আমাদের দেশে প্রচার মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম বৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্রগুলো দূরদর্শন ও বেতার। ঠিক তার পরের ধাপেই আছে বিপুল প্রচারিত কিছু সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা এবং তারও পরের ধাপে বিদেশী টেলিভিশন।

প্রধাণত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপ্ত্রকে এবং কিছুটা আঞ্চলিক ভাষার সংবাদপত্র ও দূরদর্শনকে খবর সরবরাহের কাজ করে কিছু এদেশী ও বিদেশী সংবাদ সরবরাহ সংস্থা।

দূরদর্শন জনগণের টাকায় শাসকশ্রেণীর প্রচার মাধ্যম

দূরদর্শন সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। যে দল যখনই গদিতে বসুক, দূরদর্শন তার মূল চরিত্র কিন্তু অপরিবর্তিতই রাখে। নানারূপে, নানাভাবে ভোগবাদী ও অধ্যাত্মবাদী সংস্কৃতির প্রচার চালিয়ে যায়। ভোগে-ত্যাগে মিলিয়ে সব মানুষের মাথাই একই সঙ্গে প্রচার করে সাঁইবাবা আর বাবা সায়গলকে। একদিকে ঋষি অরবিন্দের বাণী স্মরণ, আর এক দিকে শারন প্রভাবকের চিত্তহরণ-বস্ত্রহরণ। একদিকে ‘এসো পড়াই’, আর এক দিকে- ধর্ষণ করে দেখাই। একদিকে ‘হে ভারত ভুলিও না’, আর একদিকে ভারতবাসীদের ভুলিয়ে রাখার বিশাল আয়োজন। একদিকে গৈরিক আর নামাবলি জড়িয়ে ভোগের মুখে মুগুর, আর একদিকে ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ দেখতে ভাদ্দুরে কুকুর। একদিকে সতীত্বে-মাতৃত্বে-ত্যাগে নারী মহাশক্তির লীলা, আর একদিকে ফ্যাসান প্যারেডে আধা-ন্যাংটো নারীর মেলা। একদিকে রামকৃষ্ণ মিশনের ‘বিশ্ব ধর্মসম্মেলন’, আর একদিকে সামান্থা ফক্স-ম্যাডোনা-মাইকেল জ্যাকসনের উদোম নৃত্যের ‘মহামিলন’। দূরদর্শনের এমন ভুবন জোড়া ভোগ ও ত্যাগের ফাঁদ থেকে বাঁচা বড়ই কঠিন হে !

আমার এমনতর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেউ বলতেই পারেন, “দোষটা একা সরকার বাহাদুরের নয়, দোষটা আমাদেরও।“

যিনি এ-ধরনের বক্তব্য রাখেন, তিনি বুদ্ধিজীবী না হয়ে সাধারণ মানুষ হলে বলতে পারি- দোষটা একা তাঁর নয়, দোষটা মগজধোলাইকারী বুদ্ধিজীবীদেরও। বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে মগজধোলাই শুরু করেন বোঝাতে একটা উদাহরণ টানা যায়। ৮ ডিসেম্বর ৯৩ ‘বর্তমান’ দৈনিক সংবাদপত্রের ‘হামলোগ’ কলমে সমর বসু লিখলেন, “বোম্বাই-এর টাকার থলির ক্ষমতা যে কত প্রচণ্ড সে আমরা আঁচও করতে পারি না। সমস্ত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চলছে কালো টাকায়। সরকার বাহাদুর জানেনা না? কিছু করতে পেরেছেন? সামান্য অশ্লীল পোস্টার ছাপা বন্ধ করতে পারেন না যারা তাঁরা কিনা অশ্লীল ফিল্ম করবেন? তাও আবার শ্লীল নাটক করে? দোষটা অবশ্য একা সরকার বাহাদুরের নয়, দোষটা আমাদের রুচিরও। আমরাই চাই এই ধরনের ফিল্ম উপোসি ছারপোকা যেমন চায় সেক্স।“

সমরবাবুর এইটুকু বক্তব্যের দিকে আরও একটু সতর্ক দৃষ্টি দিন। তাহলেই পরিষ্কার দেখতে পাবেন সমাজে অশ্লীল ফিল্মের উপস্থিতির জন্য সরকারকে জোর একহাত নেওয়ার পরই দোষের একটা ভাগ এবং বড় ভাগটাই চাপিয়ে দিয়েছেন জনগণেরই উপর। সরকারকে গাল পেড়ে একদিকে নিজের প্রতিবাদী ইমেজ তৈরি করেছেন, আর একদিকে ‘আমাদের’ কথাটা প্রয়োগ করে ‘জনগণের আপনজন’ মার্কা ইমেজও তৈরি করেছেন। দুয়ের ফাঁদে পড়ে জনগণ আরও বেশি বিভ্রান্ত হবেনই। মারাদোনার সূক্ষ্ম পায়ের কাজের মতই সমরবাবুর কলমের সূক্ষ্ম কাজে জনগণ টালমাটাল হয়ে যান। সমাজ কাঠামোর প্রয়োজনই সমরবাবু অশ্লীলতা দূর করতে চান না। আর তাই তিনি একবারের জন্যেও জনগণের কাছে আহ্বান রাখেন না- আসুন এই অশ্লীল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনা জনমানসে ছড়িয়ে দিতে আন্দোলন গড়ে তুলি। সমরবাবুর মতো বুদ্ধিজীবীরা চান, আন্দোলন গড়ে সমস্যার মূলে না পৌঁছে, জনগণ সমাজের বর্তমান অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে নিজেদের বুকের দিকেই আঙ্গুল তুলে দেখাক। সমরবাবু মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝেন। জানেন- অন্যায়বোধের দ্বারা সংগ্রামী মানুষেরও মন স্তিমিত হয়।

দূরদর্শন এ’ছাড়া আর একটি কাজ করে থাকে, সেটা হল, যে দল গদিতে বসে, সেই দলকেই দেয় বাড়তি প্রচার। শাসক দলের গোটা, আধা, পোয়া মাপের নেতাদের প্রতিটি ফিতে কাটাকে টি. ভি. স্ক্রিনে হাজির করতে ‘জো হুজুর’ বলে হাজির থাকে দূরদর্শনের ক্যামেরা।

এ’সবের বহিরাবরণ সরালে আমরা দেখতে পাব, দূরদর্শনের ও বেতারের প্রচারের মূল সুরে রয়েছে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা (এবং যে দলই শাসন ক্ষমতায় আসুক, প্রতিটি শাসকদলের মতাদর্শের ‘নিউক্লিয়াস’ একই)। শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ অবাধারিতভাবে এই সিস্টেমের মতাদর্শেরই অংশ।

B.B.C-র নিরপেক্ষতা নেহাৎই ভান

অনেকেরই ধারণা (এই ধারণা বিশেষ করে উচ্চ-শিক্ষিত ও উচ্চ-বিত্তের মানুষদের মধ্যে প্রবল) British Broadcasting Corporation অর্থাৎ B.B.C খুবই নিরপেক্ষ প্রচার-মাধ্যম। শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এই প্রচার মাধ্যম কখনোই দূরদর্শনের মত শাসক ও শোষকশ্রেণীর মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে সত্যকে বিকৃত করে না।

বাস্তব সত্য কিন্তু আদৌ তা নয়। B.B.C-র নিরপেক্ষতার ভানের মুখোশটুকু সরালে দেখতে পাবেন, বিশ্বের এই এক নম্বর প্রচার-মাধ্যমটিও বর্তমান সমাজ কাঠামোর (অর্থাৎ অসাম্যের সমাজ কাঠামোর) স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে বিশ্ব জনমতকে পরিচালিত করে। পার্থক্য এইটুকু এই B.B.C-র নিরপেক্ষতার মুখোশে আছে সূক্ষ্ম তুলির টান।

একটি উদাহরণ টানলে বাস্তব চিত্রটা পরিষ্কার হবে আশায় একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।

B.B.C-এর টেলিভিশন ইউনিটের চ্যানেল-ফোর সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয়। চ্যানেল-ফোর এর জন্য যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে একটা তথ্য চিত্র করার ইচ্ছেয় ডিরেকটর, প্রডিউসার রবার্ট ঈগল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই নিয়ে উভপক্ষের মধ্যে দীর্ঘ কিছু মাস ধরে মত বিনিময় চলতে থাকে ফ্যাক্স ও ফোন মারফত।

ভারতের যুক্তিবাদী আন্দোলন নিজেদের বিশ্লেষণী চোখ দিয়ে দেখতে লন্ডন থেকে উড়ে এলেন ঈগল ও তাঁর সহকারী অ্যানা সাইমন। ৯৪-এর সেপ্টেম্বরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরলেন, দেখলেন, শুনলেন, অনেকের সঙ্গে কথা বললেন, এবং অনেক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কয়েকজনের পক্ষে ওকালতি করে বোঝালেন, যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে ফিল্ম করতে গেলে ওঁদের ফিল্মে রাখা কতটা জরুরি। এই কয়েকজন তথাকথিত ‘জরুরি যুক্তিবাদী’দের ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি। এঁদের কাউকে দেখেছি বৃহৎ পত্রিকায় অধ্যাত্মবাদ ও ধর্মের পক্ষে এবং যুক্তিবাদের বিপক্ষে কলম চালাতে অথবা নিজেকে ‘নাস্তিক’ বলে ঘোষণার পাশাপাশি নাস্তিকতা একটা উচ্চকোটির মানুষদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার, যা সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য- বলে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে আকাশে নাক ঠেকিয়ে বসে থাকতে। কিংবা, ঈশ্বর-ভূত-জ্যোতিষ-অলৌকিক ক্ষমতার অস্তিত্বের পক্ষে জোরাল সওয়াল করার পাসাপাশি নিজেকে বুক বাজিয়ে ‘যুক্তিবাদী’ বলে জাহির করতে। রবার্ট ঈগলদের নিয়ে এঁদের আদিখ্যেতা ও হ্যাংলামির গোটা ব্যাপারটার উপর আমরা সতর্কতার সঙ্গে নজর রাখাছিলাম।

আমরা ঈগলের সঙ্গে এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার টেবিলে বসলাম। জানালাম, তোমরা দেখলে, B.B.C-র অনুষ্ঠানে মুখ দেখাবার জন্য কতজন তোমাদের এয়ারকন্ডিশন গাড়িতে চাপাল, পাঁচতারা হোটেলে পার্টি দিল। আমাদের সেই সঙ্গতি নেই। আমরা কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকারের কাছ থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য নেই না, নেই না কোন বিদেশী সাহায্য। আমরা সংসদীয় রাজনীতিতে ঢুকে পড়া কোনও রাজনৈতিক দল নই, যারা ধনীদের থেকে দালালী আদায় করে। আমাদের শক্তি অর্থে নয়, প্রভাবে। আমাদের সংগঠন চলে আমাদেরই চাঁদার টাকায় ও আমাদের লেভি’র অর্থে। তাই তোমাদের আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি হোটেলের বার বা কফি-শপ ছেড়ে আমাদেরই এক সদস্যের বাড়িতে। আমরা বর্তমান সমাজ কাঠামোতে আঘাত হানতে চাই, তোমরা এই সমাজ কাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখতে চাও। এই দুই বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েও আমরা তোমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা যে কারণে সুযোগ পেলেই বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রত্রিকায় লিখি, দূরদর্শনে হাজির হই, সেই একই কারণে তোমাদের সহযোগিতা করতে চাই। কারণটা হল, আমাদের দর্শনের ও আদর্শের প্রচার। আমরা জানি, বৃহৎ পত্রিকাগুলো কখনোই আমাদের আদর্শের কথাকে ততদূর পর্যন্ত জনগণের কাছে পৌঁছে দেয় না, যা এই সমাজ কাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে আঘাত করতে পারে। কিন্তু ওসব পত্রিকায় লেখার সময় আমরা একটা বিষয়ে সচেতন থাকি, যেন আমাদের বক্তব্যের মূল সুর সম্পাদকের কাঁচির ছোঁয়ায় অন্য কিছু না হয়ে যায়। একইভাবে আমরা নিশ্চিত হতে চাই, তোমরা যেভাবেই কাঁচি চালাও, আমাদের আদর্শের মূল সুর যেন তাতে বজায় থাকে, তথ্য না বিকৃত হয়।

এই আলোচনার সূত্রেই আমরা ঈগলকে জানিয়েছিলাম, তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের ইচ্ছে মতই ছবি বানাবে। যাকে খুশি নিয়ে, যেভাবে খুশি তোমাদের ছবি বানাবার স্বাধীনতা যেমন আছে, তেমনই আমাদেরও স্বাধীনতা আছে, তোমাদের ছবিতে আদৌ আমরা মুখ দেখাব কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তোমাদের এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করে দেওয়া ভাল, আমাদের আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রশক্তি একটা সুগভীর চক্রান্ত চালাচ্ছে। এই চক্রান্তেরই ফলস্বরূপ  আরও দুটি যুক্তিবাদী আন্দোলনের ধারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। একটি বিদেশী সহযোগিতা পুষ্ট, অপরটি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পুষ্ট। এই দুই ধারাই গত কয়েক বছর ধরে নানাভাবে প্রচার করে চলেছে- অধ্যাত্মবাদ অর্থাৎ আত্মা, পরমাত্মা ইত্যাদি বিষয়ক বিশ্বাস কোনও কুসংস্কার তো নয়ই, বরং এ’সব বিশ্বাস নাকি মানুষের মানবতা বিকাশের পক্ষে প্রয়োজনীয় শর্ত। এই দুটি ধারাই প্রভাবে ক্ষীণ হলেও অর্থ বলে বলীয়ান এবং সর্বপড়ি ওদের পিছনে রয়েছে এ’দেশ ও বিদেশের ধনকুবের গোষ্ঠী। আমরা এটাকে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলে মনে করি। কারণ এ’দেশের সমাজ কাঠামোর উপর আঘাত হানায় আমাদের সাফল্য অন্যান্য দেশের অসাম্যের সমাজ কাঠামোর নিয়ন্ত্রকশক্তিগুলোর কাছে আতঙ্কের কারণ বই কি। এই দুই মেকি যুক্তিবাদী আন্দোলনের ক্ষীণ ধারাকে পুষ্ট করতে নানাভাবে নিরন্তর যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তারই একটি হল- অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র) কে যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী একটি চরিত্র হিসেবে পশ্চিমবাংলার জনগণের সামনে হাজির করা। সরকার নিজেকে যেমন কুসংস্কার বিরোধী চরিত্র বলে হাজির করেছেন, তেমনই সুযোগ পেলেই পত্র-পত্রিকায় সগর্ব ঘোষণা রাখছেন- তিনি ঈশ্বর, ভূত, ভাগ্য এবং অলৌকিক ক্ষমতায় পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন। এটা অবশ্যই সাধারণ মানুষদের মগজধোলাই করার  একটা চক্রান্তের একটি অংশ বই কিছু নয়। প্রচারের ব্যাপকতায় বহু মানুষই ভাবতে শুরু করবেন- ঈশ্বর, ভূত, ভাগ্য, অলৌকিকত্বে বিশ্বাস রেখেও যুক্তিবাদী হওয়া সম্ভব। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে রাখছি, তোমরা যদি এই আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শরীক হিসেবেই এসে থাক, তাহলে তোমাদের তরফ থেকে নিরপেক্ষতার ভানের আড়ালে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সরকারকেও একজন যুক্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে হাজির করার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। সরকারের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তুমি যদি জিজ্ঞেস কর- আপনি কি আজ পর্যন্ত কোনও অলৌকিক ক্ষমতাবান মানুষ দেখেছেন? উত্তরে উনি নিশ্চয়ই বলবেন- না। তোমরা ফিল্মে সরকারের এই কথাটুকু রেখে, ওঁর ভূত-ঈশ্বর-ভাগ্য-অলৌকিকে গভীর বিশ্বাসের কথা যদি প্রচার না কর, সে ক্ষেত্রে তোমার এই সত্য গোপনের ফলে কুসংস্কার বিরোধী যুক্তিবাদী সমিতি ও কুসংস্কারের আগা-গোড়া ডুবে থাকা সরকারের অবস্থান তোমার ফিল্মে একই লেভেলে থাকবে। এই পরিস্থিতিতে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি- তোমরা তোমাদের এই ফিল্মে সরকারকে রাখলে, আমাদের এই ফিল্মের বাইরে রেখ।

