আইরশ রমণী অ্যানি বেশান্ত ভারতে আসেন ১৮৯৩ সালে। মাদামের ‘সিক্রেট ডকট্রিন’ পড়ে তিনি মাদামের ভক্ত হয়ে ওঠেন, সেই সঙ্গে থিওজফিস্ট। অ্যানি ছিলেন সুবক্তা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ব্লাভাৎস্কির মৃত্যুর পর বেশান্ত ও জাজ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সোসাইটির কাজকর্ম চালাতে থাকেন। অলকট ছিলেন সোসাইটির সভাপতি। সহ-সভাপতি ছিলেন জাজ। মাদামের জায়গা দখলের লড়াইয়ে এক সময় আমরা নামতে দেখলাম জাজ ও বেশান্তকে। এক সময় বেশান্ত জাজকে উদ্দীপ্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন অলকটকে হটিয়ে দেবার কাজে সহযোগিতা করার জন্য। জাজ এগিয়ে না আসায় বেশান্ত অলকটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নামেন জাজকে অপদস্ত করার কাজে।
জাজ এই সময় মাদামের জায়গা দখল করার জন্য ‘মহাত্মদের’ নানা লিখিত নির্দেশ হাজির করে থিওজফিস্টদের দেখতে লাগলেন। এইসব চিঠিতে সোসাইটি ভালমত পরিচালনার নির্দেশও দিতেন বিদেহী মহাত্মারা। এমন মহা বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে বেশান্ত ও অলকট জাজের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনলেন। ৯৪ তে। জাজ জানালেন- আমি বলছি মহাত্মদের কাছ থেকে চিঠিগুলো পেয়েছি, এটাই কি যথেষ্ট নয়?
থিওজফিক্যাল সোসাইটি থেকে জাজকে বহিষ্কার করা হল। কিন্তু থিওজফিক্যাল সোসাইটির আমেরিকার শাখাগুলো জাজের সঙ্গেই রয়ে গেল, কারণ আমেরিকার থিওজফিস্টদের কাছে উইলিয়ম জাজের সততা মাদাম ব্লাভাৎস্কির সততার মতই প্রশ্নাতীত ছিল।
অ্যানি বেশান্ত থিওজফিস্টদের কাছে নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে জানালেন, ‘মহাত্মা’রা পৃথিবীর যে মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, নির্দেশ পাঠান, তিনি জাজ নন, অ্যানি বেশান্ত। বেশান্ত আরও জানালেন ঈশ্বর বা পরমপিতা অথবা আল্লা যে নামেই তাদের ডাকি না কেন, সেই সর্বশক্তিমান পৃথিবী শাসন ও পরিচালনা করেন মহাত্মাদের সাহায্যে। ঈশ্বরের মুখ্য প্রতিনিধি সনৎকুমার। তাঁর বাস গোবি মরুভূমিতে। জগৎসংসার চালাচ্ছেন মনু। তাঁকে সাহায্য করছেন অগস্ত্য, কুথুমি, মোরিয়া, বুদ্ধ, খৃষ্ট, জরথুস্ট্র ইত্যাদি মহাত্মারা।‘
বেশান্ত তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতায়, প্রচারযন্ত্র, বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগানোর সফলতায় দেশ-বিদেশে বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি অতি দৃঢ়তার সঙ্গে শ্রোতাদের সামনে বক্তব্য রাখতেন, “আমার সামনে আপনারা যেমন আছেন, মহাত্মারাও তেমনইভাবে আছেন- আছেন- আছেন”।
অ্যানি বেশান্ত প্রেতচক্রের আসর বসাতেন। আত্মাদের দিয়ে ঘণ্টা বাজাতেন, বাজনা বাজানো, ফুল নিয়ে আসা- এমনি অনেক অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা দেখাতেন। সাংবাদিকদের কাছে আত্মাদের ঘটানো অদ্ভুত সব কান্ডকারখানার গল্প বলে চমক লাগিয়ে দিতেন। সে সব গল্পের কিছুটা হদিস দিতে বহু থেকে একটি উদাহরণ এখানে হাজির করছি।
১০ জুন ১৮৯৪ ‘মাদুরা মেল’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অ্যানি বেশান্ত বলেন- বিদেহী আত্মার সাহায্যে শূন্য থেকে কতই না জিনিস আনা যায়। টেবিল, বই বা অন্য কিছুর প্রয়োজন হলে সেগুলোর কাছে না গিয়ে সেগুলোকেই নিজের কাছে আনা যায় আত্মার সাহায্য নিয়ে। মাদাম ব্লাভাৎস্কি পেসেন্স তাস খেলতে ভালবাসতেন। আমি দেখেছি, তিনি যখন খেলতে চাইতেন তাসগুলো আপনা থেকে তাঁর কাছে এসে যেত।
