তসলিমা সাহিত্যিক হিসেবে কেমন? সমরেশ মজুমদার ওঁকে সাহিত্যিক হিসেবে একটুও পাত্তা দিতে রাজি নন। দু-দু’বার আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার পরও তসলিমা সমরেশের চোখে এলে-বেলে।

আবার এই বঙ্গের কিছু সাহিত্যিক তসলিমার লেখার প্রশংসায় আকাশের মত উদার। কিছু সাহিত্যিক (বিশেষ করে ওপার বাংলার সাহিত্যকরা) মনে করেন, তসলিমা প্রশংসায় পঞ্চমুখ সাহিত্যিকরা আসলে একটি পত্রিকা মালিকের ‘হিজ মাস্টার ভয়েজ’। অর্থাৎ তাঁরাও তসলিমার সাহিত্য-বোধকে তুড়ি মেরে ওড়াতে চান। সাহিত্যিকদেরই এমন দুটি বোধের কারণ, সাহিত্য বিষয়ে দু’ধরনের যুক্তিবোধ। অর্থাৎ সাহিত্যের ভালো-খারাপ একান্তভাবেই দুই চেতনার বিষয়। আপেক্ষিক ব্যাপার। এই যে সাহিত্যের একটা নির্দ্দিষ্ট মানের তুলনায় ভাল বা খারাপ লাগা— তা একান্তভাবেই যার যার নিজস্ব ব্যাপার। আর তাই ‘দেশ” ও ‘নবকল্লোল’ দুই- ই ভালোই কাটে।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ আর ‘স্পাইডার ম্যান’ দুটোই কল্পকাহিনী। গ্রাম বাংলার এক একটা সিনেমা হলে ‘বেদের মেয়ে…’ চলেছে এক বছরের ওপর। তাও আবার টানা ‘হাউজ ফুল’। গরুর গাড়ি নিয়ে দর্শকরা দু-একদিন আগে থেকেই হাজির হতেন হলের সামনে। ‘বেদের মেয়ের….’ বিশাল জনপ্রিয়তা ভাবা যায়! ‘স্পাইডারম্যান’ পৃথিবী জুড়ে সাড়া জাগিয়ে রেকর্ড রোজগার করে এই বঙ্গের এঁদো ডোবায় এসে মুখ থুবড়ে পড়লো।

স্পাইডারম্যানের হিন্দি ভার্সনও ছিল। কিন্তু চলেনি। গাদা-গুচ্ছের হিন্দি ছবি যখন শ’য়ের বান্ডিল গুনে ঘরে তুলছে, তখন হিন্দি মাকড়সা-মানুষ সিকি-আধুলি কুড়োচ্ছে ।

এই যে বিশেষ কোনও মানের ছবিকে ভালোলাগা, অন্য মানের ছবিকে খারাপ লাগা—একে আমরা বলতে পারি ‘আপেক্ষিক’ ব্যাপার, বা তুলনামূলক ব্যাপার। একটু একটু করে আমার মনে ভালো-মন্দের যে ধারণা গড়ে উঠেছে, সেই ধারণা থেকেই আমরা একের সঙ্গে আর একের তুলনা করি। এই ধারণা গড়ে ওঠার পিছনেও থাকে কারণ বা যুক্তি। আমাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ-ই আমাদের মধ্যে নানা ধারণা, নানা মূল্যবোধ গড়ে তোলে।

মধ্যপ্রদেশের পটনা তামেলি গ্রামের কুটুবাঈকে সতীদাহ করা হয়েছে শুনে আমরা পশ্চিবঙ্গবাসী চমকে উঠি। কী বীভৎস! আমরা মধ্যপ্রদেশবাসী বা রাজস্থানবাসী হলে আপ্লুত আলোচনায় মুখর হতাম—কী অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন সতী কুটুবাঈ! পিতৃকুল ও শ্বশুরকুলের সাত পুরুষকে স্বর্গে নিয়ে গেলেন। সতী-তীর্থ করে গেলেন গ্রামকে, যেমনটা সতী রূপ কানওয়ার করে গেছেন দেওয়ালা গ্রামকে।

কয়েক দিন আগের ঘটনা। মধ্যপ্রদেশের কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুকে একটা সি ডি দেখাচ্ছিলাম। কালীপুজোর রাতে বর্ধমান জেলার এক গ্রামে দশ হাজার বলির দৃশ্য। রক্তে রাস্তা-ঘাট থকথকে লাল কাদা হয়ে গেছে। মোষ বলি দিয়ে মোষের মাথা ঘাড়ে নিয়ে নাচছেন এক ব্রাহ্মণ। ভক্ত নারী-পুরুষের সে কী উন্মাদনা !

ওই বীভৎস দৃশ্য দেখে এক সাংবাদিক বন্ধু বমি করে ফেললেন। অন্য সাংবাদিক বন্ধুরাও ভয়ংকর ধাক্কা খেয়েছেন। তাঁরা সমস্বরে উত্তেজিতভাবে চেঁচাচ্ছিলেন। তাঁদের মোদ্দা বক্তব্য ছিল—তোমরা কী করে এই ধরনের ভয়ংকর নিষ্ঠুর বলি চালাতে দাও? দর্শকরা সবাই তো এ-সব দেখতে দেখতে নিষ্ঠুর হয়ে যাবে। ছোটদের তো মানসিক রোগী বানিয়ে ছাড়বে, যারা বড় হয়ে খুন করতেও পিছ-পা হবে না। তোমরা এইসব বে-আইনি কাজ চালাতে দাও কী করে ?

