তৃতীয় পর্যায়

আমিঃ এখানে উপস্থিত আছেন পাগলাবাবা (বারাণসী)। পাগলাবাবার আসল নাম সুনীলকুমার ভট্টাচার্য। পাগলাবাবা দাবি করেন, তিনি হাত বা কোষ্ঠি না দেখেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক উত্তরদানে সক্ষম। তিনি দাবি করেন, অলৌকিক শক্তির প্রভাবে যে কোনও তিনটি প্রশ্নের উত্তর লিখিতভাবে দিতে পারেন। প্রশ্নগুলো অদ্ভুত ধরনের হতে পারে। যেমন- আমার মানিব্যাগে কত টাকা আছে । আমার বাড়িতে কতগুলো বেড়াল আছে, সবই। এ-সবই তিনি পারেন মায়ের কৃপায় পাওয়া অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিলাভের ফলে। সুনীলবাবু, পত্র-পত্রিকায় বহু জ্যোতিষী ও তান্ত্রিকদের বিজ্ঞাপন দিতে দেখি, যাঁদের নামের পরেই থাকে কয়েক ইঞ্চি নানা ধরনের অদ্ভুত সব ডিগ্রীর মিছিল। এই যেমন ধরুন MA. A (Great Britain), L. WICWA (New Delhi) FR.A.S. (London), L. M. K. B. S. (N. Delhi), তান্ত্রিক-জ্যোতিষী, রাজ জ্যোতিষী, অ্যাস্ট্রোপামিস্ট, তান্ত্রিক আচার্য, জ্যোতিষ সম্রাট, সামুদ্রিক-রত্ন, ইত্যাদি।

এই বিজ্ঞাপকদের মধ্যে এমন অতি-তরুণ আছেন, যাঁদের দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগে, এই এত অল্প বয়সে এত ভারী ভারী সব ডিগ্রী-টিগ্রী পেলেন কী করে ?

পাগলাবাবাঃ আমার কোনও ডিগ্রী নেই, সব বিষয়ে আমি বলতে পারব না। ‘রাজ- জ্যোতিষী’, যেমন ‘রাজ-কর্মচারী’। কিছু কিছু জ্যোতিষী আছেন যাঁরা জেলে গিয়ে কয়েদীদের ধর্ম-তত্ত্ব, গীতা-ভগবত ইত্যাদি পাঠ করে শোনান। এর জন্য গরমেন্ট থেকে কিছু পান, আবার কেউ কেউ বিনে পয়সায় কাজ করেন। এঁদেরকেই রাজ-জ্যোতিষী বলে।

M.A.A. (London), at Calcutta, এ-রকমও আছে। আবার আমি শুনেছি, অনেকে কোর্টে এফিডেভিট করে যেগুলো চায় সেগুলো নিতে পারেন।

আমিঃ ডিগ্রীগুলো নিতে পারেন ?

পাগলাবাবাঃ হ্যাঁ।

আমিঃ আমাদের সময়ও খুবই কম। তিনজন আপনার সামনে প্রশ্ন রাখবেন। প্রথম প্রশ্ন রাখবেন কল্যাণ চক্রবর্তী। প্রফেশনে প্রেস ফটোগ্রাফার।

কল্যাণঃ আমার সঙ্গে যে ক্যামেরা আছে, সেই ক্যামেরায় কতগুলো ছবি উঠিয়েছি?

পাগলাবাবাঃ এই ১৬ থেকে ১৭টা ।

আমিঃ কল্যাণ, কটা ছবি তুলেছ, তুমি একটু দেখাও।

কল্যাণঃ আমার ক্যামেরায় ইন্ডিকেটরে তোলা ছবির নম্বরটা দেখে নিন, তিরিশ।

পাগলাবাবাঃ তাহলে আমার ভুল হয়েছে ।

আমিঃ ময়ূখবাবু, ময়ূখ বোস এবার প্রশ্ন রাখছেন।

ময়ূখঃ আমার মানিব্যাগে কত টাকা আছে?