মিস্টার ঈগল রাজি হলেন আমাদের শর্তে আমাদের নিয়ে কাজ করতে। বাধ্য হয়েই রাজি হলেন। কারণ স্পষ্ট- বর্তমান পৃথিবীতে একটি দেশেই যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে, ব্যাপকতা পেয়েছে, মানুষকে আন্দোলিত করেছে। দেশটির নাম- ভারত। একটি মাত্র দলের নেতৃত্বে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে। দলটির নাম- ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি। সুতরাং যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে একটা ভাল বাণিজ্যিক ফিল্ম করতে গেলেও আমাদের সমিতির উপস্থিতি অপরিহার্য।

বর্তমান পৃথিবীতে যুক্তিবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সমিতির যে অবস্থানের কথা বললাম, তা ‘কুয়োর ব্যাঙ’-এর চিন্তার ফসল নয়। বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা পৃথিবী জুড়ে কাজ করছে, তাদেরই মতামতেরই প্রতিধ্বনি। (মূলত মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংগঠন নিয়ে গঠিত এক ‘ফেডারেশন’ হল “COUNCIL FOR DEMOCRATIC & SECULAR HUMANISM’, সংক্ষেপে” CODESH’। এই CODESH ‘এর অন্যতম সদস্য হ’ল ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’ বা ‘HUMANISTS ASSOCIATION OF INDIA’। মানবতাবাদী সমিতি হ’ল যুক্তিবাদী সমিতিরই একটি ‘Wing বা শাখা। CSICOP এবং এই জাতীয় যুক্তিবাদী কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত কিছু সংস্থাও ‘CSICOP’ এর সদস্য। সুতরাং এইসব সংস্থার কাজ-কর্ম, জনগণের উপর তাদের প্রভাব ও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংগঠন বিষয়ে তাদের মতামত সব সময়ই জানার সুযোগ আমাদের কাছে এবং সে সুযোগ আমরা নিয়েও থাকি।) অতি সম্প্রতি নেওয়া B.B.C-র মতও এর চেয়ে ভিন্নতর কিছু নয়। আমাদের ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকার জন্য ভিডিও ক্যামেরার সামনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (১৯.১২.৯৪) B.B.C-র পক্ষ থেকে রবার্ট ঈগল জানান, পৃথিবীর বহু দেশে বহু আন্দোলন কাছ থেকে দেখার সুবাদেই বলছি, তোমাদের সমিতি যে ভাবে এ’দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছে, পৃথিবীর কোনও দেশেই তার ধারে-কাছে থাকা কোনও যুক্তিবাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত নেই। ইউরোপ ও আমেরিকায় C.S.I.C.O.P-র নেতৃত্বে যে যুক্তিবাদের প্রচার প্রচেষ্টা চলছে, তা পুরোপুরি জেমস র‍্যান্ডির ব্যাক্তিগত প্রয়াস বই কিছু নয়। ওসব দেশে C.S.I.C.O.P-র না যত মানুষ জানে, তার একশগুণ মানুষ তোমাদের সমিতির নাম জানে। জেমস র‍্যান্ডি মাঝে-মধ্যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে হাজির হয় বটে, কিন্তু সেও বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যার কথা বলতে গিয়ে তোমাদের সমিতির নাম টেনে আনে, প্রবীর ঘোষের নাম টেনে আনে। ভারতে বি. প্রেমানন্দ যা করছে, একজন ব্যক্তি হিসবেই করছে। ওর কর্মস্থল কেরালায়ও ওর সংস্থা Indian C.S.I.C.O.P-র কোনও শাখা দেখিনি। ও দু’চার জনকে অলৌকিকতার বিরুদ্ধে কিছু কিছু কৌশল শেখাচ্ছে। ওর কাজ-কর্মের সঙ্গীও একজন কি দু’জন। তোমাদের যে শাখাতেই যাচ্ছি, সেখানেই দেখতে পাচ্ছি প্রচুর টগবগে, মিলিট্যাণ্ট আদর্শে নিবেদিত তরুণ-তরুণী। তোমাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে মানুষের ভীড় দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি তোমাদের ছেলেমেয়েরা মানুষদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের আন্দোলিত করে বলেই মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তোমাদের আন্দোলনের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল- তোমাদের লক্ষ্য সাম্যের সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা। অন্য কোনও দেশেই যুক্তিবাদী আন্দোলনে এমন লক্ষ্য রাখার নজির আমি দেখিনি। তোমাদের লক্ষ্য, আমার মনে হচ্ছে, কিছুটা রাজনৈতিক। অন্যান্য যুক্তিবাদী সংস্থার কিন্তু স্পষ্ট একটিই লক্ষ্য- অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারের ব্যাখ্যা হাজির করা।

আমাদের সঙ্গে মিস্টার ঈগলের ফ্যাক্স মারফত লিখিতভাবে মত আদান-প্রদানের সময়ও আমরা স্পষ্টভাবে আমাদের অংশ গ্রহণের ক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে জানিয়েছিলাম, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পি. সি. সরকার (জুনিয়র) কে যুক্তিবাদী আন্দোলনের এই ফিল্মে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে, আমাদের ফিল্মের বাইরে রেখ।

ফ্যাক্সে ঈগলের খবর এলো, আমাদের সব শর্তই মেনে নেবার খবর।

ডিসেম্বর ৯৪-এ ভারতে এলেন রবার্ট ঈগল চার সঙ্গী নিয়ে ফিল্ম তুলতে। কেরল ও বাঙ্গালোর হয়ে কলকাতায় এলেন। কেরল, বাঙ্গালোরে দু-এক দিনে ছবি তোলা শেষ করলেও আমাদের সমিতির জন্য বরাদ্দ রেখেছেন চোদ্দটি দিন। মাঝখানে দুটি দিন বিশ্রাম। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তে ঠাসা প্রোগ্রামে ভরিয়ে দিলাম। নিয়ে গেলাম দুর্গম ও প্রত্যন্ত গ্রামে, আধা শহরে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল। পনের, কুড়ি, পচিশ হাজার মানুষ মাঠ-ঘাট ভেঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে হাজির হয়েছেন। কি-ইনা দেখানো হয়েছে সে সব অনুষ্ঠানে ! চড়কে ঘোরা, কাঁটায় ও খাড়ায় ঝাঁপের মত গ্রামীণ অলৌকিক বিশ্বাস থেকে আধুনিকতম প্যারাসাইকোলজিস্টদের তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতা- সবেরই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, রহস্য ফাঁস করা হয়েছে। হাজির হয়েছি বিখ্যাত বিখ্যাত অবতারদের সামনে সরাসরি চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁদের নিত্যনতুন বুজরুকি B.B.C-র ক্যামেরার সামনেই ফাঁস করেছি। এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে এক ফকিরবাবার সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতি দক্ষতার সঙ্গে।

বিশ্রামের দুটি দিন রবার্ট ঈগল সদলবলে ছিলেন কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে। ওঁদের কাজকর্মের উপর আমরা নজর রেখেছিলাম। সেই নজর রাখার অঙ্গ হিসেবেই ওঁরা কার সঙ্গে কখন কোথায় দেখা করছেন, কি বলছেন, কোনও কিছুই আমাদের নজরের বাইরে ছিল না। আর তাইতেই আমরা B.B.C-র এক মিথ্যাচারিতা ও চক্রান্তের হদিস পেলাম। আমরা দেখলাম নিরপেক্ষতা ও সততার প্রতিমূর্তি B.B.C-র প্রতিনিধি রবার্ট ঈগল একতরফা ভাবে আমাদের দেওয়া তাঁর লিখিত ও মৌকিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন। অতি গোপনীয়তার সঙ্গে সরকারের ছবি তুললেন। কেন এই মিথ্যাচারিতা? কেন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আইন ভাঙ্গার ঝুঁকি নিলেন? কেন এই নিশ্চিদ্র গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়াস? তবে কি ‘তথ্য গোপন’ অথবা ‘তথ্য বিকৃতি’র মধ্য দিয়ে আমাদের ধসিয়ে মেকী আন্দোলনকে তুলে আনতে এ’এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত?

সে রাতেই আমরা রবার্ট ঈগল ও তাঁর সহকারী অ্যানা সাইমনের বিরুদ্ধে সরাসরি মিথ্যাচারিতা, চুক্তিভঙ্গ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলাম, তাঁদেরই কাছে। প্রথমে এই ষড়যন্ত্রের ও চুক্তিভঙ্গের ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যখন একের পর এক প্রমাণগুলো ওঁদের সামনে মেলে ধরে বললাম, “তোমাদের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’কে আমাদের সমিতির কাছে পাঠিয়ে দিও, আমাদের ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট ওদের ট্রেনিং দিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে”, তখন ওঁরা স্বীকার করলেন, বলতে কি, স্বীকার করতে বাধ্য হলেন- চুক্তি ভেঙ্গেছেন। এও বার বার বোঝাবার চেষ্টা করলেন- পি. সি. সরকার এতই ছোট জাদুকর যে, ইউরোপ-আমেরিকায় ওকে কেউ চেনেন না। তোমাদের মুখেই প্রথম ওর নাম শুনি এবং তোমাদের বিরোধীতার জন্যই আমরা যুক্তিবাদী আন্দোলনকে বিতর্কিত করে তুলতেই ওর ছবি তুলেছি। এটুকু কথা দিচ্ছি তোমরাই প্রায় পঞ্চান্ন মিনিটের ফিল্মের শতকরা নব্বই ভাগ জুড়ে থাকবে। বাকিরা দশ ভাগ। আর সরকার থাকবে মিনিট দু’য়েকের মত।

আমরা জানালাম, তোমাদের এই একতরফা চুক্তি ভংগের জন্য আমরা আর তোমাদের কোনও মুখের কথাতেই বিশ্বাস করছি না। এই যে ‘স্ট্যাম্প পেপার’- এ চুক্তির বয়ান করে এনেছি। মিস্টার ঈগল, তুমি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে তবেই আবার কাজ করব আমরা, নতুবা কাজ বন্ধ।

একদিকে মিস্টার ঈগল আমাদের বোঝাতে চাইলেন, আজ পর্যন্ত কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার উপর তথ্যচিত্র তোলার ক্ষেত্রে B.B.C. কোনও ভাবেই তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় না। B.B.C. বরং যাদের সাক্ষাৎকার নেয় একতরফাভাবে তাদের দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়, সাক্ষাৎকারটিতে ইচ্ছে মত কাঁচি চালাবার সমস্ত অধিকার B.B.C.-র থাকবে। এই অবস্থায় কোনও ভাবেই আমাদের পক্ষে তোমাদের সঙ্গে কোনও রকম আইনি চুক্তিতে আসা সম্ভব নয়। এলে সেটা হবে B.B.C.-র ইতিহাসে প্রথম ব্যতিক্রম। এক্ষেত্রে তোমরা আইনি চুক্তির জন্য জোরাজুরি করলে আমরা এই চুক্তিপত্রের প্রতিলিপি B.B.C. তে পাঠিয়ে দিতে পারি। B.B.C.-র আইনজ্ঞরা এই চুক্তিপত্র পড়ে যে মতামত দেবেন, আমরা সেই মতই চলবে।

আর এক দিকে অ্যানা বোঝাতে লাগলেন, তোমরা ফিল্মের বাইরে থাকলে লাভ কি? বরং ফিল্মে থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে তোমরা তোমাদের কথা সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে।

ওঁরা দু’জন যখন নানা ভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই কথাগুলোই আমাদের কাছে বলে চলেছেন, তখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে রইলাম- হয় যুক্তি, নতুবা আমাদের বাদ দাও। এমনকি যেদিন আমাদের নিয়ে ছবি তুলেছ, তাও ফিল্ম থেকে বাদ দিতে হবে। এ’টুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি আমাদের এই অনমনীয়তা ঈগল ও অ্যানার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

চুক্তিপত্রে স্পষ্ট করে বলা ছিল, আমরা যে সব ঘটনা ঘটিয়ে দেখিয়েছি, এবং আমাদের অনুষ্ঠানে যে জনসমাবেশ হয়েছে, তা অন্য কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান বা জনসমাবেশ বলে দেখানো চলবে না। এমন একটা ‘ক্লজ’ বা ‘ধারা’ চুক্তিপত্রে আনার কারণটিও আমরা স্পষ্ট করেই ঈগলকে ব্যাখ্যা করেছিলাম। বলেছিলাম- তোমরা সত্য সাঁইয়ের কাছে আমাদের সমিতির সদস্যের সঙ্গে ঘুরে এসে স্পষ্ট বুঝে নিয়েছ, সত্য সাঁইয়ের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিভূতির বদলে রসগোল্লা আনার গপ্পোটা সত্যি হবার সম্ভাবনা কতখানি ! তোমরা গ্লোব ডিটেকটিভ সার্ভিসের বিস্তৃত রিপোর্ট পড়ে ট্রেন ভ্যানিসের সত্যতা বিষয়েই জেনে নিয়েছ। এরপরও তোমরা চুক্তি যখন চুক্তি ভঙ্গ করার সমস্ত রকম ঝুঁকি নিয়েও সরকারকে ফিল্মে নিচ্ছ, তখন আমাদের ভাবতেই হচ্ছে, তোমাদের সদিচ্ছায় ও সততায় কতটা বিশ্বাস করব? আগামী দিনে আমাদের ঘটানো ঘটনাগুলো দেখানর পাশাপাশি তোমরা যদি সরকারের মুখ থেকে ব্যাখ্যাগুলো প্রচার করতে থাক ! অথবা আমাদের অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া জনতার ঢলকে সরকারের বা বি. প্রেমানন্দের অনুষ্ঠানের দর্শক হিসেবে হাজির কর !

আমরা জানি, তোমরা সরকারের নেওয়া সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছ, তুমি কি কোনও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সাধু দেখছ? উত্তরে সরকার বলেছেন, না, আজ পর্যন্ত তেমন কোনও সাধুর দেখা তিনি পাননি।

মিস্টার ঈগল স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্ন করলে না- তুমি কি ঈশ্বর, ভূত, ভাগ্য ও অলৌকিকের অস্তিত্বে বিশ্বাস কর?

ঈগল বললেন, আসলে ওকে তো যুক্তিবাদী হিসেবে আমরা হাজির করছি না। হাজির করব জাদুকর হিসেবে। সাক্ষাৎকারটা এতটা ছোট ও অকিঞ্চিৎকর যে, সেখানে এই ধরনের প্রশ্ন আনা অবান্তর।

জানালাম, আমরা তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না, ঈগল। সরকারের এই উত্তরটুকু প্রচারিত হলে শ্রোতারা ভুল করে ভাববেনই সরকারও একজন প্রকৃত যুক্তিবাদী। তুমি বাস্তবিকই যদি সরকারকে জাদুকর হিসেবেই প্রজেক্ট করতে চাও, তাহলে এ প্রশ্ন তাকে করতে তো কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়?