বললাম, “যে কারণে তোমাদের রাজ্যের মানুষ গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে সহমরণের বিরল দৃশ্য দেখতে দৌড়োন; যে কারণে এমন মহৎ কাজে কেউ বাধা দিতে গেলে তাঁরা জান লড়াতেও কসুর করেন না; সেই একই কারণে আমাদের রাজ্যের মানুষ মনে করেন শক্তি আরাধনায় বলি শ্রেষ্ঠ ভোগ। বলিতে বাধা দিতে গেলে ভক্তরা রক্ত-গঙ্গা বইয়ে দিতে-ই পারেন। কারণটা হল প্রশ্নহীন ধর্মীয় আনুগত্য, ধর্মীয় বিশ্বাস ।

দু’রাজ্যের আমজনতা দু’ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবেশে একটু একটু করে বড় হয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাসেও কিছু নিজস্বতা বা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই নিজস্বতার কারণে তোমরা সতীতে আপ্লুত, আমরা বলিতে। পিছিয়ে থাকা সাংস্কৃতিক পরিবেশের কারণে দু’রাজ্যের মানুষই যুক্তি-র চেয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগকে গুরুত্ব দেয় বেশি। আবার দু’রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন স্থানীয় মানুষের ভাবাবেগকে গুরুত্ব দেন। ফলে সতীদাহ, বলি, ডাইনি হত্যা ইত্যাদি অপরাধ চলে আসছে। সাংস্কৃতিক পরিবেশগত কারণে তোমাদের কাছে সতীদাহ মহৎ, বলি বীভৎস। আমাদের কাছে উল্টোটা।”

মধ্যপ্রদেশের শিক্ষিতরাও সতীমাঈ কুটুবাঈয়ের মাহাত্ম্যের গুজব চেটে-পুটে খাচ্ছেন। গুজব—এক পুলিশ অফিসার সতীমাঈকে চিতা থেকে টেনে নামাতে গিয়েছিলেন। সতীমাঈকে ছোঁয়ামাত্র বৈদ্যুতিক শক খেলেন। ছিটকে পড়লেন দূরে। আর একটি গুজব—এক পুলিশ অফিসার সতীমাঈকে যেই ছুঁয়েছেন, অমনি অফিসারের হাত থেকে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো ।

খবরের কাগজে সতীমাঈ কুটুবাঈয়ের অলৌকিক মাহাত্ম্যের খবর আমরা

বাঙালিরা পড়েছি। অবাক হয়েছি এই ভেবে যে—এমন গুজবে

কেউ বিশ্বাস করতে পারে? আমরাই আবার গুজব খাচ্ছি

-রণে-বনে-জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়ি না কেন,

শুধু একবার বাবা লোকনাথকে ডাকলেই

সমস্ত সমস্যার ‘মুশকিল আসান’

হবে।

আমরাই তান্ত্রিক-জ্যোতিষীদের কাছে দৌড়োই বশীকরণ তাবিজ কিনতে । যাকে চাই, তার ছবি আর হাজার তিরিশ চল্লিশ টাকা খরচ করলেই কেল্লা ফতে—বলে মনে করি। আর এই জ্যোতিষীদের ধাপ্পাবাজিতে ভোলার জন্য কর্ণাটকবাসীরা বাঙালিদের আহাম্মক মনে করেন।

তা’হলে কী দাঁড়ালো? আমরা বাঙালিরা চালাক, না বোকা? নাকি এ সবের পিছনে রয়েছে আত্মসমালোচনার অভাব? অবস্থান পাল্টে নিজেকে দিল্লিবাসী, মুম্বাইবাসী বা ভোপালবাসী বলে ভাবতে শুরু করুন, তারপর আমাদের বাঙালিদের দোষ-ত্রুটিগুলো দেখার চেষ্টা করুন—অনেক কিছুই চোখে পড়বে।

মূল্যবোধ বা ভালো-খারাপ বিচারবোধকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে কেউ কেউ ‘আপেক্ষিক’ শব্দটিকে কাজে লাগালন। ধরুন আপনি হয়তো বলছিলেন, “সিগারেট খাওয়াটা খুব খারাপ।” ওমনি একটি তরুণ বললেন, “ভাল-খারাপ ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। আপনি খারাপ ভাবছেন, তাই আপনার কাছে খারাপ। আর, যিনি সিগারেটের ধোঁয়া টেনে এনার্জি পাচ্ছেন, তাঁর কাছে ভালো।”

যে কোনও ‘ভালো-খারাপ’ প্রসঙ্গকে এভাবে ‘আপেক্ষিক’ শব্দের মোড়কে গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা অতি-সরলীকরণ ছাড়া কিছুই নয়। সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটাই ধরা যাক। তার ভাল দিক কী? না, অন্যান্য নেশার মতই নেশাগ্রহণকারীর কাছে অপরিহার্য হয়ে ওঠা। পায়খানায় বসে সিগারেটে টান না দিলে পেট হালকা হচ্ছে না। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হওয়ার পর আবার চনমনে হয়ে উঠতে সিগারেটে টান—জবাব নেই।

সিগারেটের বা যে কোনও নেশার গুণ-ই তার দোষ। নেশা একটা মানসিক নির্ভরতার ভিত্তি ভূমি হয়ে দাঁড়ায়। হাতের সামনে নেশা না পেলে প্রাণ আনচান। চিকিৎসা করে নেশা নির্ভরতা কাটিয়ে তোলা সম্ভব। তারপর দেখা যাবে মানুষটি সিগারেট না টেনেই প্রতিটি কাজ স্বাভাবিকভাবেই করে চলেছেন। অর্থাৎ তাঁর এই কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সিগারেটের বাস্তবিক কোনও ভূমিকা ছিল না। সিগারেট থেকে কত রকম রোগ-ই না হয়। হাপানি, কাশি, থ্রোট-ক্যানসার, লাং-ক্যানসার, ফ্যারেনজাইটিস থেকে শুরু করে অনেক রোগকে পুষ্ট করে বা তৈরি করে সিগারেটের ধোঁয়া। ক্ষতি করে গর্ভের সন্তানের। এর পরও ‘আপেক্ষিক’ শব্দ প্রয়োগ করে সিগারেট পানকে ‘ভাল ভাবলে ভাল’ বলা যায় না।

