‘- ফাদার, এই মহাবিশ্ব তৈরি করার আগে ঈশ্বর কী করছিলেন?”
তোদের মতো লোক, যারা এ ধরনের প্রশ্ন করে, তাদের জন্য জাহান্নাম
বানাচ্ছিলেন ঈশ্বর’।
সেন্ট অগাস্টিন, এক আগন্তুকের প্রশ্নের জবাবে।
স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাব
সেন্ট অগাস্টিন, এক আগন্তুকের প্রশ্নের জবাবে।
এই যে আমাদের চিরচেনা মহাবিশ্ব, এই যে আমাদের চারদিকের প্রকৃতি – চাঁদ, তারা সূর্য, পৃথিবী, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন – এই সব কিছু এল কোথা থেকে? এই প্রশ্ন কেউ করলে কিছুদিন আগেও আমরা চোখ বুজে বলে দিতাম কোত্থেকে আবার, ‘বিগ ব্যাং’ থেকে বাংলায় আমরা যাকে ‘মহাবিস্ফোরণ’ নামে ডাকি! কিন্তু আশির দশকে ‘ইনফ্লেশন’ বা স্ফীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের কথা জানার পর থেকে কিন্তু বিজ্ঞানীরা এরকম উত্তর আর পছন্দ করছেন না। আসলে কোনো কিছু ‘বিগ ব্যাং থেকে এসেছে’ বলা মানে একটা শিশু হাসপাতালের ‘মাতৃসদন’ বা মেটারনিটিটি ওয়ার্ড থেকে এসেছে—বলার মতো শোনায় এখন^° । উত্তরটা হয়তো ভুল নয়, মাতৃসদন থেকেই শিশুদের কোলে করে বাসায় নিয়ে আসি আমরা, কিন্তু এই ধরনের উত্তর শিশুর জন্মের সত্যিকার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্বন্ধে কিন্তু কোনো ধারণাই দিতে পারে না।
বিগ ব্যাং-এর ব্যাপারটিও তেমনি। মহাবিশ্বের উদ্ভব বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ থেকে হয়েছে—এভাবে বললে হয়তো বলাই যায়, কিন্তু বিস্ফোরণের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা কোনো ধারণাই পাই না এ থেকে। অ্যালেন গুথের ভাষায়, ‘কী এই বিস্ফোরণ, কীভাবে এই বিস্ফোরণ, আর কেনই বা এই বিস্ফোরণ—এই প্রশ্নগুলোর কোনো সন্তোষজনক উত্তর বিগ ব্যাং তত্ত্ব দিতে পারে না
40 Brad Lemley and Larry Fink, Guth’s Grand Guess, Discover, April
01, 2002
Alan Guth, The Inflationary Universe, Basic Books; 1st Paperback
আর বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল – এই প্রশ্ন করলে তো কথাই নেই। এ ধরনের প্রশ্ন কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানে দেখা হতো ‘ব্লাসফেমি’ হিসেবে। কেউ এ ধরনের প্রশ্ন করলেই বিজ্ঞানীরা বলতেন, আরে, এ ধরণের প্রশ্ন অনেকটা ‘উত্তর মেরুর উত্তরে কী আছে?’ বলার মতো শোনায়। এভাবে ভাবার কারণ যে নেই তা নয়। আমরা আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বে যে স্থান-কালের ধারণার সাথে পরিচিত, সেই স্থান ও কালের ধারণাও আসলে এসেছে এই মহাবিস্ফোরণ ঘটবার পর-মুহূর্ত থেকেই। কাজেই মহাবিস্ফোরণ ঘটার মুহূর্তে কিংবা পূর্বে কী ছিল—এ প্রশ্ন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একেবারেই অর্থহীন।
কিন্তু অর্থহীন বলে সবাই এড়িয়ে গেলেও ‘ক্যারা মাথা’র কেউ কেউ থাকেন দুনিয়ায়, যাঁরা ‘মান্য করে ধন্য’ হবার নন। তাঁরা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন না। নাফরমানি চিন্তা করতেই থাকেন অনবরত। এমনি একজন নাফরমান বিজ্ঞানী অ্যালেন গুথ।
গুথের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। না, হয়েল, গ্যামো, ওয়েইনবার্গ, হকিংদের মতো প্রথম থেকেই একাডেমিয়ার সাথে যুক্ত কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না গুথ। তাঁর পরিচিতি বলার মতো কিছু ছিল না, অন্তত আশির দশকের আগ পর্যন্ত তো বটেই। ১৯৭৯ সালে ৩২ বছরের এই বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ কাজ করছিলেন
Edition, 1998
স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার এক্সিলেটরে, একজন ছাপোষা বিজ্ঞানের কর্মী হিসেবেই। চাকরি থাকা আর না থাকার মাঝামাঝি জায়গাতেও চলে গিয়েছিলেন কিছুদিন। হয়তো বা বিস্তৃতির আড়ালেই হারিয়ে যেতেন তিনি, কিন্তু সে অবস্থা থেকেই এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করলেন, যে গোটা মহাবিশ্বের ছবিটাই গেল পালটে। মহাবিশ্বের পাশাপাশি অবশ্য তাঁর জীবনও পাল্টাল বলাই বাহুল্য। অভূতপূর্ব এই আবিষ্কার মূলধারার বিজ্ঞানীদের মধ্যে এতটাই সাড়া ফেলে দিল যে, এক মাসের মধ্যে তিনি আমেরিকার সাত-সাতটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পেলেন। এর মধ্য থেকে তিনি গ্রহণ করলেন তাঁর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটির অফার, এবং এখনো সেখানেই অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটিকে এখন ইনফ্লেশন বা স্ফীতি-তত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়। মহাবিশ্বের উদ্ভববিষয়ক আধুনিক যেকোনো বইয়ে কিংবা যেকোনো পেপারে গুথের কাজের উল্লেখ থাকতেই হয়। প্রমিত মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বকে এর সাথে জুড়ে দিয়ে তত্ত্বটিকে এখন ‘ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাং মডেল’ হিসেবেও ডাকা হয়।
মহাকর্ষের বিকর্ষণ
গুথের আবিষ্কারের মূল বিষয়টি তাহলে ঠিক কী ছিল? মুল ধারণাটা আসলে খুব একটা কঠিন কিছু নয়। মহাকর্ষ ব্যাপারটিকে যে আমরা এত দিন আকর্ষণমূলক বল বলে ভেবে এসেছি, গুথ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই মহাকর্ষ আসলে সুযোগ আর পরিস্থিতি বিচারে কখনো কখনো বিকর্ষণমূলক হয়ে উঠতে পারে। এবং সেটা হয়ও। আইনস্টাইনের ঝানু মাথাতেও একসময় এটা এসেছিল। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি তাঁর আপেক্ষিকতা থেকে পাওয়া ক্ষেত্র-সমীকরণে একটা ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’ যোগ করেছিলেন, পরে আবার তা ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ ভেবে বাদও দিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের ভুলটাকেই যেন সঠিক প্রমাণিত করে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনলেন অ্যালেন গুথ, তবে একটু অন্যভাবে।
দেখা যাক কিভাবে। আমরা বস্তু কণাদের মধ্যে আকর্ষণের কথা বলি হরহামেশাই। ছোটবেলায় শেখা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র থেকে আমরা জানি, এই আকর্ষণ বল বস্তুকণাদের ভরের ওপর এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বাজারে আসার পর থেকে আমরা বুঝলাম, ব্যাপারটা আসলে পুরোপুরি ঠিক নয়। মাধ্যাকর্ষণ বল কেবল বস্তুর ভরের ওপরেই নির্ভর করে না, নির্ভর করে বস্তুকণার মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তির ওপরও। বস্তুর মধ্যস্থিত অণু-পরমাণুগুলো কী হারে ছুটোছুটি করছে সেটা আমাদের কাছে শক্তির একটা পরিমাপ হাজির করে। এই ছুটোছুটি আবার নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রার ওপর। তাপমাত্রা বাড়লে অণুদের ছুটোছুটি বাড়ে, সেই সাথে বাড়ে ওজন। তাই, টেবিলে পড়ে থাকা একদিনের বাসি ডালপুরি আর তাওয়ায় ভাজা গরম গরম ডালপুরির ওজন এক হবে না। গরম ডালপুরির ওজন কিছুটা হলেও বেশি পাওয়া যাবে, এবং পাওয়া যায়ও, কারণ, গরম ডালপুরিতে বাড়তি তাপমাত্রার কারণে এর ভেতরকার অণুগুলো বেশি হারে ছুটাছুটি করে, ঠান্ডা ডালপুরির তুলনায়। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বললে আমরা বলব, গরম ডালপুরিতে গতিশক্তি বেশি থাকে। ব্যাপারটা ডালপুরির জন্য বললেও যেকোনো পদার্থের জন্যই সত্য। পদার্থের এই গতিশক্তি যে বস্তুর ওজন বাড়াতে পারে, আর সর্বোপরি আকর্ষণ বলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিউটনের সময় জানা ছিল না। আরেকটি ব্যাপারও বোধ হয় নিউটন জানতেন না। বস্তুকণার মধ্যস্থিত চাপ ও বস্তুকণাদের শক্তি বাড়িয়ে দিতে পারে, আর সেটা ফেলতে পারে আকর্ষণ বলের ওপর নানামুখী প্রভাব। একটা স্প্রিং-ওয়ালা খেলনা এমনিতে পাল্লায় রেখে ওজন করলে, আর তারপর স্প্রিং-এর চাবি জোরসে পেঁচিয়ে ওজন করলে ওজনে সামান্য হেরফের পাওয়া যাবেই। এর কারণ হচ্ছে ‘খোলা স্প্রিং’-এর চেয়ে ‘প্যাচানো স্প্রিং’-এ শক্তি বেশি লুকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা স্প্রিং-এর জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য চিপসের ঠোঙা কিংবা কোকাকোলার বোতলের ক্ষেত্রেও। কোকের বোতলে বাতাসকে উঁচু চাপে আটকে রাখা হয় । সেরকম একটা বন্ধ বোতল ওজন করলে আর বোতলের ছিপি খুলে ওজন করলে দেখা যাবে ওজন খানিকটা কম পাওয়া যাচ্ছে।
গুথ ধারণা করতে পেরেছিলেন যে, চাপ যেমন ওজন বাড়িয়ে বস্তুকে টেনে ধরতে পারে, ঠিক তেমনি সেটা কখনো কখনো বস্তুকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলেও দিতে পারে দূরে। কখন? যখন চাপটা ধনাত্মক না হয়ে হয়ে ওঠে ঋণাত্মক। এই ঋণাত্মক চাপের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ঋণাত্মক চাপের উদ্ভব ঠিক কিভাবে হয় এটা বোঝা জরুরি। তবে এই ব্যাপারটিকে পরিচিত জাগতিক উপমা দিয়ে বোঝানো একটু কষ্টকর। একটা দুর্বল চেষ্টা আমি (অ. রা) করেছিলাম আমার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটিতে গিটারের উপমা হাজির করে2, এখানেও সেটা দেওয়া যাক। যাঁরা গিটার বাজান তাঁরা জানেন, গিটার বাজানো শেষ হলে গিটারটা ঝুলিয়ে রাখার সময় তারগুলোকে খুলে ঢিলে করে দিতে হয়। নয়তো তারগুলো সারা রাত ধরে টান টান হয়ে থেকে গিটারের বাহুকে ভেতরের দিকে বাঁকিয়ে দেবে। এখানে গিটারের সাপেক্ষে তারের চাপ ঋণাত্মক বলে চিন্তা করা যেতে পারে। ঠিক একভাবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে চিন্তা করলে চাপযুক্ত কোনো বস্তু বাইরের দিকে চাপ দেবে না, ভেতরের দিকে কুঁকড়ে যেতে চাইবে, অর্থাৎ এটি অনুভব করবে অন্তর্চাপ। আর এই চাপের ফলে বস্তুটির মহাকর্ষীয় শক্তি হবে ঋণাত্মক, অর্থাৎ বিকর্ষণধর্মী। বিজ্ঞানী ব্রায়ান গ্রিন তাঁর ‘দ্য
অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫ (পুনর্মুদ্রন ২০০৬)
ফেব্রিক অব কসমস’ বইয়ের ‘Deconstructing the Bang’ অধ্যায়ে লিখেছেন”
ধনাত্মক চাপ স্বাভাবিকভাবেই মহাকর্ষের ওপর ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে চাপ হয়ে উঠতে পারে ঋণাত্মক, ফলে সেই অংশে বহিচাপের বদলে অনুভূত হবে অন্তর্চাপ। যদিও ব্যাপারটা মোটেই অদ্ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছে না, কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সাপেক্ষে ব্যাপারটা হয়ে ওঠে রীতিমতো অসাধারণ। যেখানে ধনাত্মক চাপ বস্তুকণার ওপর সাধারণ এবং পরিচিত আকর্ষণমূলক মহাকর্ষের সৃষ্টি করে, ঋণাত্মক চাপ সেখানে তৈরি করে বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের।
আর বলা বাহুল্য, এই বিকর্ষণধর্মী শক্তিটাই মহাবিশ্বকে এমন তীব্রভাবে প্রসারিত হবার পথ তৈরি করে দিয়েছিল। কতটা তীব্র বোধ হয় কল্পনাতেও আসবে না। গুথ গণনা করে দেখলেন, চোখের পলক ফেলতে আমাদের যে সময় লাগে তার চেয়েও ঢের কম সময়ে খুব সঠিকভাবে বললে মাত্র ১০-৩৫ সেকেন্ডের মধ্যে মহাবিশ্ব বেড়ে গিয়েছিল অন্তত ১০২৬ গুণিতক হারে। আর এই ব্যাপারটাই সমাধান করে দিয়েছিল যাবতীয় সমস্যার, যেগুলো সমাধান করতে বিগ ব্যাং তত্ত্বের অনুসারীরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন এত দিন ধরে।
কিন্তু কথা হচ্ছে কোথায় আর কীভাবে তৈরি হয় এই অদ্ভুতুড়ে বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের? মহাবিশ্বের শুরুতে তো আর গিটারের তার (ওপরের উদাহরণ দ্র.) হাজির ছিল না মহাবিশ্বের বাহুকে বাঁকানোর জন্য। তাহলে? আসলে এর জন্য গুথকে চিন্তা করতে হয়েছিল একধরনের অস্থায়ী ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতার, যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘ফল্স্ ভ্যাকুয়াম’ ।
ফল্স্ ভ্যাকুয়াম
গুথের দেওয়া ফলস ভ্যাকুয়ামের ব্যাপারটা সাধারণ পাঠকদের কাছে একটু জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে আমরা একটু সহজ উপমা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করব, সেটা আমাদের চেনাজানা নদীর গতিপথ থেকে। নদীগুলো সাধারণত পাহাড়-পর্বত থেকে সৃষ্টি হয়ে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, এ আমরা সবাই জানি। আমাদের পদ্মা নদীর কথাই ধরি। এই নদী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যায়। তারপরে দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় এর নাম হয় গঙ্গা। এই গঙ্গা নামে
Brian Greene, The Fabric of the Cosmos: Space, Time, and the Texture of Reality [ Paperback], Vintage, 2005.