ঈগল জানালেন, আসলে সরকারের জন্য এতই কম সময় রেখেছি যে, আবার এইসব প্রশ্ন ও উত্তর হাজির করতে দু’মিনিট চলে গেলে, ওর সাক্ষাৎকার প্রায় পুরোটাই বাদ চলে যাবে। এই বাস্তব অসুবিধের জন্যই আমি আর নতুন করে ওর সাক্ষাৎকার নিতে চাই না।

বললাম, বেশ তো, ওঁর এইসব প্রশ্নোত্তরের জন্য আমাদের থেকেই না হয় সময় কেটে নিও।

 

বি. বি. সি. যুক্তিবাদী সমিতির উপর তথ্যচিত্র তুলছে

না, বহু লক্ষ কথা চালাচালির পরও ঈগলকে দিয়ে চুক্তিপত্রে সেই করাতে পারলাম না। অতএব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম, তোমাদের সঙ্গে আমাদের এখানেই ইতি। কাল থেকে আমরা আর তোমাদের চিনি না।

ফিরে এসে মধ্যরাত পার করে দিয়েও আমরা ভীষণভাবে ব্যস্ত রইলাম আমাদের সমিতির আইনি উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল রাত পোহালে কলকাতা হাইকোর্টে মিস্টার ঈগলদের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের মামলা আনা হবে, এবং ওদের সমস্ত ক্যাসেট বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টার পাশাপাশি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওদের ভারত ত্যাগের প্রচেষ্টা রোখার চেষ্টা করা হবে।

মধ্যরাতের পরও আসতেই লাগল রবার্ট ঈগল ও আরও বহু বিশিষ্ট নাগরিকদের ফোন। রবার্ট কাল দুপুরে আবার আলোচনায় বসতে চান। জানিয়ে দিলাম- দুপুরে? খুব দেরি হয়ে যাবে। চুক্তিপত্রে ঈগলের আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও নীতিগত সততার বাইরে কোনও প্রশ্ন আমরা তুলিনি, অতএব সকালের মধ্যে ঈগল চুক্তিপত্রে সই না করলে আইন তার নিজের পথে এগুবে। শেষ পর্যন্ত রবার্ট ঈগল সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটালেন- চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলেন। সাক্ষী হিসেবে সই দিলেন অ্যানা।

চুক্তিমত আমরাই মুখোশধারী যুক্তিবাদীর প্রসঙ্গ টেনে এনে হাজির করলাম সরকার প্রসঙ্গ। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা ও সাক্ষাৎকার ক্যামেরার সামনে হাজির করে দেখিয়ে দিলাম- তিনি যুক্তিবাদী তো ননই, বরং ভূত-ভগবান-ভাগ্য-অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী কুসংস্কারে আগাপাশতলা ডুবে থাকা একটি মানুষ।

সৎ ও নিরপেক্ষতার প্রতীক B.B.C.-র প্রতিনিধি মিস্টার ঈগল দ্বিধাহীন ভাবে বার বার জানিয়েছিলেন, B.B.C.-র আইনজ্ঞদের মতামত ছাড়া তাঁর পক্ষে চুক্তিতে আসা অসম্ভব। তাহলে আইনজ্ঞের মতামত ছাড়া তিনি চুক্তিপত্রে সই করলেন কেন? এই গোটা ঘটনা কি এ’কথাই স্পষ্ট করে তোলে না, B.B.C.-র নিরপেক্ষতাও একটি ভান মাত্র? ওরাও প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলে, সত্য গোপন করে, সত্য বিকৃত করে, অনাদর্শকে আদর্শ বলে প্রচার করতে সচেষ্ট, সচেষ্ট তথ্য গোপনের সাহায্যে কুসংস্কারে ডুবে থাকা মানুষকেও যুক্তিবাদী বলে প্রজেক্ট করতে। কেন এই মিথ্যাচারিতা? কেন এত ষড়যন্ত্র। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা- একটু গভীরে ডুব দিলে দেখতে পাবেন, ওদের এত আয়োজন শুধু অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।

জানি, এই বই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার ঈগলের কাছে এই অংশটি অনুবাদ করে পাঠিয়ে দেবার মত বুদ্ধিজীবী এ বাংলায় কম নেই। জানি, পরিণতিতে আমাদের বিরুদ্ধে B.B.C-র মত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম নিরপেক্ষতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা নখ-দন্ত বিস্তার করতে পারে। কিন্তু তবু সবই লিখলাম। কারণ, বিশ্বাস করি জনগণই শেষ করা বলে।

এদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একচেটিয়া মিথ্যে ছাপাবার ও
সত্যকে ব্ল্যাক আউট করার স্বাধীনতা

এ’দেশের প্রতিটি বৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্র ও প্রতিটি অতি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক জাতীয় পত্র-পত্রিকাগুলোর পিছনেদ মূলধন হিসেবে খাটে কোটি কোটি টাকা। কোটিপতি পত্র-পত্রিকার মালিকদের কাছে ‘পত্রিকা-ব্যবসা’ আর পাঁচটা ব্যবসার মতই ব্যবসা। উৎপাদন কর, খদ্দের ধর, বিক্রি কর। আর পাঁচটা ব্যবসার মতই এখানেও- যত বেশি উৎপাদন, যত বেশি বিক্রি, তত বেশি লাভ। অন্যান্য ব্যবসায় বড় ভাবে পুঁজি নিয়োগ করার আগে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিল্পপতিরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা চালান। প্রাথমিকভাবে বুঝে নেন মার্কেটের অবস্থা। তারপরে নামেন উৎপাদনে। বৃহৎ পত্র-পত্রিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সম্ভাব্য পুঁজি বিনিয়োগকারী বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষা চালান। সমীক্ষকরা কয়েক মাসব্যাপী সমীক্ষা চালান নানাভাবে, যার একটা বড় অংশ জনমত যাচাই। তারপর তাঁরা রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে পত্রিকার চরিত্র কি কি ধরনের হলে সম্ভাব্য পাঠক কতটা হতে পারে, তার একটা হদিস দেওয়া হয়। এই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে পুঁজিপতি ঠিক করেন তার পত্রিকার চরিত্রের রূপরেখা, ঠিক করেন পেপার পলিসি। কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন সম্পাদক থেকে সাংবাদিক। এঁরা প্রত্যেকেই বুঝে নেন পত্রিকার চরিত্রের রূপরেখা, এই রূপরেখা ভাঙ্গার কোনও স্বাধীনতাই থাকে না সম্পাদক থেকে সাংবাদিক কারুরই। ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ বলে যে শব্দটি আমরা অহরহ শুনে থাকি, যে শব্দটি নিয়ে ফি-বছর গোটা কয়েক সেমিনার হয় দেশের বড়-মেজ শহরগুলোতে, সেই শব্দটি একটিই মাত্র অর্থ বহন করে ; আর তা হল সংবাদপত্র মালিকের পত্রিকা-চরিত্রকে বজায় রাখার স্বাধীনতা, যা খুশি লেখার স্বাধীনতা, এবং এই স্বাধীনতা নামের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে সব সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠিত ভাবে আঘাত হানার স্বাধীনতা।

সম্পাদক থেকে সাংবাদিকরা মালিকের কাছে ‘পেপার পলিসি’ মেনে লেখার ও তা প্রকাশ করার অলিখিত চুক্তির বিনিময়েই চাকরিতে ঢোকেন। পেপার পলিসিকে অমান্য করার মত ধৃষ্টতা কেউ দেখালে, পরের দিনই তার স্থান হবে পত্রিকা অফিসের পরিবর্তে রাস্তায়।

সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের এই সীমাবদ্ধতার কথা স্পষ্টভাবে না জানা থাকার দরুন এবং পত্রিকা চরিত্র গড়ে ওঠার কাহিনী অজানা থাকার কারণে পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে একটা বিপদজনক ধারণা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে- অমুক পত্রিকা প্রতিক্রিয়াশীল, ত্মুক পত্রিকা প্রগতিবাদী। ধারণাটা আগপাশতলা ভুল। সমস্ত বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর মালিকরাই এক একটি ধনকুবের, এবং সবারই মূল চরিত্র একই। সমাজ-কাঠামোতে আঘাত না দিয়ে আমি আপনি যত খুশি লম্ফ-ঝম্প দিতে পারি। চাই কি, তার জন্য প্রচারও পেতে পারি। কিন্তু ‘সিস্টেম’কে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করলে ওঁরা প্রত্যাঘাত হানবে সর্বশক্তি দিয়ে। আর প্রচার মাধ্যমের সে শক্তি এতই বিশাল যে সাধারণের কল্পনাতীত। জনগণকে প্রভাবিত করার এই বিশাল শক্তিই তাকে দিয়েছে সিস্টেম’-এর বনিয়াদের এক গুরুত্বপূর্ণ পিলারের ভূমিকা। প্রচার মাধ্যমের অকল্পনীয় শক্তির প্রসঙ্গে পরে আসব, আপাতত প্রসঙ্গে ফিরি।

বৃহৎ পত্রিকাগুলো তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের খদ্দের ধরতে বহিরঙ্গকে সাজায় নানাভাবে। এদের কেউ সি. পি. এম-এর প্রতি জনগণের ক্ষুব্ধতাকে পুঁজি করে খদ্দের ধরতে পত্রিকার চরিত্রকে খাড়া করে। কেউ বা সি. পি. এম-এর জনসমর্থনকে পুঁজি করে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করে। কেউ বা জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে এবং তারই সঙ্গে পরিচ্ছন্ন রাজনীতির ইমেজ বা সরকার-বিরোধী ইমেজ তৈরি করে কাগজের বিক্রি বাড়িয়ে চলে। এইসব পত্রিকাগুলোর সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের অবস্থান মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের ফুটবল টিমের কোচ ও খেলোয়াড়দের মতোই- যখন যে দলে খেলবেন, সেই দলকে জয়ী করতেই সচেষ্ট থাকেন। প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা বলে যাকে আপনি গাল পাড়েন, তারই অতিক্ষমতা সম্পন্ন দুঁদে বার্তাসম্পাদক কিংবা ঝান্টু সাংবাদিক আপনার মনে হওয়া প্রগতিবাদী পত্রিকায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার স্বার্থে কলম থেকে ঝরাতে থাকেন কলমও টিম পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবিপ্লবী কলম হয়ে ওঠে। এই জাতীয় উদাহরণ কিন্তু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত নয়, বরং সাবলীল গতিশীল। এইসব বিপ্লবী, প্রতিবাদী, প্রতিবিপ্লবী, বুর্জোয়া প্রভৃতি প্রতিটি বাণিজ্যিক পত্রিকার মালিকদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে-বিপজ্জনক কোনও শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ওরা দারুণ রকম এককাট্টা।

সংবাদপত্রগুলোর ভানের মুখোশটুকু সরালে দেখতে পাবেন, প্রতিটি সংবাদপত্রই বর্তমান সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে জনমতকে পরিচালিত করে এবং বহিরঙ্গা এরা সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের কিছু কিছু দুর্নীতির কথা ছেপে সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখার মূল ঝোঁককে আড়াল করে। এমন সব দুর্নীতির কথা ‘পাবলিক খায়’ বলেই পত্রিকাগুলো ছাপে। এই সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি যাদের হাতে, তারা জানে, এমন দু-চারটে দুর্নীতি ধরার লালিপপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে কি ভাবে অত্যাচারিতের ক্ষোভের আগুনে জল ঢালতে হয়। তারা জানে, সিস্টেমের প্রেসার কুকারে নিপীড়িতদের ফুটন্ত ক্ষোভকে বের করে দেওয়ার ‘সেফটি ভালভ’ হল মাঝে-মধ্যে দু-চার জনের দুর্নীতি ফাঁস। পরে অবশ্যই শাস্তি-টাস্তি না দিলেও ক্ষতি নেই। জনগণের স্মৃতি খুবই দুর্বল। ভুলে যাবে প্রতিটি ঘটনা, যেভাবে ভুলেছে বফর্স কেলেংকারি, শেয়ার কেলেংকারি। আর এর ফলে এক-আধটা রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ বা প্রশাসক যদি বধ হয়, তাতেও অবস্থা একটুও পাল্টাবে না। ফাঁকা জায়গা কোনও দিনই ফাঁকা থাকে না, থাকবে না। এক যায়, আর এক উঠে আসে।

আমার বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে একটা দৃষ্টান্ত বেছে নিতেই পারি। বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যের সময় শ্মশানে স্বপন নামের জনৈক রাজনৈতিক মস্তানের হাতে লাঞ্ছিত হন মন্ত্রী থেকে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার, বুদ্ধিজীবী থেকে প্রাক্তন সাংসদ পর্যন্ত ! পুলিশ স্বপনকে গ্রেপ্তার করলো। প্রচার মাধ্যমগুলোর হৈ-চৈ’ তে স্বপন বিরোধী একটা জনমত সৃষ্টি হল। স্বপনকে রাজনৈতিক নেতারাও বাঁচাতে পারলেন না। স্বপনের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল। সরকার এমন দৃষ্টান্তমূলক দৃঢ়তা দেখানোয় অনেকে তুষ্ট হলেন। যে-সব রাজনৈতিক ও পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা স্বপনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে কৃতার্থ হতেন, তাঁদের নাম প্রকাশ পাওয়ায় পত্রিকার এমন মহান ভূমিকায় অনেকেই উদ্বাহু বলেন, আমন্ত্রণ-গ্রহণকারীদের নামে ঢি-ঢি পড়ে গেল।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আপনারা এবার একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, কালীঘাট এলাকার মস্তান স্বপন ধ্বংস হল বটে, কিন্তু কালীঘাট মস্তানমুক্ত হল না। স্বপনের জায়গা নিল স্বপনের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক-মস্তান শ্রীধর।

স্বপন এক বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি ও প্রচারমাধ্যমগুলোর সামনে এমন অশালীন তান্ডব ও হামলা চালানোয় জনগণের মধ্যে যে তীব্র ক্ষুব্ধতা দেখা দিয়েছিল, সেই ক্ষুব্ধতার আগুনকে প্রশমিত করতেই স্বপনের স্রষ্টারা থেকে গিয়েছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

স্বপনের মতো হাজারো, লাখো সমাজবিরোধী তো একদিনে গজিয়ে ওঠেনি। রাজনীতির প্রয়োজনেই এদের সৃষ্টি। সৃষ্টির চেয়ে স্রষ্টা চিরকালই মহৎ। তাই স্বপনের স্রষ্টারা অন্তরালে থেকে এক স্বপ্ন গেলে আর এক স্বপন সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠে। স্বপনদের জায়গা কোনও দিনই ফাঁকা থাকে না। এক যায়, আর এক উঠে আসে।

আরও একটু তলিয়ে দেখুন, স্রষ্টা রাজনীতিকরা শেষ হয়ে গেলে সে জায়গা কখনো ফাঁকা থাকে না। যেমনভাবে স্বপনের সমর্থক রাজনৈতিক দলের জায়গা দখল করেছে স্বপনের বিরোধী রাজনীতিকরা-শ্রীধরকে দিয়ে। রাজীব গান্ধীর জায়গা দখল করেছেন রাজীবেরই দলের পিভি নরসিমা। রাজা যায়, রাজা আসে। আসন ফাঁকা থাকে না। আসন ফাঁকা থাকতে দেয় না আমাদের সমাজ কাঠামো, আমাদের ‘সিস্টেম’।

এইভাবে অসাম্যের সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দুর্নীতিগ্রস্থরা আসে এবং বিদায়ও নেয়, কিন্তু দুর্নীতি টিকেই থাকে। এই দুর্নীতির সূত্রেই বাঁধা পড়ে থাকে ‘সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তিগুলো।

কখনো কখনো বিশাল বাণিজ্য সম্রাজ্যের অধিকারীরা রাজনীতিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিজের ক্ষমতা রক্ষা ও বর্ধিত করতে পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হয়। এখানেও কিন্তু বাণিজ্য-সম্রাটের পক্ষে পত্রিকার বাণিজ্যিক সাফল্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। যে পত্রিকা বিক্রি হয় না, তাকে কোন রাজনীতিক পাত্তা দেবে?