 

খণ্ডিত ছেড়ে পূর্ণতায়ঃ ভালো-খারাপের মাপকাঠি

আমাদের মুশকিলটা হয়, যখন একটা ব্যক্তিমানুষের ভালোখারাপ বিচারে বসি, তখন আমাদের শ্রেণী-চরিত্র, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠা ভালো-খারাপের ধারণা সব-ই আমাদের বিচার শক্তিকে প্রভাবিত করে। এমনকী, এর মধ্যে আমাদের স্বার্থ চিন্তাও কাজ করে। একে অতিক্রম করে যাঁরা উঠে আসতে পারেন, তাঁরাই ব্যক্তি চরিত্র ঠিকমত বিশ্লেষণ করতে পারেন।

মধ্যপ্রদেশের কুটুবাঈ সতী হলেন। দিন সাতেকের মাথায় কলকাতা এফ এম রেডিও থেকে সতীদাহ’র ওপর আলোচনায় অংশ নেবার আমন্ত্রণ পেলাম। সঞ্চালক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খোলা-মেলা কথা বলার সুযোগ পাবে?” সঞ্চালক জানালেন,“অবশ্যই।” বললাম, “স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু সতীদাহ প্রথার সমর্থক ছিলেন। তিনি সতীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, যেমনটা করেন রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের ধর্মান্ধ মানুষ।”

সঞ্চালক বললেন, “এ’সব আপনি রেফারেন্স-সহ বলতে পারবেন ? বললাম, “তা পারবো।”

সঞ্চালক এবার বললেন, “স্বামী বিবেকানন্দকে বরং ছেড়ে দিন। স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে বাঙালিদের গভীর আবেগ জড়িয়ে রয়েছে।”

বললাম, “কেনই বা আমরা মনে করে বসে থাকবো যে, বাঙালি আবেগ-স্বর্বস্ব জাতি। যদি তেমনটাই হয়, তবে আমাদের কি উচিত নয়, আগে সর্বস্বতার অবস্থা থেকে বাঙালিদের তুলে আনার সাধ্যমত চেষ্টা করা? আপনি-ই পারেন, এফ এম- এর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির চেতনাকে তুলে আনতে।”

অসম্ভব ভালো লাগলো যখন দেখলাম, সঞ্চালক তাঁর ব্যক্তি স্বার্থ-চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বলার স্বাধীনতা দিলেন। কেন্দ্রে গদিতে বসে ভারতীয় জনতা পার্টি। আকাশবাণী আসলে কেন্দ্রের অধীন। এই অবস্থায় ভারতীয় জনতা পার্টির আদর্শ বিবেকানন্দের বিরুদ্ধে কথা বলার স্বাধীনতা দিয়ে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক যে হিম্মত দেখালেন, তাতে তিনি আমার কাছে মুহূর্তে বিশাল মানুষ হয়ে গেলেন।

মাত্র একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সঞ্চালক যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তাকে স্বীকার করার মানে এই নয় যে, তিনি সামগ্রিকভাবেই বিশাল মানুষ। এমনটা তিনি হতেও পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। আবার একই ভাবে বিবেকানন্দের কর্মজীবন থেকে একটি দুটি বিচ্ছিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ তাঁকে বিচার করলে ভুল হতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আমাদের প্রয়োজন তাঁর সামগ্রিক কাজ- কর্ম নিয়ে বিশ্লেষণ ।

হাতকাটা নেলো একজন বিখ্যাত তোলাবাজ। ওর মূল ঘাঁটি যে পাড়ায়, সেখানকার গরিব মানুষগুলোর কাছে নেলোর রবিনহুড মার্কা ইমেজ। নেলো আর তার দলবল দক্ষিণ কলকাতার একটা বড় অঞ্চল জুড়ে ছোট-বড় দোকানদার থেকে প্রমোটার, সবার কাছ থেকেই তোলা আদায় করে। কেউ বেগড়বাঁই করলে গুলিও চালাতে হয়। ষোলটা খুনের অভিযোগ আছে। আতঙ্কিত দোকানদার ও স্থানীয় মানুষ নেলোকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বেশ কয়েকবার রাস্তা অবরোধ করেছেন। নেলোকে ধরা যায়নি।

যে গরিব মানুষগুলোর দরকারে-অদরকারে নেলো অর্থ-সাহায্য করে, তাঁরা এক কথায় নেলোর জন্য জান দিতে পারেন। নেলোর প্রচুর ইনফরমার। ওঁরা নেলোকে ভালোবেসে ইনফরমারের কাজ করেন। পাড়ায় সন্দেহজনক কোনও লোক বা পুলিশ ভ্যান ঢুকলে সঙ্গে সঙ্গে নেলোর কাছে খবর পৌঁছে যায়। নেলোকে নিরাপদে পালাতে সাহায্য করেন পাড়ার কচি-কাঁচা, বুড়ো-বুড়ি সব্বাই।

হাত-কাটা নেলোকে আমরা ভালো বলবো, না খারাপ? এই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আরও একটা কথা পরিষ্কার করা বোধহয় জরুরি। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে জেনেছি—অসাম্যের সমাজ কাঠামোর ওপর গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামগ্রিক আইন এমনভাবে তৈরি হয়, যাতে আইন মেনেই শোষণ প্রক্রিয়া চালু রাখা যায়। এমন এক সমাজ কাঠামো কি ভাঙতে চায় নেলো? তার রাজনৈতিক চেতনা, সমাজ চেতনার মধ্যে ভুল থাকতে পারে। ভুল থাকলেও একটা সৎ ইচ্ছের হদিস নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তেমন কি কিছু পাওয়া গেছে নেলোর চিন্তায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নেলো ইতিমধ্যে তিনটি সংসার পেতেছে। অনেক বেশ্যালয়-ই তার অস্থায়ী ঠিকানা। অর্থাৎ চরিত্রটা আর পাঁচজন সমাজবিরোধীর ছাঁচে ঢালা। হাত-কাটা নেলো পাড়ার গরিবদের অর্থ সাহায্য করে, না অর্থের বিনিময়ে সাহায্য কেনে ?