Ken Olum (Institute of Cosmology, Tufts University), What powered the Universe’s early growth spurt?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
ভারতের উত্তরপ্রদেশ ও বিহার রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েটয়ে একসময় নবাবগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করে। তারপর সেটা চাঁদপুরের কাছে এসে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। দেশের অন্যান্য নদীগুলোও তাই। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র—এসেছে কৈলাস শৃঙ্গের মানস সরোবর থেকে,মেঘনা এসেছে আসামের লুসাই পাহাড় থেকে, তারপর নানা পথ পেরিয়ে কোনো-না-কোনো সাগরে গিয়ে পড়ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন নদীরা শেষ পর্যন্ত সাগরের বুকে গিয়ে আশ্রয় খোঁজে? কারণ,বিজ্ঞানীরা বলেন, যে যা-ই করুক না কেন, দিন শেষে সবাই আসলে ‘লোয়ার এনার্জি স্টেটে থাকতে চায়। এই যে আমরা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটনি করে এসে রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিই—এই জন্যেই। কারণ শুয়ে থাকার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেহের সবচেয়ে নিচু শক্তিস্তরে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করি। নদীরাও তাই চায়। পাহাড়-পর্বত বেয়ে সারা জীবন চলতে চাওয়ার চেয়ে সাগরের বুকে থাকাই তার কাছে পছন্দের, কেননা সেখানে সে সবচেয়ে কম শক্তিস্তরের জায়গাটা খুঁজে নিতে পারে। ধরা যাক, এই সাগরের এই সবচেয়ে কম শক্তিস্তরের জায়গাটাকে আমরা নাম দিলাম প্রকৃত শূন্যতা বা ‘ট্রু ভ্যাকুয়াম’। এখন কথা হচ্ছে, সব সময়ই যে নদীরা সাগরে তথা প্রকৃত ভ্যাকুয়ামের মধ্যে গিয়ে পড়তে পারে তা কিন্তু নয়। ধরা যাক, ফারাক্কা বাঁধের মতো কোনো বাঁধ কোনো একটা নদীর বুকে আছে। ফলে নদীর পানি সাগর পর্যন্ত না পৌঁছে বাঁধেই আটকে থাকবে। বাঁধের উদাহরণের মতোই আমাদের বিছানায় ঘুমানোর উদাহরণেও এ ধরনের অস্থায়ী অবস্থা তৈরি করতে পারি। পুরোপুরি বিছানায় গা এলিয়ে দেবার বদলে চেয়ারে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিতে পারি। আমাদের এই বিছানার বদলে চেয়ারে মানে খানিকটা উঁচু শক্তিস্তরে বসে ঝিমানো, কিংবা নদী একদম নিচে সাগরে না এসে একটু উঁচুতে বাঁধ পর্যন্ত গিয়ে আটকে থাকা—এই ধরনের অবস্থাকে বলা যেতে পারে ‘ফল্স ভ্যাকুয়াম’।
এই ফলস ভ্যাকুয়াম আসলে বস্তুর অস্থায়ী দশা। গুথ তাঁর বইয়ে লিখেছেন,
‘ফলস ভ্যাকুয়াম আসলে অস্থায়ী ভ্যাকুয়াম হিসেবে কাজ করে। কাজেই ফলস মানে এখানে আসলে সাময়িক বা অস্থায়ী’।
নদীতে বাঁধ দিয়ে মানে সাময়িক সময়ের জন্য পানি আটকে দিয়ে আমরা তৈরি করতে পারি একধরনের ফলস ভ্যাকুয়ামের মতো ক্ষেত্র। বাঁধ যত শক্ত পোক্তই হোক না কেন, একে কেউ সাগরের মতো প্রকৃত ভ্যাকুয়াম ভেবে নেবেন না যেন! বাঁধের ওপরে পড়ছে পানির অবিরত চাপ। বাঁধের মুখ খুলে দিলেই কিংবা বাঁধে সামান্য চিড় ধরলেই সেই বাঁধ ছত্রখান হয়ে ভেঙেচুরে পানিকে বয়ে নিয়ে যাবে সাগরের বুকে
নদীর উপমা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো হলেও এখানে বলা দরকার যে, মহাবিশ্বের ফলস ভ্যাকুয়ামের কাজের সাথে ওপরের নদীর উপমার পার্থক্য আছে। ফলস ভ্যাকুয়ামের মধ্যে তৈরি হয় বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের, যা আক্ষরিক অর্থেই এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। গুথ তাঁর বইয়ে এই মেকি ভ্যাকুয়ামকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন—
এই মেকি ভ্যাকুয়ামের রয়েছে এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, যা অন্য সকল পদার্থ থেকে আলাদা। সাধারণ পদার্থের (সেটা কঠিন, তরল, বায়বীয় বা প্লাজমা যা-ই হোক না কেন), শক্তি-ঘনত্ব নিয়ন্ত্রিত হয় কণাদের ভর দিয়ে, যেটা আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুযায়ী আবার শক্তির সমানুপাতিক (E = mc²)। সাধারণ পদার্থের ক্ষেত্রে আয়তন বাড়লে পদার্থের ঘনত্ব কমে যায়, সেই সাথে কমে শক্তি-ঘনত্ব। কিন্তু মেকি ঘনত্বের ক্ষেত্রে এটা কণার ওপর প্রযুক্ত হয় না, হয় হিগস ক্ষেত্রের ওপর। কাজেই মহাবিশ্ব প্রসারিত হলেও ফল্স ভ্যাকুয়ামের শক্তি-ঘনত্ব অপরিবর্তিত থাকে, যদি না আমরা দীর্ঘ সময় ধরে মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়ের জন্য অপেক্ষা করি।
এই মেকি ভ্যাকুয়ামের থাকে তীব্র বিকর্ষণমূলক শক্তি। গুথ গণনা করে দেখিয়েছেন, ভ্যাকুয়ামের ক্ষেত্রে বিকর্ষণ শক্তির মান আকর্ষণ শক্তির অন্তত তিন গুণ বেশি পাওয়া যায়। ইনফ্লেশনের গণিতটা খুব সহজভাবে লিখলে দাঁড়াবে অনেকটা এরকমের
Alan Guth, The Inflationary Universe, Basic Books; 1st Paperback Edition, 1998
Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang; 2006
Andrew R. Liddle and David H. Lyth, Cosmological Inflation and Large-Scale Structure, Cambridge University Press, 2000
INFLATION >> ρ + 3P < 0
যেহেতু P-এর মান সব সময়ই ধনাত্মক, কাজেই সমীকরণের শর্তকে সিদ্ধ করতে হলে P-এর মান ঋণাত্মক হতে হবে, এবং এটা অবশ্যম্ভাবী।
আসলে মহাবিশ্বের শুরুতে ‘ফলস ভ্যাকুয়াম’ বা মেকি শূন্যতা নামের অদ্ভুতুড়ে জিনিসটা ছিল বলেই কিন্তু ঋণাত্মক চাপ এসে মহাবিশ্বকে এত দ্রুত প্রসারিত করে দিতে পেরেছে। কিন্তু কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই মেকি শূন্যতা? এটা বোঝার জন্য আমাদের হিগস ফিল্ডের মতো স্কেলার ক্ষেত্রের দ্বারস্থ হতে হবে।
স্কেলার ক্ষেত্রঃ হিগস ফিল্ড
কান টানলে যেমন মাথা আসে, ফলস ভ্যাকুয়ামের কথা বলতে গেলে স্কেলার ক্ষেত্রের কথা চলে আসবে আমাদের আলোচনায়। স্কেলার ক্ষেত্র বলতে আমরা বুঝি এমন সাংখ্যিক মান, যা সুষমভাবে আমাদের চারপাশের স্থানের প্রতিটি বিন্দুতে ছড়িয়ে রয়েছে। ক্ষেত্রটিকে ‘স্কেলার’ বলা হয় কারণ, এর সাংখ্যিক মান আছে, কিন্তু কোনো দিক নেই। এই সাংখ্যিক মান এক বিন্দু থেকে অপর বিন্দুতে ভিন্ন হতে পারে, কিংবা হতে পারে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত । এ ধরনের স্কেলার ক্ষেত্রের একটি খুব সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে তাপমাত্রা। আমরা পৃথিবীর কিংবা মহাবিশ্বের যেখানেই যাওয়ার কথা কল্পনা করি না কেন, সেটা বান্দরবানের কোনো গাছের মগডালেই হোক, বা বরফাচ্ছাদিত শ্বেতশুভ্র উত্তরে মেরুতেই হোক, কিংবা হোক না সে সূর্যের কেন্দ্রে তাপমাত্রার কোনো-না-কোনো মান আমরা পাব।
গুথ সে সময় এমনি একটি স্কেলার ফিল্ড নিয়ে কাজ করছিলেন, নাম হিগস ফিল্ড। এই হিগস ক্ষেত্রটি আবার নিজেকে প্রকাশ করে থাকে এক রহস্যময় কণার মাধ্যমে। কণাটির নাম মিডিয়ার সাম্প্রতিক তোলপাড়ের কারণে সবার জানা হয়ে গেছে। এই সেই হিগস বোসন মিডিয়াতে সমাদৃত হয়েছে ‘ঈশ্বর কণা” নামে”। আশির দশকে গুথ যখন কাজ করছিলেন, তখন সেটা ‘হাইপোথিটিকাল’ বা উপপ্রমেয়মূলক একটি ধারণা হিসেবেই কেবল বজায় ছিল। কিন্তু গুথের দৃঢ় ধারণা ছিল যে, হিগস কণা পাওয়া যাবে। ১৯৯৭ সালে লেখা ‘ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ বইয়ের ১৩৬ পৃষ্ঠায় গুথ বলেছিলেন—
যদিও হিগস কণা এখনো পাওয়া যায়নি, কিন্তু তত্ত্বের প্রতি বিজ্ঞানীদের আস্থা রয়েছে পুরোমাত্রায়। আমরা জানি W এবং Z কণাগুলোকে ১৯৮৩ সালের আগ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, ‘তাড়িত দুর্বল’ তত্ত্ব আসার পর ১৬ বছর লেগেছে এর পেছনের কণার বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পেতে। কণাগুলোর ভর এবং মিথস্ক্রিয়া আগেকার দেওয়া তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে পুরোপুরি মিলে
হিগস সম্বন্ধে আলোচনার জন্য এই বইয়ের দ্বাদশ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
গেছে। তাই আশা করা অমূলক নয় যে, যখন একবিংশ শতকে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বানানো শেষ হবে, প্রমিত মডেলের আরাধ্য হিগস কণাও খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমরা আজ জানি, ১৯৯৭ সালে বলা গুথের প্রতিটি বাক্য সত্য প্রমাণিত হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ৪ জুলাই তারিখে সার্নের বিজ্ঞানীরা আমাদেরকে হিগস কণার অস্তিত্বের বাস্তব প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছেন”। অনেকেই মনে করেন, হিগস ক্ষেত্রের এহেন পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ গুথের স্ফীতি তত্ত্ব তথা প্রমিত বিগ ব্যাং মডেলেরও একটা জোরালো স্বীকৃতি (যদিও এ নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি)। এ নিয়ে আরেকটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে (দ্বাদশ অধ্যায় দ্র.) বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে। এখানে কেবল স্ফীতির সাথে হিগসের সম্পর্ক নিয়ে প্রাসঙ্গিক দু-চার কথা জানার চেষ্টা করব।
হিগসের পেছনের ইতিহাসটা বেশ পুরনো। হিগস ক্ষেত্রের ধারণাটা প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীদের মাথায় এসেছিল ষাটের দশকে কণা পদার্থবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে। প্রকৃতির মৌলিক বলগুলোর (দুর্বল নিউক্লীয়, সবল নিউক্লীয়, তাড়িত-চৌম্বক ও মহাকর্ষ) একত্রীকরণে হিগসের বড় সড় একটা ভূমিকা আছে। প্রকৃতির এই বলগুলোকে, বিশেষত মহাকর্ষ ও তাড়িত চৌম্বক বল দুটোকে একীভূত করার লক্ষ্যে আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলোতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ করতে গিয়ে সে সময় পদার্থবিজ্ঞানের মূলধারার গবেষণা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্নই হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। খুবই উচ্চাভিলাষী ছিল তাঁর স্বপ্ন। বহুবার আইনস্টাইন ভেবেছিলেন, তাঁর স্বপ্নের জাদুর কাঠি বুঝি হাতে পেয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বপ্ন-সাধ অপূর্ণই থেকে যায়। তবে, আইনস্টাইনের মৃত্যুর (১৯৫৫) দুই দশকের মধ্যে পদার্থবিদেরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করলেন।
ষাটের দশকের শেষ দিকে তত্ত্বীয় পদার্থবিদেরা সফলভাবে ‘তাড়িত-চৌম্বক’ বল এবং ‘দুর্বল নিউক্লীয়’ বলকে একই সুতায় গাঁথতে সমর্থ হলেন। একে এখন অভিহিত করা হয় ‘তাড়িত দুর্বল’ বল নামে। সত্তরের দশকে এসে তাড়িত দুর্বল তত্ত্বের পরীক্ষালব্ধ সত্যতা নির্ণীত হয়। শুরুটা হয়েছিল শেল্ডন গ্ল্যাসোর হাতেই।