যে-সব সাংবাদিক বা সংবাদপত্রকর্মী সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন, দুর্নীতির শিকল ভেঙ্গে সুসংস্কৃতির সমাজ গড়তে চান, তাঁদের পক্ষেও কলমকে হাতিয়ার করে পত্রিকাকে রণভূমি করা সম্ভব হয় না। কারণ পত্রিকায় ব্যক্তি ইচ্ছে বা ব্যক্তি আবেগের স্থান সীমাবদ্ধ। পত্রিকার পলিসির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই একজন সাংবাদিককে কলম চালাতে হয়। কোনও সাংবাদিকের পক্ষে একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ততক্ষণই সহযোগিতা করা সম্ভব যতক্ষণ না পেপার পলিসি ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে যায়।

পেপার পলিসি কাউকে ব্ল্যাক-আউট করতে চাইলে বা কারও বিপক্ষে গেলে তাকে পত্রিকার প্রচারে আনা বা তার পক্ষে লেখা কোনও সাংবাদিকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কিন্তু পত্রিকা মালিক যদি দেখেন কাউকে ব্ল্যাক-আউট করার ফলে অথবা কারও বিপক্ষে লেখার ফলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, পত্রিকা ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার মুখে, তখন ব্যবসার স্বার্থেই তাঁরা পলিসি পাল্টে ফেলেন, ডিগবাজি খান। এই ডিগবাজি খাওয়াটাও ততক্ষণই সম্ভব, যতক্ষণ না ওই ব্যক্তি বা সংস্থা পত্রিকা মালিকের অস্তিত্বের পক্ষে চূড়ান্ত সঙ্কট হিসেবে হাজির হচ্ছে।

বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকার বাস্তব কাঠামো বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, ভুল বোঝার অবকাশ বেশি থাকে। আর এই ভুলই বহু সৎ ও গতিশীল আন্দোলনে ধস নামাতে পারে। সত্যিকারের আন্দোলনের পাল থেকে জনসমর্থনের হাওয়া কেড়ে নিতে মেকি আন্দোলনকারী খাড়া করে তথাকথিত প্রগতিশীল পত্রিকা যখন ময়দানে নামে, তখন পত্রিকা-চরিত্র বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা বহু সমর্থককে, বহু আন্দোলন-কর্মীকে, বহু নেতাকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

বিভিন্ন প্রচার-মাধ্যম বা পত্র-পত্রিকা যেমন বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনের নেতৃত্বকে ‘পেপার পলিসি’র পক্ষে কাজে লাগায়, নিজস্ব ছাঁচের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ার পক্ষে কাজে লাগায়, তেমনই শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনের নেতৃত্ব বা আন্দোলনের নেতৃত্ব কেন পারবে না পত্র-পত্রিকা ও প্রচার-মাধ্যমগুলোকে যতদূর সম্ভব কাজে লাগাতে? কাজে লাগানো সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্লোভ ও লক্ষ্য সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব চেষ্টা করলে দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ না করে, প্রচার-মাধ্যম দ্বারা ব্যবহৃত না হয়ে প্রচার-মাধ্যমকেই ব্যবহার করতে পারেন।

যে পত্রিকার পাঠক সংখ্যা যত বেশি, জনগণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও তার তত বেশি।

বাংলা ভাষার সবচেয়ে
জনপ্রিয় পত্রিকার দিকে একটু সচেতনতার
সঙ্গে ফিরে তাকান, দেখতে পাবেন ওই পত্রিকা
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে মানুষের মাথায় ঢোকাতে
চায়, সমাজের সেরা লেখক, সেরা শিল্পী, সেরা বুদ্ধিজীবীরা
তাঁদের পত্রিকায় লেখেন, আঁকেন। ফলে ওই পত্রিকায় স্থান পাওয়া,
জনগণের কাছে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়।
এর পর ওরা ইচ্ছে মতন একজনকে প্রচারের
তুঙ্গে তুলে নিয়ে যান, একজনকে ব্ল্যাক
আউট করে জনগণ থেকে নির্বাসিত
করেন। জনপ্রিয় সব পত্রিকাই
কম-বেশি একই মানসিকতার
দ্বারা পরিচালিত হয়।

আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনের দিকে আপনাদের দৃষ্টিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। “কোনও সমকালীন বিখ্যাত লেখকের নাম মনে করতে পারেন যিনি দেশ শারদীয় সংখ্যায় লেখেন নি?” (২৮ আগস্ট ৯০, আনন্দবাজার পত্রিকা)

এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গর্বিত ঘোষণা স্পষ্ট- যারা দেশ শারদীয় সংখ্যায় লেখার সুযোগ বা সম্মান পাননি, তাঁরা কেউই প্রকৃত অর্থে লেখকই নন।

জানি না, আনন্দবাজার গোষ্ঠী (‘দেশ’ পত্রিকা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সাহিত্য পত্রিকা, যা একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কাছে, সাহিত্যের শেষ কথা বলার পত্রিকা) অমিয়ভূষণ মজুম্দারের নাম শুনেছেন কি না- যিনি মননশীল পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সাহিত্যিক হিসেবে অগ্রগণ্য। শারদীয় দেশ কি আজ পর্যন্ত অমিয়ভূষণের লেখা ছাপাবার সম্মান ও যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন? বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মন, তপোবিজয় ঘোষ কোনও দিনই আনন্দবাজার গোষ্ঠীর পত্রিকায় না লিখেও বাংলা সাহিত্যে তাঁদের অবদানের জন্য সমজদার পাঠক- পাঠিকাদের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন। যতদূর মনে পড়ছে মিহির আচার্য, দেবেশ রায়, উদয়ন ঘোষ শারদীয় ‘দেশ’-এ কোনদিন লেখেননি। যে কমলকুমার মজুমদারকে আজ আনন্দবাজার গোষ্ঠী নিজেদের ‘আপনজন’ হিসেবে প্রচার করতে অতিমাত্রায় সচেষ্ট, সেই কমলকুমারও ‘দেশ’ শারদীয়ের লেখক ছিলেন না। কিন্তু এই ধরনের গর্বিত বিজ্ঞাপনও সরলমতি পাঠক-পাঠিকাদের মাথা খায়। অবশ্য মাথা খাবার জন্যই এমন বিজ্ঞাপনের সৃষ্টি। একথা বলার জন্যই আমি উদাহরণগুলো টানলাম যে, ‘দেশ’-শারদীয়’তে না লিখেও এঁরা লেখক হিসেবে খ্যাতির অধিকারী।

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কি তবে কোনও স্বাধীনতা নেই? ক্ষমতা নেই? নিশ্চয়ই আছে। ওদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা আছে, পেপার পলিসির সঙ্গে সংঘর্ষে না নামা কাউকে প্রচার দেওয়া, বা বিশেষ কোন সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, আইনি অধিকার বা বে-আইনি সুবিধে আদায়ে সহযোগিতা করা, অপছন্দের মানুষ বা সংস্থাকে কিঞ্চিৎ টাইট দেওয়া। এবং স্বভাবতই এই ক্ষমতা একটু বেশি পরিমাণেই থাকে সম্পাদকের ও তাঁর প্রিয় সাংবাদিকদের। অনেক সময় ওদের কৃপায় অনেক ‘না’ ‘হ্যাঁ’ হয়ে যায়, অনেক ‘মিথ্যে’ হয়ে ওঠে ‘সত্যি’, অনেক জোনাকি মিথ্যে প্রচারের আলোতে নক্ষত্র হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে কিংবদন্তি।

এই বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে একটা দৃষ্টান্ত বেছে নিতেই পারি।

স্বাধীনতার নামে হলদে সাংবাদিকতা ও প্রতারণার এক অন্যন্য নজির ‘ট্রেন ভ্যানিশ’

আপনারা প্রায় প্রত্যেকেই শুনেছেন জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর যাত্রী বোঝাই অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশের কথা। জেনেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ে, অথবা অন্য কারও মুখ থেকে। ঘটনাটা দেখেছেনও অনেকে, দূরদর্শনের পর্দায়। কিন্তু অল্পজন জেনেছেন, এই ট্রেন ভ্যানিশের প্রচারটা ছিল চূড়ান্ত মিথ্যাচারিতা, ইয়লো-জার্নালিজিমের এক ক্লাসিক প্যাটার্ন।

যাত্রী বোঝাই গোটা একটা অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশের সুবাদে সরকার আজ কিংবদন্তি-মানুষ। কিন্তু ওই জাদুর খেলায় না ছিল অমৃতসর এক্সপ্রেস, না হয়েছিল ভ্যানিশ। আসলে আদপেই ওটা ম্যাজিক ছিল না। কারণ, ম্যাজিকটা কেউই দেখেননি। দেখানো হয়নি বলেই দেখেননি। দূরদর্শনে ট্রেন ভ্যানিশের দর্শক হিসেবে যে গ্রামবাসীদের দেখা গিয়েছিল, তাঁদের বলা হয়েছিল- সিনেমার শ্যুটিং হবে। ওঁরা শ্যুটিং দেখার দর্শক হতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছিলেন। কারণ, ওঁদের একজনও অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশ হতে দেখেননি। অথচ ওঁদের যাত্রীবোঝাই ট্রেন ভ্যানিশের দর্শক হিসেবে দূরদর্শনের পর্দায় হাজির করা হয়েছিল। কোনও বিশিষ্ট দর্শকও সেদিন প্যাসেঞ্জার ঠাসা অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশ হতে দেখেননি। কারণ অমৃত এক্সপ্রেসও ছিল না, ভ্যানিশও হয়নি। দূরদর্শনের পর্দায় যা দেখানো হয়েছিল সেটা ছিল দর্শকদের প্রতারিত করার এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।

এটা জাদুর ক্ষেত্রেও এক ঐতিহাসিক অনৈতিক ঘটনা। যে জাদু কেউ দেখল না, যে জাদু কেউ দেখাল না, সে জাদু দেখানো হয়েছে বলে প্রচার করাটা একটা বড় মাপের সংগঠিত প্রতারণার দৃষ্টান্ত বই কিছু নয়।

এসব শোনার পরও আমার পরিচিত এক সাংবাদিক বলেছিলেন, “জাদুর ব্যাপারটাই তো কৌশল”। বলেছিলাম, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই কৌশল, কিন্তু তারও একটা নির্দিষ্ট নীতি আছে। জাদুকর যখন দেখান একটা মানুষ শূন্যে ভাসছে, তখন তা দেখানোর পিছনে যে কৌশলই থাকুক, দর্শকরা কিন্তু তাদের চোখের সামনে দেখতে পায়, একজন আমাদের সামনে একটা মানুষকে শূন্যে ভাসালেন। ট্রেন ভ্যানিশের ঘটনার যে প্রচার হয়েছে, সেখানে কোনও দর্শকই যখন ট্রেন ভ্যানিশ হতেই দেখলেন না, তখন এটাকে শুধু জাদুর নীতি মতই নয়, কোনও নীতিতেই ‘দেখানো হয়েছে’ বলে প্রচার করা যায় না।“

“আবার দেখুন, দেখা এবং দেখানরও একটা নীতি আছে। যে খানা জংশনের কাছে তথাকথিত জাদুটি দেখানো হয়েছিল, সেখানকার অবস্থানগত কারণে প্রতিটি ট্রেনই ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়ার কারণে এক সময় দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। কেউ কোনও ফেস্টুন দিয়ে আড়াল করে ট্রেনকে চলে যেতে দিলে যদি সেটা ট্রেন ভ্যানিশ হয়েছে বলে বিবেচিত হয়, তাহলে আগামী যে কোনও দিন একই পদ্ধতিতে শিয়ালদা স্টেশনে আপনার চোখের সামনে দশ ঘণ্টায় শ’খানেক ট্রেন ভ্যানিশ করে দেখাতে পারি। আর সে জন্য আমাকে এমন কিছু করতে হবে না, একটা করে ট্রেন ছাড়বে, আপনার দৃষ্টির সামনে মেলে ধরব একটা রুমাল। মিনিট খানেকের মধ্যেই বাঁক নিয়ে ট্রেনগুলো দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে থাকবে, আর আপনি ভ্যানিশ হওয়া ট্রেনের সংখ্যা গুনতে থাকবেন, পরের দিন আপনার কাগজের প্রথম পাতায় খবরটা ছাপাবেন বলে।“ সব শুনে সাংবাদিক বন্ধুটি বললেন, “ও এই ব্যাপার ! কিন্তু এই করেও তো উনি দিব্বি কিংবদন্তি বনে গেলেন।“

হ্যাঁ কিংবদন্তি বনে গেলেন, সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যাচারিতাতেই বনে গেলেন। আসল ঘটনা কি? আসুন সেদিকে আমরা ফিরে তাকাই।

সে-দিন ট্রেন ভ্যানিশ হতেও কেউ দেখেননি। কোনও আমন্ত্রিত বিশিষ্ট দর্শকও অমৃতসর এক্সপ্রেসকে যাত্রী-সহ ভ্যানিশ হতে দেখেননি। তবু এই না দেখা, না ঘটা ঘটনার খবরই প্রকাশিত হল। ১২ জুলাই, ১৯৯২। খবরের সঙ্গে দূরদর্শন দেখাল সেই না ঘটা ঘটনার ছবি। পরের দিন একটিমাত্র পত্রিকা ‘আনন্দবাজার’- এ প্রকাশিত হল খবরটি। তারপর সরকার খবর থেকে কিংবদন্তি।

ঘটনাটা খুব সাদামাটা। সরকার ইস্টার্ন রেলের কাছ থেকে ভাড়া করেছিলেন একটা ইঞ্জিন ও ছ’টা কোচ। ইঞ্জিনটা ডিজেল চালিত, ইঞ্জিনের নম্বর l/405। ছ’টা কোচের পাঁচটা সাধারণ, একTA.C.। ইঞ্জিন এলো আন্দুল লোকেশেড থেকে। ছ’টা কোচ নিয়ে নকল ‘অমৃতসর এক্সপ্রেস’ এসে দাঁড়াল খানা জংশনের অনতিদূরে, খানা লিংক কেবিনের কাছে। ড্রাইভার ছিলেন অনিলবরণ দত্ত। কোনও গার্ড বা টিকিটচেকার ছিলেন না। দর্শকরা জানতেন, ওই ছ’কোচের ট্রেনটি অমৃতসর এক্সপ্রেস’ নয়, শ্যূটিং-এর জন্য ভাড়া করা। ট্রেনে যারা যাত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তাঁরা সরকারের কর্মী ও রেল কর্মী। দর্শকদের বসানো হয়েছিল নিচু খেতে ও তার কাছাকাছি। কোচ নিয়ে ইঞ্জিন যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে চার জোড়া লাইন চলে গেছে। চার জোড়ার দু’জোড়া লাইন হঠাৎ গেছে নেমে। এই লাইন দিয়ে ট্রেন একটু এগুলোই উঁচু মাটির আড়ালে চলে যায়।

ওই অনুষ্ঠান দেখতে একটি মাত্র পত্রিকার সাংবাদিক আমন্ত্রিত হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি হলেন, আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। ভিডিও রেকর্ডিং-এর জন্য উপস্থিত ছিলেন দূরদর্শনের সংবাদ পাঠিকা ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য। ইন্দ্রাণী শঙ্করলালের জীবনসঙ্গিনীও।