বেশান্ত আত্মার অমরতার পাশাপাশি জন্মান্তর ও কর্মফলের পক্ষেও প্রচার চালান। নীচবংশে জন্মান ও গরিবির জন্য তিনি দ্বিধাহীনভাবে কর্মফলকেই দায়ী করেছিলেন। বোম্বাইয়ে ভয়াবহ প্লেগ দেখা দেওয়ায় বেশান্ত ঘোষণা করেছিলেন- কর্মফলই এই রোগভোগের কারণ। বেশান্ত আরও ঘোষণা করলেন পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন হিন্দু পণ্ডিত, এই জন্মে পাশ্চাত্যে জন্মে সেখান থেকে বস্তুবাদের বা জড়বাদের অসারতা প্রমাণ করা। এখন তিনি জড়বাদকে নস্যাৎ করে দেওয়ার শক্তি অর্জন করে ফিরে এসেছেন আপন বাসভূমিতে। নিজের নাম ঘোষণা করলেন আন্নাবাঈ, অ্যানি থেকে আন্নাবাঈ। তাঁর এমনতর হিন্দু সেন্টিমেন্টকে সুড়সুড়ি দেওয়া ঘোষনায় ভারতের প্রচুর মানুষ আবেগে আপ্লুত হলেন।
১৮৯৩-এর শেষে আন্নবাঈ বিশাল প্রচারের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে বক্তৃতাসফর শুরু করলেন। থিওজফি বা ‘প্রেততত্ত্ব’ বা ‘মহাত্মাদের’ বিষয়ে যত বললেন, তার চেয়ে বেশি বললেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য নিয়ে। ভক্ত ভারতীয় হিন্দুদের মন তাতে সিক্ত হল।
ভারতের নানা জায়গায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে অ্যানি থিওজফিস্ট ধর্মের প্রচারের পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতির জগতেও প্রবেশের দিকে পা বাড়ালেন। অ্যানি ‘পায়োনিয়ার’ পত্রিকায় চিঠি লিখে জানালেন- হিন্দুধর্ম রাজভক্তি আনুগত্য বজায় রাখার অতি সহায়ক। চিঠিতে বেশান্ত পাশ্চাত্যে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন অমানবিক ও ভয়াবহ বলে বর্ণনা করে লিখলেন- এ’সব কারনে ইংলন্ড এখন আরও বেশি বেশি করে রাজতন্ত্রকেই আঁকড়ে ধরছে। অ্যানি এও জানালেন, ভারতবর্ষ সফর করে এই দেখে খুশি যে ভারতীয়রা শাসক রাজশক্তির প্রতি শাসিত প্রজাদের প্রাচীন ঐতিহ্যে উজ্জীবিত। তিনি এও জানালেন- প্রাচীন হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান যে শুরু হয়েছে, তার শুভময় ফলেই পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ থেকে শিক্ষিত হিন্দুরা সরে গিয়ে রাজভক্ত হচ্ছে।
পায়োনিয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত এই চিঠি ভারতের প্রায় প্রতিটি প্রধান খবরের কাগজেই প্রকাশিত হয়েছিল।
ইংরেজ রাজতন্ত্রের প্রতি ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভক্তি ও আনুগত্য বাড়িয়ে তুলতে হিন্দুধর্ম আন্দোলন ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে ছিলেন বেশান্ত। সেকথা প্রকাশিত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারী ১৮৯৯ এর ইংরেজি দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় ও ২২ ফেব্রুয়ারী ১৮৯৯ ‘মাদ্রাজ টাইমস’ পত্রিকায়।
১ এপ্রিল ১৮৯৯-এ ‘মাদ্রাজ মেল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল অ্যানি বেশান্তের আরও ভয়াবহ বক্তব্য। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল, “Hinduism and Loyalty”। সেখানে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, আমার মতে গণতন্ত্রের পথ ভাল ফল দেবার মত নয়। …গণতন্ত্র ভারতীয় মানসিকতার পক্ষে অনেক দূরের জিনিস। গণতন্ত্রের ফলে প্রথম ক্ষতিগ্রস্থ হবে শিক্ষিত মুষ্টিমেয় ভারতবাসীরা কারণ তাদের অশিক্ষিত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় গ্রাস করবে।
‘My view is that demoeratic methods are ill-fitted to bring about good results ….. I believe them to be alien from the spirit of the Indian people, and that the comparatively small class of educated Indians would be first ti suffer from their successful introduction here, since they would be swamped by the uneducated.”