২০১২ সালের জুলাই মাসের চার তারিখে যখন হিগস প্রাপ্তির ঘোষণা দেওয়া হয়, তার ক’দিন পরই আমি (অ.রা) মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম ‘সার্ন থেকে হিগস বোসন – প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে !’ শিরোনামে। সেখানে হিগস কণার বৈশিষ্ট, এবং এর আবিষ্কারের, প্রক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেই সাথে যোগ করেছিলাম আমার সান ভ্রমণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও। লেখাটি সে সময় বাংলা ব্লগে বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।
ইনফ্লেশনের জন্য দায়ী ফিল্ডটি হিগস কি না এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত নন। সার্বিকভাবে একে ‘ইনফ্লেটন’ বলে অভিহিত করা হয়।
১৯৬৭ সালের দিকে গ্ল্যাসো ‘গেজ গুচ্ছ’ নামের একটি প্রক্রিয়া ব্যবহার করে দুর্বল ও তাড়িত-চৌম্বক মিথস্ক্রিয়ার একত্রীকরণের একটা প্রয়াস নিয়েছিলেন। কিন্তু এ পদ্ধতিতে সমস্যা ছিল যে, গ্ল্যাসোর সমীকরণ থেকে পাওয়া ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান ভরসূচক পদটি প্রতিসাম্যতাকে সংরক্ষণ করত না।
এর সাত বছর পর এই বোসনের ভরসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হাজির করলেন আব্দুস সালাম ও স্টিভেন ওয়েনবার্গ; এবং যে প্রক্রিয়ায় তারা এর সমাধান বের করেছিলেন তাকে বলা হয় ‘হিগস প্রক্রিয়া’। প্রক্রিয়ার নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের সমাধানে ‘হিগস অনুকল্পের’ একটা বড় ভূমিকা ছিল। আসলে ঠিক কীভাবে W বোসন, Z বোসনের (এরা দুর্বল নিউক্লীয় বলের পরিবাহী কণা, ঠিক যেমন আমরা জানি যে ফোটন হচ্ছে আলোর পরিবাহী কণা) মতো গেজ বোসনগুলো ভরপ্রাপ্ত হয়, আর ফোটনের মতো কণিকারা থেকে যায় ভরশূন্য——এই সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে স্কটল্যান্ড নিবাসী বিজ্ঞানী পিটার হিগস ১৯৬৪ সালে এক নতুন ‘বল ক্ষেত্র’ (Force Field)-এর কল্পনা করেছিলেন, যেটাকেই আমরা আজ ‘হিগস ক্ষেত্র’ বলে ডাকি। সালাম আর ওয়েনবার্গেরা দেখালেন, যখনই হিগস বলক্ষেত্র নিজেকে প্রকাশ করে, সেই মুহূর্তেই তাড়িত-চৌম্বক আর দুর্বল নিউক্লীয় বল পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি ‘প্রতিসাম্যের ভাঙন’। যখন থেকে হিগস প্রক্রিয়া গ্ল্যাসো-সালাম-ওয়েনবার্গ মডেলের সমীকরণে অন্তর্ভুক্ত হলো, তখন থেকেই তাড়িত দুর্বল তত্ত্ব চমৎকারভাবে কাজ করতে শুরু করল। আর এ তত্ত্বটির পুনর্নমায়ন (renormalization) সংক্রান্ত প্রমাণ দিয়ে তত্ত্বটিকে আরো পাকাপোক্ত করে তুললেন বিজ্ঞানী ‘টি হুফট ১৯৭১ সালে। ‘টি হুফটের প্রমাণে উদ্বেলিত হয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিডনি কোলম্যান মন্তব্য করেছিলেন, ‘টি হুফটের কাজ ওয়াইনবার্গ-সালামের রূপকথার ব্যাঙ-কে যেন জাদুমন্ত্রে সুদর্শন রাজকুমারে পরিণত করল’ । এ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আবদুস সালাম, স্টিফেন ওয়েইনবার্গ এবং শেলডন গ্ল্যাসো ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
হিগসসংক্রান্ত পেছনের এ ইতিহাসগুলো গুথের জানা ছিলই। তিনি আরো জানতেন যে, হিগস নামের এই স্কেলার ক্ষেত্রটা W এবং Z কণার সাথে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়, আর তাদের গায়ে-গতরে তাদের ভারী করে তোলে। কিন্তু ফোটন কণা এই স্কেলার ক্ষেত্রের সাথে কোন ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না, তাই তারা চলতে পারে আলোর বেগে হু হু করে। এই হিগস ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরো কিছু নতুন ব্যাপার জানলেন গুথ। তিনি দেখলেন, এর বৈশিষ্ট্য অন্য সব চেনাজানা স্কেলার ক্ষেত্রের চেয়ে আলাদা। অন্য সবার জন্য, বল ক্ষেত্রের মান
Sidney Coleman, The 1979 Nobel Prize In Physics, Science, December 1979: 1290-1292.
শূন্য থাকলেই শক্তি-ঘনত্ব সবচেয়ে কম পাওয়া যায়। কিন্তু হিগসের ক্ষেত্রে শক্তি- ঘনত্ব আমরা সবচেয়ে কম পাই—যখন হিগসের একটি ‘নন জিরো ভ্যালু’ বা অশূন্য মান থাকে। এর মানে হচ্ছে শূন্য স্থানে, যেটাকে আমরা প্রচলিতভাবে ভ্যাকুয়াম বলে অভিহিত করি, সেখানেও হিগসের একটা মান সব সময়ই পাওয়া যাবে। আমাদের মহাবিশ্বের মেকি শূন্যতার পথ পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকৃত শূন্যতায় এসে পৌঁছানোর ব্যাপারটা যদি সঠিক হয়, তবে সেই প্রকৃত শূন্যতার অবস্থানে হিগসের একটা নির্দিষ্ট মান থাকবে, যেখানে মহাবিশ্বের শক্তি-ঘনত্ব হবে সর্বনিম্ন। নিচের ছবিটার দিকে তাকানো যাক। এ ছবিটা ওপরে ফলস এবং ট্র ভ্যাকুয়াম-সংক্রান্ত ত্রিমাত্রিক ছবিটির দ্বিমাত্রিকরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।
ছবি থেকে বোঝা যাচ্ছে,শক্তি-ঘনত্ব u-এর মান ধীরে ধীরে কমতে কমতে একটা জায়গায় এসে শূন্য হলেও সেখানে স্কেলার ক্ষেত্র Φ-এর মান শূন্য নয় বরং Φ = Φt । এটাই প্রকৃত ভ্যাকুয়াম। আমাদের মহাবিশ্ব আজ এই জায়গাতেই আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। কিন্তু অতীতে যখন স্কেলার ক্ষেত্রের মান শূন্য ছিল (Φ = 0) তখন তার ঘনত্বের মান ছিল uf । এই সসীম ঘনত্বের দশাকেই বলা হয় মেকি ভ্যাকুয়াম। ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে, হিগস ক্ষেত্রের মান যত বাড়তে থাকে শক্তি-ঘনত্ব একটি মালভূমির ঢাল বেয়ে ততই নিচে নামতে থাকে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সাথে সাথে স্কেলার ক্ষেত্র তার ঘনত্ব কমাতে চায়। কিন্তু মালভূমিটি যদি যথেষ্ট সমতল হয় তাহলে বোঝাই যাচ্ছে সেই ঘনত্ব কমাতে (অর্থাৎ, মালভূমির চূড়া থেকে পর্বতের ঢাল বেয়ে উপত্যকায় নেমে আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। এই স্বল্প সময়ের জন্য মেকি ভ্যাকুয়াম একধরনের আপাতশূন্যতা হিসেবে কাজ করে,অর্থাৎ তার ঘনত্ব সেভাবে কমানো যায় না। আর এই ব্যাপারটাই যেন হাজির হয়েছিল সব রহস্যের সমাধান হিসেবে। গুথ তাঁর সে সময়কার সহকর্মী হেনরি তাই এর সাথে মিলে হিগস ফিল্ডের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে গুথ ভাবলেন, হিগস ফিল্ডের মানের সাথে হয়তো মহাবিশ্বের প্রসারণের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। ব্যাপারটা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে হবে।
নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে যা পেলেন তা এককথায় অভিনব। হিগস ক্ষেত্র একধরনের অতিশীতীভূত (supercool) অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়ে তার দশার পরিবর্তন ঘটায়, ফলে সে সময়টায় প্রতিসাম্যের ভাঙন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও যেন চেপেচুপে রাখা যায়। ‘অতিশীতীভূত অবস্থা’, ‘প্রতিসাম্যের ভাঙন’ এই কঠিন কঠিন শব্দ শুনে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। পুরো ব্যাপারটাকে সহজ উপমা দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। একে অনেকটা পানির দশা পরিবর্তনের সাথে তুলনা করা যায়। সাধারণ তাপমাত্রায় পানি তরল অবস্থায় থাকে। যেদিক থেকেই তাকাই না কেন, পানিকে একই রকম লাগে আমাদের। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে বলা যায়, তরল অবস্থায় পানি সবদিক থেকেই থাকে প্রতিসম। পানিকে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ঠান্ডা করলে তা বরফে পরিণত হয়, এ আমরা জানি, আর হরহামেশাই দেখি। কিন্তু যেটা অনেকেই জানি না তা হলো, বরফে পরিণত হওয়া মানেই কিন্তু এর প্রতিসাম্যতা ভেঙে পড়া। যেকোন বরফের চাই নিয়ে পরীক্ষা করলেই দেখা যায়, এর বিভিন্ন অক্ষ বরাবর অণুর সাজসজ্জা ভিন্ন হয়। তাই বলা যায়—তরল অবস্থায় পানির যে প্রতিসমতা বজায় ছিল তা ভেঙে পড়ে পানি বরফে পরিণত হয়ে গেলেই। তবে, একটু সতর্ক হলে আমরা কিন্তু পানির এই সহজাতভাবে বরফে পরিণত হওয়া ঠেকাতে পারি। এ জন্য অবশ্য দরকার অতিমাত্রায় বিশুদ্ধ পানি জোগাড় করে একে অতিদ্রুত বরফ গলনের তাপমাত্রার নীচে নিয়ে যাওয়া। এভাবে খুব তাড়াতাড়ি পানিকে ঠান্ডা করলে অনেক সময় দেখা যায়, পানি শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচেও বরফে পরিণত না হয়ে আগের মতোই তরল অবস্থাতেই থেকে যাচ্ছে। তরলের এই দশাকে ‘অধিতরল’ অবস্থা বলতে পারি আমরা। গুথ ভাবলেন, মহাবিশ্বও নিশ্চয় এভাবেই কাজ করেছিল শুরুতে। তাপমাত্রা ক্রান্তিমানের চেয়ে নিচে নেমে গেলেও প্রতিসাম্যতা বজায় ছিল, আর মহাবিশ্ব ছিল সাময়িক সময়ের জন্য অস্থায়ী দশায় মানে মেকি শূন্যতায় বন্দী হয়ে। কিন্তু এ ব্যাপারটা ঘটার জন্য সুপ্ততাপের মাধ্যমে অতিরিক্ত শক্তির যে জোগানটা এসেছিল, সেটাই দিয়েছিল বিকর্ষণমূলক ধাক্কা, অনেকটা আইনস্টাইনের সেই মহাজাগতিক ধ্রুবকের মতোই। মহাজাগতিক ধ্রুবকের মতো আচরণ বললেও, আসলে মাত্রাগতভাবে এর সাথে আইনস্টাইনের ধ্রুবকের পার্থক্য অনেক। গুথ ও হেনরির গণনা থেকে যেটা বেরোল সেটার মান আইনস্টাইন যা অনুমান করেছিলেন তার চেয়ে
১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ গুণ (অর্থাৎ ১০১০০ গুণ) বেশি। এই তীব্র বিকর্ষণ শক্তি তৈরি হয়েছিল বলেই মহাবিশ্ব এইভাবে এতটা দ্রুত বিবর্ধিত হতে পেরেছিল। ‘এতটা দ্রুত’ বলছি বটে, কিন্তু ঠিক কতটা দ্রুত? বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই মহাবিশ্বের আকার বেড়ে গিয়েছিল মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন গুণ (১ এর পরে ৩০টা শূন্য)। আর এই দানবীয় স্ফীতিটাই সমাধান করে দিয়েছিল নিচের সমস্যাগুলোর, যেগুলো স্ফীতিতত্ত্ব আসার আগে কোনোভাবেই সমাধান করা যাচ্ছিল না।
মহাবিশ্বের আকার
প্রথম সমাধানটা মহাবিশ্বের আকার সংক্রান্ত। আমাদের মহাবিশ্ব যে বড় তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ঠিক কতটা বড়? আমাদের জানাশোনা বস্তুকণার মধ্যে আলোর বেগ সবচেয়ে বেশি। সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। কিন্তু মহাবিশ্বের পুরোটুকু দেখতে চাইলে এই দানবীয় গতিবেগও নেহাত তুচ্ছ মনে হবে। আমাদের ছায়াপথ থেকে সবচেয়ে কাছের যে গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডা—সে রয়েছে ২০ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। সবচেয়ে দূরবর্তী যে গ্যালাক্সিগুলো টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায় সেগুলোর আলো ছড়িয়ে পড়েছিল ১৩ বিলিয়ন অর্থাৎ ১৩০০ কোটি বছর আগে। স্ফীতি-টিতি নিয়ে যদি আমরা মাথা না ঘামাতাম, তবে ঐ ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের দূরত্বকেই আমরা দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রান্তসীমা বলে ভাবতাম। আফটার অল বিগ ব্যাং তো হয়েছিল প্রায় ১৩০০ কোটি বছরের কাছাকাছি সময়েই। তাই ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের চেয়ে বেশি দূরের জিনিস দেখা যাবেই বা কিভাবে?
