ঈশ্বরে বিশ্বাসকে অনেকেই সহজাত প্রবৃত্তি বলে মনে করেন। তাঁদের এই মনে করার পিছনে একটা যুক্তি খাড়া করেন, “হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ঈশ্বর-‘বিশ্বাসের ধারা স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে চলে আসছে। যারা ঈশ্বর দেখেনি, যারা ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখেনি, তাদের মধ্যেও আমরা ঈশ্বর-বিশ্বাস দেখতে পাই। ঈশ্বর-বিশ্বাস, ঈশ্বর-চেতনা, বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মধ্যে সহজাত ভাবে রয়েছে বলেই মানুষের মনে ঈশ্বর-চেতনার প্রকাশ অনিবার্য। ঈশ্বর-চেতনার পথ ধরেই আসে উপাসনা-ধর্ম।”

প্রশ্ন উঠে আসতে পারে—ঈশ্বর-বিশ্বাস সহজাত প্রবৃত্তি হলে ঈশ্বর অবিশ্বাসী কিছু মানুষের অস্তিত্ব কেন দেখা যায়? এর উত্তরে ‘সহজাত প্রবৃত্তি’ তত্ত্বের প্রবক্তারা বলেন, “সবেরই ব্যতিক্রম আছে। ঈশ্বরে অবিশ্বাসীরা এমনই ব্যতিক্রমী উদাহরণ। যেমন সবার সব ইন্দ্রিয় কাজ করে না, কেউ দেখতে পায় না দৃষ্টি ইন্দ্রিয়ের অভাবে, তেমনই ঈশ্বর অবিশ্বাসীরা এমনই মানুষ ‘ঈশ্বর’ বিশ্বাস যাদের সহজাত প্রবৃত্তি নয়।” যাঁরা এমন যুক্তি দেন, তাঁদের বোধহয় এটা জানা নেই যে, ইউরোপে নাস্তিকরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ।

 

‘সহজাত প্রবৃত্তি’ কাকে বলবো

আসুন একটু দেখা যাক, ‘সহজাত প্রবৃত্তি’ বিষয়টা কী। মানুষের মধ্যে শুধু নয়, মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যেও সহজাত অর্থাৎ সহিতজাত বা জন্মগত ভাবে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা জন্মের পরে প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন : বেঁচে থাকার সংগ্রাম (Survival)। বেঁচে থাকার সংগ্রামের শুরু খাবার খুঁজে নেবার মধ্য দিয়ে। ক্ষিদে পেলে শিশু মায়ের দুধ খোঁজে। খোঁজ না পেলে চলে কান্না। পেটের জ্বালাই নানা অপরাধের আঁতুড়ঘর। তাইতো কোনও দেশ যত দেউলিয়া হতে থাকে, ততই গরিবি বাড়ে, ততই বাড়ে নানা অপরাধ।

বেঁচে থাকার তাগিদেই মানুষ মাথা গোঁজার ঠাই খোঁজে। গুহাবাসী আদিম মানুষের কাল থেকে আজও সহজাত প্রবৃত্তির তাগিদে মানুষ মাথা গোঁজার আস্তানা খোঁজে । ঝুপড়ি থেকে প্রাসাদ—সবের সৃষ্টির মূলেই রয়েছে আস্তানা খোঁজার সহজাত প্রবৃত্তি, বাঁচার সংগ্রাম।

বন্যার স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে যেতে যে মা এক হাতে গাছের ডাল, আর এক হাতে সন্তানকে ধরে বাঁচার ও বাঁচাবার সংগ্রাম চালায়, সেও স্রোতের তোড় বাড়লে সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে দু-হাতে গাছ আঁকড়ে ধরে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিবশে। এটাই মূল ধারা। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, কিন্তু তা ব্যতিক্রমই

সাঁইতিরিশ কেজির মস্তান পকা থানার বড়বাবুর পিছনে রিভলবার ঠেকিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় তাঁকে আধ কিলোমিটার দৌড় করিয়ে ছেড়েছে—খবর। বড়বাবু দৌড়েছেন রিভলবারের ভয়ে, পটকার ভয়ে নয়। জীবন বাঁচাতে মান-সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে পকার আদেশ মান্য করে আধ কিলোমিটার দৌড়েছেন। এখানে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি হয়নি।

