থিওজফিক্যাল সোসাইটির রমরমা কমলেও মানুষের মন থেকে যে নির্মূল হয়নি, তার প্রমাণ মাঝে-মধ্যেই পাই উঠে আসা প্রশ্নের ভিতর দিয়ে। থিওজফিস্টরা প্রেততত্ববিদ। এক সময় বাংলার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিই ছিলেন থিওজফিস্টরা প্রেততত্ত্ববিদ। এক সময় বাংলার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিই ছিলেন থিওজফিস্ট। তাঁদের নানা প্রেতচর্চার বিষয় নিয়ে এবং থিওজফিক্যাল সোসাইটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব অ্যানি বেশান্ত (Annie Besant) –এর প্রেতচর্চার সাড়া জাগানো নানা ঘটনা নিয়ে বহু প্রশ্নই উচ্চশিক্ষিত একটি বিশেষ মহল থেকেই সাধারণত উঠে আসে। উঠে আসা প্রশ্নগুলি সাধারণভাবে সব সময়ই এই ধরনের- ওঁরা প্রত্যেকেই কি তবে মিথ্যাচারী ছিলেন। যে থিওজফিক্যাল সোসাইটি প্রেততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করত, প্ল্যানচেটে আত্মা নামিয়ে আনত, তাদের সম্বন্ধে সামান্য হলেও কিছুটা আলোচনা করে নেওয়া তাই একান্তই জরুরি বলে মনে করি।
১৮৭৫ সালের ১৭ নভেম্বর থিওজফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে হেলেনা পেট্টোভনা ব্লাভাৎস্কি প্রেতাত্মাদের বা বিদেহী আত্মাদের খুব প্রিয় ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর আহ্বানে আলো-আঁধারী ঘরে প্রেতাত্মারা টেবিল ঠকঠক করত। বিদেহী ‘মহাত্মা’রা রেখে যেতেন নানা লিখিত নির্দেশ, উপদেশ ইত্যাদি। ‘মহাত্মা’ কারা? অলকটের কথায়, ‘মহাত্মা’ এমনই একজন, যিনি নিজের অধ্যাত্মশক্তি ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে উন্নত করে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যেখানে তিনি ক্ষুদ্র বাসনা-কামনার দ্বারা আচ্ছন্ন নন, নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন। পবিত্র, কামনাহীন।“ (থিওজফিস্ট পত্রিকা, জুন ১৯০১ সাল)
মহাত্মারা শুধু যে লেখাই পাঠাতেন, তেমন নয়। মাদাম ব্লাভাৎস্কির সঙ্গে অনেক কথাও বলতেন, এক মহাত্মার ওভারকাটের পকেট থেকে জাপানি টি পট বের করে মাদাম ভক্তদের তা দেখিয়েও ছিলেন।
অলকটের জীবনের এক প্রেতাত্মা ঘটিত ঘটনার কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। এক প্রেতবৈঠক অলকট গিয়েছিলেন একটি গোলাপ নিয়ে। ভরগ্রস্থ মিডিয়াম তাঁকে বললেন- গোলাপটি শক্ত মুঠোয় চেপে ধরতে। যখন মিডিয়াম হাত খুলতে বললেন তখন মুঠো খুলে দেখেন গোলাপের ভিতর একটি সোনার আংটি। তারপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। সিমলায় অলকট তাঁর এক বান্ধবীকে বলছিলেন বিদেহী আত্মার আংটি দেওয়ার লোম খাড়া করা ঘটনার কথা। ঘটনাটি শুনে বান্ধবী আংটিটি নিজের হাতে নিয়ে দেখার কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। অলকট আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে বান্ধবীর হাতে তুলে দিলেন। মাদাম ব্লাভাৎস্কি বান্ধবীর হাতের মুঠোটা চেপে ধরলেন। মুঠো বন্দী হয়ে রইল আংটি। মাদাম আহ্বান জানালেন এক ‘মহাত্মা’কে। তারপর মুঠো খুলতেই অবাক কান্ড ! সোনার আংটি হয়ে গেছে তিনটে হিরে বসানো আংটি।
থিওজফিস্টদের আত্মা নামিয়ে কান্ডকারখানা ঘটানোর কথা সেই সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে বহু পত্র-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা জেনেছি মাদামের আহ্বানে আত্মাদের ঘণ্টা বাজাবার কথা, শূন্য থেকে জিনিস আনার কথা- ওমনি কত কি !