কিন্তু মজাটা হলো, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রান্তসীমা ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ নয়, বরং অন্তত ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষ”। মানে, ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের ঢের বেশি দূরের জিনিস বিজ্ঞানীরা ‘দেখতে’ পান। কিভাবে এটা হলো? এটা হলো, কারণ স্ফীতি তত্ত্বের কল্যাণে বিজ্ঞানীরা জানেন ১৩০০ কোটি বছর আগে যে গ্যালাক্সিগুলো থেকে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল, সেগুলো আমাদের কাছ থেকে আলোর গতির দ্বিগুণ গতিতে দূরে চলে গেছে। ফলে মধ্যবর্তী স্থানের ঘটেছে বিস্তর
Chris Impey (University of Arizona, Tucson), How Big is the Universe, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
প্রসারণ । আর দৃশ্যমান মহাবিশ্বের দেয়ালটা সরে গিয়ে ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দুই পাশ হিসাব করলে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস হবে ৯২০০ কোটি আলোকবর্ষ।
এ তো গেল ‘দৃশ্যমান’ মহাবিশ্বের কথা। প্রকৃত মহাবিশ্ব যে কত বড় কেউ তা জানে না। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের দেয়ালও তার কাছে ক্ষুদ্র। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে মহাবিশ্বের ব্যাস অন্তত ১৫ হাজার কোটি আলোকবর্ষের কম হবে না।
এত কম সময়ের মধ্যে কীভাবে তৈরি হয়েছে এই বিপুলাকৃতি মহাবিশ্ব? বিগ ব্যাং তত্ত্ব এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু স্ফীতি তত্ত্বের জন্য এর উত্তর দেওয়া কোনো সমস্যা নয়। কারণ স্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী শুরুতে মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটেছিল সূচকীয় হারে। কোনো কিছু সূচকীয় হারে বাড়লে সেটা কী রকম ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায় তার নমুনা পাওয়া যায় ভারতের প্রাচীন এক উপাখ্যানে। গল্পটা রসিকরাজ গ্যামো তাঁর ‘ওয়ান, টু, থ্রি … ইনফিনিটি’ বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন গুথের ‘ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ বইয়েও এর উল্লেখ আছে। ঘটনাটা এরকমেরঃ
George Gamow, One Two Three . . . Infinity: Facts and Speculations of Science, Dover Publications, 1988
এক জ্ঞানী দরবেশ দাবা খেলা আবিষ্কার করলে, সে রাজ্যের সুলতান তাঁর ওপর খুব খুশি হন। কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সুলতান দরবেশকে পুরস্কার দিতে চাইলে দরবেশ সুলতানকে এক অভিনব প্রস্তাব দিয়ে বসেন । বললেন, —মহারাজ, আমি যৎসামান্য ভিক্ষে চাই। প্রথম দিন দাবার প্রথম ছকে কেবল একটি গমের দানা।
কী? মাত্র একটা গমের দানা? তুমি কি আমার জৌলুশের প্রতি অবজ্ঞা করছ? দরবেশ উত্তরে বললেন,
– না হুজুর, ঠিক একটা গমের দানা নয়। প্রথম দিন একটা গমের দানা। এর পর দিন এর পরের ছকে থাকবে এর দ্বিগুণ দানা—অর্থাৎ দুটি৷ তৃতীয় দিন তৃতীয় ছকে থাকবে এর দ্বিগুণ—অর্থাৎ চারটি, এর পরদিন আটটি… এভাবে আমাকে প্রতিদিন ভিক্ষে দিতে হবে যত দিন না দাবার ছক পূর্ণ হয়।
সুলতানের ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটে উঠল। বললেন,
—তোমাকে অনেক জ্ঞানী আর চালাক ভেবেছিলাম। কিন্তু তোমার প্রস্তাব দেখে বুঝলাম তুমি তা নও। দাবার ৬৪টা ঘর পূর্ণ হতে মাত্র ৬৪ দিন লাগবে। একটা গমের দানা দিয়ে যাত্রা শুরু করে ৬৪ দিনে আর কয়টা গমের দানা তুমি কব্জা করবে? এখনো সময় আছে, অন্য কিছু যদি চাও তো চাইতে পারো।
না হুজুর, এই সামান্য ভিক্ষেই আমার সই।
“তথাস্তু’ বলে সুলতান দরবেশের প্রার্থনা মঞ্জুর করে দিলেন।
গমের দানা সূচকীয় হারে বাড়লে কোথায় যাবে – সেই গণিতটা সুলতান আসলে বুঝতে পারেননি। প্রথম কয়েক দিনে অবশ্য সুলতানের আসলেই কোনো চিন্তা ছিল না। কারণ প্রথম দিন একটি দানা, দ্বিতীয় দিন দুটি দানা, তৃতীয় দিনে চারটি দানা করে দরবেশ এগোচ্ছিলেন। সুলতান দরবেশের বোকামির জন্য আড়ালে- আবডালে তামাশাও করছিলেন সভাসদদের সাথে মিলে।
ষষ্ঠ দিনে দরবেশ ৩২টি দানা পেলেন। অষ্টম দিনে ১২৮টি গমের দানা পেলেন। কিন্তু এর পর যত দিন যেতে লাগল সম্রাটের কপালে রীতিমতো ভাঁজ পড়তে শুরু করল। ষোলোতম দিনে ৩২,৭৬৮টি দানার হিসাবে দেখা গেল দরবেশ বাবাজি সবমিলিয়ে ৬৫ হাজারের বেশি দানা কবজা করে ফেলেছেন। ২০ দিনে তা বেড়ে দাঁড়াল ১০ লক্ষ ৪৮ হাজার দানার ওপরে। সম্রাটের চোয়াল তখন রীতিমতো ঝুলে পড়েছে। তিনি খানিকটা হলেও বুঝতে শুরু করেছেন, দরবেশের পাওনা মেটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ দাবার সর্বশেষ ছক মানে ৬৪ নম্বর ঘরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তাকে ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন গমের জোগান দিতে হবে, যেটা ভারত বর্ষ তো কোন ছাড় হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীর সকল গমের দানা জোগাড় করলেও পোষাবে না। ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন গমের হিসাবটা যেন কেউ কোনো আকাশকুসুম কল্পনা ভেবে না বসেন, চৌষট্টিতম দিনে এসে সত্য সত্যই দরবেশের হস্তগত হবে ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১,৬১৫ টা দানা, যা দিয়ে আসলে সারা পৃথিবীকে কয়েক ইঞ্চি পুরু গমে ঢেকে ফেলা যাবে। এত গমের জোগান দেবার সাধ্য আর সুলতানের ছিল কোথায়?
মহাবিশ্বের স্ফীতিও কাজ করেছিল অনেকটা দরবেশের দাবার ছকে দেওয়া গমের মতোই। তবে পার্থক্য ছিল যে, স্ফীতির ঘরের সংখ্যা দাবার বোর্ডের ৬৪টি ঘরে সীমাবদ্ধ না থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল একশ কিংবা তার চেয়েও বেশিসংখ্যক ঘরে। ফলে মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই মহাবিশ্বের আকার বেড়ে প্রাথমিক আকারের ১০ গুণ হয়ে গিয়েছিল।
যার ফল আমরা পেয়েছি আজকের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের (অর্থাৎ, ১০২৮ সেন্টিমিটারের) মতো এত বড় একটা মহাবিশ্ব”।
পুরো গণনা পাওয়া যাবে এই সাইটে –
http://britton.disted.camosun.bc.ca/jbchessgrain.htm
অবশ্য পদার্থবিদ ও বিজ্ঞান লেখক ড. দীপেন ভট্টাচর্য আমাদের উল্লিখিত এ ধারণাটির সাথে একমত নন। তাঁর মতে (ব্যক্তিগত ম্যাসেজে আলোচনাক্রমে সঠিকভাবেই বলেছেন), এখানে “মধ্যবর্তী স্থানের প্রাসারনটাই” সঠিক উত্তর। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটি স্থানের প্রসারণ ঘটছে, শুধু গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে না, সেই জন্যই ১৩০০ কোটির জায়গায় ৪৬০০ কোটি পাচ্ছি। একটা সহজ ইন্টিগ্রেশন প্রোগ্রাম এই হিসাবটা করতে পারে, ইনফ্লেশনের প্রস্তাবনা ছাড়াই। তবে এই বিপুল আকারের সাথে স্ফীতির সম্পর্কের ব্যাপারটা লিন্ডের প্রস্তাবিত ইনফ্লেশনের মডেলে রয়েছে (এ প্রসঙ্গে দেখুন, A. D. LindeParticle Physics and Inflationary Cosmology (Contemporary Concepts in Physics), CRC Press;1990)
দিগন্ত সমস্যা
কোনো এক রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালে বোঝা যায় এদিকে-ওদিকে ছোটখাটো কিছু পার্থক্য থাকলেও মোটাদাগে আমাদের আকাশের দৃশ্যপটটা মোটামুটি সুষম। তেমনিভাবে কেবল আকাশ নয় আমাদের চারদিকে তাকালেও দেখা যায়, চারপাশের প্রকৃতি বিন্যস্ত হয়েছে সুষমভাবে। সেটা ভাল করে বোঝা যায় খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়ালে কিংবা এমনকি সুন্দরবনের মতো গহিন বনে গিয়ে হাঁটলেও। সুন্দরবনে জঙ্গলের একটু ভেতরে প্রবেশ করলেই আপনি দেখতে পাবেন, বনের গাছগুলো আপনাকে ঘিরে তৈরি করেছে এক সুষম জগৎ। আপনি আরেকটু এগিয়ে সামনে যান, কিংবা দুই কদম পিছিয়ে দাঁড়ান, একই ছবি পাবেন। আপনার অবস্থান পরিবর্তনের সাথে ডান, বাম, সামনে কিংবা পেছনের গাছগুলো হয়তো বদলাবে, কিন্তু মোটাদাগে সুষম জঙ্গলের ছবিটা প্রায় একই রকমের। অর্থাৎ গড় হিসাবে (স্থানিক বিচ্যুতি বাদ দিলে) পুরো জগৎটাই মোটের ওপর সমস্বত্ব আর দিকনিরপেক্ষ”। একই কথা বিজ্ঞানীরা বলেন মহাজাগতিক বিকিরণের তাপমাত্রা মেপেও। বিকিরণের তাপমাত্রা গড়পড়তা একইরকম পাওয়া যাবে। এবং সেটা যায়ও।
কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আমরা জানি, মহাবিশ্বে আলোর গতিই সর্বোচ্চ। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে আলোর গতিকে টেক্কা দিয়ে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মহাবিশ্বের যা বয়স তাতে করে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলো, তাপমাত্রা কিংবা তথ্য এত সহজে পৌঁছে যেতে পারে না। বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মহাবিশ্বে সেটা ঘটা তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব নয় কোনোভাবেই।
পরিস্থিতিটা আরো জটিল হয়ে যায় যখন আমরা বিগ ব্যাং-এর ৩৮০,০০০ বছর পরের আকাশের কোনো ছবি দেখি। এই সময়ের ছবিটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এই সময় মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের মায়াবী প্রতিচ্ছবিটা প্রথমবারের মতো এক ধরনের অবয়ব নিতে করেছিল। খুব ক্ষুদ্র স্কেলে ফ্লাকচুয়েশন থাকলেও মোটাদাগে এই বিকিরণের প্রতিচ্ছবির প্রকৃতি সুষম বলেই বিজ্ঞানীরা জানেন। বিগ ব্যাং-এর ৩৮০,০০০ বছর পরে মহাবিশ্বের ব্যাস এখন থেকে অনেক কম ছিল,হয়তো ৮ কোটি আলোকবর্ষ থেকে একটু বেশি। এর মানে হচ্ছে,এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণকে অন্তত ৮ কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দিতে হবে আজকের দিনের এই সমস্বত্ব অবস্থায় পৌঁছুতে। কিন্তু এটা এক
এ এম হারুন-অর-রশীদ ও ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, প্রথমা, ২০১১। অথবা, সৈয়দা লাম্মীম আহাদ ও ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা, তাম্রলিপি, ২০১২
কথায় অসম্ভব ব্যাপার, এমনকি আলোর বেগে তথ্য গেলেও ৩৮০,০০০ বছরের মধ্যে দুই পাশের সবকিছু এভাবে সমান করে দেওয়া সম্ভব নয়। এটা হলো কী করে? আলোর বেগে তথ্য গেলেও যে দূরত্ব অতিক্রম করা যাচ্ছে না, সেই দুর্লঙ্ঘ্য বাধা পেরিয়ে কিভাবে দুই প্রান্তকে একই জায়গায় নিয়ে আসা গেল? এটা বহুদিন ধরেই বিগ ব্যাং মডেলের জন্য একটা সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রবার্ট ডিকি (হ্যাঁ, যার নাম আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি, তাঁর বিখ্যাত ‘বয়েস, উই হ্যাভ বিন স্কুপড’ উক্তির মাধ্যমে) এর নাম দিয়েছিলেন ‘দিগন্ত সমস্যা’।
সমস্যার কথা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু সমাধানটা কী? কিভাবে অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের এবড়োখেবড়ো জমিকে এত তাড়াতাড়ি পিটিয়ে সমান করে দেওয়া গেল? কে চালাল অমানুষিক বেগে এই ‘থরের হাতুড়ি’? হ্যাঁ, উত্তর হচ্ছে আমাদের ‘ইনফ্লেশন’। গুথ চিন্তা করলেন, স্ফীতি যদি সত্য হয়ে থাকে তবে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই স্থানের প্রসারণ হয়েছিল ১০৩০ গুণ, ফলে নিমেষের মধ্যেই মহাবিশ্বের দুই প্রান্ত তাপীয় সাম্যাবস্থায় পৌঁছিয়ে যেতে পেরেছিল, ঠিক যেমনিভাবে চুলায় রান্নাবান্না করার পর আমাদের রান্নাঘর আর বসার ঘরের তাপমাত্রাকে সামান্য সময়ের মধ্যেই আমরা সমান হয়ে হয়ে যেতে দেখি। কিংবা কাপের গরম চা বাইরে রেখে দিলে সামান্য সময় পরই দেখি ঘরের তাপমাত্রায় নেমে আসতে।