ট্রেন চলার পূর্ব মুহূর্তে ট্রেনকে আড়াল করতে তুলে ধরা হল ব্যানার। দর্শকদের সামনে ব্যানার, কানে জেনারেটরের বিশাল শব্দ। সঙ্গে বাজি-পটকার ঘন-ঘন শব্দ ও ঘন ধোঁয়া। ছবি রেকর্ডিং-এর দায়িত্বে ছিলেন ইন্দ্রাণী। ইশারা পেয়ে ইঞ্জিন চালু করলেন অনিলবরণ। নিচে নেমে যাওয়া লাইন ধরে এগুলো তাঁর ট্রেন। রেকর্ডিং-এ ট্রেনের আওয়াজ যাতে ধরা না পড়ে তারই জন্য জেনারেটরটাকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। উত্তেজনাহীনভাবে ট্রেনটি দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই ব্যানার সরিয়ে দেওয়া হল। শেষে হল ‘ট্রেন ভ্যানিশ’-এর খেলা।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। ট্রেন ভ্যানিশের নেপথ্য দুর্নীতি জানাতে গিয়ে আমাদের সমিতি-সহ বহু বিশিষ্ট ও শ্রদ্ধেয় জাদুকরদের অভিজ্ঞতাই খুব তিক্ত। বহু সংবাদপত্রের সাংবাদিকরাই আমাদের ও জাদুকরদের কাছ থেকে সব কিছু শুনেছেন, জেনেছেন, তথ্য প্রমাণ নিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খবরটির উপর প্রতিবারই নেমে এসেছে ব্ল্যাক-আউটের থাবা। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় ‘যুক্তিবাদী’ ও ‘কিশোর যুক্তিবাদী’ পত্রিকায় ট্রেন ভ্যানিশ নামক শতাব্দীর সেরা সাংস্কৃতিক দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছি। কলকাতার অতি শ্রদ্ধেয় জাদু ও সরঞ্জামের নির্মাতা ও পরিবেশক শ্যাম দালাল লিখেছেন একটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত জাদু পত্রিকায়, লিখেছেন বিশিষ্ট জাদুকর সুবীর সরকার ও ভারতের অসাধারণ জাদুশিল্পী কে. লাল। কিন্তু এসব লেখা বৃহৎ পত্রিকায় প্রকাশিত না হওয়ায়, প্রতারক হিসেবে যার ঘৃণা কুড়োবার কথা, তিনি কুড়িয়েছেন কিংবদন্তির সম্মান।

‘সানন্দা’ একটি জনপ্রিয় পাক্ষিক। প্রকাশ করেন আনন্দবাজার গ্রুপ। সান্দনা’র ৫ আগস্ট ১৯৯৪ সংখ্যায় চিঠিপত্তর বিভাগে ট্রেন-ভ্যানিশের নেপথ্য-কাহিনী দু-চার লাইনে লেখার একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রকাশিত চিঠিটির তলায় লেখা ছিলঃ “চিঠিটির উত্তর দিচ্ছেন পি. সি. সরকার, আগামী সংখ্যায়”। পত্রিকার তরফ থকে এই ধরনের ঘোষণা, অবশ্যই ব্যতিক্রম।

যাই হোক, ১৯ আগস্ট ৯৪ সংখ্যার সান্দদায় সরকারের উত্তর প্রকাশিত হল। সরকার লিখলেন, “ট্রেন ভ্যানিশের ম্যাজিকটা আমি একটা বিশেষ এবং বিশাল কমিটির সামনে দেখিয়ছলাম…”

সেই কমিটির এক নম্বর নাম হিসেবে সরকার যার উল্লেখ করেছিলেন, তিনি হলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত ভি. আই. পি’দের তালিকায় ছিলেন, “সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউ. এন. আই, এ-পি’র প্রতিনিধি। ছিলেন আনন্দবাজার গ্রুপ, আজকাল, গণশক্তি, ওভারল্যান্ড পত্রিকার সাংবাদিক ও প্রতিনিধি। দূরদর্শনের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডাইরেক্টর-সহ ছিলন দূরদর্শনের সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানদের বিরাট টিম তো বটেই…” “আপামর জনসাধারণকে দেখাবার জন্য দূরদর্শন নিউজ কভার করেছে।“ “কুচুটে মনোবৃত্তির লোকেরা যত কুৎসাই রটাক না কেন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের ইজ্জত বেড়েছে।“

উত্তর পাঠিয়েছি ‘সান্দনা’র দপ্তরে, কলকাতা জেনারেল পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে। পাঠাবার তারিখঃ ৮.১০.১৯৯৪। রেজিস্ট্রেশন নম্বর জি-৩৩৪৪। ওঁরা যে চিঠি পেয়েছেন, তার প্রাপ্তিস্বীকারের কার্ডও পেয়ে গেদছি। এই প্রসঙ্গে সান্দনার সম্পাদকীয় দপ্তরের সঙ্গে কথাও হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৪ পেরিয়ে এখন ১৯৯৫ জানুয়ারি। এখন পর্যন্ত সানন্দা আমার চিঠিটি প্রকাশ করেননি। চিঠিটিতে লিখেছিলামঃ

“কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মাননীয় মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায় ৩ সেপ্টেম্বর ৯৮ প্রকাশ্য সভায় দ্বিধাহীন জানালেন- পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর ট্রেন ভ্যানিশের আমি একজন দর্শক ছিলাম। সেদিন অমৃতসর এক্সপ্রেসকে ভ্যানিশ করা হয়নি। একটা ইঞ্জিন ও কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট ভাড়া করে আনা হয়েছিল, সেগুলো রেললাইন ধরেই চলে গিয়েছিল। দূরদর্শনের তরফে ছবি তুলেছিলেন ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য। পি. সি. সরকার (জুনিয়র) এ বিষয়ে আমাকে মুখ না খুলতে অনুরোধ করেছিলেন।

সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের ৮ নম্বর কোর্টে, দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত। সভার শিরোনাম ছিল ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’। ব্যবস্থাপকঃ হাইকোর্ট লেডিজ ওয়েলফেয়ার কমিটি। সহযোগিতায় হাইকোর্ট কর্মচারী সমিতি। সভার প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায়। মূল বক্তা প্রবীর ঘোষ। হল উপচে পড়া ভিড়ে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার শ্রী পি. কে. সেন, ডেপুটি রেজিস্ট্রার শ্রীনিরোধবরণ হালদার, স্টেট কোঅর্ডিনেশন কমিটির প্রেসিডেন্ট শ্রীচুনিলাল চক্রবর্তী, কলকাতা হাইকোর্ট এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের এক্সজিকিউটিভ কমিটির সদস্যবৃন্দ।

৮মে ৯৪ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দাবিসহ দূরদর্শনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ডেপুটেশন দিয়েছিলেন কলকাতা দূরদর্শনের ডিরেক্টর শ্রীঅরুণ বিশ্বাসের কাছে। তাতে দুর্নীতির একটি অভিযোগ ছিল ‘ট্রেন ভ্যানিশ’ দেখিয়ে কলকাতা দূরদর্শন ১২ জুলাই ৯৪ যে সংবাদ প্রচার করেছিল, সেই ট্রেন আদৌ কোনও কৌশলেই ভ্যানিশ করা হয়নি। গোটাটাই করা হয়েছিল ক্যামেরার কৌশলে। এমন একটি মিথ্যে খবর প্রচার করে একদিকে একজনকে রাতারাতি কিংবদন্তি বানানো হয়েছে। অন্যদিকে কোটি কোটি দর্শককে প্রতারিত করা হয়েছে।

ডিরেক্টর শ্রীবিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার দায়িত্ব অর্পণ করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর শ্রীঅমলেন্দু সিনহার ওপর।

শ্রীসিনহা তদন্ত রিপোর্টে জানান, দূরদর্শন কেন্দ্রের কোনও কর্মী বা টিম জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর অমৃতসর এক্সপ্রেসের ছবি তুলতে যাননি। খবরে যে ছবিটি দেখানো হয়েছিল তা তুলে এনেছিলেন শ্রীমতী ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য। শ্রীসিনহা আরও জানান, শ্রীমতী ভট্টাচার্য দূরদর্শন কেন্দ্রের কর্মী নন। ক্যাজুয়াল কর্মী হিসবে মাঝে-মধ্যে তিনি খবরে পড়ে থাকেন মাত্র।

‘অল ইন্ডিয়া ম্যাজিক সোসাইটি’ –এর সভাপতি ভারতবর্ষের বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা গ্লোব-ডিটেকটিভ সার্ভিসেসকে দিয়ে এ ব্যাপারে একটি তদন্ত করান। ওই সংস্থার ডিরেক্টরের স্বাক্ষর-সম্বলিত (রেফারেন্স নং- জি ডি এস/২৫৪০/৯২, তারিখ ১৮/৮/৯২) দীর্ঘ তদন্ত রিপোর্টে দ্বিধাহীনভাবে জানানো হয়েছেঃ

(১) অমৃতসর এক্সপ্রেস আদৌ ভ্যানিশ করা হয়নি। (২) তথাকথিত ট্রেন ভ্যানিশের জন্য একটি বিশেষ ট্রেন ভাড়া করা হয়েছিল, যার ডিজেল ইঞ্জিন নং- ১/৪০৫। ড্রাইভারের নাম অনিলবরণ দত্ত। (৩) গ্রামবাসীদের বলা হয়েছিল সিনেমার স্যুটিং হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের ট্রেন ভ্যানিশের দর্শক হিসেবে দেখিয়ে প্রতারিত করা হয়েছে। (৪) ভাড়া করা ট্রেনটি লুপ লাইন দিয়ে তার নিজের মতোই চলে গেছে। (৫) ম্যাজিকের নামে ট্রেন ভ্যানিশের ঘটনাটি ছিল নিছকই একটি ক্যামেরা ট্রিক। (৬) আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপ ছাড়া আর কোনও পত্রিকা প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দু’জন-একজন আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠীর সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য এবং অপরজন দূরদর্শনের ক্যাজুয়াল নিউজ রিডার শ্রীমতী ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য যিনি শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের স্ত্রী। প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে ‘গ্লোব ডিটেকটিভ সার্ভিসেস-এর তদন্ত রিপোর্টের জেরক্স কপি পাঠালাম। প্রয়োজনে আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দিতে পারব, আর কোনও পত্রিকাগোষ্ঠীই যায়নি; এবং মাননীয় বিচারপতি মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায় ও দূরদর্শনের ডিরেক্টর প্রসঙ্গে যে বক্তব্য রেখেছি তাও কাঁটায় কাঁটায় সত্যি।

সানন্দার মতো জনপ্রিয় পত্রিকায় জাদুকর জুনিয়র সরকারের এই চূড়ান্ত মিথ্যাচারিতার নিদর্শন প্রকাশিত হওয়ায় আমার ও আমাদের সমিতির সম্মান ও মর্যাদা বিশালভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। যতদিন না এই চিঠির মাধ্যমে সত্য প্রকাশিত হচ্ছে, ততদিন এই মিথ্যে কলঙ্কের বোঝা আমাকে এবং আমাদের সমিতিকে বয়ে বেড়াতে হবে। যুক্তিবাদী আন্দোলনের ওপর এই ষড়যন্ত্রমূলক আঘাত ইতিহাস কোনও দিনই ক্ষমা করবে না, ক্ষমা করবে না ‘মিথ’ হতে শ্রীসরকারের মিথ্যাচারিতাকে। বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠি প্রকাশ করুন- অনুরোধ।“

চিঠির সঙ্গে গ্লোব ডিটেকটিভ সার্ভিসেস’ –এর তদন্তের সম্পূর্ণ প্রতিলিপিও পাঠিয়েছিলাম।

কিন্তু তারপর? প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, একবার ভাবুন, ১৯৯২-এর ১২ জুলাই কি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র) ? সংস্কৃতির জগতে দুর্নীতির ইতিহাস? প্রচার- মাধ্যমের অকুন্ঠ সহায়তায় ও মিথ্যাচারিতায় প্রতারকের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার ইতিহাস? নাকি প্রচার মাধ্যমের হলদে সাংবাদিকতার অনন্য নজির স্থাপনের ইতিহাস? ভারতের ইজ্জত কেমনভাবে বেড়েছে? হর্ষদ মেহেতা, দাউদ ইব্রাহিমের দুর্নীতির পাশাপাশি আরও একটি নাম উচ্চারিত হওয়ার সুবাদে ইজ্জত বেড়েছে?

আরও একটি প্রবল ক্ষমতা সংবাদ মাধ্যমগুলোর কর্তাব্যক্তিদের আছে। আর তা হল, কাউকে ‘ব্ল্যাক আউট’ করার ক্ষমতা। সরকার ও একাধিক প্রচার মাধ্যমের বোঝাপড়ায় যে ‘মিথ্যে’ ‘সত্যি’ হয়ে গেল, তাকে ‘চিরন্তন সত্যি’ করে রাখতে আমাদের প্রতিবাদকে ‘ব্ল্যাক-আউট’ করা তো একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। আমাদের সমিতি যে কতবার এমন অনৈতিক ক্ষমতার শিকার হয়েছে এবং হয়েই চলেছে, তার পুরো হিসেব রাখতে কম্পিউটারের প্রয়োজন হয়ে পড়বে।

সংবাদ মাধ্যমগুলো বাস্তবিকই পারে ‘জোনাকি’কে ‘নক্ষত্র’ বানাতে, সত্যের সূর্য ঢাকতে পারে ‘ব্ল্যাক-আউট’ –এর মেঘে। এই দুই ক্ষমতাই ‘নামী’ হতে চাওয়া, ‘জনপ্রিয়’ হতে চাওয়া, ‘দামি’ হতে চাওয়া, ‘পুরস্কৃত’ হতে চাওয়া, ‘সম্মানিত’ হতে চাওয়া বুদ্ধিজীবীদের (যাদের মধ্যে সাধারণভাবে ফেলা হয় সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী, চিত্রকর, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী, শিক্ষাবিদ, চলচিত্র পরিচালক-সহ অধুনা ক্রিড়াবিদদের পর্যন্ত) সংবাদ মাধ্যমগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসে। ‘নামী’, ‘দামি’ হওয়ার একটা পর্যায় অতিক্রম করে আরও ‘নামী’ ‘দামী’ হতে গেলে সাধারণভাবে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে আপোষ করা প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বুদ্ধিজীবীদের এই আপোষকামিতাকে, কৃপাপ্রার্থী মানসিকতাকে শেষ পর্যন্ত কাজে লাগায় প্রচার মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রক শক্তি ধনকুবের পুঁজিপতিরাই।

