কোলকাতার জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চার ইতিহাস কলকাতারই সমবয়স্ক। কলকাতার জন্ম থেকেই জ্যোতিষীরা ছিলেন। তাঁরা বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীদের কোষ্ঠী বিচার করে দিতেন । গ্রহশান্তির জন্য নানা ধরনের দেবতার পূজা করতেন, যজ্ঞ করতেন, কবচ তৈরী করে দিতেন ।

প্রায় ৩০০ বছর আগের কোলকাতার যে দু’জন জ্যোতিষীর নাম আজও জ্যোতিষীরা অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন, তাঁরা হলেন জ্যোতিষ বাচস্পতি ও ফকিরচাদ দত্ত। জ্যোতিষ বাচস্পতি কোষ্ঠী ও হাতের রেখা দেখে ভবিষ্যৎ গণনা করতেন। ফকিরচাঁদ শুধু কোষ্ঠী বিচারের পর প্রয়োজন মত কবচ ধারণের বিধান দিতেন। কবচ তাঁরা তৈরি করে দিতেন বা তৈরির ব্যবস্থা করে দিতেন। কবচের মধ্যে ছিল নবগ্রহ-কবচম, সূর্য-কবচম, চন্দ্ৰ-কবচম বা সোমস্য-কবচম, মঙ্গলস্য-কবচম, বুধস্য-কবচম, বৃহস্পতে-কবচম, শুকুস্য-কবচম, শনেঃ কবচম, রাহোঃ-কবচম, কেতোঃ-কবচম ইত্যাদি।

প্রতিটি গ্রহের কবচ করতে ঐ গ্রহের এবং ঐ গ্রহদেবতার পূজো করতেন তাঁরা। রবির দেবতা মাতঙ্গী। রবির কবচের দক্ষিণা ছিল ‘ধেনুমূল্য’। চন্দ্রের দেবতা কমলা। দক্ষিণা শঙ্খ ও যথাসাধ্য রজতমূদ্রা। মঙ্গলের দেবতা বগলামুখী। দক্ষিণা ‘বৃষমূল্য’। বুধের দেবতা ত্রিপুরাসুন্দরী। দক্ষিণা ‘স্বর্ণমুদ্রা। বৃহস্পতির দেবতা তারা। দক্ষিণা ‘পীতাভ যুগলবস্ত্ৰ’ । শুক্রের দেবতা ভূবনেশ্বরী। দক্ষিণা ‘অশ্বমূল্য’। শনির দেবতা দক্ষিণাকালী । দক্ষিণা ‘কৃষ্ণবর্ণ গাভীমূল্য’। রাহুর দেবতা ছিন্নমস্তা। দক্ষিণা লৌহ। কেতুর দেবতা ধূমাবতী। দক্ষিণা ‘ছাগমূল্য’ ।

‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোলজি’র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত চ্যাটার্জি জ্যোতিষ বাচস্পতি ও ফকিরচাদ দত্তের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বললেন, এঁরা প্রবাদপুরুষ। গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ সময় পুঁথির প্রতিটি নিয়মনিষ্ঠা মেনে কবচ তৈরি করতেন। তারপর ঐ কবচ গঙ্গাজল পাত্রে ডুবিয়ে রেখে যে গ্রহের জন্য কবচ সেই গ্রহ-মন্ত্র নির্দিষ্ট সংখ্যকবার জগ করতেন। বিশুদ্ধ উচ্চারণে পূর্ণ জপসংখ্যা ছাড়া কবচ তৈরি সম্পূর্ণ হয় না। আজ পঞ্জিকা খুললেই বা পত্র-পত্রিকায় মাঝে-মধ্যে নানা ধরনের শক্তিশালী, মহাশক্তিশালী, কবচের বিজ্ঞাপন দেখবেন। এঁদের বেশিরভাগই কবচে কিছু আশীর্বাদীফুল, বেলপাতা ভরে দেন ।

এ তো স্রেফ প্রতারণা । গ্রহশান্তির জন্য গ্রহরত্ন ধারণ করা অনেক সহজ। কারণ ভাল গ্রহরত্ন পাওয়া অনেক সহজ, কিন্তু খাঁটি, ঋষিতুল্য কবচ তৈরি করার মত মানুষ বিরল ।