পাগলাবাবাঃ সেভেন সেভেন।

ময়ূখঃ সেভেন সেভেন? আমারমানি ব্যাগে ২৭০ টাকা আছে, দেখে নিন।

পাগলাবাবাঃ ভুল, আমার ভুল।

আমিঃ এবার প্রশ্ন করছেন রঞ্জনবাবু, রঞ্জন সেনগুপ্ত ।

রঞ্জনঃ আমার একটাই প্রশ্ন, আমার পকেটের সিগারেটের প্যাকেটটা দেখেছেন, এটায় ক’টা সিগারেট আছে ?

পাগলাবাবাঃ সাতটা ।

রঞ্জনঃ দেখুন, ন’টা আছে। –

পাগলাবাবাঃ তিনটেই আমার ভুল হল।

আমিঃ আচ্ছা, এই ধরনের ভুল কেন হয়?

পাগলাবাবাঃ আমাদের একটা মুড আছে। প্রত্যেক মানুষের একটা জায়গা আছে।

আমিঃ তার মানে নিজের জায়গায় হলে আপনার সুবিধে হয়?

পাগলাবাবাঃ না, তার কোনও প্রশ্ন নয়। যে কোনও জায়গায়ই প্রশ্নের উত্তর দিই । হয়তো আপনি বলবেন যে আমি এখানে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না, অতএব গুল ওসব। হয়তো আমি এখন মুডে নেই। মানুষের সুস্থতা, অসুস্থতা আছে। আর তিনটে প্রশ্নের উত্তরেই ভুল করলাম। এতে আমি খুব আনন্দ পেলাম। বুঝলাম, আমিও ভুল করি।

রহস্য এখানেই শেষ নয়। এর পরও বলার কিছু থেকে যায়। এই লড়াইয়ের নেপথ্যের কিছু কথা তুলে দিলাম, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনে আসতে পারে ভেবে।

পাগলাবাবা (বারাণসী)-কে লিখে উত্তর দিতে দিইনি; শুধুমাত্র এই কারণেই জিতেছি; এমনটা ভাবলে পুরোপুরি ভুল ভাবা হবে। সেদিন কল্যাণ চক্রবর্তী এবং রঞ্জন সেনগুপ্ত যেমন প্রশ্ন করবেন ভেবেছিলেন, তেমনটি করলে পাগলাবাবা না লিখেই সঠিক উত্তর দিয়ে দিতে সক্ষম হতেন । আর, তার ফলেও অলৌকিক ক্ষমতারই বিশাল জয় ঘোষিত হতো । যুক্তিবাদী আন্দোলন আজ যে অবস্থায় অবস্থান করছে তা নিঃসন্দেহে অনেকটাই ব্যাহত হতো।

রেকর্ডিং-এর দু’দিন আগে আমার অফিসে এসেছিলেন কল্যাণ। জানালেন, সব তৈরি। একটা ক্যামেরায় কিছু ফিল্ম তুলে রেখে দিয়েছেন। ওটাই পরশু নিয়ে আসবেন । জিজ্ঞেস করলাম, “ক’টা ফিল্ম তুলেছ ? ১৬-১৭টা ?” কল্যাণ বললেন, “হ্যাঁ, “সতেরটা তুলেছি।”

বললাম, “ওটা তিরিশে নিয়ে যাও।”

“বললে নিয়ে যাব। কিন্তু কোনও দরকার আছে কী ?”