পাড়ার গরিব মানুষদের কাছ থেকে প্রটেকশন আদায়ের জন্য অর্থ বিনিয়োগ

করাটা অনেক মস্তানদের-ই পুরনো কৌশল। এর দ্বারা গরিবের

বন্ধু সাজা যায়, কিন্তু বন্ধু হওয়া যায় না। আর, নকল

গরিব-বন্ধুকে, আসল বলি কী করে?

বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বিবেকানন্দ অথবা যে কোনও কিংবদন্তি মানুষকে নিয়ে যখনই আমরা কিছু বলি, তাতে কিছু বাড়তি আবেগ যুক্ত হয়। ফলে বক্তব্যে কিছু অসংগতি থেকে যায়। আবার প্রচারমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকরা কাউকে ভাল বা খারাপ বললে, আমরা আমজনতা তাকেই সত্যি বলে ধরে নিয়ে সেই সুরে সুর মেলাই। তলিয়ে বিচারে যাই না। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বিবেকানন্দ আমাদের চোখে মনীষী, কারণ প্রচারমাধ্যম থেকে বুদ্ধিজীবী তেমনই বলেন। এ’বার আসুন, যুক্তিকে শাণিত করতে আমরা তিনজনকে নিয়ে কিছু নির্মোহ বিশ্লেষণে নামি।

যে কোনও চরিত্র বিশ্লেষণের আগে আমরা একটা কথা মাথায়

রাখবো—আমরা কেউ-ই শ্রেণীবদ্ধতা ও কালবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নই।

সমস্ত দোষ-মুক্ত মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। প্রতিটি চরিত্রকে

সামগ্রিকভাবে বিচার করে দেখা প্রয়োজন তাঁদের

দোষের পাল্লা ভারী, না গুণের ?

আমাদের যুক্তি-বুদ্ধিই বুঝিয়ে দেবে এই তিন কিংবদন্তি মানুষকে একই ধরনের বিশেষণে বিশেষিত করাটা ঠিক, কি বেঠিক। তিন ব্যক্তিকে একই পঙ্ক্তিতে দাঁড় করিয়ে আমাদের যুক্তিবোধের অভাবকে বে-আব্রু করে তুলছি না তো? আসুন, নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি পর্যালোচনা করা যাক ।

আমাদের আলোচ্য তিন চরিত্রের শ্রেণী-বিশ্লেষণের পাশাপাশি সময় বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি। ভারত তখন ব্রিটিশ শক্তির অধীন। বাঙালি সমাজ তখন দারিদ্র- অশিক্ষা-কুসংস্কার-অধ্যাত্মবাদ ও তন্ত্র সাধনার নামে অনাচারের-যৌনাচারের অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। সেই সময় সমাজ সংস্কারের কাজে অবতীর্ণ হতে দেখেছি দুটি আধুনিক মানুষকে। একজন বিদ্যাসাগর, অপরজন রামমোহন।

আমরা জানি ছোটলাট গ্রান্ট সাহেব গ্রামে গ্রামে স্কুল খোলার প্রস্তাব দিলে বিদ্যাসাগর জানিয়েছিলেন, এতে তাঁর সায় নেই। অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের মধ্যে শিক্ষার গভীর অনুপ্রবেশকে তিনি বেশি কাম্য মনে করেছিলেন। মেয়েদের স্কুল বেশি বেশি করে গড়ে তুলতে শিক্ষিকা-শিক্ষণ ব্যবস্থার প্রস্তাবের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। এই বিরোধিতারও প্রেক্ষিত ছিল। ব্রিটিশ শাসকরা শিক্ষা খাতের খরচের পরিমাণ বা বাজেট ঠিক করে দিতেন। বিদ্যাসাগরের মনে হয়েছিল ওই বরাদ্দ টাকায় গ্রামে গ্রামে স্কুল, শিক্ষিকা-শিক্ষণ কেন্দ্র ও চালু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চালাতে গেলে শেষ পর্যন্ত কোনওটাই ঠিক মতো চলবে না। তারচেয়ে সচ্ছল, এগিয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে পারলে, সেই শিক্ষিতদের মধ্যে থেকেই অনেকে উঠে আসবেন, যাঁরা শিক্ষাকে গরিব ও নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেবেন। শিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যাসাগর লিখেছেন বর্ণপরিচয়, ব্যাকরণকৌমুদী, কথামালা থেকে কত না বই। এ’সব বইয়ের অনেকগুলোই গ্রামের গরিবদের ও নারীদের শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। সব শ্রেণীর মানুষের কাছে যাতে বইগুলো পৌঁছে যায়, তার জন্য বই ছাপা ও প্রকাশনার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রচলন করেছিলেন। বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও ব্রাহ্মণদের আচারসর্বস্বতার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বেদান্ত বিরোধী। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করেও কখনও ‘সরকারি বুদ্ধিজীবী’ বা ‘যো-হুজুর’ হননি। খুব গরিব অবস্থা থেকে উঠে এসেছিলেন। প্রচুর উপার্জন করেছেন। দানও করেছেন প্রচুর। বর্ধমানের মহারাজের ইচ্ছে হল বীরসিংহ ও তার আশেপাশের গ্রাম বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তুলে দেন। বিদ্যাসাগর বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে বলেছিলেন—যখন আমি ওইসব গ্রামের সমস্ত প্রজার খাজনা দেবার মত উপার্জন করতে পারবো, তখন আপনার জমিদারি গ্রহণ করবো।