অ্যানি বেশান্তের রাজভক্তির পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য যখন সভায় ও পত্রিকার পাতায় এসে হাজির হচ্ছে, তখন বালগঙ্গাধর তিলকের পত্রিকা ‘মারাঠা’য় সম্পাদকীয় লিখে জানানো হল- তাঁরা থিওজফিস্টদের মত মানুন না মানুন অ্যানি বেশান্তের প্রচারের ফলে ভারতবাসীদের মনে জাতীয়তাবোধ বেড়েছে।
বেশান্তের উপর আক্রমণ তখন সত্যিই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বেশান্তের ও অন্যান্য থিওজফিস্টদের আত্মা ও মহাত্মা নামানোর ব্যাপারটা যে পুরোপুরি বুজরুকি এবং জালিয়াতি, এ বিষয়ে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল ‘স্টেটসম্যান’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘মাদ্রাজ মেল’, ‘মাদ্রাজ টাইমস’ ইত্যাদি পত্রিকায়। এ’সব লেখাগুলো অবশ্য কোনও বুদ্ধিবাদী যুক্তিবাদী বা বস্তুবাদী যুক্তিবাদীদের কলম থেকে উৎসারিত হয়নি, উৎসারিত হয়েছিল মিশনারিদের সমর্থকদের কলম থেকে।
‘মর্ডান রিভিউ’এর ১৯১১ সালের নভেম্বর সংখ্যার সম্পাদকীয়টির শিরোনাম ছিল ‘Mrs Besant Lifts Her Veil in London’। তাতে লেখা হল- শ্রীমতি বেশান্ত ইংলন্ডে গিয়ে ‘ইন্ডিয়ান আনরেস্ট’ বিষয়ে বক্তৃতায় ইংরেজ বিচারপতিদের নিরপেক্ষতার কথা বলে একদিকে যেমন প্রশংসা করেন, অপরদিকে তেমনই ভারতীয় বিচারপতিদের পক্ষপাতদুষ্টতা বিষয়ে সমালোচনা করেন।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল এমন এক প্রতারক, বুজরুক, ইংরেজ রাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষাকারী দেশীয় ধনী ও শিক্ষিতদের স্বার্থরক্ষাকারী মহিলা অ্যানি বেশান্তকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে বসানো হল ১৯২০ সালে। আমরা আরও দেখলাম অ্যানি বেশান্তের মৃত্যুর পর তাঁর নামে রাস্তা করতেও কোনও সরকারের বিবেক সামান্যতম কাঁপেনি। কে জানে, হয় তো প্রতারককে জাতীয় সম্মান জানাবার একটা পরম্পরা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতারণাকেও সম্মানজনক করে তুলতেই এমন অনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৪র্থ খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ আত্মার রূপ নিয়ে বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি
অধ্যায়ঃ চার
♦ এ’দেশের কিছু আদিবাসী ও বিদেশের কিছু অধিবাসীদের আত্মা-চিন্তা
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘সানন্দা’র দপ্তরে প্ল্যানচেটের আসর
♦ ঘাড়ে চাপল প্ল্যানচেটের আত্মা
♦ রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা
♦ স্বামী অভেদানন্দের সামনে আত্মা লিখল শ্লেটে
♦ ভূতের ভরে পটকা মেয়েও পেয়ে যায় হাজার হাতির বল
♦ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ভূতে পাওয়া কি
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ভিড় করে আসা প্রশ্নমালার উৎপত্তি
♦ থিওজফিক্যাল সোসাইটির প্রেতচর্চা
♦ উনিশ শতকের সেরা মিডিয়ামদ্বয় ও দুই শৌখিন জাদুকর
♦ থিওজফস্টদের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
♦ থিওজফিস্টদের প্রতি লেখা বিজ্ঞানী হাক্সলের মজার চিঠি
অধ্যায়ঃ সাত
♦ যুক্তির নিরিখে ‘আত্মা’ কি অমর?
অধ্যায়ঃ আট
♦ অসাম্যের বিষবৃক্ষের মূল শিকড় অধ্যাত্মবাদ অধ্যাত্মবাদের মূল শিকড় আত্মা
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সিস্টেম’কে পুষ্ট করতেই টিনের তলোয়ার ঝন-ঝন বাজে “আত্মা থাক, কুসংস্কার দূর হোক”
♦ সমাজ কাঠামোর সিংহাসনের চারটি পায়া কারা
অধ্যায়ঃ দশ
♦ হিন্দু ছাড়া কেউ জন্মান্তর মানে না
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ আত্মার অস্তিত্বে বিশাল আঘাত হেনেছিল চার্বাক দর্শন
অধ্যায়ঃ বারো
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ তবু জাতিস্মর বার বার ঘুরে ফিরে আসে
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ জাতিস্মর কাহিনীর প্রথম পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ২ : চাকদার অগ্নিশিখা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৩ : সুনীল সাক্সেনা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৪ : যমজ জাতিস্মর রামু ও রাজু
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৫ : পুঁটি পাত্র
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৬ : গুজরাটের রাজুল
অধ্যায়ঃ পনের- জাতিস্মর কাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৭ : জ্ঞানতিলক
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৯ : ত্রিশের দশকে কলকাতায় জাতিস্মর
অধ্যায়ঃ ষোল- অবতারদের পুনর্জন্ম
♦ জাতিস্মর তদন্ত-১০ : সত্য সাঁইবাবা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ১১ : দলাই লামা
অধ্যায়ঃ সতের
♦ জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদারদের প্রতি ১৫০,০০০ টাকার চ্যালেঞ্জ