নিরপেক্ষতা’র মোড়কের আড়ালে লুকোন শোষকশ্রেণীর মূল্যবোধ

ধনকুবেরের দল চায়, বঞ্চিত মানুষরা যেন বঞ্চনার কারণ হিসেবে বঞ্চনাকারী ধনকুবেরদের দায়ী না করে দায়ী করে নিজেদেরই ভাগ্যকে, পূর্বজন্মের কর্মফলকে, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রকে, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়াকে। বঞ্চনাকারীরা, শোষণকারীরা জানে, দেশের সিংহভাগ বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষ তাঁদের বঞ্চনার প্রকৃত কারণ হিসেবে ধনকুবের গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করলে তারই পরবর্তী পর্যায়ে এক সময় পায়ের নীচের মানুষগুলোই ধনিকগোষ্ঠীর পায়ের তলার জমি কেড়ে নেবেই। শোষকরা এও জানে, শোষিতদের ঘুম ভাঙ্গলে, তারা শোষণের কারণগুলোকে উৎপাটিত করতে লড়াইয়ে নামলে সে লড়াই জেতার মত পুলিশ ও সেনা শোষকদের হাতে নেই। দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টি বিক্ষুব্ধ হলে, বিদ্রোহ বা বিপ্লবের পথে পা বাড়ালে পৃথিবীর কোনও শক্তিশালী সেনা বাহিনীরও সাধ্য হয়নি, সে লড়াই জেতার-ইতিহাস বার বার এই সত্য আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছে। এই সত্যই সমাজের অর্থনৈতিক নীতি ও আর্থিক কাঠামোর নিয়ন্তা ধনিকগোষ্ঠীর কাছে মগজ ধোলাইয়ের প্রয়োজনীয়তাকে অনিবার্য করে তুলেছে। এই প্রয়োজনই ধনিককুলের কাছাকাছি এনেছে প্রচার মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের। আর তারই ফলস্বরূপ প্রচার মাধ্যমগুলোর সংবাদ সরবরাহের ‘নিরপেক্ষ’ মোড়কের আড়ালে থাকে শোষকশ্রেণীর পক্ষে প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ ও মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে সাধারণ মগজে ঢুকিয়ে দেবার দৃঢ় প্রচেষ্টা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে নানা রঙ্গে, ননা ঢঙ্গে, বিভিন্ন বৈচিত্র্যে তাদের বহিরঙ্গকে সাজালেও, মূলগত ভাবে এরা প্রত্যেকেই বর্তমান অসাম্যের সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থার দিকেই ঝুঁকে থাকে। কেউ অসাম্যের সমাজ কাঠামো পাল্টে সাম্যের সমাজ কাঠামো তৈরির পক্ষে মূল্যবোধ ও মতাদর্শ প্রচারের জন্য বৃহৎ পত্র-পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হলে (এখানে তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিলাম, কোটি-কোটি টাকার পুঁজি বিনিয়োগকারী উদ্যোগী মানুষটি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজ্য-পাট বঞ্চিতদের হাতে তুলে দিয়ে পথে এসে দাঁড়াবেন) সেই পত্রিকাকে কোণঠাসা করে লাটে তুলে দেবে এই সমাজ ব্যবস্থাই। আমরা তো দেখেছি, ইন্দিরা গান্ধীর জমানার বিরুদ্ধে সমালোচনার জন্য বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর মালিকের বাড়িতে এ’বেলা- ও’বেলা, পুলিশ, কাস্টমস, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরদের ‘রেড’। আমরা দেখেছি, সাংবাদিকদের নানা অজুহাতে কারাগারে নিক্ষেপ। আমরা দেখেছি, নিউজপ্রিন্টের কোটা ও সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া ও না দেওয়ার চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা। এ’সব তো এক শাসকের বিরোধীতা করার ফল, গোটা সমাজ-কাঠামোর বিরোধীতার ফল অবশ্যই এর চেয়ে বহুগুণ ব্যাপক। কারণ তখন আপনার শত্রু শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নয়, শত্রু সমগ্র ধনী সম্প্রদায়, বর্তমান সমাজ কাঠামোর ক্ষমতার মধুভোগী প্রতিটি রাজনৈতিক দল, ধনিককুলের কুক্ষিগত প্রচার-মাধ্যমগুলো ও বুদ্ধিজীবীরা, প্রশাসন-পুলিশ-প্রত্যেকেই।

প্রচার মাধ্যমগুলো বর্তমান সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই ভোগবাদ ও অধ্যাত্মবাদের পক্ষে নানা ভাবে মগজ ধোলাই করে, শোষিত শ্রেণীকে এক কাট্টা হতে না দেওয়ার প্রশ্নাতীত প্রয়োজনে মানুষে মানুষ বিভাজন সৃষ্টি করে নানা ভাবে। এ’দেশের মানুষ যে আজ ধর্মের ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে, প্রদেশের ভিত্তিতে, জাত-পাতের ভিত্তিতে বিভক্ত, তা তো এমনি এমনি হয়নি। সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলেই এমনটা হয়েছে। আর, সমাজে সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলতে প্রচার-মাধ্যমগুলোর ভূমিকা অবশ্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রচার-মাধ্যমের হাত ধরে মানুষকে আরও একটি ভাগে বিভাজিত করার চেষ্টা এবং একটি সঠিক আন্দোলনকে চেপে দিয়ে মেকি আন্দোলনকে তুলে আনার প্রয়াসের একটি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ এই প্রসঙ্গে আপনাদের সামনে পেশ করছি।

বিপন্নবোধেই প্রথা ভেঙ্গে ‘মানবতাবাদী নারীবাদ’-এর
উপর আনন্দবাজারী আক্রমণ

গত কয়েক বছরে দেখলাম ‘নারীবাদ’, ‘নারীমুক্তি’, ‘নারী-স্বাধীনতা’ ইত্যাদি নামে পুরুষশাসনের মূলোচ্ছেদের দিশা দেখানোর পরিবর্তে মানুষকে আরও একটি নতুন ভাগে ভাগ করার কাজে নামতে একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীকে। নতুন ভাগটি হল- ‘নারী’, ও ‘পুরুষ’। তৎপর পত্রিকাগোষ্ঠী তার সহযোগী বিদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে তাদের ‘নারীবাদী’ ও ‘প্রতিবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত  করে লাগাতার  প্রচার নেমেছে। পত্রিকাগোষ্ঠীর বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে নাচন-কোঁদন করে জনগণকে বোঝাতে চেয়েছেন ‘নারীবাদী হো তো এ্যাইসা’। পত্রিকাগোষ্ঠীর চাওয়াকে হাতের মুঠোয় পাইয়ে দিতে তৎপর বুদ্ধিজীবীরা পুরুষ শাসনের বিরোধিতার নামে পুরুষের বিরুদ্ধেনারীর ঘৃণাকে সৃষ্টি করতে ও তীব্র করতে তৎপর হয়েছে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পত্রিকাগোষ্ঠীর এই বিভাজন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা যখন অশ্বমেধের ঘোড়া, তখন তার গতিরোধ করে অসাম্যের মূল্যবোধ ভাঙতে সুচেতনার দখিনা হাওয়ায় মেঘ ওড়াবার লড়াই করতেই হাজির হল ‘যুক্তিবাদের চোখে নারী ‘মুক্তি’ নামের বইটি। যুক্তিবাদের উপর ভিত্তি করে নতুন এক নারীবাদ ‘মানবতাবাদী নারীবাদ’-এর রূপরেখা এই বইটিতে স্পষ্টতর হতেই অশ্বমেধের ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়ল।

কিন্তু, এ যেন- ‘মরিয়া না মরে রাম’। শেষ কামড় দিতে পত্রিকাগোষ্ঠী যা করলেন, তাও এক ইতিহাস তৈরি করল।

ওই পত্রিকার প্রচলিত প্রথা- পুস্তক সমালোচনার জন্য অনুরোধসহ বই ঐ পত্রিকায় দপ্তরে না পাঠালে আলোচিত হবার সুযোগ লাভ করে না। অবশ্য, অনুরোধসহ বই পাঠালেইযে পুস্তকটি আলোচিত হবে- এমনটি নয়। বরং অতি ক্ষুদ্র অংশের অনুরোধই রক্ষিত হয়। ওই পত্রিকার খাতায় আলোচনা লাভের সুযোগের জন্য ‘যুক্তিবাদ্দের চোখে নারীমুক্তি’ বইটির লেখক হিসেবে আমি মোটেই উৎসাহী ছিলাম না। সুতরাং বইটি আমি দিইনি এবং বইটির প্রকাশক আমার এই মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত থাকার দরুন কোনও পত্র-পত্রিকাতেই সমালোচনার জন্য আমার লেখা কোনও বই পাঠান না। এর এই বইটিও পাঠাননি। তা সত্ত্বেও সমস্ত ঐতিহ্য ও প্রথা ভঙ্গ করে ওই পত্রিকাগোষ্ঠী বইটির সমালোচনা প্রকাশ করলেন। প্রতিকাগোষ্ঠীর তীব্র বিপন্নতাবোধই যে এই ধরনের ইতিহাস তৈরিতে বাধ্য করেছিল- বইটি পড়লে এটুকু বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না।

বইটির সমালোচনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল আর এক ‘নারীবাদী’ বলে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী চিহ্নিত মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। যদিও বইটি পড়ে ইতিপূর্বে  প্রকাশ্যেই প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন মৈত্রেয়ী, তবুও নতুন দায়িত্ব পেয়ে তাঁর বীর বক্ষ একটুও কাঁপলো না। বরং বাবুদের তুষ্ট করতে সত্যি-মিথ্যের সীমারেখা ভেঙ্গে, আমার ওই বইয়ের কথা বলে এমন সব কথা লিখলেন, যেগুলো তিনি কোনও দিনই আমার বইটি খুঁজে দেখাতে পারবেন না। ‘দেখাতে যেতে বয়েই গেল, আমার দরকার বাবুদের তুষ্ট করা’ ভেবে মৈত্রেয়ী বইটির বিরুদ্ধে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করতে কুৎসা ছড়াতে সচেষ্ট হলেন, সেই সঙ্গে তিনি তীব্র ক্ষোভ সোচ্চারে প্রকাশ করলেন, বইটিতে “বারে বারে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীকে আক্রমণ” করায়।

মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় ও এই বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর ক্ষোভ আমাদের স্পষ্ট করে দেয়- আমরা ঠিক পথে এগুচ্ছি, ঠিক জায়গাতেই আঘাত দিচ্ছি, তাই সততা, নীতি, সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে ওরা পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টায় পাগল। বৃহৎ পত্রিকায় আমাদের আন্দোলনের খবরও নিশ্চয়ই প্রকাশিত হয়। এই খবর প্রকাশের দ্বারা আর কিছু না হোক, আমাদের আন্দোলনের গুরুত্ব ও শক্তি যে প্রমানিত হয়, সেটা সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা যায়। ‘কলম বেঁচে’ পত্রিকায় জায়গা পাওয়ার চেয়ে নীতি বজায় রেখে জায়গা পাওয়াটা যে ভাল, সেটা বুঝতে খুব একটা কান্ডজ্ঞানের প্রয়োজন হয় না।

আলোচনার জন্য অনুরোধসহ বইটি না পাঠানো সত্ত্বেও সমালোচনার নামে মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে একটি চিঠি পাঠাই আনন্দবাজারে। চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম রেজিস্ট্রি ডাকে। পাঠাবার তারিখ ৭.১০.১৯৯৪ কলকাতা পি. জি. ও থেকে। রেজিস্ট্রেশন নম্বর জি. ১২৮৮। ওরা যে চিঠি পেয়েছেন, তার প্রাপ্তিস্বীকারের কার্ডও পেয়ে গেছি। কিন্তু উত্তরটি ছাপা হয়নি। একচেটিয়া মিথ্যে ছাপাবার অধিকার ও ‘সত্য’-কে ‘ব্ল্যাক-আউট’ করার স্বাধীনতাই কি তবে ‘পত্রিকার স্বাধীনতা’ বলে বিবেচিত হবে? প্রিয় পাঠক-পাঠিকা সংবাদপত্রের এই তথাকথিত স্বাধীনতার স্বরূপকে চিনে আপনাদের নিতেই হবে। নতুবা এই স্বাধীনতা এমনি করেই বারবার প্রতিটি সৎ আন্দোলনকে, প্রতিটি অসাম্য বিরোধী সঠিক আন্দোলনকে ধ্বংস করতে গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসবে।

সমাজের সাংস্কৃতিক উপাদানের নিয়ন্তা ও তাদের দালালদের
মগজ-ধোলাইয়ের দু’চারটি উদাহরণ

আজকের সমাজ কাঠামোয় এ’দেশের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর একছত্র নিয়ন্তা ধনকুবেরগোষ্ঠী, তা সে বস্তুগত বা অবস্তুগত- যাই হোক না কেন।

সংস্কৃতির ‘বস্তুগত উপাদান’ কথার অর্থ- একটি মানবগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালীর সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুসমূহ। যেমন- ঝুপড়ি থেকে আকাশচুম্বী প্রাসাদ, গরুরগাড়ি থেকে মহাকাশযান, হাতপাখা থেকে এয়ার কন্ডিশনার, প্রদীপ থেকে জেবারেটার, টিনের চোঙ থেকে স্যাটেলাইট, ধুতি থেকে জিন্স, ছাতু থেকে শ্যাম্পেন, শিলনোড়া থেকে গ্রাইন্ডার, ঝাঁট থেকে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, আলপথ থেকে রেড-রেড, ফোঁড়া কাটার নরুন থেকে মাইক্রোসার্জারির যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সব কিছুই।

অবস্তুগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র, ধর্মগ্রন্থ থেকে যুক্তিবাদী গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা, প্রচারমাধ্যম হিসেবে লিফলেট থেকে স্টার-টিভি, অন্ধবিশ্বাস থেকে বিজ্ঞানমনস্কতা, পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা, আস্তিক্যবাদ থেকে নাস্তিক্যবাদ, ভাববাদ থেকে যক্তিবাদ, নীতিহীনতা থেকে নীতিবোধ, চাটুকারিতা থেকে ঠোঁটকাটা স্পষ্টবাদিতা, দ্বিচারিতা থেকে আপোষহীনতা ইত্যাদি সব কিছুই।

বস্তুগত এবং অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো নিয়েই একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, চলমান সংস্কৃতি।

এই বস্তুগত ও অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর নিয়ন্তা যে, ধনকুবেরগোষ্ঠী, এ-টুকু বুঝতে আপনার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টিভি, স্টার-টিভি, সিনেমা ইত্যাদি প্রচারমাধ্মগুলোর চিন্তার সর্বগ্রাসী প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ভোগ্যবস্তুর প্রতি ক্ষুধা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। সাহিত্য, সঙ্গীত, টিভি সিরিয়াল, সিনেমা, নাটক, যাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে স্বার্থান্ধ, ভোগসর্বস্ব উত্তেজক সংস্কৃতির গন্ধ তৈরি করে মানুষের চেতনায় পাঠানো হচ্ছে। একই সঙ্গে ‘ঈশ্বর’ জাতীয় সেরা গুজবের ঘাস-বিচুলিকে কুশলী হাতে পরিবেশন করে মানুষকে ‘হাম্বা’ রবের চতুষ্পদীতে পরিণত করা হচ্ছে ফলে তৈরি হচ্ছে নারী-পুরুষের পরস্পরকে ভোগ করার সংস্কৃতি, উচ্ছৃঙ্খলতার সংস্কৃতি, ধর্ষণের সংস্কৃতি, গুছিয়ে নেবার সংস্কৃতি, পেশীশক্তির সংস্কৃতি, ইভ-টিজারদের সংস্কৃতি, ব্লু-ফিল্মের সংস্কৃতি, ব্যবসায়ী-মন্ত্রী-আমলা-পুলিশের অশুভ চক্রের দেওয়া-নেওয়ার সংস্কৃতি। পর্ণো-পত্রিকা, সিনেমা পত্রিকা, সিনেমা ও টিভির বিজ্ঞাপনে শরীরকে অনাবৃত রাখার, যৌন আবেদনকে তীব্র করার যে অশুভ প্রতিযোগিতা- একে শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিকতার ফলে বলে চিহ্নিত করা যায় কি? যায় না। এঁরা কেউই বেঁচে থাকার তাগিদে দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হওয়া নারী নন। এঁরা সাধারণত আসেন উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে। এঁরা ক্ষুধার অনিবার্য ফল নন, অপসংস্কৃতির অনিবার্য ফসল- যে অপসংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্টশক্তি ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা।

ভোগবাদী ও ভাববাদী চিন্তার সাঁড়াশি আক্রমণের পরও অনেক সময় প্রতিবাদী মানুষের চিন্তা এক থেকে বহুকে উদ্দীপ্ত করতে থাকে। শুরু হয় প্রতিবাদী সংস্কৃতির বিজয় অভিযান। শোষক ও শাসককুলের অজানা নয়, এমন প্রতিবাদী সংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাদের সর্বনাশের বীজ। আর তাই প্রতিবাদী সংস্কৃতিকে,  সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রোখার মসৃণ কায়দা হিসেবেই হুজুরের দল, রাষ্ট্রশক্তি ও তাদের সহায়ক প্রচারমাধ্যমগুলো প্রচারের আলোকে তুলে আনে মেকি প্রতিবাদীদের। এইসব ভন্ড প্রতিবাদীরা চিন্তার প্রোটিনের ছদ্মবেশে চিন্তার বিনাশকারী ভাইরাস। একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলেই কিন্তু চেনা যায়। এইসব ভন্ড প্রতিবাদী শিল্পী, সাহিত্যিক, সঙ্গীতকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীদের স্পনসরের ভূমিকায় সর্বত্রই দেখবেন রয়েছে রাষ্ট্রশক্তি, ধনকূবের বণিকশ্রেণী বা প্রচারমাধ্যম- যার মালিক অবশ্যই বণিকশ্রেণী।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি ও প্রচার মাধ্যমগুলোর তুলে আনা এক-আধটি তথাকথিত প্রতিবাদী চরিত্রগুলোর প্রকৃত স্বরূপ একটি দেখি আসুন।

জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র) কে সংস্কার বিরোধী এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ‘প্রজেক্ট’ করার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষাভাষি পত্রিকা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের CSICOP নামক একটি তথাকথিত যুক্তিবাদী সংস্থার (যারা বিভিন্ন দেশের অসাম্যের সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থা বজায় রেখে অলৌকিক রহস্যের অনুসন্ধানকেই যুক্তিবাদী কাজ-কর্ম বলে মনে করেন) সহযোগী এক বাংলা মাসিক (যারা বর্তমানে গণবিজ্ঞান আন্দোলন নামক এক ধরনের বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং মানুষের মনের উৎসে একই সঙ্গে যুক্তিবাদ ও অধ্যাত্মবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে দারুণ সোচ্চার) পত্রিকা এবং পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় সরকার বাহাদুর। আমরা সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত সংবাদ সূত্র থেকে জেনেছি কলকাতার মাননীয় মেয়র মার্কসবাদী আন্দোলনের নেতা প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয় শ্রীসরকারের কুসংস্কার-বিরোধী সংগ্রামী প্রয়াসকে বাহবা দিয়ে সমস্ত রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

শ্রীসরকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। খুবই ভাল খবর। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি মানুষের যুদ্ধে নামা মানেই যেখানে সামান্য হলেও অগ্রগমন, সেখানে শ্রীসরকারের মত জনপ্রিয় মানুষটির অংশগ্রহণ তো একটা বড়-সড় অগ্রগতি। এবার একটু  খতিয়ে দেখা যায় শ্রীসরকারের যুদ্ধ-বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে? না, যাত্রার আসরে? হাতের তলোয়ার ইস্পাতের? না, টিনের?