কবচ তৈরির পর সঠিক উচ্চারণ প্রতিনিয়ত বজায় রেখে সঠিক সংখ্যায় জপ বাস্তবিক‍ই কেউ করতে পারতেন কিনা, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। পুরোন পুঁথি ও ‘পুরোহিত দর্পণ’-এ দেখেছি শুক্রের কবচের জন্য ২১,০০০ বার জপ করার প্রয়োজন হয় ‘ওঁ হ্রীং শুক্রায়’। কেতুর বেলায় ২২,০০০ বার জপতে হয় ‘ওঁ হ্রীং ঐং কেতবে’। সবচেয়ে কম জপতে হয রবি-কবচের বেলায়। তাও নেই নেই করে ৬,০০০ বার জপতে হবে ‘ওঁ’ হ্রীং হ্রীং সূর্যায়’। জপের গণনতা কম-বেশি হলেই তো কবচের গুণ ফোক্কা (এটা অবশ্য আমার কথা নয়, পুরোন পুঁথিপত্তর ও পুরোহিত দর্পণের কথা)।

গ্রহের খারাপ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে, জীবনে সাফল্য পেতে কবচের পরিবর্তে রত্ন- ব্যবসায়ে কোলকাতার যিনি প্রথম নেমেছিলেন তাঁর নাম ফণিভূষণ রায়। ফণিবাবু ১৯৪৫ সালে বিবেকানন্দ রোডে প্রতিষ্ঠা করলেন এম. পি. জুয়েলার্স। পত্রপত্রিকায় এম. পি-র বিজ্ঞাপনের সঙ্গী হলো ‘কাফি খাঁ’র অসাধারণ কার্টুন যা এম. পি.-র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশ বড় ভূমিকা নিয়েছিল।

কলকাতায় প্রথম জ্যোতিষশাস্ত্র ছাত্রদের শেখান শুরু করেন হৃষিকেশ শাস্ত্রী। তাও এটা বিশ শতকের একেবারে গোড়ার কথা। এর আগে জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষণকেন্দ্র বলতে বোঝাত কোলকাতার গ্রে স্ট্রিট বা হাতিবাগান। হাতিবাগানের মতই হাওড়ার জানবাড়িও জ্যোতিষচর্চার কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

হাতিবাগান বা গ্রে স্ট্রিটের শাস্ত্রী পরিবারেরই চার ছেলে কৈলাসচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, হরিশচন্দ্র ও কাশীশ্বর জ্যোতিষী হিসেবে যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। রমেশচন্দ্র তাঁর নামের পরে শাস্ত্রীর পরিবর্তে পুরোন উপাধি ব্যবহার করতেন। রমেশচন্দ্র একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠির কৃপায় ব্যাপক প্রচার পেয়েছিলেন এবং পরিচিত হয়েছিলেন ‘জ্যোতিষ-সম্রাট’ হিসেবে ।

রমেশচন্দ্র বসবাস শুরু করেছিলেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে। বাসস্থানের লাগোয়া গড়ে তুলেছিলেন জ্যোতিষচর্চা ও জ্যোতিষ-শিক্ষণ-কেন্দ্র। তবে এটা ছিল তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত শিক্ষাদানের ব্যাপার। নাম দিলেন ‘অল ইন্ডিয়া অ্যাস্ট্রোলজিকাল অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটি’।