দু-চারটি ঘটনাকে টেনে এনে বিদ্যাসাগরকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ সাজাবার

একটা চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টা নিজেদের অজ্ঞতা বা অনিরপেক্ষতার

প্রমাণ। খণ্ডিত বিদ্যাসাগরকে ছেড়ে গোটা বিদ্যাসাগরকে

নিয়ে যুক্তি-শৃঙ্খলার সাহায্যে বিশ্লেষণে নামুন। নিজের

যুক্তি-বুদ্ধি দিয়েই বুঝতে পারবেন,

ভাল-খারাপের মধ্যে

কোনটা ভারী।

বিদ্যাসাগরের পূর্বসূরি রামমোহন জন্মেছিলেন প্রায় সোয়া-তিনশো বছর আগে সোনার চামচ মুখে নিয়ে। ব্যবসা ও দেওয়ানি পেশায় তাঁর আয় ছিল বিশাল। ধনী বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।

আমরা সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান থেকে শিখেছি—সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ব্যক্তি মানুষকে প্রভাবিত করে। ব্যতিক্রমী মানুষ-ই শুধু পারেন সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করতে। রামমোহন ছিলেন এমনই এক ব্যতিক্রমী আধুনিক মানুষ। তিনি বিশাল ধন-সম্পদের মালিক হয়েও বাঙালি বাবু-সংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসাননি। খেউড় গান, বাঈ-নাচ, বেশ্যালয়ে রাত কাটানোর মধ্যে যখন ধনী বাঙালি সমাজ ডুবে রয়েছে, তখন রামমোহন আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন গভীর পড়াশুনোর মধ্যে, জগদ্দল সমাজের সংস্কারের কঠিন কাজের মধ্যে।

রামমোহন কোরান পড়তে পাটনায় গিয়ে ফার্সি শেখেন। উপনিষদ পড়তে বারাণসী গিয়ে সংস্কৃত শেখেন। এখানেই শেষ নয়। বাংলা, ফার্সি, সংস্কৃত, আরবি, হিব্রু, ইংরেজি, হিন্দি-সহ গোটা বারো ভাষায় লিখতে-পড়তে-বলতে পারতেন। ২৩ বছর বয়সে ফার্সি ভাষায় তাঁর লেখা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির নাম বাংলা করলে দাঁড়ায়, একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার।’ বাইবেল বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মত নিয়ে তিনি খ্রিস্ট উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতি আবেদন জানিয়ে তিনটি বই লিখেছিলেন ইংরেজিতে। লিখেছেন পাঁচটি উপনিষদ ভাষ্য, ব্রহ্মসূত্রের নিজস্ব-ভাষ্য। নারী শিক্ষা নিয়েও বই লিখেছেন। তিনশো বছর আগে তিনি এক আশ্চর্য কথা বলেছিলেন, “স্ত্রীলোকদের বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা কবে আপনারা করিয়াছেন যে, তাঁহাদিগকে বুদ্ধিহীন কহেন?” বাড়িতে মেয়েরা আসন গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি কখনও বসতেন না। রামমোহন সোচ্চারে বহুবিবাহের বিরোধিতা করেছেন। সতীদাহের মত সেই সময়কার অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সমাজের সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আন্দোলন করেছেন, আইন বিধিবদ্ধ করিয়েছেন। এবং এ’সবই করেছেন বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবেরও শ’খানেক বছর আগে।

আমরা জানি, রামমোহন ব্রাহ্ম উপাসনা-ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। আমরা তাঁর ব্রিটিশ শক্তি-প্রীতির কথাও জানি। তিনি মনে করেছিলেন, ইংরেজ শাসনের আবির্ভাবে শত- শত বছরের কুশাসনের অবসানের পালা শুরু হল। পাশ্চাত্য-সভ্যতা, সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে ভারতবর্ষ শিক্ষায়-জ্ঞান-বিজ্ঞানে-সাহিত্যে-শিল্পে-বাণিজ্যে কয়েক’শো বছর এগিয়ে গেল। ভারত পেলো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। কাজির বিচারের নামে প্রহসনের অবসান ঘটলো। বন্ধ হল শাসকদের হেঁকে-ডেকে সম্পত্তি থেকে নারী- লুণ্ঠন। ইংরেজ শাসকদের তিনি মুসলিম বা হিন্দু শাসকদের চেয়ে অনেক বেশি কাম্য মনে করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার বিরোধীদের নিন্দা করেছেন, আবার মধ্যযুগীয় অবস্থায় ফিরে যাবার আতঙ্কে।

ব্রিটিশ শক্তি ভারতকে শোষণ করতে শাসন ক্ষমতা দখল করেছিল, এ’নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। ভারতের গরিবরা সব রাজা-সম্রাটদের দ্বারা হাজার হাজার বছর ধরে শোষিত হয়েছে, এ’নিয়েও কোনও দ্বিমত নেই। আবার এটাই সত্যি যে, ইংরেজরাই প্রথম প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে শিক্ষিত সমাজের কাছে তুলে এনেছিল। ভারতের বিভিন্ন কালের সম্প্রদায়ের, ভাষাভাষির, অঞ্চলের সংস্কৃতির পরিচয় আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকেই পেয়েছি। রাষ্ট্র-চেতনা, জাতীয়তাবোধ ব্রিটিশরাই এ দেশের উচ্চবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর চেতনায় ঢুকিয়েছিল। উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তারাই আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজ শাসনের আগে এ’দেশের আমজনতা ছিল কয়েক হাজার ছোট-বড় রাজা, সামন্তপ্রভু, গোষ্ঠীপতিদের অধীন। শাসকদের জুতোর শুকতলা হয়ে কৃপা পাওয়াটাই তখন ‘মহাভাগ্য’ বলে বিবেচিত হত।