শ্রীসরকার সত্যিই বেপরোয়া অকুতোভয় মানুষ। তিনি একই সঙ্গে ঘোষণা করেছেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, এবং সেই সঙ্গে সোচ্চারে ঘোষণা রেখেই চলেছেন- আত্মা, ভূত ও ঈশ্বরে তাঁর গভীর বিশ্বাসের কথা। যে কোন বিন্দুতে বিশ্বাস বা গভীর-বিশবাসযে কোনও মানুষের থাকতেই পারে, এবং থাকেও। আমার কাছে বিভিন্ন মানসিক-সমস্যা নিয়ে অনেকেই আসেন-টাসেন, যাদের এক একজন এক-এক রকম গভীর বিশ্বাস থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এঁদের কেউ ভাবেন তাঁর মাথার সমস্ত চিন্তাকে ধরে নিতে আমেরিকা নাকি আকাশে একটা উপগ্রহ ছেড়ে রেখেছে কেউ বা ভাবেন, তাঁর মাথার শক্তিকে কাজে লাগিয়েই এ’দেশের সরকার সমস্ত বিদ্যুৎ বানিয়ে নিচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু এমন প্রমাণহীন আত্মা- ভূত-ঈশ্বরের অস্তিত্বে গভীর বিশ্বাস রাখার জন্য শ্রীসরকারকে যখন কুসংস্কারের আচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা ছাড়া আরও কোনও উপায় নেই, তখন তাঁকে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী হিসেবে ‘প্রজেক্ট’ করা নিশ্চয়ই অসততা ও দুর্নীতি। প্রকৃত যুক্তিবাদী আন্দোলনের পাল থী হাওয়া কেড়ে নেবার প্রয়োজনীয়তাই প্রচারমাধ্যম ও সরকারের স্পর্ধা আকাশ ছুঁয়েছে। তিনি তাঁর বিশ্বাসের পাশাপাশি গর্বিত ঘোষণা রেখেছেন, আগামী দিনে আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরিষ্কার বিজ্ঞান বলে পরিচিত হবে।

সুমন চট্টোপাধ্যায় জনপ্রিয় গায়ক। প্রচার মাধ্যম তাঁকে ‘প্রগতিবাদী’ গায়ক হিসেবে প্রচার দিয়েছে এবং সে প্রচার বহুজনের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সুমন দিব্বি গাইছিলেন। ভালই গাইছিলেন। তারপর জনপ্রিয় হয়ে উঠতেই তাঁর ব্যাপার-স্যাপারই গেল পাল্টে। গানের ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চে দাঁড়িয়েই লুম্পেনকেও লজ্জা পাইয়ে দেওয়া ভাষায় নোংরা খিস্তি খেউড়ের এক নতুন সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টায় রত হলেন। সফলও হলেন। গানের আসরে (সময়ঃ সন্ধ্যা, ২১ মার্চ ৯৩ ; স্থানঃ কলকাতার নজরুল মঞ্চ) এক সাংবাদিককে ‘মাদার ফাকার’ অর্থাৎ ‘মা’কে সঙ্গমকারী’ বলে খিস্তি দিয়েও দর্শকদের কাছ থেকে পেলেন তীব্র ঘৃণার পরিবর্তে হাততালি। দর্শক-চিত্তে বিকৃত উত্তেজনার পরশ লাগানোর ফসলই এই হাততালি। প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, একবার গভীরভাবে ভাবুন- ‘সংস্কৃতির পীঠস্থান’ বলে পরিচিত কলকাতায় থাবা বসিয়েছে এ কোন চতুর শৃগাল ও লোভী নেকড়ে? একই অঙ্গে দুই রূপ। সুমনের খিস্তি-খেঁউড় এখানেই থেমে থাকেনি, বদ্ধ পচা জলার মত দুর্গন্ধ ছড়াতেই থাকে তাঁর রেওয়াজি খিস্তির দূষণ। এরপরও সুমন যখন গান ধরেন, “পাল্টে দেবার স্বপন আমার এখনও গেল না”, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, পাল্টে কোন সংস্কৃতি আনতে চান সুমনবাবু?

সুমনের এমন অশ্লীল সাংস্কৃতিক দূষণের বিরুদ্ধে, ভোগবাদী চিন্তার প্রসার প্রয়াশের বিরুদ্ধে একটি বাণিজ্যিক পত্রিকাও সোচ্চার হয়নি।

প্রতিবাদ আমাদের সমিতি করেছিল। অতীতে সুমন আমাদের কতটা প্রশংসা করেছেন, কতটা তোল্লাই দিয়েছেন, সেই সমস্ত আবেগ ও কৃতজ্ঞতাকে বিদায় করে দিয়ে সুমনের বর্তমান সুচতুর অবস্থান আমাদের দেশের সংস্কৃতির পক্ষে ক্ষতিকারক বিবেচনায় তাঁর কদর্য অশ্লীল ধ্বংসাত্মক শক্তির গতি রুদ্ধ করতে জনচেতনাকে সচেতন করতে সচেষ্ট হয়েছি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি- শেষ কথা বলেন জনগণ।

সুমনকে আমরা আরও নানা রূপে পেতে লাগলাম। ভোগবাদী সুমনের পাশাপাশি অধ্যাত্মবাদী চিন্তার প্রচারক হিসেবও সুমনকে আমরা পেলাম, তিনি গানের আসরে আত্মা নামাতে লাগলেন, ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের কথা বারবার গানের ফাঁকে ফাঁকে কথোপকথনের মাঝে মাঝে গুঁজে দিতে লাগলেন। দুর্নীতির সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ঘুষ নেওয়ার পক্ষে জেরালো বক্তব্য হাজির করলেন (বসুমতী ; ১৯৯৩-এর মহালয়ার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে)।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, একবার ভাবুন তো, ‘প্রতিবাদী’ সুমনের প্রতিবাদ কার বিরুদ্ধে? অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে? না কি, তাঁর প্রতিবাদের ভানগুলো আসলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কিছুটা হাওয়া কেড়ে নেওয়ার প্রয়োজনে? এই ভানের খোসা ছাড়ালে আমরা সেই সুমনকে পেয়ে যাব, যিনি চান, সামাজিক স্থিতাবস্থাকে জনগণ প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিন আবেগের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে।

যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে সিস্টেমের সহযোগী
পত্র-পত্রিকার উপদেশামৃত

সম্প্রতির আমরা কয়েকটি বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকাকে দেখতে পেলাম যুক্তিবাদী সমিতির কাজ-কর্ম কি হওয়া উচিৎ, কিভাবে হলে ভাল হয়, বিজ্ঞান আন্দোলনের সঠিক রূপ রেখা কি হওয়া উচিৎ, ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় পর্যন্ত প্রকাশ করতে। প্রবন্ধগুলির লেখকরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নামী-দামী।

প্রবন্ধগুলোতে প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা হয়েছে (এক) : বিজ্ঞান আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হওয়া উচিৎ বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধে পৌঁছে দেওয়া (প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, কাঁটায় কাঁটায় ঠিক এই সুরে, এই কথাই বলেন সরকারি সাহায্যপুষ্ট ও নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা হিসেবে গড়ে ওঠা প্রতিটি বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাই)।

(দুই) : ঈশ্বর বিশ্বাস, জ্যোতিষ বিশ্বাস জাতীয় মানুষের গভীর বিশ্বাসকে আঘাত দেওয়া অনুচিত (এ’বিষয়ে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড’- এর ভূমিকায় নামা CSICOP –এর লেজুড় ‘উৎস মানুষ’ও একই কথা বলে। ওদের অক্টোবর- নভেম্বর ১৯৯৪ সংখ্যায় ২৫৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে- ঈশ্বর বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলব না। “যেহেতু এই সংস্কার সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও অধ্যাত্মিক বোধ উন্মেষের কাজে সাহায্য করে, তাই এই সংস্কারকে আমরা কুসংস্কার বলব না”)।

(তিন) : বিজ্ঞান আন্দোলনের সঠিক প্রয়োগ হল- মডেল প্রদর্শনী, জমির উর্বরতা পরীক্ষায় সাহায্য, মৌমাছির চাষ ইত্যাদির ক্ষেত্রে জনগণের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া (অর্থাৎ সমাজের বর্তমান অবস্থার বিরুদ্ধে কোনও আঘাত না করে, তাকে টিকিয়ে রেখে সরাসরি প্রশাসনকে সাহায্যের মধ্যেই বিজ্ঞান আন্দোলনকে বন্দি করে রাখা। এমন আন্দোলনই করেন জনবিজ্ঞান ও গণবিজ্ঞান নামের সরকারি সাহায্যে হৃষ্টপুষ্ট ও প্রভাবে ক্ষীণ সংগঠনগুলো)।

(চার) : যারা বিজ্ঞান আন্দোলনের অর্থ করেছেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলন, যুক্তিবাদী আন্দোলন, তারা তাদের আন্দোলনকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে চান রাজনৈতিক দলগুলোর মত (অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা গড়তে, অর্থাৎ বর্তমান ‘সিস্টেম’ ভেঙ্গে নতুন ‘সিস্টেম’ গড়তে আমাদের যা যা প্রয়োজন হবে, তার জন্য রাস্তায় নামতে হয়, রান্নাঘরে ঢুকতে হয়, এবং শেষ পরিণতিতে যদি প্রাণও দিতে হয়, তাও আমরা দেব। নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোর মত বর্তমান সমাজ কাঠামো জিইরে রেখে আখের গোছাতে আমরা আসিনি, আমরা এসেছি ভাঙ্গা ও গড়ার এই খেলায় জীবনটুকুকে পর্যন্ত ‘বাজি’ রেখে শেষ লক্ষ্যে পৌঁছতে। এই আন্দোলন, আমাদের কাছে আনন্দের উৎসব, তাই তো, একটা লেখা প্রকাশ না করলে বর্তমান বাজার দরে কোটি টাকার উৎকোচ দেবার প্রস্তাব হেলায় ঠেলতে পারি আমরাই। এই ঘটনার ঐতিহাসিক পূর্ণ বিবরণ রয়েছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে, বারবার হত্যার হুমকি ও আক্রমণ মুখোমুখি হই আমরাই।

(পাঁচ) : যুক্তিবাদী সমিতির উচিৎ অধ্যাত্মবাদ ও ধর্মকে আঘাত না দিয়ে জনসেবায় নিজেদের শক্তিকে ব্যয় করা, যেমন সেবার কাজ করে থাকেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো (আমরাই তো জনগণের প্রকৃত সেবা করি, কারণ আমরা চাই শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা। আর সেই লক্ষ্যেই তো আমাদের প্রতিটি কাজ-কর্ম। কুসংস্কার মুক্তির কাজের পাশাপাশি নিপীড়িতদের আইনি সাহায্যও তো ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ ও ;মানবতাবাদী সমিতি’ নামের আমাদের এই সংগঠন দুটি দিয়ে থাকে। এরই পাশাপাশি আমাদের এই দুটি সংগঠন রক্তদান, মরণোত্তর দেহদান, ফ্রি কোচিং সেন্টার, বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদিও করে থাকে। আরও বহু সংগঠনই সেবামূলক কাজ-কর্ম করে থাকেন। তাঁদের এইসব কাজ-কর্মের প্রতি পূর্ণ-সম্মান জানিয়েও বলতেই হয়, শেষ পর্যন্ত সেবা শোষিত জনতার শোষণমুক্তি ঘটাতে পারে না। শোষণমুক্তি ঘটাবার প্রাথমিক ও আবশ্যিক ধাপ অবশ্যই যুক্তির আলোকে সমাজসেবা বোধ। হাজারটা রামকৃষ্ণ মিশন, হাজারটা ভারত সেবাশ্রম সংঘ, হাজার মাদার টেরিজা ভারতের শোষিত জনতার শোষণমুক্তি ঘটাতে পারবে না। বরং এইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবা পারবে জনসেবার আবেগে সিক্ত, কৃতার্থ জনগণের হৃদয়ে ধর্মীয় কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ, কর্মফল ইত্যাদি ভ্রান্ত চিন্তা ঢুকিয়ে দিতে, যেগুলো শেষ পর্যন্ত সাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ নিপীড়িত জনগণকে সাহায্যের নামে, শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী করতে শোষক ও শাসকগোষ্ঠীকেই ওরা সাহায্য করে। অনেক সময় শাসক ও শোষণগোষ্ঠী এবং বিদেশী ধনকুবেরদের বিপুল অর্থ সাহায্যও বিভিন্ন সেবামূলক কাজ-কর্মের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। জনসেবার আড়ালে এরা সেবা করে শোষক ও  শাসকশ্রেণীরই এবং ভর্তি করে নিজের পকেট।

(ছয়) : সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী জিজ্ঞাসা জুড়েছেন, মুক্ত বাণিজ্য ও মুক্ত সংস্কৃতির খোলা হওয়া যখন সমস্ত মানুষ, সংগঠন ও দেশ গ্রহণ করেছে, তখনও যুক্তিবাদীরা কেন নমনীয় না হয়ে কেতুহীন কট্টর ! (আসলে যুক্তিবাদীরাই সবচেয়ে নমনীয়। যেখানে যুক্তি, সেখানেই যুক্তিবাদীরা নতজানু। কাল পর্যন্ত তথ্য, প্রমাণের ভিত্তিতে জানা যে বিষয়কে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গ্রহণ করেছিলেন, আজ এই মুহূর্তে সেই তথ্য প্রমাণকে অসম্পূর্ণ বলে বাতিল করে দিয়ে অন্য কোনও তথ্য যদি প্রমাণসহ হাজির হয়, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষরা নিশ্চয়ই তা গ্রহণ করবেন। যুক্তিবাদীদের কট্টরতা, অনমনীয়তা তাদের আদর্শের প্রতি। মুক্ত বাণিজ্য, মুক্ত সংস্কৃতি, কাদের স্বার্থে বাণিজ্য? কাদের স্বার্থে সংস্কৃতি? এ’সব না জেনে মুক্তকচ্ছ হওয়াটা শুধুমাত্র যুক্তিহীনই নয়, নির্বুদ্ধিতারও পরিচয়)।