কলকাতার জ্যোতিষচর্চার এবং গ্রহরত্ন-ব্যবসায়ের রমরমা শুরু বিশ শতকের ষাটের দশকে। ষাটের দশকের শুরুতে স্বর্ণনিয়ন্ত্রণ আইন জারি হতে কোলকাতার বহু সোনার দোকানেরই ঝাপ বন্ধ হয়েছিল। অনেক দোকনই রূপান্তরিত হয়েছিল শয্যা-সামগ্রীর দোকান বা শাড়ি-কাপড়ের দোকানে। বেশ কিছু দোকানের হাত-বদলও ঘটেছিল। অনেক স্বর্ণশিল্পী অর্থাভাবে আত্মহত্যাও করেছিলেন, যে-সব সোনার দোকান তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত ছিল তারা প্রত্যেকেই একে একে জ্যোতিষ বিভাগ খুলে গ্রহরত্ব বিক্রি করে ক্রেতাদের ভাগ্য ফেরাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে চাইল। প্রতিটি পাথর বিক্রিতে ১০০ শতাংশ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ। অতএব জ্যোতিষীদের সঙ্গে অনেক রত্ন ব্যবসায়ীই কমিশনের রফা করলেন। নামী দামী জ্যোতিষীরা খদ্দের বুঝে ব্যবস্থাপত্র দিতে লাগলেন। আইন-ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী, ডাক্তারদের হাতে তুলে দিতে লাগলেন হিরে, চুনি, ক্যাটস-আইয়ের ব্যবস্থাপত্র, সেই সঙ্গে খাঁটি রত্ন কোথায় পাওয়া যাবে তার হদিশ। ব্যবসা জমে উঠতে লাগল । স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের পালে আবার হাওয়া ফিরতে লাগল। জ্যোতিষ বিভাগে কার কতজন দামী-দামী জ্যোতিষী রয়েছে তার প্রচার নেমে গেলেন ব্যবসায়ীরা। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে গ্রহরত্ন ও ভাগ্য ফেরাবার হাতছানি এবং রমরমা শুরু হল। স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হওয়ার আগে যেখানে কলকাতায় জ্যোতিষ বিভাগসহ রত্ন-ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল দশজন, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সেই সংখ্যা দাঁড়ায় আশির উপর । বর্তমানে অবশ্য এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। এখন প্রায় প্রতিটি সোনার দোকান মানেই জ্যোতিষ ও গ্রহরত্নের বিভাগ। স্বর্ণ-ব্যবসায়ী নন, শুধুমাত্র গ্রহরত্ন বেচেন এমন দোকানের সংখ্যাও বর্তমানে কলকাতায় দশের বেশি। লালবাজারের দু’পাশে ফুটপাতেও ‘ডালা সাজান’ একাধিক ‘খাঁটি গ্রহরত্ন’এর দোকান গজিয়ে উঠেছে।

সত্তরের দশক কলকাতার জ্যোতিষীদের ‘সুবর্ণ দশক’ বলে চিহ্নিত। ১৯৭৫-এ জ্যোতিষচর্চা ও জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষার জন্য গড়ে উঠল ‘অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল রিসার্চ প্রজেক্ট’। ৭৮-এ গড়ে উঠল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোলজি’। এই সংস্থাও একই উদ্দেশ্য নিযে গড়ে উঠেছিল।

কলকাতায় বিভিন্ন জ্যোতিষচর্চার কেন্দ্র এবং জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষণ কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছে প্রধানত বিভিন্ন গ্রহরত্ন ব্যবসায়ীদের সক্রিয় সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতায়।

কলকাতায় বর্তমানে জ্যোতিষচর্চা কেন্দ্র এবং জ্যোতিষ-শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে প্রধান পাঁচটি।

১। অল ইন্ডিয়া অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি।

৮২/২এ, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড, কলকাতা-৭০০ ০১৩

২। অ্যান্টোলজিক্যাল রিসার্চ প্রজেক্ট

৭০, কৈলাস বসু স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০ ০০৬

৩। হাউজ অফ অ্যাস্ট্রোলজি

৪৫এ, এস. পি. মুখার্জি রোড, কলকাতা-৭০০ ০২৬

৪। বিশ্ব জ্যোতির্বিদ সংঘ

২ আদিনাথ সাহা রোড, কলকাতা – ৭০০ ০৪৮

৫। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোলজি

৭এ, বিনয় বসু রোড, কলকাতা-৭০০০২৫

এইসব সংস্থা থেকে যে-সব উপাধি বিলি করা হয় সেগুলো হল, জ্যোতির্বিদ, জ্যোতিষশাস্ত্রী, জ্যোতিষভূষণ, জ্যোতিষ আচার্য ইত্যাদি। আপাতত ডক্টরেট ডিগ্রি এইসব প্রতিষ্ঠানের কেউই দেন না। তবে এখানে জ্যোতিষশাস্ত্রের বেশ কিছু ডক্টরেট আছেন যাঁরা ডিগ্রিগুলো পেয়েছেন লন্ডন বা আমেরিকার কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লন্ডন কনসোলেট অফিস এবং আমেরিকান সেন্টাবের ডিরেক্টরকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম বলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব অস্তিত্ব আছে কিনা ? এবং থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন কিনা ?