মনোপোল সমস্যা
বিগ ব্যাং তত্ত্বের একটা ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, আমাদের মহাবিশ্বে বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয়
আধানযুক্ত অতি ভারী একক মেরুবিশিষ্ট কিছু কণিকার প্রাচুর্য থাকবে”। এই একক কণাগুলোকে বলা হয় মনোপোল। সহজ কথায় মনোপোল হচ্ছে সেরকম চুম্বক, যার কেবল উত্তর মেরু আছে, কিন্তু দক্ষিণ মেরু নেই; কিংবা হয়তো দক্ষিণ মেরু আছে, উত্তর মেরু নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ধরনের কোনো কণার অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই না।
একটা চুম্বক হাতে নিয়ে একে মাঝামাঝি জায়গায় দ্বিখণ্ডিত করুন। যে ছোট টুকরো দুটো পাওয়া যাবে, তাতে উত্তর আর দক্ষিণ মেরু থাকবে। সেগুলোকে দ্বিখণ্ডিত করলেও উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুবিশিষ্ট খণ্ড পাওয়া যাবে। যত ছোট
In one paper published in 1979, J. P. Preskill calculated that magnetic monopoles would be produced so copiously that they would outweigh everything else in the universe by a factor of about 102. (Ref. Preskill, J. P. 1979, Phys. Rev. Lett., 43, 1365)
টুকরাই আমরা করি না কেন, দেখব সব সময়ই উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুকে যুগল আকারেই পাওয়া যাচ্ছে। একক কোনো উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরু আমরা পাই না।
অথচ, ‘গ্র্যান্ড ইউনিফাইড’ তত্ত্বের জোরালো পূর্বাভাস ছিল যে এ ধরনের কণা থাকতেই হবে। তাহলে কেন আমরা সেগুলো দেখতে পাই না? এই ব্যাপারটারও সমাধান হিসেবে হাজির হলো স্ফীতি তত্ত্ব। গুথের গণনা থেকে জানা গেল, মেকি ভ্যাকুয়ামের দশায় মহাবিশ্ব এত বিপুলভাবে প্রসারিত হয়েছে যে, মনোপোলগুলোর ঘনত্ব লঘু থেকে লঘুতর হয়ে গেছে, আর মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে তা চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে, কিংবা একেবারেই নগণ্য স্তরে। বিজ্ঞানী শন ক্যারল তাঁর ‘ফ্রম ইটারনিটি টু হেয়ার’ গ্রন্থে একে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে
মনোপোল সমস্যার কথাই ধরুন। আদি মহাবিশ্বে এই মনোপোল প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয়েছিল। এখন চিন্তা করুন, মনোপোল তৈরির আগেই ইনফ্লেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এর ফলে ইনফ্লেশন যতক্ষণ টিকে থাকবে, আনুষঙ্গিক স্থান প্রসারিত হবে এত দ্রুতগতিতে যে, মনোপোলগুলো লঘুকৃত হতে হতে শূন্যতায় মিলিয়ে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ডার্ক সুপার এনার্জি (ইনফ্লেটন) অবক্ষয়িত হয়ে পদার্থে পরিণত হবে, এবং তেজস্ক্রিয়তা আর কোনো মনোপোল তৈরি করবে না—আর তারপর—হিং টিং ছট – মনোপোল সমস্যা উধাও হয়ে যাবে।
সামতলিক সমস্যা
স্ফীতি তত্ত্ব সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে যে সমস্যাটির সমাধান করেছিল সেটা হলো সামতলিক সমস্যা। অন্যগুলো যদি বাদও দিই, এই একটি সমস্যা সার্থকভাবে সমাধানের কারণেই স্ফীতি তত্ত্বকে এত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে শুরু করলেন মূলধারার জ্যোতিঃপদার্থবিদরা।
মজাটা হল, সামতলিক সমস্যা বলে যে কিছু একটা আসলে ছিল সেটাই গুথ প্রথমে জানতেন না। তখন তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ করছিলেন। সেটা সেই ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আইনস্টাইন দিবস’ উপলক্ষে একটা আলোচনা সভায় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রবার্ট ডিকির বক্তৃতা দেবার কথা ছিল। সে সময় গুথ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানকে দেখতেন একধরনের অস্পষ্ট ঘোলাটে বিষয় হিসেবে, যার কোনো সঠিক গন্তব্য নেই, নেই কোনো দিকনির্দেশনা। এর চেয়ে কণা-
Sean Carroll, From Eternity to Here: The Quest for the Ultimate Theory of Time, Dutton Adult, 2010
পদার্থবিজ্ঞানের সাজানোগোছানো কাঠামোটাই ছিল তার কাছে ঢের উপাদেয়! গুথ তাঁর বইয়ে বলেছেন, ‘যদি সপ্তাহটাতে আরেকটু বেশি ঝামেলা থাকত, তাহলে হয়তো ডিকির লেকচার শুনতে যাওয়া হতো না’।
কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে সপ্তাহে ঝামেলাটামেলা তেমন কিছু ছিল না, আর গুথও যথারীতি লেকচার শুনতে যেতে পারলেন। সেখানে গিয়ে গুথ দেখলেন, ডিকির বক্তৃতার মূল বিষয় হচ্ছে ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম বা ‘সামতলিক সমস্যা’; এটি নাকি মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের জন্য সবচেয়ে বড় একটা ধাঁধা। ডিকি তাঁর বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করলেন, আমাদের মহাবিশ্বকে ‘দেখলে’ মনে হয় তা যেন অতিমাত্রায় ‘ফ্ল্যাট’। এর মানে, আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ‘বদ্ধ’ আর ‘উন্মুক্ত’ মহাবিশ্বের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে খুব কায়দা করে গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। সেটা কীভাবে হচ্ছে বলার আগে বদ্ধ আর উন্মুক্ত মহাবিশ্ব নিয়ে দুচার কথা বলে নেওয়া যাক। বদ্ধ মহাবিশ্ব হচ্ছে সেই মহাবিশ্ব যা প্রসারিত হতে হতে একসময় মাধ্যাকর্ষণের টানে আবার চুপসে যেতে শুরু করবে। অন্য দিকে উন্মুক্ত মহাবিশ্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে কেবল প্রসারিতই হতে থাকবে ক্রমাগত। আর ডিকির আলোচিত ফ্ল্যাট বা সামতলিক মহাবিশ্ব থাকবে এই দুইয়ের মাঝামাঝি। এই সামতলিক মহাবিশ্ব প্রসারিত হবে বটে, তবে কোনো রকমে পাস-মার্ক পেয়ে পাস করে যাওয়া ছাত্রের মতো টায়ে টায়ে। ফেল করার হাত থেকে খুব কায়দা করে গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। এখন মহাবিশ্ব উন্মুক্ত হবে না বদ্ধ হবে নাকি সামতলিক হবে, তা নির্ভর করে মহাবিশ্বের ভর তথা গড় ঘনত্বের ওপর। মহাবিশ্বের প্রকৃত ঘনত্ব আর সন্ধি ঘনত্ব (অর্থাৎ যে ঘনত্ব মহাবিশ্বকে চুপসে দেবার জন্য যথেষ্ট) – এর অনুপাতকে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেন গ্রিক অক্ষর ওমেগা (Ω) দিয়ে। মহাবিশ্বকে সামতলিক বা ফ্ল্যাট হতে হলে এর মান হতে হবে ১-এর কাছাকাছি।
ডিকির লেকচার শেষে নিজের বাসায় গিয়ে খাতাকলম নিয়ে বসলেন গুথ। দেখলেন প্রমিত বিগ ব্যাং মডেলে সামতলিক মহাবিশ্ব পেতে হলে মহাবিশ্বের শুরুতে ওমেগার মান শুধু ১-এর কাছাকাছি নয়, এক্কেবারে সমান হতে হবে। একটু কমবেশি হলেই ভ্যারাচ্যারা লেগে যাবে। যেমন, ১-এর চেয়ে একটু কম মান নিয়ে যাত্রা শুরু করলেই দেখা যাবে কিছুদিন পর তা কমতে কমতে ১-এর এত নিচে চলে যাবে যে সেই মহাবিশ্বে গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা তৈরি হবার মতো কোনো পরিবেশই গঠিত হবে না। আবার ১-এর চেয়ে সামান্য বেশি মান নিয়ে যাত্রা শুরু করলে হবে আরেক বিপদ। কিছুদিনের মধ্যেই এই মান বাড়তে বাড়তে এত বেশি হয়ে যাবে যে, এই মহাবিশ্ব আর প্রসারিত না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়বে নিজের ঘাড়েই।
কারণটা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। আজকের যে মহাবিশ্বের ছবি আমরা দেখি, সেটা আদি (রিকম্বিনেশনের সময়ের) মহাবিশ্বের অন্তত এক লক্ষ কোটি গুণ আকারে বেড়েছে। তাই, মহাবিশ্ব যদি শুরুতে ক্রান্তি ঘনত্বের চেয়ে শতকরা দশ ভাগ কম বা বেশি মান নিয়ে যাত্রা শুরু করত, তবে আজকে আমাদের মহাবিশ্বের ঘনত্বের মান অন্তত এক লক্ষ কোটি গুণ পার্থক্য পাওয়া যেত।
এই পুরো ব্যাপারটাকে নিচের সমীকরণের সাহায্যে লেখা যায় এভাবে—
গুথ গণনা করে দেখলেন, মহাবিস্ফোরণের ১ সেকেন্ড পরে ভর ঘনত্বের মান ক্রান্তীয় ঘনত্বের থেকে ১,০০০০০০০০০০০০০০১-এর মধ্যে থাকতে হবে, নইলে আজকের এই সামতলিক মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে না।
এবার স্ফীতিকে গোনায় ধরে আবারো ক্যালকুলেশন করলেন গুথ। এবারে যে সমীকরণ পেলেন তা ওপরেরটা থেকে একেবারেই ভিন্ন। তার প্রকৃতি হলো এরকমের –
Ω – 1 α e-2Hinƒt
যেখানে Hinƒ হচ্ছে স্ফীতি চলাকালীন সময়ে হাবলের প্যারামিটার। সমীকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাম পাশে যে মান নিয়েই ওমেগা যাত্রা শুরু করুক না কেন, t-এর মান যত বাড়বে, ডান পাশের চলকটি (e-2Hinƒt ) তা ০-এর কাছাকাছি চলে যাবে। ডান পাশের চলক শূন্য হয়ে যাবার অর্থ হলো, ওমেগা (Ω)-এর মান ১ এর কাছাকাছি চলে যাওয়া।
Ω – 1 → 0
Ω → 1
গণিত থেকে পাওয়া এই ফলাফল সত্যই দুর্দান্ত। প্রমিত বিগ ব্যাং থেকে পাওয়া আগের উপসংহার ছিল—ওমেগার মান ১-এর সমান হতে হবে খাপে খাপ (কিছু বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেছিলেন সেটা হতে হবে ১০১৫ ভাগের ১ ভাগ সূক্ষ্মতায়)। গুথ তাঁর গণনায় দেখালেন – না, ওমেগাকে যাত্রা শুরুর সময় এত সূক্ষ্মভাবে সমন্বিত (Fine tuned) হবার দরকার নেই। প্রমিত বিগ ব্যাং মডেলে
H Dicke, & Peebles, P. J. E., in General Relativity : An Einstein Centenary Survey, ed. S. W. Hawking & W. Israel (Cambridge: Cambridge Univ. Press), 1979
যেখানে সামান্য হেরফের হলেই ওমেগার মান ১-এর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, সেখানে স্ফীতি তত্ত্ব একেবারে বিপরীত উপসংহার নিয়ে আসল। দেখা গেল ১, ১০০০, ১,০০০,০০০, .০০০১ অথবা .০০০০০১ কিংবা এ ধরনের যেকোনো মান দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও স্ফীতির কারণে ওমেগার মান ১ থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং সব সময়ই ১-এর দিকে চলে আসে, আর মহাবিশ্বকে করে তোলে পুরোপুরি সামতলিক।
ঠিক তখনই গুথ বুঝতে পারলেন তিনি মহাবিশ্বের অন্তিম রহস্যটা এক ধাক্কায় সমাধান করে ফেলেছেন, তিনি তাঁর ডায়েরির পাতায় শিরোনাম দিলেন ‘স্পেক্টেকুলার রিয়েলাইজেশন’ বা ‘অভাবনীয় অনুভব’; তারপর ওটার চারদিকে ডবল মার্জিন দেওয়া বক্স করে লিখলেন –
অভাবনীয় অনুভবঃ
এ ধরনের অতিশীতীভূতকরণ ব্যাখ্যা করতে পারে কেন আমাদের মহাবিশ্ব আজকে এত প্রত্যয়াতীতভাবে সমতল, এবং সেই সঙ্গে এটি রবার্ট ডিকি আইনস্টাইন দিবসের দিনের লেকচারে যে সূক্ষ্ম সমন্বয়ের ধাঁধা উপস্থাপন করেছিলেন, সেটারও সমাধান দিয়ে দেয়।
গুথ তাঁর গণনার ফলাফলগুলো ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠালেন সে বছরই ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে। সহকর্মী হেনরি তাই- এর সাথে যৌথভাবে লেখা সেই গবেষণাপত্রটি জার্নালে আলোর মুখ দেখেছিল ১৯৮০ সালে। এর পরের বছর প্রকাশিত হয় গুথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পেপার। ১৯৮১ সালে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত এ গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল ‘স্ফীতিময় মহাবিশ্বঃ দিগন্ত এবং সামতলিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান”।
A. H. Guth and S.-H. H. Tye, “Phase Transitions and Magnetic Monopole Production in the Very Early Universe, ” Phys. Rev. Lett. 44, 631, 1980.