হ্যালডেন-সত্যেন্দ্রনাথ-রাহুল সাংকৃত্যায়নকে
সিস্টেমের স্বার্থে কাজে লাগাবার চেষ্টা

সম্প্রতি প্রচার মাধ্যমগুলোর কল্যাণে আমরা এক নিশ্বাসে জেনে ফেলেছি তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও ‘যুক্তিবাদী’ ব্যক্তিত্বের জন্মশতবর্ষ পালনের নানা খবর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেই এই তিন বিজ্ঞানীর নানা কাজকর্ম নিয়ে, তাঁদের নানা চিন্তাকে নিয়ে, তাঁদের যুক্তি-মনস্কতাকে নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে এবং হয়ে চলেছে নানা প্রবন্ধ। এঁরা হলেন, প্রশান্ত মহলানবিশ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং জে. বি. এস. হ্যালডেন।

এই তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের জন্মশতবর্ষ মহাসাড়ম্বরে পালনে মেতেছেন আমাদের রাজ্য সরকার এবং তৎসহ বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন ও বিজ্ঞান পত্রিকা। এদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করলে সরকারি অর্থ সাহায্যও মিলছে। একটা লক্ষণীয় বিষয় প্রত্যেকেই এঁদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এমনভাবে প্রজেক্ট করছেন যেন এই তিন বিজ্ঞানী বিজ্ঞান আন্দোলন বা যুক্তিমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মহান নাম। এঁরা বাস্তবিকই যদি আন্তরিকতার সঙ্গে, প্রত্যয়ের সঙ্গে মনে করতেন- যুক্তি দিয়ে বিচার করে শুধুমাত্র তারপরই গ্রহণ বা বর্জন করা উচিৎ- তবে এভাবে প্রজেক্ট করা থেকে নিশ্চয়ই বিরত থাকতেন।

প্রশান্ত মহলানবিশ ‘নিষ্ঠাবান’ ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বা পরমপিতায় বিশ্বাসী। আবার ব্রাহ্মধর্ম প্রেতচর্চা ও প্ল্যানচেটে বিশ্বাসী না হলেও প্রশান্ত মহালানবিশ বিশ্বাসী ছিলেন এবং প্ল্যানচেটের আসরে উপস্থিতও থাকতেন। হাতের কাছে প্রমাণ পেতে রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা রবীন্দ্র-জীবনী গ্রন্থ আগ্রহী পাঠক-পাঠিকারা নেড়ে-চেড়ে দেখতে পারেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঈশ্বরে ও অলৌকিকত্বে পরম বিশ্বাসী ছিলেন। অএঙ্ক অলৌকিকবাবাদের চরণে মাথা ঠেকাতে তিনি যেতেন। সে’সব তাঁর ছাত্র-ছাত্রী বহু বিজ্ঞানীদেরই অজানা হয়। কিছু কিছু অলৌকিকবাবারা সত্যেন্দ্রনাথ বাসুর ভক্তি গদগদ সার্টিফিকেট ও ছবি নিজেদের প্রচারমূলক বইতে ছেপে থাকেন।

জে. বি. এস. হ্যালডেন সম্পর্কে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যা বলা হয় তা হল- “হ্যালডেন শুধুমাত্র একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী সামাজিক দায়বদ্ধ এক মহান পুরুষ। সমাজতন্ত্রের প্রতি আম্রণ তাঁর আস্থা ছিল।“ … একদিকে বিজ্ঞানের গবেষণা অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানের শিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়া, এই ছিল তাঁর আদর্শ।“ (কথাগুলো হ্যালডেনের The Inequality of Man and other Essays” নামের প্রবন্ধ সংকলন থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ ‘মানুষের বিভিন্নতা’য় প্রকাশিত প্রকাশকের নিবেদন’-এর অংশ বিশেষ) যে কলম থেকে উৎসারিত হয় হ্যালডেনের ই. এস. পি. ও টেলিপ্যাথি বিশ্বাসে আমরণ আস্থার কথা, সেই কলমই কিন্তু হ্যালডেনের নিজের কথায়, “আমি বুঝি না যে একজন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কেন পূর্বসিদ্ধভাবে টেলিপ্যাথি বা আলোকদৃষ্টির ঘটনা বলে যা দাবি করা হয় সেগুলির সম্ভাবনা অস্বীকার করবেন। আমি নিঃসন্দেহে যেসব ঘটনার কথা বলা হয় সেগুলোর অধিকাংশ সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে প্রতারণার ঘটনা।“ [The Marxist Philosophy and the Sciences গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ‘বিজ্ঞান ও মার্কসীয়দর্শন ; জে. বি. এস. হ্যালডেন। প্রকাশক চিরায়ত প্রকাশন, ; ১৯৯০ ; পৃষ্ঠা- ১০৭]

অর্থাৎ হ্যালডেন বস্তুবাদীদের টেলিপ্যাথিসহ বিভিন্ন অতীন্দ্রিয় ব্যাপার-স্যাপার না মানায় যথেষ্টই বিস্মিত এবং কিছুটা ক্ষুব্ধও। তাঁর মতে এ’সব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণা হতে পারে, কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। কি সর্বনাশ ! হ্যালডেন একই সঙ্গে মার্কসবাদ ও অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাস রেখেছিলেন, এই বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেছিলেন।

হ্যালডেনকে আরও একটু নেড়ে-চেড়ে দেখলে আশা করি আরও কিছু বিস্মিত হওয়ার খোরাক আমরা পার। হ্যালডেন দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, “মন হল দেহের একটি দিক এবং দেহ ছাড়া মন থাকে একথা মনে করবার পক্ষে কোনও যুক্তি নেই।“ আবার সেই সঙ্গে এও মনে করতেন, “মনের প্রকৃতি যদি শরীরের প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত হয় তার অনুসিদ্ধান্ত হবে প্রত্যেক ধরনের মানবমন ইতিপূর্বে অনন্তবার সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। শরীর যদি মনের নিয়ামক হয় তাহলে বস্তুবাদ অনন্তজীবনের ধারণা থেকে বিশেষ কিছু পৃথক নয়। আমার নিজের মন বা আত্মার অনুরূপ মন বা আত্মা অনন্তকাল ছিল এবং ভবিষ্যতেও অনন্তকাল ধরে থাকবে।“ [মানুষের বিভিন্নতা, হ্যাল্ডেন ; চিরায়ত প্রকাশন ; ১৯৯৩, পৃষ্ঠা- ৭৭]

হ্যাল্ডেনের এই অমর মন ও অনন্তবার সৃষ্টিতত্ত্ব (যা জন্মান্তরজাতীয় চিন্তা মাত্র) কোনও পরিপ্রেক্ষিত-বিছিন্ন চিন্তা নয়। বরং স্পষ্টতই এই উক্তি তাঁর মূল চিন্তাধারার সঙ্গে অতিমাত্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ।

হ্যাল্ডেনকে যখন বিভিন্ন মহল থেকে ‘বস্তুবাদী’ বলে প্রচার করা হচ্ছে, তখন হ্যাল্ডেনের লেখায় আমরা পাচ্ছি, “আমি নিজে বস্তুবাদী নই, কারণ বস্তুবাদ যদি সত্য হয় তাহলে আমার ধারণা আমরা জানতে পারি না যে সেটা সত্যি। আমার মতামতগুলি যদি আমার মস্তিষ্কের মধ্যে চলতে থাকা রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে হয় তাহলে সেগুলি নির্ধারিত হয় রসায়নের নিয়মে, যুক্তিশাস্ত্রের নিয়মে নয়।“ [মানুষের বিভিন্নতা, হ্যাল্ডেন, পৃষ্ঠা-৬৮] এর পরেও হ্যাল্ডেনকে বস্তুবাদী, মহান মার্কসবাদী বলে প্রজেক্ট করা কি নীতিগর্হিত নয়? মিথ্যাচারিতা নয়? উদ্দেশ্যমূলকভাবে বস্তুবাদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের মেলবন্ধনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নয়?

রাহুল সাংকৃত্যায়নের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনে এগিয়ে এসেছে বহু সংগঠন, প্রধানত বাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করা সংগঠনগুলো। রাহুল সাংকৃত্যায়নকেও একইভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, ‘মার্কসবাদী’ ‘বস্তুবাদী’ ইত্যাদি বলে। এ কথাও ঠিক, রাহুল সাংকৃত্যায়ন ভারতীয় দর্শনে ও মার্কসীয় দর্শনে সুপণ্ডিত। কিন্তু কেউ কোনও বিষয়ে সুপণ্ডিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে সে সেই বিষয়ে আস্থাশীল। ধনবাদী আমেরিকার রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ অনেক বুদ্ধিজীবীই মার্কসবাদে সুপণ্ডিত। এই পান্ডিত্য তাঁরা মার্কসবাদকে উৎখাত করার কাজেই নিয়োজিত করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মার্কসবাদে পান্ডিত্যকে যারা মার্কসীয় দর্শনের প্রতি ও বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি গভীর আস্থার নিদর্শন বলে মনে করেন, তাঁরা হয় এটা ভুলে যান, নতুবা ভুলে থাকতে চান যে রাহুল বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মে আস্থাশীল ছিলেন। রাহুল একই সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনে আস্থাশীল এবং বৌদ্ধদর্শনে আস্থাশীল- এটা হয় কি করে? আমার মাথায় ঢোকে না। কারণ বৌদ্ধদর্শনে অতি স্পষ্টতই অ-বস্তুবাদী দর্শন।

আজ ভেবে দেখার সময় হয়েছে- কেন এই সমাজ ব্যবস্থার সহায়ক প্রচার মাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমগুলোর বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা এমন কিছু চরিত্রকে ‘আদর্শ’ হিসেবে জনসাধারণের কাছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে তুলে ধরছেন, যারা একই সঙ্গে ‘বিজ্ঞানী ও অধ্যাত্মবাদী’, ‘বিজ্ঞান-আন্দোলক ও অধ্যাত্মবাদী’, ‘বস্তুবাদী ও অধ্যাত্মবাদী’ ইত্যাদি ! আমরা নিশ্চয়ই এইসব বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের মূলগতভাবে অশ্রদ্ধেয় মনে করি না, বা অধ্যাত্মবাদী সংস্কৃতি প্রচারের ষড়যন্ত্রের অংশীদার বলেও মনে করি না। বরঞ্চ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের কাজ-শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার ও স্মরণ করাই একজন যুক্তিবাদীর পক্ষে উচিৎ বলে মনে করি। কিন্তু তাঁদের যা যা সীমাবদ্ধতা (এবং আমরা দেখলাম, যেগুলো প্রত্যেকটাই মারাত্মক) সেগুলোকে পাশে সরিয়ে রেখে তাঁদেরকে একতরফাভাবে ‘মুক্তবাদী’, ‘বিজ্ঞানমনস্ক’, ‘সমাজসচেতন’ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে ভক্তিগদগদ প্রচারের কারণ কি হতে পারে? এই ধরণের প্রচারের ফলে সমাজ সম্পর্কে স্বচ্ছ-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে যেমন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে, তেমনই নির্বিচারে ব্যক্তিপুজোর মইতে চড়ে ঐ সীমাবদ্ধতাগুলোই চরম যুক্তিবাদীতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার নিদর্শন হিসেবে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবে। ফলে যুক্তিবাদী ধ্যানধারণা তথা আন্দোলন তাতে করে পিছিয়ে যাবে হাজার বছর। কেন এই অসুস্থ প্রবণতা? এই অসুস্থ প্রবণতা কি সমাজ-বিচ্ছিন্ন ঘটনা? অস্বচ্ছ চিন্তার ফসল? নাকি বৃহত্তর কোনও সুগভীর চক্রান্ত বা পরিকল্পনারই অঙ্গ? ‘ব্রেন-ওয়্যার’ বা চিন্তা-যুদ্ধের সাহায্যে সাম্য-চিন্তাকে নিঃশব্দে ধ্বংস করার যে স্বপন দেখতে শুরু করেছে ধনবাদী দেশের বিত্তবানেরা, এইসব অসুস্থ চিন্তার বপন কি সেই স্বপ্নেরই ফলশ্রুতি নয়? যুক্তিবাদী দর্শনকে আটকাতেই কি এমন বিভ্রান্তিতে ভরা চরিত্রগুলোকে ‘মহান’, ‘যুক্তিবাদী’, ‘বস্তুবাদী’ ইত্যাদি বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করার চেষ্টা হচ্ছে না? ভাববার সময় এসেছে বন্ধু। শত্রুর শক্তিকে হালকা ভাবে না নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময়।

শুধু অতীতে চরিত্রগুলোকেই এভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে না, বর্তমান সময়ের একই অঙ্গে যুক্তিবাদী ও অধ্যাত্মবাদী’, ‘ঈশ্বরেরবিশ্বাসী যুক্তিবাদী’, ‘ভূত বিশ্বাসী যুক্তিবাদী’, ‘জ্যোতিষে বিশ্বাসী যুক্তিবাদী’, ‘ঘুষের দুর্নীতিতে বিশ্বাসী প্রতিবাদী’, ‘পুরুষকে ঘৃণা করা মানবতাবাদী’ ইত্যাদির উপর প্রচারের আলো ফেলা হচ্ছে- এটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। (এক্ষুনি কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন- আপনারও তো প্রচার চান ! উত্তরে বলব- নিশ্চয়ই চাই। ত্বে তা আদর্শের প্রচার ; আমাদের মতাদর্শের প্রচার। এবার কেউ কেউ বলবেন- আপনারা প্রচার তো পানও ! উত্তরে বলবো, আদর্শ বেঁচে, দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতাসর্বস্ব শ্রেণীর তাঁবেদারি করার সুবাদে প্রচারের আলোয় থাকার চেয়ে আদর্শ না বেঁচে প্রচার পাওয়া যেমন অতি কঠিন, তেমনই অতি উত্তম। আমরা বার-বার এই কঠিন পথ ধরেই প্রচারের ছিটেফোঁটা পেয়েছি। আদর্শে আপোষহীন থাকার পরও আমাদের খবর প্রচার-মাধ্যমগুলো যখন প্রচার করে, তখন তার মধ্য দিয়ে আমাদের আন্দোলনের গুরুত্ব ও শক্তি যে প্রমাণিত হয়, সেটা যে কেউ বুঝবেন।) প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, বানভাসি আবেগ ও নির্বিচার ভালোবাসা, ব্যক্তিশ্রদ্ধা ইত্যাদিকে বিদায় দিয়ে শাণিত যুক্তির নিরিখে বিষয়টিকে আগাপাশতলা বিশ্লেষণ করুন।

দূরদর্শন-বেতার-পত্রপত্রিকা-জুনিয়র-মৈত্রেয়ী-সুমন-বিজ্ঞানমঞ্চ-গণবিজ্ঞান-পথ নাটিকার নামে প্যান্ট খুলে বাস্তবানুগ ধর্ষণ দৃশ্য-যুক্তিবাদী হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ-হ্যাল্ডেন-রাহুল সাংকৃত্যায়ন তুলে আনা-বুদ্ধ দর্শনকে প্রগতিশীল দর্শন বলে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা (যে দর্শন অবশ্যই বস্তুবাদী দর্শনের বিরোধী, সাম্যের সমাজের বিরোধী। এই প্রসঙ্গ নিয়ে ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ গ্রন্থের পরবর্তী ‘ধর্ম’ খন্ডে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব) –এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজ কাঠামোকে পালন ও পুষ্ট করার প্রয়োজনেই নানাভাবে, নানারূপে এঁদের হাজির করে চলেছে প্রচার মাধ্যমগুলো।

error: Content is protected !!