“নিশ্চয়ই, কারণ তোমাকে দেখে যেমন আমি অনুমান করতে পেরেছি পরীক্ষার জন্য তুমি এক থেকে ছত্রিশ-এর মধ্যে কত নম্বরকে বেছে নেবে, পাগলাবাবাও তা পারবেন । পাগলাবাবার সঙ্গে একদিন কিছুক্ষণ মেশার সুযোগে যা বুঝেছি, তাতেই মনে হয়েছে বিভিন্ন মানুষের সংখ্যা ভাবার ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন মানসিকতা কাজ কবে, সেই মনস্তত্ত্ব বিষয়ে উনি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। লিখে উত্তর দেবার সুযোগ বন্ধ করে দিলেই যে উনি ভুল বলতে বাধ্য হবেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। উনি তোমার মানসিকতাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করবেন। ছত্রিশটি ফিল্মের মধ্যে কতটি তুলেছ, অর্থাৎ ১ থেকে ৩৬-এর মধ্যে একটা সংখ্যা তোমাকে বেছে নিতে বললে তুমি কোন সংখ্যাটি বেছে নিতে চাইবে-এটাই পাগলাবাবা বুঝতে চাইবেন তোমাকে দেখে। এবং পারবেনও, দেখে দিও। কিন্তু তুমি ৩০-এ রেখে দেখ, পাগলাবাবা বলতে পারবেন না। কারণ বাস্তবিকই তাঁর অতীন্দ্রিয়-দৃষ্টিশক্তি নেই; তাঁর মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল ও তাঁর আগাম চিন্তা আমি ধরতে সক্ষম!”

কল্যাণ আমার কথামত ১৭কে ৩০-এ নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে হেরে যাওয়া বাজিও যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মীরা জিতে নিয়েছিলেন।

রেকর্ডিং-এর একটু আগে রঞ্জন সেনগুপ্তকে একটু নির্জনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “প্যাকেট রেডি?”

“হ্যাঁ।”

“কটা রেখেছেন?”

“আপনাকেও বলব না। কেউ না জানলে জেতার সম্ভাবনা বাড়ে।”

বলেছিলাম, “সাতটা রেখেছেন না?”

বিস্মিত রঞ্জন বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানলেন তিনটে সিগারেট সরিয়ে রেখেছি?”

বললাম, “সে পরে বোঝাব, এখন প্যাকেটে আর দুটো সিগারেট পুরে ফেলুন ।”

অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হওয়ার কিছুদিন পর কল্যাণ চক্রবর্তী তাঁর এক চিত্র-গ্রাহক বন্ধু কল্যাণ বসাককে নিয়ে এসেছিলেন আমার ফ্ল্যাটে। কল্যাণ বসাক আমার অনুমান-শক্তির প্রমাণ নিতে চেয়েছিলেন, বলেছিলাম, “১ থেকে ১০ এর মধ্যে একটা সংখ্যা ভাবুন তো?” কল্যাণ বসাক বললেন, “ভেবেছি।”

“সাত ভেবেছেন।”

কল্যাণ বসাক যথেষ্টই বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “হ্যাঁ, সাতই ভেবেছিলাম।”

কল্যাণ বসাককে দেখে আর পাঁচজন গড় মানুষের মতই সতর্ক, সাবধানী মানুষটিকে আবিষ্কার করেছিলাম। তাই, ১ থেকে ১০-এর মধ্যে সাধারণভাবে ‘৭’ ভাবার গরপড়তা মানুষের প্রবণতার কথাই বলেছিলাম । এই সতর্ক ও সাবধানী হওয়ার প্রবণতা সাধারণভাবেই অখ্যাত, বিখ্যাত, সবার মধ্যেই বেশির ভাগ সময়ই বিরাজিত। আপনারা হাতে-কলমে পরীক্ষা করলেই আমার বক্তব্যের যাথার্থতা বিষয়ে আরও আস্থাশীল হবেন। আবার যাঁরা অতি মাত্রায় অগ্রাসী, যাঁরা হটকারি, যাঁরা জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে পারেন যখন তখন, তাঁরা নামী বা অনামী যাই হোন না কেন, অন্য ধাতে গড়া। তাঁদের চিন্তায় আবার একই ধরনের সংখ্যা আসবে। এমনি অনেক রকম শ্রেণী-বিভাগ করে বহু ক্ষেত্রেই চিন্তার হদিশ পাওয়া সম্ভব হয়।

error: Content is protected !!