এইসব মোসাহেবদের বউ, বোন বা মেয়ের রূপের বর্ণনা শুনলে রাজা থেকে গোষ্ঠীপতি প্রত্যেকেই তার মহলে বা হারেমে পাঠিয়ে দিতে বলতো মোসাহেবদের। ধন-প্রাণ রক্ষা ও বৃদ্ধি করতে সেই আদেশ পালন করতো ‘মহাভাগ্যবানেরা’। সম্পত্তি লুঠ, ডাকাতি, হত্যা এ’সব নিয়ে তখন ছিল জঙ্গলের-আইন। রাস্তা-ঘাট-যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। বিচারব্যবস্থা বলতে খেয়ালখুশি।

এই অবস্থা থেকে ব্রিটিশ শক্তি নিজেদের স্বার্থে হলেও ভারতবর্ষের খোল-নলচে পাল্টে

ফেলেছিল। রাস্তা-ঘাট-রেল-স্টিমার, বিচার ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা,

শিক্ষা ব্যবস্থা, সবেই একটা নতুন জোয়ার এলো। এ’সব

সুযোগের অনেকটা সাধারণের কাছে অধরা থাকলেও

মাৎস্যন্যায়ের অবস্থা অনেকটাই বিদায় নিল। এমন

একটা অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে অতীত শাসকদের

থেকে ব্রিটিশ শাসকদের অনেক বেশি

কাম্য মনে করেছিলেন রামমোহন।

ইংরেজ প্রীতি এই কাম্যজ্ঞানেরই ফলশ্রুতি ছিল।

গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। তারপরও আমরা সরবে স্বীকার করি- বুদ্ধ ছিলেন পৃথিবীর প্রথম যুক্তিবাদী মানুষ। তিনি অস্বীকার করলেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব । জানালেন, আত্মা অনিত্য। বললেন, কোনও গ্রন্থকেই অপৌরুষেয় ও স্বতঃপ্রমাণ বলে মানা যায় না। বুদ্ধের কিছু সময়ের সীমাবদ্ধতা ছিল। তারপরও সামগ্রিক বিশ্লেষণের পর বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জানাতে দ্বিধা হয় না। বরং ভাবাই যায় না, আড়াই হাজার বছর আগে তিনি কী বিপ্লবাত্মক চিন্তা-চেতনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

চৈতন্যদেব জাত-পাতহীন, নারী-পুরুষের ভেদাভেদহীন যে উপাসনা ধর্ম প্রচার করেছিলেন, সেই ধর্ম যে হিন্দু-উপাসনা ধর্মের তুলনায় অনেক প্রগতিশীল—এ কথা না মেনে উপায় নেই ।

এক-ই ভাবে রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্ম উপাসনা-ধর্মকে হিন্দু উপাসনা-ধর্মের থেকে অনেকটা এগিয়ে রাখতে পারি। উপাসনা-ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাসে ব্রাহ্ম উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি অবশ্যই একটা মাইল স্টোন। ব্রাহ্ম উপাসনা-ধর্মে জাত- পাতের ভেদাভেদ নেই, শ্রাদ্ধ-শান্তির কুসংস্কার নেই, জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস নেই, নেই নিয়তিবাদে বিশ্বাস। সুতরাং তাগা তাবিজ গ্রহরতে ব্রাহ্মধর্মে অলৌকিকতার কোনও স্থান নেই। বিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই নেই।

রামমোহন প্রায় তিনশো বছর আগে বাঙালি হিন্দু সমাজকে যতটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে ব্রাহ্মদেরই উচিত ছিল যুক্তিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এক সময় ব্রাহ্মরাই প্রথম নারী-শিক্ষা প্রসারে আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আমাদের সমাজের বিবাহিত পুরুষ যখন নিজেকে বিবাহিতা স্ত্রীর স্বামী বা প্রভু বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তখন ব্রাহ্ম সমাজ চেয়েছিল বিবাহিত নারী- পুরুষের সম্পর্ক হোক বন্ধুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মসমাজ সে’কালে শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না। নানা সমাজ সংস্কারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। বহুবিবাহের বিরোধিতায়, বাল্যবিবাহের বিরোধিতায়, সহমরণের বিরোধিতায় সমাজ যেমন সামগ্রিকভাবে সোচ্চার ছিল, তেমনই বিধবা বিবাহের সমর্থনেও সোচ্চার ছিল। অসমের চা বাগানের কুলিদের বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য তাদের দেখেছি আন্দোলনে শামিল হতে। অবশ্য সে’সবই অতীত ইতিহাস ।

আজকের ব্রাহ্মরা ঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে তাগা তাবিজ-গ্রহরত্ন-

অলৌকিকত্ব সবেই বিশ্বাসী হয়ে পড়েছেন। এবং এটাই মূল

স্রোত। সমাজ সংস্কারকে শীতের কাঁথার মত গুটিয়ে

রেখে ঈশ্বর ভজনাকে সার করেছেন।

এ’সব গভীর পরিতাপের বিষয় হলেও তার জন্য আমরা কোনও ভাবেই রামমোহনকে দায়ী করতে পারি না। সামগ্রিক বিচারে রামমোহন ছিলেন একজন ‘আধুনিক মানুষ’।