Alan H. Guth, The Inflationary Universe: A Possible Solution to the Horizon and Flatness Problems., Physical Review D, Volume 23
সাফল্য ও প্রতিক্রিয়া
গুথের গবেষণার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকাশিত হলেও প্রাথমিকভাবে গুথ একটু ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, হয়তো তাঁর গণনায় কোথাও ভুলত্রুটি আছে। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই তত্ত্বের ভুল বের করে ফেলবেন, এবং তিনি তাঁর সহকর্মীদের মাঝে ঠাট্টাতামাশার পাত্র হয়ে উঠবেন।
তা অবশ্য হলো না। আশির দশকে গুথ যখন তাঁর নতুন তত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছিলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মারে গেল-ম্যান উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটির সমাধান করে ফেলেছেন’। এম আইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেন পি লাইটম্যান তাঁর ধারণাটিকে অভিহিত করেছেন, “বিগ ব্যাং-এর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক ধারণার উন্নয়ন’ হিসেবে। আরেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী শেল্ডন গ্ল্যাসো একদিন গুথের কাছে এসে বললেন, ‘গুথ, স্টিভেন ওয়েনবার্গ কিন্তু ইনফ্লেশনের কথা শুনে খুব রেগে গেছেন’।
-“তাই নাকি? স্টিভ কি কোনো সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন?” উদ্বিগ্ন গুথ প্ৰশ্ন করলেন গ্ল্যাসোকে। গ্ল্যাসোর সাথেই পদার্থবিজ্ঞানে ভাগাভাগি করে নোবেল পেয়েছিলেন ওয়েনবার্গ। তাই স্টিভেন ওয়েনবার্গ কোনো সমস্যা খুঁজে পেলে তা নির্ঘাত বিপদের কথা, জানতেন গুথ।
—— নাহ!’ আশ্বস্ত করলেন গ্ল্যাসো— ‘এই স্ফীতির ব্যাপারটা তাঁর নিজের মাথায় আসেনি কেন, এ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্টিভ।’
না, স্ফীতি তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো সমস্যা তৈরি করল না, বরং বড় ধরনের আলোড়নই ফেলে দিল বিজ্ঞানীদের মাঝে। মূলধারার বিজ্ঞানীরা স্ফীতি তত্ত্বকে সাদরেই গ্রহণ করলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী কয়েক বছর ধরে স্ফীতি নিয়ে গবেষণাপত্রের লাগাতার প্রকাশে। একটা সময় গুথ হিসাব করতে বসেছিলেন কয়টা পেপারে স্ফীতি তত্ত্বের উল্লেখ আছে। প্রথম বছরই অন্তত ৪০টি পেপারে গুথের কাজের উল্লেখ থাকল। তারপর থেকে যেন এটা বাড়তে লাগল প্রায় গুণোত্তর হারেই। ১৯৯৭ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ বইটি লেখার আগ পর্যন্ত হিসাব করে দেখেছিলেন, অন্তত ৩০০০টা পেপারে ইনফ্লেশন নিয়ে গবেষণার হদিস আছে; তারপর গোনাগুনি ছেড়ে দিয়েছিলেন গুথ। সেসব নিত্যনতুন গবেষণাপত্রে পুরাতন স্ফীতি, নতুন স্ফীতি, কেওটিক স্ফীতি, হাইব্রিড স্ফীতি, হাইপারটেক্সট স্ফীতি থেকে শুরু করে
Issue 2, 1981
‘ওয়ার্ম’, ‘সফট’, ‘টেপিড’, ‘ন্যাচারাল’সহ বিভিন্ন ধরনের স্ফীতির ভাষ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়”। তবে স্ফীতির যে নতুন ভাষ্যই তৈরি হোক না কেন, তাকে যাত্রা শুরু করতে হয় গুথ বর্ণিত উচ্চ শক্তি ঘনত্ববিশিষ্ট সেই ‘ফলস ভ্যাকুয়াম’ ধরনের স্তর থেকে, আর করতে হয় কোনো-না-কোনোভাবে বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের প্রয়োগ। শুধু পেপারেই নয়, সাফল্য এল তাঁর নিজের কর্মজীবনেও। এক অখ্যাত অচেনা পোস্ট ডক্টরেট ফেলো থেকে রাতারাতি পরিণত হলেন এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকে; পরিণত হলেন মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একজন শীর্ষস্থানীয় কান্ডারিতে।
এরপর যত দিন গেছে স্ফীতি তত্ত্ব কেবল জোরালো থেকে জোরালোই হয়ে উঠেছে কেবল। স্ফীতি তত্ত্বে পক্ষে প্রমাণের পাহাড় কেবল বাড়ছেই। স্ফীতি তত্ত্ব কেবল বিগ ব্যাং-এর মনোপোল, দিগন্ত বা সামতলিক সমস্যাজাতীয় সমস্যাগুলোই সমাধান করেনি, দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। একটি হলো, মহাবিশ্বের জ্যামিতি হতে হবে সামতলিক, অর্থাৎ ওমেগা (2)-র মান হবে ১-এর একদম কাছাকাছি। আর দ্বিতীয়টি হলো, আদি মহাবিশ্বের সঠিক ছবি কেউ তুলতে পারলে সেখানে কিছু বিশেষ প্যাটার্নে ঘনত্বের পার্থক্য বা ফ্লাকচুয়েশন পাওয়া যাবে। দুটোই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৩ সালে ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্থনি অ্যাগুরি বলেন,
দুটো ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতাই নির্ণীত হয়েছে নাসার উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব স্যাটেলাইটের পাঠানো উপাত্তের মাধ্যমে। স্ফীতি তত্ত্ব উত্তীর্ণ হয়েছে সময় সময় এ ধরনের বিভিন্ন পর্যবেক্ষিত পরীক্ষার মাধ্যমে খুব দুরন্তভাবেই। স্ফীতির যে প্রসারণের কথা আমরা বলি সেটা বোধ হয় সত্যই ঘটেছিল ।
তবে পরিস্থিতি প্রথম থেকেই এরকম কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ওমেগার সঠিক মান নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক ছিল অনেক দিন ধরেই। যদিও গুথের গণনা ইঙ্গিত করছিল স্ফীতি তত্ত্ব সঠিক হলে, ওমেগার মান ১-এর কাছাকাছি হতেই হবে, কিন্তু
Brad Lemley and Larry Fink, Guth’s Grand Guess, Discover, April 01, 2002.
A. D. Linde, Particle Physics and Inflationary Cosmology (Contemporary Concepts in Physics), vol 5, CRC Press, 1990
Anthony Aguirre (University of California, Santa Cruz ), How did Our Universe Come to be?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
সত্যই সেটা ১ কি না বহুদিন পর্যন্ত আমরা জনতে পারিনি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল টার্নার অবশ্য লরেন্স ক্রাউসের সাথে মিলে মাঝখানে (১৯৮৫ ও ১৯৯৫ সালে) দুটো পেপার লিখেছিলেন। সেখানে তাঁরা দাবি করেছিলেন যে মহাবিশ্বের জ্যামিতি হতে হবে সামতলিক”, কিন্তু তার পরও সেটা সঠিক কিনা কেউ নিশ্চিত ছিলেন না। ওমেগার মান পর্যবেক্ষণ থেকে আসছিল সর্বসাকল্যে মাত্র ০.২-এর মতো। অর্থাৎ মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব পাওয়া যাচ্ছিল সন্ধি ঘনত্বের মাত্র শতকরা ২০ ভাগও। আর সেটা তৈরি করেছিল স্ফীতি তত্ত্বের জন্যও অস্বস্তিকর একটা ক্ষেত্র । হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট ক্রিশনার বলেছিলেন, “দিস ইনফ্লেশন আইডিয়া সাউন্ডস ক্রেজি’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার পেনরোজ বলেছিলেন, ‘হাই এনার্জি ফিজিসিস্ট- দের জ্যোতির্বিজ্ঞানে এসে নাক গলানোটা মনে হচ্ছে একধরনের ফ্যাশন হয়ে গেছে। এমনকি কুৎসিত আর্ডভার্করাও ভাবে তার সন্তান খুব সুন্দর’। এর মধ্যে ১৯৮২ সালে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং নাফিল্ড ওয়ার্কশপ নামে একটা ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছিলেন, যার অফিশিয়াল শিরোনাম ছিল ‘দ্য ভেরি আর্লি ইউনিভার্স’। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণারত ত্রিশ জন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীকে আহবান জানানো হয়েছিল সেই ওয়ার্কশপে। অ্যালেন গুথ, পল স্টেইনহার্ট, মাইকেল টার্নারসহ অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীই উপস্থিত ছিলেন সেই ওয়ার্কশপে। সেই ওয়ার্কশপ শেষে সারসংকলন করতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উইলজেক খুব স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, “ওমেগার মান ১-এর কাছাকাছি পাওয়া না গেলে স্ফীতি তত্ত্বের কোনো ভাত নেই”।
Michael S. Turner, Gary Steigman and Lawrence M. Krauss, Flatness of the Universe: Reconciling Theoretical Prejudices with Observational Data, Phys. Rev. Lett. 52, 2090-2093, 1984 Also see, Lawrence M. Krauss and Michael S. Turner, The Cosmological Constant Is Back., General Relativity and Gravitation, Vol. 27, No. 11, page 1135; 1995.