১৯৮৮ সালে মাদামের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Secret Doctrine’ প্রকাশিত হল। প্রেততত্ত্ব বিষয়ক গুপ্ত বিদ্যা শিখতে বহু মানুষের আগ্রহ জাগিয়ে তুলল এই গ্রন্থটি।
১৯৮১ সালে মাদাম মারা গেলেন। তাতে কিন্তু থিওজফিক্যাল সোসাইটির রমরমা একটুও কমল না। কারণ ইতিমধ্যে বহু বিশিষ্টরাই তখন মাদামের বিশাল ভক্ত। ১৮৮২ সালে মাদাম ও অলকটের আশীর্বাদ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘বেঙ্গল থিওজফিক্যাল সোসাইটি’। সভাপতি হলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, যেই প্যারীচাঁদ এক সময় চিহ্নিত হয়েছিল, ‘ডিরোজিয়ান হিসেবে’, বুদ্ধিবাদী-যুক্তিবাদী হিসেবে। সোসাইটির সহ-সভাপতি হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর ও রাজা শ্যামাশংকর রায়। সম্পাদক ও কোষাধ্যাক্ষ-নরেন্দ্রনাথ সেন। সহ-সম্পাদক – বলাইচাঁদ মল্লিক ও মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও মাদাম ও অলকটের পায়ের ধুলো পড়ত প্রায়ই।‘ ৮২ সালেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীকে সভানেত্রী করে গড়ে উঠেছিল ‘লেডিস থিয়োজফিক্যাল সোসাইটি’। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল থিওজফি প্রচারের এক প্রত্রিকা। ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এক সময়ের ‘নাস্তিক’ বলে চিহ্নিত শিশিরকুমার ঘোষও এক সময় ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করে পরে একই সঙ্গে পরম বৈষ্ণব ও ঘোর থিওজফিস্ট বা প্রেততত্ত্ববিদ হয়ে উঠেছিলেন। অমৃতবাজারও সেই সময় থিওজফিস্টদের প্রশংসা করে অনেক লেখা প্রকাশ করেছে। এবং তারই পরম্পরা বজায় রেখে আজও ‘অমৃতবাজার’ ও তাদের গোষ্ঠীরই বাংলা দৈনিক ‘যুগান্তর’ অক্লান্তভাবে প্রচার করে চলেছে বৈষ্ণব ও থিওজফিস্ট ভাবধারা।
থিওজফিক্যাল সোসাইটি যে কি বিপুলভাবে প্রধাণত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে প্রভাব ফেলেছিল, তারই উদাহরণ- ১৯০০ সালে সোসাইটির আমেরিকাতে শাখা ছিল ছ’শো এবং ভারতে তিনশো। আমেরিকায় সোসাইটি বিস্তৃতি লাভ করেছিল যার কাঁধে ভর দিয়ে, তিনি থিওজফিক্যাল সোসাইটির অন্যতম প্রাণপুরুষ উইলিয়ম জাজ।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৪র্থ খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ আত্মার রূপ নিয়ে বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি
অধ্যায়ঃ চার
♦ এ’দেশের কিছু আদিবাসী ও বিদেশের কিছু অধিবাসীদের আত্মা-চিন্তা
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘সানন্দা’র দপ্তরে প্ল্যানচেটের আসর
♦ ঘাড়ে চাপল প্ল্যানচেটের আত্মা
♦ রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা
♦ স্বামী অভেদানন্দের সামনে আত্মা লিখল শ্লেটে
♦ ভূতের ভরে পটকা মেয়েও পেয়ে যায় হাজার হাতির বল
♦ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ভূতে পাওয়া কি
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ভিড় করে আসা প্রশ্নমালার উৎপত্তি
♦ থিওজফিক্যাল সোসাইটির প্রেতচর্চা
♦ উনিশ শতকের সেরা মিডিয়ামদ্বয় ও দুই শৌখিন জাদুকর
♦ থিওজফস্টদের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
♦ থিওজফিস্টদের প্রতি লেখা বিজ্ঞানী হাক্সলের মজার চিঠি
অধ্যায়ঃ সাত
♦ যুক্তির নিরিখে ‘আত্মা’ কি অমর?
অধ্যায়ঃ আট
♦ অসাম্যের বিষবৃক্ষের মূল শিকড় অধ্যাত্মবাদ অধ্যাত্মবাদের মূল শিকড় আত্মা
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সিস্টেম’কে পুষ্ট করতেই টিনের তলোয়ার ঝন-ঝন বাজে “আত্মা থাক, কুসংস্কার দূর হোক”
♦ সমাজ কাঠামোর সিংহাসনের চারটি পায়া কারা
অধ্যায়ঃ দশ
♦ হিন্দু ছাড়া কেউ জন্মান্তর মানে না
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ আত্মার অস্তিত্বে বিশাল আঘাত হেনেছিল চার্বাক দর্শন
অধ্যায়ঃ বারো
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ তবু জাতিস্মর বার বার ঘুরে ফিরে আসে
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ জাতিস্মর কাহিনীর প্রথম পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ২ : চাকদার অগ্নিশিখা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৩ : সুনীল সাক্সেনা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৪ : যমজ জাতিস্মর রামু ও রাজু
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৫ : পুঁটি পাত্র
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৬ : গুজরাটের রাজুল
অধ্যায়ঃ পনের- জাতিস্মর কাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৭ : জ্ঞানতিলক
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৯ : ত্রিশের দশকে কলকাতায় জাতিস্মর
অধ্যায়ঃ ষোল- অবতারদের পুনর্জন্ম
♦ জাতিস্মর তদন্ত-১০ : সত্য সাঁইবাবা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ১১ : দলাই লামা
অধ্যায়ঃ সতের
♦ জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদারদের প্রতি ১৫০,০০০ টাকার চ্যালেঞ্জ