মানসিক অবসাদের চাপে কখনও কখনও বেঁচে থাকার সংগ্রাম বা Survival- এর সহজাত প্রবৃত্তি হেরে যায়। নিজের জীবনকে শেষকরে দেওয়াকে তখন কেউ কেউ কাম্য মনে করে, মুক্তির উপায় মনে করে। এই অবসাদ অনেক কারণেই আসতে পারে। কোনও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর, খরচ চালাতে বেসামাল অবস্থা এবং রোগ মুক্তির সম্ভাবনা নেই, এমন অবস্থা থেকে অবসাদের জন্ম হতে পারে। ব্যবসায় একদম ডুবে যাওয়া, বিশাল দেনার দায় থেকে মানুষ সহজে বিষণ্ণতার শিকার হন। দুর্ঘটনায় বিকলাঙ্গ হয়ে চাকরি জীবন থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হওয়া থেকে আসতে পারে বিষণ্ণতা। প্রিয়জনকে হঠাৎ করে হারাবার ব্যথা থেকে, অথবা প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণে অবসাদ আসতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অবসাদ মাথা চাড়া দেওয়ার প্রবণতা বেশি, কারণ তাঁরা বেশি রকম আবেগ তাড়িত। আবার কেউ আদর্শের কারণে আত্মবিসর্জন দেন হাসিমুখে। বিধর্মীদের হাতে ধর্ম আক্রান্ত ভেবে, ধর্মে বিশ্বাসীদের আত্মঘাতী ঘাতক-বাহিনী হতে আমরা দেখেছি।

এমন বাহিনীর হাতে আমরা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে ধ্বংস হতে দেখেছি। দীর্ঘ- মেয়াদি মগজ ধোলাইয়ের মধ্য দিয়ে বাঁচার প্রবৃত্তির উপর ‘আত্মত্যাগের আদর্শ স্থাপন করা হয়। আবার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দেখতে পাবেন রক্তোন্মাদরা প্রাণ নিতে ও দিতে একটুও পিছ-পা নয়। গণউন্মাদনা তাদের বেঁচে প্রবৃত্তিকে সাময়িক ভাবে ভুলিয়ে দেয়।

এইসব অস্বাভাবিক অবস্থায় না পড়লে সহজাত প্রবৃত্তি তাদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বজায় রাখে।

 

সহজাত প্রবৃত্তি ক্রোধ (Anger), আক্রমণ প্রবৃত্তি (Aggression), পাল্টা আক্রমণ প্রবৃত্তি (Counter aggression )

তৃতীয় সন্তানও মেয়ে হওয়ায় ক্রুদ্ধ বাবা সন্তানটিকে আছড়ে মেরে ফেলেছেন। এমন ধরনের খবর আমরা মাঝে-মধ্যেই খবরের কাগজে পড়ি।

পুরুলিয়ার একটি খবর। রফিকের সঙ্গে ফতেমার বিবাহিত জীবন মাত্র এক বছরের। বিয়েতে দশ হাজার টাকা পণ দেওয়ার কথা ছিল ফতেমার বাপজানের দিয়েছিল সাত হাজার। পাওনার তিন হাজার দিচ্ছি-দেব বলে এক বছর ধরে ঠকাচ্ছিল। এক রাতে ফতেমার বাপকে জোচ্চোর বলায় ফতেমা চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল, বাপ তুলে গাল দেবে না বলছি। ধাঁ করে মাথায় আগুন ধরে গেল রফিকের। ফতেমার মাথায় বসিয়ে দিল হেঁসোর কোপ। এক কোপেই সব শেষ ।

আপনি একজন নিছক মধ্যবিত্ত। ছাপোষা মানুষ। বউ সন্তানসম্ভবা। আপনার ছোট্ট শহরের ছোট্ট সরকারি হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দিতে অপেক্ষায় আছেন । প্রসব ব্যথা উঠছে না। ডাক্তারবাবু ইনজেকশন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে পাঠিয়ে দিলেন জেলার বড় হাসপাতালে। সঙ্গে গেলেন আপনি ও তিন পড়শি। জেলা হাসপাতালের গেটে যখন পৌঁছলেন তখন রাত এগারোটা। গেট বন্ধ। এগারটা থেকে আড়াইটে অ্যাম্বুলেন্স হর্ন বাজিয়ে গেল। আপনারা গেট খোলার জন্য চেঁচালেন। হাসপাতালের কিছু রোগীও চেঁচালেন। কিন্তু দারোয়ান, নার্স, ডাক্তার—কারও দেখা পাওয়া গেল না। তারপর আপনারা এক মাথা আগুন নিয়ে দাপিয়ে বেড়ালেন, ভাঙচুর করলেন। এমন ঘটনা অনেক ঘটে।