স্বামী বিবেকানন্দের অনেক সুন্দর সুন্দর বাণী আছে। একঃ জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। দুইঃ হে ভারত ভুলিও না মেথর মুচি চণ্ডাল তোমার ভাই…। তিনঃ খালি পেটে ধর্ম হয় না…। চারঃ ভারত বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে…

এমনই আরও অনেকবাণী হাজির করা যায়, যে’গুলো সত্যিই ভাল লাগে শুনতে। বিবেকানন্দকে খণ্ডিতভাবে না জেনে সামগ্রিকভাবে জানতে তাঁর ‘বাণী ও রচনা’, ‘পত্রাবলী’, নিবেদিতার লেখা ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি’, শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখা ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’, পড়াটা খুবই জরুরি। এ’সব পড়লে বিবেকানন্দ সম্পর্কে যে ধারণা পরিষ্কার হয়ে ওঠে তা হল—বিদ্যাসাগর বা রামমোহনের মত কালের সীমাবদ্ধতা তাঁর জীবনে আমরা দেখতে পাই না। আমরা যা পাই, তা ভয়ংকর! সোজা-সাপটা স্ববিরোধীতা।

বিবেকানন্দ এক দিকে বাণী দিচ্ছেন “জীবে প্রেম করে

যেই জন….” পাশাপাশি তিনি বরানগর

মঠে পশুবলির প্রবর্তন করেন।

দরিদ্র সেবার ক্ষেত্রেও বিবেকানন্দ ছিলেন পাক্কা হিসেবি। ১৮৯৭ সালে বিবেকানন্দ একটি চিঠি দিয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে নির্দেশ দেন, “কলকাতার মিটিং-এর খরচা বাদ দিয়ে যা বাঁচে ঐ famine-এতে (দুর্ভিক্ষে) পাঠাও বা কলকাতা, ডোমপাড়া, হাড়িপাড়া বা গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে তাদের সাহায্য কর তারপর লোকের (হিন্দুত্বে) বিশ্বাস হবে, তারপর যা বলবে শুনবে।” (পত্রাবলী, পত্র নম্বর ৩৬৩)

বিবেকানন্দ একদিকে বলছেন, “হে ভারত ভুলিও না….” বলছেন, “নতুন ভারত বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে”, তখন তিনি-ই চিঠি লিখে শিষ্যদের নির্দেশ পাঠাচ্ছেন, “ধনী দরিদ্রের বিবাদ যেন বাঁধিয়ে বসো না। ধনীদের আদতে গালমন্দ দেবে না।” (পত্রাবলী, পত্র সংখ্য ৪৭৬)

‘ব্রহ্ম-বাদিন্’ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে কী করা উচিত, সে বিষয়ে উপদেশ দিয়ে তাঁর একটি চিঠি, “গত সংখ্যায় ক্ষত্রিয়দের খুব বাড়ান হয়েছে, পরের সংখ্যায় ব্রাহ্মণদের খুব প্রশংসা কর, তারপরের সংখ্যায় বৈশ্যদের।” (পত্রাবলী, পত্র সংখ্যা ২৩৯)

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের মতামত জানি। বিবেকানন্দ এই প্রসঙ্গে বলছেন, “বাল্য বিবাহের ওপর আমার প্রবল ঘৃণা।” (ভারতীয় নারী, প্রকাশক উদ্বোধন কার্যালয়, পৃষ্ঠা ৯০)। তারপর-ই আমরা ভয়ংকর রকমের ধাক্কা খাই, যখন দেখি ‘ভারতীয় নারী’ বইটির ১৫ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দের একটি মত মুদ্রিত রয়েছে, যেখানে তিনি বলছেন, “কখনো কখনো শিশু বয়সেই আমাদিগকে বিবাহ দেওয়া হয়, কেন না বর্ণের নির্দেশ। মতামতের অপেক্ষা না রাখিয়া যদি বিবাহের ব্যবস্থা করিতে হয়, তবে প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া ভাল।”

প্রণয়বৃত্তি বা প্রেম সম্বন্ধে বিবেকানন্দের মতামতে চোখ রাখি আসুন। তিনি বলছেন, “যে-কাউকে ইচ্ছামতো পতি বা পত্নীরূপে গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া যায়, যদি ব্যক্তিগত সুখ এবং পাশবপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির চেষ্টা সমাজে বিস্তার লাভ করে, তার ফল নিশ্চয় অশুভ হবে—দুষ্টপ্রকৃতি, অসুর ভাবের সন্তান জন্মাবে।” (বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৩য় খণ্ড, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, পৃষ্ঠা ২৬৪)। ‘প্ৰেম’ বিষয়ে এমন মতকে আমরা কোন্ যুক্তির নিরিখে প্রগতিশীল বলবো?