উত্তরে তাঁরা জানিয়েছিলেন এইসব নামের কোন বিশ্ববিদ্যালয় ওইসব দেশে নেই । এই প্রসঙ্গে পাগলাবাবা (বারাণসী) জানিয়েছিলেন, এঁদের অনেকেই লন্ডন, আমেরিকায় না গিয়ে কলকাতায় বসেই এফিডেভিট করে আমেরিকার ওয়ান্ড ইউনিভার্সিটির ‘ডক্টরেট’ বনে যান, স্বর্ণমূল্যে স্বর্ণপদক কেনেন। রাজজ্যোতিষী প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছিলেন, তাও ভারি মজার বলেছিলেন, জেলের কয়েদিদের বা ফাঁসির আসামীদের প্রয়োজন মেটাতে নিয়োজিত পুরোহিতই সরকার বা রাজার নিয়োজিত হিসেবে নিজেকে রাজজ্যোতিষী বলে প্রচার করেন । পাগলাবাবা এসব কথা বলেছিলেন ১৯৮৫ সালের ১৮ এপ্রিল আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে।

জ্যোতিষসম্রাট উপাধি ধারণকারীরাও স্ব-ঘোষিত সম্রাট ছাড়া কিছু নন। অনেক সময় অবশ্য এইসব সম্রাটদের হাতে গড়া জ্যোতিষ প্রতিষ্ঠানই আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের হাতে সম্রাট উপাধি তুলে দেন। আবার কখনও কখনও রত্ন-ব্যবসায়ীরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোতিষীকে বিখ্যাত করে তুলতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থা আয়োজিত অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক হয়। বিনিময়ে সংস্থা এই জ্যোতিষ-ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের জ্যোতিষীকে সংবর্ধনা জানায় । সত্তর দশক থেকেই বিভিন্ন জ্যোতিষ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ফি বছর জোতিষ সম্মেলন, আন্তর্জাতিক জ্যোতিষ সম্মেলন ইত্যাদি করছেন।

প্রত্যেক সম্মেলনের উদ্যোক্তারাই একে অপরকে টেক্কা দিতে অনুষ্ঠানকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করতে অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন মন্ত্রী, বিচারক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদিদের ।

প্রতিটি জ্যোতিষচর্চা সংস্থার পিছনেই রয়েছে গ্রহরত্ন ব্যবসায়ীদের অর্থ সাহায্য। তাই রমরমা করতে বাধা নেই। মানুষকে যত বেশি জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী এবং জ্যোতিষ-নিৰ্ভর করে তোলা যাবে ততই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে, এটা তো স্বাভাবিক ।

জ্যোতিষশাস্ত্রের ব্যাপকতর প্রচারের জন্য শুধুমাত্র জ্যোতিষ নিয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় চারটি পত্রিকা :

১। জ্যোতির্বাণী

৫-এ বিন্দু পালিত লেন, কলকাতা-৭০০ ০০৬

২। জ্যোতিষ সিদ্ধান্ত

৭০ কৈলাস বসু স্ট্রিট, কলকাতা – ৭০০ ০০৬

৩। রাজজ্যোতিষী

১/২এ, নীলাম্বর মুখার্জি স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০ ০08

৪। বিদ্যাজ্যোতি

২-এ. এন, সাহা রোড, কলকাতা-৭০০ ০৪৮

কলকাতায় পেশাদার জ্যোতিষীর সংখ্যা কত ? এই বিষয়ে পরিসংখ্যান নিতে বিভিন্ন জ্যোতিষী, জ্যোতিষী-কেন্দ্র এবং রত্ন-ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়েছিলাম। এই বিষয়ে তাঁরা কেউই ঠিকমত আলোকপাত করতে পারলেন না। আমার সংগ্রহেও এই বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই। তবে আমাদের সমিতি ১৯৮৮তে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার সূচনা হয় ১ মার্চ, ‘আস্তর্জাতিক যুক্তিবাদী দিবস’এ। চলে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত । এই ছয় মাসব্যাপী সমীক্ষার মতামত ইতিমধ্যে ‘নাগরিক সমাচার’, ‘আলোকপাত’ এবং আরো কিছু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের অনুমান, কোলকাতায় জ্যোতিষীর সংখ্যা দু’হাজারের মত। কোলকাতায় পুরোপুরি পেশাদার জ্যোতিষীর সংখ্যা একশোর মত; যাঁদের আয় মাসিক ২৫০০ টাকা বা তারচেয়ে বেশি। দেড় হাজার জ্যোতিষীর আয় ৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা।

পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতিষীর সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের মত। কলকাতার পর সবচেয়ে বেশি জ্যোতিষীর বাস মেদিনীপুরে।

এককালে ভারতবর্ষে জ্যোতিষশাস্ত্রচর্চার পীঠস্থান ছিল নৈহাটির ভাটপাড়া। এখন এখানে জ্যোতিষী আছেন পাঁচ ঘর ।

আগে জ্যোতিষচর্চা ছিল ব্রাহ্মণদেরই একচেটিয়া অধিকার। এখন তাতে বিশাল এক থাবা বসিয়েছে অব্রাহ্মণ জ্যোতিষীরা। এই অব্রাহ্মণ জ্যোতিষীদের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগই কায়স্থ

জোতিষচর্চার ক্ষেত্রে সেকালে পুরুষদেরই একছত্র আধিপত্য ছিল। এখন যুগ পাল্টাচ্ছে । জ্যোতষচর্চায় এগিয়ে এসেছেন অনেক মহিলা।

কলকাতার প্রথম নামী মহিলা জ্যোতিষী পারমিতা। তারপর যাঁদের নাম উল্লেখযোগ্য, তাঁরা হলেন অঞ্জলি দেবী, প্রিয়াংকা, লোপামুদ্রা, মণিমালা, কৃষ্ণা, কল্যাণী মুখার্জি। এ- ছাড়া আরও অনেক মহিলা জ্যোতিষীরাই উঠে আসছেন ; নামী-দামী- হয়ে উঠছেন । নামটা কতখানি ব্যাপক হবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করছে বিজ্ঞাপন ও প্রচারের ওপর। যার যত বিজ্ঞাপন, যার যত প্রচার, সে তত নামী। আব যার যত নাম, তাত তত দাম ।

বিজ্ঞাপন ও প্রচারের দৌলতে এক কালের সম্রাট-জ্যোতিষীর দলও আবার এক সময় সিংহাসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, অন্য জ্যোতিষীদের সঙ্গে বিজ্ঞাপন ও প্রচারের প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে না পেরে। পুরোন দিনের পঞ্জিকা বা পত্রিকার পাতা ওল্টালেই চোখে পড়বে অতীত জ্যোতিষ-সম্রাটদের বিজ্ঞাপন। একটু কষ্ট করে খোঁজ করলেই দেখতে পাবেন বর্তমানে অচেনা এইসব জ্যোতিষীদের অনেকেই এখনও জীবিত এবং এখনও জ্যোতিষ-পেশা আঁকড়ে আছেন।

বিজ্ঞাপনের দৌলতে নামী-দামী জ্যোতিষীরা হলেন ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তী, পণ্ডিত রামকৃষ্ণ শাস্ত্রী, সমরেন্দ্র দাস, শ্রীরবি শাস্ত্রী, ডঃ সন্দীপন চৌধুরী, পারমিতা, প্রিয়াংকা, নরোত্তম সেন, শুকদেব গোস্বামী ওরফে ভৃগু-আচার্য, শ্রীভৃগু এবং অমৃতলাল।

অমৃতলাল এক বিষয়ে সবার চেয়ে আলাদা। তিনি রত্ন ধারণের ব্যবস্থাপত্র দেন না। পরিবর্তে দেন মেটাল ট্যাবলেট। দাম ১০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা।

অপেশাদার বা অন্য পেশায় নিযুক্ত থাকলেও কোলকাতায় এমন কিছু জোতিষী আছেন যাঁদের কাছে প্রতিনিয়ত ভাগ্য-বিশ্বাসী মানুষের ভীড় লেগেই আছে। এঁদের দু’জন হলেন অতীন ঘোষ, কর্মস্থল কলকাতা হাইকোর্ট। দ্বিতীয় জন গৌরলাল মুখার্জি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী।

বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মানুষও জ্যোতিষচর্চায় এগিয়ে এসেছেন। সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়, সাংবাদিক সাহিত্যিক পার্থ চট্টোপাধ্যায, সুদেব রায়চৌধুরী, খেলোয়াড় শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী, পি. কে. ব্যানার্জি, জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র), অভিনেতা দিপঙ্কর দে, তরুণকুমার, সাহিত্যক শিল্পী এবং চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, রাজনীতিবিদ ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, অজিত পাঁজা, যতীন চক্রবর্তী, নির্মল বসু প্রমূখেরা জ্যোতিষচর্চা করেন বলেই প্রচারিত।

error: Content is protected !!