থালা-পড়া দিয়ে সাপে কাটা, কুকুরে কামড়ান রোগীকে ভাল করার মত ওঝা ও গুণীন এখন এদেশে অনেক আছে- এ ধরনের বিশ্বাস অনেক মানুষের মধ্যেই বর্তমান। আবারও বলি, শুধুমাত্র আদিবাসীদের মধ্যেই এই বিশ্বাস সংক্রমিত হয়নি, ছড়িয়ে পড়েছে বহু শহরবাসী বা শহুরে চাকুরিয়াদের মধ্যেও।

রোগী রোদ্দুরে পিঠ খুলে বসে থাকে। গুণীন পিতল বা কাঁসার থালায় মন্ত্র পড়ে পিঠে থাবড়ে বসিয়ে দিতেই অবাক কান্ড! থালাটা রোগীর পিঠের উপর সেঁটে বসে যায়। যেন চুম্বকের টানে আটকে আছে লোহা। গুণীন যতক্ষন মন্ত্র পড়ে অর্থাৎ যতক্ষন সাপের বা কুকুরের বিষ শরীর থেকে না নামে, ততক্ষণ থালা আটকে থাকে পিঠে। বিষ নামলেই পিঠের থালাও সুরসুর করে নেমে আসে।

বহু প্রত্যক্ষদর্শী আমাকে জানিয়েছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই নাকি রোগী থালা-পড়াতে বিষ-মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু মূল-প্রশ্নটা এই, কি করে প্রত্যক্ষদর্শী সিদ্ধান্তে এলেন রোগী বিষ-যুক্ত ছিলেন? কুকুরে কামড়ালেই জলাতঙ্ক হয় না। জলাতঙ্ক হয় এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ থেকে। যে কুকুরটি কামড়েছে সে যদি আগে থেকেই জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত থাকে শুধুমাত্র তবেই তার কামড়ে সৃষ্ট ক্ষত ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

কুকুর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত ছয় দিনের বেশি বাঁচে না। জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার চারদিন আগেই কুকুরের লালায় রোগের ভাইরাস থাকতে পারে। তাই চিকিৎসকরা সাধারণভাবে বলেন, যে কুকুর কামড়েছে সেটাকে দশ দিন পর্যন্ত লক্ষ্য করবেন। দশ দিনের পরও কুকুরটি বেঁচে থাকলে Anti Rabies Vaccine বা ARV নেওয়ার কোনও প্রয়োজন হয় না। কোনও কারনে কুকুরটিকে নজরে রাখা সম্ভব না হলে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে ARV ইনজেকশন নেওয়া উচিৎ। বর্তমানে অবশ্য কার্যকর আরও কিছু Vaccine বেরিয়েছে। যেমন, inactivated Rabies Vaccine তার মধ্যে একটি।

বিড়াল, শেয়ালের বা নেকড়ের কামড়েও জলাতঙ্ক হতে পারে, যদি যে কামড়েছে সে জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

সাপে কাটার ক্ষেত্রেও একই রকমভাবে বলতে হয়, সাপে কামড়ালেই বিষাক্ত সাপ কামড়েছে ভাবার কোনও কারণ নেই। আমাদের দেশে নির্বিষ সাপই সংখ্যাগুরু (শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ)। আবার সংখ্যালঘু বিষাক্ত সাপ কামড়ালেই যে সে কামড় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে, এমনটা ভাবারও কোন কারণ নেই। দেখতে হবে সেই কামড়ে একজনের মৃত্যু ঘটানোর মত পরিমাণে বিষ ঢালতে পেরেছে কি না। অনেক সময় এমনটাও হয়ে থাকে, ছোবল মারছে দেখে দ্রুততার সঙ্গে শরীর সরে নেওয়ার জন্য বা অন্য কোনও কারণে বিষাক্ত সাপ অতি সামান্য বিষ ঢালতে সক্ষম হয়। এইসব ক্ষেত্রেও রোগীর বিষ থেকে মৃত্যু সম্ভাবনা থাকে না।

অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, কুকুর বা সাপ কামড়ালেই ‘কুকুরের বিষ’ বা ‘সাপের বিষ’ মুক্ত করার প্রয়োজন হয় না, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বিষমুক্তই থাকে। কিন্তু বাস্তবিকই যদি জলাতঙ্কে আক্রান্ত কুকুর, বিড়াল বা শিয়াল কামড়ায় তবে ARV ইনজেকশন নেওয়া প্রয়োজন। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আরও কম বেদনাদায়ক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, ইনজেকশন বা ঔষধও হয়তো আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু কোন ক্রমেই থালা পড়ায় জলাতঙ্কের বিষ টেনে নিয়ে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে না।

কুকুরে কামড়াবার পর পিঠে থালা বসান হয়েছে

একই কথা সাপের বিষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, বিষাক্ত সাপ উপযুক্ত পরিমাণে শরীরে বিষ ঢাললে এ্যান্টিভেনম সিরাম নিতে হবে অথবা অন্য কোনও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু এরকম ক্ষেত্রে মন্ত্রঃপূত থালা কিংবা কোনও ভাবেই বিষ মুক্ত করে রোগীকে বাঁচাতে পারবে না।

কোনও ভাবেই বিষ মুক্ত করে রোগীকে বাঁচাতে পারবে না।

তবে থালা আটকায় কিভাবে? সে প্রসঙ্গেই আসি। ওঝা যে থালা ব্যবহার করে, সেটা অবশ্যই যার পিঠে বসান হবে তার পিঠের চেয়ে ছোট মাপের। পিতল বা কাঁসার থালাটির মাঝখানটা চারপাশের চেয়ে কিছুটা উঁচু। রোদে বসিয়ে রাখা তথাকথিত রোগীটির পিঠ স্বাভাবিকভাবেই ঘামে ভিজে ওঠে। থালাটির পিছন দিকটি এবার সজোরে রোগীটির পিঠের উপর এমনভাবে বসান হয় যাতে থালাটির চারপাশ ও পিঠের মধ্যে সামান্যতম ফাঁক না থাকে। পিঠের ঘাম ফাঁক হওয়ার সম্ভাবনা বন্ধ করে। জোরে প্রায় ছুঁড়ে থালাটি পিঠে বসানোয় এবং থালাটির মাঝখানটা সামান্য উঁচু হওয়ায় থালা ও পিঠের মাঝখানে বায়ু থাকে না বা কম থাকে। ফলে বাইরের বাতাসের চাপে থালা পিঠ আঁকড়ে থাকে।

সময় যতই পার হতে থাকে একটু একটু করে বাতাসও ঘামের সূক্ষ্ম ফাঁক-ফোঁকর দিয়েও ঢুকতে থাকে। ফলে এক সময় থালা পিঠ থেকে খসে পড়ে।

আপনারাও হাতে-কলমে পরীক্ষা করেই দেখুন না। কোনও সাপে কাটা বা পাগলা কুকুড়ে কামড়ানো রোগী লাগবে না। লাগবে না কোনও মন্ত্র-তন্তর। একই পদ্ধতিতে

থালা আটকাবার কৌশল

ঘামে ভেজা থালা চেপে ধরলেই কিছুক্ষণের জন্য আটকে থাকবে।

থালা পড়ায় যেসব মানুষ সাপের বিষ বা জলাতঙ্ক থেকে মুক্ত হচ্ছেন, থালা পড়া না দিলেও এবং কোনও ওষধ গ্রহণ না করলেও তারা সাপের বিষ ও জলাতঙ্ক থেকে মুক্ত হতেন। কারণ তাঁদের শরীরে সাপের বিষ বা জলাতঙ্কের ভাইরাসই ছিল না। কামড়ে ছিল নির্বিষ-সাপ আর ভাইরাস-মুক্ত কুকুর।

error: Content is protected !!