Richard Panek, The 4 Percent Universe: Dark Matter, Dark Energy, and the Race to Discover the Rest of Reality, Houghton Mifflin Harcourt; 2011
G. W. Gibbons (Editor), S. W. Hawking (Editor), S. T. C. Siklos, The Very Early Universe: Proceedings of the Nuffield Workshop, Cambridge 21 June to 9 July, 1982
Richard Panek, The 4 Percent Universe: Dark Matter, Dark Energy, and the Race to Discover the Rest of Reality, Houghton Mifflin Harcourt; 2011
কিন্তু সবকিছুই বদলে গেল যখন গুপ্ত পদার্থ (Dark Matter) গুপ্ত শক্তি (Dark Energy)র খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা। গুপ্ত পদার্থের খোঁজ অবশ্য বিজ্ঞানীরা বেশ আগেই পেয়েছিলেন ফ্রিৎস জুইকি এবং পরে ভেরা রুবিনের পর্যবেক্ষণের কল্যাণে সেই সত্তরের দশকেই। কিন্তু তার পরও ওমেগার মান ১-এর কাছাকাছি আসছিল না; মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব পাওয়া যাচ্ছিল ক্রান্তি ঘনত্বের কেবল এক-তৃতীয়াংশ। সোজা কথায়, আমাদের চেনাজানা পদার্থ আর গুপ্ত পদার্থ মিলিয়ে শতকরা ৩০ ভাগ পদার্থের সন্ধান আমরা পাচ্ছিলাম তখন। কিন্তু মহাবিশ্বকে সমতল প্রমাণ করার জন্য দরকার ছিল আরো ৭০ ভাগ শক্তির যা মহাবিশ্বের সামগ্রিক কাঠামোর ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না, কিন্তু সন্ধি ঘনত্বে পৌঁছানোর জন্য বাদবাকি শক্তির জোগান দেবে।
গণিতের ভাষায় বললে, আমাদের হাতে তখন Ω(পদার্থ) = ০.২৭ মানের সমান উপকরণ ছিল। মহাবিশ্বকে সমতল করার জন্য আমাদের দরকার ছিল বাদবাকি Ω(Λ) = ০.৭৩-এর হিসাব। সেটাই পাওয়া গেল ১৯৯৮ সালে। টাইপ ১-এ সুপারনোভা নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের দুই দল মহাবিশ্বের প্রসারণের হার কতটুকু কমছে সেটা বের করতে গিয়ে দেখেন, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার আসলে কমছে না বরং সমানে বেড়ে চলেছে। আর এই বেড়ে চলার পেছনে আছে এক অজ্ঞাত শক্তি—শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল টার্নারের সুপারিশক্রমে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘গুপ্ত শক্তি’ বা ডার্ক এনার্জি হিসেবে। গুপ্ত শক্তির হদিস পাওয়ার পরপরই গণিতের হিসাবটা মিলে গেল খাপে খাপ
Ω(চেনা জানা ব্যারিয়নিক পদার্থ) + Ω(গুপ্ত পদার্থ) + Ω(Λ)
= ০.০৪ + ০.২৩ + ০.৭৩
= ১
কেবল গুপ্ত শক্তির হিসাব থেকেই নয়, মহাবিশ্বের জ্যামিতি যে সামতলিক, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করেও। প্রথম প্রমাণ এসেছিল ১৯৯৭ সালের দিকে যখন একদল বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিকায় বড়সড় বেলুন উড়িয়ে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের প্রকৃতি ধরার চেষ্টা করলেন। তারা তাঁদের বেলুনে লাগিয়ে দিয়েছিলেন খুব সংবেদনশীল এক টেলিস্কোপ। সে বেলুন মাটির ১২০,০০০ ফুট ওপর থেকে সাড়ে দশ দিন ধরে ডেটা সংগ্রহ করে ফলাফল প্রকাশ করল। সে ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন যে মহাবিশ্বের প্রকৃতি সত্যই সমতল।
আরো নিখুঁত ফলাফল পাওয়া গেল কয়েক বছর পর WMAP-এর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। সেখানে ওমেগার মান পাওয়া গেছে Ω = ১.০২ ±০.০২, যা স্ফীতি তত্ত্বের অনুমানের সাথে প্রায় অবিকল মিলে যায়”। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ২০১৩ সালে নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে বলেই ফেললেন, ‘ডব্লিউম্যাপ থেকে পাওয়া স্ফীতির সাক্ষ্যগুলো আমার পেশাগত জীবনে সবচেয়ে চমকপ্রদ সাফল্য’।
Alan H. Guth, Inflation, Carnegie Observatories Astrophysics Series, Vol. 2, Measuring and Modeling The Universe, 2004
গুপ্ত শক্তি নামে হারানোর শক্তির আবিষ্কার এবং ডব্লিউম্যাপ ডেটা থেকে পাওয়া নিখুঁত পর্যবেক্ষণ সমতল মহাবিশ্ব নিয়ে সব বিতর্কের মোটামুটি যবনিকাপাত ফেলে দেয়; এবং সেই সাথে স্ফীতি তত্ত্বের সফলতার মুকুটে যোগ করে এক নতুন পালক। ২০০১ সালে অ্যাস্ট্রোনমি ম্যাগাজিন শিরোনাম করল, ‘মহাবৈশ্বিক সুর গাইছে স্ফীতির গান’। এর দু মাস পরই ফিজিকস টুডেতে নিবন্ধিত হলো আরেকটি প্রবন্ধ ‘স্ফীতি তত্ত্বের আরেকটি বিজয়’70 শিরোনামে। স্ফীতি তত্ত্ব পরিণত হলো মহাজাগতিক গবেষণার অন্যতম সজীব একটি ক্ষেত্রে।
খুব সম্প্রতি স্ফীতি তত্ত্বের মুকুটে যোগ হয়েছে সাফল্যের আরেকটি বড় পালক। স্ফীতি তত্ত্বের একটি বড় অনুমান ছিল, প্রচণ্ড রকমের স্ফীতির মধ্য দিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব উদ্ভূত হয়ে থাকে, তবে সেই ধাক্কার কিছুটা রেশ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আকারে আমাদের খুঁজে পাওয়ার কথা। এই মহাকর্ষ তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যায় যে হাইপোথিটিকাল কণা, বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছিলেন ‘গ্র্যাভিটন’। ফোটন কণার কথা যে আমরা অহরহ শুনি সেটা আলোক কণিকা বা তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যায়। তড়িচ্চুম্বক বলের ক্ষেত্রে বার্তাবহ কণিকা যেমন হচ্ছে ‘ফোটন কণিকা”, তেমনি সবল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে আছে ‘গ্লুয়োন’ (Gluon) আর দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য রয়েছে W এবং Z কণা। মহাকর্ষের ক্ষেত্রেও তেমনি কল্পণা করা হয়েছে গ্র্যাভিটন কণার। সেই ১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা জানতেন মহাবিস্ফোরণের প্রমিত মডেল সঠিক হলে এই মহাকর্ষ তরঙ্গ একদিন না একদিন খুঁজে পাবেন তারা।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মহাকর্ষীয় এ তরঙ্গ খুব দুর্বল তরঙ্গ। এটা এমনিতে খুঁজে পাওয়া মুশকিলই। গ্র্যাভিটনের সাথে পরিচিত পদার্থের মিথষ্ক্রিয়া এতোই দুর্বল যে এটা মানবীয় পরিমাপণের সীমার বাইরে বলেই এতোদিন ধরে নেয়া হত। কিন্তু সেই অসাধ্যই সম্পন্ন করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সম্প্রতি (মার্চ, ২০১৪) জন কোভাক সহ ‘হার্ভার্ড স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ এর সাথে নিযুক্ত পদার্থবিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ তরঙ্গ সনাক্ত করতে পেরেছেন বলে দাবী করা হচ্ছে। অ্যান্টার্কটিকায় পরিচালিত বাইসেপ২ পরীক্ষার (BICEP2 experiment) মাধ্যমে এই তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে বলে মিডিয়ায় এসেছে?
70 A. Guth,: Inflation and the New Era of High-Precision Cosmology. MIT Physics Annual, pp. 28–39, 2002
Staff, BICEP2 2014 Results Release, National Science Foundation, March 17, 2014
D. Overbye, Detection of Waves in Space Buttresses Landmark Theory of Big Bang, New York Times, March 17, 2014
যেভাবে সনাক্ত করা হয়েছে, তার মূল ব্যাপারটি বর্ণনা করলে দাঁড়াবে এরকমের । বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সরাসরি দেখতে পান না বটে, কিন্তু আদি মহাবিশ্ব থেকে আসা তরঙ্গের প্রভাব আলোর উপরে কেমন সেটা তারা সনাক্ত করতে পারেন। বিজ্ঞানীরা জানেন যে, তরঙ্গ আলোকে ‘পোলারাইজ’ করে দিতে পারে। আলো বিভিন্নভাবে পোলারাইজড হতে পারে, কিন্তু স্ফীতির উপজাত হিসেবে পাওয়া মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ একটি বিশেষ উপায়েই কেবল আলোর এই পোলারাইজেশন ঘটাতে পারে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন, ‘B mode polarization’। এ পোলারাইজেশন কিভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা বের করতে গিয়ে অবশ্য তাদের বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের ‘ক্লাম্পস’ এবং ‘জিগেলস’ এর কৌনিক গতিপ্রকৃতি সহ বহুকিছু। আর এগুলো বিশ্লেষণ করেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্বন্ধে৷
এই আবিষ্কারের ফলে মহাকর্ষ আসলেই যে একটি কোয়ান্টাম ঘটনা থেকে উদ্ভূত উদ্ভাস – বিজ্ঞানীদের অনেক দিনের ধারণার প্রমাণ পাওয়া গেল। স্বয়ং জন কোভাক ‘নেচার’ জার্নালের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে জড়িত সবাই জানে, হয়তো স্পষ্ট করে বলে না যে, স্ফীতি থেকে পাওয়া ‘বি মোড’ এর ভবিষ্যদ্বাণী কেবল মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ঘটনাই নয়, সেই সাথে মকাকর্ষ নিজেও যে কোয়ান্টাইজড – সেটার ইঙ্গিতবাহী। স্ফীতিতত্ত্বের অনুমান ছিল, সবকিছুই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন থেকে উদ্ভূত, এবং স্ফীতির মাধ্যমে বিবর্ধিত হয়েছে। কাজেই গভীর স্তরে গিয়ে চিন্তা করলে, এই আবিষ্কার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং মহাকর্ষের সাথে এর সম্পর্কের স্থাপনার উপর দাঁড়িয়ে আছে।
সেইসাথে মহাবিশ্ব যে এক ধরণের ‘কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনেরই ফসল’ এই ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়ে উঠল। তবে সে আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য তোলা থাক, আমরা এখানে স্ফীতি তত্ত্বের বিবর্তনের ইতিহাসের সাথে পরিচিত হব।
স্ফীতি তত্ত্বের বিবর্তন
১৯৮১ সালে দেওয়া অ্যালেন গুথের স্ফীতি তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা খুব সাদরে গ্রহণ করলেও মূল ভাষ্যে একটা ছোট সমস্যা ছিল। গুথ স্ফীতির শুরুটা কিভাবে ঘটবে সেটা বুঝতে পারলেও এর সমাপ্তি কিভাবে ঘটবে সেটার সুরাহা তিনি করতে
How astronomers saw gravitational waves from the Big Bang, Nature | News: Q&A, March 17, 2014
পারছিলেন না। এ যেন অনেকটা মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অভিমন্যুর মতো অবস্থা। অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল জানতেন, কিন্তু নির্গমের কৗশল জানতেন না।
আসলে সমস্যাটা করেছিল প্রকৃত ভ্যাকুয়ামে উত্তরণের সময় মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়। গুথ দেখছিলেন, এই মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়ের ফলে অসংখ্য বুদ্বুদ তৈরি হয়। একটা পাত্রে পানি নিয়ে চুলায় ফুটাতে থাকলে আমরা যেমন দেখি, অনেকটা সেরকমের। কিন্তু গুথের মডেলে পাওয়া বুদ্বুদগুলো ছিল মহা বদ্ খদ। তারা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ ঘটিয়ে অতি দ্রুত এমন ‘ভ্যারাচ্যারা অবস্থা’ তৈরি করে যে মহাবিশ্বের সমস্বত্ব অবস্থার একেবারে বারোটা বেজে যায়। অর্থাৎ গুথের মূল মডেল সত্য হলে মহাবিশ্ব আজকের দিনের মতো এত সুষম হবার কথা নয়। কাজেই কোথাও একটা ঝামেলা আছে। এই ঝামেলার ব্যাপারটা অবশ্য গুথের নিজেরই নজরে পড়েছিল74। সেই সাথে পড়েছিল আরেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর অভিজ্ঞ চোখেও। হকিং একটু ভিন্ন দিক থেকে গণনা করে সিদ্ধান্তে এলেন, বুদ্বুদগুলোর সংঘর্ষ কোনো সমস্যা করবে না, কিন্তু বুদ্বুদগুলোর তুলনায় মহাবিশ্ব এত দ্রুত প্রসারিত হবে যে কোনো ধরনের সংঘর্ষ ঘটারই সুযোগ পাবে না, আর সেটা মহাবিশ্বকে একসময় পরিণত করবে এক ‘এম্পটি ইউনিভার্স’-এ; এর কোনো কোনো জায়গায় প্রতিসাম্যের ভাঙন ঘটবে, কোনো কোনো জায়গা থেকে যাবে অক্ষত। এই মহাবিশ্ব মোটাদাগে পরিণত হবে সমরূপতা-বিবর্জিত এক মহাবিশ্বে যা মোটেই আমাদের আজকের মহাবিশ্বের মতো নয়75 । কাজেই গুথের ‘পুরাতন’ এ স্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী হয় বুদ্বুদের স্থানান্তর ঘটবে এত দ্রুত যে যথেষ্ট স্ফীতি ঘটার সুযোগ থাকবে না, আর নয়তো এত ধীরে এগুবে যে, মহাবিশ্ব স্ফীতি থেকে বেরুতেই পারবে না। এই সমস্যাটিকে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ (graceful exit problem) হিসেবে।
এই সমস্যাটির সমাধান হাজির করলেন রুশ বিজ্ঞানী আঁদ্রে লিন্ডে ১৯৮২ (এর কিছুদিন পরই আরো দুই বিজ্ঞানী—পল স্টেইনহার্ট ও আলব্রিচট
A.H. Guth, & Weinberg, E.J. ‘Could the universe have recovered from a slow first-order phase transition?’, Nucl. Phys. B212, 321, 1983