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ অনেক দেশপ্রেমীর কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ। ১৮৯৭-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা-অভিনন্দনের উত্তর দিতে গিয়ে বিবেকানন্দ আবেগের সঙ্গে বলেছিলেন, “ইংরেজদের সম্বন্ধে যে ঘৃণার হৃদয় নিয়ে আমি ইংলন্ডের মাটিতে পদার্পণ করেছিলাম, কোনো জাতি সম্বন্ধে তার থেকে অধিক ঘৃণার ভাব নিয়ে সে দেশের মাটিতে আর কেউ কখনো নামেনি।” বিবেকানন্দের এই বক্তব্যকে অনেকেই তুলে ধরে প্রমাণ করতে চান তাঁর ইংরেজ বিদ্বেষ। কিন্তু আসলে এটা বিবেকানন্দের বক্তব্যের অংশ বিশেষ। “কেউ কখনো নামেনি”-র ঠিক পরেই বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “এই সভামঞ্চে যেসব ইংরাজ- বন্ধু উপস্থিত আছেন, তাঁরাই সে-বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। কিন্তু যতই আমি তাদের মধ্যে বাস করতে লাগলাম, তাদের জাতীয় জীবনযন্ত্র কিভাবে কাজ করছে দেখতে পেলাম, তাদের সঙ্গে মিশে জানলাম কোথায় রয়েছে তাঁদের জাতির হৃৎস্পন্দন— ততই আমি তাদের ভালবাসতে লাগলাম। তার ফলে, হে ভাতৃগণ, এখানে এমন কেউ নেই যিনি আমার থেকে ইংরেজদের বেশি ভালবাসেন।” (বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২) বিবেকানন্দের ‘বাণী ও রচনা’ ৯ম খণ্ডের ২৫৩ পৃষ্ঠায় বিবেকানন্দ বলছেন, “সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে— ইংরেজ আমাদের দাও।’ বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়েছে, তারের খবর দিয়েছে, রাজ্যে শৃঙ্খলা দিয়েছে, ডাকাতদের দল তাড়িয়েছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে। আবার কী দেবে? নিঃস্বার্থভাবে কে কী দেয়? বলি ওরা তো এতো দিয়েছে, তোরা কী দিয়েছিস?”

বিবেকানন্দের এই সব বক্তব্য তুলে বলতে চাইছি, বিবেকানন্দকে পুরোপুরি ইংরেজ বিদ্বেষী বলে বর্তমানে যেভাবে চিত্রিত করা হয়, সেটা ঠিক নয়। তিনি তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য অনুসারে কখনও ইংরেজ-প্রেম, কখনও ইংরেজ-বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন।

এই লেখকের একটি বিনীত অনুরোধ,

বিবেকানন্দের কিছু ভালো বাণী পড়ে খণ্ডিত বিবেকানন্দকে না জেনে সম্পূর্ণ

বিবেকানন্দকে জানতে আন্তরিকতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় বই-পত্তর

আদ্যন্ত পড়ুন। দেখতে পাবেন, বিবেকানন্দের সতীদাহের প্রতি

সমর্থন থেকে বিধবা বিবাহ বিরোধিতার সম্পূর্ণ চিত্র।

দেখতে পাবেন বিবেকানন্দের স্ববিরোধিতার নানা

দিক। সুতরাং তাঁর প্রগতিশীল বাণীগুলোই

শেষ কথা নয়।

বিদ্যাসাগর, রামমোহন শিক্ষা প্রসারে সমাজ সংস্কারে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। শিক্ষা বিষয়ে বিবেকানন্দের মত ছিল একটু ভিন্ন রকম। তাঁর কথায়, “এইসব বই, এইসব বিজ্ঞান আমাদিগকে কিছুই শিখাইতে পারিবে না। বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখী হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না । …. বই যত কম পড়েন ততই ভাল। …. গ্রন্থ দ্বারা জগতের ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে।” (বাণী ও রচনা,

 ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৫, ৯৯ এবং ১০৯) সমাজ সংস্কার সম্বন্ধে বিবেকানন্দের স্পষ্ট অভিমত, “সমাজ সংস্কার ধর্মের কাজ নয়।” (পত্রাবলী, পত্র সংখ্যা ৮৩)

যে মতামত, আদর্শ ও আন্দোলনের জন্য বিদ্যাসাগর, রামমোহনকে

আমরা শ্রদ্ধা করি, সেই মতামতের, আদর্শের বিরোধী চরিত্র’কে

আমরা শ্রদ্ধা জানাবো কী করে? এতে আমাদের

স্ববিরোধিতা, ভণ্ডামী, অজ্ঞতা-ই কি

প্রকাশিত হয় না?

আমরা কী করবো, আমাদেরই ঠিক করতে হবে। আমজনতার আবেগে গা ভাসাবো, না-কি যুক্তি-বুদ্ধিকে শাণিত করতে সচেষ্ট হবো? আবেগ হল যুক্তির সবচেয়ে বড় শত্রু। আবেগ চিন্তা শক্তিকে দুর্বল করে, যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা শেষ করে দেয়। চিন্তা একটা অভ্যাস, একটা চর্চা। এই চর্চা ও শৃঙ্খলাবদ্ধ যুক্তির মধ্য দিয়ে এগোলে সব সময়-ই আমরা উন্নত থেকে উন্নততর মূল্যবোধে পৌঁছতে কোনটা পারবো। বুঝে নিতে পারবো কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ ; কোনটা কালো, সাদা। তারপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কালোকে কালো, আর সাদাকে সাদা বলার হিম্মত দেখবো কি না? একটা লাগাতার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ভীরুও সাহসী হয়ে ওঠে ; সাহসী হয় ভীরু। মানসিকভাবে সাহসীদের সঙ্গে গভীর মেলামেশার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভীরুও সাহসী হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘গ্রুপ থেরাপি’। আবার একজন শারীরিক ও মানসিক ভাবে শক্তিশালী মানুষও জেলের প্রহার ও অন্ধকার সেলে থাকতে থাকতে মানুষ ও আলো দেখলেই ভয়ে সিটিয়ে যেতে পারে। পাশা-পাশি এও সত্যি—একজন ব্যক্তির আদর্শ, সাহস বহুজনকে উদ্দীপ্ত করে। আপনি-আমিও পারি সেই ব্যতিক্রমী মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে।

হ্যাঁ, আমাদেরই ঠিক করতে হবে, জনতার আবেগের সুরে সুর মেলাবার নিরাপদ পন্থা গ্রহণ করবো, নাকি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার হিম্মত দেখাবো? আমরা কাকে শ্রদ্ধা জানাবো—যাঁদের কর্মময় জীবন-ই ছিল বাণী, না-কি বাণীদান-ই যাঁদের প্রধান কর্ম ?

error: Content is protected !!