রুচি ও সংস্কৃতিগত অগ্রগামীতার কারণে উচ্চ শিক্ষিতদের রাগের অভিব্যক্তি কিছুটা ভিন্ন ধরনের। প্রতীচী ট্রাস্টের সমীক্ষার রিপোর্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অমর্ত্য সেন। পুরুলিয়া, বীরভূম ও মেদিনীপুর জেলায় প্রাথমিক শিক্ষার হালচাল জানতে প্রতীচী ট্রাস্ট সমীক্ষা চালিয়েছিল। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন সমীক্ষা রিপোর্টের ভূমিকায় লিখেছেন, “স্কুলশিক্ষায় অগ্রসর ও অনগ্রসর শ্রেণী- বিভাজন দূর হয়নি, বস্তুত তীব্রতর হয়েছে, এটা লজ্জার কথা।” অমর্ত্য সেনের এই সংযত ক্ষোভও কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই প্রমাণ করে, ক্রোধ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রকাশ ভিন্ন হতে পারে।

দুর্বলের ওপর সবলের যে অত্যাচার যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তা আমাদের আক্রমণ চালাবার সহজাত প্রবৃত্তিরই প্রকাশ। বাড়ি তুলবেন? মস্তানদের তোলা দিতে হবে। ব্যবসা চালাবেন? তোলা না দিয়ে উপায় নেই। রাজনৈতিক নেতা থেকে পুলিশ সবাই মস্তানদের তোলার বখরাদার।

তোলাবাজরা কখনও বাড়াবাড়ি রকমের অত্যাচার চালালে, বা কোনও দোকানিকে খুন করে ফেললে, আক্রান্ত দোকানিরা তোলাবাজকে সেই সময় ধরতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলে, তাদের ঘর-দোর জ্বালিয়ে দেয়। এ’সব খবর আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। আক্রান্ত হলে প্রতি আক্রমণ চালাবার এই প্রবৃত্তিও সহজাত।

আপনি বোনকে নিয়ে ট্রেনে যাচ্ছেন। গোটা তিনেক যুবক বোনের সিটের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্লীল কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছে। আপনি প্রতিবাদ করলেন, “ঘরে মা-বোন নেই ?”

“মা-বোন তো আছে, কিন্তু মাইরি বউ নেই। দেবেন নাকি ওকে কয়েক ঘন্টার বউ করতে?”

আর এক তরুণ হঠাৎ আপনার কলার চেপে ধরলো। “মা-বোন তুললি কেন রে শালা?” ধাঁ করে একটা ঘুসি চালিয়ে দিল। আপনার মুখ লক্ষ করে। নাকের থেকে রক্ত গড়িয়ে নামছে। উত্তেজনায় ব্যথা অনুভব করছেন না। দেখতে পেলেন, একজন বোনের হাত ধরে টানাটানি করছে। ওরা তিনজন। আপনার ডান পায়ের হাঁটু মুহূর্তে ঘুসি চালানো ছেলেটির দুই ঊরুসন্ধির মাঝে সজোরে আঘাত করলো। ছেলেটি আর্তনাদ করে দু’হাতে ঊরুসন্ধি চেপে শুয়ে পড়লো। তৃতীয় ছেলেটি আপনার দিকে এগোতেই আপনি সোজা একটা ঘুসি ছুড়ে দিলেন বকসিং-এর ব্যাকরণ না জেনেই। ছেলেটির নাক থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। সার্ট ভিজে যাচ্ছে রক্তে। অত রক্ত দেখে ছেলেটা ঘাবড়ে গেছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন মুহূর্তে যাত্রী ঝাঁপালো আপনার বোনের গায়ে হাত দেওয়া ছেলেটির উপর। এই যে নির্বিরোধী আপনি আক্রান্ত হতেই বাঁচার তাগিদে, বোনের ইজ্জত বাঁচাবার তাগিদে প্রতি আক্রমণ চালালেন—এটা আপনার সহজাত প্রবৃত্তির ফল।