W. Hawking., Moss. I. G. & Stewart. J. M., Bubble collisions in the very early universe. Phys. Rev. D26. 2681, 1983.
D. Linde, “A new inflationary universe scenario : A possible solution of the horizon, flatness, homogeneity, isotropy and primordial monopole problems,” Phys. Lett. B 108, 389, 1982
স্বতন্ত্রভাবে গবেষণা করে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন)। লিন্ডে দেখলেন বুদ্বুদের সংযোগের সমস্যাকে সহজেই সমাধান করা যায় যদি মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়ের সময় উদ্ভূত বুদ্বুদগুলোকে শুরুতেই কোনো-না-কোনোভাবে একটি বড়সড় বুদ্বুদের ভেতরে সাঁটানো যায়। এর ফলে মহাবিশ্বের সমস্বত্ব অবস্থা যেমন রক্ষা করা যায়, ঠিক তেমনি পাওয়া যায় ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ থেকেও মুক্তি।
এটা অবশ্য এমনি এমনি ঘটেনি; এর জন্য স্কেলার ফিল্ডের চালচলনে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছিল লিন্ডেকে। পুরনো স্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী যেখানে হিগস ক্ষেত্রের মান একটি খাড়া মালভূমির ঢাল বেয়ে নিচে নামতে হতো, এবং তাকে নির্ভর করতে হতো রহস্যময় ‘কোয়ান্টাম টানেলিং’ প্রক্রিয়ার ওপর, সেখানে লিন্ডের নতুন মডেলে কোনো ধরনের টানেলিং-এর দরকার পড়ে না, কারণ সেখানে মালভূমি থাকে অপেক্ষাকৃত নিচু আর সমতল। মেকি ভ্যাকুয়াম থেকে প্রকৃত ভ্যাকুয়ামে পৌছুতে হলে এই মালভূমির ঢাল বেয়ে শক্তিঘনত্বের নিচে নেমে আসতে হবে অত্যন্ত ধীর লয়ে। প্রতিসমতার ভাঙন ঘটবে অতি ধীর গতিতে। তাঁর এই ঢিলেঢালা মডেলকে নামাঙ্কিত করা হয়েছে ‘নতুন স্ফীতি তত্ত্ব’ হিসেবে।
কিন্তু এই ‘নতুন স্ফীতি তত্ত্ব’ও একেবারে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ছিল না। তথাকথিত ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ থেকে এই মডেল আমাদের মুক্তি দিলেও এর প্রক্রিয়া ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল এবং আদপে যে মোটেই বাস্তবসম্মতও নয় সেটা লিন্ডেও স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে লিন্ডে সমস্ত জটিলতা থেকে মুক্ত এক ‘সুন্দর’ স্ফীতি তত্ত্বের ভাষ্য আমাদের উপহার দিলেন। কেওটিক স্ফীতি বলে অভিহিত এই ভাষ্য আগের স্ফীতি তত্ত্বগুলোর চেয়ে অনেক সরল – এতে কোয়ান্টাম টানেলিং, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি এফেক্ট, ফেইজ ট্রানজিশন কিংবা সুপার কুলিং – কোনো অনুকল্পকেই স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে নেওয়ার দরকার নেই। এমনকি দরকার নেই বিগ ব্যাং-এর সেই অতি উত্তপ্ত অসীম ঘনত্বের কোনো পরিবেশ কল্পনারও। কেবল স্কেলার ক্ষেত্রের বিভিন্ন মান পরিবর্তন করে আমরা বিভিন্ন ধরনের স্ফীতি পেয়ে যাই আমরা। এই স্ফীতির বিভিন্ন মান থেকে আবার তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের যেসব মহাবিশ্বের একেকটাতে একেক ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কাজ করতে পারে।
লিন্ডের এই কেওটিক স্ফীতির একটা বৈশিষ্ট্য হলো—এটা ‘চিরন্তন’ এবং ‘অবিরাম’, কারণ একবার এটা শুরু হলে এ আর থামে না, দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে । তাই এই তত্ত্বকে ‘Eternal Inflation’ নামেই অভিহিত করা হয় এখন। তবে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যটা অন্য জায়গায়। স্ফীতির বিভিন্ন মান ক্রমাগতভাবে এখানে-সেখানে ঘটাতে থাকে বিগ ব্যাং-এর, যা জন্ম দিতে থাকে ছোট-বড় নানা ধরনের মহাবিশ্বের”। এর কোনোটাতে হয়তো প্রাণের অভ্যুদয়ের মতো পরিবেশ তৈরি হয় কোনো এক গ্রহে গিয়ে, কোনোটা হয়তো থেকে যায় সাহারা মরুভূমির মতো উষর আর বন্ধ্যা – সেখানে গ্রহ-নক্ষত্র- নীহারিকা তৈরি হবার মতো পরিবেশই তৈরি হয় না। এটাই সেই বিখ্যাত ‘মাল্টিভার্স’ বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা যা এখন বিজ্ঞানীদের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
Andrei Linde, The Self-Reproducing Inflationary Universe, Scientific American, Vol. 271, No. 5, pages 48-55, November 1994
Andrei Linde, Eternally Existing Self-Reproducing Chaotic Inflationary Universe, Phys. Lett. B175, 395, 1986
লিন্ডে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় বলেছেন, ‘এই প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, ইনফ্লেশন বা স্ফীতি বিগ ব্যাং তত্ত্বের অংশ নয়, যেটা ১৫ বছর আগেও সত্য বলে মনে করা হতো, বরং বিগ ব্যাংই এখন ইনফ্লেশনারি মডেলের অংশ হয়ে উঠেছে’ (Scientific American, Vol. 271, No. 5, 1994)।
লিন্ডে দেখালেন, মাল্টিভার্স আসলে স্ফীতি তত্ত্বের একটি স্বাভাবিক পরিণতিই। পরে অবশ্য স্ট্রিং তত্ত্ব থেকেও মাল্টিভার্সের সপক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে লিওনার্ড সাসকিন্ডসহ অন্যান্য স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের গবেষণায় ।। সম্প্রতি পাওয়া গেছে অন্তত একটি ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণগত আলামতও। এ নিয়ে আমি
স্ফীতি থেকে যে অনন্ত মহাবিশ্বের অভ্যুদয় ঘটে অতি স্বাভাবিক নিয়মে তা কেবল লিন্ডে নয়, আরেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিনের চোখেও পড়েছিল, এবং সেটা লিন্ডে তত্ত্ব দেওয়ার বহু আগেই। কিন্তু মূলধারার পদার্থবিজ্ঞানীরা এটা গ্রহণ করবেন না ভেবে তিনি এই ধারণা বাক্সবন্দী করে তাঁর কাজের টেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রেখেছিলেন বহুদিন। Leonard Susskind, The Cosmic Landscape: String Theory and the Illusion of Intelligent Design, Back Bay Books; 2006
Stephen M. Feeney (UCL), Matthew C. Johnson (Perimeter Institute), Daniel J. Mortlock (Imperial College London), Hiranya V. Peiris (UCL), First Observational Tests of Eternal Inflation, Phys. Rev. Lett. 107, 071301, 2011
(অ.রা) মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম বছর খানেক আগে ‘মাল্টিভার্সঃ অনন্ত মহাবিশ্বের খোঁজে’ শিরোনামে। মাল্টিভার্স নিয়ে আলোচনা এই অধ্যায়ের পরিসরের বাইরে রাখছি, কারণ এই বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায়ে বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আনব বলে ঠিক করেছি।
মাল্টিভার্স আছে কি নেই এ নিয়ে জমজমাট বিতর্ক করা গেলেও যে জিনিসটি ক্রমশ বিতর্কের ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছে তা হলো স্ফীতিতত্ত্বের সাফল্য আর গুরুত্ব। সেই আশির দশকের শুরুতে গুথ ও লিন্ডের গবেষণাপত্র প্রকাশের পর বহুদিন পর্যন্ত স্ফীতি তত্ত্বের আসলে কোন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। সম্প্রতি বিজ্ঞানী পল স্টেইনহার্ট ও নিল টুরক ‘চক্রাকার’ বা ‘সাইক্লিক মডেল” নামে একটা তত্ত্বকে স্ফীতি তত্ত্বের বিকল্প হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করছেন অবশ্য। তবে মূলধারার বিজ্ঞানীরা এখনো এটাকে সেরকম কোনো ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলে কিছু মনে করেন না । বরং ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ বইয়ে বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস স্পষ্ট করেই বলেন, ‘বর্তমানে স্ফীতি তত্ত্বই হচ্ছে একমাত্র তত্ত্ব যা মহাবিশ্বের সমস্বত্ব প্রকৃতি এবং সামতলিক বৈশিষ্ট্য সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। অধিকন্তু স্ফীতি তত্ত্ব মহাবিশ্ব নিয়ে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যার সবগুলোই এখন পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে’।
পল স্টেইনহার্ট ও নিল টুরকের মডেলটি ‘চক্রাকার’ বা ‘সাইক্লিক’। এ ধরনের সাইক্লিক মডেলে সব সময়েই একটা সমস্যা থাকে, সেটা হলো এন্ট্রপির সমস্যা। যেকোনো সাইক্লিক মডেল এটা দীর্ঘ সময় পর ‘হিট ডেথ’ অবস্থাপ্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ এন্ট্রপি স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসে, যেটা আমাদের মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণের ঠিক বিপরীত। যদিও স্টেইনহার্ট ও টুরক দাবি করেছেন, তাঁরা পূর্ববর্তী সাইক্লিক মডেলের এই এন্ট্রপির এই সমস্যা সমাধান করেছেন (তাঁদের ‘এন্ডলেস ইউনিভার্স’ বইয়ে আইজ্যাক আসিমভের বিখ্যাত The last question গল্পের শিরোনাম দিয়ে একটি চ্যাপ্টারও অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাঁরা), কিন্তু বহু বিজ্ঞানীই মনে করেন না যে, তাঁরা এই সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পেরেছেন। বিজ্ঞানী শন ক্যারলের ‘From Eternity to Here’ বইয়ে এ নিয়ে ভাল আলোচনা আছে। অ্যালেন গুথ তাঁর একটি পেপারে (Inflation, Carnegie Observatories Astrophysics Series, Vol. 2) বলেছেন, ‘স্ফীতির বিকল্প দাবি করা হলেও স্টেইনহার্ট ও টুরক মূলত স্ফীতির তত্ত্বের সাহায্যেই প্রমাণ করেছেন যে মহাবিশ্বের আকার কেন এত বড় কিংবা মহাবিশ্বের প্রকৃতি কেন এত সমস্বত্ব কিংবা সামতলিক’। আঁদ্রে লিন্ডে দাবি করেছেন, স্ফীতি তত্ত্বের বিকল্প হয়ে ওঠার বদলে চক্রাকার মডেলের রূপরেখা বরং ‘উদ্ভট’ এবং ‘স্ফীতি তত্ত্বেরই একটি সমস্যাজনক ভাষ্য’ হয়ে উঠেছে”। তার চেয়েও বড় কথা হল, সম্প্রতি BICEP2 পরীক্ষায় মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার ফলে পল স্টেইনহার্টের ‘চক্রাকার’ বা ‘সাইক্লিক’ মডেলের সমাধি সূচিত হল। স্ফীতিতত্ত্বই বর্তমানে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব বলে অনেকেই মনে করছেন।
আমাদের কাছে স্ফীতি তত্ত্বের আবেদন অবশ্য আরো বৃহৎ পরিসরে। আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন যে কথাগুলো তাঁর ‘মেনি ওয়ার্লডস ইন ওয়ান’ বইয়ে বলেছেন, সেগুলোর সাথে আমি খুবই একমত-
স্ফীতি তত্ত্বের আবেদন অনেক ক্ষেত্রেই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সাথে তুলনীয়। দুটি ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন সমস্ত রহস্যের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যেগুলোকে একটা সময় মনে করা হতো মানুষের জ্ঞানের বাইরে কিংবা ঐশ্বরিক কিছু। বিজ্ঞান তার হাত প্রসারিত করে কুসংস্কারকে হটিয়ে অজানাকে জয় করেছে।
ভিলেঙ্কিন ভুল কিছু বলেননি। স্ফীতি তত্ত্ব আসলে আমাদের সবচেয়ে অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, আমাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রহস্যটির সমাধানের দিকে ইঙ্গিত করে –‘কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?” এবং, এটি তৈরি করে প্রাকৃতিকভাবেই শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের নান্দনিক একটি ক্ষেত্র।
শূন্য থেকে মহাবিশ্ব? অবিশ্বাস্য মনে হবে শুনলে। কিন্তু স্ফীতি তত্ত্ব সত্যি হলে এটাই হয়তো ঘটেছে বাস্তবে, তা আপাতদৃষ্টিতে যত অসম্ভবই মনে হোক না কেন। স্ফীতি তত্ত্বের গণিত থেকেই বেরিয়ে এসেছে এটা। ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ উদ্ভবের ব্যাপারটা কোনো সায়েন্সফিকশন নয়, কিংবা নয় জুয়েল আইচের জাদু; বরং শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ধারণাটা স্ফীতি তত্ত্ব থেকে আসা জোরালো অনুসিদ্ধান্তই। ধারণাটিকে গবেষণারত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা খুব গুরুত্বের সাথেই নিচ্ছেন এখন। তাঁরা জানেন স্ফীতি তত্ত্ব থেকে আসা অন্য উপসংহারগুলো যেহেতু পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে গেছে, এটাকে পাগলামো বলে উড়িয়ে দিলে খুব ভুল হবে। আর শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ধারণাটা অবাস্তব হলে পদার্থবিজ্ঞানের নামকরা জার্নালগুলোতে এর উল্লেখ পেতাম না”, কিংবা বড় বড় বিজ্ঞানীদের লেখা (যেমন, অ্যালেন গুথের ‘ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’, আলেকজান্ডর ভিলেঙ্কিনের ‘মেনি ওয়ার্ল্ডস ইন ওয়ান’, মিচিও কাকুর ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস’, ব্রায়ান গ্রিনের ‘হিডেন রিয়ালিটি’, স্টিফেন হকিং-এর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ কিংবা ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’, এবং লরেন্স ক্রাউসের সাম্প্রতিক ‘দ্য ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’) জনপ্রিয় ধারার বইগুলো বাজারে দেখতে পেতাম না। স্ফীতি তত্ত্বের
Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang; 2007
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, A. Vilenkin, “Creation of the Universe from Nothing,” Physical Letters 117B: 25–8.,1982; Victor Stenger, “The Universe: the Ultimate Free Lunch”, Eur J Phys 11, 236243, 1990; ইত্যাদি।
জনক অ্যালেন গুথ মহাবিশ্বকে অভিহিত করেছেন, ‘দ্য আল্টিমেট ফ্রি লাঞ্চ’ হিসেবে; তিনি স্ফীতি তত্ত্বের গণিত সমাধান করে উদ্বেলিত হয়ে বলেন –
গ্রিক দার্শনিক লুক্রেটিয়াস খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে একটি বই লিখেছিলেন De Rerum Natura (On the Nature of Things) নামে। সে বইয়ে একটা লাইন ছিল –‘শূন্য থেকে কোনো কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না’। তাঁর সেই দাবির ২০০০ বছর পর আজ মহাজাগতিক স্ফীতি তত্ত্ব দাবি করছে, তাঁর দাবি সঠিক ছিল না।
প্রাকৃতিকভাবে মহাবিশ্বের তথা পদার্থের উদ্ভবের ব্যাপারটি আজ আর বিজ্ঞানের বাইরে নয়। দুই হাজার বছরের বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি ইঙ্গিত করছে লুক্রেটিয়াস নির্ঘাত ভুল ছিলেন। সঠিকভাবে বললে, আমাদের চারদিকের আদি উপাদানগুলোর সবকিছুই শূন্য থেকে তৈরি হয়েছে। ‘সবকিছু’ বলতে কেবল আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যকার জিনিসগুলো নয়, এর বাইরের অনেক কিছুও এসে পড়বে। মহাজাগতিক স্ফীতি তত্ত্বের কাঠামোতে বিচার করলে মহাবিশ্ব হচ্ছে আল্টিমেট ফ্রি লাঞ্চ
কিন্তু কিভাবে এত বিপুল মহাবিশ্ব, আর তার ভেতরের গ্রহ-নক্ষত্র, সৌরজগৎগুলো স্রেফ শূন্য থেকে রাতারাতি উদ্ভূত হতে পারে? প্রক্রিয়াটা ঠিক কী রকমের? এ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে শিগগিরই…..
♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি
♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে
♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে
♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?
♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস
♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব
♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি
♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা
♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?
♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি
♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে
♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি
♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন
♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