে এক-আধটা উদাহরণ একটু নেড়ে-চেড়ে দেখি।

১৯৭০ থেকে ৭৬-এ কংগ্রেস সরকারের আমলে জেলখানায় ৪০০ বন্দী হত্যা হয়েছিল। কলকাতার কাশীপুর বরাহনগরে এক দিন-রাতের অভিযানে হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল। স্থানীয় মানুষ দেখেছে ঠেলায় চাপিয়ে গাদা করে কিভাবে গঙ্গায় ঢেলে দিতে চাপানো হচ্ছে মানুষের দেহগুলোকে। ৭৭-এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের জামানা (৭০-৭৭)-র নায়কদের শাস্তি দেবেন। ৯২-এর শেষে দাঁড়িয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন-কতজন হত্যাকারীর শাস্তি হয়েছে? উত্তর পাওয়া যাবে না।

ক্ষমতায় সিংহাসনে যে চারটি পায়া,
তারই একটি হল পুলিশ।
অতএব বিরোধী পক্ষে থেকে আইনভঙ্গকারী পুলিশদের বিরুদ্ধে
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যতটা সোজা,
ক্ষমতার সিংহাসনে বসে শাস্তি দেওয়া ততটাই কঠিন।

অতীত ইতিহাসের দিকে একটু চোখ বোলালে দেখতে পাব, ব্রিটিশ সরকারের বিনা-বিচারে আটকের বিরোধিতা করেছিল কংগ্রেস। কংগ্রেস বই প্রকাশ করেছিল, “পুলিশরাজ আন্ডার ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া”। ব্রিটিশ বিদায় নিতে ক্ষমতার সিংহাসন বসে কংগ্রেস সেই ‘পুলিশ-রাজ’-কেই বরণ করল।

মূলায়েম সিং যাদব সরকারের আমলে উত্তরপ্রদেশ সরকার সরকারি সিমেন্ট কারখানা বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চাইল। প্রতিবাদ জানাল শ্রমিকেরা। পুলিশ গুলি চালিয়ে ১৫ জন শ্রমিককে হত্যা করলো। ভারতীয় জনতা পার্টি ঘোষণা করল, “কাল আমরা শাসন ক্ষমতায় এলে যারা গুলি চালিয়ে নিরীহ শ্রমিকদের হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি দেবই।“ তারপর উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতার সিংহাসনে বসলো ভারতীয় জনতা পার্টি এবং সিংহাসনের একটি পায়া পুলিশরাজকে ঠিক-ঠাক রাখতে জনগণের সামনে ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল আস্তাকুড়ে।

এই সিস্টেম এমনটাই ঘটবে তা সিংহাসনে প্রতিবিপ্লবী বসুক, কি অতিবিপ্লবী।

প্রায় প্রতিটি দেশই সেনাবাহিনী পোষে প্রতিরক্ষার নামে। জাতীয় আয়ের একটা বিরাট অংশ সেনা-খাতে ব্যয় করে। এবং ইতিহাস থেকে লাগাতার ভাবে দেখেই চলেছি, কি ভাবে সরকার বার বার তার সেনাবাহিনীকে দেশের মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়েই চলেছে। ইংরেজি পত্র-পত্রিকা ও টিভিতে বি.বি. সি. দেখার সুযোগ যারা পান, তাঁরা প্রায়ই এই ধরনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হন।

 এ’দেশের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন সেনাবাহিনী সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে বিদ্রোহী দেশবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছে পূবে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে। বাস্তবিকই তাই, নাগাল্যান্ড-মেঘালয় ও তার আশেপাশের অঞ্চলে, পাঞ্জাবে, জম্বু-কাশ্মীরে ও অন্ধ্রে, সর্বত্রই সেনা-সন্ত্রাস। আমি এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের আন্দোলনগুলোর প্রতি কোনও ভাবেই সমর্থন বা অসমর্থন প্রকাশ করছি না। এই ঘটনার উল্লেখের মধ্য দিয়ে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরতে চাইছি একটি বাস্তব সত্যকে- সেনাবাহিনী হল ‘সিস্টেম’ বা ‘সমাজ-কাঠামো’ রক্ষার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও শেষ শক্তি প্রয়োগের ধাপ।

‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ জাতীয় সভা-সমিতি অনেক মিছিল-টিছিল আমরা দেখেছি। তাতে শামিল হতে দেখেছি সংসদের বহু বিরোধী দল ও তাদের ছাত্র যুব সংগঠনগুলোকে। নামতা পড়ার মত আউড়ে যেতে দেখেছি যুদ্ধের বিপক্ষে ও শান্তির পক্ষে গরম গরম কথা। ওরা শুনিয়েছেন, ধনবাদী-রাষ্ট্রশক্তি ও অস্ত্রব্যবসায়ীদের আপন প্রয়োজনে কি ভাবে নির্ধন মানুষগুলোর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধ। সম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত ভেঙ্গে দেবার, গুঁড়িয়ে দেবার শপথ-বাক্যগুলো দু’কান দিয়ে ঢোকে বটে, কিন্তু মস্তিষ্ক কোষকে প্রভাবিত করতে পারে না, ভাসা-ভাসা থেকে যায়।

কারা সম্রাজ্যবাদী? কাদের চিহ্নিত করব ধনবাদী রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে? যুদ্ধবাজ দেশ হিসেবে কাদের গায়ে মারব শিলমোহর? প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ খাতে যারা বাজেট বাড়িয়েই চলে, তাদের বিরুদ্ধে কতখানি সোচ্চার হবো?

এইসব সোজা-সাপ্টা প্রশ্নের উত্তর দিতেও হাঁস-ফাঁস করেন। ‘যুদ্ধ-শান্তি’র প্রবক্তা নেতারা। এইসব নেতাদের ভোটার তোষণের কথা মনে রাখতে হয়, তাই সদা সত্য কথা বলার বিলাসিতা এঁরা দেখান না। ফলে এইসব কেন্দ্রের তখৎ-এ না বসা শান্তির পায়রা ওড়ানো নেতারা কোনও দিনই সত্যের খাতিরেও উচ্চারণ করতে পারেননি, মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চক্রান্ত শুধু মার্কিন হামলাবাজরাই করছে না, করছে প্রতিটি অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার সিংহাসনে বসা সরকারই। নিরন্ন মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। এই হামলা নেমে আসে অর্থনীতির মধ্য দিয়ে, সাংস্কৃতিক চেতনা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে। এমন কথা বিরোধী পক্ষের নেতারা উচ্চারণ করতে পারেন না, কারণ কেন্দ্রের গদিতে বসলে তাদেরও যে এই সেনাবাহিনীকেই কাজে লাগাতে হবে বেয়াদব দেশবাসীদের শায়েস্তা করতে।

error: Content is protected !!