কয়েকজন সহযাত্রীরা একটা সময় পর্যন্ত নীরব দর্শক ছিলেন। তিন তরুণের অশ্লীল আচরণে তাঁদের রাগ হচ্ছিল। আবার গোলমালে না পড়ার আজন্ম লালিত মধ্যবিত্ত মানসিকতা মনের রাগ মনেই চেপে রাখতে বলছিল। আপনার হাতে দুই মস্তানকে পিটুনি খেতে দেখে এবং বড় রকমের বিপদ ঘটার সম্ভাবনা নেই—এটা বুঝতে পেরে নিজেদের নিস্পৃহতা ঝেড়ে ফেলে সহযাত্রীরা প্রতি আক্রমণ চালিয়েছেন। এই প্রতি আক্রমণ চালিয়েছেন সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নায়।

এখানে যদি দেখা যেত যুবক তিনজনেরই হাতে রিভলবার, তবে Survival বা বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তিই বড় হয়ে উঠতো। আপনার প্রতি অত্যাচার হতে দেখেও একাত্মতা অনুভব করতো না।

 

সহজাত প্রবৃত্তি— যৌন অভিলাষ (Sex) :

মানুষ যৌনতার প্রতি আকর্ষণ ও যৌন অভিলাষ নিয়ে জন্মায়। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছরের ছেলেমেয়েরা যৌনাঙ্গ নিয়ে নাড়াচাড়া করে এক ধরনের আনন্দ পায়। এই আনন্দ অনির্দিষ্ট।

কৈশোরের শুরুতে সমকামিতা (Homosexuality) প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য রূপ পায় । যৌনগ্রন্থি, যৌনাঙ্গ যতই পরিণতির দিকে এগোতে থাকে ততই বিপরীত লিঙ্গের মানুষটির কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চায় ৷

তারপর আসে আত্মরতির পর্যায়। এই সময় কিশোর-কিশোরীদের (মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৩-১৪ বছর, ছেলেদের ১৬-১৭ বছর পর্যন্ত সময়) যৌনগ্রন্থি, অন্যান্য প্রয়োজনীয় অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি যেমন পিটুইটারি (Pituitary) ও অ্যাড্রেনাল (Adrenal) গ্রন্থিগুলি সক্রিয় হয় ।

মেয়েদের রজঃস্রাব ও ছেলেদের বীর্য তৈরি হয়। এই সময় বন্ধুদের সঙ্গে যৌনতা নিয়ে আলোচনা, পর্নো বইয়ের প্রতি একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আসে। বিচরণ করে এক অদ্ভুত স্বপ্নের জগতে। স্বপ্নের নায়ক-নায়িকা বা পরিচিত কোনও বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে ভেবে আত্মরতি করে। এর পরের পর্যায়ে আসে যৌন-মিলনের আনন্দকে উপভোগ করার পর্যায়।

এই যে একটু একটু করে যৌন অভিলাষের দিকে এগোনো, এর প্রতিটি পর্যায়ই স্বাভাবিক ঘটনা। এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তির গতিময়তা বাধা পেলে অস্বাভাবিক যৌন আচরণ গড়ে উঠতে পারে।

আমাদের সমাজের রীতিনীতি ও চাপিয়ে দেওয়া মূল্যবোধ মানতে গিয়ে অনেক সময় আমরা যৌন অভিলাষকে খারাপ, নোংরা ব্যাপার বলে মনে করি। কিন্তু স্বাভাবিক প্রবৃত্তির তাড়নাকে এড়াতে পারি না। ফলে আমাদের ভণ্ড হতে হয়। মুখে যৌনতার বিরুদ্ধে সরব হই, সুযোগ পেলেই ‘কাম’ নামের সহজাত প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ করি।

অজাচার মধ্যবিত্ত মানসিকতার নারী-পুরুষদের মধ্যেই সাধারণত দেখা যায়। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানসিকতার নারী-পুরুষের মধ্যে অজাচারের ঘটনা বিরল। ‘লোকে কী বলবে’– ব্যাপারটাকে ওরা পাত্তা দিতে রাজি নয়। ওদের ‘পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ’ নেই। দেহ-মিলনের সময় এই দুই সমাজ-মানসিকতার নারী নিষ্ক্রিয় না থেকে সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়। দেহ শুচিতার ভণ্ডামী নেই। মধ্যবিত্তদের একটা প্রবণতা— দেহশুচিতার পক্ষে সাড়ম্বরে বলা। যৌন অভিলাষ একটি সহজাত প্রবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত সমাজ বিষয়টিকে ‘খারাপ’, রেখে-ঢেকে রাখার বিষয় বলে চিহ্নিত করে দিয়েছে।

যৌন অভিলাষ নিশ্চয়ই প্রকাশ্যে সংঘটিত হওয়ার বিষয় নয়।

কিন্তু যৌন-শিক্ষা, ছেলে-মেয়েদের

বন্ধুত্বপূর্ণ মেলামেশাকে

খারাপ ভাবাটাই

কুশিক্ষা।

এমন বহু মানুষের মুখোমুখি অবিরত হই, যাঁরা গর্বের সঙ্গে বলেন, “আমার মেয়ে খুব ভালো। একটিও ছেলে বন্ধু নেই।” যেন ছেলে বন্ধু না থাকাটাই মেয়েদের ভালো হওয়ার আবশ্যিক শর্ত। অনেক ছেলের মা-বাবাও এমন বোকা বোকা গর্ববোধ নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন।

যৌন অভিলাষ সহজাত প্রবৃত্তি। মিলন ইচ্ছে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানসিকতার পরিবারের ছেলে-মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা করে। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গোপনে প্রেমপত্র দেওয়ার ঘটনা বিরল, কারণ তার প্রয়োজন নেই। গোপনে পার্কে বা সিনেমা হলে দেখা করার দরকার হয় না। বন্ধু-বান্ধবীদের ব্যক্তিজীবন নিয়ে অহেতুক কৌতূহলও কম। মধ্যবিত্ত মানসিকতার রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে- মেয়েরা সংস্কৃতিগত ভাবে দুর্বল মানসিকতার (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে ব্যতিক্রম-ই)। এই অবস্থায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের যৌন অভিলাষের অভিব্যক্তি ঘটে গোপনে। কিছু সময় অজাচারে।

মানসিক কারণে শারীরিক অসুখে মধ্যবিত্ত নারীরাই বেশি ভোগেন। মধ্যবিত্ত বলতে আমি মধ্যবিত্ত মানসিকতার কথা বলছি। মা, মাসি, পিসি, দিদিমা, ঠাকুমারা মেয়েদের শিখিয়ে এসেছেন, লজ্জাই নারীর ভূষণ। স্বামীর কাছে মিলন প্রার্থনা করলে স্বামী চরিত্রহীনা ভাববে। মিলনকালে স্ত্রী সক্রিয়ভাবে অংশ নিলে স্বামী কামুক ভাববে। মধ্যবিত্ত নারীদের মিলন-আনন্দ উপভোগের সুযোগ থাকে না। ফলে বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই স্ত্রী’র কাছে এই মিলন ভরণ-পোষণের বিনিময়ে স্বামীর কাছে নিজের দেহকে তুলে দেবার প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ যৌন অবদমনের ফলে মানসিক কারণে নানা ধরনের শারীরিক অসুখের প্রকাশ ঘটে। নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানসিক অবস্থার নারীদের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল আছে; তারা পুরুষদের সঙ্গে মিলনের সময় পুরুষদের মতই সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ফলে সাধারণভাবে তাঁরা যৌন অবদমনের কারণে মানসিক কারণে দেহজনিত (Psychosomatic disorder) রোগে ভোগেন না ।

সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাসের কোনও স্থান নেই। মনোবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে সহমত। এই অবস্থায় আমরা কোনওভাবেই ঈশ্বর বিশ্বাসকে সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারছি না।

ঈশ্বর বিশ্বাস যে সহজাত প্রবৃত্তি নয়, সেটা মনোবিজ্ঞানের তত্ত্বে না ঢুকে ‘গোদা’ যুক্তি দিয়েই প্রমাণ করা যায়।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সাধারণ শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে

উপাসনা-ধর্মে (religion) বিশ্বাসীর সংখ্যা হু হু করে নেমেই চলেছে।

ন’য়ের দশকের এনসাইক্লোপিডিয়ার যে কোনও সংস্করণে

চোখ বোলালে দেখতে পাবেন, রিলিজিয়ানে

বিশ্বাসীর সংখ্যা শতকরা

পঞ্চাশেরও কম।

এই তথ্য প্রমাণ করে যে, উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাস বা ঈশ্বরে বিশ্বাস সহজাত প্রবৃত্তি নয়। সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের পরিণতি।

error: Content is protected !!